- নিরাপদ সড়ক আন্দোলন
- যেসব স্থানে মামলা হয়েছে, সেখানে সহিংসতা ছিল না
- মামলায় কয়েক হাজার অজ্ঞাত ব্যক্তি আসামি
- বিরোধীদের অভিযোগ, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই মামলা
হবিগঞ্জ সদর মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নাজমুল ইসলাম ১২ আগস্ট নিজের থানায় একটি মামলা করেছেন। আসামি ৭০ থেকে ৮০ জন, সবাই অজ্ঞাত। অভিযোগ হচ্ছে, গত ৩০ জুলাই হবিগঞ্জ শহরের জে কে অ্যান্ড হাইস্কুলের সামনে আসামিরা সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, যানবাহন ও সরকারি সম্পত্তির ক্ষতিসাধন এবং সরকারকে উৎখাত করার চেষ্টা করেছে।
যে সময় এই মামলা হয়েছে, একই সময় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে নিরাপদ সড়কের দাবিতে পথে নেমেছিল শিক্ষার্থীরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ৩০ জুলাই হবিগঞ্জ শহরে এ রকম কিছুই ঘটেনি। এমনকি নিরাপদ সড়কের দাবি নিয়ে হবিগঞ্জে কেউ রাস্তায়ও নামেনি। তারপরও হবিগঞ্জ শহর ও জেলায় চারটি থানায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে বিশেষ ক্ষমতা আইনে ১০টি মামলা করে রেখেছে পুলিশ।
শুধু হবিগঞ্জ নয়, শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় নাশকতার অভিযোগ এনে আরও কয়েকটি জেলায় এমন আরও ‘ভুতুড়ে’ মামলা করে রেখেছে পুলিশ। মাঠপর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘ওপরের নির্দেশে’ এসব মামলা হয়েছে।
রাজনৈতিক দলের স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা বলছেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানি করতেই থানায় থানায় গোপনে এভাবে মামলা করে রাখা হয়েছে, যাতে নির্বাচনের আগে-পরে প্রতিপক্ষের লোকজনকে এসব মামলায় ফাঁসানো যায়।
ঘটনা ছাড়া এভাবে মামলা করা যায় কি না—জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি সরকারের নজরে আনার সুযোগ আছে। তদন্ত হোক, যদি মামলা করার মতো উপাদান না থাকে, তাহলে মামলা চলবে না।
মামলা দেশজুড়ে
পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্রগুলো বলছে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ঘটনায় দায়ের করা মামলার বিষয়ে তথ্য চেয়ে সদর দপ্তর থেকে সারা দেশে পুলিশ সুপারদের কাছে গত ৮ আগস্ট থেকে দুটি করে চিঠি পাঠানো শুরু হয়। এর একটি চিঠিতে বলা হয়, ২৯ জুলাই থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত যত মামলা হয়েছে, সেসব মামলার তথ্য সদর দপ্তরকে জানাতে হবে। দ্বিতীয় চিঠিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাঁরা পোস্ট দিয়েছেন, তাঁদের কতজনকে শনাক্ত করা হয়েছে, আর শনাক্তের পর তাঁদের কতজনের বিরুদ্ধে কী ধরনের আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জানাতে বলা হয়।
এ ব্যাপারে তথ্য চেয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে যোগাযোগ করা হলে কর্মকর্তারা জানান, এখন পর্যন্ত সারা দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ঘটনায় পাওয়া মামলার মধ্যে রয়েছে ঢাকা মহানগরে ৪৩টি, সিলেট অঞ্চলে ৩৭, চট্টগ্রাম অঞ্চলে ১৭, ময়মনসিংহ অঞ্চলে ১১টি, বরিশালে ২টি এবং রাজশাহী মহানগর ও রংপুর অঞ্চলে একটি করে মামলা। তবে এই হিসাব চূড়ান্ত নয়।
সিলেটে ৩৭ মামলা
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় সিলেট রেঞ্জে ৩৭টি মামলা হয়েছে। সিলেট মহানগরের ছয় থানা এলাকায়কোনো সহিংস ঘটনা ঘটেনি। তারপরও সিলেট মহানগরের দক্ষিণ সুরমা, শাহপরান থানা ও কোতোয়ালি থানায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করা করেছে। মামলায় কোনো আসামির নাম উল্লেখ করা হয়নি। অভিযোগ করা হয়েছে, যান চলাচল ও সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সিলেট কোতোয়ালি থানা এলাকার চৌহাট্টা মোড়ে জমায়েত হয়ে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবি জানিয়েছে। সেখানে কোনো সহিংস ঘটনা ঘটেনি। তবে শিক্ষার্থীরা চৌহাট্টা মোড়ে অবস্থানের সময় যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল।
দক্ষিণ সুরমা থানা এলাকায় পড়েছে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক। ওই এলাকায় শিক্ষার্থীদের কোনো কর্মসূচি হয়নি, এরপরও মামলা হলো কেন-জানতে চাইলে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খায়রুল ফজল প্রথম আলোকে বলেন, যানবাহন চলাচলে বাধা দেওয়ায় মামলা করা হয়েছে। শাহপরান থানার ওসি আখতার হোসেনও একই ধরনের মন্তব্য করেন।
কোতোয়ালি থানার ওসি মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, চৌহাট্টায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালে একটি গাড়িতে ঢিল ছোড়া হয়েছিল। এ ঘটনায় মামলা করা হয়েছে।
হবিগঞ্জ জেলায় নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের ঘটনায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে ১০টি মামলা হয়েছে। তার মধ্যে হবিগঞ্জ সদর মডেল থানায় চারটি, চুনারুঘাট থানায় দুটি, মাধবপুর থানায় একটি, বাহুবল থানায় একটি, নবীগঞ্জ থানায় একটি এবং বানিয়াচং থানায় একটি মামলা। সব মামলায়ই অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করা হয়।
হবিগঞ্জ সদর মডেল থানায় ১২ আগস্ট এসআই নাজমুল ইসলামের দায়ের করা মামলায় বলা হয়, ‘গত ৩০ জুলাই হবিগঞ্জ শহরের জে কে অ্যান্ড হাইস্কুলের সামনে ৭০ থেকে ৮০ জন দুষ্কৃতকারী সমবেত হয়ে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, যানবাহন, যন্ত্রপাতি, সরকারি সম্পত্তিসহ সর্বসাধারণের জনপথের কর্মক্ষমতা ব্যাহত করা, রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি করা এবং সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা ও সহায়তা করার অপরাধ সংঘটিত করেছে।’ একই দিন একই থানার এসআই আবদুর রহিম বাদী হয়ে ৫০ থেকে ৬০ জনকে আসামি করে আরেকটি মামলা করেন। মামলায় অভিযোগ করা হয়, গত ৩১ জুলাই হবিগঞ্জ শহরের বৃন্দাবন কলেজের সামনে দুষ্কৃতকারীরা সমবেত হয়ে ‘সন্ত্রাসী কার্যকলাপ’ করেছে। ওই দিনই এসআই জহির আলী বাদী হয়ে ১০০ থেকে ১২০ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে আরেকটি মামলা করেন। অভিযোগ হচ্ছে, ২ আগস্ট হবিগঞ্জ শহরের এম সাইফুর রহমান টাউন হলের সামনে দুষ্কৃতকারীরা সমবেত হয়ে ‘সন্ত্রাসী কার্যকলাপ’ করেছে।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে হবিগঞ্জে কোনো শিক্ষার্থী রাস্তায় না নামা সত্ত্বেও কেন ১০টি মামলা হলো-জানতে চাইলে জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) বিধান ত্রিপুরা বলেন, ‘কারও নামে মামলাগুলো হয়নি। ওই আন্দোলনের সময় এবং পরে অনেক কিছুই ঘটেছে, যা জনগণের জানা নেই। সবার কাছে বিষয়গুলো সাদা মনে হলেও এর অন্তরালে অনেক কিছুই ঘটতে পারত। যে কারণে পুলিশ বাদী হয়ে এ মামলাগুলো করেছে।’
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মৌলভীবাজার সদরে একদিন একটি গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছিল। এর বাইরে উপজেলায় ছোটখাটো মিছিল হলেও কোনো সহিংস ঘটনা ঘটেনি। তারপরও বিভিন্ন থানায় ১২টি মামলা হয়েছে। এসব মামলার মধ্যে মৌলভীবাজার মডেল থানায় তিনটি, শ্রীমঙ্গল, রাজনগর, কুলাউড়া ও বড়লেখায় দুটি করে এবং জুড়ী থানায় একটি মামলা হয়েছে। জেলার পুলিশ সুপার শাহ জালাল এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছোটখাটো বিষয় নিয়ে এসব মামলা হয়েছে। তবে কাউকে তো আসামি করা হয়নি। তদন্তে যা পাওয়া যায়, সেটাই করা হবে।’
চট্টগ্রাম রেঞ্জে ১৫ মামলা
চট্টগ্রাম শহরের বাইরে কোথাও আন্দোলন না হলেও চট্টগ্রাম জেলার ১৫টি থানায় একটি করে মামলা হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ৬ আগস্ট সকালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ছোট কমলদহ এলাকায় একটি পিকআপ ভ্যান ভাঙচুরের অভিযোগ এনে অজ্ঞাতনামা ৭০-৭৫ জনকে আসামি করে মিরসরাই থানায় একটি মামলা করে পুলিশ।
তবে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল কবির ফিরোজ প্রথম আলোকে বলেন, গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে-এমন কোনো ঘটনা তাঁর জানা নেই। তবু কেন মামলা-জানতে চাইলে মিরসরাই থানার ওসি সাইরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সরকার-সমর্থক ছাত্র ও যুব সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বাধায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে কুমিল্লায় কেউ রাস্তায় নামতে পারেনি। তারপরও ৫ আগস্ট আন্দোলনে উসকানির অভিযোগে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ মডেল থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করে পুলিশ। মামলায় কুমিল্লার বিএনপি, জামায়াত, যুবদল ও ছাত্রদলের কিছু নেতা-কর্মী এবং একাধিক কাউন্সিলরকে আসামি করা হয়। মামলায় উসকানি ও ছাত্র আন্দোলন ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে সরকার পতন এবং রাষ্ট্রবিরোধী কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে।
ওই মামলায় কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বিএনপি নেতা সিদ্দিকুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে এক দিন করে রিমান্ডেও নিয়েছে পুলিশ। সিদ্দিকুরের ছেলে মিলহানুর রহমান ওরফে নাওমিকে বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর সঙ্গে ফোনালাপে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল।
জানতে চাইলে মানবাধিকারকর্মী নূর খান প্রথম আলোকে বলেন, ভুয়া অভিযোগে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের নামে এভাবে মামলা করার অর্থ হলো প্রতিপক্ষকে চাপে রাখা, আর সুযোগমতো তাদের ঘায়েল করা। আজকে যাঁরা এটা করছেন, হয়তো তাঁরাও একদিন এর শিকার হতে পারেন।
- কার্টসিঃ প্রথম আলো/ সেপ্টেম্বর ৫,২০১৮