Search

Saturday, February 20, 2021

দুর্নীতিতে পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন বলছি

 — ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা


রাজনৈতিক বাকযুদ্ধে কিছু কথা এতবার এতভাবে বলা হয়েছে যে সেগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলার কথা এখন আর কেউ চিন্তাও করেনা। রাজনীতির মাঠে আওয়ামেলীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি’কে ঘায়েল করার জন্য গত এক যুগের বেশি সময় ধরে ব্যবহৃত সবচেয়ে ধারালো অস্ত্র ছিল সম্ভবত যে কোনো প্রসঙ্গে বলা – বিএনপি তার শাসন আমলে দুর্নীতিতে ৫ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। ব্যাংক কেলেঙ্কারি,  শেয়ার বাজার লুট কিংবা কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডাকাতি থেকে শুরু করে ৩৭ লাখ টাকার পর্দা, ১০ হাজার টাকার বটি মার্কা প্রকল্প-দুর্নীতি কিংবা বিদ্যুৎ খাতের মত হরিলুট নিয়ে যখনই প্রশ্ন তোলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ এক বাক্যে উত্তর দিয়েছে এসব বিষয়ে প্রশ্ন তোলা ৫ বারের দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়নের মুখে মানায় না। এমনকি তথাকথিত শুদ্ধি অভিযানে যখন আওয়ামী লীগের অঙ্গ-সংগঠনের দ্বিতীয়/তৃতীয় সারির নেতার ঘরে শত কোটি টাকার কাগজ, ঢাকায় শতাধিক ফ্ল্যাট/বাড়ির খবর পাওয়া গেছে তখনও সেটা নিয়ে টু শব্দটি করার আগেই বলা হয়েছে চোর ধরতে গিয়ে আমরাই চোর হয়ে গেলাম।   


বাংলাদেশ দুর্নীতিতে প্রথম বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হবার ‘গৌরব’ অর্জন করে ২০০১ সালে। ২০০১ সালে অষ্টম সংসদ নির্বাচনটি হয়েছিল বছরের শেষের দিকে, অক্টোবর মাসে। ওই বছরের প্রায় পুরোটা সময় ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। তাই বাংলাদেশের ওই বছরের আমলনামার পেছনে একমাত্র ভূমিকা ছিল আওয়ামী লীগের। বছরের শেষের দিকের তিন মাস তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল ক্ষমতায়। বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক ধরণের সরকারগুলোর সময় দুর্নীতির প্রকোপ অনেক কম থাকে, কিন্তু এর আগেই আওয়ামী লীগ এত ভয়ঙ্কর পরিমাণ দুর্নীতি করেছে যে, বাংলাদেশের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়া তাতে ঠেকে থাকেনি।  

 

দুর্নীতির এই ‘গৌরব’ বিএনপি’র ওপর আরোপিত হয় কারণ ২০০১ সালের রিপোর্টটি প্রকাশিত হয় ২০০২ সা্লে, বিএনপি’র শাসন আমলের প্রথম বছর। এই বছর, ২০২১ সালে ঠিক যেমন প্রকাশিত হয়েছে ২০২০ সালের রিপোর্ট। আওয়ামী লীগের সৌভাগ্য যে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল যখন বাংলাদেশকে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করে তখন মাত্রই জনগণের ভোটে ভূমিধস বিজয় নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসে বিএনপি।  



আওয়ামী লীগ যখন ২০০১ এ ক্ষমতা ছেড়ে যায়, তখন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের স্কোর ছিল ১০ এ ০.৪, অর্থাৎ একেবারে তলানিতে। এর পরের চার বছর বিএনপি’র শাসনামলে পরিস্থিতির অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়। ২০০২ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্কোর ছিল যথাক্রমে ১.২, ১.৩, ১.৫ ও ১.৭। আর ২০০৬ সাল, বিএনপি সরকারের শেষ বছর বাংলাদেশের স্কোর ছিল ২, অর্থাৎ বিএনপির পুরো সময়টি ব্যয় হয়েছে বীভৎস দুর্নীতিতে নিমজ্জিত বাংলাদেশের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রনে। 


২০০২ সাল থেকে দুর্নীতির সূচকে সর্বনিম্ন অবস্থানে থাকার পেছনে আওয়ামী লীগের চাপিয়ে দেয়া দুর্নীতির জঞ্জাল যেমন ছিল, তেমনি ছিল সেই সময়ে বাংলাদেশের চাইতে অনেক দুর্নীতি পরায়ন দেশ সেই সূচকে অন্তর্ভুক্ত না হওয়া। যেমন ২০২০ সালের সূচকে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ১৭৯ টি দেশ, কিন্তু ২০০২ এর সূচকে অন্তর্ভুক্ত দেশের সংখ্যা ছিল ১০২ টি। সোমালিয়া, দঃ সুদান, সিরিয়া, ইয়েমেন, সুদান, সিরিয়া, ইয়েমেন, ইকোয়েটরিয়াল গিনি, লিবিয়া, উত্তর কোরিয়া, গিনি বিসাউ, আফগানিস্তা্ন, তুর্কমেনিস্তা্ন, কঙ্গো, বুরুন্ডি, কোমরস, হন্ডুরাস, চাদ এর মতো কিছু দেশ এবারের সূচকে বাংলাদেশের নীচে আছে। কিন্তু এই দেশগুলো আজকের মত ২০০২ সালে দুর্নীতির সূচকে বিবেচিত হয়নি। হলে আর যাই হোক বাংলাদেশ ‘চ্যাম্পিয়ন’ হত না।  


ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এর রিপোর্টে সেই সময়ের স্কোরের প্রেক্ষাপটে বলা হয়েছিল, ১০ এর স্কেলে যে সব দেশের স্কোর ২ এর নীচে সেসব দেশের দুর্নীতি সবচেয়ে বীভৎস। বিএনপির শেষ বছরে বিএনপি ২ স্কোর করে সেই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশকে বের করে আনতে সক্ষম হয়েছিল। ২০০৬ সালে বাংলাদেশের নীচে ছিল মিয়ানমার। বাংলাদেশের স্কোর যখন ২ মিয়ানমারের স্কোর তখন ১.৯। এক যুগের বেশী একচ্ছত্রভাবে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের সময়ে ২০২০ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী মিয়ানমার আমাদের চাইতে দুই পয়েন্ট বেশি পেয়ে আমাদের চেয়ে নয় ধাপ উপরে আছে। অর্থাৎ যে মিয়ানমার ছিল বাংলাদেশের নিচের অবস্থানে সেও এই এক দশকে বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে অনেক খানি।   


২০০১ সালের ০.৪ থেকে ২০০২ এ তিনগুন অর্থাৎ ১.২ স্কোর করা পরিষ্কারভাবে নির্দেশ করে যে মাত্র এক বছরের শাসনামলে বিএনপি বিস্ময়কর মাত্রায় দুর্নীতি কমিয়ে এনেছিল। এর পরবর্তী ইতিহাস কেবলই ধারাবাহিক উন্নতির। আওয়ামী লীগের সৌভাগ্য আর বিএনপির দুর্ভাগ্য যে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এই সূচক ১৯৯৫ সালে চালু করলেও বাংলাদেশকে প্রথমবার এই সূচকে বিবেচনা করা হয় ২০০১ সালে। ফলে এর আগে কোনও তথ্য বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নেই। থাকলে আওয়ামী লীগ বিএনপি’র বিরুদ্ধে ‘পাঁচবারের দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন’ এই অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ পেত কিনা সেটা ভীষণভাবে প্রশ্ন সাপেক্ষ। 



সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের রিপোর্টে আফগানিস্তান, মিয়ানমার এবং মালদ্বীপের ভূয়সী প্রশংসা করেছে। কারণ এই তিনটি দেশই দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করে তাদের আগের স্কোর থেকে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। এর মধ্যে আফগানিস্তান আমাদের চাইতে কম স্কোর করা সত্ত্বেও (আমাদের স্কোর ২৬ এর বিপরীতে তাদের স্কোর ১৯) তাদের ক্রমাগত উন্নতি প্রসংসিত হয়েছে। বলা বাহুল্য গত এক যুগে বাংলাদের ইতিহাস ক্রমাবনতির। এই বছরও বাংলাদেশ নেমে গেছে আরও দুই ধাপ। এই প্রেক্ষাপটে ২০০২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের উন্নতি ছিল অসাধারণ। আওয়ামে লীগ যে সূচক রেখে গিয়েছিল ০.৪ এ, বিএনপি তার পাঁচ বছরের শাসন আমলে সেটিকে নিয়ে গিয়েছিল ২ এ। কিন্তু প্রোপাগান্ডার এমনই শক্তি যে আওয়ামে লীগের রেখে যাওয়া অবস্থার যে বিস্ময়কর উন্নতি বিএনপির আমলে হয়েছিল সেটি ছাপিয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে চ্যাম্পিয়নের খবরটি যেটি আদতে আওয়ামে লীগের ৯৬ থেকে ২০০১ শাসন আমলের রেখে যাওয়া অবস্থার ফসল। 


বিএনপির সর্বশেষ সরকারটি দুর্নীতি দমন করে সুশাসন নিশ্চিত করার পথে একেবারেই সঠিক পথে ছিল। আওয়ামী লীগ যে বীভৎস দুর্নীতির জঞ্জাল রেখে গিয়েছিল, সেটাকে সাফ করার জন্য ৫ বছর কোনোভাবেই যথেষ্ট সময় ছিল না, কিন্তু বিএনপি তার সর্বোচ্চ চেষ্টাটি করে দেশকে একটা চমৎকার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। এই সময়ের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে উন্নতির গ্রাফটি প্রমাণ করে বিএনপি যদি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব চালিয়ে যেতে পারত, তাহলে দেশ দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে এক অসাধারণ পর্যায়ে চলে যেত। কিন্তু হয়নি সেটা। এরপর কেবলই পিছিয়ে যাবার গল্প। গত এক যুগের বেশী সময় ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের ভয়াবহ দুর্নীতি বাংলাদেশকে লজ্জার মুখে ফেলে দেয় বিশ্ববাসীর সামনে। সরকারের নানা ব্যঙ্গ বিদ্রুপের শিকার পাকিস্তানের অবস্থান আমাদের চাইতে ২২ ধাপ উপরে। আর নেটিজেনরা বাংলাদেশের সাথে তুলনা করে যে দেশটি নিয়ে নানা রকম ট্রোল করে, সেই উগান্ডার অবস্থানও আমাদের চাইতে উপরে। 


বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের অতি উচ্চকিত প্রোপাগান্ডাগুলোর মধ্যে অন্যতম হল ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স’ এবং ‘শুদ্ধি অভিযান’; যদিও এই অভিযানেই বেরিয়ে এসেছে ভয়ংকর সব তথ্য। তবে সত্যিকারের সদিচ্ছা থাকলে একটি দেশ যে বিস্ময়কর উন্নতি করতে পারে তার এক অসাধারণ উদাহরন হতে পারে মালদ্বীপ। এই বছরের দুর্নীতির সূচকে দেশটি যা দেখিয়েছে তা স্রেফ ম্যাজিক। গত বছরের তুলনায় এক বছরে এই দেশটি ১৪ পয়েন্ট বেশি পেয়েছে যাতে তার অবস্থানের উন্নতি হয়েছে ৫৫ ধাপ। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে দেশটি ১৩০ থেকে ৭৫ এ উঠে এসেছে। মালদ্বীপই প্রমাণ করে রাজনৈতিক বুলির বাইরে গিয়ে কোন দেশ যদি দুর্নীতি দমনে সত্যিকারের সদিচ্ছা রাখে তাহলে ম্যাজিক ঘটানো সম্ভব।  


দেশের দুর্নীতি এখন কতটা ভয়াবহ পর্যায়ে গেছে সেটি বোঝানর জন্য রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের দুইজনের দুটি উক্তি পাঠকের জন্য রেখে যাচ্ছি। স্বয়ং রাষ্ট্রপতি কিছু দিন আগে দুদকের সাথে বৈঠকে বলেছেন - দুর্নীতি উন্নয়নের বড় অন্তরায়। এর আগে ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও বলেছিলেন – দুর্নীতি না হলে দেশের চেহারা পাল্টে যেত। 



লেখক জাতীয় সংসদ সদস্য ও আইনজীবী। 



Wednesday, February 17, 2021

ব্যতিক্রমী সেক্টর কমান্ডার

— আসিফ নজরুল



১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে জিয়াউর রহমান ছিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একজন মেজর। সে রাতে চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্র খালাসরত পাকিস্তানি এক জেনারেলের কাছে তাঁকে পাঠানো হচ্ছিল। পরিকল্পনা ছিল তাঁকে ‘গ্রেপ্তার বা হত্যা’ করার (গোলাম মুরশিদ, মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর: একটি নির্দলীয় ইতিহাস)। পথিমধ্যে তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের সংবাদ শোনামাত্র বিদ্রোহের সিদ্ধান্ত নেন। চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ফিরে এসে তাঁর কমান্ডিং অফিসারসহ অন্যান্য পাকিস্তানি অফিসার ও সৈন্যকে বন্দী করেন। পরদিন তিনি প্রাণভয়ে পলায়নপর মানুষকে থামিয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্দীপনাময় ভাষণ দিতে শুরু করেন (বেলাল মোহাম্মদ, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র)। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তিনি বেতারে নিজ কণ্ঠে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

জিয়ার এই রূপান্তর বা উত্থান বিস্ময়কর হতে পারে, কিন্তু তা আকস্মিক ছিল না। বরং বাংলাদেশের মানুষের বঞ্চনা, স্বাধীনতার স্বপ্ন, সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ একজন সৈনিককেও কীভাবে উদ্দীপিত করেছিল, এটি ছিল তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত (জিয়াউর রহমান, ‘একটি জাতির জন্ম’)।

জিয়া ছিলেন স্বাধীনতাযুদ্ধের একজন অগ্রগণ্য সেনানায়ক। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ১১ জন সেক্টর কমান্ডারের একজন ছিলেন। ৪৯ জন যুদ্ধফেরত মুক্তিযোদ্ধাকে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার সর্বোচ্চ বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করে। তিনি তাঁদের একজন ছিলেন। কিন্তু তিনি সেক্টর কমান্ডার ও বীর উত্তম খেতাবধারীদের মধ্যেও অনন্য ছিলেন স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে। ২৭ মার্চ এই ঘোষণা ‘মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের’ পক্ষে তিনি প্রদান করেন কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে।

এরপর জিয়া চট্টগ্রাম যুদ্ধাঞ্চল, ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক এবং পরে জেড ফোর্সের প্রধান হিসেবে বহু আলোচিত যুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদান করেন। যুদ্ধের শেষ ভাগে সিলেট অঞ্চলে তাঁর বাহিনীর কাছেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। তিনি সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের, এম এ জলিল বা খালেদ মোশাররফের মতো সম্মুখসমরের অসীম সাহসী যোদ্ধা ছিলেন না। সমশের মবিন চৌধুরী ও হাফিজ উদ্দিনের মতো তাঁর নিজস্ব বাহিনীর অফিসারদের মতো তিনি যুদ্ধ করতে গিয়ে আহতও হননি। কিন্তু ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী যুদ্ধে তাঁর বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রম শক্তিশালী প্রভাবকের ভূমিকা রেখেছে, কিছু ক্ষেত্রে তাঁকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে।



জিয়াউর রহমানের সবচেয়ে আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা। তাঁর আগে মাওলানা ভাসানী স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, ছাত্রনেতারা স্বাধীন বাংলাদেশের স্লোগান দিয়েছিলেন এবং বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। একাত্তরের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতাসংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন, এ জন্য সবাইকে প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এমনকি ২৫ মার্চ কালরাতের পর জিয়ার আগেই চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতা এম এ হান্নান বেতারে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু তারপরও বিভিন্ন কারণে জিয়াউর রহমানের ঘোষণার তাৎপর্য ছিল অন্য রকম।

প্রথমত, শক্তিশালী সম্প্রচারকেন্দ্রে বারবার সম্প্রচারিত হওয়ার ফলে জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণাটিই কেবল দেশের সব অঞ্চল থেকে বহু মানুষ শুনতে পেয়েছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর আক্রমণের মুখে দিশেহারা ও পলায়নপর অবস্থায় এটি মানুষের কাছে পরম ভরসার বাণী হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, জিয়ার ঘোষণাটি ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একজন বিদ্রোহী বাঙালি অফিসারের এবং বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে। এটি মানুষকে প্রতিরোধের সম্ভাবনা সম্পর্কে প্রবলভাবে আশান্বিতও করেছিল।



মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান এ কে খন্দকার ২০০২ সালে এক স্মৃতিচারণায় বলেন, ‘যুদ্ধের সময় সামরিক বাহিনীর একজন বাঙালি মেজরের কথা শোনা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। আমি নিজে জানি, যুদ্ধের সময় জানি, যুদ্ধের পরবর্তী সময়েও জানি যে মেজর জিয়ার এই ঘোষণাটি পড়ার ফলে সারা দেশের ভেতরে এবং সীমান্তে যত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সাংঘাতিক একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করল যে হ্যাঁ, এইবার বাংলাদেশ একটা যুদ্ধে নামল।’ (এ কে খন্দকার, মঈদুল হাসান ও এস আর মীর্জা, মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর: কথোপকথন)। 

জিয়ার ঘোষণায় উৎসাহিত বা উদ্দীপিত হয়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম (মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি), এইচ টি ইমাম (বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১), অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের (আমার একাত্তর) মতো আরও বহু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিও। তাঁর ঘোষণার গুরুত্বের উল্লেখ আছে মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতের সক্রিয় কূটনীতিক জে এন দীক্ষিতসহ ট্রেভর ফিসলক, ডেভিড লুডেনের মতো বহু আন্তর্জাতিক ব্যক্তির ভাষ্যে (মাহফুজ উল্লাহ, প্রেসিডেন্ট জিয়া অব বাংলাদেশ)।

জিয়ার ঘোষণাটির অতুলনীয় প্রভাব পড়ে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে এটি দেওয়া হয়েছিল বলে। মুক্তিযুদ্ধের গবেষক মঈদুল হাসান লিখেছেন, ‘মেজর জিয়া তাঁর প্রথম বেতার বক্তৃতায় (২৭ মার্চ সন্ধ্যা) নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ঘোষণা করলেও পরদিন স্থানীয় নেতাদের পরামর্শক্রমে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার কথা প্রকাশ করেন। এই সব ঘোষণা লোকের মুখে মুখে বিদ্যুতের মতো ছড়িয়ে পড়ে, শেখ মুজিবের নির্দেশে সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালিরা স্বাধীনতার পক্ষে লড়াই শুরু করেছে।’ (মূলধারা ’৭১)


২.

১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু করার জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর বাঙালি অফিসারদের কাছে কোনো সুস্পষ্ট বা সরাসরি নির্দেশ ছিল না। কিন্তু ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী নেতা বঙ্গবন্ধুর কাছে পাকিস্তানের শাসনভার প্রদানে অনীহার ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁরা সচেতন ছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনীতে তাঁদের প্রতি বৈষম্য ও বঞ্চনা নিয়েও প্রচণ্ড ক্ষোভ ছিল (রফিকুল ইসলাম, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে)। এ কারণে তাঁদের অনেকেই ২৫ মার্চে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যার সংবাদ শোনামাত্র বিদ্রোহ করেন। বাঙালি সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের মধ্যে জিয়া বিদ্রোহ করেন সবার আগে (মুরশিদ, পূর্বোক্ত)। ২৮ মার্চের মধ্যে বিদ্রোহ করেন সেক্টর কমান্ডারদের প্রায় সবাই। কিন্তু তাঁদের বিক্ষিপ্ত বিদ্রোহকে সমন্বিত, সুশৃঙ্খল ও কার্যকর করার প্রয়োজনীয়তা এবং এটিকে পরিপূর্ণ একটি স্বাধীনতাযুদ্ধে পরিণত করার ব্যাপারে জিয়াসহ প্রত্যেকে সচেতন ছিলেন। যুদ্ধের সময়ে বিভিন্ন ঘটনায় তাঁদের এই অসাধারণ প্রজ্ঞা, দায়িত্ববোধ ও রণকৌশলের পরিচয় পাওয়া। এবং এখানেও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে আমরা জিয়াকে অনন্য বা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে দেখি।

প্রথমত, ৩ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করার ঠিক পরদিন জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ, কে এম সফি উল্লাহসহ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী ইউনিটগুলোর কমান্ডাররা তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে বৈঠক করেন। সেখানে তাঁরা ভারতের সামরিক সাহায্য এবং দেশের রাজনীতিবিদদের নিয়ে স্বাধীন সরকার গঠনের আবশ্যকতা প্রশ্নে একমত হন, বিদ্রোহী ইউনিটগুলো নিয়ে সম্মিলিত মুক্তিফৌজ গঠন করেন এবং এম এ জি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান হিসেবে স্থির করেন। ৪ এপ্রিলের এই বৈঠকই ছিল বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর প্রথম সাংগঠনিক ভিত্তি।

দ্বিতীয়ত, যুদ্ধ সরঞ্জামের অভাব, কেন্দ্রীয় কমান্ডের নিষ্ক্রিয়তা এবং কূটনৈতিক স্বীকৃতি দানে ভারতের বিলম্বের কারণে একাত্তরের মে থেকে জুলাই মাসের প্রথম ভাগ পর্যন্ত হতোদ্যম পরিস্থিতিতে যুদ্ধাঞ্চলের অধিনায়কদের এক সম্মেলনে জিয়াই নতুন চিন্তা নিয়ে আসেন। ১০ থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী সদর দপ্তরে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে এটি অনুষ্ঠিত হয়। এর সূচনায় মুক্তিযুদ্ধের অধোগতি রোধ ও যৌথ কমান্ড-ব্যবস্থায় যুদ্ধ পরিচালনার জন্য যুদ্ধ কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব দেন জিয়া। তাঁর এই প্রস্তাবে একজন বাদে বাকি সব সেক্টর কমান্ডারের সম্মতি ছিল। মন্ত্রিসভার সমর্থন থাকলে এটি যুক্তিসংগত বলে মেনে নিতে পারতেন তাজউদ্দীন। তাতে যুদ্ধ আরও গতিশীল হতে পারত (এ কে খন্দকার, মঈদুল হাসান ও এস আর মীর্জা, মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর: কথোপকথন)। তবে সেই সম্মেলনে গেরিলাযুদ্ধের পাশাপাশি সম্মুখসমর, মুক্তাঞ্চল প্রতিষ্ঠা এবং ভবিষ্যৎ সেনাবাহিনী গঠনের প্রস্তুতি হিসেবে ব্রিগেড গঠনের যে সিদ্ধান্ত হয়, তা রূপায়ণের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁকেই।


সিলেট রেলওয়ে স্টেশনে মেজর জেনারেল কে​ ভি কৃষ্ণ রাওয়ের সঙ্গে জেড ফোর্স কমান্ডার জিয়াউর রহমান (বাঁ থেকে দ্বিতীয়), ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। ​ছবি: সংগৃহীত


তৃতীয়ত, জুলাই মাসের এই সম্মেলনে জিয়ার নেতৃত্বাধীন ব্রিগেড গঠনের প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে নেওয়া হলেও পরে কর্নেল ওসমানীর একক সিদ্ধান্তে আরও দুটি ফোর্স গঠিত হয় (এ কে খন্দকার, পূর্বোক্ত)। জেড ফোর্স নামে পরিচিত জিয়ার ব্রিগেড একাত্তরে দ্রুত কাজ শুরু করে। ঢাকামুখী অভিযানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পাকিস্তানি বাহিনীর কামালপুর ঘাঁটিতে তারা ৩১ জুলাই থেকে ১০ আগস্ট কয়েক দফা হামলা চালায়। ১ আগস্ট জেড ফোর্স বাহাদুরবাদ এবং ৩ আগস্ট শেরপুরে নকশি বিওপিতে আক্রমণ করে। এসব দুঃসাহসিক সম্মুখসমরে অনেক পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। কামালপুর যুদ্ধে অনেক মুক্তিযোদ্ধাও শহীদ হন। জিয়াকে এ জন্য কিছু সমালোচনাও মেনে নিতে হয়। কিন্তু এসব যুদ্ধ মুক্তিবাহিনীর সামর্থ্য ও সাহসিকতা সম্পর্কে নতুন উপলব্ধির জন্ম দেয়।

চতুর্থত, মুক্তিযুদ্ধের শেষ ভাগে জিয়াকে আমরা দেখতে পাই সুনির্দিষ্ট অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণাত্মক যুদ্ধের অধিনায়ক হিসেবে। একাত্তরের অক্টোবরে যৌথ সামরিক নেতৃত্ব গঠনের পর যুদ্ধের নীতিনির্ধারণের দায়িত্ব চলে যায় ভারতের জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের কাছে। নভেম্বরে ভারতীয় বাহিনী নিজ দেশের সীমান্তে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এ সময় বাংলাদেশের সেক্টর ও ফোর্সগুলো আরও মুহুর্মুহু আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

ওসমানীর নিদের্শ অক্টোবর মাসে পুরো জেড ফোর্স নিয়ে মেজর জিয়া চলে আসেন সিলেটে। এর তিনটি ব্যাটালিয়ন শ্রীমঙ্গল, ছাতক ও কুলাউড়ায় অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনা ও ক্যাম্পে সরাসরি হামলা চালায়। ১০ ডিসেম্বর এই ফোর্স সিলেট আক্রমণ শুরু করে। ১৪ তারিখ তারা সিলেটে প্রবেশ করে। যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে তিনি একদিন বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন, সিলেটে ১২৫ জন অফিসার, ৭০০ সৈন্যসহ সেই বাহিনীর একটি অংশ তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করে।


৩.

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের অবদান ছিল অপরিসীম। স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করা ছাড়াও যুদ্ধ পরিচালনা ও যুদ্ধ প্রশাসনের নীতিনির্ধারণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন মুক্তিযুদ্ধের সময়। জিয়া ছিলেন এই যুদ্ধে মহানায়কের মতো। আরও ছিলেন খালেদ মোশাররফ, আবু তাহের, আবু ওসমান, এম এ জলিল, রফিকুল ইসলামসহ অন্যান্য সেক্টর কমান্ডার। মুক্তিযুদ্ধ সর্বোপরি ছিল একটি জনযুদ্ধ, বহু সাধারণ মানুষের অসাধারণ আত্মত্যাগ আর শৌর্য–বীর্যের এক অনুপম গৌরবগাথা।

বাংলাদেশের এই বীর সন্তানেরা ছিলেন অত্যুজ্জ্বল এক নক্ষত্রমণ্ডলীর মতো। সে নক্ষত্রমণ্ডলীর সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন বঙ্গবন্ধুই। কিন্তু তাই বলে অন্য কোনো নক্ষত্রের আলোও ম্লান হতে পারে না, অন্য কোনো নক্ষত্রও মুছে যেতে পারে না।

জিয়া আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের এমনই এক অবিনশ্বর নক্ষত্র। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে শুধু জিয়া নন, আরও অনেকের কিছু কর্মকাণ্ড নিয়ে পক্ষে–বিপক্ষে নানা আলোচনা রয়েছে। কিন্তু সেটি তাঁদের একাত্তরের ভূমিকাকে ম্লান করতে পারে না।


  • লেখক  অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
  • কার্টসি — প্রথম আলো/ ১৯ ডিসেম্বর ২০১৬



Wednesday, February 10, 2021

জিয়ার খেতাব বাতিলের সিদ্ধান্ত হিংসার অপরাজনীতি

— ড. জাহিদ দেওয়ান শামীম 

 

স্বাধীনতার যুদ্ধের মাঠে বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান বীর উত্তম


স্বাধীন বাংলাদেশ ও জিয়া একে অপরের পরিপূরক। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার অপর নাম জিয়াউর রহমান। জিয়াকে বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করা সম্ভব নয়। জিয়া বাংলাদেশের আপামর জনগণের হৃদয়ে মেজর জিয়া নামে প্রতিষ্ঠিত। মেজর জিয়া ছিলেন স্বাধীনতার ঘোষক, রনাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক সেনাপ্রধান এবং বাংলাদেশের একজন সফল রাষ্টনায়ক। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য স্বাধীনতা উত্তর সরকার ‘বীরউত্তম’ খেতাবে ভুষিত করেন জিয়াকে। স্বাধীনতার ঘোষণার আগেই ১৯৭১ সাল ২৫শে মার্চ রাজনৈতিক নেতারা গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন অথবা পালিয়ে যান। শহীদ জিয়া সংকট মূহুর্তে শুধু স্বাধীনতার ঘোষনা দেননি, সেক্টর কমান্ডার হিসেবে রনাঙ্গনে যুদ্ধে নেতৃত্বও দেন। মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের অবদান অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে অস্বীকার করা হলে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে অস্বীকার করা হবে। এটাই সত্য ও ইতিহাস। ইতিহাস তার নিজস্ব গতিতে চলে।  হিংসা ও বিদ্বেষের রাজনীতি এবং আদালতের রায় দিয়ে ইতিহাস বদলানো যায় না। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নাম ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়ার জন্য ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সাথে শহীদ জিয়ার নাম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সুতরাং কখনোই স্বাধীনতা ও বাংলাদেশ থেকে জিয়াকে বিচ্ছেদ করা যাবে না।

মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার স্বীকৃতিসরূপ স্বাধীনতার ঘোষক, রনাঙ্গনের যোদ্ধা জিয়াউর রহমানকে যে খেতাব দেওয়া হয় তা বাতিলের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটা নিকৃষ্টতম সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ন ও হীনমন্যতার বহিঃপ্রকাশ। স্বীকৃত সত্য শহীদ জিয়া মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক ও রনাঙ্গনের যোদ্ধা। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নাই। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর যারা জিয়াউর রহমানের খেতাব বাতিলের সিদ্ধান্ত  নিয়েছে, তারা মূলত স্বাধীনতাকে অস্বীকার করছে। তাই জিয়াউর রহমানের খেতাব সরকার বাতিল বা যাই করুক না কেনো তিনি এদেশের মানুষের হৃদয়ের মধ্যে রয়েছেন। বাংলাদশের ইতিহাসও এটাই বলে। 

 

—   লেখক  সিনিয়র সায়েন্টিস্ট, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি 



মাফিয়াতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় পদক ছিনতাই

— মারুফ কামাল খান

 

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের অমর ঘোষক শহীদ জিয়াউর রহমান বীরউত্তম 

মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত আমাদের এ জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ। মুক্তিযোদ্ধারাই এ রাষ্ট্রের স্রষ্টা। তারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে এ ভূখণ্ডকে হানাদার শত্রুবাহিনীর কবলমুক্ত করে রাজনৈতিক নেতাদের হাতে উপহার দিয়েছিলেন। তারা এ দেশ মুক্ত করেছিলেন বলেই রাজনীতিকেরা এর শাসনক্ষমতা ও কর্তৃত্ব গ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারাই এ রাষ্ট্রের সব পদ-পদবি ও ক্ষমতার স্রষ্টা। এ রাষ্ট্র অস্তিত্বশীল না হলে এসবের কিছুই থাকতো না।

জিয়াউর রহমান স্বকণ্ঠে সদর্পে এই রাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে বিপ্লবে এবং প্রতিরোধ যুদ্ধকে স্বাধীনতার সশস্ত্র যুদ্ধে উন্নীত করেন। তিনি কেবল আমাদের স্বাধীনতার প্রথম কণ্ঠস্বরই নন, প্রথম মুক্তিযোদ্ধাও। তিনি আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডারই কেবল নন, তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান ও সশস্ত্রবাহিনীর অস্থায়ী সর্বাধিনায়ক রূপে স্বাধীনতার ঘোষক এবং মুক্তিযুদ্ধের তিনটি ব্রিগেড ফোর্সের একটির অধিনায়ক ছিলেন। 

রাষ্ট্রের স্রষ্টারা এই রাষ্ট্রের আইন-আদালত, সংবিধান, ক্ষমতাকাঠামো, সব প্রথা-প্রতিষ্ঠান, রাজনীতি বা অন্য কোনো কিছুরই অনুকম্পানির্ভর নন। তারাই এ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। বরং আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা যাদের হাতে রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব এনে দিয়েছে তারাই মুক্তিযোদ্ধাদের করুণা নির্ভর ও কৃতজ্ঞতার ঋণে আবদ্ধ থাকার কথা ছিল।

বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান বীরউত্তম 

কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের দুর্বিনীত নব্য শাসকেরা মুক্তিযোদ্ধাদের কর্তা সেজে বসেন। এমনকি তারা নিজেদেরকে সমগ্র জাতির উর্ধ্বে এবং জাতির চেয়েও বড় ভাবতে থাকেন। তারা প্রচার করতে থাকেন, এই দেশ ও স্বাধীনতা নাকি তাদেরই দয়ার দান। প্রকৃত জাতীয় বীরদের আড়াল করে মেকি বীরপূজা শুরু করা হয়। তারাই কৃতিত্বারোপ ও হরেক রকমের সার্টিফিকেট বিতরণের মালিক সেজে বসেন। তাদেরই হঠকারি তত্ত্বে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে। অনেক  বড়ো হয়ে দাঁড়ায় স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তির আকৃতি। সেই রাজনৈতিক হঠকারিতার বিবরণ তুলে ধরে তখন সংবাদপত্রে 'সিক্সটি-ফাইভ মিলিয়ন কোলাবরেটর্স' শিরোনামে আর্টিকেল প্রকাশিত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের অবহেলা উপেক্ষার পাশাপাশি তাদের মধ্যে বিভেদ ও বিভাজনও সৃষ্টি করা হয়।

এসবের ফলাফল শুভ হয়নি। রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করার এই রাজনৈতিক ধারা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছালে রক্তাক্ত এক বিদ্রোহের মধ্যদিয়ে এর পরিবর্তন ঘটে। সেই পরিবর্তন আসে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বিদ্রোহী অংশের হাত দিয়েই। সেই নির্মম অভিজ্ঞতা জাতিকে বিভাজনের বদলে ঐক্যবদ্ধ করার, সংহতি গড়ে তোলার অনিবার্য বাস্তবতা, প্রয়োজনীয়তা ও শিক্ষাকে সামনে তুলে ধরেছিল। মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান সব চেয়ে বেশি উপলব্ধি করেছিলেন সময়ের এই দাবিকে। তাই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদেরকে কেন্দ্রে স্থাপন করে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। দ্বন্দ্ব-বিভাজনের রক্তাক্ত সব ক্ষত নিরাময় এবং জাতীয় সংহতি ও সমঝোতার মহাসড়ককে চলার পথ হিসেবে বেছে নিয়েছিল বাংলাদেশ।

জিয়াউর রহমানের আগে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানও সেই জাতীয় ঐক্যের পথে নানা পদক্ষেপে এগুবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আমাদের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে তার ব্যক্তিগত অনুপস্থিতিজনিত দুর্বলতা এবং যুদ্ধোত্তর জাতীয় পুনর্গঠনে নেতৃত্ব প্রদানে ব্যর্থতার কারণে দ্রুত জনপ্রিয়তা হ্রাস তাকে এ ক্ষেত্রে সফল হতে দেয়নি। মুজিবোত্তর কালে জিয়াউর রহমান এক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেন।

আজ বাংলাদেশকে আবার ইতিহাসের কানাগলিতে ঠেলে দেয়ার জন্য মূর্খতাপ্রসূত এক হঠকারি অন্ধ রাজনীতির ধারা প্রাধান্য পেয়েছে। বাংলাদেশ তার রাষ্ট্রীয় চরিত্র হারিয়েছে। এটি আজ আর কোনো রাষ্ট্র নয়, প্রজাতন্ত্র নয়, পরবাহুনির্ভর এক মাফিয়াতন্ত্র মাত্র। অধঃপতিত এই পদ্ধতিতে নীতি, আদর্শ, প্রজ্ঞা বা দূরদর্শিতা নয়, হঠকারিতা ও অবিমৃষ্যকারিতাই এখন এর চলার পথ নির্ধারক। পদ-পদবি-ক্ষমতা লোভী স্তাবকের দল বিশেষ কাউকে তুষ্ট করার অভিপ্রায়ে এখন পরিণাম-পরিণতির চিন্তা না করেই যা-খুশি তাই করে যাচ্ছে।

এরই ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের অর্জিত বীরত্বসূচক 'বীরউত্তম' পদক ছিনতাই করার সিদ্ধান্তের কথা জানা গেলো। মাফিয়াতন্ত্র সিদ্ধান্ত নিচ্ছে রাষ্ট্রীয় পদক ছিনিয়ে নেয়ার। বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে জাতির কৃতজ্ঞতার স্বীকৃতিস্বরূপ এসব পদকে ভূষিত করে আমাদের রাষ্ট্রই সম্মানিত হয়েছিল। এটা বুঝবার মতন ন্যূনতম যোগ্যতা ও শিক্ষা যাদের নেই তারাই নতুন করে কলঙ্কের এই ক্ষতচিহ্ন অঙ্কন করতে যাচ্ছে। গর্ত থেকে মুখ বের করে হুতোমপ্যাঁচা ভাবছে, সে সূর্যের প্রখর দীপ্তিকে আটকে দিতে সক্ষম। হিংসায় জর্জরিত এই অতিক্ষুদ্ররা বুঝতেও পারছে না যে, এর মাধ্যমে তারা প্রকারান্তরে আমাদের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধকে চ্যালেঞ্জ করার ধৃষ্টতাই প্রদর্শন করেছে। ঘৃণা-বিভাজনের এই বিষবৃক্ষ রোপণের ফলাফল কী হবে তা আগামী দিন বলবে।


লেখক সাংবাদিক।  

Monday, February 1, 2021

একটি ‘ভালো’ নির্বাচনের উপাখ্যান

— এম আবদুল্লাহ

বুধবার, জানুয়ারি ২৭, ২০২১, চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন আলাউদ্দিন। সহিংসতায় নিহত আলাউদ্দিনের স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠেছে পরিবেশ।

একসময় নির্বাচন নিয়ে বিস্তর লেখালেখি করেছি। দীর্ঘ তিন দশকের সক্রিয় সাংবাদিকতার বেশির ভাগ সময় নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন বিষয়ক রিপোর্টের দায়িত্ব ছিল। পেশাগত এই দায়িত্বের কারণেই ভোটাভুটির ওপর নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও ব্যক্তিগত তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলা রুটিন ওয়ার্কের মধ্যেই ছিল। গত এক দশকে ক্রমাগতভাবে এ বিষয়ে আগ্রহে ভাটা পড়তে পড়তে একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। এখন আর এ নিয়ে লিখতে উৎসাহ বোধ করি না।

বুধবার, জানুয়ারি ২৭, ২০২১,  বন্দরনগরীতে এক রক্তাক্ত নির্বাচন দেখল জাতি। দু’টি লাশ পড়া ছাড়াও ব্যাপক সহিংসতার চিত্র উঠে এসেছে সংবাদমাধ্যমে। পুরো নির্বাচনে প্রাণ গেছে পাঁচটি। ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, নৌকার প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ধানের শীষের ডা: শাহাদাতকে তিন লাখ ১৬ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে মেয়র হয়েছেন। নৌকার ভোট তিন লাখ ৬৯ হাজার ২৪৮, আর ধানের শীষের ৫২ হাজার ৪৮৯টি। রাত পৌনে ২টায় রিটার্নিং কর্মকর্তা ঘোষিত ফলাফলে দেখা গেল, সাড়ে ২২ শতাংশ ভোট পড়েছে। বিতর্কিত ইভিএমে ভোটাভুটি হয়েছে। ভোটের ফলাফল পেতে সেই সনাতন পদ্ধতির চেয়েও বেশি সময় কেন লাগল সে এক বড় রহস্য। ইভিএম ফলাফল দিতে বড়জোর আধা ঘণ্টা সময় নেয়। সব কেন্দ্র থেকে তা সংগ্রহ করতে প্রযুক্তির যুগে বড়জোর দুই ঘণ্টা লাগার কথা। সেখানে ১০ ঘণ্টা লাগল কেন, সে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কমিশনের মান-ইজ্জত রক্ষায় মনের মতো করে ভোটের হার ও ফলাফল মেলাতে এ সময় লেগেছে কি না তা অনুসন্ধানের দাবি রাখে।

ভোটের আগের দিন নির্বাচন কমিশন সচিব সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করে বলেছেন, ‘আশা করি চট্টগ্রামে একটি ভালো নির্বাচন দেখবেন’। এ বক্তব্যে প্রকারান্তরে আগের নির্বাচনগুলো যে খারাপ ছিল তা স্বীকার করে নিয়েছেন তিনি। এ আশ্বাস কেউ গুরুত্ব দিয়েছে বলে মনে হয় না। প্রাণ ও রক্তক্ষয়ী নির্বাচনের শেষেও কমিশন সচিব বরাবরের মতো তুষ্টির ঢেঁকুর তুলেছেন। সচিব নির্বাচন কমিশনের মুখপাত্র হিসেবে বক্তব্য দেন। তার বক্তব্য কমিশনেরই বক্তব্য। ভোট পরবর্তী মূল্যায়নে তিনি বলেছেন, ‘আমরা বলব, ভালো নির্বাচন হয়েছে। তবে দুটি কেন্দ্রে কিছু উচ্ছৃঙ্খল লোকজন, যারা ইভিএমে ভোট হোক চান না, তারা আক্রমণ চালিয়েছিল। ইভিএম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় আমরা ওই দুটি কেন্দ্রে ভোট স্থগিত করে দিয়েছি। এ ছাড়া অন্য কেন্দ্রগুলোতে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে নির্বাচন হয়েছে। যারা ভোট দিতে এসেছিলেন, তারা ভোট দিয়ে গেছেন’। সহিংসতা প্রশ্নে সচিব বলেন, ‘আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এ ধরনের নির্বাচনে কিছু ঘটনা ঘটে। সেই হিসেবে যদি বলেন, তাহলে বলব, বরং কমই হয়েছে’। আর ভোটের হার কম হওয়া প্রসঙ্গে তার বক্তব্য হচ্ছে, ‘দেশ উন্নত হওয়ায় মানুষ ভোট দিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।’

নির্বাচন কমিশনের মুখপাত্রের বর্ণনায় স্বাভাবিক, কম সহিংসতার ভালো নির্বাচনটি কেমন ছিল তা দেখে নেয়া যাক প্রধান কয়েকটি সংবাদপত্রের রিপোর্ট থেকে। নয়া দিগন্ত ‘প্রাণহানি ও সহিংস ভোট চসিকে’ শিরোনাম করে প্রতিবেদনে জানিয়েছে, দু’জনের প্রাণহানি, বিভিন্ন কেন্দ্রে সরকার সমর্থকদের অভ্যন্তরীণ বিরোধে দফায় দফায় সংঘর্ষ, গুলি বিনিময়, ককটেল বিস্ফোরণ, কয়েকটি স্থানে বিএনপি সমর্থকদের সাথে সরকার সমর্থকদের সংঘর্ষ, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধাদান, বিএনপি এজেন্টদের বের করে দেয়া, ইভিএমের গোপনকক্ষে সরকার সমর্থকদের হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার চসিক নির্বাচন।’

দৈনিক প্রথম আলো ‘সহিংসতায়ম্লান ভোট উৎসব’ শিরোনামে নির্বাচনী রিপোর্টটি শুরু করেছে এভাবে, ‘আশঙ্কাই সত্য হলো চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ভোটে। হামলা, গোলাগুলি, একজনের প্রাণহানি ও ক্ষমতাসীনদের শক্তির প্রদর্শনী ভোটের উৎসবকে ম্লান করে দিয়েছে। এ ছাড়া ভোটকেন্দ্র থেকে বিরোধীদলীয় প্রার্থীর এজেন্টকে বের করে দেয়া বা ঢুকতে বাধা দেয়া, কেন্দ্রের প্রবেশপথসহ আশপাশের এলাকা ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে রাখা, গোপন বুথে অবাঞ্ছিত ব্যক্তির উপস্থিতি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষপাতমূলক আচরণ, অভিযোগ পাওয়ার পরও নির্বাচন কমিশনের কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়াসহ সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন নির্বাচনে যেসব অনিয়মের অভিযোগ ছিল, তার সবই ছিল চট্টগ্রামের নির্বাচনে।’

বাংলাদেশ প্রতিদিন তাদের ‘চট্টগ্রাম ভোটে ব্যাপক সংঘর্ষ’ শিরোনামের রিপোর্টের শুরুতে জানিয়েছে, দফায় দফায় সংঘর্ষ, সহিংসতা, গোলাগুলি, প্রাণহানি, ককটেল বিস্ফোরণ ও বর্জনের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, গোপন ভোটকক্ষে অবস্থান নিয়ে একটি প্রতীকে ভোট দিতে বাধ্য করা হয়েছে ভোটারদের। নির্বাচন নিয়ে নৈরাজ্যকর অবস্থার কারণে সকালের পর কেন্দ্রগুলোতে ভোটারের উপস্থিতি কমতে থাকে।’

দৈনিক যুগান্তর ‘দফায় দফায় সঙ্ঘাত-সংঘর্ষে ভোট সম্পন্ন’ শিরোনাম করে জানিয়েছে, দিনভর সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ, গোলাগুলি, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, ইভিএম ভাঙচুরসহ নানা অঘটনের মধ্য দিয়ে বুধবার শেষ হয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। শুরু থেকেই বিশেষ করে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের কারণে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে যে হানাহানির আশঙ্কা করা হয়েছিল, ভোটারদের মধ্যে যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল সেসবের প্রতিফলন ঘটেছে ভোটের মাঠে।’

শীর্ষস্থানীয় চারটি দৈনিকে চসিক নির্বাচনের যে খণ্ডিত চিত্র উঠে এসেছে তা যদি নির্বাচন কমিশনের দৃষ্টিতে স্বাভাবিক, কম সহিংসতার ভালো নির্বাচনের অনুষঙ্গ হয় তা হলে বলার কিছু নেই। কিছু দিন আগে ৪০ জন বিশিষ্ট নাগরিক নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার জন্য কমিশনের প্রতি যে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন এবং বিচার দাবি করে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকপত্র দিয়েছেন তার যৌক্তিকতার প্রমাণ তারা নিজেরাই বারবার দিচ্ছেন।

চসিক নির্বাচনে ২২ দশমিক ৫২ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে দেখানো হয়েছে। তার মানে হচ্ছে, বন্দরনগরীর তিন-চতুর্থাংশের বেশি ভোটার বুধবারের নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে। ৭৮ শতাংশ ভোটার যে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে সে নির্বাচন নামক তামাশায় কাউকে পাঁচ বছর নগরীর কর্তৃত্ব করতে দেয়া যায় কি না প্রশ্ন তোলা বোধ করি অবান্তর ও অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ১৯ লাখ ভোটারের ১৪ লাখ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত নির্বাচনের বাতাবরণে কথিত নগরপিতার আসন দখলের নৈতিক ভিত্তি কতটা? এই ৭৮ শতাংশ ভোটার কি তাহলে নৌকাবিরোধী। নৌকা সমর্থক কোনো ভোটারের মনে তো ভয়ভীতি থাকার কথা নয়। তারা কেন ভোট দিতে যাবে না? তা হলে চট্টলার মানুষ রায়টা আসলে কোন দিকে দিলো? ক্ষমতাসীনদের বলদর্পী শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে, নাকি নতজানু ও মেরুদণ্ডহীন নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে? আর বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার যে শবযাত্রা মানুষ দেখছে তারই বা প্রতিকার কী?

জাতি হিসেবে আমরা ভুলোমনা। খুব দ্রুতই আমাদের বিস্মৃতি ঘটে। একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন হয়েছে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর। ওই নির্বাচনের পর গঠিত সরকার এরই মধ্যে দুই বছর দেশ শাসন করেছে। নির্বাচনটি কেমন হয়েছে তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা-পর্যালোচনা, বিতর্ক হয়েছে দেশে-বিদেশে। এক দশক ধরেই বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা তুমুল আলোচনায়। জাতীয় কিংবা স্থানীয় কোনো নির্বাচনই জনমতের প্রতিফলন ঘটাতে পারছে না বলেই মত দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহলের।

একাদশ নির্বাচনে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে, দিনের ভোট রাতে দেয়ায়। ভোট চলাকালে কেন্দ্র দখল করে সিল মারা, ব্যালট বাক্স লুট, একের ভোট অন্যে দেয়া এসব বাংলাদেশের নির্বাচনে সবসময়ই কমবেশি হয়েছে। কিন্তু ৩০ তারিখের ভোট ২৯ তারিখ রাতে হবে এমনটা সম্ভবত কেউ ভাবতে পারেননি। ফলে এ নিয়ে নানা হাস্যরসও হয়েছে, হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ আড্ডা-আলোচনায়। কেউ বলছেন এটি ছিল ‘ডে-নাইট ইলেকশন’। কারো মতে ‘ডবল শিফটে’ ভোট করেছে প্রশাসন। নিন্দুকেরা সরকারকে আখ্যায়িত করছে ‘ মিডনাইট ভোটের সরকার’ হিসেবে।

কন্ট্রোলড ও ম্যানেজড মিডিয়ার জামানায় ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চিত্র জনসম্মুখে এসেছে খুব কমই। এক ধরনের ত্রাসের পরিবেশে সাংবাদিক, সুশীল, পর্যবেক্ষক, বিশ্লেষক- কেউই নির্বাচন প্রশ্নে ঝেড়ে কাশতে পারেননি। জাতীয় নির্বাচনের নামে যে তামাশা হয়েছে তা বিস্মৃতির গহ্বরে যাওয়ার পর ঢাকা সিটির উপনির্বাচন ও পরে মূল নির্বাচন, তারও পর উপজেলা নির্বাচন এবং বর্তমানে চলমান পৌরসভা নির্বাচনের ডামাডোল জাতিকে ভোটরঙ্গ দেখিয়ে বিনোদন দিয়েছে এবং দিয়ে চলেছে।

বাংলাদেশের বর্তমান নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ছোটভাই আবদুল কাদের মির্জা তার পৌর নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার কৌশল হিসেবে যে ‘সত্য বচন’ দিয়েছেন তা কিছু দিনের জন্য হলেও বাজার পেয়েছিল। তার ভাষায়, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে চট্টগ্রামেও হয়তো অনেকে পালানোর ‘দজ্জা’ খুঁজে পেতেন না। বগুড়ায় শাসকদলীয় এক নেতা ঘরোয়া সভায় নৌকায় ভোট না দিলে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার দরকার নেই বলে যে হুঙ্কার দিয়েছেন তা-ই হচ্ছে সমকালীন নির্বাচনে সরকারের অনুসৃত নীতি। এমন পরিস্থিতিতে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি কেন নির্বাচনে অংশ নেয়, অথবা অংশ না নিয়েই বা কী করবে সে বিতর্ক হয়তো চলতেই থাকবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, নির্বাচনের নামে রাষ্ট্রীয় কোষের অর্থ অপচয় ও মানুষের জীবন ও মান-সম্ভ্রমের ক্ষয় বন্ধ করার সময় এসেছে। চট্টগ্রামে পাঁচটি জীবন ও বিপুল অর্থের শ্রাদ্ধ করে কী অর্জন তা আমজনতার জানার অধিকার রয়েছে।

অনেকের স্মরণ থাকার কথা, ইভিএম নিয়ে বিতর্কের জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নির্বাচনী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কর্মশালায় বলেছেন, ‘রাতে ব্যালট বাক্স ভরার প্রবণতা রোধেই নির্বাচন কমিশন ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমের দিকে ঝুঁকছে’। সেই ইভিএমে অনেকগুলো নির্বাচন হলো। তাতে দেখা গেল, ব্যালটে সিল মারার পরিবর্তে এখন আঙুলের ছাপ নিয়ে ভোটারদের বিদায় করে ‘নৌকা’ প্রতীকের বাটন চেপে দিচ্ছেন শাসকদলীয় ক্যাডাররা। পার্থক্য শুধু এই, আগে ক্যাডারদের গোপন বুথ দখল করতে হতো না, এখন সেই বুথে একজন করে ক্যাডার অবস্থান নিতে হয়। ক্যাডারদের কষ্ট খানিকটা বেড়েছে, বেড়েছে ভোটারের কষ্টও। কষ্ট করে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে আঙুলের চাপে মেশিন অন করা পর্যন্ত ভোটারের দায়িত্ব। কোন মার্কায় ভোট দেয়া হবে সে দায়িত্বটা নিচ্ছেন ‘মহানুভব’ ক্যাডার। ব্যালট বই দখলে নিয়ে সিল মারার পরিবর্তে এ পদ্ধতিতে ভোটের সংখ্যা কমে এসেছে, এই যা। ফলাফল তথৈবচ।


  • লেখক সাংবাদিক, সভাপতি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন -বিএফইউজে


হাইকোর্ট-ফাইকোর্ট, মানব-পাচার আর আওয়ামী এমপিদের 'খেলা'

— ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা



'আপনি এখন রাত্তিরে থানায় বোম মারেন একটা। মারায়ে ওর নামে মামলা করতে হইবে। পারবেন? আপনি থাকলে এগুলো করতে অইবে' - ছোটবেলার পরীক্ষার মতো যদি জিজ্ঞেস করা হয় এই কথাগুলো কে, কাকে, কোন প্রসঙ্গে বলেছিল, তাহলে প্রায় সকলেই এর সঠিক উত্তর দিয়ে দিতে পারবেন। বরাবরের মতই এটাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। তবে সেটা হালে পানি পাচ্ছে না খুব একটা, মানুষ নিজ কানে অডিওতে শুনেছে এবং একেবারে মূল ধারার মিডিয়ায় সংবাদটি দেখেছে।


একজন তথাকথিত আইন প্রণেতা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ওসিকে এই কথাগুলো বলছেন, এটুকু জানিয়ে এই কথাগুলো ন্যূনতম গণতন্ত্র আছে এমন কোন দেশের মানুষকে শোনানো হলে তাদের কাছে অকল্পনীয় লাগবে। তারা ভাববে রাষ্ট্রের ২ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের দুইজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এমন আলাপ করতে পারে? 


পুরো কথোপকথনটি যারা শুনেছেন তারা কেউ কেউ বলতে পারেন সংসদ ওসিকে থানায় কিংবা ইটের ভাটায় বোমা মেরে মামলার কথা বলেছেন কিন্তু ওসি তো সেই ব্যাপারে অন্তত সেই সময়ে রাজি হননি। কিন্তু আমরা কেউ কি এভাবে ব্যাপারটা ভেবে দেখছি যে একজন ওসিকে এইরকম কথা বলা যায় সেটা এমপির কেন মনে হল? কেন তিনি মনে করেন থানায় থাকতে হবে এসব করতে হবে? 


গত এক যুগে এই রকম অসংখ্য মিথ্যা মামলা সাজিয়ে এই দেশের বিরোধী দলকে দমন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা হয়েছে। সেই চেষ্টায় বিভিন্ন থানার কর্মরত কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। সরকার দলীয় সংসদ সদস্য কিংবা অন্য কোনো নেতার ফরমায়েশ মত মামলা সাজিয়েছেন। প্রভাবশালীদের দেয়া মিথ্যা মামলায় বছরের পর বছর কারাগারে থেকে শেষ পর্যন্ত মুক্তি পাওয়া মানুষের প্রচুর খবর নিয়মিতই আসে আমাদের সামনে। অলক্ষ্যে থেকে যায় আরো অনেকে যারা দুর্ভাগা। 


যশোরের কেশবপুরের সাইফুল্লাহ 'সৌভাগ্যবান'। এই ফাঁস হওয়া অডিও হয়তো তাকে বাঁচিয়ে দেবে। কিংবা হয়তো দেবে না। সাইফুল্লাহকে থামিয়ে দেবার জন্য হয়ত আবিষ্কার করা হবে নতুন কোন পথ। কারণ থানার ওসির চোখেও সাইফুল্লাহ ভালো কোনো মানুষ নয়; এমপি চাকলাদার সাইফুল্লাহ পরিচয় জানতে চাওয়ার জবাবে ওসি বলেন - 'স্যার ওই ইটভাটার একটা বিষয় নিয়ে সাইফুল্লাহ, বেলায় যেয়ে মামলা-টামলা করে আর কী। বাজে একটা ছেলে স্যার'।


আসলেই তাই, বর্তমান বাংলাদেশের সরকারি দলের বাইরে গিয়ে এই দেশের জনগণ এবং রাষ্ট্রের পক্ষে যে কারো দাঁড়ানো মানেই তাদের চোখে খারাপ হওয়া। গত এক যুগের ক্ষমতায় থাকার পথে বিশেষ করে ২০১৪ সালের পরের ৭ বছর অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ দেশের প্রশাসনের কাছে এই ন্যারেটিভ তৈরি করেছে। 


আলোচিত কথোপকথনে আরো বেশি উল্লেখযোগ্য বিষয় এসেছে ওসির একটা তথ্যের জবাবে এমপি চাকলাদার যা বলেন তাতে। ইটভাটার বিরুদ্ধে সাইফুল্লাহর হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ নিয়ে আসা প্রসঙ্গে যখন ওসি এমপিকে জানান তখন তার জবাব -


'আরে কোথার হাইকোর্ট-ফাইকোর্ট। কোর্ট-ফোর্ট যা বলুক, বলুইগ্যা। আমাদের খেলা নাই? খেলা নাই'?


একজন আইনপ্রণেতা দেশের সর্বোচ্চ আদালত নিয়ে এই ধরনের মানসিকতা পোষণ করে। এই রাষ্ট্রের 'সেপারেশন অব পাওয়ার' কে ধ্বংস করে সবকিছুকে শাসন বিভাগের সাথে একত্রে মিলিয়ে ফেলা হয়েছে, তাই রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ বিচার বিভাগের প্রতি এরকম তাচ্ছিল্য এবং অবজ্ঞা অবধারিতই ছিল। আমরা স্মরণ করব এই সরকারের আমলেই বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীনভাবে একজন প্রধান বিচারপতিকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। পরিকল্পিতভাবে সেই ঘটনা ঘটানো হয়েছিল উচ্চ আদালতকে একেবারে ধ্বংস করে যাচ্ছে তাই যেন করা যায় সেটা নিশ্চিত করতে। হ্যাঁ, সরকার খুব ভালোভাবেই সফল তাতে।


উচ্চ আদালত নিয়ে বক্তব্যের শেষ বাক্যে বারবার 'খেলা'র কথা বলছিলেন চাকলাদার। খেলা শব্দটি এখন আওয়ামী লীগের অনেকের মুখ থেকে শোনা যায়। ভাস্কর্য ইস্যুতে খেলাফত মজলিসের মামুনুল হকের সাথে যখন সরকারি দলের সংঘাত চলছিল তখন আরেক এমপি মুজিবর রহমান নিক্সন চৌধুরী বারবার তাদের সাথে খেলতে আসার কথা বলছিলেন মামুনুল হককে। কাগজে-কলমে স্বতন্ত্র সদস্য হলেও তুমি চিরকাল আওয়ামী লীগ করেছেন এবং এখন যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। সরকারি দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা মাঝেমাঝেই খেলার কথা বলে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন, এই দেশকে এবং দেশের মানুষকে নিয়ে স্রেফ ছেলেখেলা করছে ক্ষমতাসীন সরকারটি।


জনাব নিক্সনেরই একটা অডিও ক্লিপ ফাঁস হয়েছিল কিছুদিন আগে, যেখানে তিনি ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) অতুল সরকারকে ‘দাঁতভাঙা জবাব’ দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন এবং চরভদ্রাসনের ইউএনওর ফোনে ফোন করে গালিগালাজ করেছেন ভাঙা উপজেলার এসিল্যান্ডকে। 


বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের ফরিদপুর জেলা শাখা গতকাল রোববার সভা করে এই ঘটনার প্রতিকার চেয়েছিল। জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় এই ঘটনায় নিন্দা প্রস্তাব আনা হয়। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছিল। কিন্তু সেই ঘটনায় আলোচিত এই এমপির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, নেবার কথাও না। আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি, ব্যবস্থা নেয়া হবে না শাহীন চাকলাদার এর বিরুদ্ধেও।


এবার আসা যাক আরেক 'আওয়ামী' এমপি পাপুল কাণ্ডে। আমি জানি পাপুলকে আওয়ামী এমপি বলায় কেউ কেউ আপত্তি করবেন কারণ কুয়েতে মানব পাচারের দায়ে শাস্তিপ্রাপ্ত বাংলাদেশি পাপুল কাগজে-কলমে স্বতন্ত্র এমপি। আসলেই কি তাই?


গত নির্বাচনে পাপুলের আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দেয়নি; সেই আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই আসনে জাতীয় পার্টির প্রতিদ্বন্দিতা করেনি সেই প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির কয়েকজন বড় নেতা দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিককে বলেছিলেন - আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের বেইলি রোডের বাসায় একটি বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে জাপার প্রতিনিধির কাছে লক্ষ্মীপুর–২ আসন শহিদ ইসলামকে ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেন এইচ টি ইমাম। এ কারণে জাপা আসনটি ধরে রাখেনি।


সেই রিপোর্টেই জানা যায়, পরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনাকমিটি থেকে চিঠি দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী শহিদ ইসলামের পক্ষে কাজ করার জন্য দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়। কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচ টি ইমামের পক্ষে চিঠিটি পাঠান নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়কারী সেলিম মাহমুদ।


শুধুমাত্র টাকা ছিটিয়ে একজন মানুষ নিজের এবং তার স্ত্রীকে এমপি বানাতে পারেন তার এক অসাধারণ উদাহরণ হয়ে থাকবে নেই পাপুল। পাপুল এর টাকার জোর থেমে থাকেনি তিনি কুয়েতে আটক হবার পরও। তিনি যখন আটক হন তখন‌ও জাতীয় সংসদ থেকে বলা হয়েছে তার আটক এর ব্যাপারে তারা কিছু জানেন না। এখন তার চার বছর সাজা পাবার পার‌ও তার সংসদ সদস্যপদ বাতিল না করে বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। 


বছরের পর বছর এই দেশের গরীব মানুষকে নিয়ে নোংরা ব্যবসা করেছে পাপুল। দেশের মানুষকে কুয়েতে নিয়ে গিয়ে বীভৎস অত্যাচার-নির্যাতন করে অতি তুচ্ছ বেতন দিয়ে বা না দিয়ে কাজ করিয়েছে। এই দেশের জনগণের পক্ষে দাঁড়ায়নি এই দেশের সরকার। শুধুমাত্র টাকা আর ক্ষমতা থাকলেই যে কেউ যে কোনো কিছু করে পার পেয়ে যেতে পারে এই দেশে। 


একটার পর একটা নির্বাচন বাদ দিয়ে ক্ষমতায় থাকা এই দেশ থেকে গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও বিলীন করে দিয়েছে - এটা এখন এক মাফিতন্ত্র। সেই মাফিয়াতন্ত্রের তথাকথিত সংসদে সংসদ সদস্যের মুখোশ পড়ে মাফিয়ারাই তো বিচরণ করার কথা; হচ্ছেও সেটা। 


মুখোশের সমস্যাই হলো সেটা মাঝে মাঝে খসে পড়ে। সম্প্রতি যেমন পড়েছে এই কলামে আলোচিত এই তিন জনের। আগেও খসেছে কারো কারো, অচিরেই খসে পড়বে আরো অনেকের। তাদের চেহারা দেখাই সার, এই মাফিয়াতন্ত্র ভেঙে দেশে গণতন্ত্র কায়েম করতে না পারলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার চিন্তা একেবারেই আকাশ-কুসুম কল্পনা। 


লেখক — রাজনীতিবিদ, আইনজীবী।