Search

Thursday, October 28, 2021

আর কতো গোঁজামিল দিবেন?

ফাইজ তাইয়েব আহমেদ

জুন ২০২১ এর শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৫% বর্ধিত দেখিয়ে $৪৬ বিলিয়ন দেখানো হয়েছিল। আইএমএফ’র হিসাব অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হয়েছে $৩৯ বিলিয়ন, অর্থাৎ ৭.২ বিলিয়ন ডলার বাড়িয়ে দেখানো হয়েছিল।

রিজার্ভের যে অংশ অর্থায়ন হয়ে গেছে, আবাসিক ব্যাংকে জমা হয়েছে, নন ইনভেস্টমেন্ট গ্রেড বন্ডে বিনিয়োগ হয়েছে এবং শ্রীলঙ্কাকে ঋণ দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে, তা এডজাস্ট করা হয়নি।

এক বছরের বেশি সময় পার করার পর ২০১৯-২০ অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধির তথ্য প্রকাশ করলো সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো- বিবিএস। সংস্থাটি জানিয়েছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩.৫১ শতাংশ। যদিও সরকারের দাবি ছিল ওই অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৫.২৪ শতাংশ।

প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে যত গোঁজামিল বিবিএস তৈরি করেছে, তার কয়াটা ধরা খাওয়ার পর ঠিক করবে?

আর দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, বিদেশী সংস্থার কি ঠেকা পড়েছে এভাবে বার বার বিবিএস এর জালিয়াতি ধরে দিবে?

জনসংখ্যা, জাতীয় আয়, প্রবৃদ্ধি, ফরেক্স রিজার্ভ, মাথাপিছু ঋণ, মোট বৈদেশিক ঋণ, মোট খেলাপি ঋণ, কৃষি-শিল্প-রপ্তানী প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, আয়কররের হিসেব ইত্যাদি খাতে আর কতদিন গোঁজামিল চালিয়ে যাবে বিবিএস? গোঁজামিল ডেটার উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা কি সুস্থ ও সুষ্ঠু হয়?

দেশী অর্থনীতিবিদ, সিপিডি, ব্রাক-বিআইজিডি, পিপিআরসি ইত্যাদি বেসরকারি সংস্থা কিংবা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা বিয়াইডিএস এর কাজটা আসলে কি? শুধু তেল্বাজি করা? সরকারের সেট করে দেয়া ডেভেলপমেন্ট ন্যারেটিভের পক্ষে গোঁজামিলে ভরা ম্যানিপুলেটেড ডেটা উৎপাদনের পক্ষে সমর্থন দিয়ে যাওয়া? 

সূত্র    — দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড/ অক্টোবর ২৩, ২০২১


  • লেখক নেদারল্যান্ডসের ভোডাফোনে কর্মরত প্রকৌশলী এবং টেকসই উন্নয়নবিষয়ক বিশেষজ্ঞ।   

Friday, October 22, 2021

গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সর্বাত্মক সংগ্রামই হওয়া উচিত বিএনপির একমাত্র অঙ্গিকার

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান

 


পরাজয় হলে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও ২৭ মার্চ ১৯৭১ সালে মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্রে যান এবং স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষনা দিয়েছিলেন, যা তাকে অসীম সাহসী দেশ প্রেমিক হিসেবে অসামান্য উচ্চতা দান করেছে। স্বাধীনতার ঘোষণার দিনক্ষণ সংক্রান্ত একটি বিষয় স্পষ্ট হওয়া দরকার। জিয়াউর রহমানের সহকর্মীদের ভাষ্য অনুযায়ী ২৫ ও ২৬ মার্চের মধ্যবর্তী রাতে তিনি সর্বপ্রথম তার সৈনিকদের কাছে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন; পরবর্তীতে ২৬ তারিখে আরেকবার এবং ২৭ মার্চ পুনরায় রেডিওতে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। শ্বাসরুদ্ধকর মুক্তিযুদ্ধের অবসান হয় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে লাখো মা বোনের ইজ্জত ও শহীদের রক্তের বিনিময়ে । রণাঙ্গনে অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ জিয়াউর রহমানকে ১৯৭২ সালে যুদ্ধ ফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ ”বীর উত্তম” খেতাবে ভূষিত করা হয়। 

সন্দেহাতীত ভাবেই তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে গৃহীত এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। পেশাদারিত্ব তাঁর চারিএিক বৈশিষ্ঠের অন্যতম প্রধান একটি দিক। দেশ প্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ জিয়াউর রহমান নিজ পেশায় ফিরে যান। তারপর প্রায় চার বছর গত হয়।

১৯৭৫ এর ১৫ ই আগস্টে পট পরিবর্তনের পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন খন্দকার মোস্তাক এবং সামরিক আইন জারি করেন। সংবিধান বলবৎ রাখলেও সংশোধনী এনে নাগরিক অধিকারের পরিধি আশঙ্কাজনক ভাবে সংকুচিত করেন। রাষ্ট্রপতি মোশতাক আহমেদ ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫-এ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করার মাধ্যমে ১৫ই আগষ্টে অভ্যুত্থান ও হত্যাকান্ডে জড়িত সেনা কর্মকর্তাদের আইনি সুরক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করেন। 

এ আদেশে বলা হয়েছিলো, ১৫ই আগস্ট অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত কারো বিচার করা যাবেনা (মহিউদ্দিনআহমদ, ২০১৭, পৃ-৬৪), যা প্রমান করে, বাকশাল সরকারের তৎকালীন বানিজ্য মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে ১৫ই আগষ্টের অভ্যুত্থানকারী ও হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতদের আইনি সুরক্ষা দিয়েছেন; জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সবৈব মিথ্যা। 


রাজনীতির এই চরম অস্থিতিশীল পরিস্থিতে জিয়াউর রহমান ক্ষমতার দৃশ্যপটে চলে আসেন। সঙ্কট, সন্দেহ, পারস্পরিক দোষারোপ, কু ও পাল্টাকু এর অগ্নিঝরা নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সিপাহি-জনতা অবরুদ্ধ জিয়াকে মুক্ত করে কিভাবে দেশ পরিচালনা গুরু দায়িত্ব প্রদান করেছেন সে সম্পর্কে ইতিহাস সচেতন দেশবাসী অবগত আছেন। এই ইতিবাচক ঘটনাটিকে যথাযথ মর্যাদা দানের লক্ষ্যে ৭ নভেম্বরকে ”জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস' হিসেবে পালন করা হয়। জিয়াউর রহমান যখন সেনাপ্রধান হন তখন সামরিক বাহিনী ছিল নানা দল উপদলে বিভাজিত। রাজনৈতিক দলগুলো ছিল পরস্পর বৈরী। সামরিক বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং রাষ্টক্ষমতা প্রয়োগের আইনি ভিত্তি তৈরী করার জন্য রাজনৈতিক দল তৈরী করে রাজনীতিকে সেনা ছাউনি থেকে জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেয়ার আন্তরিক চেষ্টায় নিমগ্ন ছিলেন। ফলাফল হিসেবে ১৯৭৮ সালে ১লা সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠিত হয়। 

অনেকের সংশয় ছিল যে, তিনি পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবেন না। ঐতিহাসিক গওহর আলী তার সন্দেহের কারণ হিসেবে চার ভাগে বিভক্ত সামরিক বাহিনীকে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে মন্তব্য করেছেন (১৯৭৬ সালে নিউজিল্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল রিভিউতে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে)। অনেকের সংশয়ের আরও একটি কারণ হল, সাধারনত ক্ষমতার বৃত্তের বাইরে থেকে, রাজপথে কিংবা আলোচনার টেবিলে এদেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছে। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ব্যতীক্রমধর্মী। এটি ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতে থাকা জিয়াউর রহমানের মস্তিস্কজাত রাজনৈতিক মতাদর্শ। সংগত কারণে অনেকের মধ্যে সংশয় ছিলো এটি কি রাজনৈতিক দল নাকি একটা ‘প্রবনতা’। এছাড়াও রাজনীতির অঙ্গনের অনেকের ধারণা ছিল সরকারের মেয়াদ শেষ হলেই বিএনপি দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যাবে। দল হিসেবে বিএনপি টিকে থাকবে কিনা সে সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে রাজনৈতিক দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ”সরকার চলে গেলে এই দল থাকবে বলে মনে হয় না” ( বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি, ১৯৭৮, পৃ.৫)। 

সব সন্দেহ ও সমালোচনাকে ভুল প্রমাণ করে জিয়াউর রহমান সামাল দিয়েছিলেন, সফল হয়েছিলেন। এই সাফল্যের পিছনে ভুমিকা রেখেছে রাষ্ট্র ক্ষমতাকে গণমুখী এবং গণনির্ভর করাতে তাঁর সদিচ্ছা ও কার্যকর পদক্ষেপ। জাতির জীবনে এ ধরনের সাফল্য বয়ে নিয়ে আসার কারণে অনেক গবেষক জিয়াউর রহমানকে তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক, মেক্সিকোর প্লুতার্ক এলিয়স কামেল ও লজারো কার্দেনাস এবং দক্ষিণ কোরিয়ার পার্ক চুংহি এর সাথে তুলনা করেন (Hossain, Golam, General Ziaur Rahman and the BNP: Political Transformation of a Military Regime, UPL,  Dhaka, P.17)। বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোন্দল ও স্থবিরতার বিপরীতে তিনি  দেশের জন্য সময় উপযোগী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বিষয়ক ইশতেহার প্রণয়ন ও ঘোষনা করেন। এভাবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) একক বিকল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়।

জিয়াউর রহমান দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমে কেবল শাসক পরিবর্তন হয়েছে তা নয় বরং বাংলাদেশ রাষ্ট্র কেমন হবে; এর দার্শনিক ভিত্তি কি হবে, তার একটি সুনির্দিষ্ট ও প্রায়োগিক রূপরেখা পাওয়া গিয়েছে। জিয়াউর রহমান প্রতিশোধ পরায়ান ছিলেন না। বহুবার বৈষম্য ও অবজ্ঞার শিকার হয়েও তিনি শত্রু চিহ্নিত করে নির্মুল করার পথে না হেটে বাংলাদেশকে একটি কার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করার নিমিত্তে  সর্বস্থরের জ্ঞাণী-গুনী মানুষের সম্মেলন ঘটিয়েছেন। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দার্শনিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করেছেন, যা পর্যায় ক্রমে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে দেশপ্রেমে উদ্ভুদ্ধ মানুষের মিলন মেলায় পরিনত হয়েছে। সমালোচকদের ভুল প্রমান করে এই দলটি জনগণের সমর্থন আদায় করে প্রভাবশালী দল হিসেবে শুধুমাত্র স্থায়ীত্বই অর্জন করেনি বরং জিয়া পরবর্তী সময়ে তিনবার গ্রহনযোগ্য অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিজয় লাভ করে সরকার পরিচালনা করেছে। 

এরশাদের আমলে বিএনপিকে ভাঙ্গার চেষ্টা হয়েছিল। আবার ২০০৭ সালের ওয়ান ইলেভেনের পরে বিএনপিতে সংস্কারপন্থী সৃষ্টি করে দলটিকে ধ্বংস করার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু সব সংকট মোকাবেলা করেই বিএনপি এগিয়েছে। এখন জিজ্ঞাসা হল এই দলের গ্রহনযোগ্যতা তথা টিকে থাকার পেছনের কারণ কি? অনেক  কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তিনটি হলোঃ (১) বহুদলীয় গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা, (২) দলের সুদৃঢ় দার্শনিক ভিত্তি রচনা করা, ও (৩)কার্যকর উন্নয়ন মূলক অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচি গ্রহণ। বাকশাল নামের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেছিল আওয়ামী লীগ, যা ব্যাপক ভাবে সমালোচিত ও নিন্দিত হয়েছে। দায়িত্ব গ্রহণের পর একদলীয় বাকশালী শাসন ব্যবস্থা থেকে বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলন জিয়াউর রহমান। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সময়েই ভারতের নির্বাসন থেকে ফিরে দলের হাল ধরেন। 

বাহাত্তরের সংবিধানে আমাদের পরিচয় “বাঙালি” হিসেবে ধার্য্য  করা হলেও রাষ্ট্র ক্ষমতা অধিষ্ঠিত হওয়ার পর জিয়াউর রহমান এই ধারনায় পরিবর্তন আনা জরুরী বলে মনে করেন। নাগরিক হিসেবে সকলের অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে জাতি হিসেবে আমাদের পরিচয় কি তা স্পষ্ট হতে হবে। তিনি বলেন, “যদি আমরা জাতীয় পরিচয় নির্ধারনের ক্ষেত্রে “বাঙালি” পরিভাষাটি ব্যবহার করি তাহলে বাংলাদেশের ভূখন্ডে বসবাসরত অবাঙালি বাংলাদেশী নাগরিকগণ (যেমন-আদিবাসীগণ) জাতীয় পরিচয়ের বলয় থেকে ছিটকে পড়বে। এটি আমাদের জাতিসত্বার একটি খন্ডিত পরিচয় তুলে ধরে। 

জিয়াউর রহমান তাই বাংলাদেশের বাঙালি ও অবাঙালিসহ সকল নাগরিকের অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্যে জাতীয় পরিচয়ের মাধ্যম হিসেবে “বাঙালির” স্থলে “বাংলাদেশী” পরিভাষা ব্যবহার করার প্রস্তাব করেন। আমাদের জাতীয় পরিচয়ের ক্ষেত্রে এ ধরনের একটি তাত্ত্বিক বিচ্যুতি দূর করার লক্ষ্যে কালক্ষেপণ না করে তিনি একে আইনি কাঠামোর মধ্যে স্থিত করেন”, ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’, জিয়াউর রহমান। বাঙালি জাতীয়তাবাদী ভাবনার তুলনায় জিয়ার রাষ্ট্র দর্শন 'বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ' অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রয়োগিক।এভাবেই জিয়াউর রহমান দলেকে 'বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী' একটি সুদৃঢ়  দার্শনিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্টিত করেছিলেন এবং একটি জাতিরাষ্ট্র তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। 

বিশিষ্ট সাংবাদিক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন,“আওয়ামী লীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনীতির নিষ্পত্তি হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার মধ্য দিয়েৃ...বায়ান্ন, ছেষট্টি , উনসত্তরের স্মৃতি নিয়ে বসে থেকে তো আর জাতিরাষ্ট্র তৈরি করা যায় না। এ জন্য প্রয়োজন ধারাবাহিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিকল্পনা, যুদ্ধ পরবর্তী সময়ের প্রয়োজনে সমঝোতা ও ঐক্যের রাজনীতি এবং জনপ্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। বলা চলে, আওয়ামী লীগ সরকার দেশের বৃহত্তর নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তের আকাঙ্খার সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি। ঐক্যের বদলে গোষ্ঠীতন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। জাতীয় ঐক্য তো দূরের কথা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রধান শক্তিটিও বিভক্ত হয়ে পড়েছিল...বাহাত্তরে প্রয়োজন ছিল নতুন রাজনীতি, নতুন কৌশল। একটি জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান তার কার্যকরিতা সম্পন্ন করেছিল। আওয়ামী লীগ এরপর পুরনো মনস্তত্ত্বের ঘেরাটোপ থেকে আর বেরিয়ে আসতে পারেনি, এর ধারাবাহিকতা চলছে আজও (মহিউদ্দিন আহমদ, বিএনপি: সময়-অসময়, ২০১৭, পৃ-১৩৪-১৩৫)।


‘উন্নয়ন মূলক অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচি গ্রহণ’ এর বিষয়টি যথাযথ ভাবে ব্যাখ্যার জন্য বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন যা এইস্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। সংক্ষেপে বললে, জিয়াউর রহমান খাল খনন, তৈরি পোশাক শিল্প রপ্তানিমুখিকরণ এবং এই শিল্প বিকাশের জন্য সর্ব প্রথম স্পেশাল বন্ডেড ওয়ারহাউজ স্কিম চালু করা, গ্রামীন ব্যাংক চালু করা, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট পদ্ধতির উদ্ভাবনসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নে নানা ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করেছেন। বিশেষ করে পোশাক শিল্প ও রেমিটেন্স, যার ওপর আজ দেশের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে, তার উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছিল জিয়াউর রহমানের আমলেই। তার সময়ে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ প্রকৃত পক্ষেই জনসাধারনের জন্য সুফল বয়ে এনেছিল। ক্ষমতায় গিয়ে চটকদার কিছু কর্মসূচি বা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুরু করে জনসাধারণকে গণতন্ত্রের দাবি থেকে সরিয়ে রাখাই হল সামরিক শাসকদের সাধারণ বৈশিষ্ট, কিন্ত জিয়াউর রহমান সেই তুলনায় ছিল এর এক অনন্য সাধারণ ব্যতিক্রমধর্মী উদাহরণ। 

জাতীয়তাবাদী দলের জনপ্রিয়তার পেছনে জিয়াউর রহমানের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিরও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রেস সচিব কাফি খান (যিনি এক সময়ে ”ভয়েজ অব আমেরিকার” সংবাদ পাঠক ছিলেন) জিয়ার সততা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, “আত্মীয় স্বজনদের কেউ কোন তদবিরের জন্য বঙ্গভবনে বা তাঁর বাসায় আসার সাহস পায়নি... তিন-চার হাজার টাকার মতো বেতন পেতেন। সেখান থেকে ১৫০ টাকা রাষ্ট্রপতির রিলিফ ফান্ডে জমা দিতেন। বাকি টাকাটা দিয়ে সংসার চালাতেন” (সৈয়দ আবদাল আহমেদের নেওয়া কাফি খানের সাক্ষাৎকার, www.bnpbd.org)। জিয়াউর রহমানের যুদ্ধ দিনের সঙ্গী ছিলেন মেজর মীর শওকত আলী। তিনি বলেন, জিয়াউর রহমানে ছিলেন স্বাধীনচেতা ও প্রখর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন । তার আশে পাশে মৌমাছির মতো অনেক চাটুকারের সমাবেশ ঘটেছিল। কিন্তু তার ছিল সজাগ দৃষ্টি। জিয়াউর রহমান মীর শওকতকে একদিন বলেছিল, ‘‘মীর, যতদিন আমাদের দেশের দশ হাজার টাউট ও চামচা নিশ্চিহ্ন না হবে, তত দিন আমাদের কষ্ট থাকবে’’ (লেপ্টেনেন্ট জেনারেল (অব) মীর শওকত আলী, যুদ্ধের কথা কষ্টের কথা, আমাদের একাত্তর, আহমদ, এম সম্পাদিত গণউন্নয়ন, গ্রন্থাগার, ঢাকা পৃষ্ঠা,৪৫)।

১৯৮১ সালের ৩০ মে চক্রান্তকারীদের হাতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান অনাকাঙ্খিত হত্যার শিকার হন। দেশ ও জাতির সংকটময় মুহূর্তে সংসারের করিডোর অতিক্রম করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেগম জিয়ার আবির্ভাব ঘটে ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি দলের প্রাথমিক সদস্য হবার মাধ্যমে। ১৯৮২ সালের শুরুর দিক থেকে দীর্ঘ নয় বছর জগদ্দল পাথরের মত ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন জেনারেল এরশাদ। বেগম খালেদা জিয়া সামরিক জান্তা এরশাদের জুলুম নির্যাতনের যাঁতাকলে পিষ্ট জাতির আরেক ক্রান্তিলগ্নে জনগনের ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন। দলের ভিতরের ষড়যন্ত্র (অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের নায়ক ছিল এরশাদের সাথে গোপনে আঁতাতকারী ‘হুদা-মতিন’ চক্র) ও দলের বাইরের ষড়যন্ত্রকে নস্যাত করে বেগম জিয়া ৭ দলীয় ঐক্যজোট তৈরি করেন। ১৯৮৩ সালের ৪ ও ৫ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ এর নেতৃত্বে গঠিত ১৫ দলীয় জোটের সাথে বৈঠক করেন এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ৫ দফা ঘোষণা দেন। ১৯৮৬ সালে সামরিক জান্তা এরশাদ তার দু:শাসনকে বৈধতা দেবার এক দূরভিসন্ধিমূলক কূট চালের অংশ হিসেবে সংসদ নির্বাচনের ঘোষনা দিলে ৭ দল ও ১৫ দল যৌথভাবে এই ষড়যন্ত্রমূলক নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ধূর্ত সামরিক জান্তা এরশাদের পাতানো নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। যদিও পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সহ অন্য দলগুলো বিএনপির সঙ্গে এসে আন্দোলনে যোগ দেয়। 


নেতৃত্বের অসাধারণ দক্ষতা ও আপোষহীন মনোভাব প্রদর্শন করে বেগম খালেদা জিয়া স্বৈরাচারী এরশাদের সামরিক শাসন বিরোধী গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনের নেতৃত্বের মূল চালিকা শক্তি হয়ে উঠেন। হরতাল, সচিবালয় ঘেরাও ও আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তিনি লাঠি চার্জ ও কাঁদানি গ্যাসে আহত হন। কোন নির্যাতন তাঁকে রুখতে পারেনি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নেতা কর্মীদের সাহস ও অনুপ্রেরণার মধ্যমণি হয়ে সকল বাধা অতিক্রম করে স্বৈরাচারী সামরিক জান্তা এরশাদ-এর কবল থেকে ১৯৯০ এর ৬ ডিসেম্বরে দেশবাসীকে মুক্ত করেছেন। এই আপোষহীন নেতৃত্বের মাধ্যমে তিনি বিএনপি-কে শক্তিশালী ও মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড় করাবার পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মের প্রত্যয়দীপ্ত ছাত্রদের বিশাল এক অংশ নিয়ে গঠিত জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলকে আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ এবং ছাত্রদের অধিকার আদায়ে লড়াকু এক ছাত্র সংগঠনে রূপান্তরিত করেন। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বরের গণ অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী এরশাদের পতনে এই আত্মবিশ্বাসী লড়াকু ছাত্রদের ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজের ভূমিকাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ১৯৯১ এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে খালেদা জিয়ার আপোষহীন নেতৃত্বের প্রতিদান স্বরূপ বিএনপি বিজয় অর্জন করে। পরবর্তীতে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিন মেয়াদে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি কিছু সেনা কর্মকর্তাসহ সেনাপ্রধান মঈন উদ্দিন ক্ষমতা দখল করেন এবং ২২ জানুয়ারি তারিখে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন বাতিল করেন। ফখরুদ্দিনের নেতৃত্বে অসাংবিধানিকভাবে সেনাসমর্থিত এক সরকার প্রতিষ্ঠা করে দেশে জরুরী অবস্থা জারী করা হয়। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে  দখলদারবাহিনী বেগম খালেদা জিয়া ও তাঁর পরিবার এবং বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে কল্পকাহিনী প্রচার শুরু করে। চাপের মুখে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার জরুরী অবস্থা বহাল রেখে নির্বাচন দেয়ার প্রস্তাব করলে বেগম খালেদা জিয়া তা প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সেই স্বৈরাচারী এরশাদের ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে ৭ দল ও ১৫ দলীয় জোটের সিদ্ধান্তকে পাশ কাটিয়ে যে প্রক্রিয়ায় শেষ মুহূর্তে অংশগ্রহণ করেছিল ঠিক সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটালো। অজ্ঞাত কারণে আওয়ামী লীগ জরুরী অবস্থার মধ্যেই নির্বাচন করার প্রস্তাব মেনে নেয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনর্বহাল করার স্বার্থে বেগম খালেদা জিয়া মঈন উদ্দিন - ফখরুদ্দিনের সেনা সমর্থিত সরকারের (যারা জিয়া পরিবার কে ধ্বংস করার জন্য বিরতিহীন ভাবে সকল প্রকার জুলুম ও নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছিল) অধীনে জরুরী অবস্থার মধ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহন করতে রাজী হননি। 

পরবর্তীতে জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার করা হলে বিএনপি জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং নানামুখী ষড়যন্ত্রের মুখে পরাজয় বরণ করে। নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। এর পর যা ঘটে যাচ্ছে তা সবার জানা। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে ভোটার বিহীন নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ ২য় ও ৩য় মেয়াদে সরকার গঠন করেছে। এ দীর্ঘ সময়ে বেগম জিয়াকে বাড়ী ছাড়া করেই তারা ক্ষ্যান্ত হয়নি, গত ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সালে  বর্তমান সরকার তাঁকে মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে কারাগারে নিক্ষেপ করেছে। মিথ্যা মামলায় তিনি এখন বন্দি। প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হলেও জামিন দেওয়া হচ্ছেনা। বেগম খালেদা জিয়া কারামুক্ত হলে বিদেশে গিয়ে যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণ করে সুস্থ হয়ে উঠবেন; তাঁর আপোষহীন নেতৃত্বে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের এই প্রাণের দাবী আদায় হবে সেই আতংকে সরকার তাঁর ওপর এই মিথ্যে মামলা-হামলা ও জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে।  

বর্তমানে গুম-খুন, নারী-শিশু নির্যাতন, অপহরণ, গুপ্তহত্যা ইত্যাদি অনাচার ও আতঙ্ক মানুষের নিত্যসঙ্গী। গণতন্ত্রের চর্চা নেই, আইনের শাসন নেই, জীবনের নিরাপত্তা নেই। জিজ্ঞাসা হল, এ অবস্থায় বিএনপি'র করণীয় কি? মূলত রাজনৈতিক সংকট রাজনীতিক ভাবেই মোকাবেলা করতে হয়। আমরা লক্ষ্য করেছি, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে বিএনপির আপোষহীন সংগ্রাম ও নেতৃতের ধারাবাহিক একটি ঐতিহ্য রয়েছে। জিয়াউর রহমান একদলীয় বাকশালী শাসন ব্যবস্থা থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করেছে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। বেগম খালেদা জিয়া স্বৈরশাসক এরশাদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে নিরলস সংগ্রাম করে 'আপোষহীন নেত্রী' হিসেবে উপাধি লাভ করেছন। আজ সময় আসছে বিএনপির নিজ দলের রচিত সংগ্রামের অতীত ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকানো এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের বিরতিহীন সংগ্রামের পুনারাবৃত্তি করা। 

এই সংগ্রামে জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের চেতনাকে অন্তরে ধারণ করে বেগম খালেদা জিয়া প্রদর্শিত আপোষহীন নেতৃত্বের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের অনুসরণে বহুদলীয় ঐক্য তৈরি করে দেশকে দু:শাসন মুক্ত করার রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা। বর্তমানে করোনা মহামারির এই দু:সময়ে জাতির প্রয়োজনে গণতন্ত্রের চর্চা পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনার জন্য আদর্শিক জোটের পাশাপাশি বহুদলীয় ঐক্য তথা রাজনৈতিক মোর্চা গঠন করা জরুরী। 

গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের কোন বিকল্প নেই। ঐক্য তথা রাজনৈতিক মোর্চা গঠন করার ক্ষেত্রে দেশে বিরাজমান বর্তমান ভয়াবহ দুরবস্থায় রাজনৈতিক মতাদর্শগত অভিন্নতা বিবেচনায় নেওয়া খুব জরুরি বিষয় নয়। বাংলাদেশের গণতন্ত্র- পুনরুদ্ধারের ইতিহাস তারই স্বাক্ষর বহন করে। সামরিক জান্তা এরশাদ বিরোধী আন্দোলন ৭ দল ও ১৫ দল যৌথভাবে করেছিল। বিএনপির নেতৃত্বধীন ১৮ দলীয় জোটের শরিক ছিল জামায়াতে ইসলামী, এটি যেমন একটি বাস্তবতা, তেমনি আওয়ামী লীগ তৎকালীন জামায়তে ইসলামীর দুই শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের সাথে মতবিনিময় করে স্বৈরাচারী এরশাদের ষড়যন্ত্রমূলক জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (১৯৮৬ সালে) অংশগ্রহণের বিষয়টিও ইতিহাসের আরেকটি অংশ। তাই বহুদলীয় ঐক্য তথা মোর্চা গঠন করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার সংগ্রামের বিরোধিতা করার যোক্তিক কিংবা নৈতিক কোন অধিকার আওয়ামী লীগ কিংবা বর্তমান সরকারের নেই, কিংবা রাখেনা। 

ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সমালোচনা কিংবা ষড়যন্ত্রের  শিকার হয়ে এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ না করা কিংবা এক্ষেত্রে বিলম্ব করা হবে ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করার শামিল। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ভবিষ্যতের বহুদলীয় রাজনৈতিক মোর্চার প্রথম শর্ত হওয়া উচিত বেগম খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য জামিন চাওয়া ও স্থায়ী ভাবে কারা মুক্তি। এই দাবী বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই। কারণ এই সংগ্রামে বিজয়ের জন্য প্রয়োজন আপোষহীন নেতৃত্ব। বাংলাদেশের ইতিহাস প্রমাণ করে, এ ধরনের নেতৃত্বের জন্য বেগম খালেদা জিয়া তুলনাহীন। 

অতীতের ন্যায় তার আপোষহীন নেতৃত্বেই নির্দলীয় সরকারের দাবী আদায় করে একটি অবাধ ও সুষ্ঠনির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব। একথা সত্য যে, বিগত একযুগ যাবৎ নিষ্ঠুরতম রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে আসছেন  বিএনপির চেয়ারপারসন ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনসহ  কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ের কর্মী -সমর্থক পর্যন্ত। কিন্তু দেশের স্বার্থে হাল ধরতে হবে। হাল ছাড়া যাবেনা, সে জন্য সাংগঠনিক ভাবে বিএনপিকে অধিকতর সক্রিয় এবং সফল হতে হবে। প্রয়োজন নেতৃত্বের পুনর্বিন্যাস ও সাংগঠনিক কার্যক্রম সক্রিয়ভাবে পরিচালনা করা। প্রত্যাশিত ইতিবাচক ফলাফল পেতে হলে, বর্তমান নেতৃত্বকে এক্ষেত্রে ধারণ ও অনুসরণ করতে হবে জিয়াউর রহমানের সেই ”বৈষম্যহীন” অথচ ”বিচক্ষন” সাংগঠনিক দৃষ্টিভঙ্গি। কর্মকান্ড ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পদায়ন ও দলের জন্য নিবেদিত এমন একধিক সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করে নেতৃত্ব সৃষ্টি করা ছিল জিয়াউর রহমানের কর্মপন্থা।

এই নীতি অনুসরণ করলেই চাটুকার কিংবা সুযোগ সন্ধানীরা দল কিংবা দেশের ক্ষতি করতে পারবেনা; মূল্যায়িত হবে পরীক্ষিত নেতা-কর্মী-সমর্থক, এবং তাদের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মাধ্যমেই গণতন্ত্র মুক্তি পাবে। বর্তমান সরকার জনগণের জান মালের নিরাপত্তা প্রদানে ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। এর অন্যতম  প্রধান কারণ হচ্ছে, দেশ গণতান্ত্রিক ভাবে পরিচালিত হচ্ছেনা। জনগণের নিরাপত্তা বিধানের জন্যই গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হবে, নির্দলীয় সরকারের দাবী আদায় করে একটি অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বর্তমান সরকারকে বাধ্য করতে হবে। তাই জনপ্রিয়, দায়িত্বশীল ও নেতৃত্ব প্রদানে ঐতিহ্যবাহী একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সর্বাত্মক সংগ্রাম রচনাই হওয়া উচিত বিএনপির ৪৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর একমাত্র অঙ্গিকার।

  • লেখক শিক্ষক দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। 


Sunday, October 17, 2021

প্রাসঙ্গিকতা

শায়রুল কবির খান

 


প্রাসঙ্গিকতা একটি চিন্তাশীল প্রশ্ন। সবকিছু প্রবাহিত হয় এবং পরিবর্তিত হয়। সবকিছু অবিচ্ছিন্নভাবে প্রায় চলমান। স্বাধীন বাংলাদেশ। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী বছর ২০২১ সাল।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সূদুর প্রসারী চিন্তার ফলেই তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। তার বাস্তবতা ভারত ও বাংলাদেশের সকল চিন্তাশীল ব্যক্তি স্বীকার করেন।

তবে পশ্চিমবঙ্গের জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সাহায্য এবং সমর্থন জানিয়ে ছিলেন। এর ঐতিহাসিক ও মনস্তাত্ত্বিক একটা কারণও ছিল। বাঙালির মনে মনে একধরনের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা ছিল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলার মুসলমানদের অবদান সবচেয়ে অগ্রগামী ছিল। এই অহঙ্কার বোধটা দুই অঞ্চলের বাংলা ভাষাভাষীদের ভাবনার মধ্যে ছিল।

স্বাধীন বাংলাদেশের সুচনালগ্নেই এই সামগ্রিক স্রোতধারায় বিচ্যুতি ঘটল, যার রেশ আজ অবধি বয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা একটা কুয়াশাচ্ছন্ন কাব্যিক দৃষ্টিতে দেখছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরবর্তীকালে অনেকের মনোভাবের একটা গুণগত পরিবর্তন হয়। যারা মনে করেছিলেন বাংলাদেশ স্বাধীন হলে এখানে একটা কল্পস্বর্গ প্রতিষ্ঠা হবে। নদীতে মধুর দুধ বইবে, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বত্র নবীনকালের রবিন্দ্রনাথ, নজরুল ও জগদীশ চন্দ্র বসুরা জন্ম গ্রহণ করতে আরম্ভ করবে। কিন্তু এর কিছুই হলো না।

বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। তাদের প্রত্যাশিত কিছুই ঘটেনি। অধিকন্ত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় মানবেতর সঙ্কট সর্বত্রই। প্রতিহিংসা পারায়ণ খুনোখুনি, অভাব, দুর্ভিক্ষ, দুর্নীতি- এসবই একটার পর একটা বেড়েই চলছে। এই আকাঙ্ক্ষা স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে রূপায়িত ছিল না।

তাদের জীবন রূপায়িত ছিল সুন্দর স্বাভাবিক একটা সমাজ ব্যবস্থা, রাষ্ট্র থাকবে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায়।

স্বাধীন বাংলাদেশের হালহকিকত দেখে পশ্চিমবঙ্গের সেই নাগরিকদের একটা অংশ আশাহত হয়েছেন, এটাই স্বাভাবিক ছিল।

বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতি পশ্চিমবাংলার শিক্ষত নাগরিকদের একটা অংশ যুগপৎ বিতৃষ্ণা ও ভালোবাসা দু’টিই পোষণ করেন। বাংলাদেশে যদি বলার মতো উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটে, তারা গলা উঁচিয়ে ঘোষণা করেন ওপার বাংলার আমার ভাইয়েো এটা করেছে, ওটা করেছে। আর যদি খারাপ কিছু হয়, তখন তারা বলতে দ্বিধা করেন না, আর কি করবে! ওরা তো সারা যুগ ধরে তাই করে আসছে। অন্য রকম কোনো একটা করবে কী করে?

নাগরিকদের যুগপৎ বিতৃষ্ণা আর ভালোবাসার মধ্যে বাংলাদেশ যদি জনগণের সপক্ষে অর্থপূর্ণ কোনো কর্মসূচি সংযোজিত হয়, তার প্রভাব ফেলবেই বিস্তৃতভাবে।

বাংলাদেশের মানুষ মনস্তাত্ত্বিকভাবেই স্বাধীনচেতা, উদার মনোভাবে ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী। এই চেতনার চিন্তা শক্তি থেকেই প্রতিবেশীদের প্রতি সবসময় সহনশীল।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারত পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া যুদ্ধে পাকিস্তানি সৈন্যের পরাজয়। 

স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার।

যুদ্ধ পরবর্তীকালে নির্বাচনে ভারতের প্রায় সবগুলো রাজ্য শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হয়।

কংগ্রেস বামপন্থী রাজনীতির প্রসার ঠেকিয়ে নিজেদের আসন ও শাসন অটুট রাখার জন্য প্রতিবেশী দেশে অনুগত সরকার প্রতিষ্ঠা করাই ছিল মূল লক্ষ্য।

আওয়ামী লীগ সরকারের একনায়কতন্ত্র দখলদারিত্বে বাংলাদেশে বামপন্থী ও ইসলামী অনুশাসনের রীতি মেনে যে রাজনীতির চর্চা আছে তার কোনো জায়গায় শক্তিশালী সংগঠন নেই। আছে একধরনের আত্মঘাতী কলহ, বঞ্চনা ও বিভক্ততা।

তার মাঝেও বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আগামীর লক্ষ্যকে স্থির রেখে রাজনৈতিক সাংগঠনিক শক্তিগুলো একটা সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐক্য বদ্ধ হবে, তেমন আশা করা কি অন্যায় হবে?

সকল রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশকে সামনে রেখে জাতীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বিবেচনায় সুস্পষ্ট রাজনৈতিক দর্শন ও সুনির্দিষ্ট একটি রাজনৈতিক কর্মসূচির ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলগুলো উপদলসমূহ ঐক্যবদ্ধ হতে পারলে অচিরেই জনগণকে জাগ্রত করে তোলা সম্ভব হবে।

সময় নষ্ট হলে এই সরকারের আগ্রাসী মনোভাবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে জনগণের আকাঙ্ক্ষা হারিয়ে যাবে। কথায় বলে ‘সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়’।

  • লেখক সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী   

Thursday, October 14, 2021

রামু ট্র্যাজেডির নয় বছর

ড. সুকোমল বড়ুয়া 



রামু ট্র্যাজেডির নয় বছর পূর্ণ হলো। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বৌদ্ধদের শুভ মধু পূর্ণিমার আগের রাতে রামু-উখিয়া-পটিয়াবাসীর বৌদ্ধদের ওপর ওই জঘন্য ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। এ ঘটনায় বিশ্বের নানা স্থানে, নানা রাষ্ট্রে, এমনকি জাতিসংঘের সদর দফতরের সামনে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।

দল-মত, জাতি-গোষ্ঠী, সম্প্রদায় এবং নানা ধর্ম-বর্ণের মানুষ সেদিন বৌদ্ধদের পক্ষে এক কাতারে দাঁড়িয়ে রাস্তায় নেমেছিল। সেদিন দেখেছি বিপন্ন মানবতার পক্ষে মানুষের সহমর্মিতা। সেই স্মৃতি বৌদ্ধরা এখনো ভোলেনি।

উত্তম বড়ুয়া নামে এক যুবকের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিথ্যা একটি স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে রামু ট্র্যাজেডির সূত্রপাত। এটি ছিল সম্পূর্ণ পরিকল্পিত, যা পরবর্তী সময়ে সরকারি-বেসরকারি নানা তদন্তেও প্রমাণিত হয়েছে। অথচ এ মিথ্যা ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেদিন শত শত বছরের প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার, স্থাপনা ও প্যাগোডা আগুন জ্বালিয়ে ধ্বংস করা হয়েছিল। আগুনের লেলিহান শিখার ধোঁয়ায় ওই জনপদ অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল। স্বর্ণ, ব্রোঞ্জ ও অষ্টধাতু নির্মিত বহু মূল্যবান বুদ্ধমূর্তি, প্রাচীন পুঁথি-পুস্তক ও পাণ্ডুলিপিসহ বৌদ্ধ কৃষ্টি-সংস্কৃতির বিভিন্ন অমূল্য সম্পদ সেদিন পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। মোট ২১টি গৃহ ভস্মীভূত হয়েছিল, যেখানে ছিল অতিদরিদ্র ও নিঃস্ব বৌদ্ধ পরিবারের বসতি।

অথচ রাত পোহালেই মধু নিয়ে বিহারে যাওয়ার কথা ছিল শত শত শিশু-কিশোর-কিশোরীসহ নানা বয়সের নারী-পুরুষের। এর মধ্য দিয়ে মধু দানোৎসবের আনন্দঘন পরিবেশ তৈরি হতো। এ দান সারা দিন চলত, বুদ্ধপূজা হতো, পঞ্চশীল-অষ্টশীল নেওয়া হতো। ভিক্ষুসংঘকে পিণ্ডদান করা হতো, প্রদীপ জ্বালানো হতো, সমবেত প্রার্থনা করা হতো, আরও কত কিছু করা হতো ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে। কিন্তু পূর্ণিমার রাতেই সব শেষ হয়ে গেল।

সরকার এ ঘটনার বিচারের আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু প্রকৃত অপরাধীদের সাজা হয়নি আজও। জানা গেছে, সে সময় কক্সবাজার ও নিকটবর্তী অন্যান্য জায়গায় যারা প্রশাসনের উচ্চপদে ছিলেন, বর্তমানে তারা পদোন্নতি নিয়ে আছেন ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে। ভস্মীভূত সেই প্রাচীন বৌদ্ধ ঐতিহ্যগুলো দেশ-বিদেশের পর্যটকদের জন্য কত মূল্যবান ও আকর্ষণীয় ছিল, তা বলাই বাহুল্য। পরবর্তী সময়ে সরকার আধুনিক নির্মাণশৈলীতে অনেক কিছু তৈরি করে দিলেও ওই প্রাচীন ঐতিহ্য আর ফিরে পাওয়া যাবে না। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্যও দেশ-বিদেশ থেকে পণ্ডিত-গবেষকরা আর আসবেন না।

বৌদ্ধদের প্রশ্ন-সেই উত্তম বড়ুয়া এখন কোথায়? জীবিত না মৃত? ওই ঘটনার বিচার দৃশ্যমান হলো না কেন? ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচার ও শাস্তি হলো না কেন? প্রশাসনের এত নজরদারি থাকতে সেদিন গানপাউডারসহ এত রাসায়নিক দ্রব্য কীভাবে, কোত্থেকে আনা হয়েছিল? গোটা কক্সবাজারের প্রশাসন সেদিন নীরব ছিল কেন? পরদিন আবার রামু, উখিয়া ও পটিয়ার কয়েকটি বিহারসহ ধর্মীয় স্থাপনা কীভাবে জ্বালিয়ে দেওয়া হলো? আমরা আর এ রকম বর্বরতা দেখতে চাই না। এ দেশ সবার। এ দেশকে অসাম্প্রদায়িক বলে দাবি করি আমরা। আমাদের প্রার্থনা-সবার শুভবুদ্ধির উদয় হোক। ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’-এ নীতি যেন আমরা সবাই পালন করি। আবারও বলতে চাই, হাজার বছরের আমাদের সম্প্রীতির বন্ধন যেন অটুট থাকে। শাস্ত্রে বলা হয়েছে-সুখ সঙ্ঘসস সামগ্গি সামগ্গনং তপো সুখো। অর্থাৎ একত্রে বসবাস করা সুখকর, একত্রে মিলন সুখকর এবং একসঙ্গে তপস্যাজনিত সর্বতো কল্যাণসাধনও সুখকর। অতএব চলুন আমরা আজ সবাই এ শিক্ষায় নিজেদের গড়ে তুলি, শান্তি-শৃঙ্খলায় এবং দেশ, সমাজ ও জাতির উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে একত্রে কাজ করি এবং ঐক্যবদ্ধ হই। সব্বে সত্তা সুখিতা ভবন্তু-জগতের সব জীব সুখী হোক। জয় হোক মানবতার। বিশ্বে শান্তি বিরাজ করুক।

লেখক সাবেক চেয়ারম্যান, পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি, বিশ্ব বৌদ্ধ ফেডারেশন-বাংলাদেশ চ্যাপ্টার 

skbaruadu@gmail.com

Sunday, October 10, 2021

দামে দিশাহারা ক্রেতা, এখন সংসার চালানোই দায় — ফাইজ তাইয়েব আহমেদ

সূত্র প্রথম আলো 



দামে দিশাহারা ক্রেতা, এখন সংসার চালানোই দায়। মূল্যস্ফীতি অসহনীয় এবং সরকারের মূল্যস্ফীতির তথ্য ডাহা মিথ্যা।

করোনাভাইরাস মহামারি মাঝামাঝি স্তর পার হবার পর থেকেই আমি বলে আসছি বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি প্রায় দুই অঙ্কের কাছাকাছি। ছবির দুটি তালিকা মিলিয়ে দেখুন, বাৎসরিক হিসেবে মূল্যস্ফীতি সরকার ঘোষিত সংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ। খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভুত উভয় মূল্যস্ফিতিই ৯% এর উপরে। অর্থাৎ সরকার ও বিবিএস এর মূল্যস্ফীতির (৪,৫% থেকে ৫%) হিসাব মিথ্যা। 

সরকারের অর্থাৎ পরিসংখ্যান ব্যুরো মূল্যস্ফীতি বের করার প্রক্রিয়াটা ভয়াবহ জালিয়াতিতে ভরা।

চালের দাম তিন মাসে কেজি প্রতি ১২ থেকে ১৫ টাকা করে বাড়লে, ভোজ্যতেলের দাম লিটার প্রতি ৩০-৪০ টাকা বাড়লে, এলপি গ্যাসের দাম সিলিন্ডার প্রতি ১৫০-২০০ টাকা বাড়লে, ঠিক কিভাবে খাদ্য ইনফ্লাশন ৫% এর মধ্যে থাকে? 

বাজার দরের যে অবস্থা, অবশ্যই মূল্যস্ফীতি দুই অংকের ঘরে অবস্থান করছে। এখানে দুটা বিষয়। প্রথমত সরকারের মূল্যস্ফীতি নির্ণয়ের কারিগরি পদ্ধতি ভুল। দ্বিতীয় হচ্ছে, সেকেলে যে পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতি নির্ণয় করা হয় তাতে পর্যাপ্ত স্যাম্পল ও পণ্য কোনটাই থাকে না।

মূল্যস্ফীতি পরিমাপের নতুন পুরানো বিভিন্ন পদ্ধতি আছে। পুরানো-ভোক্তা মূল্যসূচক (সিপিআই) পদ্ধতি থেকে নতুন এভরিডে প্রাইস ইনডেক্স বা ইপিআই পদ্ধতিতে যেতে হবে। এতে গেলে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি দ্বিগুণের বেশি দেখাবে, যা প্রকৃত বাস্তবতা।

আমি মনে করি পুরানো হলেও খোদ সিপিআই ভিত্তিক হিসাবেই বড় জালিয়াতি করে সরকার ও বিবিএস। পুরানো মূল্যস্ফীতি পরিমাপের বাস্কেটেও অনেক পণ্যই সংযুক্ত করা হয়নি। ভ্যাট নীতিমালায় দেখাবেন প্রায় এগারশত পণ্যকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। অথচ এরা সুবিধামত মাত্র কয়েকটা পণ্য দিয়ে সুবিধাজনক সময়ের আগে পরে (যখন দাম কিছুটা সহনীয় থাকে) শহরের আড়তের কাছাকাছি স্থানের কম দামের জায়গায় গিয়ে কয়েকটা মাত্র স্যাম্পল নিয়ে মূল্যস্ফীতি হিসাব করে ফেলে। অথচ একই পণ্যের খুচরা মূল্য পাড়া গ্রামে কিংবা মফস্বল অঞ্চলে বেশি। এরা এমনভাবে সার্ভে করে যাতে মূল্যস্ফীতি ৫% এর আশেপাশে দেখায় (সিলেকসান বায়াস)। এগুলা ডেটা ম্যানিপুলেটেড। যেখানে ডেটা বাড়িয়ে দেখালে সূচক ভালো দেখায় (জিডিপি, বাজেট, মাথাপিছু আয়) সেখানে এক্সেলে ইনপুট বাড়ায়ে দেখানো হয়। আর যেখানে ডেটা কমিয়ে দেখালে সূচক ভালো হয় (জনসংখ্যা, মূল্যস্ফীতি ইত্যাদি) সেখানে তথ্য চুরি করে সূচক জালিয়াতি করা হয়।

এখন আসেন, মূল জালিয়াতিটা কোথায়? মূল জালিয়াতিটা জিডিপির হিসাবে।

নমিনাল জিডিপি থেকে মূল্যস্ফীতি বাদ দিয়ে রিয়েল জিডিপি বের করা হয়। মুলত রিয়েল জিডিপি উপর দাঁড়িয়ে অর্থনৈতিক সূচক ক্যালকুলেশান করা হয়। আপনি যদি দেখেন, ক্যাবের হিসাবে খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভুত উভয় মূল্যস্ফীতিই এক থেকে দুই শতাংশ বেশি থাকে। কিন্তু অতীতে ক্যাবের সাথে সারকারের মূল্যস্ফীতি হিসাবের কখনো ৩% আবার কখনও বা ৭% পার্থক্য ছিল (২০১১ থেকে ২০১৪)। এখন আমরা যদি এক দশকের গড় বের করি তাইলে দেখবেন এই দশকে গড়ে ২,৫ থেকে ৩% মূল্যস্ফীতি কমিয়ে দেখানো আছে। এর মানে হচ্ছে এই দশকে গড়ে জিডিপিও ২,৫ থেকে ৩% বাড়িয়ে দেখানো।

এসব জালিয়াতি নিয়ে দেশের সিনিয়র অর্থনীতিবিদরা কথা বলেন না কেন? উনাদের সমস্যা কোথায়? দুর্বৃত্ত সিস্টেম বুঝায়? নাকি সরকারের হয়রানির ভয়?

এটা বলার সময় হয়ে গেছে যে রেমিটেন্সে দেয়া ২% প্রণোদনা মূল্যস্ফীতি বাড়াতে সাহায্য করছে। প্রনোদনা ১% এ নামিয়ে আনা উচিৎ। আমি আগে বলেছি, হুন্ডিদের বা পাচার কারীদের কারেন্সি কনভার্শন লস যা হয় তার কাছাকাছি থাকতে পারে প্রণোদনা। মূলত রেমিটেন্স আগমন হুন্ডির মত রিয়েল টাইম করতে পারাটাই মূল কাজ। বাংলাদেশের ব্যাংক গুলোর হাই কোর্ট দেখানোও হুন্ডির অন্যতম কারণ, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ সচল হয়ে পড়ায় হুন্ডি চক্রও সচল হয়ে রেমিটেন্স কমে যেতে শুরু করেছে। রেমিটেন্সে দেয়া প্রণোদনা কত শতাংশ হবে এই বিষয়টা গবেষণার বিষয় হয়ে গেছে।

করোনার পরে ক্যাপিটাল মেশিনারির দাম বাড়তে কিছু বেড়েছে। সে হিসাবে নতুন উৎপাদিত খাদ্য বহির্ভুত পণ্যের দাম কিছু বাড়বে। কিন্তু তাতে সংগতি থাকা চাই। আমদানিহীন দেশীয় পণ্যে আন্তর্জাতিক হারের দ্বিগুণ হারে দাম বাড়ার যুক্তি কি?

সরকারের মনিটারি পলিসি অর্থাৎ বাজারে সস্তায় মুদ্রা সরবারহের নীতি এবং করোনা প্রণোদনা প্যাকেজের নামে নতুন টাকা ছাপানোর অভিযোগ মূল্যস্ফীতির লাগামহীনতার মাধ্যমে প্রমাণিত।

যেহেতু প্রণোদনা প্যাকেজ বিনিয়োগে আসেনি, বরং কম সুদের নতুন ঋণের মাধ্যমে উচ্চ সুদের পুরানো ঋণের অদলবদল হয়েছে (তারল্য বেড়েছে)। নতুন ঋণের একটা অংশও পাচারে পড়েছে তাই ঋণের মাধ্যমে নতুন সম্পদ তৈরি হয়নি। ফলে নিশ্চিত ভাবেই এটা মূল্যস্ফীতি বাড়িয়েছে।

  • লেখক নেদারল্যান্ডসের ভোডাফোনে কর্মরত প্রকৌশলী এবং টেকসই উন্নয়নবিষয়ক বিশেষজ্ঞ। 

Saturday, October 9, 2021

মাস শেষে আমার আয় বাড়েনা কিন্তু দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ে

কামরুল আহসান নোমানী 


বাজারে ফুলকপি দেখে কেনার শখ হলো। দাম জানতে চাইলাম, বললো কেজি একদাম ১৫০ টাকা! আমি ফুলকপির সাইজের সাথে দাম মেলাতে পারলামনা। হতাশ হয়ে শীমের দিকে তাকালাম, দাম জিজ্ঞেস করার সাহস পেলামনা। কাঁচা মরিচের কেজি দুইশো টাকা। তাও ভালো তিনশো বলেনাই, তিনশো টাকা কেজিতেও এই সরকারের আমলে কাঁচা মরিচ কেনার অভিজ্ঞতা আছে। টুকটাক কাঁচা বাজার শেষে বিল আসলো পাঁচশ ত্রিশ টাকা। আমি চোখ বুজে টাকাটা দিয়ে দিলাম।

মাছের বাজারে রীতিমত আগুন। কেজিতে মোটামুটি একশ টাকার ডিফারেন্স। আমি দেড় কেজি সাইজের একটা রুইয়ের দাম জিজ্ঞেস করলাম, দাম চাইলো পাঁচশ টাকা। কাতলের দামও প্রায় কাছাকাছি। চোখের সামনে একটা নাদুস নুদুস রুই মাছ দেখা যাচ্ছে, আড়াই কেজির কম হবেনা, আমি ওটার দাম জিজ্ঞেস করার সাহস পেলামনা। অগত্যা আমাদের মত নিম্ন মধ্যবিত্তদের জাতীয় মাছ পাঙ্গাস আর তেলাপিয়ার দিকে মনযোগ দিলাম।

পোলট্রি সাদাটা কেজি একশ নব্বই, সোনালী তিনশ দশ টাকা। সোনালী আমার সাধ্যের বাইরে, নিজেকে বোঝালাম সোনালী আর সাদাতে পার্থ্যক্যই বা এমন কি, পেটে গেলে সবই এক। সাদাটা কিনতে গিয়েই তো দম বেরিয়ে যাচ্ছে।

গরুর মাংসের গলির দিকে তাকালাম এক ঝলক, তারপর ঝট করে চোখ নামিয়ে নিলাম। ওই গলি বড় লোকদের জন্যে।

ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে মুদি দোকানে ঢুকলাম। গিন্নি একটা লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছে, আমি ওটার ধারে কাছ দিয়েও গেলামনা। যেটারই দাম জিজ্ঞেস করি সেটাই দেখি গত মাসের তুলনায় কেজিতে বিশ থেকে পঞ্চাশ টাকা পর্যন্ত বাড়তি। যেগুলো না কিনলেই নয়, আমি সেগুলো দোকানীকে চোথা করতে দিয়ে বের হয়ে আসলাম। নিড সাম ফ্রেশ এয়ার।

আমি একটা নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ, মাস শেষে আমার আয় বাড়েনা কিন্তু দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ে। এই বাড়তি দামের সাথে তাল মিলাতে আমাকে প্রচুর কসরত করতে হয়। ছোটখাটো শখগুলোকে বিসর্জন দিতে দিতে এখন আর কোন শখই অবশিষ্ট নেই। আমার ধারণা আমাদের মত মধ্যবিত্ত সব ফ্যামিলিরই এরকম অবস্থা। মধ্যবিত্তরা বেঁচে আছে, না খেয়ে মরছেনা, সত্য, কিন্তু তাদের বুকচিরে বের হয়ে আসা দীর্ঘ নি:শ্বাসও কেউ শুনতে পাচ্ছেনা। এই দীর্ঘ নি:শ্বাসটুকু একান্তই তাদের নিজের।



Thursday, October 7, 2021

শহিদ আবরার ফাহাদ আধিপত্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে বাংলাদেশের মানুষের জাগরণের প্রতীক

 ফাইজ তাইয়েব আহমেদ


একচেটিয়া সীমান্ত হত্যা, অর্থনৈতিক গোলামী, বন্দর ও পানি আগ্রাসনকে নিয়ে কয়েকটি প্রশ্ন করায় আবরারকে ছাত্রলীগ নামের সন্ত্রাসীরা নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছে আজ থেকে দু বছর আগে। একচেটিয়া সামরিক ও রাজনৈতিক গোলামী, নির্বাচনী দুর্বিত্তপনা, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মানুষের জানের নিরাপত্তা, বাংলাদেশের তরুণদের কর্মসংস্থান ও অবকাঠামো, বিদ্যুৎ বন্দর ও জলসীমার নিরাপত্তাসহ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সম্পদ ও স্বার্থ লুটের সকল আয়োজনের বিরুদ্ধে আবরারের মৃত্যু একাই এক অতন্দ্র প্রহরীর সমতুল্য। শোষণ ও আধিপত্যবাদের প্রশ্নে আবরার আমাদের অনুপ্রেরণা, আমাদের আগত ও অনাগত সংগ্রামের মশাল। আবরার আমাদের নব জাগরণের তাজ।



শহিদ আবরার ফাহাদ হত্যার বিচার চাই। সাথে সাথে চাই, উনি যে আধিপত্যবাদের আগ্রাসনের প্রতিবাদ করায় খুন হয়েছেন, সে আধিপত্যবাদের আগ্রাসনকে থামানো। চাই আধিপত্যবাদের চূড়ান্ত প্রতিরোধ। ছাত্রলীগের টর্চার সেলে আবরার ভারতীয় নদী ও বন্দর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লিখার জন্য ক্ষমা চেয়ে, ফেইসবুক পোস্ট ডিলিট করে পার পেতে পারতেন। রাজি হননি বলেই দ্বিতীয় দফায় তাঁকে আমৃত্যু পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। মাফিয়া খুনীরা ক্ষমতা দখল করে আছে বলেই আজকে আবরার হত্যার বিচার প্রক্রিয়াটাকেই আটকে রাখা হয়েছে। আমরা এর নিন্দা জানাই।

আবরার বাংলাদেশের উপর একচেটিয়া ভারতীয় অর্থনৈতিক ও নদী-পানি-বন্দর-প্রাণ-পরিবেশ আগ্রাসনের বিরোধিতা করেছেন, উনার স্বপ্নের আগ্রাসন মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার শপথই তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীর বুলন্দ  শপথ হোক। আবরারের জন্য ফ্যাসিবাদের সম্মতি উৎপাদনকারী শিক্ষিত দালালদের কোন দরদ, কোন ম্রিয়মাণ মায়াকান্নার প্রয়োজন নেই। 

শহীদ আবরার,

চির উন্নত তব শির!

  • লেখক বিশিষ্ট গ্রন্থ প্রণেতা  


Wednesday, October 6, 2021

বাংলাদেশ না হোক ২০১১ নম্বর কক্ষ

ব্র্যাড অ্যাডামস, এশিয়া পরিচালক হিউম্যান রাইটস ওয়াচ

 


বাংলাদেশ শাসকদলীয় কর্মীরা ফেসবুক পোস্টের পরে একজন ছাত্র হত্যা করেছে। নিহতের নাম আবরার ফাহাদ। তার নৃশংস হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশে ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়মুক্তিকে সামনে এনেছে। দিনটি ছিল ৬ই অক্টোবর। ২১ বছরের বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ। তাকে তার কক্ষ থেকে ডেকে নেয়া হলো ২০১১ নম্বর কক্ষে। এটি ছাত্রদের কাছে একটি টর্চার সেল হিসেবে পরিচিত। এই কক্ষটি পরিচালিত হতো ছাত্রলীগের সদস্যবৃন্দের দ্বারা।

ছাত্রলীগ ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন। ওই ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পরে ফাহাদকে মৃত পাওয়া গেছে।

বুয়েট ছাত্রলীগের এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি মিডিয়াকে বলেছেন, ছাত্রলীগ কর্মীরা ছাত্রশিবিরের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা বিষয়ে ফাহাদকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন। ছাত্রশিবির হলো ইসলামী সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন। ছাত্রলীগ কর্মীরা দাবি করেছেন যে, ফাহাদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট এবং তার সেল ফোন জব্দ করার পর তারা শিবিরের সঙ্গে ফাহাদের সম্পর্কের যোগসূত্রের প্রমাণ পেয়েছেন।

সিসিটিভি ফুটেজ থেকে দেখা যায়, ছাত্ররা ফাহাদের অচেতন দেহ মধ্যরাতে ২০১১ নম্বর কক্ষ থেকে নিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের রিপোর্ট বলেছে, ফাহাদের শরীরে বিপুলসংখ্যক আঘাত করা হয়। অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে তিনি মারা যান। পুলিশ বলেছে, ২০১১ নম্বর কক্ষে তারা ক্রিকেট খেলার স্টাম্প পেয়েছেন। পুলিশের সন্দেহ এই স্টাম্প দিয়ে ফাহাদকে পেটানোর ফলে তার মৃত্যু ঘটেছে।  

এই মরণঘাতী ঘটনায় বিস্ময় নই। আওয়ামী লীগ সরকার দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগের সমর্থকদের দ্বারা সংঘটিত সহিংসতা এবং ভীতি প্রদর্শনের বিষয়ে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে চলছিলেন। ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, মিথ্যা অভিযোগে হয়রানি, নির্বাচন কেন্দ্রিক সহিংস আক্রমণ পরিচালনা এবং এমনকি ২০১৮ সালের ছাত্র প্রতিরোধ আন্দোলন দমনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহযোগী হিসেবে সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে।

হাজার হাজার ছাত্র ফাহাদ হত্যার দাবিতে প্রতিবাদ করছেন। ১৯ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেছেন ফাহাদের বাবা। পুলিশ এ পর্যন্ত ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। যাদের অধিকাংশই ছাত্রলীগের সদস্য।


কিন্তু ফাহাদ হত্যাকাণ্ড রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ক্ষমতার অপব্যবহারকারীদের বিচারের আওতায় আনতে বাংলাদেশ সরকারের অব্যাহত ব্যর্থতার একটা সুগভীর প্রতিফলন। বাংলাদেশে একটি সরকার রয়েছে, যারা নির্যাতন, গুম, নিরাপত্তা কর্মীদের দ্বারা বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের নির্বিচারে গ্রেপ্তারকে অবজ্ঞা করছে। আর এসবই এমন একটি সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে, যেখানে ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একটি ‘টর্চার সেল’ পরিচালনা করতে পারে।

বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষসমূহের উচিত হবে একটি ব্যাপকভিত্তিক, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছতার সঙ্গে ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত পরিচালনা করা এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো।

 বাংলাদেশকে অবশ্যই ২০১১ নম্বর কক্ষে পরিণত হতে দেয়া উচিত নয়।


হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ওয়েবসাইট থেকে। অক্টোবর ১২, ২০১৯, দৈনিক মানবজমিনে প্রকাশিত।