Search

Friday, January 31, 2020

উৎসব ও উৎকণ্ঠার ভোট

সাখাওয়াত সায়ন্ত

ঢাকার দুই সিটিতে ভোটের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, ভোটকেন্দ্রিক উৎসব ও উৎকণ্ঠা ততই বাড়ছে। প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা দেখে মনে হচ্ছে উৎসবটা বেশ জমে উঠেছে। এত পোস্টার, এত মাইকিং, ভোটারদের আকৃষ্ট করতে এত নির্বাচনী গান-প্যারোডি আগের কোনো নির্বাচনে হয়েছে বলে মনে হয় না। শহরের প্রতিটা অলিগলি-পাড়া-মহল্লা ছেয়ে গেছে পোস্টারে। যদিও এই পোস্টার প্রতিযোগিতায় অনেক এগিয়ে সরকারি দলের প্রার্থীরা। এই অতিপ্রচার নিয়ে বিশেষ করে শব্দদূষণ নিয়ে অনেকে বিরক্ত।

নির্বাচনী প্রচারে প্রার্থী ও তাদের দলীয় সমর্থকদের উৎসব দেখা গেলেও এই উৎসব ভোটারদের উৎকণ্ঠা কাটাতে পেরেছে বলে মনে হয় না। ভোট কেমন হবে এই প্রশ্নটি যেকোনো সাধারণ ভোটারকে জিজ্ঞেস করলেই তারা কেমন যেন এক রহস্যময় হাসি দিয়ে এর উত্তর এড়িয়ে যান।

পোস্টার, মাইকিং, গানবাজনা, ঢোলবাদ্যের আড়ালে ঢাকা পড়া এই যে ভোটারের উৎকণ্ঠা তা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে আলোচনা হয়েছে কমই। নিজেরা বেশি প্রচার চালিয়ে, বিরোধী দলকেও কিছুটা সুযোগ দিয়ে নির্বাচনকে উৎসবমুখর বানানোটাও আওয়ামী লীগের কোনো বিশেষ কৌশল কি না সেটা জানা যাবে আর দুদিন পরই। প্রচারের ডামাডোলের আড়ালে তাদের কী কৌশল লুকিয়ে আছে, সেই উৎকণ্ঠা থেকেও মুক্ত নয় শহরবাসী।

সাধারণ ভোটারের পাশাপাশি এই নির্বাচনে অংশ নেওয়া দুই প্রধান দলের উৎকণ্ঠাও কম নয়। সিটি নির্বাচন নিয়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই শিবিরের উৎকণ্ঠা দুই ধরনের। আওয়ামী লীগের উৎকণ্ঠা কী নিয়ে তা বুঝতে হলে এই সংবাদ শিরোনামগুলো মনে রাখাই যথেষ্টÑ ‘মেয়র জেতাতে মরিয়া আওয়ামী লীগ’ (দেশ রূপান্তর), ‘আ.লীগের ভাবনায় শুধুই জয়’ (প্রথম আলো)। এই প্রতিবেদনই বলে দেয় আওয়ামী লীগ কোনোভাবেই হারতে চায় না এই নির্বাচনে। যেকোনোভাবে জিততে মরিয়া দলটি। তারা মনে করছে, ঢাকার মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গার এই নির্বাচনে তারা হারলে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তার গল্পের বেলুন ফুটো হয়ে যাবে। এতে করে মনোবল ভেঙে যাবে তাদের নেতাকর্মীদের। আর মাত্র এক বছর আগে নগণ্যসংখ্যক ভোট ধরিয়ে দিয়ে বিদায় করা বিএনপি এখন জিতে গেলে আগের নির্বাচনগুলোর বিষয়ে আওয়ামী লীগের আর বলার কিছু থাকে না। এই নির্বাচনে বিজয়ী হলে বিএনপির নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা হতে পারে। তারা সংগঠিত হওয়ার সুযোগ নিতে পারে। সামনের স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে তারা রুখে দাঁড়াতে পারে। আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হতে পারে। এইসব উৎকণ্ঠা আছে আওয়ামী লীগের।

কিঞ্চিৎ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন আওয়ামী লীগ অবশ্য মনে করে, ঢাকা সিটি নির্বাচনে হেরে গেলেই সরকারের পতন হবে, এমন তো নয়। তাই নির্বাচন ব্যবস্থা যে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এবং তার পুরোটা দায় আওয়ামী লীগের কাঁধে তা থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘোরাতে এই নির্বাচনটি সুষ্ঠু সুন্দর গ্রহণযোগ্য করা উচিত। একাদশ জাতীয় নির্বাচন তাদেরকে যে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে তার বিপরীতে তারা এই নির্বাচনকে উদাহরণ হিসেবে দেখিয়ে বলতে পারবে যে এই সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়। এই ফর্মুলা প্রয়োগ করেই হয়তো অনেকে বলছেন, ঢাকা দক্ষিণে যেকোনোভাবে জয় কেড়ে নেবে আওয়ামী লীগ। আর কিছুটা সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে উত্তরে হারার ঝুঁকি নিতেও পারে আওয়ামী লীগ। কারণ হিসেবে এই গ্রুপটা মনে করছে, শেখ পরিবারের ছেলে তরুণ নেতা তাপসকে এমপি থেকে পদত্যাগ করিয়ে সিটি নির্বাচনে নামানো হয়েছে, পরাজয় মেনে নেওয়ার জন্য নয়। ব্যারিস্টার তাপস নিজেও বলেছেন, হারার জন্য সংসদ থেকে পদত্যাগ করে নির্বাচনে আসিনি। কিন্তু পুরান ঢাকার সন্তান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইশরাক হোসেনকে হারিয়ে অভিজাত ধানম-ি থেকে আসা তাপসকে জেতাতে যে বেগ পেতে হতে পারে, তা ঢাকতে উত্তর সিটিতে পরাজয়ের ঝুঁকি নেবে কি তারা? আ.লীগ তখন বলতে পারে, সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে উত্তরে বিএনপি জিতল কীভাবে?

কিন্তু এই দুই গ্রুপের বাইরেও আরেক গ্রুপ আছে যারা কোনো যুক্তিতেই আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করতে নারাজ। তারা মনে করে, আওয়ামী লীগের নির্বাচনকেন্দ্রিক লজ্জাশরম ভেঙে গেছে অনেক আগেই। আর মাত্র দুদিন পরেই জানা যাবে আওয়ামী লীগকে নিয়ে কোন গ্রুপের ধারণা সঠিক হয়।

আসলে ঢাকা সিটি নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ আছে উভয় সংকটে। তারা সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে হারলেও বিপদ। কারচুপি করে জিতলেও বিপদ। কেউ মনে করতে পারেন, কত নির্বাচনে কত রকম জালিয়াতিই তো করা হলো। তাতে কী এমন বিপদটা হয়েছে? বিএনপি তো কিছুই করতে পারল না! তারা হয়তো ভাবে না, জাতির সামনে ভোট ডাকাতি প্রমাণিত হলে সেটাও কম ক্ষতি নয় দলটির জন্য। তাই ঢাকা সিটি নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের উৎকণ্ঠা উভয়মুখী ও ব্যাপক।

অন্যদিকে এই নির্বাচন নিয়ে বিএনপির উৎকণ্ঠা আওয়ামী লীগের মতো নয়। বিএনপির উৎকণ্ঠার জায়গাটা যে কী তাও বোঝা যায় দেশ রূপান্তরের শিরোনাম থেকেইÑ ‘পুলিশের জেনে ফেলার ভয় : গোপনে এজেন্ট তালিকা করছে বিএনপি’। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বিএনপি জানে, এই নির্বাচনে তাদের যতটুকু প্রচারের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, সেটা লোক-দেখানো হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আগের নির্বাচনগুলোতে বিএনপিদলীয় পোলিং এজেন্টদের ভয় দেখিয়ে, গ্রেপ্তার করে কীভাবে কেন্দ্রগুলো ধানের শীষের এজেন্টশূন্য করা হয়েছিল তা জানে বিএনপি। তাই দলটির সবচেয়ে বড় উৎকণ্ঠাটি পোলিং এজেন্ট নিয়ে। একটা দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা কতটা ভেঙে পড়লে, একটা সরকার বিরোধী দলের প্রতি কতটা নিপীড়নমূলক হলে বিএনপির মতো একটি বড় দলের  পোলিং এজেন্টের তালিকা করতে হয় গোপনে! কেন্দ্রে শক্তভাবে দলীয় এজেন্ট না থাকলে যে ভোটাররা ভোট দিতে অস্বস্তি বোধ করেন তা তো সবারই জানা। অভিযোগ আছে, সরকারদলীয় এজেন্ট ও প্রশাসনের লোকজন ভোটারদের বাধ্য করেন তাদের সামনে ভোট দিতে। আবার কোথাও আরও এক ডিগ্রি এগিয়ে ভোটারকে কষ্ট না দিতে তার ভোটটি তারাই দিয়ে দেন বলেও জানিয়েছেন অনেক ভুক্তভোগী। তাই বিএনপির প্রথম ও প্রধান উৎকণ্ঠা, এত ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে দলীয় এজেন্টরা কেন্দ্রে থাকবেন কি না সেটা নিশ্চিত করা।

বিএনপির দ্বিতীয় উৎকণ্ঠা ইভিএম নিয়ে। ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে, বিরোধী দলকেও কিছুটা প্রচারের সুযোগ দিয়ে, আপাতদৃষ্টিতে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন দেখিয়ে ইভিএম কারসাজি করে ফলাফল পাল্টে নৌকাকেই বিজয়ী ঘোষণা করা হবে কি না সে উৎকণ্ঠাও আছে বিএনপির। ঢাকা সিটি নির্বাচনকে সামনে রেখে ইভিএমের বিরোধিতা করে দলটি একাধিক আলোচনা অনুষ্ঠানের মূলে আছে ইভিএম জালিয়াতি নিয়ে উৎকণ্ঠা।

বিএনপি মনে করে, সরকার মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদের যেভাবে অপমান-অপদস্ত করেছে তার জবাব তারা সুযোগ পেলে ভোটের মাধ্যমে দেবে। কেননা গুম, খুন, মানবাধিকার হরণ, গণতন্ত্র ধ্বংস, শেয়ারবাজার লুট, ব্যাংক লুট, দুর্নীতি, বিদেশে টাকা পাচার, অনিয়ন্ত্রিত দ্রব্যমূল্যসহ এত কিছু নিয়ে জনগণের ক্ষোভ আছে যে, তার জবাব সাধারণ ভোটাররা নিশ্চয়ই ভোটের মাধ্যমে দেবে। তাছাড়া এই শহরটাকে বসবাস উপযোগী রাখতে না পারা, ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, জলাবদ্ধতাসহ অনেক বিষয়েও ঢাকার মানুষ মহাবিরক্ত এই সরকার ও তাদের মেয়রদের ওপর। এই শহরটি যানজটে পৃথিবীর নিকৃষ্ট, বসবাসের উপযোগিতার বিচারেও নিকৃষ্ট। বায়ুদূষণে পৃথিবীর সেরা। নারীর জন্য অনিরাপদ নগরীর তালিকায়ও চতুর্থ। আরও কত সব কলঙ্কতিলক এই শহরের কপালে জুটেছে। দক্ষিণের নৌকার প্রার্থী তাপসও বলেছেন, অচল ঢাকাকে তিনি সচল ঢাকা বানাবেন।

টানা এগারো বছর দেশের ক্ষমতায় ও প্রায় অর্ধযুগ সরকারদলীয় মেয়র থাকার পরও ঢাকা অচল নগর হয়ে থাকা, ঢাকার কপালে  এত কলঙ্ক লেপন করা, ঢাকাকে মানুষের জন্য অনিরাপদ নগরী বানিয়ে রাখার কথা মানুষ ভুলবে না। অন্যদিকে জনগণের করের টাকা শহরবাসীর সেবায় ব্যবহার না করে লোপাট করাও মানুষ ভুলবে না। তাদের যে মানুষ ভোট দেবে না, এটা শুধু বিএনপি কেন অনেকেরই ধারণা। তাই ভোটপ্রাপ্তি নিয়ে বিএনপির উৎকণ্ঠা কম। শুধু ভোটারদের কেন্দ্র পর্যন্ত নিতে পারলেই হলো। বিএনপির উৎকণ্ঠা সরকার ও তাদের অনুগত নির্বাচন কমিশনের জালিয়াতির আশঙ্কা নিয়ে।   

এই উৎকণ্ঠা নির্বাচনের ফলাফল না আসা পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে, নাকি ভোট চলা অবস্থায়ই পরিষ্কার হয়ে যাবে সেটা আসলে কার ওপর নির্ভর করে? এ প্রসঙ্গে সিটি নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেছেন ‘এজেন্টদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। যাদের পোলিং এজেন্ট নিয়োগ করা হয়েছে তাদের ভোটের দিন ভোটকেন্দ্রে পাঠানো হবে। বাকিটা নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর। প্রধানমন্ত্রী কেমন নির্বাচন চান তা ভোটের দিন স্পষ্ট হবে।’

মানুষ হয়তো সব সময় জালিয়াতি প্রতিরোধ করতে পারে না। কিন্তু জালিয়াতদের ঘৃণা করতে পারে অনায়াসে। সেই ঘৃণাও এক সময় জালিয়াতদের কঠিন পতনের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

  • লেখক-চিকিৎসক ও কলামনিস্ট/ 
  • কার্টসি - দেশ রূপান্তর / জানুয়ারি ৩১, ২০২০ 

Wednesday, January 29, 2020

আপনি ভোট দিতে আসছেন তো?

আলী রাবাত

আমি ভোটার। কবে যে ভোটার হয়েছিলাম তাও মনে নেই। প্রতিবারই ভোট কেন্দ্রে যাই। কখনও ভোট দেই, কখনও দেই না। ভোট না দিয়ে বাড়ি ফিরে আসি। বলা হয়, আমার ভোট নাকি দেয়া হয়ে গেছে। তারপরও আমার মধ্যে ভোটের কৌতূহল, আকুতি। একধরনের আনন্দ কাজ করে।

নিকট অতীতে ভোট দিতে গিয়ে শুনলাম রাতেই নাকি হয়ে গেছে। একদল লোক কেন্দ্রের সামনে  জটলা করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এরা নাকি ভোট দেয়ার জন্য লড়াই করছে। বাস্তবে তা কিন্তু নয়। এটা এক ধরনের কৌশল। ভিন্নমতাবলম্বী ভোটাররা যাতে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না পারে, এটা সে কৌশলেরই অংশ। সব কৌশলের শেষ কথা হচ্ছে ভোটারকে কেন্দ্রমুখী হতে না দেয়া। আগের রাতে এজেন্টকে ভয়ভীতি, কিংবা গ্রেপ্তারের ভয় দেখানো পুরনো কৌশল।

এখন কৌশল হচ্ছে এজেন্টদের মাইক্রোবাসে তুলে ৬৫ কিলোমিটার দূরে ফেলে আসা। আইনের লোকেরা এই কাজটি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করছে। কেউ প্রতিবাদ জানায়, কেউ জানায় না। বলে, এটাও নাকি আধুনিক ভোটের অংশ। এসব জেনেও আমি ভোট দিতে যাবো। এবারতো মেশিনে ভোট। যদিও আমি জানি না কীভাবে ভোট দেবো? এখানেও নাকি গায়েবি ভোটের সুযোগ আছে। তা কী করে সম্ভব! দু’বার বোতাম টিপতে হয়। একবার টিপলে ছবি আসবে। তখন সটান দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি বলবে, আপনার ভোট হয়ে গেছে। ভোটার যেই ঘুরে দাঁড়ালেন তখনই ভোট গেল এক নির্দিষ্ট মার্কায়। এটা নাকি মেশিনের কেরামতি। এ নিয়ে দেশজুড়েই সরস আলোচনা। এই রাজধানীতে নানা গুঞ্জন, মেশিনও কি তাদের দমাতে পারবে না? যারা গায়েবি ভোটে বাজিমাত করতে চায়।

অনেকে বলেন, ওসব বাজে কথা। দেশে দেশে এ মেশিন বাতিল হয়ে গেছে। পাশের দেশে চালু থাকলেও জালিয়াতির পথ বন্ধ করেছে। আমাদের এখানে বাতিল মাল চালু করার জন্য কী যে প্রাণান্তকর চেষ্টা। নির্বাচন কমিশনতো মরিয়া। তাদের মরিয়া হতে হবে দু’  কারণে। এক. উপরওয়ালারা চায় তাই এটা চালু করতে হবে। অন্য কারণ বলবো না। বলে নিজের বিপদ ডেকে আনবো নাকি? বাংলাদেশে যারা এ মেশিনের জনক তারা নীরব কেন? বুঝতে পারি না। বুঝার কী দরকার। না বুঝলেও চলে। বেশি বুঝতে গেলেইতো বিপদ। রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। কৌতূহলবশত পঞ্চাশোর্ধ এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা ভাই আপনি কি ভোট দিতে যাবেন? তার জবাব শুনে একদম আক্কেল গুড়ুম। ভোট দিতে হয় নাকি! আপনি কেন্দ্রে না গেলেও ভোট হয়ে যায়। ফলাফলতো আগেই জানা যায়। বললাম ভাই, এবারতো যন্ত্রে ভোট হচ্ছে। হেঁসে দিয়ে বললেন, তাহলেতো ষোলকলা পূর্ণই হয়ে গেল। টকশো শুনেতো তাই মনে হচ্ছে।

বেশিরভাগ টকশোপ্লেয়ার নানা ছলচাতুরি আর অনিয়মের কথা বলছেন। কী রকম সেটা? সেদিন শুনলাম, ভোট গণনার সময় নাকি মেশিন একমুখী হয়ে যায়। কম্পিউটারে নাকি প্রোগ্রামিং করা  থাকে। এজন্য কিছু অস্থায়ী স্টাফ নিয়োগ করা হয়েছে। তাদের প্রশিক্ষণ চলছে। চোখ কান খোলা রাখলেই জানতে পারবেন। ভোটের পরিবেশ আপাতত ভালো। ২৪ ঘণ্টা পার হলেই অন্য এক পরিবেশ দেখা যাবে। সেটা আবার কী? পুরনো মামলার সুবাধে চলবে ব্যাপক অভিযান। এর ফলে মামলাহীন লোকেরাও পালাবে। এতোসবের কী দরকার। আরে ভাই এসব না করলে শান্তি বিরাজ করবে, ভোটাররা কেন্দ্রমুখী হবে।

আর কেন্দ্রমুখী হলেই সব হিসাব নিকাশ যাবে ওলটপালট হয়ে। তাহলে ভোটের দরকার কি? সিলেকশন পদ্ধতিতে গেলেই তো সব সমস্যার সমাধান। কাড়িকাড়ি টাকা বাঁচবে। খুনখারাবি হবে না। পরিবেশও দূষণ হবে না। শুধু সমস্যা হবে কাগজওয়ালাদের। ওরা তখন কী লিখবে? ভিডিও ফুটেজতো ইশারায় হাওয়া করে দেয়া যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেতো প্রতিদিনই চমকপ্রদ খবর আসে। তাতে কি? মানুষতো ওসব বিশ্বাস করে না। এতোকিছুর পরও আমি ভোট দিতে যাবো। আমাকে ভোট দিতেই হবে। আসুন সবাই মিলে কেন্দ্রে যাই। নিজের ভোট নিজে দিয়ে অধিকার প্রতিষ্ঠা করি। আপনি আসছেন তো?

  • কার্টসি - মানবজমিন/ জানুয়ারি ২৯, ২০২০ 

Tuesday, January 28, 2020

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে রক্তের রাখিবন্ধন

রুমিন ফারহানা

‘সীমান্তে গরু আনতে গিয়ে নিহত হলে দায় নেবে না সরকার’ বাংলাদেশের বর্তমান সরকার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে যে কারোরই মনে হতে পারে এই কথাটি কোনো ভারতীয় কর্মকর্তা বলেছেন। কিন্তু না, কথাটা বলেছেন বাংলাদেশের খাদ্যমন্ত্রী। ২৩শে জানুয়ারি নওগাঁর পোরশা উপজেলার দুয়ারপাল সীমান্ত এলাকায় বিএসএফ জওয়ানদের গুলিতে তিন বাংলাদেশি নিহত হন। পোরশা সীমান্ত খাদ্যমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা বলে ২৫শে জানুয়ারি সাংবাদিকরা এ ব্যাপারে মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি ওই বক্তব্য দেন।
রুমিন ফারহানা

২০১৭ সালে একটি সীমান্ত হত্যা বাংলাদেশের মিডিয়ায় প্রচণ্ড ভাইরাল হয়েছিল। গোবিন্দ গৌতম নামের এক নেপালি যুবক ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের হাতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন। এরপর ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল (ভারতের যেকোনো মন্ত্রীর চাইতে বেশি ক্ষমতাবান মানুষ ইনি) বিষয়টি নিয়ে নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দহলের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করেন। নিহত হওয়ার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন দোভাল।

নিহতের পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করেন এবং ওই বিষয়ে তদন্তের জন্য নেপাল সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন দোভাল। নানা বিবেচনায় আমাদের চেয়ে দুর্বল রাষ্ট্র নেপালের ক্ষেত্রে ভারত যা করলো আমাদের ক্ষেত্রে কেন করে তার ঠিক উল্টোটা, এটা এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

সীমান্ত হত্যা নিয়ে গত জুলাইয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি বলেন, ‘সীমান্ত হত্যা বাড়ার কারণ সীমান্তবর্তী এলাকার কিছু লোকের বেপরোয়া আচরণ। তাদের ব্যাপারে বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) ও বিএসএফ’র প্রতিবদেন একই। তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা চলছে।’

বিজিবি’র পক্ষ থেকেও একই ধরনের কথা বলা হয়েছে বারবার। ২০১৬ সালে তৎকালীন বিজিবি প্রধান স্পষ্টভাবে জানান ‘গরু চোরাকারবারি বন্ধ না হলে সীমান্ত হত্যা বন্ধ সম্ভব নয়’।

যুক্ত করছি সীমান্ত হত্যা সম্পর্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যও ‘সীমান্ত হত্যা বন্ধে ঢালাওভাবে ভারতকে দোষারোপ না করে আমাদের নিজেদেরও দায়িত্বশীল হতে হবে। আর যারা মারা যাচ্ছে, তাদের অধিকাংশই চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত।’

সর্বশেষ গতকাল আলোচিত বাংলাদেশের খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ’র গুলি করে বাংলাদেশিদের হত্যা বন্ধ করতে হলে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই বলে মনে করেন। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছি আমরা, এই বক্তব্যগুলোর একটা কমন প্যাটার্ন আছে।

প্রতিটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পর ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের যে গল্প আমরা শুনি তাতে আমাদের এটা জানানো হয় মৃত ব্যক্তির নামে কয়টি এবং কী ধরনের মামলা আছে। জনগণের কাছে এটা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয় যেহেতু এই ব্যক্তির নামে এই ধরনের অভিযোগ আছে, সেহেতু তাকে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে মেরে ফেলা যায়।

ঠিক তেমনি সীমান্ত হত্যা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের উঁচু পদে অসীনদের প্রত্যেকটা বক্তব্যে এটা প্রমাণ করার চেষ্টা আছে যেহেতু কিছু বাংলাদেশি সীমান্তে গরু চোরাচালান এবং অবৈধ অনুপ্রবেশের সঙ্গে জড়িত, সেহেতু সে সব মানুষকে বিএসএফ গুলি করে মেরে ফেলতে পারে।

ধরে নেয়া যাক কিছু বাংলাদেশি গরু চোরাচালান কিংবা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ভারতে প্রবেশ করে। সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য পৃথিবীর আর সব দেশের মতো ভারতেও আইন আছে। আমাদের কেউ যদি অবৈধ অনুপ্রবেশ করেই থাকে তাহলে তাদের আইনের আওতায় নেয়াই একটা সভ্য রাষ্ট্রের পদক্ষেপ হওয়া উচিত। যদিও বিএসএফ নানা সময়ে এই হত্যার পেছনে একটা যুক্তি তুলে ধরার চেষ্টা করে। তারা বলে শুধুমাত্র বিএসএফ আক্রমণের শিকার হলেই পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে তারা সীমান্তে গুলি করে। ব্যাখ্যাটা পরিচিত লাগছে না? হ্যাঁ, এটাই সেই ওত পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে এবং পুলিশও চালায় পাল্টা গুলি... এই গল্পের এই ভারতীয় সংস্করণ এটা।

অসাধারণ মানবিক কোনো সরকারের কথা বাদই দেই ন্যূনতম আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন কোনো সরকার যদি এই দেশে ক্ষমতায় থাকতো তাহলে তারা ভারতের সরকারকে খুব শক্তভাবে জানিয়ে দিতে পারতো কোনো বাংলাদেশি যদি কোনো কারণে ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশ করে তাহলেও তাকে কোনোভাবেই বিএসএফ হত্যা করতে পারে না। সেই সরকার ভারতকে জিজ্ঞেস করতো প্রাণঘাতী নয় এমন অস্ত্র ব্যবহার দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা হলেও ভারত সেটা কেন সেটা মেনে চলছে না? সেটা এই সরকার করছে না, এমনকি চুপ থাকছে না। বরং সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের লোকজন এমন সব কথা বলছে যেটা এই ধরনের সীমান্ত হত্যার একটা শক্ত নৈতিক ভিত্তি তৈরি করে দেয়।

এমন সময়ে সীমান্তে বাংলাদেশিদেরকে হত্যা করা হচ্ছে যখন সরকার দলীয় সাধারণ সম্পাদক বলেন, বাংলাদেশ-ভারত রক্তের রাখিবন্ধনে আবদ্ধ দেশ। কিংবা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথামতো ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর মতো সম্পর্ক বিরাজমান। এমন সম্পর্কের মধ্যেই আওয়ামী লীগের ১১ বছরে প্রায় ৩৫০ জন, গত বছর ৪৩ জন আর এই বছর এখন পর্যন্ত ১৫ জনকে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী।

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ ছাড়া স্থলসীমান্ত আছে পাকিস্তান, চীন, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমারের। চীন ভারতের চাইতে অনেক বড় শক্তি, পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমা আছে, এসব বিবেচনায় এই দুইটা দেশকে সরিয়ে রাখা যাক। কিন্তু বাকি দেশগুলো এমনকি বাংলাদেশের তুলনায় নানা দিক থেকে দুর্বল রাষ্ট্র। এইসব দেশের সীমান্তে ভারতের সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে মৃতের সংখ্যা শূন্য। বাংলাদেশ সরকারের লজ্জা হওয়া উচিত।

গোবিন্দ গৌতমের মৃত্যুর পর ভারতকে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল, কারণ সে সময় নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্পকমল দহল কারো করুণায় ক্ষমতায় আসেননি এবং ক্ষমতায় টিকে থাকেননি। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় থাকা দহল জনগণকে নিয়ে এই নৃশংসতার প্রতিবাদ করেছিলেন। সেই নৈতিক শক্তি তার ছিল। ঠিক এখানেই বাংলাদেশ সরকারের খামতি।

আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেনা-পাওনা বিষয়টি খুব জরুরি। ভারত বাংলাদেশ থেকে কি পেয়েছে তা খুব স্পষ্ট হয়ে যায় প্রধানমন্ত্রীর এক উক্তিতে। তিনি বলেছেন, ভারতকে যা দিয়েছি, সেটি তারা সারা জীবন মনে রাখবে। প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য এই দেয়ার বদলে ৫৪ অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, তিস্তা চুক্তি, বাণিজ্য বৈষম্য, সীমান্তে কাঁটাতার, শুল্ক-অশুল্ক বাধা, রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের পক্ষ নেয়া, সিএএ এবং এনআরসি’র নামে বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ পুশইন করার হুমকিসহ আরো অসংখ্য প্রতিবন্ধকতার বাইরে যা পেয়েছে বাংলাদেশ তা হলো ভারতের প্রত্যক্ষ মদতে জনগণের ম্যান্ডেটহীন একটি সরকার এবং সীমান্তে বাংলাদেশিদের রক্তাক্ত লাশ।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যথার্থই বলেছেন ভারতের সঙ্গে রক্তের রাখিবন্ধনে আবদ্ধ বাংলাদেশ। তার কথা ‘মুক্তিযুদ্ধে ভারতের যে সংহতি তা বাংলাদেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ।’ এর সঙ্গে সহমত পোষণ করেই বলছি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির ফল হিসেবে নিয়মিত যে লাশ পড়ে তা ভারতের সঙ্গে আরেক রক্তাক্ত রাখিবন্ধন তৈরি করে, এবং সেটাও ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়েই থাকবে। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না।

  • লেখক: সংসদ সদস্য
  • কার্টসি - মানবজমিন/ জানুয়ারি ২৮, ২০২০ 

Monday, January 27, 2020

চাকরির বাজারে ভারতীয়দের আধিপত্য দেশের বেকার তরুণদের কী হবে

কামরুল হাসান দর্পণ

দেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রটি ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। বেকার থেকে যাচ্ছে লাখ লাখ কর্মোপোযোগী মানুষ। সরকারি হিসেবে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখের মতো হলেও এ সংখ্যাটি নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, দেশে বেকারের সংখ্যা কয়েক কোটি। যে হারে কর্মসংস্থান হওয়ার কথা, সে হারে না হওয়ায় এ সংখ্যা ক্রমবর্ধমানহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে বছরে ২২ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। এদের মধ্যে কাজ পায় মাত্র ৭ লাখ। এর মধ্যে শিক্ষিত-অশিক্ষিত বেকার রয়েছে। পত্রপত্রিকার হিসাব অনুযায়ী, দেশে উচ্চ শিক্ষিত বেকার প্রায় পৌনে এক কোটি। প্রতি বছর এর সাথে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন বেকার। তথ্য অনুযায়ী, কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় মাধ্যম বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান শতকরা ৯৫ ভাগ বেকারের কর্মসংস্থান করে। এর মধ্যে এককভাবে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান করছে পোশাকশিল্প। এ খাতে প্রায় ৪০ লাখ লোক কাজ করছে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সরকারি সংস্থার অবদান মাত্র ৫ শতাংশ। অবশ্য দেশি এসব পরিসংখ্যানের সাথে বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার হিসাবের মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান পরিলক্ষিত হয়। বছর পাঁচেক আগে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-এর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ৩ কোটি। কয়েক বছরের মধ্যে তা দ্বিগুণ হবে। যা মোট জনসংখ্যার ৩৯.৪০ শতাংশ হবে। হিসাবটি কয়েক বছর আগের হলেও এর যে খুব পরিবর্তন হয়েছে, তা বলা যায় না। বরং বেকারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এর সাথে নতুনভাবে যুক্ত হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ও মালয়েশিয়া থেকে ফেরত আসা শত শত শ্রমিক। শুধু এসব দেশ থেকেই নয়, যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকেও মানুষ দেশে ফিরছে। ফলে দেশের বেকারত্বের হারের সাথে তারাও যুক্ত হচ্ছে। লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে বিদেশ যাওয়া হতাশ এসব মানুষ দেশে ফিরে কী করবে, কোথায় কর্মসংস্থান হবে, তার নিশ্চয়তা নেই। এই যখন পরিস্থিতি তখন পত্র-পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, দেশে বিদেশি কর্মী কাজ করছে প্রায় সাড়ে ১০ লাখ। এর মধ্যে শুধু ভারতেরই রয়েছে প্রায় ৫ লাখ। এছাড়া চীন, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ডসহ উন্নত বিশ্বের কর্মীও রয়েছে। এরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচ্চ বেতনে কর্মরত। বিশেষ করে গার্মেন্ট শিল্প-কারখানায় বিভিন্ন উচ্চপদে এরা কাজ করছে। সিপিডির এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, এ খাতের ১৩ শতাংশ বা ৪০০ কারখানায় বিদেশি কর্মীরা কাজ করছে। আর এ খাতসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বিদেশিরা দেশ থেকে বছরে নিয়ে যাচ্ছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এসব তথ্য-উপাত্ত এখানে তুলে ধরার কারণ হচ্ছে, আমাদের দেশে যেখানে কোটি কোটি বেকার নিদারুণ দুঃখ-কষ্ট ও হতাশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, সেখানে অবলীলায় বিদেশিরা এ দেশ থেকে বিপুল অংকের অর্থ নিয়ে যাচ্ছে। চাকরির বাজারে ক্রমশঃ তাদের আধিপত্য। অথচ দেশে শিক্ষিত-অশিক্ষিত কোটি কোটি বেকারের কর্মসংস্থান হচ্ছে না। দেশে বিদেশিদের এই বিপুল কর্মসংস্থানের চিত্র দেখে বিস্মিত এবং দুঃখিত না হয়ে পারা যায় না।

দুই.
রেমিটেন্স নিয়ে আমাদের গর্বের সীমা নেই। প্রতি বছরই রিজার্ভ হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ফুলে ফেঁপে উঠছে। তবে এই রিজার্ভের যোগানদাতা যে তরুণ, তার জমিজমা, বসতবাটি বিক্রি করে বিদেশে গিয়ে যে দিন-রাত হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটছে, তাতে আমাদের সরকারের ভূমিকা কতটুকু? সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দূতাবাসগুলো প্রবাসী শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখছে? বরং আমরা দেখছি, এক্ষেত্রে সরকারের তেমন জোরালো কোনো উদ্যোগ নেই। বলা হয়, অবৈধভাবে বা বৈধ কাগজপত্র ছাড়া বিদেশ গিয়ে অনেকে বিপদে পড়ছে এবং ফেরত আসছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যেমন করেই হোক, যারা বিদেশ গিয়ে পৌঁছেছে, সরকার কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে তাদের বৈধ করার উদ্যোগ নিতে পারে। দুঃখের বিষয়, সরকারের তরফ থেকে এ ধরনের উদ্যোগ দেখা যায় না। আমরা জানি, কর্মক্ষম এবং কর্মস্পৃহ অনেক তরুণ নিজ প্রচেষ্টায় ঝুঁকি নিয়ে বিদেশ-বিভূঁইয়ে যায়। এখনও যাচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, একটি দেশের মানুষ আরেকটি দেশে গিয়ে মুটে-মজুরের কাজ করে অর্থ উপার্জন করে দেশে পাঠাবে, আর তা নিয়ে সরকার গর্ব করবে, এটা কতটা সীচীন হতে পারে? মর্যাদাশীল কোনো জাতি চাইবে না, তার দেশের মানুষ বিদেশ গিয়ে দিন-মজুরের কাজ করুক। খুপড়ি ঘরে গাদাগাদি করে থাকুক। সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিকরা তাদের নিচু দৃষ্টিতে দেখে বলুক অমুক দেশের ফকির-মিসকিন। আমাদের দেশ থেকে যেসব তরুণ কামলা খাটতে যায়, কোনো কোনো দেশ তাদের এই দৃষ্টিতেই দেখে। অথচ রাষ্ট্রের সম্মান রক্ষার্থে তরুণদের কর্মসংস্থান দেশে করার ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া উচিত। তা করতে না পারার ব্যর্থতা যে রাষ্ট্রের, তা সরকার ভাবে বলে মনে হয় না। আমরা উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়া নিয়ে গর্ব করছি। আগামী দশ বছরে দেশে একজনও বেকার থাকবে না বলে ঘোষণা দিচ্ছি। কিন্তু বেকারত্ব কমানোর কোনো উদ্যোগ নিতে পারছি না। উল্টো প্রবাসীদের আয় নিয়ে উচ্ছ¡সিত হচ্ছি। রেমিট্যান্স নিয়ে সরকার ক্রেডিট নিচ্ছে। অথচ প্রবাসে যেসব শ্রমিকের মৃত্যু হয়, নীরবে লাশ হয়ে দেশে ফেরে এবং পরবর্তীতে তাদের পরিবার কী ধরনের দুর্দশায় পড়ে, সারকারকে এ ব্যাপারে দায়িত্ব নিতে দেখা যায় না। মৃত্যুবরণকারী প্রবাসী শ্রমিক যে রাষ্ট্রের কোষাগার সমৃদ্ধ করতে ভূমিকা রেখে গেল, তার স্বীকৃতিটুকুও দেয়া হয় না। এটা প্রবাসী শ্রমিকদের দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে! বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, দেশে এখন প্রায় চার কোটির বেশি মানুষ দরিদ্র সীমার মধ্যে রয়েছে, যা মোট জনসংখ্যার ২৪.৪৭ শতাংশ। বিশ্ব ব্যাংকের হিসাব মতে যে ব্যক্তির দৈনিক আয় ১.২৫ ডলার বা প্রায় ৯৭ টাকা সে দরিদ্র। এ হিসাবে দেশের ৪ কোটিরও বেশি মানুষ দৈনিক এ আয় করতে পারছে না। তারা দরিদ্র রয়ে গেছে। এর সাথে বেকার বা যার কোনো আয় নেই তা যুক্ত করলে দেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী দারিদ্র্য সীমার মধ্যে রয়েছে। যে তরুণ বেকার, বাবা-মায়ের উপর নির্ভরশীল, সে তো আরও দরিদ্র। অথচ সরকারের মধ্যে এ প্রবণতা দেখা যায়, দেশের মানুষ খুব সুখে-শান্তিতে আছে। এটা যে শুভংকরের ফাঁকি, তা স্বীকার করে না। সরকার তাদেরকেই গণনায় ধরছে যাদের আয় আকাশ ছোঁয়া। তাদের উন্নতিকে উন্নয়নের মাপকাঠি মনে করছে। এই খÐিত উন্নয়নকেই সরকার ব্যানার আকারে তুলে ধরে বলছে, আমরা অনেক উন্নতি সাধন করছি। অবশ্য সরকার দেশে বেকারের সংখ্যা কম দেখাবে, এটাই স্বাভাবিক। বেকারের সংখ্যা বেশি দেখানোর অর্থ তার ব্যর্থতা। কোনো সরকারই এই ব্যর্থতা দেখাতে চায় না। বেকারের সংখ্যা নিরূপণে যদি বেকার নিবন্ধনের ব্যবস্থা থাকত, তাহলে হয়ত বেকারের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যেত।

তিন.
যে দেশে চার কোটি মানুষ দরিদ্র সীমা অতিক্রম করতে পারেনি এবং কোটি কোটি বেকার থাকে, সে দেশ অর্থনৈতিকভাবে দ্রæত উন্নতি করছে, এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন। সরকারের কথা মতো যদি উন্নয়নের চাকাটি তরতর করে এগিয়ে যেত, তাহলে এতো মানুষ দরিদ্র ও বেকার থাকাত না। কর্মসংস্থানের এই আকালের মধ্যে যদি বিদেশিরা এসে হানা দেয়, তাহলে কোটি কোটি বেকারের দুঃখ ঘুচবে কি করে? নিবন্ধের শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রায় ১০ লাখ বিদেশি কাজ করছে। এদের বেশির ভাগই কর্মকর্তা পর্যায়ের। তাদের একেক জনের বেতন পাঁচ বাংলাদেশী কর্মকর্তার মোট বেতনের চেয়েও বেশি। অর্থাৎ এক বিদেশি কর্মকর্তা পাঁচ জন দেশীয় কর্মপ্রত্যাশীর জায়গা দখল করে রেখেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গার্মেন্ট খাতে ২০ হাজার বিদেশি কর্মী কাজ করছে। তাদের বেতন গার্মেন্ট খাতে দেশীয় শ্রমিকের মোট বেতনের প্রায় অর্ধেক। এ থেকে বোঝা যায়, বিদেশি কর্মীরা এদেশ থেকে কী পরিমাণ অর্থ নিয়ে যাচ্ছে। বিদেশিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ দেয়া হয়েছে ভারতীয়দের। 

সিপিডি’র এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় ৫ লাখ ভারতীয় কাজ করছে। তারা বছরে ৩.৭৬ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা তাদের দেশে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ দেশটির পঞ্চম রেমিট্যান্স প্রদানকারী দেশ। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, একদিকে আমাদের তরুণরা বিদেশে গিয়ে চরম প্রতিকূল পরিবেশে থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা দেশে পাঠাচ্ছে, অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে বিদেশিরা হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে। পার্শ্ববর্তী ভারত বাংলাদেশকে তার অন্যতম শীর্ষ রেমিট্যান্স আহরণকারী দেশে পরিণত করেছে। যেখানে বাংলাদেশে কর্মক্ষম বেকার উপচে পড়ছে, সেখানে বিদেশিদের এই আধিপত্যকে সরকার অবলীলায় মেনে নিচ্ছে। এক্ষেত্রে নীতিমালা থাকলেও তা যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে না। দুঃখজনক হচ্ছে, যোগ্য বাংলাদেশী চাকরিপ্রার্থী থাকা সত্তে¡ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিদেশিদের নিয়োগ দেয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশী কর্মী ছাঁটাই করে বিদেশিদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে বলে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এ ধারণা বদ্ধমূল, বিদেশিদের নিয়োগ দিলে তাদের প্রেস্টিজ বাড়ে। তাদের এ মানসিকতা যে দেশকে দেশের কর্মক্ষম বেকারদের উপহাস করা, তা তাদের বিবেচনায় নেই। তাদের মধ্যে এ বোধটুকু কাজ করছে না, যদি দেশের একজন বেকারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়, তবে দেশের অনেক বড় উপকার হয়। একজন বেকারের কর্মসংস্থানের কারণে একটি পরিবার দারিদ্র্যমুক্ত হয়। দেশের অর্থনীতি গতি লাভ করে। দেশের টাকা দেশে থেকে যায়। তাদের এ মানসিকতা দেশপ্রেমহীনতা ছাড়া কী বলা যেতে পারে? তারা এটা মনে করে না, আমাদের দেশ মধ্যপ্রাচ্য বা ইউরোপ-আমেরিকার মতো উন্নত দেশ নয় যে, বাইরের দেশ থেকে শ্রমিক আমদানি করে কাজ করাতে হবে। যেখানে আমাদের দেশের শিক্ষিত-অশিক্ষিত বেকার তরুণরা উন্নত দেশে মজুরের কাজ করার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশ যাচ্ছে, সেখানে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদেশিদের চাকরি দেয়া কি তাদেরকে উপেক্ষা, উপহাস ও অবহেলা করা নয়? আমাদের বিদেশিপ্রীতি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এ বোধ কে জাগাবে? বাংলাদেশে বিদেশি কর্মকর্তা ও কর্মচারি যে নিয়োগ করা যাবে না, তা নয়। বিনিয়োগ বোর্ড একটি নীতিমালা করে দিয়েছে। নীতিমালায় বলা আছে, একজন বিদেশি নিয়োগ দিতে হলে তার বিনিময়ে পাঁচজন বাংলাদেশি নিয়োগ দিতে হবে। পাশাপাশি এ কথাও বলা আছে, নিযুক্ত বিদেশি নাগরিকের কাজের ক্ষেত্রে বাংলাদেশিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করে বিদেশিকে বিদায় করে দিতে হবে। নীতিমালা যথাযথভাবে করলেও, বিদেশিদের নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো তার কোনো তোয়াক্কা করছে না। বিনিয়োগ বোর্ড বা সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানও এ নীতিমালা অনুসরণ করছে কিনা, তা তদারকি করছে না। করলে এভাবে স্বেচ্ছাচারি মনোভাব দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশি কর্মী নিয়োগ দিতে পারত না। 

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের হিসাবে, বাংলাদেশে অবস্থানকারী বৈধ বিদেশি আছেন ১ লাখের উপরে। অথচ বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে বিদেশি আছে প্রায় ১০ লাখ। এদের বেশিরভাগ ট্যুরিস্ট ভিসায় এলেও তাদের মূল লক্ষ্য কাজ করা। ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার কয়েক দিন আগে ছুটি নিয়ে দেশে গিয়ে নতুন করে আবার ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে আসে। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো লাখ লাখ বিদেশিকে নিয়োগ দিয়ে একদিকে যেমন হাজার হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে চলে যাওয়ার পথ তৈরি করে দিচ্ছে, তেমনি বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের পথটিকেও রুদ্ধ করে দিচ্ছে। বিদেশি চাকুরেদের এই অবাধ সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া যে দেশের বেকারত্বের হার অধিক বাড়িয়ে দেয়া এবং যুব সমাজকে হতাশার দিকে ঠেলে দেয়া, তা কেউই আমলে নিচ্ছে না।

চার.
বিশ্বের কোনো দেশই বেকারত্ব থেকে মুক্ত নয়। উন্নত বিশ্বেও বেকারত্ব রয়েছে। তবে তাদের বেকারত্ব আর আমাদের দেশের মতো উন্নয়নকামী দেশের বেকারত্বের ধরণ এক নয়। সেখানে সরকারিভাবে বেকারদের ভাতা দেয়ার নিয়ম রয়েছে। যদিও সেসব দেশের বেকাররা এ ভাতা নেয়াকে অসম্মানজনক মনে করে। আবার ইউরোপের বেশ কিছু দেশ আছে, যাদের জনশক্তি কম এবং কাজ করার মতো পর্যাপ্ত লোকবলের অভাব রয়েছে। তারা অন্যদেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি আমদানি করে। আমাদের দেশে দক্ষ জনশক্তির অভাব থাকলেও কর্মক্ষম বিপুল জনগোষ্ঠী রয়েছে। এদের বেশিরভাগই তরুণ। বলা যায়, তারুণ্যে ভরপুর একটি দেশ। 

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তরুণ জনগোষ্ঠীর এ সুবিধা যদি কাজে লাগানো যায়, তবে বাংলাদেশ দ্রæত অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করবে। এই জনগোষ্ঠীকে বোঝায় পরিণত না করে কাজে লাগানোর সব ধরনের ব্যবস্থা দ্রæত গ্রহণ করতে না পারলে এ সম্পদ হারিয়ে যেতে সময় লাগবে না। সরকারের এদিকে তেমন মনোযোগ আছে বলে মনে হয় না। বলার অপেক্ষা রাখে না, কর্মসংস্থানের মূল ক্ষেত্র হচ্ছে বিনিয়োগ। এর মাধ্যমে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা ও অন্যান্য ক্ষেত্র গড়ে তোলা হয়। বিনিয়োগের এ ক্ষেত্রটি বিগত কয়েক বছর ধরে ঋণাত্মক পর্যায়ে রয়েছে। সরকার মুখে মুখে বিনিয়োগের প্রাচুর্যের কথা বললেও বাস্তবতা হচ্ছে, নতুন শিল্প-কারখান গড়ে উঠা দূরে থাক, বিদ্যমান অনেক কারখানা বিশেষ করে গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কর্ম সংস্থানের সবচেয়ে বড় খাত গার্মেন্টের শত শত কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে বলে ইতোমধ্যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বেকার হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। বিদ্যমান বেকারের সংখ্যার সাথে কর্মচ্যুত বেকার যুক্ত হয়ে বেকারত্বের মিছিলটিকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ করে তুলছে। এই বেকারদের অনেকে হতাশ হয়ে আত্মহত্যা থেকে শুরু করে মাদকাসক্তি ও সন্ত্রাসের পথ বেছে নিচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে পরিবারিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা। বেকাররা পরিণত হচ্ছে পরিবার, সমাজ ও দেশের বোঝায়। এই বেকারের দেশই আবার কোনো কোনো দেশ তাদের আয়ের অন্যতম উৎসে পরিণত করেছে। কেবল আমরাই পারছি না, এ মরুদ্যান রক্ষা করতে। ইচ্ছাকৃতভাবে বিদেশিদের হাতে তা ছেড়ে দিচ্ছি। একদিকে জনশক্তি রপ্তানি করছি, অন্যদিকে আমদানি করছি। আমাদের বেকার তরুণরা একটি চাকরির সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরছে, বিদেশ যাওয়ার জন্য সর্বস্ব বিক্রি করছে, অন্যদিকে আমাদেরই প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশিদের নিয়োগ দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে চলে যাওয়ার রাস্তা করে দিচ্ছে। এ অবস্থা যদি চলতে থাকে, তবে আমরা যে উন্নতির কথা বলছি, তা মানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েই থাকবে। দেশের বেকারত্বের রাশ টেনে ধরতে সরকারকে অবশ্যই এ দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বিদেশি নিয়োগের ক্ষেত্রে নীতিমালা কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান বিদেশিদের নিয়োগ দিচ্ছে, তাদেরও দেশের বেকারত্বের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। দেশ প্রেমের পরিচয় দিয়ে দেশের মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। দেশের টাকা দেশে রেখে অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে হবে।

  • কার্টসি - দিনকাল/ জানুয়ারি ২৪, ২০২০ 

দ্রব্যমূল্যে পিষ্ট নিম্ন আয়ের মানুষ

সাঈদ শিপন

দুই সন্তানের জনক রিকশাচালক মিরাজ। পরিবার নিয়ে ভাড়ায় থাকেন রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রিকশা চালিয়ে দিনে তার আয় হয় ৬০০-৭০০ টাকা। এ টাকা দিয়েই মেটাতে হয় পরিবারের চার সদস্যের ভরণ-পোষণসহ অন্যান্য খরচ।

মাসে টিন শেডের দুই রুমের ভাড়া ৮ হাজার টাকা। পরিবারের চার সদস্যের জন্য মাসে চাল লাগে দুই হাজার টাকার ওপরে। মাছ-মাংস বাদেই কাঁচাবাজারের পেছনে খরচ হয় আরও প্রায় তিন হাজার টাকা। সব মিলিয়ে সংসার চালাতে তার মাসে খরচ হয় ১৫ হাজার টাকার ওপরে।

খরচের এই লাগাম টেনে স্কুল পড়ুয়া দুই সন্তানের চাহিদা খুব একটা পূরণ করতে পারেন না মিরাজ। এরপরও স্বপ্ন দেখেন ছেলে-মেয়েকে মানুষের মতো মানুষ করবেন। সংসার ও ছেলে-মেয়ের খরচের ঘানি টানতে বেশিরভাগ দিনই দুপুরে না খেয়ে কাটিয়ে দেন তিনি।

মিরাজ বলেন, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রিকশা চালিয়ে যে আয় করি তা দিয়ে কোনো রকমে সংসার চলে। চাল, ডাল, তেল, চিনির যে দাম স্ত্রী, ছেলে, মেয়ের মুখে তিন বেলা খাবার তুলে দেয়াই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি নিজে দুপুরের খাবার ছেড়ে দিয়েছি। তারপরও খরচের হিসাব মিলাতে পারি না।

শুধু মিরাজ নয়, রাজধানীতে বসবাস করা একটি বড় অংশেরই জীবনযাত্রার চিত্র এটি। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে অনেক কর্মজীবীই দুপুরে ভাত খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। গত এক সপ্তাহে রাজধানীতে বসবাসরত রিকশাচালক, বীমাকর্মী, বেসরকারি চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার কমপক্ষে ৩০ জনের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে, এ বিষয়ে গত এক সপ্তাহে এ প্রতিবেদক যাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাদের প্রত্যেকেই বলেছেন, মাসে এক থেকে দুই বারের বেশি মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। এদের মধ্যে ১৫ জন জানিয়েছেন তারা দুপুরে ভারি খাবার ছেড়ে দিয়েছেন। ১০ জন জানিয়েছেন মাসের খরচ মেটাতে অন্যের কাছ থেকে অর্থ ধার করেছেন।

বেসরকারি একটি জীবন বীমা কোম্পানিতে অফিসার পদে কাজ করেন রায়হান। তিনি জানান, পরিবারসহ দুই সন্তান নিয়ে গোপীবাগের একটি ভাড়া বাসায় তার বসবাস। দুই সন্তানই স্কুলে পড়ে। বড় ছেলে পঞ্চম শ্রেণীতে এবং ছোট সন্তান তৃতীয় শ্রেণীতে।

তিনি বলেন, সারা মাসে যে আয় করি সংসার চালাতেই তার সব খরচ হয়ে যায়। মাস শেষে কোনো টাকাই জমা থাকে না। আর গত কয়েক মাস ধরে যে হারে খাদ্য দ্রব্যের দাম বাড়ছে তাতে ঠিকমত সংসার চালানোই দুরুহ হয়ে পড়ছে। গরুর মাংস খাওয়া অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি। মাঝে মধ্যে ব্রয়লার মুরগি কেনা হয়। তবে মাসে ২-৩ দিনের বেশি নয়।

রায়হান আরও বলেন, মাংসের কথা বাদ দিন। ঠিকমত সবজিও কিনে খাওয়ার উপায় নেই। এই শীতের মধ্যেও সব সবজির দাম চড়া। একটি ফুলকপি কিনতে ৩০ টাকার ওপরে লাগে। টমেটোর কেজি ৫০ টাকার ওপরে। পেঁয়াজের কেজি ১০০ টাকা। এতো দামে পছন্দ মতো সবজি কিনে খাওয়া সম্ভব নয়।

একটি গার্মেন্টস কারাখানার কর্মী মিলা থাকেন রামপুরার একটি টিন শেডের বাসায়। কারখানা থেকে মাসে বেতন পান ১২ হাজার টাকা। বাসা ভাড়া দিতে হয় ৫ হাজার টাকা। বাকি টাকা দিয়ে নিজের খাওয়া ও অন্যান্য খরচ মিটিয়ে গ্রামের বাড়িতেও প্রতি মাসে কিছু টাকা পাঠাতে হয় তাকে।

এই গার্মেন্টসকর্মী বলেন, মাসে যে বেতন পাই, তা দিয়ে কোনো রকমে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছি। বেশিরভাগ দিন দুপুরে কিছু খাই না। মাঝে মধ্যে বেশি ক্ষিধে লাগলে সিঙ্গারা অথব বিস্কুট খেয়ে কাটিয়ে দেই। আমরা যে কী কষ্টে আছি তা বলে বোঝাতে পারবো না ভাই। মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি অনেক আগেই। আলু, ভর্তা-ডিম ভাজি দিয়ে পেট ভরে ভাত খাব তারও উপায় নেই। এক কেজি চাল কিনতে লাগে ৪০ টাকা। একটি ডিমের দাম ৯ টাকা। আলুর কেজি ৩০ টাকা। এবার আমার কী অবস্থা, তা একটু চিন্তা করেই বুঝে নেন।

বেড়েই চলেছে চাল, ডাল, তেল, চিনির দাম

সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, এক মাস আগের তুলনায় প্রায় ৫ শতাংশ বেড়ে বর্তমানে এক কেজি সরু চালের দাম দাঁড়িয়েছে ৫০-৬০ টাকা। মোটা চালের দামও মাসের ব্যবধানে বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ। বর্তমানে প্রতিকেজি মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৩৩-৩৫ টাকায়।

চালের পাশাপাশি আটা, তেল, ডাল, চিনিসহ সব ধরনের নিত্য পণ্যের দাম বেড়েছে। মাসের ব্যবধানে আটার দাম কেজিতে ১৩ শতাংশ বেড়ে ২৬-৪৫ টাকায় উঠেছে। খোলা সয়াবিন তেলের দাম প্রায় সাড়ে ৬ শতাংশ বেড়ে প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ৯০-৯৫ টাকা। পাম অয়েলের দাম ১৩ শতাংশ বেড়ে হয়েছে প্রতিলিটার বিক্রি হচ্ছে ৮৫-৯০ টাকা। মসুর ডালের দাম প্রায় সাড়ে ৮ শতাংশ বেড়ে প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ৬৫-১৩০ টাকায়। এক কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৬৬ টাকা।

মসলার বাজার গরম

পেঁয়াজের অস্বাভাবিক দাম এখনো ভোগাচ্ছে দেশবাসীকে। রাজধানীর বাজারগুলোতে ১০০ টাকার নিচে মিলছে না দেশি নতুন পেঁয়াজের কেজি। আমদানি পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০-৮০ টাকা। টিসিবির হিসাবে, বছরের ব্যবধানে দেশি পেঁয়াজের দাম ৩১১ শতাংশ এবং আমদানি করা পেঁয়াজের দাম ২১১ শতাংশ বেড়েছে। রসুনের দাম বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৮৭ শতাংশ। বর্তমানে আমদানি করা রসুন কেজি ১৩০-১৫০ টাকা এবং দেশি রসুন ১৪০-২০০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। এক মাস ধরেই রসুনের এমন চড়া দাম।

শুকনো মরিচের দাম মাসের ব্যবধানে ১৪ শতাংশ এবং বছরের ব্যবধানে সাড়ে ৪২ শতাংশ বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২২০-৩৫০ টাকা কেজি। আদার কেজি বিক্রি হচ্ছে ১১০-১৫০ টাকা। বছরের ব্যবধানে এ পণ্যটির দাম বেড়েছে ১৮ শতাংশ। জিরার দাম বছরের ব্যবধানে ৪ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৩৫-৪৫০ টাকা কেজি। দারুচিনির দাম ৩৪ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৪২০-৪৫০ টাকা কেজি। আর এলাচের দাম বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণ বেড়ে ৫ হাজার টাকা কেজি হয়েছে।

স্বস্তি নেই সবজিতে

শিম, টমেটো, গাজর, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শালগমসহ শীতের সবজি বাজারে ভরপুর থাকলেও বেশিরভাগ সবজির দাম এখনো বেশ চড়া। শসা ৪০-৬০ টাকা, পেঁপে ৪০-৬০ টাকা, করলা ৫০-৭০ টাকা, দেশি পাকা টমেটো ৪০-৬০ টাকা, শিম ৪০-৫০ টাকা, গাজর ৪০-৫০ টাকা, মুলা ২০-২৫ টাকা, নতুন গোল আলু ২৫-৩০ টাকা, শালগম ৩০-৪০ টাকা, বেগুন ৪০-৫০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। শীতের অন্যতম সবজি ফুলকপি ও বাধাকপি বিক্রি হচ্ছে ৩০-৩৫ টাকা প্রতি পিস।

আয়-ব্যয়ের তথ্য

গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৬ সালের খানা (একই রান্নায় খাওয়া এবং একসঙ্গে বসবাস) আয়-ব্যয় জরিপে উঠে এসেছে, খানাপ্রতি মাসিক আয় দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৯৪৫ টাকা, যা ২০১০ সালে ছিল ১১ হাজার ৩৫৩ টাকা। অর্থাৎ ছয় বছরের ব্যবধানে খানাপ্রতি মাসিক আয় বেড়েছে ৪ হাজার ৫৯২ টাকা বা ৪০ শতাংশ হারে।

অপরদিকে ২০১৬ সালের হিসাবে খানাপ্রতি মাসিক ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৯১৫ টাকা, যা ২০১০ সালে ছিল ১১ হাজার ২০০ টাকা। অর্থাৎ ছয় বছরের ব্যবধানে খানাপ্রতি ব্যয় বেড়েছে ৪ হাজার ৭১৫ টাকা। ব্যয় বৃদ্ধির এ হার ৪২ শতাংশ।

এরপর বিবিএস’র খানা আয়-ব্যয়’র আর কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ২০১৬ সালের তুলনায় বর্তমানে ব্যয়ের পরিমাণ যে বেশ বেড়েছে তা সহজেই বোঝা যায়। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে, ২০১৯ সালে ঢাকার মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬ শতাংশ। আগের বছরেও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির হার একই ছিল। এ হিসাবে দুই বছরে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ১২ শতাংশের ওপরে।

  • কার্টসি - জাগো নিউজ/ জানুয়ারি ২৪ , ২০২০ 

Wednesday, January 22, 2020

ভালো নেই ঢাকার মানুষ

আবু সালেহ সায়াদাত

দুর্বিষহ যানজট, লাগামহীন বাসা ভাড়া, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, গণপরিবহন সংকট, পয়ঃনিষ্কাশনে জটিলতা, বিষাক্ত বাতাস, দূষিত পরিবেশ, ভেজাল খাবার- সব মিলিয়ে রাজধানীবাসীকে প্রতিদিনই দুর্ভোগ, দুর্দশা আর বিড়ম্বনা পোহাতে হচ্ছে। এসব সমস্যা রাজধানীবাসীর সুখ প্রতিনিয়ত কেড়ে নিচ্ছে। হতাশ হতে হতে এখন অনেকেই বিষণ্নতায় ভুগছেন। সার্বিক বিবেচনায় ভালো নেই রাজধানীর মানুষ।

সম্প্রতি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) বার্ষিক গবেষণা সম্মেলনের অধিবেশনে একটি প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয়, রাজধানীর বাসিন্দাদের মধ্যে আয়ের বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। ধনী-গরিবের আয়ের বিপুল বৈষম্য প্রভাব ফেলছে রাজধানীবাসীর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার ওপর। রাজধানীর ৭১ শতাংশ মানুষ বিষণ্নতায় ভুগছে। ৬৮ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত।

২০১৯ সালের জুন-জুলাইয়ে রাজধানীতে বাস করা ১২ হাজার ৪৬৮ জন মানুষের ওপর সমীক্ষা চালানো হয়। সেখানে দেখা যায়, ঢাকার ১৭ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। অর্থনৈতিক কারণে তাদের অনেকে বস্তিতে থাকেন। অনেকের বসবাসের সংস্থান নেই। এছাড়া নগরীর যানজট, বাতাসের মান, বিশুদ্ধ পানির অভাবসহ আরও কিছু সমস্যার কারণে রাজধানীতে বাস করা মানুষের মধ্যে বিষণ্নতা বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যান্ত্রিক শহরে বাস করায় জীবনযাত্রাও অনেকটা যান্ত্রিক হয়ে পড়েছে। সবাই শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবছে। পারস্পরিক সুখ-দুঃখে কেউ কাউকে তেমন পাশে পায় না। একটা সময় মানুষ একাকিত্ব অনুভব করে হতাশ হচ্ছে। পাশাপাশি অল্পতেই ধৈর্যহারা এবং মেজাজ আরও খিটখিটে হচ্ছে। সামান্য কথায় একে অপরের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ছে।

রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা ইমরান আলী একজন বেসরকারি চাকরিজীবী। যানজটের কারণে মিরপুর থেকে পল্টন মোড়ে তার অফিসে আসতে প্রতিদিন প্রায় দেড়-দুই ঘণ্টা সময় লাগে। অফিস শেষে ফেরার সময়ও একই অবস্থা। ইমরান আলী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘প্রতিদিন এত দীর্ঘ সময় যানজটে বসে থেকে অফিসে পৌঁছানোর পর একটুতেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়, কোনো কাজ ভালো করে করতে পারি না। মনে হয়, সবার মেজাজ সব সময় চড়া থাকছে, কেউ কিছু বললেই ক্ষেপে উঠছে।’

রাজধানীর মানুষ কেন এত খিটখিটে মেজাজের হচ্ছে, কেনই-বা তাদের মনোবৈকল্য বাড়ছে- এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, বসবাসের অযোগ্য এবং বায়ুদূষণের নগরীতে পরিণত হয়েছে ঢাকা। যানজট, জলাবদ্ধতা, দূষণ, খাদ্যে ভেজাল, সামাজিক নিরাপত্তা- সবকিছু মিলিয়ে প্রতিটি বিষয় এমন একটি জায়গায় পৌঁছেছে যে মানুষ মানসিক ও স্বাস্থ্যগত দিক থেকে ভালো নেই।

তিনি বলেন, ঢাকার রাস্তায় একটি সাধারণ বাহনে গন্তব্যে যেতে ১০ মিনিট সময় লাগার কথা কিন্তু এক ঘণ্টা বা দেড় ঘণ্টা লাগছে। তখন মানুষের মধ্য এক ধরনের চাপ তৈরি হয়। এ চাপ তার শরীরের মধ্যে কতগুলো হরমন (রাসায়নিক পদার্থ) নিঃসরণ করে যেটি তার হৃদপিণ্ড, নাড়ির গতি ও ব্লাড পেসার বাড়িয়ে দেয়। হার্ট, ফুসফুস, শরীরের সামগ্রিক অবস্থার ওপর এক ধরনের নেতিবাচক চাপ সৃষ্টি হয়। সবকিছু মিলিয়ে মানুষ ভালো থাকতে পারে না। ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।

ডা. লেলিন চৌধুরী আরও বলেন, সামগ্রিক দূষণ ক্যান্সারের ঝুঁকি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। খাদ্যে ভেজালসহ অন্যান্য কারণে কিডনি নষ্ট হওয়া থেকে শুরু করে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। একই সঙ্গে বায়ু ও পরিবেশ দূষণ, সামাজিক অনিরাপত্তা মানুষের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ তৈরি করছে। যেটা তাকে প্রতিনিয়ত দহন করছে। বসবাসের অনুপযোগী এ শহরে আসলে কেউ ভালো থাকতে পারছে না।

জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ

সম্প্রতি কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাত্রার ব্যয়বিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ২০১৯ সালে আগের বছরের তুলনায় দেশি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৪৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। আমদানি করা পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৭১ দশমিক ১১ শতাংশ। সবমিলিয়ে ২০১৯ সালে ঢাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ এবং পণ্য ও সেবার দাম বেড়েছে ৬ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। বৃদ্ধির এ হার আগের বছরের চেয়ে বেশি।

রাজধানীর ১৫টি খুচরা বাজার ও বিভিন্ন সেবার মধ্য থেকে ১১৪টি খাদ্যপণ্য, ২২টি নিত্য ব্যবহার সামগ্রী ও ১৪টি সেবার তথ্য পর্যালোচনা করে ক্যাব এ হিসাব করেছে। এ হিসাব শিক্ষা, চিকিৎসা ও প্রকৃত যাতায়াত ব্যয়বহির্ভূত।

বেতনের সিংহ ভাগই যাচ্ছে বাসা ভাড়ায়

জরিপ অনুযায়ী, রাজধানীতে প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ ভাড়া বাসায় থাকেন। ভাড়া বাসার এমন চাহিদা দেখে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই বাড়ির মালিকরা ভাড়ার বাড়তি বোঝা চাপিয়ে দেন ভাড়াটিয়াদের কাঁধে। জানুয়ারি এলেই ভাড়া বৃদ্ধির খড়গ নামে ভাড়াটিয়াদের ওপর। যে কারণে তাদের বেতনের সিংহ ভাগই চলে যাচ্ছে বাড়ি ভাড়া দিতে।

অন্যদিকে ক্যাবের বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, ২০১৯ সালে উচ্চবিত্তের বাড়ি ভাড়া কিছুটা কমলেও নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের বাড়ি ভাড়ায় বাড়তি খরচ করতে হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে বস্তিঘরের ভাড়া। নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের বাড়ি ভাড়া বেড়েছে গড়ে ৮.১৮ শতাংশ, বস্তির ঘর ভাড়া বেড়েছে ৯.৭৪ এবং মেস রুমের ভাড়া ৭.৯১ শতাংশ বেড়েছে।

উন্নয়নের ভোগান্তি

এমনিতেই বসবাসের অযোগ্যের তালিকায় বার বার উঠে আসছে রাজধানী ঢাকার নাম। তার ওপর উন্নয়ন কাজে বছর ধরে খোঁড়াখুঁড়ি চলায় পরিস্থিতি আরও নাজুক করে তুলছে। রোদ থাকলে ধুলা আর একটু বৃষ্টি হলেই কাদা। মাঝেমধ্যে দেখা দেয় জলাবদ্ধতাও। যানজট, ধুলা দূষণে নগরবাসী এমনিতেই অতিষ্ঠ। সমন্বয়হীন অপরিকল্পিত এসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে নগরবাসীর জনদুর্ভোগ যেন চরমে পৌঁছেছে।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন- পবা এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, বর্তমান যানজটের কারণে প্রতিদিন ঢাকায় ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। ফলে বছরে যে ক্ষতি হয়, অংকের হিসাবে তা প্রায় হাজার কোটি টাকা। এ শহরে এখন ঘণ্টায় গড়ে প্রায় সাত কিলোমিটার গতিতে যানবাহন চলছে।

এক জরিপ প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে পবা বলছে, নব্বইয়ের দশকে ঢাকায় পাবলিক পরিবহনের সংখ্যা ছিল ১১ হাজার, ২০০৮ সালে সে সংখ্যা দাঁড়ায় আট হাজারে। নানা সমস্যার কারণে ২০১৫ সালে এ সংখ্যা মাত্র তিন হাজারে উন্নীত হয়। অন্যদিকে ২০১০ সালে প্রাইভেট গাড়ির সংখ্যা ছিল তিন লাখ ১৮ হাজার ৪৯৫ যা ২০১৬ সালে দাঁড়িয়েছে চার লাখ ৩৬ হাজার ৫৫-তে। দিন দিন যেমন প্রাইভেট কারের সংখ্যা বাড়ছে তেমনি পাবলিক বাস হ্রাসের হারটিও খুব উদ্বেগজনক।

ঢাকায় যাতায়াত ও গণপরিবহন

দিনে অন্তত ছয় লাখ মানুষ নানা প্রয়োজনে আসছেন রাজধানীতে। ২০১৩ সালে প্রকাশিত ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষে পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা যায়, ঢাকায় জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি। তাই দিনে অন্তত ২১ লাখ পরিবহন ট্রিপের প্রয়োজন। কিন্তু যানজটের কারণে ২১ লাখের তিনভাগের একভাগও ট্রিপ হচ্ছে না। পরিসংখ্যান বলছে, রাজধানীতে প্রতি তিন হাজার যাত্রীর যাতায়াতের জন্য বাস ও মিনিবাস আছে মাত্র একটি। এছাড়া অটোরিকশাগুলোর এক-তৃতীয়াংশ অচল। গণপরিবহন সংকটের বিপরীতে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে।

তিনটি রুটে পরিচালিত জাইকার এক গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকায় পাবলিক বাসে প্রতিদিন প্রায় ১৯ লাখ যাত্রী চলাচল করে। ঢাকার তিনটি করিডোরে পাবলিক বাসের যাতায়াতের জন্য গড়ে ৭৭ মিনিট করে সময় লাগে। যার ২৪ শতাংশ বাসের জন্য অপেক্ষা, ৪৪ শতাংশ বাসে ওঠা-নামা ও বাস পরিবর্তন এবং ৩২ শতাংশ সময় বাসে চলন্ত অবস্থায় ব্যয় হয়।

পবার মতে, ঢাকা মহানগরীতে যানজট হ্রাসে গণপরিবহনের দক্ষ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার মাধ্যমে অপেক্ষার সময়, বাসে ওঠা-নামা ও বাস পরিবর্তনের সুবিধা সৃষ্টির পাশাপাশি বাসের পৃথক লেন করা গেলে যাতায়াতের সময় অনেক কমবে।

৭৬ ভাগ সড়ক ৬ শতাংশ মানুষের দখলে

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল (ডিআই) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যক্তিগত গাড়িতে চলাচলকারী ৬ শতাংশ মানুষ ঢাকার ৭৬ ভাগ সড়ক দখল করে আছে। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোট সড়কের ৬০-৬৫ ভাগ ব্যক্তিগত গাড়ির দখলে। গণপরিবহনের দখলে থাকে ৬-৮ শতাংশ। সড়কের বাঁকি অংশ বিভিন্নভাবে অবৈধ দখল ও পার্কিংয়ের দখলে থাকে।

এছাড়া পবা বলছে, রাজধানীতে সিটি করপোরেশনের মোট আয়তনের ৯ শতাংশ সড়ক, যেখানে মাত্র ৬ শতাংশ ফুটপাত। এক হাজার ২৮৬ কিলোমিটার রাস্তার ৬১ কিলোমিটার প্রাইমারি, ১০৮ কিলোমিটার সেকেন্ডারি, ২২১ কিলোমিটার কানেক্টর, ৫৭৩ কিলোমিটার লোকাল ও বাকিটা সংকীর্ণ। পুরো শহরের মধ্যে ১০৭ কিলোমিটার প্রশস্ততা ২৪ মিটারের বেশি। ফুটপাতের প্রশস্ততা যেটি মাত্র ৪৫ কিলোমিটার, একটা পর্যায় পর্যন্ত যা সেবা দিতে উপযুক্ত ছিল।

প্রকৃতপক্ষে ঢাকা সিটি করপোরেশনে ৮২১ দশমিক ৬১ কিলোমিটার (৬৪ শতাংশ) রাস্তার প্রশস্ততা ৪ দশমিক ৭৫ মিটার বা তার চেয়ে কিছুটা বেশি। ফুটপাতের প্রশস্ততা অনুযায়ী এটি মাত্র ৬১৮ দশমিক ১৪ কিলোমিটার (৪৮ শতাংশ)। অন্য ৪৬৪ কিলোমিটার (৩৬ শতাংশ) সড়কে জরুরি গাড়ি যেমন- অ্যাম্বুলেন্স বা অগ্নিনির্বাপক গাড়ি প্রবেশ করতে পারে না।

এ বিষয়ে সাধারণ নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, যানজট, শব্দ ও বায়ু দূষণে নগরবাসী এমনিতেই অতিষ্ঠ। সমন্বয়হীন অপরিকল্পিত এসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে নগরবাসীর ভোগান্তি দিন দিন চরমে পৌঁছেছে। সবমিলিয়ে এ শহরের মানুষ হাঁপিয়ে উঠেছে। এখানে কেউ ভালো নেই। মানুষ মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্রমান্বয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতি আর মেনে নেয়া যায় না। এসব থেকে রাজধানীবাসীকের রক্ষা করতে সম্মিলিত পরিকল্পনা মাফিক উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি।

  • কার্টসি - জাগো নিউজ/ জানুয়ারি ২২, ২০২০ 

Monday, January 20, 2020

প্রেসিডেন্ট জিয়া এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ

গোলাম মাওলা রনি

প্রেসিডেন্ট জিয়াকে আমি প্রথম চাক্ষুষ দেখিছিলাম ১৯৭৮ সালে। সেবার তিনি আমাদের বিদ্যালয়ে এসেছিলেন একটি জনসভা করার জন্য। ফরিদপুর জেলার ঐতিহ্যবাহী বাইশরশি শিব সুন্দর একাডেমিতে প্রেসিডেন্ট জিয়া আসবেন, এমন খবরে পুরো এলাকায় হইচই পড়ে গেল। রাস্তার পাশের ঝোপঝাড় পরিষ্কার হলো এবং দুই পাশের গাছগুলোতে চুনকাম করা হলো। রাস্তার খানাখন্দক ভরাটের পাশাপাশি আমাদের বিদ্যালয়ের মাঠটিকে যথাসম্ভব সংস্কার করা হলো। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মহাব্যস্ত। কেউ ব্যস্ত মানপত্র রচনা করার কাজে- কেউ বা আবার সেই মানপত্র পাঠের অনুশীলনে গলদঘর্ম হতে থাকলেন। বিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা প্রেসিডেন্টকে গান শোনানোর জন্য সদলবলে রিহারসেল শুরু করে দিলো। শরীর চর্চার শিক্ষক, ধর্মশিক্ষক, প্রধান শিক্ষক এবং বিদ্যালয় কমিটির সভাপতি ঘন ঘন বৈঠক করে পুরো অনুষ্ঠানের জন্য যথাসম্ভব সুন্দর একটি ছক বানিয়ে প্রেসিডেন্টের আগমনের মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।

প্রেসিডেন্ট জিয়া তার সঙ্গী-সাথীদেরকে নিয়ে নির্ধারিত দিনের নির্ধারিত সময়ে আমাদের মধ্যে এলেন। আমাদের বিদ্যালয়ের সুবিশাল মাঠ- সামনের রাস্তা-আশপাশের ফসলি জমি এবং আম বাগানগুলো সকাল ১০টার মধ্যেই লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ল। কত লোক যে সে দিন এসেছিলেন তা বলতে পারব না- তবে আমার জন্মের পর থেকে আজ অবধি আমি সদরপুর-চরভদ্রাসন এবং ভাঙ্গাসহ ফরিদপুর জেলার কোনো সভা-সমাবেশে এত মানুষের সমাগম দেখিনি। বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক বাবু কেশব চন্দ্র দের রচিত মানপত্রটি যখন ইংরেজি শিক্ষক বলরাম বাবু পাঠ করলেন তখন লাখো লোকের সমাগম সেই মানপত্র শোনার জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে নীরব হয়ে গেল।

একটি মানপত্রের ভাষা এবং সেই মানপত্রের পাঠকের গুরুগম্ভীর এবং ছন্দময় কণ্ঠস্বর আজো আমাকে বিমোহিত করে, যা আমি দেশ-বিদেশের কোথাও দ্বিতীয়টি দেখিনি। আমার চাচাতো বোন মুকুট আপার নেতৃত্বে বিদ্যালয়ের মেয়েরা প্রেসিডেন্টের প্রিয় গান ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’সহ আরো কয়েকটি দেশাত্মবোধক গান যে মাধুর্যময়তা দিয়ে পরিবেশন করলেন, তা আজকের জমানায় কল্পনাও করা যায় না।

সেদিনের জনসভার প্রসঙ্গ দিয়ে আজকের নিবন্ধ শুরু করলাম এ কারণে যে, ওই জনসভাকে কেন্দ্র করে আমি প্রেসিডেন্ট জিয়ার রুচি-ব্যক্তিত্ব-দেশপ্রেম এবং সর্বোপরি তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের যে নমুনা পেয়েছিলাম; যা অন্য কারো মধ্যে কল্পনাই করা যায় না। প্রথমত, লক্ষাধিক লোকের একটি জনসভার সার্বিক দায়িত্ব তিনি দিয়েছিলেন একটি স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এবং সভামঞ্চে তিনি এবং শিক্ষকমণ্ডলী ছাড়া কাউকে বক্তব্য দিতে দেয়া হয়নি। তিনি নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠানস্থলে এলেন এবং প্রায় এক কিলোমিটার দূরে তার প্রটোকলের গাড়ি এবং নিরাপত্তাবহর রেখে সম্পূর্ণ একাকী বীরদর্পে হেঁটে সভামঞ্চে উঠলেন। তিনি তার বক্তব্যে কোনো হতাশার কথা বললেন না- কারো গিবত করলেন না এবং নিজের বা অন্য কারো ব্যর্থতার কথাও বললেন না। তিনি উপস্থিত জনতাকে উজ্জীবিত করলেন পিতার মতো- সহায্যের প্রতিশ্রুতি দিলেন অভিভাবকের মতো এবং উপদেশ দিলেন শিক্ষকের মতো। তিনি সবাইকে পরিশ্রম করার আহ্বান জানালেন এবং কৃষি-মৎস্য পালন এবং সেচপ্রণালী নিয়ে তার সরকারের পরিকল্পনার কথা বললেন।

জিয়াউর রহমান যখন আমাদের বিদ্যালয়ে গেলেন তখন আমার রাজনৈতিক বোধবুদ্ধিতে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো কিছু ছিল না। আমাদের এলাকার বেশির ভাগ মানুষ আওয়ামী লীগ করা সত্ত্বেও তারা সবাই সদলবলে প্রেসিডেন্ট জিয়ার জনসভায় এসেছিলেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। জনসভার আগে কিংবা পরে আমরা কোনো কট্টরপন্থী আওয়ামী লীগের মুখ থেকে প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য শুনিনি। তখনকার জমানায় অনেক অভাব-অভিযোগ ছিল- তবে বর্তমানের মতো অসভ্যতা ছিল না। যে যার মতো করে রাজনীতি-ধর্মকর্ম ও ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি নিরিবিলি পারিবারিক জীবন যাপন করতেন। কারো কুৎসা করা, সম্মানিত লোককে অসম্মান করা এবং ছোটমুখে বড় কথা বলার রীতি আমরা প্রেসিডেন্ট জিয়ার জমানায় দেখিনি। তিনি নিজে ওই সব কর্ম করতেন না বলে ‘রাজার দোষে রাজ্য নষ্ট’ প্রবাদের আদলে তখনকার জনগণের ইতর স্বভাব খুবই কম ছিল।

আপনারা যদি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জীবন ও কর্ম নিয়ে একটু চিন্তাভাবনা করেন তবে লক্ষ করবেন, তিনি কোনো দিন কারো গিবত করেননি। কাউকে অনুকরণ করেননি। কোনো কিছু নকল করা- ধারদেনা করা এবং অন্যের ধনে পোদ্দারি করে ফুটানি দেখানোর মতো বাঙালির কুস্বভাবগুলো তার মধ্যে ছিল না। তিনি কোনো কিছু না জেনে সবজান্তা সমশেরের মতো ভাব ধরে থাকতেন না। তিনি যা জানতেন তা তিনি খুব ভালোভাবেই জানতেন এবং নিজের সীমা-পরিসীমা সম্পর্কে সথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন। সময়ানুবর্তিতা-ভদ্রতা-সৌজন্যবোধ, পরিশ্রম, একনিষ্ঠতা ও সততার সমন্বয়ে তিনি সকাল থেকে গভীর রাত অবধি দেশ ও জাতির জন্য পরম মমত্ববোধ নিয়ে কাজ করতেন।

তার শাসনামলে তিনি সারা বাংলার আনাচে-কানাচে হেঁটে এত বেশি এলাকা পরিভ্রমণ করেছেন, যা তার পর্যায়ের অন্য কোনো শাসকের কাছ থেকে কল্পনাও করা যায় না। তার সহজাত মেধা-বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং গভীর দেশপ্রেমের কারণেই তিনি বাংলাদেশকে ভিন্ন আঙ্গিকে চিনিয়ে ছিলেন। তার চিন্তার গভীরতা-উদ্ভাবনী ক্ষমতা উচ্চমার্গের শিক্ষাদীক্ষা এবং এ দেশের মানুষের প্রতি মমত্ববোধের কারণে তিনি বুঝেছিলেন যে, বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে এই জাতির জাতীয়তাবোধকেও একক-স্বাধীন-সার্বভৌম এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে তুলতে হবে।

আমি প্রেসিডেন্ট জিয়ার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা বা পলিটিক্যাল জিনিয়াসনেস নিয়ে যতই ভাবি, ততই অবাক হয়ে যাই। কারণ, ১৯৭১ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত সে কথা কেউ ভাবেনি বা যে সমস্যার অন্তঃমূলে কেউ হাত দেননি, ঠিক সেই জায়গায় তিনি মনোনিবেশ করে বাংলাদেশ নামের এক রাষ্ট্রের নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়ের প্রশ্নটি কেন সবার আগে নিষ্পত্তি করার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন, তা ভাবলে আজো শিহরিত হয়ে পড়ি।

তার পূর্বসূরিরা যেখানে চাল নেই, ডাল নেই, ব্যাংকে টাকা নেই, চোরেরা সব চুরি করে নিয়ে গেছে, চাটার দলেরা সব চেটে খেয়ে ফেলেছে ইত্যাদি সমস্যা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলেন অথবা তার পূর্বসূরিরা যেখানে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করে সব রাজনৈতিক দল ও প্রতিপক্ষ নির্মূল, সেকুলারিজমের ভিত্তিতে জাতি গঠন এবং সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণাকে মূলমন্ত্র করে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সংবিধানের মূল স্পিরিটকে কবর দিয়ে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্র ও জাতীয়তাবাদের ধারণা সম্পূর্ণ পাল্টে দিলেন; সেখানে তিনি কোনো কিছুর দিকে না তাকিয়ে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এবং পরম করুণাময় আল্লাহর ওপর বিশ্বাস ও আস্থার ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিলেন।

উল্লিখিত বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারণা এবং এই জাতীয়তাবাদের ঝুঁকি সম্পর্কে দু-চারটি কথা বলা অবশ্যক। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারণাটি আমাদরে এই ভূখণ্ডে প্রবল হয় ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় থেকে। ব্রিটিশরা যখন বাংলাকে দুই ভাগে বিভক্ত করে ফেলেছিল তখন বাঙালি জ্ঞানী-গুণী, কবি-সাহিত্যিক এবং রাজনীতিবিদেরা ঐক্যবদ্ধ বাংলা তথা অবিভক্ত ভারতের দাবিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের আন্দোলন শুরু করেন, যা মূলত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের মস্তিষ্ক থেকে এসেছিল। তিনি অবিভক্ত বাংলার দাবিকে জনপ্রিয় করার জন্য ‘আমার সোনার বাংলা- আমি তোমায় ভালোবাসি’ নামক গান রচনা করে কলকাতা-কেন্দ্রিক এমন এক আন্দোলন গড়ে তোলেন, যার কারণে ব্রিটিশরা বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হয়।

আমরা হয়তো অনেকেই জানি না, বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলা তথা আজকের বাংলাদেশ এবং আসামের জনগণ ফুঁসে উঠেছিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বঙ্গভঙ্গকে মোকাবেলার জন্যই ঢাকায় বসে পূর্ব বাংলার সর্বস্তরের নেতৃবৃন্দ ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করে এক দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে। সে দিন যদি পূর্ব বাংলার সব জনগণ মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও আস্থার ভিত্তিতে গঠিত মুসলিম লীগকে সমর্থন না দিয়ে কবিগুরুর অবিভক্ত বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে অবস্থান নিত, তবে আমরা কোনো রকম বাগি¦তণ্ডা ছাড়াই অবিভক্ত ভারতের বঙ্গ প্রদেশ হতাম অথবা দেশ বিভাগের সময় অবিভক্ত বঙ্গরূপে ভারতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়ে আসাম, ত্রিপুরা, মিজোরাম ও বিহারের মতো প্রদেশে পরিণত হতাম।

১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর আমরা যখন পাকিস্তানের অংশে পরিণত হলাম তখন পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃবৃন্দের ভুল নীতি, জুলুম, অত্যাচার এবং শোষণ-বঞ্চনার কারণে রীতিমতো দিশাহারা হয়ে পড়লাম। এক দিকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় অত্যাচার, অন্য দিকে পাশের রাষ্ট্রের জটিল কূটচালে আমাদের মধ্যে সীমাহীন অস্থিরতা এমনভাবে বেড়ে গেল, যার কারণে আমরা স্বাধীনতা না স্বায়ত্তশাসন তা যেমন স্থির করতে পারলাম না- তেমনি দিল্লি না পিন্ডি তা না বুঝেই আগরতলা, গোহাটি, কলকাতা এবং দিল্লি চক্রান্তে বা ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পড়ে গেলাম। পরিস্থিতি আরো জটিল হলো যখন পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ চরম অস্থির হয়ে পড়ল, যার কারণে মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ল এবং ভারতীয় সৈন্যরা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস ঘোষণা করা হলো এবং ওই দিন ভারতীয় বাহিনীর কাছে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করল। আমাদের দেশে আমরা যেটিকে মহান মুক্তিযুদ্ধ রূপে ধ্যানজ্ঞান করি, সেটিকে ভারত ও পাকিস্তান তাদের নিজ দেশের দলিলপত্রে পাক-ভারত যুদ্ধ রূপে লিপিবদ্ধ করে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটির জন্ম, নাগরিকদের জাতীয়তা এবং সার্বভৌমত্বের মূলে আশ্চর্যজনক চিহ্ন রেখে দেয়ার অপপ্রয়াস আজো চালিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ যেন কোনোকালে সিকিম বা কাশ্মিরের মতো না হয়, সে জন্য বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাগরিকদের জাতীয়তার পরিচয় রাষ্ট্রকেন্দ্রিক হবে এবং কেবল বাংলাদেশের ভূখণ্ডের লোকজনের জাতীয়তাবোধ- এ দেশের মাটি-মানুষ-কৃষ্টিকালচার এবং ইতিহাস-ঐতিহ্যভিত্তিক হবে, এমন ইউনিক চিন্তা স্বাধীনতা লাভের সাত-আট বছর পর কেবল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাথায় কিভাবে এলো, তা ভাবলে সব বুদ্ধিমান মানুষের মাথা এমনিতেই প্রেসিডেন্ট জিয়ার প্রতি যেমন নত হয়ে যায় তেমনি দেশপ্রেমিক বাংলাদেশীদের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা এবং মমত্ববোধও শহীদ জিয়ার প্রতি বিগলিত না হয়ে পারে না।

বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের উদ্ভাবক তথা জনক হিসেবে প্রেসিডেন্ট জিয়ার যে ভাবমূর্তি তা নিয়ে কারো কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ নেই। কারণ, গত ৪২ বছরের মধ্যে কেউ একটিবারের জন্যও এই দাবি করেনি যে, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ধারণা অমুকের মস্তিষ্ক থেকে এসেছে অথবা তমুকের স্বপ্নের মধ্যে ছিল। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের জনক নিয়ে কারো প্রশ্ন না থাকলেও এমন প্রশ্ন অনেকে করতে পারেন, একজন মিলিটারি জিনিয়াস কাম-পলিটিক্যাল জিনিয়াসের মাথায় সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি অত্যন্ত জটিল অনুসিদ্ধান্ত এলো কিভাবে! বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারণা যেমন রবীন্দ্রনাথের মস্তিষ্কপ্রসূত তেমনি মহাকবি ইকবালের মাথা থেকেই পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের ধারণা এসেছিল। অন্য দিকে প্রাচীন ভারতের মহাকবি বানভট্টই ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ধারণা প্রথম দিয়েছিলেন।

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের উল্লিখিত আবিষ্কারের প্রেক্ষাপট নিয়ে যারা জানতে চান, তাদেরকে অবশ্যই জিয়ার জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং কর্মজীবন সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে হবে। তিনি এই ভূখণ্ডের খাঁটি ভূমিপুত্র। তিনি এবং তার পূর্বপুরুষেরা এখানেই জন্ম নিয়েছেন এবং এই মাটি, এই দেশ এবং এই দেশের মানুষকে ভালোবেসে এ দেশেই সম্মান ও মর্যাদার সাথে মারা গেছেন। তিনি বা তার পূর্বপুরুষেরা ইরান-তুরান থেকে আসেননি। তাদের রক্তেও রয়েছে ধর্মপ্রাণ খাঁটি মুসলমানের রক্ত। হালাল উপার্জনে পরিশ্রম করা এবং সৎভাবে জীবন যাপন করা জিয়া এবং তার পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য। তিনি এবং তার পূর্বপুরুষদের সুযোগ ছিল ভারতীয় নাগরিক হওয়ার অথবা চাইলে তারা পাকিস্তানি অভিজাত সমাজের প্রতিভূ হতে পরতেন। কিন্তু তারা সেটি না করে স্বেচ্ছায় বাংলাদেশী হয়েছিলেন।

প্রেসিডেন্ট জিয়ার বাবা মনসুর রহমান ব্রিটিশ সরকারের উচ্চপদস্থ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ছিলেন এবং উপমহাদেশের প্রধানতম কালি ও কাগজ বিশেষজ্ঞ রসায়নবিদ ছিলেন। ভারত বিভাগের সময় তিনি ব্রিটিশ সরকারের সচিবালয় কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংয়ে কর্মরত ছিলেন। তখন সরকারি কর্মকর্তাদের ইচ্ছানুযায়ী তাদের চাকরি ও নাগরিকত্ব ভারত অথবা পাকিস্তান রাষ্ট্রে ন্যস্ত হতো। মনসুর রহমান বৃহত্তর ভারত ত্যাগ করে পাকিস্তান চলে এলেন। অন্য দিকে, ১৯৭১ সালে জিয়াউর রহমানের যখন সুযোগ এলো পাকিস্তানি অথবা বাংলাদেশী হওয়ার তখন তিনি জীবন বাঁচাতে পাকিস্তানে না গিয়ে অস্ত্র হাতে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

তার এই বীরত্ব, তার মেধা এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতা তিনি তার পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এবং উন্নত কর্মপরিবেশ থেকেই পেয়েছিলেন। ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী জিয়াউর রহমান ব্রিটিশ ভারতের সবচেয়ে নামকরা বিদ্যালয় হেয়ার স্কুলের ছাত্র ছিলেন- ছিলেন পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমির সবচেয়ে মেধাবী ও চৌকস ছাত্র। কর্মজীবনে তিনি একজন সামরিক কর্মকর্তারূপে ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যে বীরত্ব দেখিয়েছেন এবং সেই বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ সে রাষ্ট্রীয় উপাধি পেয়েছেন তা অন্য কোনো সামরিক নেতার ভাগ্যে জোটেনি। সুতরাং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ধারণা তার মস্তিষ্ক থেকে আসবে না তো কার মস্তিষ্ক থেকে আসবে!

লেখক সাবেক সংসদ সদস্য

কার্টসি— নয়া দিগন্ত

একজন রাষ্ট্রনায়ক

এমাজউদ্দীন আহমদ

বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জিয়াউর রহমানের সততার, তার সঠিক দিকনির্দেশনার, জনগণের প্রতি তার সহমর্মিতার। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একজন রাষ্ট্রনায়কের তথা স্টেটসম্যানের যিনি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য বর্তমানকে সুসজ্জিত করতে পারেন। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একজন প্রয়োগবাদীর (প্র্যাগমেটিস্ট), যিনি বাস্তবতার নিরিখে নতুন নতুন কর্মসূচি দিয়ে প্রমাণ করবেন : রাষ্ট্র এবং সরকার সবার, সামগ্রিক জনসমষ্টির। এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একজন দেশপ্রেমিকের, যার নেতৃত্বের পরশমণি সবাইকে জাতীয় স্বার্থের বৃহত্তর মোহনায় সম্মিলিত করতে সক্ষম।

এ দেশ দীর্ঘ চার দশকে বহু রাজনীতিকের দর্শন পেয়েছে। দর্শন পায়নি তেমন সার্থক রাষ্ট্রনায়কের। রাজনীতি তাই আজকে ক্ষমতার রাজনীতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। রাজনীতিতে কালো টাকার প্রভাব তাই হয়েছে আকাশচুম্বী। পেশিশক্তির নির্লজ্জ প্রভাব তাই রাজনীতিকে করেছে কলঙ্কিত। রাজনীতি তাই জনকল্যাণের মাধ্যম না হয়ে, হয়ে পড়েছে রাজনীতিকদের প্রভাব ও বৈভবের মাধ্যম। আইনের প্রাধান্যের পরিবর্তে সুস্পষ্ট হয়েছে সমাজব্যাপী ব্যক্তিপ্রাধান্য। সৃষ্টি হয়েছে প্রতিযোগিতার পরিবর্তে বৈরিতা। অসহিষ্ণুতা এবং অরুচিকর হিংসা-প্রতিহিংসার মরণ খেলায় জড়িয়ে পড়েছে সামাজিক শক্তিগুলো। চারদিকে অনৈক্য ফণা তুলেছে। জাতীয় শক্তি প্রতিনিয়ত ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। বাইরে জাতির ভাবমূর্তি মøান হয়ে পড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে জাতির আশা-আকাক্সক্ষা ধারণ করে, জাতিকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্নে সচকিত করতে প্রয়োজন আরেকজন জিয়াউর রহমানের। প্রয়োজন একজন যথার্থ রাষ্ট্রনায়কের।

রাজনীতিকরা ক্ষমতার অন্ধকার গুহায় বন্দী হয়ে শুধু ক্ষমতাপ্রসূত সুবিধার দিকে দৃষ্টি রাখেন। ক্ষমতার বৃদ্ধি-প্রবৃদ্ধিতেই খুশি হন। রাষ্ট্রনায়ক কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে সমাজে কল্যাণমুখী কর্মসূচির মাধমরূপেই দেখে থাকেন। তাই যে ক্ষেত্রে রাজনীতিক চান ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, রাষ্ট্রনায়ক চান ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রিকরণের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে। রাজনীতিকরা জনগণকে তাদের ক্ষমতা লাভের সোপান হিসেবে ব্যবহার করেই সন্তুষ্ট, রাষ্ট্রনায়ক কিন্তু জনগণকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদার করে চান তাদের ক্ষমতাশালী করতে। রাজনীতিকরা নিজেদের স্বার্থে জাতীয় ঐক্যে ভাঙন ধরাতেও রাজি, রাষ্ট্রনায়ক কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে জাতীয় ঐক্য সুদৃঢ় করেন। রাজনীতিকদের কাছে ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত অথবা দলীয় স্বার্থই মুখ্য। রাষ্ট্রনায়কের লক্ষ কিন্তু জাতীয় স্বার্থকে সমুন্নত রাখা। দেশের ভেতরে অথবা বাইরে জাতীয় ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করা। শুধু রাষ্ট্রনায়কই জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা ধারণ করে, তাদের সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে, বর্তমানকে ছাপিয়ে দূর ভবিষ্যতের স্বপ্নে জনগণকে সচকিত করতে সক্ষম।

এসব বিবেচনায় রেখেই বলতে চাই, আজকের বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আকাশছোঁয়া গুণপনাসমূহের। আইনানুগ সমাজ গঠনে তার একাগ্রতার, দুর্নীতির প্রতি তার তীব্র ঘৃণার, সুশাসনের প্রতি গভীর আকর্ষণের, স্বশাসনের প্রতি তার সহজাত দুর্বলতার, সমাজব্যাপী শান্তিপূর্ণ পরিবেশ রচনায় তার বলিষ্ঠ পদক্ষেপের। বিশ্বায়নের একালে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মননশীলতার, সৃজনশীল চিন্তাভাবনার। উন্নয়নশীল বিশ্বের প্রান্তসীমায় দণ্ডায়মান বাংলাদেশের শিল্প-বাণিজ্যকে বিশ্বময় প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত করতে হবে। প্রতিযোগিতার বৃহত্তর ক্ষেত্রে টিকে থাকার জন্য জনগণকে প্রশিক্ষিত করতে হবে। উন্নত মানব সম্পদরূপে তাদের গড়ে তুলতে হবে। সমগ্র সমাজটাকে জ্ঞানভিত্তিক সমাজে রূপান্তরিত করতে হবে।

সামাজিক শক্তিগুলোকে সব অনৈক্য ও বিভেদ জয় করে বৃহত্তর ঐক্যের উপত্যকায় উপনীত হতে হবে। মেধা চর্চার মাধ্যমে সৃষ্টিশীল প্রত্যয়ের দিগন্ত বিস্তৃত করতে হবে। সমাজটাকে মুক্ত সমাজের আদলে তুলে ধরতে হবে। এসবই তো এখনকার প্রয়োজন। এসব প্রয়োজনের নিরিখেই এ সমাজের দাবি হচ্ছে জিয়াউর রহমানের ধীশক্তি। তার মেধা। তার বিশ্বাস। তার সততা। তার দূরদৃষ্টি। তার দেশপ্রেম। যখন তিনি ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরে বাংলাদেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেলেন, তখনকার কথা একবার ভেবে দেখুন। ভেবে দেখুন কিভাবে মাত্র দুই বছরের মধ্যে জাতীয় জীবনের সেই সঙ্কটময় মুহূর্তে অকুতোভয় এক সৈনিকের মতো, অনেকটা একক প্রচেষ্টায় দুস্থ, অসহায়, বাংলাদেশকে অনগ্রসরতার গভীর গহ্বর থেকে তুলে উপস্থাপন করলেন অগ্রগতির মহাসমুদ্রের তীরে।

১৯৭৫ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশ ছিল সামরিক অভ্যুত্থান প্রতি অভ্যুত্থানের আঘাতে আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত। ডান-বামের টানাপড়েনে নিঃস্ব প্রায়। যে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ দাবিতে জাতি রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের আগুনে ঝলসে গেল সেই বাংলাদেশ থেকে গণতন্ত্র নির্বাসিত। একদলীয় কর্তৃত্বব্যঞ্জক বাকশালের গুরুভারে জাতীয় জীবন ন্যুব্জ। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবয়বে অপচয়প্রবণ ও পীড়নমূলক লুটেরা অর্থনীতির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের দ্বীনহীন ও নিঃস্ব অবস্থা তথা তলাবিহীন ঝুড়ির দুর্দশা। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের নিঃসঙ্গ, একাকী, বন্ধুবিহীন, শ্রমহীন ও হতশ্রী চেহারা।

এমনি যখন বাংলাদেশের অবস্থা তখন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব এলো জিয়াউর রহমানের ওপর। একজন দক্ষ প্রশাসক হিসেবে তিনি একজন পেশাদার সমাজবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে সমাজের সামগ্রিক চেহারাটা অনুধাবন করে এর সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণ করেন। তারপর এসব সমস্যা সমাধানের দিকে দৃষ্টি দেন। তিনি অনুধাবন করেন, দেশের হাজারো সমস্যার মোকাবেলার জন্য প্রথমত সরকারকে হতে হবে শক্তিশালী, ভীষণ শক্তিশালী। সরকারকে শক্তিশালী হতে হবে বিভিন্ন কারণে : এক. রাষ্ট্রের প্রধান যেসব দায়িত্ব-ভৌগোলিক অখণ্ডতা সংরক্ষণ, স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব নিশ্চিন্তকরণ, দেশের অভ্যন্তরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর স্বাভাবিকীকরণ এবং আইনের প্রাধান্য নিশ্চিতকরণ, নাগরিকদের জীবন ও সম্পদের নিশ্চয়তা বিধান পালন করা। এ কোনো দুর্বল সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তিনি বিদ্যমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থার উন্নতি সাধনে মনোযোগী হন। আগ্রহী হন আধা-সামরিক বাহিনীর সার্বিক উন্নয়নে। আগ্রহী হন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আধুনিকীকরণে। প্রচলিত বিচারব্যবস্থার কার্যক্রমে দক্ষতা, নিরপেক্ষতা এবং সততা আনয়নে উদ্যোগী হন।

দায়িত্ব নেয়ার ছয় মাসের মধ্যেই এসব ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়। দুই. তিনি অনুধাবনে সক্ষম হন, সরকার শক্তিশালী না হলে জনগণের আনুগত্য লাভে তা সমর্থ হবে না। তিনি বিশ্বাস করতেন, জনগণের সার্বিক সমর্থনই সরকারকে শক্তিশালী করে তোলে। তাই জনসমর্থন নিশ্চিত করতে তিনি কেন্দ্রের ওপর যতটা নির্ভর করেছেন, তার শতগুণ নির্ভর করেছেন প্রান্তের ওপর। দেশের প্রান্তসীমা পর্যন্ত তিনি ছোটাছুটি করেছেন জনগণের সাথে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য। তাদের ভাষায় কথা বলা, তাদের চিন্তা-ভাবনা আশা-আকাক্সক্ষা ধারণ করে, আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে ছিন্ন করে জনগণের সাথে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করে। গণতান্ত্রিকব্যবস্থায় জনগণের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন অপরিহার্য দু’টি কারণে-

এক. রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে জনগণ যদি একবার ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত হয় তাহলে উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হতে বাধ্য, কেননা সরাসরি জনগণের জন্য উন্নয়নমূলক কর্ম। দুই. জনগণ একবার রাজনৈতিক ক্ষমতায় অংশীদার হয়ে উঠলে সমাজের অগ্রহণযোগ্য অংশ মাস্তান, চাঁদাবাজ, লুণ্ঠনকারী, নিপীড়ক আইন ভঙ্গকারী নিরস্ত্র হতে বাধ্য। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ সহজ হয়ে আসে। সমাজে আইনের প্রাধান্য নিশ্চিত হয়। তাই দেখা যায়, জিয়াউর রহমান যতদিন ক্ষমতাসীন ছিলেন সেই সময়কালই এ দেশের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা শান্তির কাল বলে চিহ্নিত হয়েছে। আজকের সমাজে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, ছিনতাই ও চাঁদাবাজির যে মচ্ছব পরিলক্ষিত হচ্ছে ওই সময়ে তার বিন্দুমাত্রেরও প্রকাশ ঘটেনি। অথচ ১৯৭২-৭৫ সময়কাল তা ছিল অনেকটা দুরারোগ্য ব্যাধির মতো। তার মৃত্যুর পরে আবারো ওই সব ব্যাধি নতুন আকারে প্রকারে প্রকাশিত হয়।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তার নতুন নতুন পদক্ষেপ এ সমাজে সৃষ্টি করে সৃজনশীল এক আবহ। কৃষককে ঋণ দান করে, পানি সেচের ব্যবস্থা করে, রাসায়নিক সার প্রয়োগে কৃষককে উদ্বুদ্ধ করে, উন্নত বীজের প্রয়োগ সহজলভ্য করে তিনি কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লবের সূচনা করেন। খাল খনন প্রকল্প এ ক্ষেত্রে ছিল এক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। দেশের পণ্যসামগ্রী বিদেশে রফতানির মাধ্যমে, নতুন নতুন পণ্যের বাজারজাতকরণের মাধ্যমে, বেসরকারি খাতে উৎপাদনের উৎসাহ জুগিয়ে, বেসরকারি ব্যাংক-বীমা ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে দেশে উৎপাদনের নতুন জোয়ার সৃষ্টি করেন। ফলে বাংলাদেশ ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র যে লজ্জাকর অভিধা লাভ করেছিল, তা থেকে জাতি অব্যাহতি লাভ করে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এভাবে মর্যাদার আসনে আসীন হয় বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্ট হয় কর্মতৎপর মধ্যপ্রাচ্যের সাথে। যুক্ত হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে। ইউরোপ এবং আমেরিকা বাংলাদেশকে নতুন আলোকে দেখতে শুরু করে। আজকে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যেভাবে কলঙ্কিত হয়েছে, বছরের পর বছর ধরে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিপরায়ণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে জাতীয় মর্যাদা যেভাবে ধূলি ধূসরিত, প্রেসিডেন্ট জিয়ার আমলে এমন অবস্থা ছিল কল্পনাতীত।

তাই বলি, সেই মহান নেতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের সবচেয়ে উত্তম প্রক্রিয়া হলো তার চিন্তাভাবনাকে ধারণ করে, তার আদর্শকে মাথায় নিয়ে, তার দক্ষতা, সততা এবং জনদরদি ভাবধারাকে পুঁজি করে তারই নির্দেশিত পথে চলা। নিজেদের কাজকর্মে তাকে আদর্শ জ্ঞান করে তাকে সামনে রাখা। 

টাইমলাইন      ১৯৩৬-১৯৮১


১৯৩৬ : বগুড়ার বাগবাড়িয়ায় ১৯ জানুয়ারি জন্ম।
১৯৫৩ : কাকুল মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান।
১৯৫৫ : সামরিক বাহিনীতে কমিশন লাভ
১৯৬০ : খালেদার সঙ্গে বিয়ে
১৯৬৫ : পাক-ভারত যুদ্ধে অসীম সাহসিকতার জন্য বীরত্বসূচক পুরস্কার লাভ
১৯৭০ : ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে দ্বিতীয় অধিনায়ক হিসেবে ট্রান্সফার।
১৯৭১ : পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান ও ২৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান। মুক্তিযুদ্ধে জেড ফোর্সের অধিনায়ক। স্বাধীনতাযুদ্ধে অবদানের জন্য ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত।
১৯৭২ : ডেপুটি চিফ অব স্টাফ পদে পদোন্নতি।
১৯৭৩ : মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি।
১৯৭৫ : চিফ অব আর্মি স্টাফ নিযুক্ত। ৭ নভেম্বর সিপাহি জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসা। উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদে নিযুক্ত।
১৯৭৬ : প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ।
১৯৭৭ : রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ।
১৯৭৮ : জাগদলের প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিজয়ী। একই বছরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা।
১৯৭৯ : জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও সামরিক আইন প্রত্যাহার।
১৯৮১ : চট্টগ্রামে এক সামরিক ব্যর্থ অভ্যুত্থানে নিহত।

লেখক : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সাবেক ভিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শহীদ জিয়া ও নারীর ক্ষমতায়ন

ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান

বাংলাদেশের নারীদের ক্ষমতায়নের পেছনে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বিশেষ অবদান রয়েছে। শহীদ জিয়া ছিলেন একজন সত্যিকারের উন্নয়নকর্মী। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার সুযোগ্য ও দক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশ সার্বিক উন্নয়নের পথে অগ্রসর হয়েছিল। আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার শহীদ জিয়া তার উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী সমাজকে এতে সম্পৃক্ত করার প্রয়োজন অনুভব করেন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রের অনেক অনুচ্ছেদ, বিশেষ করে ২৬, ২৭, ২৮, ২৯ অনুচ্ছেদে নারী-পুরুষের সমঅধিকার ঘোষণা করা হয়েছে। জনজীবনের সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমভাবে অংশগ্রহণের কথাও আমাদের সংবিধানে বলা আছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র ছিল ভিন্নরূপ। স্বাধীনতার পর জাতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নারীদের সম্পৃক্ততা উল্লেখ করার মতো ছিল না।

১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার ‘নারী পুনর্বাসন বোর্ড’ গঠন করেন। তবে এর কার্যক্রম ছিল খুবই সীমিত। এরূপ একটি বাস্তবতায় শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে নারী সমাজের কল্যাণ, তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য ব্যাপকভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের দ্বিতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণে তিনি উল্লেখ করেছিলেন- ‘বাংলাদেশের সমগ্র জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। কিন্তু সেই নারী সমাজ শিক্ষা-দীক্ষায়, অর্থকরী কার্যাবলিতে, জাতি ও সমাজ গঠন ব্যবস্থায় পুরুষদের তুলনায় অনেক পশ্চাতে পড়ে রয়েছে। পূর্বে তাদের চেতনাবোধ জাগিয়ে তোলার জন্য কোনো সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা সরকারের তরফ থেকে গ্রহণ করা হয় নাই। ঘর-কন্নার কাজ ছাড়া আর কোনো অর্থকরী বা গঠনমুখী কাজে অংশ নেয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। এই কথা স্বীকার করতেই হবে যে, যদি কোনো জাতির অর্ধেক অংশ পেছনে পড়ে থাকে, তবে সেই জাতির সর্বাঙ্গীণ উন্নতি আশা করা যায় না। বর্তমান সরকার এ সমস্যাটি ভালোভাবে উপলব্ধি করেছে এবং আমাদের নারী সমাজের অবস্থার উন্নয়নের জন্য সমাজ ও জাতি গঠনে তাদের সমান সুযোগ দেয়ার কাজে সচেষ্ট হয়েছে এবং তার জন্য বিভিন্ন বাস্তবমুখী কর্মপন্থা গ্রহণ করেছে।’ (দৈনিক বাংলা, ৩ এপ্রিল ১৯৭৯)


Ad by Valueimpression
জিয়ার ১৯ দফা কর্মসূচির মাধ্যমে সূচিত দেশের উন্নয়ন ও জাতি গঠন কাজে বাংলাদেশের নারীদের সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। ১৯ দফার ১১ নম্বর দফায় নারীদের যথাযোগ্য মর্যাদা নিশ্চিত করে এবং সমাজে তাদের যোগ্য স্থানে প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়।

নারীর কল্যাণ ও তাদের অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৭৬ সালে রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের অধীনে একটি নারীবিষয়ক দফতর প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরে ১৯৭৮ সালে জিয়া সরকার ‘মহিলাবিষয়ক’ একটি স্বতন্ত্র ও পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করে। নারীরা যাতে যথাযোগ্য মর্যাদা, ধর্মীয়, শাসনতান্ত্রিক ও আইনগত অধিকার এবং আর্থিক ও সামাজিক সুবিধাগুলো ভোগ করতে পারেন, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তারা যাতে চাকরি করতে পারেন এবং সর্বোপরি সমাজ ও জাতি গঠনে অবদান রাখতে পারেন এ বিষয়গুলো দেখভাল করার লক্ষ্যে মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করে এ মন্ত্রণালয়ে একজন নারীকে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৯৪ সালে জিয়ার সুযোগ্য সহধর্মিণী ও তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে বর্ধিত করে ‘মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে’ রূপান্তরিত করেন।

নারী ও শিশু নির্যাতন বন্ধ, নারী পাচার রোধ, নারীর নিরাপত্তা এবং সর্বক্ষেত্রে সমঅংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই হলো মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মূল লক্ষ্য। ১৯৭৮-৮০ সালের জিয়া সরকারের গৃহীত দ্বিবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় নারী উন্নয়নবিষয়ক বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। জাতীয় মহিলা সংস্থা ও নারী উন্নয়ন অ্যাকাডেমির তত্ত্বাবধানে নারীদের সেলাই, বুনন, হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশু পালন এবং মৌচাষ ইত্যাদি নানামুখী প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে তাদের কর্ম উপযোগী করে তোলা হয়। বাংলাদেশ নারী পুনর্বাসন ও কল্যাণ ফাউন্ডেশন নারীদের জন্য বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে নারীদের কল্যাণে আইডিএ ও বিশ্বব্যাংক বেশ কিছু প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে এসেছিল।



শহীদ জিয়া নারী শিক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব দেন। শিক্ষিত নারীদের কর্মজীবী নারীতে রূপান্তরিত করার জন্য সরকারি-বেসরকারি খাতে চাকরির শূন্য পদে নারীদের জন্য শতকরা ১০ শতাংশ পদ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় নারীদের বিশেষ প্রাধিকার প্রদান করা হয়। মাধ্যমিক স্কুলে নারীদের জন্য শতকরা ৫০ ভাগ, সরকারি কলেজের প্রভাষক পদে এক-তৃতীয়াংশ, সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে টাইপিস্ট ও করণিক পদের শতকরা ৫০ ভাগ, টেলিফোন অপারেটর ও রিসেপশনিস্টের সব পদ এবং থানা পরিবার পরিকল্পনা অফিসারের ২০ শতাংশ পদ নারীদের জন্য সংরক্ষণ করা হয়। মেডিক্যাল কলেজসমূহের ২০ শতাংশ আসন নারী শিক্ষার্থীদের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। (The Bangladesh Observer, 25 Dec. 1980) বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীতে আজ যে নারী সদস্যের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা যায় এর উদ্যোগটি প্রথম নিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। তিনিই প্রথম সামাজিক ও ধর্মীয় বাধা উপেক্ষা করে নারীদের পুলিশ বাহিনী যোগদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। গ্রামীণ জনপদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য শহীদ জিয়া গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী বা ভিডিপি প্রতিষ্ঠা করেন। এতেও তিনি নারী সদস্য অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।

বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রায় ৭৬% আসে তৈরী পোশাক খাত থেকে। তৈরী পোশাক শিল্পকে রফতানিমুখী শিল্প হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা ছিল জিয়াউর রহমানের উদ্ভাবনী চিন্তার ফসল। এই পোশাক তৈরির খাতে নারী শ্রমিকের অবদানই আজ সবচেয়ে বেশি। এ খাতে কর্মরত প্রায় ৩৫ লাখ শ্রমিকের শতকরা ৯০ ভাগই নারী। নারীদের এ বিশাল কর্মসংস্থান সৃষ্টি শহীদ জিয়ার দূরদৃষ্টির ফল বলা যেতে পারে।

বাল্যবিয়ে বন্ধ, যৌতুক নিরোধ ও নারী নির্যাতন বন্ধে তিনি কঠোর ব্যবস্থা করেছিলেন। এ কাজে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সদস্য ও গ্রাম সরকারকে সম্পৃক্ত করা হয়েছিল। ১৯৮০ সালে জাতীয় সংসদে বিবাহে যৌতুক নিরোধ আইন পাস করা হয়। জিয়ার এসব উদ্যোগের ফলে তখন নারীর প্রতি সহিংসতা অনেক কমে গিয়েছিল। জনসংখ্যা বাড়ানোকে বাংলাদেশের এক নম্বর জাতীয় সমস্যা হিসেবে ঘোষণা করে ১৯৭৬ সালে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। একটি সামাজিক আন্দোলন হিসেবে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি সফল করার লক্ষ্যে মাঠপর্যায়ে প্রায় ৫৫ হাজার পূর্ণকালীন স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেয়া হয়। এদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন নারী কর্মী।

শহীদ জিয়া নারীর ক্ষমতায়নের অংশ হিসেবে তাদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করেন। রাজনীতিতে মহিলারা যাতে অধিকহারে স¤পৃক্ত হতে পারেন, নিজের প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপিতে সে ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৯৭৮ সালের ২০ অক্টোবর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির প্রথম সভায় বক্তৃতায় তিনি কেন্দ্র, জেলা এবং আরো নিচের পর্যায়ের কমিটিতে নারী সদস্য অন্তর্ভুক্তির কথা বলেছিলেন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন ‘বাংলাদেশের প্রত্যেকটি নারী একদিন না একদিন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সদস্য হবেন।’ শহীদ জিয়া স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সংস্থায় নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। স্থানীয় পর্যায়ে নেতৃত্বের বিকাশ, সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ব্যাপক অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা এবং তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সরকারের যোগাযোগ তৈরির জন্য তিনি গ্রাম সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

১১ সদস্যের গ্রাম সরকারে ২টি সদস্য পদ নারীদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। এছাড়া প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে ২টি এবং ঢাকা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনে পাঁচটি সদস্য পদ নারীদের জন্য সংরক্ষণ করা হয়। সংরক্ষিত পদের বাইরেও নারীরা সাধারণ পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারতেন। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৬৫(৩) অনুচ্ছেদে জাতীয় সংসদে ১০ বছরের জন্য ১৫টি আসন সংরক্ষণ করা হয়েছিল। জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমান দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র ৬ নম্বর সংশোধন আদেশ, ১৯৭৮ দ্বারা ১০ বছরের স্থলে ১৫ বছর এবং নারীদের সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা ১৫ থেকে বাড়িয়ে ৩০ জন করেন। এর বাইরে সংবিধানের ৬৫(২) অনুযায়ী সাধারণ আসনেও নারীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারতেন। মন্ত্রিপরিষদেও জিয়া নারী সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি করেছিলেন। ১৯৭০-৭৫ সালের সরকারে নারী মন্ত্রীর সংখ্যা ছিল মাত্র ২ জন। ১৯৭৬-৮০ সালে জিয়া সরকারের সময় এ সংখ্যা ৬ জনে উন্নীত হয়।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশে বর্তমানে শহীদ জিয়ার এসব অবদানকে অস্বীকার করার প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু ইতিহাস থেকে কারো অবদান জোর করে মুছে দেয়া যায় না।

লেখক : অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢা.বি.
কার্টসি - নয়াদিগন্ত