Search

Saturday, February 18, 2023

গরিব মানুষ কি খেতে পারছে?




খুব সাধারণ একটি প্রশ্ন করতে চাই, মানুষ কি খেতে পারছে? যাদের ব্যাপারে এই প্রশ্নটি করছি তারা অবশ্যই সাধারণ মানুষ, অথবা খুব নির্দিষ্ট করে বললে গরিব মানুষ।  কারণ মধ্যবিত্তদের বর্তমান সময়ে একটু কষ্ট হলেও ধনী মানুষের খাদ্যের অভাব নেই। বাংলাদেশে একইসাথে দুই ধরণের বিপরীত চিত্র আমরা দেখতে পাই – কেউ বেশি খেয়ে মরছে বা অসুস্থ হচ্ছে (নানারকম অসংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে) আর জনগণের একটি বড় অংশ অর্ধভুক্ত থাকছে, বা না খেয়েও আছে দিনের পর দিন। হ্যাঁ, সেই দরিদ্র মানুষদের অবস্থার কথাই জানতে চাচ্ছি। তারা কি খেতে পারছে?

বাংলাদেশে শতকরা হিসাবে দারিদ্রের হার ২৪.৩% হলেও সংখ্যায় তারা প্রায় চার কোটি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৬ সালের গৃহস্থালি বা খানা আয়-ব্যয় জরিপের তথ্য অনুযায়ী এই হিসাব পাওয়া গেছে। চার কোটি দরিদ্র মানুষ নিয়ে একটি দেশ টিকে থাকা কঠিন। এরাই শ্রমজীবী মানুষ অথচ তাদেরই খাদ্যের অভাব! টেকসই উন্নয়নের যে লক্ষ্যমাত্রা ২০১৬ সালে ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে ২০৩১ সালের মধ্যে দারিদ্র্য দূর করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। এরই মধ্যে কোভিড মহামারি, ইউক্রেন যুদ্ধ, অর্থনীতিতে বিনিয়োগের অভাব ইত্যাদি কারণে দেশের মানুষের জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়েছে। জীবনযাপনের জন্যে যেসব খরচ চালাতে হয়- তা সব কমানো সম্ভব হয় না বলে- খরচ কমাবার চাপ খাদ্যের ওপরই গিয়ে পড়ে, এবং খাওয়াটাই কমিয়ে দিতে হচ্ছে। সন্তানের শিক্ষা খরচ, বাড়ি ভাড়া, যাতায়াত, চিকিৎসা ব্যয় সব কিছুই বাড়ছে। কমানোর কোনো উপায় নেই। তাই কম খাওয়াই একমাত্র উপায়। এখন ২০২৩ সাল শুরু হয়েছে, আর ১০ বছর সময়ও আমাদের হাতে নেই।  দারিদ্র্য দূর করা কি সম্ভব হবে এই সময়ে? 

বছর খানেক ধরেই, অর্থাৎ করোনা পরবর্তী সময়ে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে পত্রপত্রিকায় এমন খবর এবং তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।  টেলিভিশন চ্যানেলেও ২০২১ সালে খবর প্রচারিত হয়েছে, যে করোনার কারণে কাজ ও আয় হারিয়ে- তিনবেলা খেতে পারছে না ১০% মানুষ। সতেরো কোটি মানুষের মধ্যে ১০% হলে তাতে ১ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষের একটা সংখ্যা দেখা যায়। এই সংখ্যা দেখতে খুব ভয়ানক লাগে। অর্থাৎ ২০১৬ সালের যে গরিবের সংখ্যা আমরা জেনেছি, তা নিশ্চয়ই আরো বেড়ে গেছে।  এবং সেই চার কোটির মধ্যেই প্রায় ২ কোটি মানুষ তিন বেলা খেতে পারছে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ২০২৩ সালে এসে কি অবস্থার কোনো উন্নতি হয়েছে? 

দুই হাজার বাইশ সালের একটি দৈনিক পত্রিকায় খবরের শিরোনাম হচ্ছে "আর ম্যানেজ করতে পারছে না মানুষ"। এই খবরের মধ্যে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত মানুষের কথা বলা হয়েছে, তারা সবাই হিমশিম খাচ্ছেন। কারণ খাদ্যদ্রব্যের দামের ঊর্ধ্বগতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি। বলাবাহুল্য সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছেন- যাদের আমরা অতিদরিদ্র বলে চিহ্নিত করি তারা। নিম্ন-মধ্যবিত্তদের টিসিবির ট্রাকের লাইনে দাঁড়াতে হয় বলে আমরা অনেকে আক্ষেপ করি; কিন্তু গরিব যারা, তারা কি তা-ও পায়? তাদের অবস্থা কী?



বিশ্বের চরম দরিদ্ররা বাস করে এমন পাঁচটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
ছবি  Syed Zakir Hossain/Dhaka Tribune

এরা গরিব খেটে খাওয়া মানুষ। এদের পেশা নানাবিধ। কোনো একক পেশা দিয়ে তাদের চেনা যাবে না, কারণ তারা যা পায় তাই করে। শরীরে যতক্ষণ শক্তি থাকে, তারা কাজ করে যায়। নিজে খেতে হবে এবং পরিবারকে খাওয়াতে হবে তো! সামাজিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান উবিনীগের (উন্নয়ন বিকল্প নীতি নির্ধারণী গবেষণা) সাম্প্রতিক একটি জরিপে যে তথ্য বেরিয়েছে তার একটু উল্লেখ করছি।  দুইশত গরিব পরিবার যাদের পেশা চায়ের দোকান, চটপটি বিক্রেতা, দরজি, গার্মেন্টস শ্রমিক, ছোট চাকুরি, রিক্সা ও ভ্যান চালক ইত্যাদি। তাদের আয় খুব কম, দৈনিক হিসাবে বেশিরভাগ (প্রায় ৬০%) মানুষের মাত্র ২৭৬ টাকা গড়ে; এক-তৃতীয়াংশ মানুষের আয় ৫০০ টাকা। কিছু লোকের আয় ৫০০ টাকার বেশিও আছে। বিশ্বব্যাংকের দারিদ্র নিরুপণের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড হচ্ছে ১.৯০ ডলার বা ২০০ টাকার কিছু বেশি। তার অর্থ হচ্ছে, এই মানুষগুলোর বিশ্বব্যাংকের দরিদ্র মানুষের সংজ্ঞার কাছাকাছি ২৭৬ টাকা দৈনিক আয়।

যাদের আয় কম, তারা আসলে কি খাচ্ছেন? ভাত, ডাল ও ডিম খাচ্ছে মাত্র ২৭%, এবং ভাত এবং সবজি খাচ্ছে ২২% পরিবার।  পোল্ট্রির ডিম সস্তা ছিল বলে এতোদিন অনেক গরিব পরিবার তা খেয়েছেন এবং মনে করেছেন তারা পুষ্টিকর খাদ্য খাচ্ছেন। ডিম বা মুরগি নিরাপদ কিনা- সে তর্কে না গিয়েও বলা যায় যে, এই খাদ্য যোগানোও সম্ভব হচ্ছে না বেশিরভাগ পরিবারের। আর যারা সবজি খাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন, তারা তাজা সবজি কিনতে পারেন না। তাছাড়া এই সবজিগুলো উৎপাদিত হয়েছে সার-কীটনাশক দিয়ে। সবজির মধ্যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আলু দেখা গেছে। মৌসুমি সবজির সস্তা হলে খাওয়া হয়। শুধু পেট ভরানোর জন্যে খাদ্য গ্রহণই তাদের জন্যে যথেষ্ট!! মাছ খাওয়ার ভাগ্য জুটেছে ১২% শতাংশ পরিবারের, সেটাও মাঝে মাঝে। মাংস খাওয়ার কথা বললেন, ২০০ পরিবারের মধ্যে মাত্র ৩টি পরিবার। এই সংখ্যার কোনো শতকরা হিসাব হয় না। দুধের অবস্থাও তাই। নয়টি পরিবারে চায়ের দোকান থেকে পাউরুটি (বন রুটি) খাওয়ার কথা জানা গেছে। মাসের সব দিনে খাবার জোটেনি এমন পরিবারের সংখ্যা ৫৭টি বা ২৮%, এদের কেউ ৫ দিন, কেউ ১০ দিন পর্যন্ত অভুক্ত থেকেছেন বলে জানিয়েছেন। এই চিত্র দিয়ে সারা দেশের গরিব মানুষের বিচার করা যাবে না অবশ্যই, কিন্তু এই চিত্রের সাথে মিল থাকার সম্ভাবনা কম নয় মোটেও।

খাদ্য নিয়ে আরো একটি পত্রিকার শিরোনামে দেখেছি 'মাংসের বাজারে ঘেঁষতে পারছে না সাধারণ মানুষ'।  এই শিরোনাম ২০২৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তারিখের। মাংসের বাজার? এতো কল্পনার বাইরে সাধারণ মানুষের, তারা ঘেঁষবে কী? শুধু মাংসে ৫০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকা খরচ করলে, চালডাল কিনবে কীভাবে? মধ্যবিত্তদেরও এখন মাংস খাওয়া দুস্কর হয়ে গেছে। মাংস প্রোটিনের জন্য একটি অন্যতম প্রধান উৎস। এখন মধ্যবিত্ত শ্রেণিও প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে পারছে না।

শুধু আয় দিয়ে দারিদ্র্য মাপা যথেষ্ট নয়, দারিদ্র মাপার আর একটি অন্যতম প্রধান পদ্ধতি হচ্ছে, খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে কত ক্যালোরি গ্রহণ করা হচ্ছে যেন তার পুষ্টিমান ঠিক থাকে। এমনও হতে পারে যে আয় বেড়েছে, কিন্তু ক্যালোরি গ্রহণ বাড়ে নাই। সরকারি হিসাবে প্রতিদিন ২,২১০ কিলোক্যালোরি গ্রহণ করা হচ্ছে। এই তথ্য একটু পুরনো ২০১৬ সালের; কিন্তু বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে এই তথ্যই পাওয়া যাচ্ছে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হলে গড়ে ২,১৮৬ ক্যালোরি হলে যথেষ্ট। কাজেই আপাত দৃষ্টিতে ক্যালোরি গ্রহণ কমে গেলেও, পুষ্টির দিক থেকে বিপজ্জনক নয়। তবে এই ক্যালোরি গ্রহণ কি গরিব মানুষের খাদ্যগ্রহণ ধরে করা হয়েছে? তাদের আলাদাভাবে করলে দৈনিক কত ক্যালোরি গ্রহণ করা হচ্ছে তা দেখা যেত। গরিব মানুষ শারীরিক পরিশ্রম করে খায়; তাহলে তাদের ক্যালোরি গ্রহণের প্রয়োজন অন্যদের তুলনায় বেশি। তারা যা খাচ্ছে তার মধ্যে ভাত, আলুর পরিমাণ বেশি অর্থাৎ বেশি কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করা হচ্ছে; অন্যদিকে প্রোটিন গ্রহণের মাত্রা একেবারেই কম। পুষ্টির দিক থেকে খাদ্যের মধ্যে কার্বোহাইড্রেট এর পরিমাণ ৬০% এর বেশি হওয়া ঠিক নয়। অথচ গরিবদের ক্ষেত্রে তাই হচ্ছে।   

টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট বা এসডিজি-র লক্ষ্যমাত্রা ২.১  অনুযায়ী "২০৩০ সালের মধ্যে সকল মানুষ, বিশেষ করে, অরক্ষিত পরিস্থিতিতে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী, দরিদ্র জনগণ ও শিশুদের জন্য বিশেষ অগ্রাধিকারসহ বছরব্যাপী নিরাপদ, পুষ্টিকর ও পর্যাপ্ত খাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করে ক্ষুধার অবসান ঘটানো।" আমরা কি সেদিকে যাচ্ছি বা যেতে পারছি, নাকি উল্টো দিকে হাঁটছি। মানুষের আয় কমে যাওয়া এবং দ্রব্যমূল্য ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকলে পুষ্টিকর ও পর্যাপ্ত খাদ্য মানুষ পাবে না ধরে নেয়া যায়। বাংলাদেশ ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়ায় আছে। বিশ্বে আমাদের ভাবমুর্তির জন্য এটা ইতিবাচক।  কিন্তু সেটা অর্জন করতে হলে শুধু মাথাপিছু আয় বেশি দেখালেই হবে না, জনগণের পুষ্টিমানটা নির্ণয় করতে হবে। আইসিডিডিআর,বি এর তথ্য অনুযায়ী, পুষ্টিহীনতার কারণে বছরে ১ বিলিয়ন ডলার বা ১,০০০ কোটি টাকার উৎপাদনশীলতা হারাচ্ছে, ৩৫% মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীন অবস্থায় আছে, প্রায় ৬ লক্ষ শিশু মারাত্মক পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। নারীদের অবস্থাও খুব খারাপ। প্রায় ৫০% নারী রক্তশূন্যতায় ভুগছে, আর এক-তৃতীয়াংশ নারীর ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় কম। 

যে প্রশ্ন দিয়ে শুরু করেছিলাম- মানুষ কি খেতে পারছে? উত্তর শুধু হ্যাঁ বা না নয়- এর সাথে সম্পৃক্ত মানুষের জীবন দিয়ে বুঝতে পারছি, আসলেই অবস্থা ভালো নয়।

মেগা প্রজেক্ট করে দেশের উন্নতি দেখানো এক কথা; আর মানুষের খাদ্যগ্রহণ, পুষ্টিমানসহ জীবনযাত্রার উন্নতি করে উন্নয়ন দেখাতে পারলেই তা অনেক বেশি টেকসই এবং গ্রহণযোগ্য হবে।   


  • লেখক প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী

লেখাটি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড -এ ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২৩-এ প্রকাশিত হয়েছে। 

Tuesday, February 14, 2023

অনির্বাচিত সরকারের জন্য শেখ হাসিনার যত লড়াই

একাদশ জাতীয় সংসদের চলতি ২১তম অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্য দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কমপক্ষে তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশ বার উচ্চারণ করেছেন ‘অনির্বাচিত সরকার’ শব্দ দুইটি। তিনি বলেছেন,অনির্বাচিত সরকারের স্বপ্ন যাঁরা দেখছেন, তাঁদের সেই ‘দুঃস্বপ্ন’ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেছেন, ‘অনির্বাচিত সরকার আর জীবনে হবে না।' আরকেটি কথা তিনি বলেছেন। তাঁর আমলেই নাকি জনগণ ভোট দিতে পারে। এই দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। প্রথম ধরা যাক অনির্বাচিত সরকার কী এবং সেই সরকার আনার ক্ষেত্রে কার অবদান কতটুকু।


এক। তিনি দীর্ঘ প্রবাসজীবন শেষে ১৯৮১ সালের ১৭ মে বাংলাদেশে ফিরে আসেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসাবে। এর ১৩ দিনের মাথায় চট্টগ্রামে চক্রান্তকারীদের হাতে শহিদ হন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। এর এক বছর পর  ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সেনা প্রধান লেঃজেঃ এরশাদ এক সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাত্তারকে হটিয়ে গঠন করেন অনির্বাচিত সরকার। আওয়ামী লীগের মুখপত্র বাংলার বাণী এরশাদের সমরিক অভ্যূত্থানকে স্বাগত জানিয়ে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। এই প্রসঙ্গে লেঃজেঃ এরশাদ লিখেছেন, 'আমি যে কোনো সামরিক শক্তি প্রদর্শন করে দেশের শাসনভার গ্রহণ করিনি, এটা তিনি (শেখ হাসিনা) ও তার দল (আওয়ামী লীগ) পরিষ্কার করেই জানতেন। তা না হলে ১৯৮২ সালে সামরিক আইন জারির পর তার দলের মুখপত্র বাংলার বাণীতে সামরিক শাসনকে স্বাগত জানিয়ে সম্পাদকীয় লেখা হতো না।'  — আমার কর্ম আমার জীবন, পৃষ্ঠা ৩৭৫।


দুই। তবে এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণের এক বছরের মধ্যেই  প্রথম রক্তক্ষয়ী আন্দেলন হয়  ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। মজিদ খানের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে সেদিনের শিক্ষাভবন ঘেরাও আন্দোলনে জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল, কাঞ্চন, দিপালী সাহাসহ বহু শিক্ষার্থী শহিদ হয়। শুরু হয় স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫ দল এবং বিএনপির নেতৃত্বে ৭ দলীয় জোটের যুগপৎ আন্দোলন। সিদ্ধান্ত হয় এরশাদের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না কোনো জোট। নির্বাচনে গেলে তারা জাতীয় বেঈমান হিসাবে চিহ্নিত হবে। কিন্তু ৮৬ সালে এরশাদের অধীনে নির্বাচনে যেতে আওয়ামী লীগ একতরফা সিদ্ধান্ত নেয়। ভেঙে যায় ১৫ দলীয় জোট,গঠিত হয় ৮ দল ও ৫ দলীয় বাম জোট। আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে ৮দল, বিএনপির নেতৃত্বে ৭দল এবং বাম দলগুলোর নেতৃত্বে ৫দলীয় জোট নতুন মাত্রায় আন্দোলন করে  ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সরকারের পতন ঘটায়। এরপর তিনজোটের রূপরেখা অনুযায়ী  প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত হয় দ্বিতীয় অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। স্মরণকালের সর্বাধিক ভোটারের অংশগ্রহণে সেই নির্বাচনে বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু আওয়ামীলীগের সভানেত্রী হিসেবে তিনি বহুল প্রশংসিত সেই নির্বাচনে সুক্ষ্ম কারচুপি আবিষ্কার করলেন।

দৈনিক খবর, ফেব্রুয়ারি ৫,  ১৯৯৬



তিন। তিনি ঘোষণা দিলেন বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সরকারকে একদিনও শান্তিতে থাকতে দেবেন না। শুরু হয় তাঁর আন্দোলন। মাগুরা উপনির্বাচন সেই আন্দোলনে ঘি ঢেলে দেয়। সামনে হাজির হয় জামায়াত আমীর গোলাম আযমের কেয়ারটেকার সরকার ফর্মুলা। সেটাকে লুফে নিয়ে  তিনি বেগবান করলেন অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আন্দোলন। ১৭৩ দিন হরতাল অবরোধ দিয়ে অবশেষে ১৯৯৬ সালের ২৬ মার্চ রাতে বিএনপি সরকারের সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করাতে সক্ষম হন। গঠিত হলো বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার।


চার। .বহুল আলোচিত ঘৃণিত মঈন উদ্দীন-ফখরুদ্দিন  গং-এর এক -এগারোর অনির্বাচিত সরকার গঠনের শতভাগ দাবিদার তিনি নিজেই। সেটা তিনি সেসময় তাদের প্রেসক্রিপশনে বিদেশ যাওয়ার প্রাক্কালে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেছিলেন এক-এগারোর সরকার তাঁর আন্দোলনের ফসল। তাদের সকল কর্মকাণ্ড তিনি ক্ষমতায় গেলে অনুমোদন দেবেন। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় গিয়ে তিনি কথা রেখেছেন।


অর্থাৎ দেখা যায় যতগুলো অনির্বাচিত সরকার গঠিত হয়েছে সবগুলোর পেছনে তাঁর রক্তক্ষয়ী অবদান আছে। এখন তিনি বিনা ভোটে এবং মধ্যরাতের ভোটে নির্বাচিত হয়ে মহান সংসদে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন আর কোনোদিন অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসবে না। তিনি কোনো জ্যোতিষী নন যে ভাগ্য গণনা করে কিছু বলতে পারেন। অনির্বাচিত সরকার কখনও বলে কয়ে আসে না পরিস্থিতিই অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় বসায়। শুধু সময় ও সুযোগের অপেক্ষা মাত্র।


সংসদের ২১তম অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে আরেকটি কথা বলেছেন, তাঁর আমলেই জনগণ কেবল ভোট দিতে পারে। তাঁর আমলে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে বিনা ভোটে ১৫৪ জন এমপি হয়েছেন। আর বাকি আসনে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। আর ২০১৮ সালের নির্বাচন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে নিশি রাতের ভোট হিসাবে।


আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যে,চট্টগ্রামে এক কেন্দ্রে আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভরে রাখা হয়েছে। স্বয়ং প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ কে এম নুরুল হুদা বলেছেন,দিনের ভোট যাতে রাতে না হয় সেজন্য ভোট কেন্দ্রে ইভিএম চালু করা হবে।


আওয়ামী ঘরানার সাংবাদিকরাও বলেছেন, ২০১৮ সালে দিনের ভোট আগের রাতেই সম্পন্ন করা হয়েছে। সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়বে দেখে তারা বিষয়টি চেপে যান। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটবাক্স ভরার অভিযোগের বিষয়টি প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিয়ে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, ‘রাতে কিন্তু কাজটা (ভোট দেওয়া) হয়। হয় মানে কী, আমরাই করাইছি। কী বলব এটা হয়। এটা হয় না,  ঠিক না।’  — ডেইলি স্টার, জুলাই ৩১,   ২০২২।


আর জাপানের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি তো হাটে হাড়ি ভেঙে দিয়েছেন। তিনি বিদায় বেলা বলে গেছেন,  ‘দিনের ভোট রাতে হয় এমন কথা তিনি আগে কখনও শোনেননি’। ২০১৮ সালের নির্বাচন সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে  নাওকি বলেন, ‘আমি শুনেছি, (গত নির্বাচনে) পুলিশের কর্মকর্তারা আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করেছেন। আমি অন্য কোনো দেশে এমন দৃষ্টান্তের কথা শুনিনি। —  প্রথম আলো।

এমন সব জলজ্যান্ত সত্যের বিপরীতে দাঁড়িয়ে তিনি বলছেন কেবল আওয়ামীলীগ সরকার আমলে মানুষ ভোট দিতে পারে।



গণতন্ত্রের পতাকা হাতে রাজপথে দেশনায়ক তারেক রহমান

ডিসেম্বর ১৯, ২০২২-এ, ঘোষিত  ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা’ শীর্ষক ২৭ দফা পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে বিকাশমান ঋণাত্মক উপাদানসমূহের জেটিয়ে বিদায় করার একটি দার্শনিক উদ্যোগ বলা যায়৷ ২৭ দফার ২য় দফাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ৷ ‘প্রতিহিংসা ও  প্রতিরোধের রাজনীতির বিপরীতে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক  ‘rainbow nation’ প্রতিষ্ঠা করা হবে৷ এজন্য একটি    ‘national reconciliation commission’ গঠন করা হবে ৷


৭৫ সালে ৪র্থ সংশোধনীর ফলে ৭২ সালের সংবিধানে লিপিবদ্ধ ওয়েস্ট মিনিস্টার গণতন্ত্রের কাঠামো ও মূল্যবোধকে শাসনতন্ত্রের বইয়ে বন্দি করে আওয়ামী লীগ নিজেকে বাকশাল চেতনা নিয়ে উত্তর কোরিয়ান পতাকা হাতে ফ্যাসিবাদে রূপান্তর ঘটিয়েছেন ৷


এশিয়ায় সরকার ব্যবস্থার দিক থেকে তিনটি ধরণ প্রতীয়মান হয় — এক৷ উদার গণতন্ত্র, liberal democracy দুই ৷ নির্বাচনী গণতন্ত্র, electoral democracy  তিন ৷ অগণতন্ত্র, non democracy। 


নির্বাচনী গণতন্ত্রের আরো একটি ঋনাত্মক ঝোঁক বাংলাদেশ এবং উত্তর কোরিয়ায় বিকশিত হচ্ছে।   উন্নয়ন  ব্যক্তি বা দলের আদর্শ হয় না৷ উন্নয়ন রাষ্ট্রের কল্যাণধর্মীতার একটি বৈশিষ্ট৷ আওয়ামী লীগের ‘উন্নয়নের গণতন্ত্র’  রাষ্ট্রব্যবস্থাপনার কোন ধরণ হতে পারে না৷ পৃথিবীতে সংজ্ঞায়িত  রাষ্ট্র ব্যাবস্থাপনার ধরণগুলি হলো — গণতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, রাজতন্ত্র, অগণতন্ত্র, উদার গণতন্ত্র, নির্বাচনী গণতন্ত্র, সামাজিক গণতন্ত্র, জনগণতন্ত্র ইত্যাদি যা গণতন্ত্রেরই বিভিন্ন ধরন ৷


রাষ্ট্রের প্রধান উপাদান সরকার৷ সরকারের চরিত্রের উপর  নির্ভর করে দমন মাত্রা ও কল্যাণকামিতা ৷ বাংলাদেশের সরকার প্রচণ্ড দমনদক্ষ এবং নির্বাচনবিহীন কারচুপিতে ওস্তাদ, ৭২ সালের সংবিধানের ওয়েস্ট মিনিস্টার টাইপ অব ডেমোক্রেসি,  সকল মূল্যবোধ, কাঠামো, প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে ফ্যাসিবাদে পরিণত হয়েছে ৷

তারেক রহমান

রাষ্ট্র শাসনব্যবস্থার এখন পর্যন্ত বিশ্বে উত্তম রূপটি হলো ওয়েস্ট মিনিস্টার টাইপ অব ডেমোক্রেসি ৷ গণতন্ত্রের এই রূপটি হরণ করে এক চরম বুর্জোয়া পুঁজিবাদী  সংকটের  উদ্ভব ঘটিয়েছে আওয়ামী লীগ ৷ দেশে জাতীয় পুঁজির বিকাশ না ঘটে লুটেরা মুৎসুদ্দি পুঁজির  বিকাশ ঘটেছে৷ ১৯৪৯ সালে শহীদ সোহরাওয়ার্দি ও জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের ওয়েস্ট মিনিস্টার টাইপ অব ডেমোক্রেসির যে পতাকা হাতে নিয়ে আওয়ামলীগের যাত্রা শুরু করেছিলেন এবং এক রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৭২-এর সংবিধান অর্জিত হলো সেই সংবিধানকে ১৭ বার কাটছাট করার ফলে দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ মিছিল করে বলছে ‘ভোট ও ভাতের অধিকার চাই’৷ চতুর্থ সংশোধনীর ধারাবাহিকতায়  পঞ্চদশ সংশোধনীর  কুফল রোধ করতে দেশের গণতন্ত্রকামী ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী জনগণ গণতন্ত্রের পতাকাটি শহিদ জিয়ার সুযোগ্য সন্তান দেশনায়ক তারেক রহমানের হাতে তুলে দিয়েছেন ৷


———

লেখক রাজনীতিবিদ 

এত দুর্নীতির পরেও কেন আমরা চ্যাম্পিয়ন হতে পারছি না

এইবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল-টিআই’র দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান এক ধাপ নেমে গিয়ে বারোতম হয়েছে । এটুকু শুনেই আমরা বহুত খুশি! আমরা সব সময় সব কিছু সোজাভাবেই দেখি। মাঝে মাঝে কিছু জিনিস যে উল্টিয়ে দেখতে হয়, সেই জরুরি কথাটি ভুলে যাই! আমাদের চিন্তাজগতের এই গলদটি দিয়েই টিআইবি/ সিপিডি বলয়ের ২০/২২ জন সুশীল আমাদেরকে তাদের ইচ্ছেমত হাসায়, কাঁদায়, ক্ষেপায় আবার ইচ্ছেমতই ঘুম পাড়িয়ে রাখে। এরাই আমাদের কাউকে অগ্রসর চিন্তার মানুষ বানায়, কাউকে অনগ্রসর, uncouth খেতাব দেয়। এরাই ঠিক করে দেয় কাদের দেশপ্রেম টুইটুম্বর আর কাদের দেশপ্রেম একদম নেই ! 

এরা এদের ইন্টেলেকচুয়াল করাপশন বা বুদ্ধিবৃত্তিক অসততার  মাধ্যমে সত্য-মিথ্যা,  ন্যায়-অন্যায় মাপার আমাদের সেন্সরগুলোকে নষ্ট বা বিকলাঙ্গ করে ফেলেছে! কোন ইস্যু নিয়ে আমরা কতটুকু চেঁচামেচি করব, একটা জায়গায় বসে এরা এগুলোও ঠিক করে দেয়!

এদের ইন্ধনেই আমরা দুই কোটি টাকার পদ্ধতিগত ত্রুটি দেখে ক্ষেপে যাই আবার বছরে লাখ কোটি টাকার উপরে মুদ্রা পাচার দেখেও না দেখার ভাণ করি। এক ক্যাশিয়ার এক লাখ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে নয় ছয় করলেও তাকে পি-নাট বলে গণ্য করি! ফি-বছর বাজেটের এক তৃতীয়াংশ স্রেফ লুটপাট হলেও তাকে উন্নয়ন বলে গণ্য করি ! এদের কল্যাণেই সারা দেশটি খাওয়া বা জয়বাংলা হলেও এখনও সেই হাওয়া ভবনের নাম শুনে আঁৎকে উঠি ! 

টিআই কর্তৃক  ২০০১ সালে যে পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা  হয়েছিল তার চেয়ে আজকের বারোতম স্থান অধিকারী হিসাবে বাংলাদেশের  দুর্নীতি কি আসলেই কম? গত পনের বছরে এত দুর্নীতি হলো কিন্তু ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল একবারও চ্যাম্পিয়ন বানালো না, এই প্রশ্নটি আমরা কেউ তুললাম না। কিন্তু ডোনারদের খুঁদ-কুড়ার প্রবাহ অব্যাহত রাখতে গিয়ে যৎ-সামান্য সত্য কথা লিখেছে সেটুকু প্রচার করেই আমরা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছি। মনে করেছি, এতেই বুঝি ফ্যাসিবাদের মসনদ তছনছ হয়ে পড়ল । অথচ এই টিআইবি/সিপিডিরাই যে ফ্যাসিবাদকে এনেছে এবং এখনও টিকিয়ে রেখেছে, সেই কথাটি বেমালুম ভুলে যেতে বসেছি ! 

২০০১ সালে বাংলাদেশকে দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করে টিআইবি দারুণ মওকাটি মারে!  কারণ এই হিসাব বা আমলনামাটি  ছিল আগের বছরের, যখন  ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ!  অর্থাৎ টিআইবি এখানে উদোর পিণ্ডিটি চমৎকারভাবে বুধোর ঘাড়ে বসিয়ে দিলেন!  ইফতেখারদের সেই বিশেষ তোহফাটি আওয়ামী চাপাবাজেরা এমনভাবে প্রয়োগ করে যে স্বল্পভাষী বিএনপি নেতারা  আসল কথাটি আর খুলে বলতে পারেন না।   ২০০১ সালে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা ছিল অত্যন্ত হিসাব করা টিআইবি মাস্টারমাইন্ডের একটি সুচিন্তিত পদক্ষেপ।  সেই তকমাটি দিয়েই মূলতঃ দেশের গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের  বিরুদ্ধে এক-এগারো নামক ষড়যন্ত্রের  বীজটি বপন করা হয়!

কাজেই দুর্নীতিতে ইফতেখাররা আমাদেরকে চ্যাম্পিয়ন বানাবেন নাকি আরেকটু আরামদায়ক পজিশনে রাখবেন সেটা নির্ভর  করে  ইফতেখারদের দেশীয় পছন্দ- অপছন্দের উপর।

ইফতেখার মিয়াদের টিআইবি ছাড়াও আরও অনেক গ্লোবাল বডি সৃষ্টি হয়েছে। সেই সব রিলায়েবল সূত্র থেকে সবাই জানতে পারছি যে এই দেশ থেকে গত ১৫ বছরে গড়ে পাচার হয়েছে এক লাখ কোটি টাকা বা দশ বিলিয়ন ডলার! প্রতিবছর  বাজেটের এক তৃতীয়াংশ অপচয় বা স্রেফ লুট হচ্ছে । রাস্তাঘাট, ব্রিজ, মেট্রোরেল নির্মাণে খরচ হয় সারা বিশ্বে সর্বোচ্চ অথচ মানের দিকে এসব রাস্তাঘাট এশিয়াতে শুধু নেপালের আগে । রাজকোষকে নিজের বাপের সিন্ধুক মনে করে বিলিয়ন ডলার তুলে নেওয়া হয়। এক ইসলামী ব্যাংক থেকেই  লোপাট করা হয়েছে এক লাখ কোটি টাকা। ২০০১ সালে যখন চ্যাম্পিয়ন বানানো হয় তখন দুর্নীতির অংক ছিল মাত্র এক বা দুই ডিজিটের কোটি টাকা- সর্বোচ্চ  শত কোটি টাকা। এখন তা  চার  থেকে ছয়  ডিজিটের  কোটি টাকা  মানে হাজার বা লাখ কোটি টাকা । তারপরেও আমরা দুর্নীতিতে এখনও চ্যাম্পিয়ন না হয়ে বারোতম থাকলাম কেমন করে ? 

এটিই ইফতেখার ম্যাজিক!  এটিই সুলতানা কামাল, টিআইবির প্রাক্তন চেয়ার পারসন ম্যাজিক !

তবে জনগণ যাতে তাদের প্রকৃত চেহারাটি চিনে ফেলতে না পারে তজ্জন্যে - আমি খাড়ায়া পড়মু,  আফনে বসাইয়া দেবেন,  এই ধরণের কিছু খেলা খেলতে হয়! মাঝে মাঝে বর্তমান  সরকারের মন্ত্রী বা নেতাদের সাথে বাকচিতে জড়িয়ে নিজেদের নিরপেক্ষতা যে অত্যন্ত সহীহ - সেটা বুঝিয়ে দেন । হাছান মাহমুদের সাথে এমনই এক বাকচিতে বলে দেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে, টিআইবি এ কথা বলেনি ।

রেল লাইনের খরচ ছাড়াই ১০ হাজার কোটি টাকার পদ্মা সেতুর খরচ হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকার উপরে!  ইন্ডিয়ার ভূপেন হাজারিকা সেতুসহ পৃথিবীর আরও অন্যান্য জায়গার  সেতুর খরচ তুলনা করলে এটিকে অস্বাভাবিক মনে হয়।  কিন্তু ইফতেখারুজ্জামান এখানে দুর্নীতির কোনো গন্ধ খুঁজে পান নাই! কুমারী মেয়ের সাত মাসের পেট নিয়ে কানাঘুষা শুরু হলেও টিআইবির মেথডলজি বলছে এখনও শতভাগ ভার্জিন।  জনগণের খালি চোখে বা সাধারণ অনুভবে যা ধরা পড়ে টিআইবির কথিত  মেথডলজিতে তা ধরা পড়ে না!  কারণ রেসপন্ডেন্টদের যে স্যাম্পলগুলি নেন তার সবগুলোই বায়াসড।

একারণেই ২০০১ সালের চেয়ে হাজারগুণ দুর্নীতি হলেও  এখনও আমরা বারো নম্বরেই আছি,  চ্যাম্পিয়ন হতে পারি নাই! 

২০১৬ সালে কোনো রাখঢাক না রেখেই  এই মিয়াসাব বলেছিলেন, টিআইবি সরকারের সহায়ক শক্তি। এই খুশীর সংবাদটি  শিরোনাম করে জানিয়েছিল  গোলাম সারওয়ারের দৈনিক সমকাল ফেব্রুয়ারি ৯,  ২০১৬-এ।  মাঝে মাঝে টিআইবির একটু আধটু খাড়ানো দেখে আমরা এই কথাটি ভুলে যাই।

দেশের ৯৫ ভাগ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চাইলেও নিরপেক্ষ এই মিয়াসাব বলছেন , তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন নেই । 

কিন্তু কোন জিনিসটা বেশি প্রয়োজন তা ঠিকঠাক মতই জানিয়ে দিয়েছেন। বিএনপির ২৭ দফা ঘোষণায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থানের কথা বলা হলেও তাদের নেতৃত্বের শীর্ষে আদালতের রায়ে সাজাপ্রাপ্তদের রাখাকে ‌‌‘সাংঘর্ষিক ও নৈতিক অবক্ষয়’ বলে আখ্যায়িত করেছেন যুগের এই যুধিষ্ঠির!


জাতির এই ‘মে’সাব’, মিয়াসাবের সংক্ষিপ্তরূপ,  অনেক সময় ঘুমিয়ে কাটান।  তাই অনেক কিছু তার চোখে ধরা পড়ে না। যে আদালতের মাধ্যমে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে এই সাজা দেওয়া হয়েছে খোদ সেই আদালতের গ্রহণ যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ইউএস কান্ট্রি রিপোর্টসহ দেশ বিদেশের নামিদামি অনেক সংস্থা।  সরকারের মনের মত রায় না দেওয়ায় সিটিং প্রধান বিচারপতিকে আক্ষরিক অর্থেই লাথি দিয়ে দেশ থেকে তাড়ানো হয়েছে!  বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে একটি দুর্নীতির মামলা  থেকে বেকসুর খালাস দেওয়ায় জাজ মোতাহার হোসেনকে জীবন বাঁচাতে দেশ ছাড়তে হয়েছে।  বিচারপতি এস কে সিনহা এবং জাজ মোতাহার হোসেনের এই পরিণতি দেখার পর দেশের মধ্যে আর কোন বিচারকের কি সাহস হবে সরকারের ইচছার বাইরে যাওয়ার?  ‘মেসাব’  কি বিষয়টি একটু খোলাসা করে বলবেন?

বেগম খালেদা জিয়ার দণ্ড সম্পর্কে ইউএস কান্ট্রি রিপোর্টের একটি লাইন - “ International and domestic legal experts commented on the lack of evidence to support the conviction, suggesting a political ploy to remove the leader of the opposition from the electoral process.”

পোল্যান্ড থেকে পিএইচডি করা জাতির এই ‘মেসাব’কে, শ্বশুর শ্রেণীর মুরব্বিদের সমীহ করে মেসাব ডাকা হয়,   কি এই ইংরেজি বাক্যটি অনুবাদ করে দিতে হবে?

নিরপেক্ষ এই মেসাবদের আরেকটি কৌশল হলো - False Equalization, বা মিথ্যা সমতাকরণ!  আওয়ামীলীগকে বিশেষ সুবিধা দিতে বা কোনো আওয়ামী অপকর্মকে ঢাকতে আওয়ামীলীগের সঙ্গে বিএনপির কল্লাও  ঢুকিয়ে দেন! সবাই যখন হিরো আলম সম্পর্কে   ওবায়দুল কাদেরের মন্তব্য নিয়ে কঠোর সমালোচনা শুরু  করেছেন তখন মির্জা আলমগীরের মন্তব্যেও দারুণ কিছু আবিষ্কার করে ফেললেন!

এই নিরপেক্ষ সমতাকারী বলেন, “গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে আমরা দেখেছি, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘হিরো আলম এখন জিরো হয়ে গেছে। হিরো আলমকে বিএনপি নির্বাচনে দাঁড় করিয়েছে। তারা সংসদকে ছোট করার জন্য হিরো আলমকে প্রার্থী করেছে।’ উল্টোদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘এই আওয়ামী লীগ হিরো আলমের কাছেও কতটা অসহায়। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে তার সঙ্গে জিততে হয়।’  “দুই ক্ষেত্রেই সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী আশরাফুল হোসেন আলমকে অবজ্ঞা বা তাচ্ছিল্যসূচক বিবেচনায় পরস্পরকে আক্রমণ করেছেন দুই নেতা।”

'অমুক অত্যন্ত নিরীহ/সহজ/সরল  মানুষ'  এটা বলা আর অমুক সংসদে আসলে সংসদ ছোট হয়ে যাবে - এই দুটির  ভাব কি এক হলো?

এই হিরো আলমকে কারা নির্বাচন  থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিল? কাদের উচ্চারণে অবজ্ঞা প্রকাশ পেয়েছে?

হিরো আলম একজন সহজ, সরল নিরীহ মানুষ।  তার কাছেও আওয়ামী লীগ অসহায় হয়ে পড়েছে।  বর্ণনার প্রয়োজনে কারও সঠিক সামাজিক অবস্থান তুলে ধরলে কি  তাকে অপমান করা হয়?  মির্জা আলমগীর এখানে হিরো আলমের প্রতি কোথায় অবজ্ঞাটি দেখালেন ?

আমরা জানি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ চাপ্টারটির নাম  ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা সংক্ষেপে টিআইবি । মূল সংগঠনটির একটি ভালো উদ্দেশ্য থাকলেও এর বাংলাদেশ চ্যাপ্টারটিকে হীন রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছে ইফতেখার ও সুলতানা কামাল গং! শুধু হীন রাজনৈতিক স্বার্থ নয় - হীন ব্যক্তি স্বার্থেও প্রতিষ্ঠানটি ব্যবহৃত হচ্ছে! ড. ইউনূসকে বয়সের কারণ দেখিয়ে তার ব্রেইন চাইল্ড গ্রামীণ ব্যাংক থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।  অথচ এই ইফতেখারের রিটায়ারমেন্ট বয়স অনেক আগে পেরিয়ে গেলেও তিনি এখনও বহাল তবিয়তে আছেন। 

আন্তর্জাতিক এই সংস্থাটিকে সূক্ষ্মভাবে নিজেদের চেতনায় ব্যবহার করে গেছেন অথবা এখনও করে যাচ্ছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক  ইফতেখারুজ্জামান এবং প্রাক্তন চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল । এর ট্রাষ্টিবোর্ডটি সর্বদা একই ঘরানার সুশীল দিয়ে গঠন করা হয়। বর্তমান ট্রাস্টিবোর্ডের চেয়ারম্যান থেকে ট্রেজারার, সদস্যসমূহ কেহই এই চেতনার বাইরে নন । ডেইলি স্টারের মাহফুজ আনাম এর ট্রেজারার । আমাদের দিপু মনির হাজবেন্ড ট্রাস্টি বোর্ডের একজন মেম্বার! আবার মাহফুজ আনামের স্ত্রী শাহীন আনাম মানুষের জন্যে ফাউন্ডেশনের কর্ণধার,  সেটার গভার্নিং বডির মেম্বার এই ইফতেখারুজ্জামান।  অর্থাৎ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ইনারাই সব।

এদের প্রতি আরেকটু নজর দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। এদেরকে বুদ্ধিবৃত্তিক এবং রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করতে না পারলে এই জাতির  মুক্তি কোনোদিন হবে না!

———

লেখক রাজনৈতিক বিশ্লেষক 

———

Saturday, February 11, 2023

নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির

——— আমিরুল ইসলাম কাগজী

এক। 

এবার গরীবের পাতে পুষ্টির প্রধান যোগানদাতা পোল্ট্রি মুরগিও নাগালের বাইরে চলে গেল। এতদিন যারা অতি কষ্টে তিনশো চারশো টাকা সঞ্চয় করতে পেরেছে তারা সপ্তাহে অন্তত একদিন মাংসের স্বাদ নিতে পেরেছে। সোমবার, ফেব্রুয়ারি ৬, ২০২৩,  থেকে সেই মুরগির দাম দুশো টাকা ছাড়িয়ে গেছে। আর ডিমের হালি ৫০ টাকা। বাজারে কোনো মাছ এখন তিনশো টাকার নিচে নেই। রুই কাতলা চারশো পাঁচশো টাকার ওপরে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এগ্রোফিডের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতসহ অন্যান্য পণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে মাছ-মুরগির দাম বেড়েছে।


এগ্রোফিড উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, গরু-ছাগল  ও মাছ-মুরগির খাদ্য প্রস্তুতির জন্য সবচেয়ে বেশি লাগে ভূট্টা ও সয়াবিন। এর সঙ্গে লাগে  রাসায়নিক দ্রব্য এবং মেডিসিন। ডলার সংকটের কারণে এগুলো আমদানি করা যাচ্ছে না। ফলে স্থানীয় বাজারে এগুলোর দাম ক্ষেত্রবিশেষে দ্বিগুণ-তিনগুন বেড়ে গেছে। যার প্রভাবে মাছ-মুরগি-ডিমের দাম আকাশ ছোঁয়া।

চিনি, সয়াবিন তেল, ডাল, আদারসুন, মসলা সবকিছুর দাম এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। খোলা চিনি ১২০ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৪০টাকা দরে। যার কাছে টাকা আছে তার কিনতে সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু যার বেতন বাড়েনি কিংবা মজুরি বাড়েনি তার জন্য বিপদ। কেননা চিনি কোনো বিলাসী পণ্য নয়। নিত্যপণ্য হিসেবে সবার প্রয়োজন।শিশু খাদ্য হিসাবে এটা মহা নিত্যপণ্য।


ইলাস্ট্রেশান —  যুগান্তর 

দুই।

জানুয়ারি ২০২৩ থেকে দু দফায় বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম যা যুক্ত হবে বর্তমান মাসের খরচের সঙ্গে। গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে গত জুন মাসে, ফের পাইকারি পর্যায়ে বাড়ানো হয়েছে গতমাসে। আইএমএফ তাদের ঋণের শর্ত হিসাবে সরকারকে বলেছে, এ দুটো পণ্যসহ জ্বালানি তেল এবং কৃষকের সারের ওপর থেকে ভর্তুকি তুলে নিতে হবে।

অনেক শর্তের মধ্যে আরেকটি শর্ত হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ২০শতাংশের নিচে এবং বেসরকারি ব্যাংকে খেলাপি ১০ শতাংশের নিচে রাখতে হবে।

শর্তগুলোর দিকে তাকালে মনে হতে পারে আইএমএফ ধনী ব্যবসায়ীদের  চাপে ফেলতেই এসব করছে। কারণ বর্তমানে খেলাপি ঋণের কারণে নতুন কোনো উদ্যোক্তা ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারছে না। আইএমএফ এর এই শর্ত কার্যকর হলে খেলাপি ঋণ কমে আসবে এবং ব্যাংকের তারল্যসংকট মোচন হবে। কিন্তু আইএমএফ তো আর বাংলাদেশ ব্যাংককে চেনে না, কাগজে- কলমে ঋণ খেলাপিদের তথ্য এমনভাবে উপস্থাপন করবে যা দেখলে সংস্থাটির বাঘা বাঘা হিসাববিদদের চোখ কপালে উঠবে। অতএব ধণী ব্যবসায়ীরা পগারপার। তারা বাংলাদেশ ব্যাংককে যতই বলছে রিজার্ভের হিসাব সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে সেদিকে কোনো কর্ণপাত করছে না এই কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নয়ছয় করে বলে দিচ্ছে রিজার্ভে আছে ৩০ বিলিয়ন ডলার।কিন্তু আইএমএফ বলছে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের ৮ বিলিয়ন ডলার বাদ দিতে হবে। কারণ এই ৮ বিলিয়ন ডলার কাগজ-কলমে আছে কিন্তু বাস্তবে নেই। ফলে রিজার্ভে আছে ২২ বিলিয়ন ডলার যা দিয়ে আমাদের তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।

বিদ্যুতের ওপর থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার করে নেওয়ার অর্থই হলো দাম বেড়ে যাওয়া। বিদ্যুতের দাম বাড়লে ধনী ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের কোনো সমস্যা হবে না। কারণ তারা পণ্য উৎপাদন করে ভোক্তাদের কাছ থেকে  বাড়তি মূল্য উসুল করে নিতে পারবে। কিন্তু সাধারণ নাগরিকের সে সুযোগ থাকে না। তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির সাথে সাথে গুনতে হয় বিদ্যুতের বাড়তি মূল্য। একইভাবে গ্যাসের ওপর থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার করার অর্থই হলো সাধারণ নাগরিকের পক্ষ থেকে গ্যাসের বাড়তি মূল্য পরিশোধ করা।

গ্যাসের ওপর থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হলে তারও আঁচ লাগে না শিল্পপতিদের গায়ে। কারণ এখানেও ভোক্তা ওই সাধারণ নাগরিক যাদের কাছ থেকে উসুল করা হয় বাড়তি মূল্য।

আইএমএফ এর ঋণ নেওয়ার পর কোনো দেশের গরীব মানুষের কল্যাণ হয়েছে এমন নজির পাওয়া যাবে না। তারা সরকারের চাপে, শিল্পপতিদের চাপে, ব্যবসায়ীদের চাপে এমনকি মধ্যসত্ত্বভোগীদের চাপে চিড়ে চ্যাপটা হয়েছে। তাদের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে, ঋণ করে সংসার চালাতে হয়েছে।

তিন।

আইএমএফের ঋণ পাওয়ার পর সরকারী দলের অনেকেই উল্লাসে আটখানা। তাদের মুখে খই ফুটতে থাকে এই বলে যে, ডলার সংকট কেটে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতি মাসে আমদানি ব্যয় মেটাতে হয় কমপক্ষে ৬ থেকে ৭ বিলিয়ন ডলার। অথচ আইএমএফ  প্রথম কিস্তিতে প্রদান করেছে মাত্র ৪৭ দশমিক ৬০ কোটি ডলার। এটা সাগরে এক বালতি পানি ঢালার মতো।



এলসির ডলার পরিশোধ করতে না পারার কারণে সাগরে ৬৫দিন যাবৎ ভাসছে চিনি, খেজুর, সয়াবিন ও ছোলা বোঝাই জাহাজ। একই কারণে আরও অন্যান্য ৫টি জাহাজ পণ্য নিয়ে সাগরে ভাসছে। যাদের প্রতিদিনের ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে ৭০ হাজার ডলার। এই যে অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে সেটাও উসুল করা হবে সেই আম জনতার কাছ থেকেই। কারণ ব্যবসায়ীরা তো আর লোকসান দিয়ে তার পণ্য বিক্রি করবে না।

অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে রমজান মাস আসার আগেই নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির হয়ে উঠতে পারে। প্রায় প্রত্যেকটি পণ্যের দাম বাড়ছে। কোনো কোনোটির দাম আবার লাগাম ছাড়া। অপরপক্ষে মানুষের আয় কিন্তু বাড়েনি। বাড়তি দামে পণ্য কিনতে গেলে তাকে অবশ্যই খাদ্যতালিকা থেকে অনেক কিছু বাদ দিতে হবে।

———

২৭ দফার চোখেরমণিতে বাকশাল কেন নিজের সর্বনাশ দেখতে পাচ্ছে


রাষ্ট্র সংস্কার ও মেরামতের নিমিত্তে বিএনপি ২৭ দফা কর্ম পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। এটা  দেখে আওয়ামীবলয়ের প্রতিক্রিয়াগুলো খুবই চিত্তাকর্ষক লাগছে । ওবায়দুল কাদেরসহ কয়েকজনের মন্তব্য এই শুষ্ক  হৃদয়টিকেও মনে হয় ভিজিয়ে ফেলেছে! মনে পড়ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই কবিতাখানি — 

‘প্রহর শেষের আলোর রাঙায় সেদিন চৈত্রমাস

তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ ।’ 

ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপির রাষ্ট্রমেরামতের রূপরেখা একটি স্ট্যান্টবাজি। হাসান মাহমুদ বলেছেন, বিএনপি নেতাদের মুখে রাষ্ট্র সংস্কারের কথা হাস্যকর ।

আলগা মোমেন হতাশার রশিটাকে  আরেকটু  আলগা করে দিয়েছেন।  তিনি বলেছেন,  বিএনপির ২৭ দফা হাস্যকর,  মানবাধিকারের কথা ভাঁওতাবাজি! আমু বলেছেন, বিএনপির ২৭ দফা  যুদ্ধাপরাধীদের স্বীকৃতির দলিল ! ৭১ টিভি জানিয়েছে, ২৭ দফার একটি দফাও পছন্দ হয়নি আওয়ামীলীগের ! জনকণ্ঠসহ আওয়ামী ঘরানার পত্রিকাগুলো  লিখেছে, তাদের এই মেরামতের প্রস্তাব মূলত বাংলাদেশের অর্জনগুলোকে, মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলোকে বাদ দেওয়ার ষড়যন্ত্র।

— এগুলো দেখে নিজের ভেতরের চেতনাকে যতটুকু সম্ভব শাণিত করে একটা ডুবুরি নামিয়ে দিলাম ২৭ দফার কোন জায়গাগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীত কথাগুলি রয়েছে অথবা যুদ্ধাপরাধীদের স্বীকৃতির দলিল কোথায় লুকিয়ে আছে তা খুঁজে বের করার জন্যে।  এই ২৭টি দফা বুলেট আকারে সবার বিবেচনায় পেশ করা হল। আপনারাও খুঁজুন !  দরকার পড়লে বিস্তারিত রূপরেখাগুলি পড়ুন। 

১। সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন

২।  জাতীয় সমঝোতা  কমিশন গঠন

৩।   নির্বাচনকালীন দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন

৪।  রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনয়ন

৫।  দুই মেয়াদের বেশি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী না থাকা

৬।  দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তন

৭।  সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন

৮।  নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন সংশোধন

৯।  সাংবিধানিক সব কমিটি পুনর্গঠন

১০।  জুডিশিয়াল কমিশন গঠন

১১।   প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন

১২।   মিডিয়া কমিশন

১৩।   ন্যায়পাল নিয়োগ

১৪।  সর্বস্তরে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা

১৫।  অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন

১৬। ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার মূলনীতির ভিত্তিতে ধর্ম পালনে পূর্ণ অধিকার ও পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান, আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণ ও সুষম উন্নয়নে বিশেষ কর্মসূচি। 

১৭।   মুদ্রাস্ফীতির আলোকে শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা ।

১৮।  বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ খাতে দায়মুক্তি আইনসহ সব কালাকানুন বাতিল ও অপ্রয়োজনীয় কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় বন্ধ,

১৯।  বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া,

২০। দেশের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষায় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সুসংগঠিত, যুগোপযোগী ও দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত করা,

২১। ক্ষমতার ব্যাপক বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকারগুলোকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করা,

২২।  নিবিড় জরিপের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের তালিকা প্রণয়ন ও যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান,

২৩। আধুনিক ও যুগোপযোগী যুব-উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন,

২৪। নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ,

২৫।  নিম্ন ও মধ্যপর্যায়ে চাহিদাভিত্তিক শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা-কারিকুলামকে প্রাধান্যসহ জিডিপির ৫ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ,

২৬। ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ এই নীতির ভিত্তিতে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রবর্তন ও জিডিপির ৫ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ,

২৭। কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা।


'রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা' উপস্থাপন করছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান 


মুক্তিযুদ্ধের অর্জন কি তাহলে দিনের ভোট রাতে করা? মুক্তিযুদ্ধের অর্জন কি তাহলে দশ হাজার কোটি টাকার পদ্মাসেতু ত্রিশ হাজার কোটি টাকায় করা? মুক্তিযুদ্ধের অর্জন কি তাহলে ১৪ বছরে ৭ লাখ কোটি টাকা বাইরে পাচার করা? মুক্তিযুদ্ধের অর্জন কি তাহলে দেশের একটি বৃহত্তম ব্যাংক দখল করে জনগণের পকেট থেকে এক লাখ কোটি টাকা লুট করা? মুক্তিযুদ্ধের অর্জন কি তাহলে দেশের সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা? মুক্তিযুদ্ধের অর্জন কি ভিন্নমতের বা ভিন্ন আদর্শের লোকদের গুম, হত্যা করা? মুক্তিযুদ্ধের অর্জন কি বিরোধী দলের নেতাকে গায়েবি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে ডাণ্ডাবেরি পরিয়ে মায়ের জানাজা পড়তে দেওয়া?

মুক্তিযুদ্ধের অর্জন কি তাহলে মাংসের পরিবর্তে কাঁঠাল খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া? মুক্তিযুদ্ধের অর্জন কি তাহলে দেশটিকে অন্য একটি দেশের করদ  রাজ্যে পরিণত করে ফেলা? মুক্তিযুদ্ধের অর্জন কি তাহলে কুইক রেন্টালে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে লাখ লাখ কোটি টাকা লুট করা? মুক্তিযুদ্ধের অর্জন কি শেয়ার বাজার থেকে এক লাখ কোটি টাকা লুট করা? মুক্তিযুদ্ধের অর্জন কি কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা  রাজকোষ থেকে কয়েক বিলিয়ন ডলার হাওয়া করে দেওয়া? মুক্তিযুদ্ধের অর্জন কি এসব কথা যেন কেউ উচ্চারণ করতে না পারে তজ্জন্যে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করা? মুক্তিযুদ্ধের অর্জন কি সিঙ্গেল ইউনিটের  চমৎকার এই জাতি  রাষ্ট্রটিকে সর্বনাশা দুইভাগ করা?

আসলে চেতনার নামে দেশ ও জাতির যে সর্বনাশটি  করা হয়েছে বিএনপির ঘোষিত ২৭ দফায়  এর প্রত্যেকটি মেরামত ও  সংস্কারের মূল ফর্মুলাটি দেওয়া  হয়েছে!  বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা স্পষ্ট করা হয়েছে। বিএনপির উপর জনগণের প্রত্যাশা এতটুকু বেড়ে গেছে যে ক্ষমতায় গেলে এই দফাগুলির বাস্তবায়ন থেকে সরে আসা বিএনপির পক্ষে অসম্ভব হবে। বিশেষ করে দুই কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য, দুই মেয়াদের বেশি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী না থাকা, ন্যায়পাল নিয়োগ আমাদের রাজনীতি ও অর্থনীতির চেহারা পুরো পাল্টে দিতে পারে !

লুটপাটের খুঁদকুড়া রক্তে কিংবা চেতনার বীজ মগজে ঢুকলে রাষ্ট্র সংস্কার ও মেরামতের  প্রয়োজনীয়তা  উপলব্ধি করা সম্ভব নয় ! চেতনার এক প্রফেসর জানিয়েছেন তিনি ভোটের আগের রাতে ঘুমিয়ে সকালে যদি দেখেন মুক্তিযুদ্ধের একটি পক্ষ জিতেছে তাতেই তিনি মহাখুশী ! অর্থাৎ আগের রাতে যে নৈশ ভোট  সংঘটিত হলো সেটা নিয়ে উনার কোনো উদ্বেগ নেই । কী ভয়ংকর এক নরসুন্দরকে আমরা জাতির বিবেক বানিয়ে রেখেছিলাম !  মূলত: তারই প্রেসক্রিপশনে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ‘আই অ্যাম এ জিপিএ ফাইভ’ হয়ে গেছে কিংবা পিনাকিদার উচ্চারণে পুরাপুরি জয়বাংলা  হয়ে গেছে!  এক ধরণের বুদ্ধিবৃত্তিক ফ্যাশনে  তাড়িত হয়ে বা চটকদার বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে এই লোকটির বই নিজেদের বাচ্চাদের হাতে তুলে দিয়েছি ! অনেকেই বুদ্ধিবৃত্তিক আদিখ্যেতায় এই মাকাল ফলকে মাথায় তুলে রাখি !

এক প্রাক্তন আমলা মহুকুমা প্রশাসক বা এসডিও থাকাবস্থায়  এক গ্রাম পরিদর্শনে গিয়েছিলেন এবং জনৈক বিশিষ্ট ব্যক্তির আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলেন । নিজের বাড়িতে এমন হাতির পা পড়ায় বেচারা অত্যন্ত শশব্যস্ত হয়ে পড়লেন । এত্তো বড় মেহমানকে কী খাওয়াবেন না খাওয়াবেন সেটা নিয়ে মহা মহা গ্যাঞ্জাম বাঁধিয়ে ফেললেন !  সবচেয়ে মজার ব্যাপারটি ঘটিয়েছিলেন চা খাওয়ানো নিয়ে । ভদ্রলোকের মনে হলো , এতো গণ্যমান্য মেহমান !  কাজেই চায়ে একটু আতর ঢেলে দিলে তা আরও সুঘ্রাণ ছড়াবে এবং অত্যন্ত উপাদেয় হবে । বেচারা এসডিও সাব পড়ে গেলেন মহা মুসিবতে । আতর মিশ্রিত সেই তিতা চা পান করে হোস্টকে খুশি করার মানসে দেখাতে হলো চা  অত্যন্ত উপাদেয় হয়েছে !

এই এসডিও সাবের মত দেশবাসী পড়েছে বিকট সমস্যায়। আমাদের সংবিধানকে বিশেষ চেতনায় চেতনায়িত করতে গিয়ে অনেক আওয়ামী আতর ঢেলে দিয়েছে। এর মধ্যে একটি আস্ত ভাষণও ঢুকানো হয়েছে ! এটি যতই তিতা হোক না কেন, সবাইকে বলতে হচ্ছে,  অত্যন্ত সুস্বাদু হয়েছে।  আতরের  সুন্দর  ও পবিত্র ব্যবহার রয়েছে, তাই বলে সেটা চায়ের মধ্যে ঢেলে নয়। এই হিতাহিত জ্ঞানটিই এই চেতনাবাজরা হারিয়ে ফেলেছে । ফলে সেই চেতনার আতর রাজনীতি, প্রশাসন, বিচারালয়, শিক্ষালয়সহ সবজায়গায় মিশিয়ে জাতীয় জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে ।  দুনিয়ার অন্যান্য সভ্য  জাতির সংবিধানের মধ্যে এর দ্বিতীয় কোনো নমুনা আছে কি?  এখন কেউ যদি  নিজেদের প্রিয় ধর্মগ্রন্থকে হুবহু  সংবিধানে ঢুকিয়ে দেন ,তবে এই উর্বর মস্তিস্কের বিরোধিতা কি ধর্মের  বা সংবিধানের  বিরোধিতা বলে গণ্য হবে?

এরকম শত শত প্রশ্ন জনগণের মনে উঁকি দিচ্ছে? কাজেই বাকশাল যেখানে নিজের সর্বনাশ দেখছে সঙ্গত কারণেই আপামর জনতা সেখানেই  মুক্তির নিশানা খুঁজে  পেয়েছে ! সকল আলামত দেখে মনে হচ্ছে ,  মুক্তির সেই সুবেহ সাদেক  খুব বেশি দূরে নয় !

বাকশালের সাংস্কৃতিক রূপ ও ঘৃণাযুদ্ধ


১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি!  বাকশাল কায়েমে
র পর তাজউদ্দীন আহমেদ বলেছিলেন,  “মুজিব ভাই, এই পদক্ষেপের ফলে আপনি শুধু নিজে মরবেন না।  আমাদেরকেও সাথে নিয়ে মরবেন।” তাঁর এই ভবিষ্যৎ বাণীটি অক্ষরে অক্ষরেই  ফলেছে।  যাকে  তাজউদ্দীন আহমেদ অত্যাবশ্যক হিসাবে ঠাহর করেছিলেন! 

এদেশের মানুষের পরম আকাঙ্খা ছিল গণতন্ত্রের জন্য।  ভয়াবহ একটা যুদ্ধে জড়িয়েছিল মূলত একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্যে! সেই যুদ্ধে আমাদেরকে যারা সহায়তা করেছিল তাদের মতলব ছিল ভিন্ন।   ফলে শুরু হয় এই দেশ ও জাতিকে নিয়ে নতুন খেলা। বাকশালের রাজনৈতিক শাখার সাথে সাথে খোলা হয় সাংস্কৃতিক ও  বুদ্ধিবৃত্তিক শাখা।

বাকশালের রাজনৈতিক রূপটি যতটুকু দানবীয় প্রতীয়মান হয়েছে, এর সাংস্কৃতিকরূপটি ততটুকুই মোহনীয় বা আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করা হয়েছে। জাতীয় আবেগ, অনুভূতি এবং আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে অত্যন্ত কৌশলে এর সাথে যুক্ত করা হয়েছে। বাকশালের এই সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উপাদান এদেশে নানা সময়ে নানা রাজনৈতিক বয়ান তৈরি করে আমাদের মুখে তুলে দিয়েছে। এই কাজে এদের অস্ত্র ছিল ‘স্বাধীনতার চেতনা’ । বুদ্ধিবৃত্তিক এই পালোয়ানদের সবাই ভয় করতেন।  কারণ এই গ্রুপকে নাখোশ করলে সুশীল বুদ্ধিজীবী হিসাবে নিজের অবস্থান ধরে রাখা তো দূরের কথা, মগজে সামান্য বুদ্ধি অবশিষ্ট আছে কী না তা নিয়েই প্রশ্ন দেখা দিত।

এরা সবচেয়ে সফল হয়েছে তথাকথিত এক-এগারোর প্রেক্ষাপট তৈরিতে। মূলত: এক-এগারো মাধ্যমেই  বাকশালের পুনর্জন্ম হয় । আর এক-এগারোর প্রেক্ষপট  তৈরির পেছনে সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বাকশালের দীর্ঘ সময়ের নিরলস প্রচেষ্টা আজ একটু পেছনে তাকালেই স্পষ্ট দেখা যায়। । দুজন পত্রিকা সম্পাদক তো প্রকাশ্যেই জানিয়েছিলেন যে এক-এগারো তাদেরই  ব্রেইন-চাইল্ড । এরা সবাই বৃহত্তর বাকশাল পরিবারের সদস্য I

এদের মূল কাজ  ঘৃণা ছড়ানোর মাধ্যমে একক জাতিসত্ত্বার চমৎকার রাষ্ট্রটিকে স্থায়ভাবে  বিভক্ত করা।  দেখা যায়, ১৯৭১ সালে যে টগবগে তরুণ যুদ্ধে না গিয়ে গর্তে বসবাস করেছিলেন, সেই বৃদ্ধ এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষক হিসাবে  ঘৃণাযুদ্ধের বিরাট বড়  সিপাহসালার সেজে বসেছেন। উনি নির্বাচনের আগের রাতে ঘুমিয়ে পরের দিন সকালে যদি দেখেন ,  যে দল নির্বাচনে জয়ী হয়েছে এবং যে দল পরাজিত হয়েছে উভয়ই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, তাতেই তিনি খুশি।  রাতের বেলায় ব্যালট বাক্স নিয়ে  কী হয়েছে , সেটা নিয়ে প্রশ্ন করবেন না!  দেখুন,  কী ভয়ংকর ফ্যাসিস্ট  ভাবনা এরা নিজেদের অন্তরে গেথে রেখে  পুরো সমাজকে কলুষিত করেছে!  একটি গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণে এরাই মূল প্রতিবন্ধক!

Friday, February 10, 2023

আমার প্রিয় বই : আমার স্বপ্ন আমার দেশ

——— শায়রুল কবির খান


আমার দেখা অসাধারণ ব্যক্তিত্ববান একজন হলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বর্তমানে তিনি বিএনপি মহাসচিব। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তিনি এখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অবশ্য মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে আন্দোলন-সংগ্রাম নতুন কিছু নয়। ১৯৬৯ সাল আইয়ুব শাসনবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে শুরু করে এই দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের এক প্রাণপুরুষ তিনি।

তবে রাজনীতি নয়, শিক্ষক হিসেবে তিনি তার পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন। বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার হিসেবে ঢাকা কলেজসহ আরো কয়েকটি কলেজে শিক্ষকতা করেছেন।

পরে রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার নির্বাচনে পৌরসভা চেয়ারম্যান হয়েছেন। বিপুল ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্য হয়েছেন ও মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন দেশনেত্রী বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সরকারের আমলে।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি'র রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে ঠাকুরগাঁও জেলা বিএনপি সভাপতি হয়েছেন। কৃষকদলের কেন্দ্রীয় কমিটি ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ছিলেন। ক্রমান্বয়ে নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিকভাবে ২০০৯ সাল ডিসেম্বর বিএনপি ৫ম জাতীয় সম্মেলনে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হয়েছেন। ২০১১ সাল ২০ মার্চ তত্কালীন বিএনপি মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেন ইন্তেকাল করার পর ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হয়েছেন। ২০১৬ সাল ১৯ মার্চ বিএনপি মহাসচিব হন।

এতটা লম্বা সময়েও তাকে সামান্য বদনাম নিতে হয়নি। পুরোটা সময় তিনি সন্মান ও সততার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন।

বিগত সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়া তার সভা সেমিনারে বক্তব্য বিবৃতি ও সাক্ষাৎকারগুলো বাছাই করে প্রস্তুত করা হয়েছে এই বই। ইতি প্রকাশনা থেকে ৮০০ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছে। বইটিতে মহাসচিবের একটা ছোট্ট নতুন লেখাও রয়েছে।

আর অর্থনীতিবিদ ডক্টর মহবুব উল্লাহ মুখবন্ধ লেখাটা দিয়েছেন।

প্রচ্ছদ ধারণা দিয়েছেন তার বড় মেয়ে মির্জা শামারুহের জামাতা লেখক ফাহাম আব্দুস সালাম। তিনি ‘বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে’ বইয়ের লেখক।

প্রচ্ছদ থেকে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন- আঁধারের অনেক গভীর থেকে ধীরে ধীরে আলোকরশ্মির মতো বের হয়ে এসেছেন।

——— লেখক সদস্য, বিএনপি মিডিয়া সেল। 


Sunday, February 5, 2023

Bangladesh hikes power price again in less than three weeks

——— The New Age Report/  January 31, 2023



The government has increased the retail power price again — by 5 per cent — along with an increase in the bulk price by over 8 per cent just 18 days after it had hiked the retail price on January 12 this year.

The new retail prices and charges, announced for all 23 consumer categories, will be effective from February 1, said a gazette notification published on Monday but made available on Tuesday.

With the latest hike, the retail electricity price has gone up by 113 per cent since 2009, when the incumbent AL-led government assumed power and this was the 12th time during the period the price was hiked at the retail level. 

The per unit (one kilowatt-hour) retail electricity tariff rose to Tk 4.14 from Tk 3.94 for the minimum-use consumers, the notification said. 

The government increased the bulk power price by 8.06 per cent, Power Division secretary Habibur Raman said on analysing another gazette notification also issued on Monday.

No average retail and bulk power price hike per unit was mentioned in the gazette notifications.

The average price of each unit of electricity rose to Tk 7.49 from Tk 7.13 with the previous hike on January 12, said officials at the Power Development Board while the gazette notification on  that hike also said nothing about the average price.

Earlier on November 21, 2022, the Bangladesh Energy Regulatory Commission increased the average bulk electricity price by 19.92 per cent with effect from December.

Asked if there was any alternative to increasing the power price, secretary Habibur said, ‘I will not make any comment in this regard.’

Both retail and bulk electricity prices have been readjusted under the authority vested in Section 34 (ka) of the Bangladesh Energy regulatory Act, 2003, the gazette notifications said.

The government recently amended the BERC Act empowering the Power Division to raise the power, gas and petroleum fuel prices using administrative power any time it wants.

Resorting to the amended law, the new gazette notifications were issued on Monday to raise the electricity tariff at the bulk and retail levels, bypassing the authorities of the energy regulator.   

According to energy expert Mohammad Tamim, the entire power sector depended on import and the government had no other option as the energy price is high on the global market.

‘The government did not try to explore gas and lift coal in our country. Inflation will increase further as the opportunists businesses will increase prices and people will have to pay the price,’ he said.    

The government last raised the retail price of electricity by 5 per cent on January 12, 2023.

Economists feared that the power price hike would further stoke inflation and lower-income people will suffer the most.

Former Bangladesh Bank chief economist Mustafa K Mujeri told New Age that the power price hike would increase the inflation further and create more adverse impact on the lower-income group in the country as they had already been struggling to cope with the price hike of essentials.

‘The IMF always gives some written and unwritten conditions in providing loans. They always discourage subsidy. There is some link between the $4.7 billion IMF loan and the power price hike,’ he said.

He thought that the government had no other option but to raise the power price considering the current economic situation.

Consumers Association of Bangladesh president Ghulam Rahman said that the government had increased the power price in an non-transparent way and the CAB did not support it.

‘Inflation will increase further and the woes of people would multiply due to the power price hike. The government does not care about people’s welfare and it is fulfilling the IMF conditions for getting the loan,’ Ghulam Rahman explained.

Earlier, State Minister for Power, Energy and Mineral Resources Nasrul Hamid said that from now on the electricity price would be adjusted in the first week of every month, state-run news agency Bangladesh Sangbad Sangstha reported. 

The government, in an executive order, on January 18 increased the retail piped gas prices in four consumer categories by up to 179 per cent with effect from February 1.

Four other consumer categories — household, fertiliser, tea industry and compressed natural gas — did not see any change in their rates but were bracing for multiple impacts from the price hike.

Businesses said that the frequent gas and electricity price hikes were creating instability in doing business.

They also feared the closure of factories in the days to come.     

Bangladesh Knitwear Manufacturers and Exporters Association executive president Mohammad Hatem told New Age that the costs of all raw materials and of manufacturing would increase due to the power price hike.

‘We have no control over our businesses now and do not know how long we will survive. If we do not survive, we will have to close our factories and give the keys to banks,’ he added.  

Bangladesh Textile Mills Association vice-president Abdullah Al Mamun said that if the government continued to increase tariffs of energy and power one after another, like gas and electricity, at such intervals, it will also create difficulties in setting the cost of production and doing business as well.

‘We didn’t see such kinds of increase in the past. We take an order for delivering a product in two or three months. How will we adjust the price? The government should fix the price once and we can have an assessment and thus make our plans,’ he said.  

The power sector has witnessed a massive fossil fuel-based expansion under the current government largely facilitated by an indemnity act.

On December 13, the US-based Institute for Energy Economics and Financial Analysis in a report predicted that Bangladesh would not be able to import electricity from the Adani Godda coal-fired power plant in India without raising power tariff.

The cost of electricity produced by the Adani plant would be double the initially expected cost, the report said, estimating that the Adani power would be three times costlier the electricity imported from India.

Bangladesh cannot use even half of its installed electricity generation capacity of more than 26,700MW that entailed a capacity charge to the tune of Tk 72,567 crore, almost equal to the Power Development Board’s accumulated losses of Tk 76,115 crore, over the decade until 2020-21.

Capacity charge is the payment that the government is legally bound to make to power plant owners, irrespective of whether or not power is generated by them, ensuring their return on investment with profit.

In 2019, the CAB estimated that checking inefficiencies and corruption could save Tk 10,549 crore in the power sector.

Retailers charge up to Tk 400 extra

——— The New Age Report/ February 05, 2023 



Gas consumers are forced to pay up to Tk 400 extra for buying a cylinder of 12-kilogramme liquefied petroleum gas from the retail markets in the capital and elsewhere in the country.

Many people on Saturday claimed that they had been paying between Tk 1,800 and Tk 1,900 for a 12-kg LPG cylinder for the past two days in Dhaka after the government increased the gas price.

The Bangladesh Energy Regulatory Commission on Thursday hiked the price of liquefied petroleum gas by Tk 266 to Tk 1,498 for a 12-kg cylinder.

In the previous month, the cylinder price was Tk 1,232.

After the recent price rise, people were supposed to pay Tk 266 more, but the retailers are cashing in on the situation.

Consumers Association Bangladesh president Ghulam Rahman told New Age that as the government adjusted the LPG price, it should ensure that the businesses would charge consumers accordingly.

He urged the government agencies to take legal action against those violating rules.

‘It is sad that the government has no control over the market. If the Directorate of National Consumers Right Protection and other law enforcement agencies boost market monitoring, they can rein in illegitimate price hike,’ he added.

Directorate of National Consumers Right Protection director general AHM Shafiquzzaman told New Age that they did not have capacity to monitor everything as they had to give priority over monitoring prices of essential commodities ahead of Ramadan.

‘We lay importance on the LPG price, but we have not enough manpower. We have issued letters to all deputy commissioners in this regard for price monitoring,’ he added.

‘The BERC would monitor the issue and take action against those charging high prices. It can cancel their licences too.’

Dina Rahman, a housewife in the capital’s Green Road, said, ‘We bought a 12-kg LPG cylinder at Tk 1,800 on Friday which was selling between Tk 1,400 and Tk 1,500 earlier.’

‘The prices of all essentials have gone up. The recent rise in gas price is like rubbing salt into the wound.’

A tea seller Md Sohag in Dhanmondi said that he bought a 12-kg LPG for Tk 1,800 on Saturday while the price was between Tk 1,450 and Tk 1,500 previously.

‘I need five 12-kg cylinders every month. The prices of gas and sugar continue to rise. If I increase the cost of tea, I may lose customers,’ the tea seller made an apprehension.   

Consumers also complain that sellers do not lower prices once the government makes downward adjustments of prices for essential products.

A retailer Md Mahbub Alam, who supplied LPG gas to households and businesses in Dhanmondi and Hazaribagh areas, said that they were selling a 12-kg LPG gas cylinder of iGas, Omera, DeltaLPG at Tk 1,800 and Bashundhara LP Gas at Tk 1,900.

‘We buy gas at a higher price from agents and distributors who have raised prices through syndication. We have no other options, but to sell at a higher price,’ Mahbub said when asked why they were not going by the government-set price.
He added that the price of Bashundhara LP Gas always remained at Tk 70 to Tk 80 higher than that of other companies.

A private company employee Mazhar Manik in Mymensingh city said that he bought a 12-kg LPG cylinder at Tk 1,750 on Friday after a long bargain.

‘I did not find LPG cylinder on Friday. Many businesses declined to sell in the name of product shortage. I managed it from a known retailer who kept Tk 100 less from me,’ he added.

New Age staff correspondent in Chattogram reported that retailers in the port city also charged more than the government-set price for 12-kg LPG cylinder. They were charging Tk 50 to Tk 100 extra.

CAB senior vice-president and adviser M Shamsul Alam told New Age that charging higher than the price fixed by the government from consumers was a violation of the BERC Act 47, and it was a punishable offence.

‘The companies are robbing people of their money in the name of business. It is happening in the country as the Bangladesh Energy Regulatory Commission and the Bangladesh Competition Commission are literally dysfunctional,’ he added.
‘If they performed their duties accordingly, and took action, the companies dared not charge extra.’

BERC member (petroleum) Md Kamruzzaman said that they also came to know through the media reports that the businesses were selling gas at a price more than the one fixed by the government.

‘If we receive complaint from consumers, we will go for action. We have also lack of manpower,’ he pointed out.

The BREC adjusted the latest price as per tons of Saudi CP (mixed of propane and butane) increased by $190.25 to $790 from $599.25.

The 12-kg LPG cylinder is one of the 13 categories of LPG cylinders, the prices of which have been adjusted every month since April 2021.

The new LPG price used by automobiles has been fixed at Tk 69.71 per litre, up from Tk 57.41 set in the previous month.
x

Thursday, February 2, 2023

জনগণ অবশ্যই নিজ অধিকার আদায় করবে ——— মির্জা আলমগীর

সাক্ষাৎকার : মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর 

———

লোটন একরাম




বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বে কোনো সংকট নেই বলে দাবি করেছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নেতৃত্বে শতভাগ আস্থাশীল এবং আনুগত্য নিয়ে কাজ করি। যে মহলটি বিএনপিতে ভাঙন, বিভ্রান্তি ও সংশয় সৃষ্টি করতে চায় — তারাই নানা গল্প তৈরি করে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে রাজনীতিকে সোজাপথে যেতে দেওয়া হয় না। এখানে একটি শক্তি আছে, তারা অত্যন্ত সচেতনভাবে এ কাজ করে থাকে।

এক মাস কারাভোগের পর বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের কার্যালয়ে সমকালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন বিএনপি মহাসচিব।

আগামী নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে করার দাবিতে আন্দোলনের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়ে গত ৯ জানুয়ারি মুক্তিলাভের পর প্রথম একান্ত সাক্ষাৎকারে মির্জা আলমগীর বলেন, নানা প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করাই রাজনীতি। সেই রাজনীতিতে অতীতেও সফল হয়েছি এবং ভবিষ্যতেও সফল হবো — ইনশাআল্লাহ। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হলে বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশ আসন পাবে দাবি করে তিনি বলেন, সরকারের পদত্যাগের আগে কোনো আলোচনা হবে না। সব সময় বেগম খালেদা জিয়া যে কথাটি বলেন, জনগণ অবশ্যই নিজ অধিকার আদায় করবে।

ভিডিয়ো লিঙ্ক  

শীর্ষ নেতৃত্বে সংকট নেই

সমকাল: এক মাস কারাভোগের দিনগুলো কেমন ছিল?

মির্জা আলমগীর: এবার কারাগারের অভিজ্ঞতাটা খুব সুখকর ছিল না। বাংলাদেশে রাজনীতি করলে কারাগারে যাওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার।

অনেকবার কারাগারে গেছি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এবার লক্ষ্য করলাম, সাবেক মন্ত্রী-এমপি হিসেবে আমি ও মির্জা আব্বাস ডিভিশন প্রাপ্য হয়েও প্রথম পাঁচ দিন ডিভিশন দেয়নি। কর্তৃপক্ষ সঠিক কোনো উত্তরও দিতে পারেনি। আমাদের পরিবারের সদস্যরা যখন আদালতে রিট করতে যাচ্ছিল, তখন ডিভিশন দিয়েছে।

সমকাল: সরকারের পদত্যাগ, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারসহ ১০ দফা ও রাষ্ট্র সংস্কারের ২৭ দফা দাবিতে চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলন কিছুটা স্থিমিত হয়ে পড়েছে বলে অনেকে মনে করেন।


মির্জা আলমগীর: প্রতিটি আন্দোলনের গতিতে উত্থান-পতন থাকে। কখনও উপরে উঠে, আবার কখনও নিচে নামে। দলের এত নেতাকর্মী কারাগারে ছিল— স্বাভাবিকভাবে আন্দোলন কিছুটা ছন্দপতন ঘটতে পারে। তার মানে একেবারে স্থিমিত হয়ে পড়েছে- তা নয়। আন্দোলন চলছে এবং আরও বেগবান হচ্ছে।

সমকাল: সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু ঢাকা সফরকালে বিএনপিসহ বিরোধী দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি। শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্রের আরও একজন ক্ষমতাবান সিনিয়র কর্মকর্তা সফরে আসছেন। তাঁর সঙ্গে কি আপনাদের সাক্ষাৎ হবে?

মির্জা আলমগীর: যুক্তরাষ্ট্রের মন্ত্রী বা কর্মকর্তা সফরকালে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সাক্ষাতের প্রয়োজন মনে করলে তাঁদের পক্ষ থেকেই আমন্ত্রণ করা হয়। এবার ডোনাল্ড লু রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেননি। তা ছাড়া সাক্ষাৎ করাটা আমাদের দিক থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও নয়।

সমকাল: সামনে পবিত্র রমজান মাস। সাধারণত ওই সময়ে রাজপথের আন্দোলন সম্ভব নয়। কবে নাগাদ আপনাদের দাবি আদায়ের আন্দোলন জোরদার করতে চান?

মির্জা আলমগীর: রমজান মাস এখনও অনেক দেরি আছে। আগামীকাল থেকে কী ঘটবে, না ঘটবে- সেটাই তো আজ বলা যায় না। নির্ভর করবে আমরা কীভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছি, আন্দোলনটা কোথায় নিয়ে যেতে চাই — তার ওপর। রমজান মাস কোনো ফ্যাক্টর নয়।

সমকাল: বিরোধী দলের প্রতিটি কর্মসূচির দিন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে রাজপথে থাকছে। কঠোর অবস্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও।

মির্জা আলমগীর: আওয়ামী লীগের চরিত্র সন্ত্রাসী চরিত্র। যখনই ক্ষমতায় এসেছে তারা, রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে বিরোধী দলকে বাধা দেওয়া তাদের স্বভাবজাত। আমরা অত্যন্ত গণতান্ত্রিক, নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করছি। তারপরও সরকার কতটা ভয় পেয়েছে- এতেই তা বোঝা যাচ্ছে। আমরা জনগণকে সম্পৃক্ত করে গণআন্দোলনের মাধ্যমে গণবিচ্ছিন্ন ও অনির্বাচিত সরকারকে সরানোর চেষ্টা করছি।

সমকাল: বর্তমান রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলায় রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীকে সংলাপ ডাকার আহ্বান জানাবেন কি? এ ছাড়া অতীতের মতো দূতিয়ালি করতে জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ বা বন্ধুপ্রতিম প্রভাবশালী দেশ ও সংস্থার প্রতিনিধি ও কূটনীতিকরা কি কোনো ভূমিকা রাখতে পারেন?

মির্জা আলমগীর: আমরা কেন সংলাপের আহ্বান জানাতে যাব? আমরা বলছি, এই সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার মেনে না নিলে কোনো আলোচনার প্রশ্নই ওঠে না। পর্দার আড়ালে কোনো দূতিয়ালি জানা নেই।

সমকাল: আন্দোলন ও নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি নেতাদের পরস্পরের মধ্যে কিছুটা সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি হয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। বিশেষ করে প্রবীণ নেতা উকিল আবদুস সাত্তার দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া উপনির্বাচনে অংশ নেওয়ায় গুঞ্জনটি আরও ডালপালা মেলেছে?

মির্জা আলমগীর: উকিল আবদুস সাত্তারের ঘটনাটি আমাদের কাছে কোনো ঘটনাই নয়। তাঁকে মোকাবিলা করার মতো সেখানে কমপক্ষে ১০ জন নেতা আছেন। বিএনপির মধ্যে কোনো মতভেদ ও মতদ্বৈধতা নেই। সন্দেহ ও সংশয় নেই। আমরা ঐক্যবদ্ধ।

সমকাল: ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে জোট গঠনের মাধ্যমে আন্দোলন করে দাবি আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এবার নামসর্বস্ব ৫৪টি দল ও সংগঠনকে নিয়ে দাবি আদায় বা আপনাদের ভাষায় গণঅভ্যুত্থান ঘটানো কি সম্ভব হবে?

মির্জা আলমগীর: বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোও জনগণের শক্তির ওপর নির্ভর করে। বিএনপি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে একাধিকবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছে। জোটের রাজনীতিরও ইতিহাস আছে। সমমনারা তাদের দায়িত্ব পালন করছে। আমরা অত্যন্ত সন্তুষ্ট। ভবিষ্যৎই প্রমাণ করবে, বিএনপি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনে কতটা সফল হয়।

সমকাল: এরই মধ্যে বিএনপির সমমনা জোট গণতন্ত্র মঞ্চের অভ্যন্তরে টানাপোড়েন চলছে বলে খবর বেরিয়েছে। আপনিও অভিযোগ করছেন।

মির্জা আলমগীর: এগুলো ছোটখাটো ব্যাপার। কিছুটা বাড়িয়ে বলা হচ্ছে। গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বৈঠক করেছি। কোনো সমস্যা বা সন্দেহ ও সংশয় দেখিনি। তারা আগের চেয়ে শক্তিশালী হচ্ছে।

সমকাল: জোট শরিক গণঅধিকার পরিষদের সদস্য সচিব নুরুল হক নুর অভিযোগ করেছেন, বিরোধী ৫৪ দল ও সংগঠনের অনেকে সরকারের কাছ থেকে টাকা ও প্লট নিচ্ছে এবং আসন ভাগাভাগিতে ঐকমত্যে পৌঁছে যাচ্ছে। কারা নিচ্ছে- বিএনপিকে খুঁজে বের করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

মির্জা আলমগীর: উনি যেহেতু বলেছেন, এটার দায়-দায়িত্ব উনি নেবেন। তবে আমি মনে করি, এটা কোনো সমস্যা নয়।

সমকাল: ওয়ান-ইলেভেনের সময়ের মতো এবার আবারও 'কিংস পার্টি'র তৎপরতা শুরু হয়েছে বলে গুঞ্জন রয়েছে?

মির্জা আলমগীর: দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সব সময়ে একটা রহস্যময়তা থাকে। কারণ, গণতন্ত্র চর্চা সঠিকভাবে হয়নি। এখানে একটি শক্তি আছে, তারা অত্যন্ত সচেতনভাবে রাজনীতিকে সঠিক এবং সোজাপথে যেতে দেয় না। নানা গল্প ও বিভিন্ন ঘটনা তৈরি করে রাজনীতিকে বিপথে পরিচালনার চেষ্টা করা হয়।

সমকাল: বিএনপিতে শীর্ষ নেতৃত্বের সংকট রয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। যেমন ভিপি নুর বলেছেন, 'খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে শীর্ষ নেতা এবং ক্ষমতায় গেলে সরকারপ্রধান হিসেবে আপনার নাম এখনই ঘোষণা দেওয়া উচিত। পরে দল সিদ্ধান্ত নেবে।' আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

মির্জা আলমগীর: এ ধরনের বক্তব্য চক্রান্তমূলক। বিএনপিতে শীর্ষ নেতৃত্বের কোনো সংকট নেই। বিএনপি অত্যন্ত ঐক্যবদ্ধ আছে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্ব শতভাগ প্রতিষ্ঠিত। সেই জায়গায় যে মহল বিএনপিতে ভাঙন, বিভ্রান্তি ও সংশয় সৃষ্টি করতে চায়- তারাই এ সমস্ত গল্প তৈরি করে।

সমকাল: 'ফিরোজা' বাসভবনে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে দলের সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক কোনো পরামর্শ চান?

মির্জা আলমগীর: উনার কাছে কোনো রাজনৈতিক পরামর্শের জন্য আমরা যাই না। তিনি খুব অসুস্থ। আমরা তাঁর স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নিয়ে থাকি। তিনি একজন রাজনৈতিক নেত্রী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। উনি সব সময় যে কথাটি বলেন, জনগণ অবশ্যই নিজ অধিকার আদায় করবে।

সমকাল: দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের জন্য ধন্যবাদ।

মির্জা আলমগীর : সমকালকেও ধন্যবাদ।

সৌজন্যে — সমকাল/ ফেব্রুয়ারি ২, ২০২৩।