Search

Saturday, February 18, 2023

গরিব মানুষ কি খেতে পারছে?




খুব সাধারণ একটি প্রশ্ন করতে চাই, মানুষ কি খেতে পারছে? যাদের ব্যাপারে এই প্রশ্নটি করছি তারা অবশ্যই সাধারণ মানুষ, অথবা খুব নির্দিষ্ট করে বললে গরিব মানুষ।  কারণ মধ্যবিত্তদের বর্তমান সময়ে একটু কষ্ট হলেও ধনী মানুষের খাদ্যের অভাব নেই। বাংলাদেশে একইসাথে দুই ধরণের বিপরীত চিত্র আমরা দেখতে পাই – কেউ বেশি খেয়ে মরছে বা অসুস্থ হচ্ছে (নানারকম অসংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে) আর জনগণের একটি বড় অংশ অর্ধভুক্ত থাকছে, বা না খেয়েও আছে দিনের পর দিন। হ্যাঁ, সেই দরিদ্র মানুষদের অবস্থার কথাই জানতে চাচ্ছি। তারা কি খেতে পারছে?

বাংলাদেশে শতকরা হিসাবে দারিদ্রের হার ২৪.৩% হলেও সংখ্যায় তারা প্রায় চার কোটি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৬ সালের গৃহস্থালি বা খানা আয়-ব্যয় জরিপের তথ্য অনুযায়ী এই হিসাব পাওয়া গেছে। চার কোটি দরিদ্র মানুষ নিয়ে একটি দেশ টিকে থাকা কঠিন। এরাই শ্রমজীবী মানুষ অথচ তাদেরই খাদ্যের অভাব! টেকসই উন্নয়নের যে লক্ষ্যমাত্রা ২০১৬ সালে ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে ২০৩১ সালের মধ্যে দারিদ্র্য দূর করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। এরই মধ্যে কোভিড মহামারি, ইউক্রেন যুদ্ধ, অর্থনীতিতে বিনিয়োগের অভাব ইত্যাদি কারণে দেশের মানুষের জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়েছে। জীবনযাপনের জন্যে যেসব খরচ চালাতে হয়- তা সব কমানো সম্ভব হয় না বলে- খরচ কমাবার চাপ খাদ্যের ওপরই গিয়ে পড়ে, এবং খাওয়াটাই কমিয়ে দিতে হচ্ছে। সন্তানের শিক্ষা খরচ, বাড়ি ভাড়া, যাতায়াত, চিকিৎসা ব্যয় সব কিছুই বাড়ছে। কমানোর কোনো উপায় নেই। তাই কম খাওয়াই একমাত্র উপায়। এখন ২০২৩ সাল শুরু হয়েছে, আর ১০ বছর সময়ও আমাদের হাতে নেই।  দারিদ্র্য দূর করা কি সম্ভব হবে এই সময়ে? 

বছর খানেক ধরেই, অর্থাৎ করোনা পরবর্তী সময়ে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে পত্রপত্রিকায় এমন খবর এবং তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।  টেলিভিশন চ্যানেলেও ২০২১ সালে খবর প্রচারিত হয়েছে, যে করোনার কারণে কাজ ও আয় হারিয়ে- তিনবেলা খেতে পারছে না ১০% মানুষ। সতেরো কোটি মানুষের মধ্যে ১০% হলে তাতে ১ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষের একটা সংখ্যা দেখা যায়। এই সংখ্যা দেখতে খুব ভয়ানক লাগে। অর্থাৎ ২০১৬ সালের যে গরিবের সংখ্যা আমরা জেনেছি, তা নিশ্চয়ই আরো বেড়ে গেছে।  এবং সেই চার কোটির মধ্যেই প্রায় ২ কোটি মানুষ তিন বেলা খেতে পারছে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ২০২৩ সালে এসে কি অবস্থার কোনো উন্নতি হয়েছে? 

দুই হাজার বাইশ সালের একটি দৈনিক পত্রিকায় খবরের শিরোনাম হচ্ছে "আর ম্যানেজ করতে পারছে না মানুষ"। এই খবরের মধ্যে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত মানুষের কথা বলা হয়েছে, তারা সবাই হিমশিম খাচ্ছেন। কারণ খাদ্যদ্রব্যের দামের ঊর্ধ্বগতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি। বলাবাহুল্য সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছেন- যাদের আমরা অতিদরিদ্র বলে চিহ্নিত করি তারা। নিম্ন-মধ্যবিত্তদের টিসিবির ট্রাকের লাইনে দাঁড়াতে হয় বলে আমরা অনেকে আক্ষেপ করি; কিন্তু গরিব যারা, তারা কি তা-ও পায়? তাদের অবস্থা কী?



বিশ্বের চরম দরিদ্ররা বাস করে এমন পাঁচটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
ছবি  Syed Zakir Hossain/Dhaka Tribune

এরা গরিব খেটে খাওয়া মানুষ। এদের পেশা নানাবিধ। কোনো একক পেশা দিয়ে তাদের চেনা যাবে না, কারণ তারা যা পায় তাই করে। শরীরে যতক্ষণ শক্তি থাকে, তারা কাজ করে যায়। নিজে খেতে হবে এবং পরিবারকে খাওয়াতে হবে তো! সামাজিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান উবিনীগের (উন্নয়ন বিকল্প নীতি নির্ধারণী গবেষণা) সাম্প্রতিক একটি জরিপে যে তথ্য বেরিয়েছে তার একটু উল্লেখ করছি।  দুইশত গরিব পরিবার যাদের পেশা চায়ের দোকান, চটপটি বিক্রেতা, দরজি, গার্মেন্টস শ্রমিক, ছোট চাকুরি, রিক্সা ও ভ্যান চালক ইত্যাদি। তাদের আয় খুব কম, দৈনিক হিসাবে বেশিরভাগ (প্রায় ৬০%) মানুষের মাত্র ২৭৬ টাকা গড়ে; এক-তৃতীয়াংশ মানুষের আয় ৫০০ টাকা। কিছু লোকের আয় ৫০০ টাকার বেশিও আছে। বিশ্বব্যাংকের দারিদ্র নিরুপণের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড হচ্ছে ১.৯০ ডলার বা ২০০ টাকার কিছু বেশি। তার অর্থ হচ্ছে, এই মানুষগুলোর বিশ্বব্যাংকের দরিদ্র মানুষের সংজ্ঞার কাছাকাছি ২৭৬ টাকা দৈনিক আয়।

যাদের আয় কম, তারা আসলে কি খাচ্ছেন? ভাত, ডাল ও ডিম খাচ্ছে মাত্র ২৭%, এবং ভাত এবং সবজি খাচ্ছে ২২% পরিবার।  পোল্ট্রির ডিম সস্তা ছিল বলে এতোদিন অনেক গরিব পরিবার তা খেয়েছেন এবং মনে করেছেন তারা পুষ্টিকর খাদ্য খাচ্ছেন। ডিম বা মুরগি নিরাপদ কিনা- সে তর্কে না গিয়েও বলা যায় যে, এই খাদ্য যোগানোও সম্ভব হচ্ছে না বেশিরভাগ পরিবারের। আর যারা সবজি খাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন, তারা তাজা সবজি কিনতে পারেন না। তাছাড়া এই সবজিগুলো উৎপাদিত হয়েছে সার-কীটনাশক দিয়ে। সবজির মধ্যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আলু দেখা গেছে। মৌসুমি সবজির সস্তা হলে খাওয়া হয়। শুধু পেট ভরানোর জন্যে খাদ্য গ্রহণই তাদের জন্যে যথেষ্ট!! মাছ খাওয়ার ভাগ্য জুটেছে ১২% শতাংশ পরিবারের, সেটাও মাঝে মাঝে। মাংস খাওয়ার কথা বললেন, ২০০ পরিবারের মধ্যে মাত্র ৩টি পরিবার। এই সংখ্যার কোনো শতকরা হিসাব হয় না। দুধের অবস্থাও তাই। নয়টি পরিবারে চায়ের দোকান থেকে পাউরুটি (বন রুটি) খাওয়ার কথা জানা গেছে। মাসের সব দিনে খাবার জোটেনি এমন পরিবারের সংখ্যা ৫৭টি বা ২৮%, এদের কেউ ৫ দিন, কেউ ১০ দিন পর্যন্ত অভুক্ত থেকেছেন বলে জানিয়েছেন। এই চিত্র দিয়ে সারা দেশের গরিব মানুষের বিচার করা যাবে না অবশ্যই, কিন্তু এই চিত্রের সাথে মিল থাকার সম্ভাবনা কম নয় মোটেও।

খাদ্য নিয়ে আরো একটি পত্রিকার শিরোনামে দেখেছি 'মাংসের বাজারে ঘেঁষতে পারছে না সাধারণ মানুষ'।  এই শিরোনাম ২০২৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তারিখের। মাংসের বাজার? এতো কল্পনার বাইরে সাধারণ মানুষের, তারা ঘেঁষবে কী? শুধু মাংসে ৫০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকা খরচ করলে, চালডাল কিনবে কীভাবে? মধ্যবিত্তদেরও এখন মাংস খাওয়া দুস্কর হয়ে গেছে। মাংস প্রোটিনের জন্য একটি অন্যতম প্রধান উৎস। এখন মধ্যবিত্ত শ্রেণিও প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে পারছে না।

শুধু আয় দিয়ে দারিদ্র্য মাপা যথেষ্ট নয়, দারিদ্র মাপার আর একটি অন্যতম প্রধান পদ্ধতি হচ্ছে, খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে কত ক্যালোরি গ্রহণ করা হচ্ছে যেন তার পুষ্টিমান ঠিক থাকে। এমনও হতে পারে যে আয় বেড়েছে, কিন্তু ক্যালোরি গ্রহণ বাড়ে নাই। সরকারি হিসাবে প্রতিদিন ২,২১০ কিলোক্যালোরি গ্রহণ করা হচ্ছে। এই তথ্য একটু পুরনো ২০১৬ সালের; কিন্তু বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে এই তথ্যই পাওয়া যাচ্ছে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হলে গড়ে ২,১৮৬ ক্যালোরি হলে যথেষ্ট। কাজেই আপাত দৃষ্টিতে ক্যালোরি গ্রহণ কমে গেলেও, পুষ্টির দিক থেকে বিপজ্জনক নয়। তবে এই ক্যালোরি গ্রহণ কি গরিব মানুষের খাদ্যগ্রহণ ধরে করা হয়েছে? তাদের আলাদাভাবে করলে দৈনিক কত ক্যালোরি গ্রহণ করা হচ্ছে তা দেখা যেত। গরিব মানুষ শারীরিক পরিশ্রম করে খায়; তাহলে তাদের ক্যালোরি গ্রহণের প্রয়োজন অন্যদের তুলনায় বেশি। তারা যা খাচ্ছে তার মধ্যে ভাত, আলুর পরিমাণ বেশি অর্থাৎ বেশি কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করা হচ্ছে; অন্যদিকে প্রোটিন গ্রহণের মাত্রা একেবারেই কম। পুষ্টির দিক থেকে খাদ্যের মধ্যে কার্বোহাইড্রেট এর পরিমাণ ৬০% এর বেশি হওয়া ঠিক নয়। অথচ গরিবদের ক্ষেত্রে তাই হচ্ছে।   

টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট বা এসডিজি-র লক্ষ্যমাত্রা ২.১  অনুযায়ী "২০৩০ সালের মধ্যে সকল মানুষ, বিশেষ করে, অরক্ষিত পরিস্থিতিতে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী, দরিদ্র জনগণ ও শিশুদের জন্য বিশেষ অগ্রাধিকারসহ বছরব্যাপী নিরাপদ, পুষ্টিকর ও পর্যাপ্ত খাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করে ক্ষুধার অবসান ঘটানো।" আমরা কি সেদিকে যাচ্ছি বা যেতে পারছি, নাকি উল্টো দিকে হাঁটছি। মানুষের আয় কমে যাওয়া এবং দ্রব্যমূল্য ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকলে পুষ্টিকর ও পর্যাপ্ত খাদ্য মানুষ পাবে না ধরে নেয়া যায়। বাংলাদেশ ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়ায় আছে। বিশ্বে আমাদের ভাবমুর্তির জন্য এটা ইতিবাচক।  কিন্তু সেটা অর্জন করতে হলে শুধু মাথাপিছু আয় বেশি দেখালেই হবে না, জনগণের পুষ্টিমানটা নির্ণয় করতে হবে। আইসিডিডিআর,বি এর তথ্য অনুযায়ী, পুষ্টিহীনতার কারণে বছরে ১ বিলিয়ন ডলার বা ১,০০০ কোটি টাকার উৎপাদনশীলতা হারাচ্ছে, ৩৫% মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীন অবস্থায় আছে, প্রায় ৬ লক্ষ শিশু মারাত্মক পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। নারীদের অবস্থাও খুব খারাপ। প্রায় ৫০% নারী রক্তশূন্যতায় ভুগছে, আর এক-তৃতীয়াংশ নারীর ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় কম। 

যে প্রশ্ন দিয়ে শুরু করেছিলাম- মানুষ কি খেতে পারছে? উত্তর শুধু হ্যাঁ বা না নয়- এর সাথে সম্পৃক্ত মানুষের জীবন দিয়ে বুঝতে পারছি, আসলেই অবস্থা ভালো নয়।

মেগা প্রজেক্ট করে দেশের উন্নতি দেখানো এক কথা; আর মানুষের খাদ্যগ্রহণ, পুষ্টিমানসহ জীবনযাত্রার উন্নতি করে উন্নয়ন দেখাতে পারলেই তা অনেক বেশি টেকসই এবং গ্রহণযোগ্য হবে।   


  • লেখক প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী

লেখাটি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড -এ ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২৩-এ প্রকাশিত হয়েছে। 

No comments:

Post a Comment