Search

Saturday, February 11, 2023

নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির

——— আমিরুল ইসলাম কাগজী

এক। 

এবার গরীবের পাতে পুষ্টির প্রধান যোগানদাতা পোল্ট্রি মুরগিও নাগালের বাইরে চলে গেল। এতদিন যারা অতি কষ্টে তিনশো চারশো টাকা সঞ্চয় করতে পেরেছে তারা সপ্তাহে অন্তত একদিন মাংসের স্বাদ নিতে পেরেছে। সোমবার, ফেব্রুয়ারি ৬, ২০২৩,  থেকে সেই মুরগির দাম দুশো টাকা ছাড়িয়ে গেছে। আর ডিমের হালি ৫০ টাকা। বাজারে কোনো মাছ এখন তিনশো টাকার নিচে নেই। রুই কাতলা চারশো পাঁচশো টাকার ওপরে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এগ্রোফিডের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতসহ অন্যান্য পণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে মাছ-মুরগির দাম বেড়েছে।


এগ্রোফিড উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, গরু-ছাগল  ও মাছ-মুরগির খাদ্য প্রস্তুতির জন্য সবচেয়ে বেশি লাগে ভূট্টা ও সয়াবিন। এর সঙ্গে লাগে  রাসায়নিক দ্রব্য এবং মেডিসিন। ডলার সংকটের কারণে এগুলো আমদানি করা যাচ্ছে না। ফলে স্থানীয় বাজারে এগুলোর দাম ক্ষেত্রবিশেষে দ্বিগুণ-তিনগুন বেড়ে গেছে। যার প্রভাবে মাছ-মুরগি-ডিমের দাম আকাশ ছোঁয়া।

চিনি, সয়াবিন তেল, ডাল, আদারসুন, মসলা সবকিছুর দাম এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। খোলা চিনি ১২০ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৪০টাকা দরে। যার কাছে টাকা আছে তার কিনতে সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু যার বেতন বাড়েনি কিংবা মজুরি বাড়েনি তার জন্য বিপদ। কেননা চিনি কোনো বিলাসী পণ্য নয়। নিত্যপণ্য হিসেবে সবার প্রয়োজন।শিশু খাদ্য হিসাবে এটা মহা নিত্যপণ্য।


ইলাস্ট্রেশান —  যুগান্তর 

দুই।

জানুয়ারি ২০২৩ থেকে দু দফায় বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম যা যুক্ত হবে বর্তমান মাসের খরচের সঙ্গে। গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে গত জুন মাসে, ফের পাইকারি পর্যায়ে বাড়ানো হয়েছে গতমাসে। আইএমএফ তাদের ঋণের শর্ত হিসাবে সরকারকে বলেছে, এ দুটো পণ্যসহ জ্বালানি তেল এবং কৃষকের সারের ওপর থেকে ভর্তুকি তুলে নিতে হবে।

অনেক শর্তের মধ্যে আরেকটি শর্ত হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ২০শতাংশের নিচে এবং বেসরকারি ব্যাংকে খেলাপি ১০ শতাংশের নিচে রাখতে হবে।

শর্তগুলোর দিকে তাকালে মনে হতে পারে আইএমএফ ধনী ব্যবসায়ীদের  চাপে ফেলতেই এসব করছে। কারণ বর্তমানে খেলাপি ঋণের কারণে নতুন কোনো উদ্যোক্তা ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারছে না। আইএমএফ এর এই শর্ত কার্যকর হলে খেলাপি ঋণ কমে আসবে এবং ব্যাংকের তারল্যসংকট মোচন হবে। কিন্তু আইএমএফ তো আর বাংলাদেশ ব্যাংককে চেনে না, কাগজে- কলমে ঋণ খেলাপিদের তথ্য এমনভাবে উপস্থাপন করবে যা দেখলে সংস্থাটির বাঘা বাঘা হিসাববিদদের চোখ কপালে উঠবে। অতএব ধণী ব্যবসায়ীরা পগারপার। তারা বাংলাদেশ ব্যাংককে যতই বলছে রিজার্ভের হিসাব সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে সেদিকে কোনো কর্ণপাত করছে না এই কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নয়ছয় করে বলে দিচ্ছে রিজার্ভে আছে ৩০ বিলিয়ন ডলার।কিন্তু আইএমএফ বলছে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের ৮ বিলিয়ন ডলার বাদ দিতে হবে। কারণ এই ৮ বিলিয়ন ডলার কাগজ-কলমে আছে কিন্তু বাস্তবে নেই। ফলে রিজার্ভে আছে ২২ বিলিয়ন ডলার যা দিয়ে আমাদের তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।

বিদ্যুতের ওপর থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার করে নেওয়ার অর্থই হলো দাম বেড়ে যাওয়া। বিদ্যুতের দাম বাড়লে ধনী ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের কোনো সমস্যা হবে না। কারণ তারা পণ্য উৎপাদন করে ভোক্তাদের কাছ থেকে  বাড়তি মূল্য উসুল করে নিতে পারবে। কিন্তু সাধারণ নাগরিকের সে সুযোগ থাকে না। তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির সাথে সাথে গুনতে হয় বিদ্যুতের বাড়তি মূল্য। একইভাবে গ্যাসের ওপর থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার করার অর্থই হলো সাধারণ নাগরিকের পক্ষ থেকে গ্যাসের বাড়তি মূল্য পরিশোধ করা।

গ্যাসের ওপর থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হলে তারও আঁচ লাগে না শিল্পপতিদের গায়ে। কারণ এখানেও ভোক্তা ওই সাধারণ নাগরিক যাদের কাছ থেকে উসুল করা হয় বাড়তি মূল্য।

আইএমএফ এর ঋণ নেওয়ার পর কোনো দেশের গরীব মানুষের কল্যাণ হয়েছে এমন নজির পাওয়া যাবে না। তারা সরকারের চাপে, শিল্পপতিদের চাপে, ব্যবসায়ীদের চাপে এমনকি মধ্যসত্ত্বভোগীদের চাপে চিড়ে চ্যাপটা হয়েছে। তাদের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে, ঋণ করে সংসার চালাতে হয়েছে।

তিন।

আইএমএফের ঋণ পাওয়ার পর সরকারী দলের অনেকেই উল্লাসে আটখানা। তাদের মুখে খই ফুটতে থাকে এই বলে যে, ডলার সংকট কেটে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতি মাসে আমদানি ব্যয় মেটাতে হয় কমপক্ষে ৬ থেকে ৭ বিলিয়ন ডলার। অথচ আইএমএফ  প্রথম কিস্তিতে প্রদান করেছে মাত্র ৪৭ দশমিক ৬০ কোটি ডলার। এটা সাগরে এক বালতি পানি ঢালার মতো।



এলসির ডলার পরিশোধ করতে না পারার কারণে সাগরে ৬৫দিন যাবৎ ভাসছে চিনি, খেজুর, সয়াবিন ও ছোলা বোঝাই জাহাজ। একই কারণে আরও অন্যান্য ৫টি জাহাজ পণ্য নিয়ে সাগরে ভাসছে। যাদের প্রতিদিনের ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে ৭০ হাজার ডলার। এই যে অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে সেটাও উসুল করা হবে সেই আম জনতার কাছ থেকেই। কারণ ব্যবসায়ীরা তো আর লোকসান দিয়ে তার পণ্য বিক্রি করবে না।

অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে রমজান মাস আসার আগেই নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির হয়ে উঠতে পারে। প্রায় প্রত্যেকটি পণ্যের দাম বাড়ছে। কোনো কোনোটির দাম আবার লাগাম ছাড়া। অপরপক্ষে মানুষের আয় কিন্তু বাড়েনি। বাড়তি দামে পণ্য কিনতে গেলে তাকে অবশ্যই খাদ্যতালিকা থেকে অনেক কিছু বাদ দিতে হবে।

———

No comments:

Post a Comment