Search

Saturday, September 28, 2019

রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় খালেদা জিয়া জেলে

বিশেষ সাক্ষাৎকারে খন্দকার মাহবুব হোসেন



বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া প্রায় দুই বছর জেলে আছেন। তার মুক্তির জন্য আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি রাজপথে আন্দোলনের কথা বলছেন আইনজীবীরা। বলছেন, রাজপথ উত্তপ্ত করতে না পারলে খালেদা জিয়া মুক্ত হবেন না। এই প্রেক্ষাপটে কোন পথে খালেদা জিয়া মুক্ত হতে পারেন তা নিয়ে নয়া দিগন্তকে বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন।

খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও রাজনৈতিক কারণে বেগম খালেদা জিয়াকে জেলে দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা যদি না থাকে অর্থাৎ দলীয় সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো আদালত বেগম খালেদা জিয়াকে জামিনে মুক্তি দিবেন এটা আমি বিশ্বাস করি না। আর এই সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত খালেদা জিয়ার মুক্তি হবে না এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

তিনি বলেন, আমি এখনো বিশ্বাস করি- এই সরকারের দুর্নীতি, জুলুমবাজি জনমনে যেভাবে বিতৃষ্ণা জন্মাচ্ছে তারই বহিঃপ্রকাশ হিসেবে একসময় হয়তো একটি গণবিস্ফোরণ ঘটবে। সেখানে হয়তো আমাদের নেতার কোনো প্রয়োজন হবে না। স্বাভাবিকভাবে মানুষ জেগে উঠবে এবং বর্তমান স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে।

নয়া দিগন্ত : আপনি বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবী প্যানেলের অন্যতম সদস্য। আপনি দীর্ঘদিন যাবৎ ওনার জামিনের ব্যাপারে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি আপনি এ কথাও বলেছেন যে, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া খালেদা জিয়ার কারামুক্তি সম্ভব নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে ওনার মুক্তির পথ কী হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?


খন্দকার মাহবুব হোসেন : দেখেন, আমি প্রথম থেকেই বলে এসেছি- রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে ও রাজনৈতিক কারণে বেগম খালেদা জিয়াকে জেলে দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা যদি না থাকে অর্থাৎ দলীয় সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো আদালত বেগম খালেদা জিয়াকে জামিনে মুক্তি দিবেন এটা আমি বিশ্বাস করি না। তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। কারণ আমরা জানি, পাঁচ বছর, সাত বছর সাজা হলে যদি উচ্চ আদালতে আপিল করা হয় সাথে সাথে তার জামিন দেয়া হয়। কিন্তু খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে আপনারা দেখেছেন, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় তাকে জামিন দেয়া হয়নি। আমাদের আইনে এরকম বিধান রয়েছে, যদি কোনো বয়স্ক ও অসুস্থ মহিলা থাকেন তবে তার জামিনের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ আবেদন থাকে। কিন্তু আমরা অত্যন্ত দুঃখিত ও লজ্জিত যে, সাত বছরের সাজায় তিন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশে বলতে গেলে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে জামিন দেয়া হয়নি। আমি এখনো মনে করি বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে জেলে রাখা হয়েছে। যে পর্যন্ত সরকারের সদিচ্ছা না হবে তত দিন পর্যন্ত আইন অঙ্গন থেকে তাকে জামিনে মুক্ত করা সম্ভব হবে না।

নয়া দিগন্ত : আপনি বিভিন্ন সময় বলেছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে রাজপথ উত্তপ্ত করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আইনানুগভাবে কিভাবে মানুষ রাজপথে আন্দোলন করতে পারে বলে আপনি মনে করেন?


খন্দকার মাহবুব হোসেন : দেখেন, আইনানুগভাবে তো রাজপথ উত্তপ্ত হবে না। আমরা আইনানুগভাবে যদি যাই তখন তো বাধা আসে। আমি বলতে চাই- একটি দেশ এভাবে একটি অবৈধ সরকারের অধীনে দীর্ঘদিন থাকতে পারে না। সমাজের সর্বস্তরে হত্যা-গুম, দুর্নীতির যেভাবে বেড়ে যাচ্ছে, এর ফলে হয়তোবা একসময় একটি সাহসী নেতৃত্বের আবির্ভাব হবে এবং সেই সাহসী নেতৃত্বের পেছনে জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়বেন। দেশ উদ্ধার হবে, গণতন্ত্র কায়েম হবে এবং দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন।

নয়া দিগন্ত : বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে প্রায় ৩৬টি মামলা আছে, যার মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার জামিন আবেদনটি আপিল বিভাগে আছে এবং জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ওনার জামিন আবেদন সরাসরি খারিজ করার পর আরেকটি বেঞ্চ ফিরিয়ে দিয়েছেন। এ অবস্থায় সামনে আপনাদের আর কোনো পরিকল্পনা আছে কি?


খন্দকার মাহবুব হোসেন : আমরা অবশ্যই আইনের বিধান মোতাবেক চেষ্টা করব। কিন্তু বিচারিক আদালতে যে ধরনের বিচার পাওয়া উচিত ছিল আমরা সেই ধরনের বিচার পেয়েছি কি না সেখানে আমাদের দ্বিমত রয়েছে।

নয়া দিগন্ত : বেগম খালেদা জিয়া প্রায় দুই বছর কারাভ্যন্তরে আছেন এবং দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দীর্ঘদিন যাবৎ দেশের বাইরে আছেন। এর ফলে বিএনপি নেতৃত্ব সঙ্কটে অসুবিধায় পড়ছে কি না? আপনার মতামত কী?


খন্দকার মাহবুব হোসেন : এটাকে অস্বীকার করার উপায় নাই যে, বিএনপিতে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন অনেক ক্ষেত্রেই তাদের দুর্বলতা রয়েছে। আরেকটা বিষয় দেখতে হবে- যারা এখন আমাদের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক, জাতীয় স্থায়ী কমিটিতে রয়েছেন, তাদের অনেকেরই বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা রয়েছে। সে কারণেও কিছুটা মানসিকভাবে দুর্বলতা তাদের রয়েছে। সরকারের বিরুদ্ধে সাহস করে কিছু বলা তাদের পক্ষে অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হচ্ছে কি না সে বিষয়ে আমার সন্দেহ হয়। তাই এখানে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের অবশ্যই একটি সাহসী ভূমিকা নিতে হবে। আর সাহসী ভূমিকা যদি তারা নিতে সক্ষম না হন তবে তাদের বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের চিন্তাভাবনা করতে হবে। এ ছাড়া অন্য কোনো ব্যবস্থা আছে বলে আমি মনে করি না।

নয়া দিগন্ত : আপনি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান, বিএনপি একটি বিশাল দল, সারা দেশে আপনাদের লাখ লাখ কর্মী রয়েছেন। যারা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নেয়ার জন্য মামলা-হামলার শিকার হয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে আপনারা আইনজীবীরা তাদের কতটুকু সহায়তা দিতে পারছেন?


খন্দকার মাহবুব হোসেন : দেখেন, আমাদের বাংলাদেশে বিএনপি ও জামায়াতের হাজার হাজার নেতাকর্মী জেলে আছেন এবং যারা বাইরে আছেন তাদের অনেককে পালিয়ে থাকতে হচ্ছে। যারা জামিনে আছেন তাদের একটি সময় মামলায় হাজিরা দিতে হচ্ছে। এই কারণে বাংলাদেশের বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে একটি চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। এটা সত্য যে, আমাদের নেত্রী বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী। এই ক্ষেত্রে আমরা মনে করি তার মুক্তি সম্ভব, দেশে যদি একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মানুষ যেন ভোট দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে আমরা যারা নেতৃত্ব দিচ্ছি তারা ব্যর্থ হচ্ছি। এবং যত দিন পর্যন্ত আমরা এ থেকে উদ্ধার না পাব তত দিন পর্যন্ত আমাদের ভাগ্যে আমরা বিশেষ কিছু আশা করতে পারি না।

নয়া দিগন্ত : সরকার এককভাবে সবকিছু করছে অর্থাৎ একক নেতৃত্ব দিচ্ছে। বিরোধী দল বলতে বিএনপিকে বুঝায়। সরকারের এই একক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিএনপি কার্যকর কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে ভূমিকা রাখতে পারছে বলে আপনার মনে হয়?


খন্দকার মাহবুব হোসেন : দেখেন, পারছে না। এটা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই। না পারারও একটা কারণ রয়েছে। যে ক্ষেত্রে বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে শত শত মামলা রয়েছে। আন্দোলন-সংগ্রামের কোনোরকম পদক্ষেপ নিলেই বিশেষ করে গ্রামপর্যায়ে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। আপনারা ঢাকা শহরে দেখছেন কোনোরকম পুলিশের অনুমোদন ছাড়া আমরা কোনো মিটিং-মিছিল করতে পারি না। সে ক্ষেত্রে এ পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হতে হলে আমি এখনো বিশ্বাস করি এক সময় একটি সফল নেতৃত্ব আসবে। বিশেষ করে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া জেলে এবং আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশের বাইরে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পক্ষে অনেক সময় এ দেশের প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করা সম্ভব হচ্ছে না। সেই কারণে আমাদের কিছুটা দুর্বল নেতৃত্ব রয়েছে।

নয়া দিগন্ত : আইন অঙ্গনে আপনি দীর্ঘদিন আছেন। ১৯৬৪ সাল থেকে আপনার আইন পেশায় প্র্যাকটিস শুরু। এই পেশায় যখন এসেছেন তখন যা দেখেছেন আর বর্তমানে যা দেখছেন এর মধ্যে কী পার্থক্য দেখছেন?


খন্দকার মাহবুব হোসেন : এই সুদীর্ঘ ৫০ বছর আইন অঙ্গনে পরিবর্তন হয়েছে অনেক। আমরা যখন প্রথম বারে এসেছিলাম তখন আমরা দেখেছি, বিচারক তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচার করেন এবং আইন মাফিক বিচার করেন। সেখানে কোনো রাজনৈতিক প্রভাব বা ব্যক্তিগত প্রভাব থাকত না। কিন্তু ধীরে ধীরে দেখতে পাচ্ছি- আইন অঙ্গনেও বিভিন্নভাবে বিচার ক্ষেত্রে প্রভাবান্বিত হচ্ছে। মানুষ এ কথা মনে করেন। তাই একটি কথা মনে রাখতে হবে- বিচার বিভাগ হলো জনগণের শেষ আশ্রয় স্থল। এই আশ্রয় স্থলটি যাতে কোনো মতে, কোনোভাবে কলঙ্কিত না হয়। প্রভাবমুক্ত থাকে সেটা আমাদের সবাইকে দেখতে হবে। আমি মনে করি, বর্তমান যে অবস্থা তার অবশ্যই পরিবর্তন হতে হবে।

নয়া দিগন্ত : একটি ভিন্ন প্রসঙ্গে প্রশ্ন করতে চাই। সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা সংবিধানের ১৬তম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল রেখেছিলেন। সম্প্রতি দেখা গেছে, হাইকোর্ট বিভাগের তিনজন বিচারপতিকে বিচারকাজ থেকে বিরত রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই অবস্থায় এখন কি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আছে?


খন্দকার মাহবুব হোসেন : দেখুন, বাকশাল হওয়ার আগে আমাদের প্রথম সংবিধানে ছিল- নিম্ন আদালতগুলোতে বিচারকদের নিয়োগ, অপসারণ বিশেষ করে বিচারকদের অপসারণের বিষয়টি নির্ধারণের দায়িত্ব ছিল সংসদের। পরবর্তী সময়ে বাকশাল হয়, এটা এককভাবে বিচারকদের নিয়োগ, অপসারণ রাষ্ট্রপতির আওতায় নেয়া হয়। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে নিজে রাষ্ট্রপতি থাকা সত্ত্বেও তিনি সেই ক্ষমতা খর্ব করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করেছিলেন। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল অনুযায়ী বিচারকদের যদি অপসারণ করতে হয়, তিনজন সদস্য থাকবেন- প্রধান বিচারপতি এবং তার পরবর্তী জ্যেষ্ঠ দুইজন বিচারপতি। পঞ্চম সংশোধনীতে সেটাকে বহাল রাখা হয়। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল যদি না থাকে তাহলে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যেভাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় সর্বক্ষেত্রে নেয়া হয় সে ক্ষেত্রে এই বিশ্বাস রয়েছে যে, বিচারকদেরও রাজনৈতিক আক্রোশে তাদের সরিয়ে দেয়া হতে পারে। এজন্য পার্লামেন্টের কাছে এটি না দিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল এখনো বহাল আছে। আরেকটা বড় বিষয় হলো আমাদের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যে দল থেকে একজন সংসদ নির্বাচিত হবেন তাকে অবশ্যই সে দলকে সমর্থন দিতে হবে যেকোনো ভাবে। তার ফলে দেখা যাচ্ছে, যদি কোনো সরকারি দল বিচারকের অপসারণ করতে চায় সে ব্যাপারে তাদের স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা সংসদে নাই। সরকার যেটি চাবে তাদের সেই মতামতের ভিত্তিতে ভোট দিতে হবে। এখনো তিনজন বিচারকের ব্যাপারে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে সেটাও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের আওতায় করা হয়েছে বলে আমি বিশ্বাস করি।
  • কার্টসি ঃ নয়াদিগন্ত/ সেপ্টেম্বর ২৮,  ২০১৯ । 

Friday, September 27, 2019

বাংলাদেশে গণতন্ত্র



এমাজউদ্দীন আহমদ 

অধ্যাপক মুনরোর (William Bennett Munro) কথায়, 'সুসভ্য মানুষ ধর্মীয় অনুপ্রেরণা লাভ করেছে প্রাচ্যদেশ থেকে, অক্ষর পেয়েছে ইজিপ্ট থেকে, অ্যালজেব্রা পেয়েছে মুরদের কাছ থেকে, ভাস্কর্য লাভ করেছে গ্রিকদের কাছ থেকে, আইন পেয়েছে রোমানদের কাছ থেকে। রাজনৈতিক সংগঠনের জন্য সে প্রধানত ঋণী ইংলিশ মডেলের কাছে।' ব্রিটিশ সংবিধান হলো সব সংবিধানের জননী। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সব পার্লামেন্টের জন্মদাত্রী। এর ভিত্তিতেই কালে কালে সংগঠিত হয়েছে সংসদীয় গণতন্ত্র বা পার্লামেন্টারি শাসনব্যবস্থা। বাংলাদেশের সরকার পদ্ধতি ব্রিটিশ মডেলের। গড়ে উঠেছে ব্রিটিশ ব্যবস্থার অনুকরণেই। ব্রিটেনের গণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনাকে ধারণ করেই। তারপরও কেন সংসদীয় ব্যবস্থা এ দেশে প্রাণবন্ত হচ্ছে না? কেন এ দেশে গণতন্ত্র ব্যর্থ হচ্ছে? এসব প্রশ্ন জনগণের মনে প্রতিনিয়ত আলোড়ন তোলে; আন্দোলিত করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীদের মনকে। এসব প্রশ্নের উত্তর সবার কাছে সহজলভ্য হওয়া দরকার। সবার জানা দরকার।



আজকের বাংলাদেশে ব্রিটিশ মডেলে নির্বাচিত সংসদ থাকার কথা। রয়েছে ব্রিটিশ পদ্ধতির মন্ত্রিপরিষদ। রানী নেই বসে শীর্ষস্থানে, কিন্তু রয়েছেন রাষ্ট্রপতি, শাসনতান্ত্রিক প্রধান হিসেবে। রয়েছে রাজনৈতিক দল। ব্রিটিশ মডেলের বহুদলীয় ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল রয়েছে শাসন কাজ পরিচালনার দায়িত্বে। সংখ্যালঘু দল বিরোধিতায়। ছায়া কেবিনেট গঠিত হয়নি বটে, কিন্তু বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবর্গ কেবিনেট সদস্যদের প্রতিপক্ষ হিসেবে কাজ করছেন। গণতন্ত্রের কাঠামো রয়েছে, নেই শুধু এর সুষ্ঠু কার্যকারিতা।

গণতন্ত্রের সুষ্ঠু কার্যকারিতা নেই কেন? এ প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়। নেই এর কোনো সর্বজনগ্রাহ্য জবাব। ইতিহাস এ ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য কোনো দলিল নয়। শুধু এটুকু বলা যায়, ইতিহাস নয়, বরং এ ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা দিতে পারে সমাজবিজ্ঞান বা মনোবিজ্ঞান বা পলিটিক্যাল ইকোনমি। বাংলাদেশে সংসদ রয়েছে, নেই শুধু সংসদীয় সংস্কৃতি। মন্ত্রিপরিষদ আছে, নেই মন্ত্রিপরিষদীয় দায়িত্বশীলতার একবিন্দু। যতটুকু রাজনৈতিক দল আছে, তার চেয়ে অনেক বেশি রয়েছে দলীয় জিঘাংসা, দলীয় প্রতিহিংসা। সরকার রয়েছে। রয়েছে বিরোধী দলও। কিন্তু একে অপরের প্রতিপক্ষ হিসেবে নয়; রয়েছে বৈরিতার ডালা সাজিয়ে, শত্রুতার হিংস্র দন্তনখরসমেত। রাষ্ট্রপতি শুধু অলঙ্কার। ব্রিটেনে অনেকে এখনও বিশ্বাস করে, যতক্ষণ রানী বাকিংহাম প্রাসাদে রয়েছেন; জনগণ ততক্ষণ ঘুমায় নিশ্চিন্তে। বঙ্গভবনের কর্মকর্তার ক্ষেত্রে এখনও তা প্রযোজ্য হয়নি।

মানবসভ্যতার ইতিহাসে বৃহৎ জনসমষ্টির শাসন-প্রশাসনের কলাকৌশলে মাত্র দুটি জাতি বিশিষ্ট অবদান রেখেছে। প্রাচীন বিশ্বে রোমান জাতি; আধুনিককালে ব্রিটিশরা। রোমানদের সুবিস্তৃত শাসনব্যবস্থার রীতিনীতি ও বিধিবিধান প্রাচীন বিশ্বের প্রায় সর্বত্র গভীর স্বাক্ষর রেখেছিল। সভ্য দুনিয়ায় রোমান সরকার ব্যবস্থা তাই গণ্য হয়েছিল নিত্য, শাশ্বত, স্থায়ী ব্যবস্থারূপে। আধুনিক বিশ্বে ব্রিটিশ মডেল অনেকটা বিশ্বজনীন। দুইয়ের মধ্যে মিল শুধু এইখানে। কার্যকারিতার ক্ষেত্রে তফাত কিন্তু আকাশ-পাতাল। অনেকটা আলো-অন্ধকারের মতো।

রোমান ব্যবস্থা গণইচ্ছার মুকুট পরে জয়যাত্রার সূচনা করে। শেষ করে অবশ্য পরম পরাক্রমশালী বিজয়ীর দুর্বিনীত একাধিপত্যের পদতলে। অন্যদিকে ব্রিটিশ ব্যবস্থা শুরু হয় ক্ষমতাদর্পী, স্বেচ্ছাচারী রাজার বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে। এর সমাপ্তি ঘটে সার্বভৌম গণইচ্ছার পদতলে আত্মনিবেদন করে। আধুনিককালের চিন্তাচেতনা ধারণ করে, প্রতি বাঁকে জনগণের রায়ের সঙ্গে নিজেকে সঙ্গতিপূর্ণ করে ব্রিটিশ ব্যবস্থা কালোত্তীর্ণ হয়েছে। গণতন্ত্রের চেতনা গ্রিক প্রতিভার অনবদ্য সৃষ্টি। রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্র কিন্তু ব্রিটিশদেরই শ্রেষ্ঠতম অবদান। 'জনগণের বাণী ভগবানেরই বাণী'- এ নীতির বাস্তবায়ন তাদের মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে।

শাসনব্যবস্থা সম্পর্কিত এ দুই ঐতিহাসিক ধারার প্রতিফলন বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন সমাজে দেখা গেছে। এমনকি একই সমাজে বিভিন্ন সময়েও এর বাস্তবায়ন দেখা যায়। বাংলাদেশ তার জন্মলগ্ন থেকেই যাত্রা শুরু করেছিল গণতন্ত্রকে মাথায় নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের অনলকুণ্থেকে স্বাধীনতা এবং রক্তরঞ্জিত পতাকা তুলে এনে; আত্মত্যাগ ও আত্মদানের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে। গণতন্ত্রের প্রতি আগ্রহ ও অনুরাগের শত মশাল জ্বালিয়ে। অনেকটা রোমানদের মতো গণতন্ত্রের চেতনাকে শানিত করে। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশে গণতন্ত্রের মৃত্যু অথবা অপমৃত্যু ঘটে। তাও মাত্র তিন বছরের মধ্যে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাত্র এক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ সংবিধান দ্বিতীয় সংশোধন আইনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের ভিত্তিমূল শিথিল হয়। মৌলিক অধিকার স্থগিত করার বিধান আসে। বিনা বিচারে আটকের ব্যবস্থা হয়। স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মধ্যে গণতন্ত্রের সমাধি রচিত হয় বাংলাদেশে। একদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। সংবাদপত্রের মুখ-চোখ-কান বন্ধ হয়। বিরোধিতার সব বাতায়ন রুদ্ধ হয়। রোমান শাসনব্যবস্থার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাতে লেগেছিল কয়েকশ' বছর। বাংলাদেশে তা এলো মাত্র সাড়ে তিন কি চার বছরে, প্রবল প্রতাপ বিজয়ীর পদতলে।

অন্যদিকে তাকালেও দেখা যাবে, ব্রিটিশ পদ্ধতি পরিণত অবস্থায় উপনীত হয় চার-পাঁচশ' বছরে। ১২১৫ সালের ম্যাগনা কার্টা থেকে যার যাত্রা শুরু, ১৬৮৮-এর গৌরবময় বিপ্লবের মধ্য দিয়ে তার স্থিতিশীল অবস্থা। পরবর্তী পর্যায়ে তা ব্রিটেনেই সীমিত থাকেনি। বিশ্বময় হয়েছে প্রচারিত, প্রবর্তিত এবং নন্দিত। বাংলাদেশে এ চক্রের আবর্তনে সময় লাগে মাত্র ক'বছর। প্রথমে একদলীয় ব্যবস্থার অবসান এবং বহুদলীয় ব্যবস্থার প্রবর্তন। গণতন্ত্রের চলার প্রক্রিয়া যে নির্বাচন, তার প্রতিষ্ঠা। মৌলিক অধিকারের পুনর্মূল্যায়ন ও পুনর্বাসন। দু'দশকের মধ্যে সংসদীয় ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন, ১৯৯১ সালে। সংসদকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে পুনঃস্থাপন। সরকারি ও বিরোধী দলের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে জাতীয় কল্যাণ সাধনের পথ প্রশস্তকরণ। এ সবকিছুই মাত্র দু'দশকের মধ্যে। ব্রিটিশ ব্যবস্থার মতো রাজাধিরাজের পদতল থেকে গণইচ্ছার সিংহাসনে।

শাসনব্যবস্থার এ নাটকে বারবার পটপরিবর্তন কাঙ্ক্ষিত নয়। নয় প্রয়োজনীয়। তার পরও তা হয় কেন? কেন হয়, তার বিস্তৃত জবাব রয়েছে। কীভাবে এর গতিপথ রোধ করা যায়, তারও পথনির্দেশ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে জন স্টুয়ার্ট মিলের কিছু বক্তব্য উদ্ধৃত করতে চাই। তিনি বলেন, 'গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি কোনো জাতির অনুরাগ থাকতে পারে। গণতন্ত্রকে সফল করার জন্য কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। কোনো সমাজে গণতন্ত্র বিধ্বস্ত হয় যদি ওই জাতি ঔদাসীন্য বা অসতর্ক বা কাপুরুষোচিত আচরণ বা গণতান্ত্রিক চেতনার অভাবে অধিকার সংরক্ষণের অযোগ্য হয়ে ওঠে। আক্রান্ত হলে সংগ্রামে লিপ্ত না হলে, শাসনব্যবস্থার বাইরের চাকচিক্যে বিভ্রান্ত হলে কিংবা সাময়িকভাবে উৎসাহ হারিয়ে ফেললে, ভীত-সন্ত্রস্ত হলে অথবা কোনো ব্যক্তির প্রতি তিনি যত বড় এবং মহান নেতাই হোক না কেন, অনুরাগের আতিশয্যে মুগ্ধ হয়ে সব অধিকার তার পায়ে সঁপে দিলে, ওই জাতি স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণের অযোগ্য হয়ে ওঠে।'

স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্যপ্রিয় বাংলাদেশের সচেতন জনগণের জন্য আজকে জন স্টুয়ার্ট মিলের গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য সম্ভবত সবচেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। ৩০ লাখ জীবনের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা অর্থপূর্ণ হতে পারে শুধু গণতান্ত্রিক কাঠামোয়। প্রত্যেকের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় গণতন্ত্রে। প্রত্যেকে নিজ নিজ ভাগ্য পরিবর্তনের সুযোগ পায় এ ব্যবস্থায়। প্রত্যেকে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের অবাধ সুযোগ লাভ করে গণতন্ত্রে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সংরক্ষণে জনগণের যে ভূমিকা, নেতৃত্বের ভূমিকা তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দেশের নেতানেত্রীদের এ কথা স্মরণে রাখা উচিত। যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে ১৮০০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে প্রথম ভাষণে বলেছিলেন, 'আমরা সবাই রিপাবলিকান-ফেডারেলিস্ট। আমাদের মধ্যে এখনও যদি কেউ থেকে থাকেন যিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ভেঙে দিতে চান বা রাষ্ট্রের প্রজাতান্ত্রিক রূপকে পাল্টে দিতে চান, তাহলেও তিনি পূর্ণ নিরাপত্তার অধিকারী হবেন। কেননা, ভ্রান্ত অভিমতকে শোধরাতে হবে শুধু যুক্তি দিয়ে।' তিনি আরও বলেন, 'ত্রুটিপূর্ণ বিচার-বুদ্ধির জন্য আমি ভুল করতে পারি। যখন সঠিক পথে থাকব, তখনও সার্বিক চিত্র চোখের সামনে না পেয়ে আমাকে ভ্রান্ত বলে সমালোচনা করতে পারেন কেউ কেউ। আমার ভুল শুধরে দেওয়ার আহ্বান জানাই।'

ওই বছরই যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান ও ফেডারেলিস্ট ওই দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ দেখা দেয়। বিজয়ী হয়ে তিনি বলতে পেরেছিলেন, আমরা সবাই রিপাবলিকান, আমরা সবাই ফেডারেলিস্ট। পারবেন কি আমাদের নেতানেত্রীরা বলতে- 'সবাই আমরা আওয়ামীপন্থি, সবাই আমরা বিএনপিপন্থি, সবাই আমরা বাংলাদেশি'। মহৎপ্রাণ নেতৃত্বের অগ্নিস্পর্শে বিভেদের সব কালিমা মুছে যায়। মুছে যায় বলেই জেফারসনের মতো নেতা সবাইকে আহ্বান করতে পারেন এক প্রাণ এক মন নিয়ে সম্মিলিত হতে। ফলে গড়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্রের বিশাল সৌধ। আর আমরা? আমাদের নেতানেত্রীরা দয়া করে স্মরণ করুন গণতন্ত্রের প্রবক্তা ওইসব দিকপালের কিছু অমৃত বাণী। গণতন্ত্রের ঝুপড়ি বানানোর ক্ষমতাও কি নেই আমাদের? সরল মনে কল্যাণকর জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পারেন না তেমনি উদাত্ত আহ্বানে সবার মনকে স্পর্শ করতে? এটিই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

সঙ্গে সঙ্গে আগামী দিনগুলোকে অর্থপূর্ণ করতে হলে নতুনভাবে চিন্তা করতে হবে রাষ্ট্রকৃত্যকদের সম্পর্কে। তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত হতে হবে জনগণের কাছে। সরকারকে দল থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হবে। রাজনৈতিক ক্ষমতা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দিতে হবে। একদলীয় ব্যবস্থার প্রতি মোহগ্রস্ত হলে গণতন্ত্রের শিকড়টা নড়বড়ে হয়ে যাবে। 


  • লেখক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী 
  • সূত্র — সমকাল/সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৯  
  • লিঙ্ক —   http://bit.ly/2nDQKXW 


Saturday, September 21, 2019

এক হাতে কাপড় সামলাই, অন্য হাতের আঙুল চুষি

ফারুক ওয়াসিফ




কারও আঙুল ফুলে কলাগাছ হয় আর কেউ আঙুল চোষে। চিকিৎসকেরা বলেন, নখসুদ্ধ আঙুল পরিষ্কার থাকলে ওটা চোষা যেতেই পারে। শিশুর বেলায় ওটা বদভ্যাস হলেও বড়দের জন্য অসহায়ত্ব। যখন কারও করার কিছু থাকে না, তখন আঙুল চোষায় লজ্জা থাকলেও অপরাধ হয় না।

৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের সময় আঙুলের নখে কালির দাগ না লাগাতে পারায় অনেকে আঙুল চুষেছিলেন। এ জন্য কেউ কোটি কোটি ভোটারকে দোষারোপ করেননি। একটু বদনাম হয় আরকি। যাঁরা আগের রাতে ব্যালট বাক্স টানাটানি করে হাতে দাগ লাগিয়েছিলেন, তাঁদের অন্তত আঙুল চোষার বদনাম দেওয়া যায় না। চুষলে বরং ঝামেলাই হতো। ময়লা আঙুল চোষা বারণ। সেটা তাঁরা করবেনই–বা কেন? চিকিৎসকেরা বলে থাকেন, আঙুল চোষে কিংকর্তব্যবিমূঢ়েরা। যে শিশু ভয় পায়, নিরানন্দ লাগে যার, সে আঙুল চোষে। আবার উত্তেজিত হলে আঙুল চুষলে মন শান্ত হয়। আঙুল চোষার ফজিলত বাংলাদেশিদের চেয়ে আর কে বেশি জানে?

প্রকাশ্যে নারীকে গণপিটুনিতে যখন মেরে ফেলা হলো, তখন দর্শকেরা আঙুল চুষেছিল। যখন বরগুনায় রিফাত শরীফকে কোপানো হচ্ছিল, তখনো চারপাশে আঙুল চোষায় সিদ্ধহস্তদের আমরা ভিডিওতে দেখেছি। তাদের মধ্যে আমার–আপনার মতো মানুষও ছিল। যখন সব আমরা আমরাই করে থাকি, তখন আর লজ্জার কী থাকতে পারে! যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের এক কর্মীর মাজায় হাতুড়িনৃত্য চলছিল, দর্শকদের কারও হাত তখন এগিয়ে এসে তাঁকে বাঁচাতে পারেনি। কারণ, হাতের একটি আঙুল মুখে পোরা ছিল। একটি আঙুল, কেবল একটি আঙুল মুখে পুরে রেখে দেখুন আর কিছু করতে পারেন কি না?

যেমন আমরা পারিনি, আমাদের তৎকালীন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান সাহেবও পারেননি। তাঁর এবং তাঁর মতো অনেক দায়িত্বশীলের চোখের সামনে ব্যাংকের নিরাপত্তাব্যবস্থা হ্যাক করে প্রায় হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়ে গেল; তাঁরা কিছু করতে পারেননি। সম্ভবত তাঁরা তখন আঙুল চুষছিলেন। সেই চোষা এমনই চোষা যে ঘটনাটির ২৮ দিন পরও তিনি মুখ খুলতে পারেননি। কারণ, মুখে আঙুল পোরা ছিল। ফলে কেউ কিছু জানতেও পারেনি।

এক গৃহস্থ ঘুমের মধ্যে মুখে আঙুল পুরে রাখতেন। ছোটবেলার অভ্যাস। এক রাতে যখন তাঁর ঘরে চুরি হচ্ছে, তখন ঘুম ভাঙলেও তিনি আওয়াজ করতে পারেননি। আওয়াজ করতে হলে মুখ থেকে আঙুল বের করতে হয় যে! মুখে ঠেসে ধরা আঙুল চুপ করানোর প্রতীক। আর আঙুল চোষা হলো স্বেচ্ছা নীরবতার প্রতীক।

ডেঙ্গু মহামারিতে সারা দেশে দুই শর বেশি মানুষের মৃত্যু হলো, আরও হচ্ছে। আগেভাগে খবরও ছিল। তবু আঙুল চোষাজনিত বিকলতায় সংশ্লিষ্টরা কোনো প্রতিরোধ গড়তে পারেননি। খেলাপি ঋণে ব্যাংক–আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হওয়ার মুখে, লাখো কোটি টাকা বিদেশে পাচার, কারও আঙুল উঁচু হয়ে বলল না, ‘খবরদার!’

আমরা দেখেছি, সঠিক মানুষের সঠিক তর্জনী সঠিক সময় উঁচু হলে কী হয়? ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বিশ্ব দেখেছে, একটি স্বাধীন ও সাহসী আঙুলের নির্দেশ কত শক্তিশালী হতে পারে। মিয়ানমার এক মিলিয়ন রোহিঙ্গা শরণার্থী পাঠিয়ে দিল, গণহত্যা চালাল সীমান্ত ঘেঁষে। মানবতার ভয়াবহ ধ্বংসের রিয়েলিটি শো দেখেও কেউ বলল না, ‘আমাদের দেশ তোমাদের নিষ্ঠুরতার শিকারদের ফেলার জায়গা না, খবরদার!’

প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১১ জন শ্রমিকের লাশ আসছে। এ বছরের প্রথম আট মাসে এসেছে ২ হাজার ৬১১টি লাশ। যেসব নারীর ঘর হইতে আঙিনা বাহির ছিল, তাঁরাও আশায় বুক বেঁধে মধ্যপ্রাচ্যে যান। রক্তাক্ত–নির্যাতিত হয়ে তাঁরা ফিরে আসছেন। আমাদের যুবকেরা ইউরোপে যেতে সমুদ্রে ডুবে মরছেন। মুখে আঙুল পুরে আমরা টেলিভিশনে দেখে গিয়েছি; কিচ্ছু করতে পারিনি।

যুবলীগের নেতা ক্যাসিনো ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হলে সংগঠনের চেয়ারম্যান গোসসা করেছেন। বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সরকারের লোকেরা কি এত দিন আঙুল চুষেছেন? তাঁরা কি এসব জানতেন না? কথা সত্য, যাঁদের করার কিছু থাকে, তাঁরা সাধারণত আঙুল চোষেন না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নিশ্চয় অন্য কাজে ভীষণ ব্যস্ত ছিলেন। তাই আঙুল চোষার অভিযোগ অন্তত তাঁদের বিরুদ্ধে করা যায় না। স্বয়ং চেয়ারম্যানও সময় পাননি তাঁর অনুসারীদের খোঁজ রাখতে। টেলিভিশনে যেভাবে তাঁদের ব্যস্ততা, সফর, বক্তৃতা ইত্যাদির সচিত্র বিবরণ দেখে মনে হয় না আঙুল চোষার সময় তাঁরা পান। সেই সময় আমাদের আছে, আমরা যারা আমজনতা।

এখন যখন ক্ষমতার এক আঙুল আরেক আঙুলকে দোষারোপ করছে, তখন জনগণ হিসেবে আমরা বিভ্রান্ত হই। বেদিশা লাগে। ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাবে সাংবাদিকদের ক্যামেরার হঠাৎ আলোর ঝলকানি দেখে চমকে আমাদের মুখ হাঁ হয়ে যায়। এই অবসরে চোষণলিপ্ত মুখ থেকে ছাড়া পায় আঙুল। সেই আঙুলে মাথা চুলকাই। বুঝতে পারি না কলির কোন কালে এসে পড়লাম রে বাবা! সবাই হঠাৎ ফ্রুটিকা খেল নাকি? এত সত্য সত্য কথা বলছে কেন সবাই? আমরা উত্তেজিত হই। উত্তেজনাবশত আবার মুখে আঙুল পুরে দিই এবং চুষতে চুষতে দেখি, বড় মাছ ছোট ছোট মাছকে ধাওয়া করছে। এক উপাচার্য চিরকুট দিয়ে ছাত্র ভর্তি করছেন, আরেকজন কোটি টাকার সেলামি দিচ্ছেন, আরেকজন আবার ৩৪০ দিনের চাকরিতে ২৫০ দিন ক্যাম্পাসেই যাননি।

একটা গল্প মনে পড়ে যায়।

প্রথম শ্রেণির ছাত্র ভোলারামের আঙুল চোষার রোগ। মা–বাবা হোমিও, অ্যালো, টোটকা, কবিরাজি সব সেরে হয়রান। কিছুতেই ভোলার মুখ থেকে আঙুল বেশিক্ষণ বাইরে রাখা যায় না। ভোলার এক মামা ছিলেন। সব দেখে তিনি সহজ বুদ্ধি দিলেন। বললেন, ‘দাও ওর প্যান্টগুলো আচ্ছা ঢিলা করে।’

এরপর হলো কী। পরলেই প্যান্ট কোমর থেকে যে–ই না খসে পড়ে, অমনি ভোলা দুই হাত দিয়ে প্যান্ট ধরে রাখে তুলে। এমনি করেই বেচারা দৌড়াদৌড়ি করে, খেলাধুলা করে, স্কুলে যায়। বাবা–মা, স্কুলের শিক্ষক, বন্ধুবান্ধব—সবাই বেজায় খুশি। সবাই শিখল, প্যান্ট খসে গিয়ে নাঙ্গা হওয়ার ভয় না পেলে কেউ আঙুল চোষা বন্ধ করে না।

যে জাতি আঙুল চোষার নেশায় আসক্ত, তাদের ভোলারামের মতো পরনের কাপড় খসে পড়লেও আঙুল চোষা আর বন্ধ হবে না। সমস্যা হলো, খেলারামরা মাঠের দখল নিয়ে নিলে ভোলারামরা আঙুল না চুষে আর কী করতে পারে? আমাদের অবস্থা হয়েছে, এক হাতে কাপড় সামলাই তো আরেক হাতের আঙুল চুষি।

  • লেখক সাংবাদিক।
  • কার্টসি —  প্রথম আলো/ সেপ্টেম্বর ২১,২০১৯ 

জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটির চোখে বাংলাদেশ






সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটিতে (ক্যাট) বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয় গত ৩০ ও ৩১ জুলাই। সেখানে গুম, আটক, হেফাজতে নির্যাতনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন অভিযোগ তোলে কমিটি এবং এর জবাব দেয় বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল। এরপর ৯ আগস্ট নিজেদের পর্যবেক্ষণ ও কিছু বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ এবং সঙ্গে বিভিন্ন সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে কমিটি। সেই প্রতিবেদনের অনুবাদ। 


বাংলাদেশের প্রাথমিক প্রতিবেদন নিয়ে চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণ, কমিটির ৬৭তম অধিবেশনে অনুমোদিত  ——     

সূচনা  ——     

বাংলাদেশ ১৯৯৮ সালের ৫ অক্টোবর জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী সনদে স্বাক্ষর করেছে। সনদের ১৯ আর্টিকেলের প্রথম প্যারাগ্রাফ অনুযায়ী, দেশটি ১৯৯৯ সালের ৪ নভেম্বরের মধ্যে তার প্রাথমিক প্রতিবেদন দাখিল করতে নীতিগতভাবে বাধ্য ছিল। ২০০০-১৮ সাল পর্যন্ত যেসব রাষ্ট্রপক্ষ তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়নি, সেসব রাষ্ট্রপক্ষের তালিকায় ছিল বাংলাদেশ; যা কমিটির বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনটি রাষ্ট্রপক্ষ ও সাধারণ পরিষদের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। ২০১৮ সালের ১০ ডিসেম্বর কমিটি এক চিঠিতে রাষ্ট্রপক্ষকে তাদের প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা না দেওয়ার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয় এবং প্রতিবেদন ছাড়াই কমিটি তার পর্যালোচনার কাজ এগিয়ে নিতে পারে বলেও উল্লেখ করা হয় চিঠিতে। ১৬ জানুয়ারি ২০১৯ বাংলাদেশ কমিটিকে জানায়, দেশটি তার প্রাথমিক প্রতিবেদন তৈরি করবে ও পাঠাবে। ১৮ জানুয়ারি ২০১৯ কমিটির চেয়ারপারসন প্রাথমিক প্রতিবেদন বিবেচনা করার তারিখের বিষয়ে ইঙ্গিত দেন। দেশটির প্রতিনিধিদলের সঙ্গে ৩০ ও ৩১ জুলাই গঠনমূলক আলোচনা হয়েছে। দেশটির প্রাথমিক প্রতিবেদন পাওয়া গেছে ২৩ জুলাই ২০১৯ গ্রহণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ তার প্রাথমিক প্রতিবেদন ২০ বছর পর জমা ও প্রতিবেদনটি বিবেচনা করার মাত্র এক সপ্তাহ আগে তা গৃহীত হওয়ায় কমিটি দুঃখ প্রকাশ করে। তবে দেশটির প্রতিনিধিদলের সঙ্গে গঠনমূলক আলোচনা এবং কমিটির সভায় বিভিন্ন জিজ্ঞাসার মৌখিক ও লিখিত জবাব দেওয়াকে স্বাগত জানায় কমিটি।

ইতিবাচক বিষয়সমূহ  ——    

আন্তর্জাতিক মানবাধিকারবিষয়ক নিম্নলিখিত সনদ ও প্রটোকলগুলো রাষ্ট্রপক্ষের স্বাক্ষর এবং অনুমোদন করার বিষয়টিকে কমিটি স্বাগত জানায়:

ক. ১৯৯৮ সালে, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদ;

খ. ১৯৯৮ সালে, গণহত্যার অপরাধ প্রতিরোধ ও সাজাবিষয়ক সনদ;

গ. ১৯৯৮ সালে, বিবাহের ক্ষেত্রে অনুমতি, বিবাহের ন্যূনতম বয়স ও বিবাহ নিবন্ধনবিষয়ক ১৯৬২ সালের সনদ;

ঘ. ২০০০ সালে, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদ;

ঙ. ২০০০ সালে, নারীর বিরুদ্ধে সব ধরনের বৈষম্য অবসান সনদের ঐচ্ছিক প্রটোকল;

চ. ২০০০ সালে, শিশুদের বিক্রির ওপর শিশুর অধিকার, শিশু পতিতাবৃত্তি ও শিশু পর্নোগ্রাফি বিষয়ক সনদের ঐচ্ছিক প্রটোকল;

ছ. ২০০০ সালে, সশস্ত্র সংঘাতে শিশুদের যুক্ত করা নিয়ে শিশু অধিকারবিষয়ক সনদের ঐচ্ছিক প্রটোকল;

জ. ২০০৭ সালে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকারবিষয়ক সনদ;

ঝ. ২০০৮ সালে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকারবিষয়ক সনদের ঐচ্ছিক প্রটোকল;

ঞ. ২০১০ সালে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতবিষয়ক রোম বিধি;

ট. ২০১১ সালে, সব অভিবাসী শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের অধিকার সুরক্ষাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদ;

নিম্নলিখিত আইনগুলো অনুমোদন করা ছাড়াও সনদের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রগুলোতে নিজস্ব আইন পর্যালোচনায় রাষ্ট্রপক্ষের উদ্যোগকে স্বাগত জানায় কমিটি: 

ক. ২০০০ সালের নারী ও শিশুদের প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধ আইন;

খ. ২০০০ সালের লিগ্যাল এইড সার্ভিস অ্যাক্ট (আইনি সহায়তা সেবা আইন);

গ. ২০১০ সালের পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন;

ঘ. ২০১২ সালের মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন;

ঙ. ২০১৩ সালের নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (প্রতিরোধ) আইন;

চ. ২০১৩ সালের প্রতিবন্ধীদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন;

ছ. ২০১৩ সালের শিশুদের ওপর যেকোনো ধরনের শারীরিক নির্যাতনে জড়িত ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণবিষয়ক শিশু আইনে সংশোধনী;

জ. ২০১৮ সালের যৌতুক নিরোধ আইন।

সনদ কার্যকর করতে রাষ্ট্রপক্ষের নীতিমালা, কর্মসূচি ও প্রশাসনিক পদক্ষেপে সংশোধনীর উদ্যোগ স্বাগত জানায় কমিটি; যার মধ্যে রয়েছে:


ক. ২০০৮ সালে নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি গঠন; নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা নিয়ে মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ের গ্রহণ করা বহুপক্ষীয় কর্মসূচি (মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রাম অন ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন/ এমএসপিভিএডব্লিউ); এবং ৫৯১৬ নম্বর রিট আবেদনে কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারীদের যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে সুরক্ষা পদক্ষেপসংবলিত নির্দেশনার উল্লেখ;

খ. ২০০৯ সালে, বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠন;

গ. ২০১০ সালে, ৫৬৮৪ নম্বর রিট আবেদনে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সব ধরনের শারীরিক শাস্তি বন্ধে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা;

ঘ. ২০১৬ সালে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার, আটক, রিমান্ড ও গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির প্রতি আচরণের ক্ষেত্রে সুরক্ষামূলক পদক্ষেপ অনুসরণ বিষয়ে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের দেওয়া ১৫টি নির্দেশনা; এবং গ্রেপ্তার, আটক, তদন্ত ও অভিযুক্ত ব্যক্তির প্রতি আচরণ বিষয়ে ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের জন্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা;

ঙ. প্রধান উদ্বেগের বিষয়সমূহ ও সুপারিশমালা

১৯৯৮ সালের ৫ অক্টোবর জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী সনদে স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। পরের বছর ৪ নভেম্বরের মধ্যে এ বিষয়ে প্রাথমিক প্রতিবেদন দাখিল করার কথা ছিল। প্রায় ২০ বছর পর সেই প্রতিবেদন বাংলাদেশ উপস্থাপন করেছে গত জুলাই মাসে। এরপর এই প্রতিবেদন ধরে এবং বাংলাদেশি প্রতিনিধিদলের উপস্থিতিতে আলোচনা হয়েছে জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটিতে। অনেক বিষয়ে কমিটি সন্তুষ্ট হতে না পারলেও বাংলাদেশ যে শেষ পর্যন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে, সেটাকেই আপতত অগ্রগতি হিসেবে উল্লেখ করে একে স্বাগত জানানো হয়েছে।

নির্যাতনের ব্যাপক ব্যবহার ও অসদাচরণের অভিযোগ  ——    

নির্যাতন বা নিষ্ঠুরতা, অমানবিক বা মর্যাদাহানিকর শাস্তি বা আচরণ থেকে যে কাউকে সুরক্ষা দিতে রাষ্ট্রপক্ষের সাংবিধানিক ধারা; এবং নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩ রাষ্ট্রপক্ষের অনুমোদন করাকে স্বাগত জানায় কমিটি। তবে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি বা ঘুষ আদায়ের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ব্যাপক ও নিয়মিত নির্যাতন এবং অসদাচরণের অভিযোগের যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে উদ্বিগ্ন কমিটি। বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের দেওয়া তথ্যে এমন ১৭টি ঘটনার কথা জানা গেছে, যেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে এই আইনের অধীনে মামলা করা হয়েছে। কমিটি এ নিয়েও উদ্বিগ্ন যে এসব মামলার বিষয়ে আরও তথ্য প্রকাশ করা হয়নি এবং প্রতিনিধিদলও এ বিষয়ে কিছু জানায়নি। আইনটি কার্যকর হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত এ আইনে দায়েরকৃত মামলাগুলোর একটিরও বিচার সম্পন্ন না হওয়ার খবরে উদ্বিগ্ন কমিটি। উপরন্তু, কমিটি এ খবর পেয়েছে, এ আইনের অধীন কিছু কিছু বাহিনীকে দায়মুক্তির সুরক্ষা দিতে বা আইনে নিষিদ্ধ আচরণের ব্যাপকতা সীমাবদ্ধ করতে আইনটি সংশোধন বা বাতিলের জন্য পুলিশ ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষ বারবার অনুরোধ জানিয়েছে। এ আইনে কোনো সংশোধনী আনা হবে না বলে প্রতিনিধিদল যে বিবৃতি দিয়েছে সেটি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের অপরাধমূলক কাজে সরকারের ‘শূন্য সহনশীলতা’ নীতি এবং পুলিশ সপ্তাহ ২০১৯-এ প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য—কোনো নিরপরাধ মানুষকে যেন নির্যাতন ও হয়রানির শিকার করা না হয়—এ সবই কমিটি সাধুবাদ জানায়। কমিটি ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ রকম দায়মুক্তির অনুরোধ করছে এবং তাদের কাজের ক্ষেত্রে নির্যাতন ও অসদাচরণের শামিল হয় এমন ঘটনাকে প্রয়োজনীয় ও গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করা অব্যাহত রেখেছে। উপরন্তু, এ-ও গভীর উদ্বেগের বিষয়, নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ হচ্ছে না। রাষ্ট্রপক্ষকে কমিটি মনে করিয়ে দিতে চায়, সনদের আর্টিকেল ২-এর ধারা ২-এ বলা আছে, কোনো ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি যেমন যুদ্ধাবস্থা বা যুদ্ধের হুমকি, অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা বা অন্য যেকোনো জরুরি অবস্থাকে নির্যাতনের দোহাই হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না (আর্টিকেল ২, ৪, ১৫ ও ১৬)।

রাষ্ট্রপক্ষের যা করা উচিত (নির্যাতনবিরোধী সুপারিশ)  ——    

ক. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নির্যাতন ও অসদাচরণের বিষয়টিকে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে প্রকাশ্যে স্বীকার করে নিয়ে কোনো অবস্থাতেই বা কারও বিরুদ্ধে তা সহ্য করা হবে না বলে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিতে হবে।

খ. এটি সরকারকে প্রকাশ্যে নিশ্চিত করতে হবে, নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনের প্রয়োগ রাষ্ট্রের কোনো কর্মীর স্বার্থে সীমিত করার কোনো রকম ইচ্ছে তাদের নেই। এই আইনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে যারা তালিকাভুক্ত রয়েছে, তার বাইরেও রাষ্ট্রের অন্য যেকোনো কর্মকর্তার ক্ষেত্রে বিধানটি কার্যকর করতে ও নির্যাতনের জন্য তার ব্যক্তিগতভাবে অপরাধের দায় বহন নিশ্চিতে ব্যবস্থা নিতে হবে। 

গ. সরকারের যে কর্মকর্তারা নির্যাতন ও অসদাচরণ করবেন, তাঁদের বিচারের আওতায় আনা এবং কৃত অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দায় বা কমান্ড রেসপনসিবিলিটিও নিশ্চিত করতে হবে।

ঘ. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ফরেনসিক এবং বলপ্রয়োগহীন তদন্ত পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদান ও এর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সন্দেহভাজন অপরাধীর কাছ থেকে জোরপূর্বক অপরাধের স্বীকারোক্তি আদায়ে নির্যাতন ও অসদাচরণ অগ্রহণযোগ্য —আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সব সদস্যকে এ ব্যাপারে অবগত করার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে।

ঙ. নির্যাতন ও অসদাচরণের মাধ্যমে সন্দেহভাজন অপরাধীর কাছ থেকে আদায় করা স্বীকারোক্তি অপরাধের প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা হবে না, এটি নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নেওয়া।

চ. নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন কার্যকর করার ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ে পরিসংখ্যানগত তথ্য পদ্ধতিগত উপায়ে সংগ্রহ করতে হবে। এতে অভিযোগের সংখ্যা, তদন্ত, প্রসিকিউশন, বিচার এবং নির্যাতন ও অসদাচরণের ঘটনায় কতজন দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, নির্যাতন ও অসদাচরণের জন্য দায়ী কর্মকর্তার শাস্তি এবং প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ, বিশেষ করে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের তথ্য ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

নির্যাতনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অপর্যাপ্ত তদন্ত  ——   

কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নির্যাতন ও অসদাচরণের অভিযোগ গ্রহণ ও তদন্তে রাষ্ট্রপক্ষের ব্যবস্থা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অর্থপূর্ণভাবে জবাবদিহি করতে পারছে না বলে যে তথ্য পাওয়া গেছে, সে ব্যাপারে কমিটি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। ভুক্তভোগী বা পরিবারের সদস্যদের আনা নির্যাতন বা গুমের অভিযোগ পুলিশ কর্মকর্তারা প্রায়ই নথিভুক্ত করতে চান না বলে যে খবর পাওয়া যায়, তা নিয়ে কমিটি উদ্বিগ্ন। নির্যাতনের শিকার ভুক্তভোগী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ দায়ের করতে চাইলে বা নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশ করলে, প্রায় ক্ষেত্রেই তাঁদের হয়রানি, হুমকি ও প্রতিশোধপরায়ণতার শিকার হতে হয় বলে যে খবর পাওয়া যায়, তা নিয়েও কমিটি উদ্বিগ্ন। রাষ্ট্রের প্রতিনিধি দল বলেছে যে তারা ভুক্তভোগী ও সাক্ষীর সুরক্ষায় আইন প্রণয়নের কথা বিবেচনা করছে এবং অংশীজনদের সঙ্গে এ আলোচনা করছে, কমিটি এই বিষয়টিকে সাধুবাদ জানায়। তবে উদ্বেগের সঙ্গে এটাও বলতে চায় যে এ বিষয়ে আইন কমিশনের একটি খসড়া প্রস্তাব অনেক বছর ধরেই বিবেচনাধীন রয়েছে, কিন্তু তাতে কোনো অগ্রগতি হয়নি।

কমিটি উদ্বেগের সঙ্গে বলতে চায় যে কর্মকর্তাদের নির্যাতনের ঘটনা বা নির্যাতনের অভিযোগ তদন্তে রাষ্ট্রে কোনো স্বাধীন কর্তৃপক্ষ নেই। কাজেই সেই সব কর্মকর্তাই এসব অভিযোগ তদন্ত করেন, যাঁরা অভিযুক্ত কর্মকর্তার দপ্তরে কর্মরত কিংবা একই শ্রেণির দপ্তরে কর্মরত। ফলে এতে স্বার্থের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। কমিটি দুঃখের সঙ্গে বলতে চায়, ২০১২ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সরকার বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে যে ৭৭টি নির্যাতনের অভিযোগ পেয়েছে, সেগুলোর তদন্তের ফলাফলের ব্যাপারে প্রতিনিধিদল কোনো তথ্য দেয়নি। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের ঘটনা, যে বিষয়টি কমিটি সরাসরি উত্থাপন করেছিল। কমিটি দুঃখের সঙ্গে বলতে চায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের চিকিৎসকেরা যখন বললেন যে শহিদুল আলম বড় কোনো আঘাত পাননি, তখন তাঁকে ছাড়পত্র দিয়ে দেওয়া হয়, যদিও তিনি দাবি করেছিলেন যে ২০১৮ সালের ৫ আগস্ট গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজতে থাকার সময় তাঁকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে এবং তাঁর সঙ্গে অসদাচরণ করা হয়েছে।

প্রতিনিধিদল জানিয়েছে যে ২০১৭ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর সদস্যদের বেশ কয়েকজনকে ‘নানা অপরাধে’ অভ্যন্তরীণ নজরদারি কর্তৃপক্ষ শৃঙ্খলা ভঙ্গের শাস্তি দিয়েছে। কমিটি এই বিষয়টিকে সাধুবাদ জানিয়ে উদ্বেগের সঙ্গে বলতে চায় যে এসব অভিযোগের সর্বোচ্চ সাজা চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়া ও পদাবনতি, যা নির্যাতন ও অসদাচরণের মতো গুরুতর অপরাধের সাজা হিসেবে যথোপযুক্ত নয়।

২০১৩ সালের নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু প্রতিরোধ আইনে অভিযোগকারীকে বিচারিক তদন্তের জন্য সরাসরি আদালতে আবেদন করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, যা কমিটি সাধুবাদ জানায়। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ আইনে বেঁধে দেওয়া সময়সীমার মধ্যে তদন্তকাজ শেষ করে না এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তদন্ত কর্মকর্তাকে তা করতে চাপ প্রয়োগ করেন না বলে যে খবর পাওয়া যায়, তা নিয়ে কমিটি উদ্বিগ্ন। কমিটি দুঃখের সঙ্গে বলতে চায় যে নির্যাতনের অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ থাকলেও তা শেষ হয়নি (পারভেজের মামলা, বশির উদ্দিনের মামলা) কিংবা বছরের পর বছর ধরে বিচার ঝুলে আছে (ইমতিয়াজ হোসেনের মামলা), এমন যে কয়টি মামলার বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে প্রতিনিধিদল কোনো তথ্য দেয়নি। (আর্টিকেল ২, ৪, ১০, ১২, ১৩, ১৫ ও ১৬)।

সব ধরনের নির্যাতন ও অসদাচরণের অভিযোগের দ্রুত, নিরপেক্ষ, কার্যকর ফৌজদারি তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রপক্ষকে। এ ক্ষেত্রে কমিটি রাষ্ট্রপক্ষকে সুপারিশ করছে:


ক. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নির্যাতন ও অসদাচরণের অভিযোগ তদন্তে একটি তদন্ত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যা পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর পদস্থ কর্মকর্তাদের প্রভাবমুক্ত ও স্বাধীন থেকে কাজ করবে;

খ. দ্রুততার সঙ্গে ভুক্তভোগী ও সাক্ষীর সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করতে হবে;

গ. নিশ্চিত করতে হবে যে একটি তত্ত্বাবধায়ক কর্তৃপক্ষ নির্যাতনের অভিযোগ তদন্ত কার্যক্রমের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ এবং নির্যাতন প্রতিরোধ আইনে উল্লেখিত সময়সীমার মধ্যে তদন্ত ও বিচার কার্যক্রম শেষ করার বিষয়টি দৃঢ়ভাবে নিশ্চিত করবে;

ঘ. চিকিৎসা সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ জোরদার করতে হবে এবং নির্যাতনের অভিযোগে নির্দেশিত ডাক্তারি পরীক্ষা নির্যাতন ও অন্য নিষ্ঠুর, অমানবিক অথবা মানহানিকর আচরণ বা সাজার কার্যকর তদন্ত ও নথিবদ্ধকরণের নির্দেশিকা (ইস্তাম্বুল প্রটোকল) অনুসারে সম্পাদনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

অস্বীকৃত বা অঘোষিত আটক ও গুম  ——    

রাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ব্যক্তির স্বাধীনতা নির্বিচারে হরণ, পরে তাঁদের অনেককে হত্যার এবং তাঁদের অবস্থান বা ভাগ্যে কী ঘটেছে তা প্রকাশের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার যে অসংখ্য, সংগত খবর পাওয়া যায়, তা নিয়ে কমিটি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। ভুক্তভোগীকে হত্যা করা হোক বা তিনি পরবর্তী সময়ে ফিরে আসুন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে এ ধরনের আচরণকে গুম হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। কমিটি এখানে উল্লেখ করছে যে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল ‘বাংলাদেশে প্রায়ই গুমের ঘটনা ঘটে’ বলে যে অভিযোগ, তা প্রত্যাখ্যান করেছে এবং একটি ক্ষেত্রে তারা স্বীকার করেছে যে নারায়ণগঞ্জে কয়েকজনকে গুমের ঘটনায় কর্মকর্তাদের ফৌজদারি বিচারের আওতায় আনা হয়েছে, যে ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তাকে ‘অপহরণ’ ও ‘হত্যার’ অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। কমিটি আরও উল্লেখ করছে যে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল বলেছে, কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে উত্থাপিত গুমের অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন, কেননা পরে দেখা গেছে তাঁরা ফিরে এসেছেন। যেমনটা ঘটেছে হুম্মাম কাদের চৌধুরীর ক্ষেত্রে।

কমিটি উল্লেখ করছে যে হুম্মাম কাদের চৌধুরীসহ মীর আহমেদ বিন কাশেম ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আল আজমির বিষয়গুলো ২০১৭ সালে জোরপূর্বক ও অনিচ্ছাকৃত গুমবিষয়ক জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ সামনে নিয়ে আসে। তাঁদের বাবাদের বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাজা হওয়ার পর তাঁরা তাঁদের মুক্তির পক্ষে প্রচারণা চালান। এরপর অজ্ঞাত কর্তৃপক্ষ তাঁদের আটক করে। ওয়ার্কিং গ্রুপ সে সময় উদ্বেগ প্রকাশ করে আরও বলেছিল, বাংলাদেশে গুমের ঘটনা ক্রমাগত বাড়ছে। কমিটি দুঃখের সঙ্গে বলছে, এসব ব্যক্তিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ দীর্ঘসময় ধরে আটক রেখেও স্বীকার করেনি বলে যে অভিযোগ, তা তদন্ত করা হয়েছে কি না, সে ব্যাপারে রাষ্ট্র কোনো তথ্য দেয়নি। এমনকি হেফাজতে একরামুল হকের মৃত্যু ও পুলিশ হেফাজত থেকে শেখ মোখলেসুর রহমানের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাসহ অন্য ঘটনাগুলোয় চলমান তদন্তের বিষয়েও রাষ্ট্র কোনো তথ্য দেয়নি (আর্টিকেল ২, ৪, ১২, ১৩, ১১ ও ১৬)।

কমিটি রাষ্ট্রপক্ষকে সুপারিশ করছে  ——    

ক. সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সুস্পষ্টভাবে নিশ্চিত করতে হবে যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ অবশ্যই তাৎক্ষণিকভাবে অস্বীকৃত বা অঘোষিত আটকের অনুশীলন বন্ধ করবে;

খ. সব স্বীকৃত আটকের তালিকা প্রকাশ করতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে যে রাষ্ট্রের কোনো জায়গায় কাউকেই গোপনে বা নির্জন আটকাবস্থায় রাখা হবে না;

গ. কাউকে অস্বীকৃত আটকাবস্থায় রাখার ঘটনায়, এমনকি আটক করার পর ওই ব্যক্তিকে ছেড়ে দেওয়া হলেও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে যেকোনো কর্মকর্তাকে অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় বিচার ও সাজা নিশ্চিত করতে হবে;

ঘ. অস্বীকৃত আটক, গুম এবং হেফাজতে মৃত্যুর সব অভিযোগ দ্রুত ও বিস্তারিত তদন্তে এমন কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করতে হবে, যা আটকের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হবে;

ঙ. রাষ্ট্রের কোনো জায়গায় স্বাধীনতা খর্বিত হলো কি না, তা নজরদারি করতে পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই আটককেন্দ্র, সেসব জায়গার যেকোনো ব্যক্তির সঙ্গে একান্তে কথা বলার ক্ষমতাসম্পন্ন একটি স্বাধীন কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করতে হবে; এবং বেসরকারি সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা যেন সব আটককেন্দ্রে যাওয়ার অনুমতি পান, সেই বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে;

চ. অপশনাল প্রটোকল টু দ্য কনভেনশন অ্যাগেইনস্ট টর্চার অনুসমর্থনের বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে;

ছ. রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের দ্বারা বা তাঁদের সহযোগিতায় অস্বীকৃত আটকের মতো গুরুতর অপরাধের প্রকৃতি ‘অপহরণ’-এর মতো অপরাধগুলো না থাকায় ‘গুমকে’ সুস্পষ্ট অপরাধ হিসেবে ‘সকল ব্যক্তিকে গুম হওয়া থেকে রক্ষায় আন্তর্জাতিক সনদ’ অনুসারে আইনে নিষিদ্ধ করতে হবে, এবং এই সনদ অনুসমর্থনের বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।

র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন  ——    

পুলিশ বাহিনী ও সেনাবাহিনী থেকে বদলিকৃত সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) সদস্যদের বিরুদ্ধে হেফাজতে নির্যাতন, নির্বিচারে গ্রেপ্তার, অস্বীকৃত আটক, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের নির্ভরযোগ্য অভিযোগসংবলিত যে অসংখ্য খবর পাওয়া যায়, তা নিয়ে কমিটি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। ওপরে উল্লিখিত নারায়ণগঞ্জের ঘটনা ছাড়া এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে এই বাহিনীর সদস্যদের ফৌজদারি বিচারের মুখোমুখি না হওয়ার বিষয়েও কমিটি একইভাবে উদ্বিগ্ন। কমিটি উদ্বিগ্ন যে সশস্ত্র পুলিশ ব্যাটালিয়ন আইনের ১৩ ধারায় বাহিনীর সদস্যদের ‘সরল বিশ্বাসে করা বা করতে চাওয়ার’ যে ছাড় দেওয়া হয়েছে, তা এই বাহিনীর সদস্যদের নির্যাতন বা বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগে বিচারের আওতায় আনার ক্ষেত্রে দায়মুক্তি দিয়েছে। কমিটি দুঃখের সঙ্গে বলছে, সুইডিশ ন্যাশনাল রেডিওতে ২০১৭ সালে সম্প্রচারিত সাক্ষাৎকারে র‍্যাবের অজ্ঞাত এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা দাবি করেছিলেন যে এই বাহিনীর সদস্যরা নিয়মিত অপহরণ, নির্যাতন এবং উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে হত্যা ও কোনো প্রমাণ না রেখেই নিহত ব্যক্তির লাশ গায়েব কিংবা আত্মরক্ষার্থে হত্যার ঘটনাটি ঘটেছে বলে সমর্থন আদায়ে অস্ত্র রাখে, সেই দাবির বিষয়ে রাষ্ট্র কোনো স্বাধীন তদন্ত করেনি। কমিটি দুঃখের সঙ্গে আরও বলেছে, র‍্যাবের অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধান ইউনিট কীভাবে গঠিত, বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিশ্চিত হওয়ার পর কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সে ব্যাপারে কমিটিকে কোনো তথ্য সরবরাহ করা হয়নি। র‍্যাবে কাজ করা সদস্যদের প্রায়ই জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে পাঠানো হয় বলে যে খবর পাওয়া যায়, তা নিয়ে কমিটি উদ্বিগ্ন (আর্টিকেল ২, ৪, ১২, ১৩ ও ১৬)।

কমিটি রাষ্ট্রকে সুপারিশ করেছে  ——    

ক. র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) সদস্যদের বিরুদ্ধে নিয়মিত নির্যাতন, নির্বিচারে গ্রেপ্তার, অস্বীকৃত আটক, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ তদন্তে একটি স্বাধীন তদন্তের ব্যবস্থা করতে হবে এবং যাঁরা এই তদন্ত করবেন, তাঁদের হয়রানি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের হাত থেকে কার্যকরভাবে রক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে;

খ. সশস্ত্র পুলিশ ব্যাটালিয়ন (সংশোধিত) আইন, ২০০৩-এর ১৩ ধারা থেকে ‘সরল বিশ্বাস’ এর বিধান বাতিল করতে হবে;

গ. সেনাবাহিনী থেকে র‍্যাবে বদলির অনুশীলন বন্ধ করতে হবে, এই বাহিনীকে পুরোপুরি বেসামরিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার এবং অন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মতো র‍্যাবের সদস্যদেরও নির্যাতন, অসদাচরণ, গুম অথবা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে ফৌজদারি বিচারের ব্যবস্থা করার বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবে;

ঘ. জাতিসংঘের দিকনির্দেশনা অনুসারে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের জন্য সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর প্রস্তাবিত সব সদস্যের স্বাধীন যথাযথ পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে এবং নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম অথবা অন্য যেকোনো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে—এমন ব্যক্তি বা ইউনিটকে যাতে এই মিশনের জন্য বাছাই না করা হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

রিমান্ড ও মৌলিক আইনি সুরক্ষা  ——    

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ প্রায়ই আটক ব্যক্তিকে নির্যাতনের হাত থেকে মৌলিক আইনি সুরক্ষা দেয় না বলে যে খবর পাওয়া যায়, তাতে কমিটি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। কমিটি এই মৌলিক আইনি সুরক্ষাকে সনদের ২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত নির্যাতন প্রতিরোধের বাধ্যবাধকতাগুলো পূরণে জরুরি বলে চিহ্নিত করেছে। খবরে অভিযোগ করা হয় যে অনেক ক্ষেত্রেই আটক ব্যক্তির বিরুদ্ধে কী অভিযোগ রয়েছে, তা জানানো হয় না তাঁকে; দ্রুত যোগ্য ও স্বাধীন আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ দেওয়া হয় না কিংবা গ্রেপ্তারের পরপরই এবং জিজ্ঞাসাবাদ বা শুনানিসহ আটকাবস্থার কোনো পর্যায়েই আইনি সহযোগিতা দেওয়া হয় না; আটককেন্দ্রে নেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আটক ব্যক্তিকে বিনা মূল্যে ডাক্তারি পরীক্ষা করার সুযোগ দেওয়া হয় না, আটক ব্যক্তির পছন্দের চিকিৎসকের মাধ্যমে গোপনে পরীক্ষার অনুরোধ ও সুযোগ দেওয়া হয় না; গ্রেপ্তারের পরপরই গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে পরিবারের সদস্য কিংবা পছন্দ অনুযায়ী অন্য কাউকে জানানোর অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হয়।

আটক ব্যক্তিদের বিষয়ে সব ঘটনাবলি আটককেন্দ্রসহ কেন্দ্রীয়ভাবে নথিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কর্মকর্তারা ব্যর্থ হয়েছেন এবং আইন অনুসারে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে আটক ব্যক্তিকে বিচারকের সামনে হাজির করা হয় না বলে যেসব খবর পাওয়া যায়, সেগুলো নিয়েও কমিটি উদ্বিগ্ন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ প্রায়ই সন্দেহভাজন অপরাধীকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার, যা রিমান্ড বলে পরিচিত, আবেদন করে এবং আইনজীবীর সঙ্গে কোনো রকম যোগাযোগ করার সুযোগ না রেখে বিচারিক হাকিম ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৫৪ ও ১৬৭ ধারা অনুসারে নিয়মিত তা সর্বোচ্চ ১৫ দিন পর্যন্ত অনুমোদন দেন বলে যেসব খবর পাওয়া যায়, তা নিয়ে কমিটি বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন। খবর অনুসারে কমিটি উল্লেখ করেছে যে রাষ্ট্রে আটক হওয়া ব্যক্তিদের ৮০ শতাংশেরও বেশি রিমান্ড হেফাজতে। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ মামলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ ও বিচারিক হাকিমদের ১৫টি নির্দেশনার মাধ্যমে যে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, সেগুলোর অনুশীলন হচ্ছে না বলে যে খবর পাওয়া যায়, তা নিয়েও কমিটি উদ্বিগ্ন। উচ্চ আদালত যদিও তাঁর রুলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সরকারকে ফৌজদারি দণ্ডবিধি-১৮৯৮, দণ্ডবিধি-১৮৬০ ও এভিডেন্স অ্যাক্ট-১৮৭২-এর সংশ্লিষ্ট ধারাগুলো সংশোধনের আহ্বান জানিয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত এসব পরিবর্তন করা হয়নি (আর্টিকেল ২, ৪, ১১, ১২, ১৩, ১৫ ও ১৬)।

রাষ্ট্রের উচিত  ——    

ক. ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ মামলায় উচ্চ আদালতের রুল প্রতিফলিত করতে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৫৪ ও ১৬৭ ধারা এবং এভিডেন্স অ্যাক্ট সংশোধন করা এবং তা আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের বাধ্যবাধকতাগুলো মেনে যেন হয়, তা নিশ্চিত করা;

খ. ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ মামলায় হাইকোর্টের দেওয়া নির্দেশনা, যা আপিল বিভাগ সমর্থন করেছেন, তা যেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ ও বিচারিক হাকিমেরা দ্রুত ও পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করেন, তা প্রশিক্ষণ ও বৃহত্তর নজরদারির মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে;

গ. ওপরে উল্লিখিত আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি ও প্রাক্-বিচার বা রিমান্ডে থাকা ব্যক্তিরাসহ আটক সব ব্যক্তিকে আইনি সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিচারকের সামনে হাজির করার বিষয়টি রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করা উচিত; গ্রেপ্তারের পরপরই ও পরবর্তী সময়ে আইনি পরামর্শকের সঙ্গে যোগাযোগের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে; এবং ব্যক্তির গ্রেপ্তার ও আটক হওয়ার সময় ও স্থান দ্রুত পরিবারের সদস্যদের জানানোর বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে;

ঘ. আটক ব্যক্তির আইনি সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে কি না, তার নিয়মিত পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে এবং কোনো কর্মকর্তা যদি এই সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হন, তাঁর বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গ বা অন্য যথোপযুক্ত সাজা নিশ্চিত করতে হবে;

ঙ. প্রাক্-বিচার আটকের ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে আইন অনুযায়ী যেন হয় এবং মৌলিক আইন ও প্রক্রিয়াগত সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সার্বক্ষণিক বিচারিক পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে;

চ. প্রাক্-বিচার আটকের বৈধতা নিয়মিত পর্যালোচনা করতে হবে এবং অপরাধের সাজার তুলনায় প্রাক্‌-বিচার আটকাবস্থার সময়সীমা বেশি হলে মুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে;

ছ. প্রাক্-বিচার আটকের ঘটনা কমাতে পদক্ষেপ নিতে হবে এবং ইউনাইটেড নেশনস স্ট্যান্ডার্ড মিনিমাম রুলস ফর নন-কাস্টোডিয়াল মেজার্স (টোকিও রুলস) অনুসারে আটক না রেখে বিচারিক প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার হার বাড়াতে হবে।

ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক, জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং অন্যান্য দুর্বল গোষ্ঠী  ——    

সরকারি কর্মকর্তাদের দ্বারা বা তাঁদের সহযোগিতায় ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক, অন্য জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর লোকজন যৌন সহিংসতাসহ ভয়ভীতি, হয়রানি ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় বলে যে খবর পাওয়া যায়, তা নিয়ে কমিটি উদ্বিগ্ন। এর মধ্যে ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে তিন সাঁওতাল নিহত ও ৫০ জন আহত হওয়ার ঘটনাও রয়েছে, যে ঘটনায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন ২০১৯ সালের ২৮ জুলাই জমা দেওয়া প্রতিবেদনে বলেছে, সাঁওতালদের বাড়িঘর ও বিদ্যালয়ে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনায় কোনো পুলিশ সদস্য জড়িত ছিলেন না। যদিও টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ঘটনার ভিডিওতে এর বিপরীত দৃশ্যই দেখা গেছে। পিরোজপুরে সম্প্রতি হিন্দুধর্মাবলম্বীদের কয়েকজন সদস্যের বাড়িঘরে আগুন দেওয়াসহ সহিংসতা ও হয়রানির এবং হিন্দু অধিকারকর্মী ও আইনজীবী পলাশ কুমার রায়ের ঘটনা কমিটি উল্লেখ করেছে। প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তি করার অভিযোগে পলাশ কুমার রায়কে আটক করা হয় এবং পরে অভিযোগ পাওয়া যায় যে পুলিশি হেফাজতে থাকা অবস্থায় তাঁর ওপর হামলা হয় এবং গায়ে আগুন দিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল ইঙ্গিত করেছে যে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে কয়েকজন সেনাসদস্যের দুই কিশোরীকে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের অভিযোগ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামভিত্তিক ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর অধিকারকর্মী মাইকেল চাকমার গুম হওয়ার ঘটনাগুলোও উল্লেখ করেছে কমিটি। প্রতিনিধিদল বলেছে, মাইকেল চাকমার ঘটনাটি তদন্তাধীন রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ অন্যদের মাধ্যমে সমকামীদের সহিংসতার খবরেও কমিটি উদ্বিগ্ন। সমলিঙ্গ যৌন সম্পর্ককে ‘অপ্রাকৃতিক আচরণ’ হিসেবে অভিহিত করে রাষ্ট্র অপরাধ বলে গণ্য করার কারণেই এসব ঘটানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে (আর্টিকেল ২, ১২, ১৩, ১৪ ও ১৬)।

রাষ্ট্রের উচিত  ——    

ক. ওপরে উল্লিখিত বিস্তারিতসহ ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, অন্য জাতিগোষ্ঠী, ধর্ম ও অন্যান্য দুর্বল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ও সহিংসতার ঘটনার স্বাধীন তদন্ত নিশ্চিত করা;

খ. ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’-এর বিষয়টিকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার আইন, যেমন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ রদ করার বিষয় বিবেচনা করা। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে হয়রানি করতে এ ধরনের আইনের প্রায়ই অপব্যবহার এবং এসব গোষ্ঠীর সদস্যদের ওপর সহিংসতা আইনিভাবে বৈধ বলে ধরে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ পাওয়া যায়;

গ. ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, অন্য জাতিগোষ্ঠী, ধর্ম ও অন্যান্য অরক্ষিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ব্যক্তিদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; তাদের অভিযোগ দেওয়ার স্বাধীন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা;

ঘ. সাঁওতাল সম্প্রদায় এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু ও দুর্বল গোষ্ঠীর যারা শারীরিক সহিংসতা, ক্ষয়ক্ষতি ও লুটপাটের শিকার, তাদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনসহ প্রতিকারের ব্যবস্থা করা; এবং ‘অর্পিত’ সম্পত্তি প্রকৃত মালিককে ফিরিয়ে দেওয়া নিশ্চিত করতে ‘অর্পিত সম্পত্তির প্রত্যর্পণ আইন, ২০০১ (আইন নম্বর ১৬)’ বাস্তবায়ন করা;

ঙ. ‘অপ্রাকৃতিক আচরণকে’ অপরাধ গণ্য করা বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা রদ করতে হবে। রাষ্ট্র সমলিঙ্গ যৌন সম্পর্ককে এই ধারা অনুসারে নিষিদ্ধ বলে বিবেচনা করে থাকে;

চ. সমকামী সম্প্রদায়সহ ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, অন্য জাতিগোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও অন্যান্য দুর্বল সম্প্রদায়ের সদস্যদের ওপর সহিংসতার সংখ্যাতাত্ত্বিক তথ্য সংগ্রহ ও প্রকাশ করতে হবে;

ছ. দুর্বল গোষ্ঠীগুলোর সদস্যদের ওপর সব ধরনের সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িত পুলিশের সদস্যসহ অন্য সাধারণ মানুষের বিচার ও সাজার ব্যবস্থা করতে হবে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন  ——    

সিইএসসিআর ২০১৮ সালের পর্যবেক্ষণের উপসংহারে পৌঁছেছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সম্ভবত যথেষ্ট বৃহত্তর এখতিয়ার (ম্যান্ডেট) না থাকার কিংবা সরকারি ব্যক্তি যেমন পুলিশ, সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে ওঠা নির্যাতন ও অসদাচরণের অভিযোগ সরাসরি তদন্তে এই কমিশনের বর্তমান এখতিয়ার (ম্যান্ডেট) পুরোপুরি কাজে লাগায়নি বলে কমিটি উদ্বিগ্ন। কমিশনের সদস্যদের বাছাই ও নিয়োগ–প্রক্রিয়া এবং ‘প্রিন্সিপালস রিলেটিং টু দ্য স্ট্যাটাস অব ন্যাশনাল ইনস্টিটিউশন ফর দ্য প্রমোশন অ্যান্ড প্রোটেকশন অব হিউম্যান রাইটস’ (প্যারিস প্রিন্সিপালস) অনুসারে দায়িত্ব পালনে কমিশনের যথেষ্ট জনবল ও আর্থিক সংগতি না থাকার বিষয়ে কমিটি উদ্বিগ্ন (আর্টিকেল ২, ১২, ১৩ ও ১৬)।

রাষ্ট্রের উচিত  ——    

ক. সেনাবাহিনী, পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে নির্যাতন ও অসদাচরণের অভিযোগ সরাসরি তদন্তে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সক্ষমতা ও এখতিয়ার (ম্যান্ডেট) সম্প্রসারণে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯ সংশোধন করা; এবং এর বৃহত্তর পরিসরে অবারিত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে;

খ. জাতীয় প্রতিরোধক ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে কমিশন যেন তার পুরো ক্ষমতার অনুশীলন করতে পারে এবং যেখানেই কেউ আটক হবে, সেখানেই যেন পৌঁছাতে পারে, তা নিশ্চিত করা;

গ. কমিশনকে পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক ও মানবসম্পদসংশ্লিষ্ট সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার অনুমোদন দিতে হবে, যাতে কমিশন তার ম্যান্ডেট নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে সম্পাদন করতে পারে;

ঘ. প্যারিস নীতিমালার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ একটি পরিচ্ছন্ন, স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও মেধাভিত্তিক নির্বাচন ও নিয়োগদান প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করতে হবে;

ঙ. নির্যাতন ও অমানবিক আচরণের তদন্ত কীভাবে করতে হয়, সেই বিষয়ে কমিশনের কর্মকর্তারা যেন সঠিক প্রশিক্ষণ পান, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। 

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা  ——    

বিচারকেরা তাঁদের কাজসংশ্লিষ্ট বিষয়ে হুমকি ও চাপের মুখোমুখি হন—এ বিষয়ে কমিটি উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে, প্রতিনিধিদলের দেওয়া ব্যাখ্যা বিবেচনায় নিয়েও সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার করা অভিযোগের বিষয়ে কমিটি উদ্বিগ্ন। অভিযোগ আছে, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীবিষয়ক মামলায় উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা তাঁর ওপর চাপ প্রয়োগ করেছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে তিনি হয়রানির শিকার হন, ফলে তাঁকে পদত্যাগে এবং দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়; এই বিষয়ে প্রতিনিধিদলের প্রধানের দেওয়া বিবৃতি, যাতে বলা হয়েছে, সিনহার পদত্যাগের সঙ্গে কমিটি ষোড়শ সংশোধনীবিষয়ক মামলার কোনো সম্পর্ক নেই, বরং দুর্নীতির অভিযোগের সম্পর্ক রয়েছে—সেটিও আমলে নেওয়া হয়েছে। সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে হস্তান্তরের বিষয়ে সরকারের ধারাবাহিক প্রচেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে, কমিটি এখনো বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। তা ছাড়া, বিচার বিভাগের সদস্যদের ওপর থাকা দৈনন্দিন যে চাপ, যার কারণে বিচারিক কর্মকর্তাদের ওয়ারেন্টবিহীন গ্রেপ্তারের ঘটনা গ্রহণ করতে হচ্ছে, কোনো তত্ত্বাবধান ছাড়াই হেফাজতে থাকার মেয়াদ বাড়াতে হচ্ছে, এবং অন্যান্য কর্মকাণ্ড, যেগুলো একজন ব্যক্তিকে নির্যাতন ও অমানবিক আচরণের মতো নিপীড়ন থেকে রক্ষা করতে মৌলিক আইনি নিরাপত্তা দেয়, সেগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে (আর্টিকেল ২)

রাষ্ট্রপক্ষকে অবশ্যই  ——    

ক. আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রভাব থেকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে শক্তিশালী করতে হবে;

খ. উচ্চপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাসহ অন্যান্য পক্ষ থেকে আসা হুমকি, হয়রানি এবং অনুচিত হস্তক্ষেপ থেকে বিচারিক কর্মকর্তাদের রক্ষা করতে হবে; 

গ. সব বিচারক ও আইনজীবী যাতে পর্যাপ্ত সম্মানী পান এবং অবসর বা কার্যালয়ের মেয়াদ শেষ না হওয়ার আগ পর্যন্ত মেয়াদ পূরণের নিশ্চয়তা পান, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। 

মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা, হয়রানি ও সহিংসতা  ——    

কিছু প্রতিবেদন পেয়ে কমিটি উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশে সুশীল সমাজের যেসব কর্মী, আইনজীবী এবং সাংবাদিকেরা কর্তৃপক্ষ বা সরকারের আচরণের সমালোচনা করেন এবং নির্যাতন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও এ সম্পর্কিত অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়গুলো প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন, তাঁদের হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হতে হয়। একই সঙ্গে এসব সমালোচনা করার জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে শাসকদলীয় কর্তৃপক্ষ প্রতিশোধমূলক মামলা করে থাকে এবং অন্যায্য বিচারকাজের সমালোচনা করায় তাঁদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয়। কমিটি উদ্বিগ্ন যে, সুশীল সমাজের কিছু কর্মী, আইনজীবী এবং সাংবাদিকদের নির্যাতন ও অমানবিক আচরণের শিকার হতে হয়েছে, যখন কাজ সম্পর্কিত কারণে আনা অভিযোগে তাঁদের আটক করা হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের জারি করা কিছু আইন বিষয়ে কমিটি উদ্বিগ্ন, এর মধ্যে রয়েছে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন, ২০০৬ এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন, ২০১৮—যেগুলো এ ধরনের হয়রানি করতে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশেষ করে, দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মামলা নিয়ে কমিটি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, যাকে তাঁর কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত রাষ্ট্রদ্রোহ, মানহানি, আদালত অবমাননা এবং এ সম্পর্কিত বিভিন্ন অভিযোগে কয়েক বছর ধরে রিমান্ডে আটক রাখা হয়েছিল এবং হতাশার বিষয় হলো, তাঁকে এসব অভিযোগে আটক রেখে নির্যাতন চালানোর অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত হয়েছে কি না, তা প্রতিনিধিদল উল্লেখ করেনি। কনভেনশন অনুযায়ী এমন তদন্ত করা প্রয়োজন।


মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা, হয়রানি ও সহিংসতা  ——    

গঠনমূলক সংলাপের সময় প্রতিনিধিদলের প্রধান এবং আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী যে বিবৃতি দিয়েছেন, তা কমিটি প্রশংসার সঙ্গে স্বীকার করে নিচ্ছে। এতে সরকার ‘সহানুভূতির সঙ্গে স্পষ্ট’ করেছে যে সরকারের পক্ষ থেকে সুশীল সমাজের সদস্য ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে প্রতিহিংসার হাত থেকে রক্ষা করা হবে। রাষ্ট্রপক্ষের প্রাথমিক প্রতিবেদনের বিষয়ে কমিটির যে ভাবনা, তাতে সহযোগিতা দিয়ে থাকে সুশীল সমাজের সদস্য ও বেসরকারি সংস্থাগুলো (আর্টিকেল ২, ৪, ১১, ১২, ১৩, ১৫ ও ১৬)।


রাষ্ট্রপক্ষকে অবশ্যই  ——    

ক. সর্বোচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ রাখতে হবে, যাতে সুশীল সমাজের কর্মীরা, আইনজীবী এবং সাংবাদিকেরা—যারা তথ্য বা মানবাধিকার লঙ্ঘনসংক্রান্ত অভিযোগ প্রকাশ করে সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে এবং সরকারের নেতারা বা তাদের নৈপুণ্যের সমালোচনা করার কারণে তারা যেন আদালত অবমাননা, মানহানি বা রাষ্ট্রদ্রোহের মতো প্রতিশোধমূলক অভিযোগের লক্ষ্য না হোন;

খ. বেআইনি বা বিতর্কিত গ্রেপ্তার, হয়রানি, নির্যাতন বা অমানবিক আচরণের বা সুশীল সমাজের সদস্য, আইনজীবী ও সাংবাদিকসহ মানবাধিকার রক্ষায় নিয়োজিত কর্মীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা চালানোর সব অভিযোগের তদন্ত করতে হবে;

গ. তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন, ২০০৬, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন, ২০১৮ এবং বিদেশি অনুদান (স্বেচ্ছাশ্রম) প্রবিধান আইন, ২০১৬-সহ কিছু আইনের সংশোধন করতে হবে—সংবিধান ও সাংবিধানিক সংস্থার বিষয়ে মানহানিকর মন্তব্যের বিষয়ে, ‘রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড’ ও ‘জাতির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা’ বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করা বিধান এগুলোতে আছে এবং এগুলো দূর করতে হবে। এ ছাড়া একই ধরনের বিধানগুলো, যেগুলো নির্যাতন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা অমানবিক আচরণের অভিযোগগুলো প্রচার করা বা সেসব অভিযোগের প্রত্যুত্তরে রাষ্ট্রপক্ষের ভূমিকার সমালোচনা করা ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও বিচারের মুখোমুখি করার ভিত্তি দেয়, সেগুলো দূর করতে হবে।

ঘ. সুশীল সমাজের সদস্যরা এবং বেসরকারি সংস্থাগুলো—যারা রাষ্ট্রপক্ষের প্রাথমিক প্রতিবেদনের বিষয়ে কমিটির বিবেচনার ক্ষেত্রে সহযোগিতা দিয়ে থাকে, তাদের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের বিধি ভাঙার অভিযোগসহ যেকোনো ধরনের প্রতিহিংসা বা হয়রানি থেকে রক্ষা করতে হবে এবং আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রীর দেওয়া এ–সংক্রান্ত অঙ্গীকার পালন করতে হবে।


আটকের শর্তাবলিকমিটি কিছু বিষয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন  ——    

ক. রাষ্ট্রপক্ষের কারাগারগুলোর পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় অনেক নিচু মানের এবং সেখানে কিছু চরম ক্ষেত্রে অনেক সময় নির্যাতন ও অমানবিক আচরণ করা হয়—এমন প্রতিবেদন পেয়ে;

খ. কারাগারগুলোতে বন্দীদের সংখ্যা অত্যন্ত বেশি, এমনকি ধারণক্ষমতার চেয়ে ২০০ শতাংশের বেশি এবং নির্বাচনের সময় ৪০ হাজার বন্দী ধারণক্ষমতার কারাগারগুলোতে এর চেয়েও বেশি বন্দী রাখা হয়—রিমান্ডের জন্য আটক রাখার বিধানের বহুল ব্যবহারের কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে বন্দীদের পালা করে ঘুমাতে বাধ্য করা হয়, এমনকি কারাগার কর্তৃপক্ষকে কারাগারের সীমানার ভেতরেই অস্থায়ী ছাউনি তৈরির কথা বিবেচনায় নিতে হয় এবং এমন পরিস্থিতির কারণেই ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে প্রায় ১০০ বন্দীকে একটি পরিত্যক্ত গুদামে রাখতে হয়েছিল;

গ. কারাগার ও হাজতখানার খুবই বাজে পরিস্থিতির কারণে ২০১৮ সালে ৭৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। একই সঙ্গে অপর্যাপ্ত পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা, খাদ্য ও সুপেয় পানির অভাব, অপর্যাপ্ত শৌচাগার ও স্নানাগারের সুবিধা এবং বিছানা, অপর্যাপ্ত আলো ও বাতাস চলাচলের ব্যবস্থার কথা জানা গেছে; এ ছাড়া চিত্তবিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ও মানসিক উত্তেজনা প্রশমনের সুযোগেরও অভাব রয়েছে;

ঘ. কারাগারগুলোতে বিদ্যমান দুর্নীতির বিষয়ে, এগুলোর মধ্যে আছে—সেখানে প্রাথমিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য রক্ষীদের চাঁদাবাজির শিকার হতে হয় বন্দী ও তাদের স্বজনদের; ‘মেট’ ব্যবস্থা থাকার কারণে জ্যেষ্ঠ বন্দীরা অন্যদের নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, এমনকি অন্য বন্দীদের খাবার পাওয়া ও কারাবাসের শর্তাবলিতেও তারা হস্তক্ষেপ করে থাকে; এবং তারা প্রায়ই কারা কর্তৃপক্ষের পক্ষ হয়ে সাজার সীমা কমিয়ে দেয়; এবং তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরকারী বন্দীদের প্রতিশোধমূলক কার্যকলাপের শিকার হতে হয়;

ঙ. রাষ্ট্রপক্ষের থাকা ৬৮টি কারাগারের মধ্যে মাত্র ১২টিতে হাসপাতাল আছে এবং সেগুলোতে থাকা চিকিৎসকদের ১৭০টি পদের মধ্যে মাত্র এক ডজনে পদায়ন আছে, জানা গেছে বাজে পয়োনিষ্কাশন ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে চিকিৎসকেরা কারাগারে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নিজেদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে ভীত থাকেন;

চ. হেফাজতে থাকাকালে মৃত্যুর উচ্চ সংখ্যার বিষয়ে, যথাযথ কর্তৃপক্ষ যেগুলোকে স্বাভাবিক মৃত্যু বা আত্মহত্যা বলে অভিহিত করে থাকে। কিন্তু এসব ঘটনার মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে পুলিশের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ এবং নির্যাতনের কারণে সৃষ্ট আঘাত থেকে মৃত্যু হয়েছে, একই সঙ্গে খারাপ পরিস্থিতি, কারাগার কর্তৃপক্ষের অবহেলা এবং চিকিৎসার সুযোগ পাওয়ার অভাবও এসবের জন্য দায়ী; ২০১৯ সালে জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যে ১১ জন কারাগারে অসুস্থতার কারণে মারা গেছেন; এবং প্রায় সব বন্দীই সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের সংস্পর্শে এসেছে এবং তা থেকে অসুস্থতা সৃষ্টি হয়;

ছ. অপ্রাপ্তবয়স্ক বন্দীদের প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে রাখা হয়; নারী বন্দীদের হয়তো পুরুষ বন্দীদের সঙ্গে রাখা হয়; এবং ওই কারাগারগুলোতে প্রতিবন্ধী বন্দীদের রাখার মতো ব্যবস্থা নেই (আর্টিকেল ২, ১১, ১২, ১৩ ও ১৬)।


রাষ্ট্রপক্ষকে অবশ্যই  ——    

ক. প্রয়োজনীয় স্বাধীনতার ঘাটতি আছে, এমন আটক করার শর্তাবলিগুলো উন্নত করার জন্য সব ধরনের জরুরি পদক্ষেপ জরুরি ভিত্তিতে গ্রহণ করতে হবে, যাতে সেগুলোকে আন্তর্জাতিক মানের সমান্তরালে নিয়ে আসা যায়, এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে বন্দীদের চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্রে জাতিসংঘ প্রণীত মানসম্মত ন্যূনতম নিয়মাবলি (ম্যান্ডেলা রুলস) এবং নারী বন্দীদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের নিয়মাবলি এবং নারী অপরাধীদের ক্ষেত্রে হেফাজতে না রাখার ব্যবস্থা (ব্যাংকক রুলস);

খ. কারাগারগুলোতে থাকা অতিরিক্ত ভিড় কমিয়ে আনতে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে, এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে, যাতে বিচারকাজ শুরুর আগে কোনো ব্যক্তিকে অযৌক্তিক সময়কালের জন্য হেফাজতে রাখা না হয় এবং রিমান্ড বা বিচারকাজ শুরুর আগে আটক রাখার নানা ধরনের প্রক্রিয়ায় আটক থাকা ব্যক্তির সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনা হয়; জামিনের পূর্বশর্তগুলো শিথিল করা এবং প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার প্রক্রিয়ার গতি বাড়াতে হবে; আটক না করে নেওয়া পদক্ষেপসমূহের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের মানসম্মত ন্যূনতম নিয়মাবলির সঙ্গে সংগতি রেখে আটকের বিকল্পসমূহের প্রচার করা এবং বিচারের গতি ত্বরান্বিত করা (টোকিও রুলস);

গ. প্রয়োজনীয় স্বাধীনতার ঘাটতি আছে, এমন অবস্থার উন্নয়নে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে পর্যাপ্ত মান ও পরিমাণের খাদ্য পাওয়া, পয়োনিষ্কাশন ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিস্থিতি, বিছানা, আলো ও বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা, এ ছাড়া বিনোদনমূলক ও অন্যান্য অর্থমূলক কর্মকাণ্ড; আরও অন্তর্ভুক্ত থাকবে নতুন কারাগার নির্মাণ ও পুরোনো কারাগারগুলোর সংস্কার;

ঘ. কারাগারগুলোয় দুর্নীতি দূর করতে হবে, এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে বন্দী ও তাদের স্বজনদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি; কারাগার ব্যবস্থায় হেফাজতের দায়িত্বে থাকা কর্মীদের সঙ্গে অপরাধী গ্যাংগুলোর গোপন চুক্তির বিষয়গুলো চিহ্নিত করতে পদক্ষেপ নেওয়া; মানবিকতা ও মর্যাদাপূর্ণ আচরণ পাওয়ার ক্ষেত্রে বন্দীদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে; বন্দীদের মধ্যকার সহিংসতাসহ সব ধরনের সহিংসতা কমিয়ে আনতে হবে;

ঙ. আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ভুলভ্রান্তি বা কমিশনের কারণে, নির্যাতন বা অন্য যেকোনো ধরনের অমানবিক আচরণের কারণে সংঘটিত হেফাজতে মৃত্যুর বিষয়ে ‘শূন্য সহনশীলতা’ নীতি বজায় রাখতে হবে, যা কমিটির সঙ্গে গঠনমূলক সংলাপের সময় আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী তাঁর বিবৃতিতে উল্লেখ করেছেন এবং হেফাজতে মৃত্যুর বিষয়ে তাৎক্ষণিক ও স্বাধীন তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে, সেগুলোর কারণ যা-ই হোক না কেন;

চ. গুরুত্ব বিবেচনায় পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে, অতিরিক্ত চিকিৎসক মজুরি ভিত্তিতে নিয়ে শূন্য পদ পূরণ করতে হবে, একই সঙ্গে সময়ে সময়ে যাতে বিশেষজ্ঞদের এবং সেবিকাদের পাওয়া যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে; বিশেষায়িত সেবার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে পাঠানো এবং অ্যাম্বুলেন্সে করে কারাগারের বাইরে নিয়ে যাওয়ার বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবে; কারাগারে ঢোকানোর আগে বন্দীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা চালু করা এবং পুরো বন্দী জনসংখ্যার স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে; এবং কারাগারে আসার সময় যেসব বন্দী সুস্থ অবস্থায় পৌঁছাবে, তাদের সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করতে শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে হবে;

ছ. বয়স্ক বন্দীদের থেকে অপ্রাপ্তবয়স্কদের আলাদা রাখার ব্যবস্থা চালু করতে হবে; দোষী সাব্যস্ত বন্দীদের থেকে রিমান্ডে থাকা আটক ব্যক্তিদের আলাদা রাখতে হবে; পুরুষ বন্দীদের কাছ থেকে নারী বন্দীদের আলাদা রাখার নিয়ম কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে এবং নারীদের জন্য লিঙ্গ-সংবেদনশীল পরিস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে; যেসব বন্দী প্রতিবন্ধী তাদের মানবিক পরিস্থিতি রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে এবং কারাগারগুলো যাতে তাদের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে;


জ. আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো, বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা সংস্থা এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোসহ স্বাধীন পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোকে কারাগারের বিভিন্ন স্থানে অঘোষিত অভিযান এবং চিকিৎসাবিষয়ক পরিদর্শন চালানোর অনুমতি দিতে হবে এবং আটক ব্যক্তিদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করার অনুমোদন দিতে হবে।


ক্ষমতার অতিরিক্ত ব্যবহার  ——    

নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এবং পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের ক্ষমতার অতিরিক্ত ব্যবহারের ঘটনার নিয়মিত অভিযোগসমূহের বিষয়ে কমিটি খুবই উদ্বিগ্ন, এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে কাছে থেকে হাঁটু, পা বা কনুইয়ে গুলি করার অনুশীলন চালানো, যা ‘নিক্যাপিং’ নামে পরিচিত, যেগুলো প্রায়ই অঙ্গহানিসহ স্থায়ী প্রতিবন্ধিতা সৃষ্টি করে থাকে। সাম্প্রতিক ও অতীতের নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্কিত ঘটনায় কর্তৃপক্ষের ঘটানো নানা সহিংসতার বিষয়ে পাওয়া প্রতিবেদনের ব্যাপারেও কমিটি উদ্বিগ্ন, এর মধ্যে আছে বিক্ষোভকারীদের ওপর চালানো হামলা, পোলিং স্টেশন জব্দ করা এবং হুমকি দিয়ে ও সহিংসতার মাধ্যমে ভোট দমিয়ে রাখা (আর্টিকেল ২, ১০, ১২, ১৩ ও ১৬)।


রাষ্ট্রপক্ষকে অবশ্যই  ——    

ক. অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের শিকার হয়েছে এমন ভুক্তভোগীদের অভিযোগ গ্রহণের জন্য একটি কার্যকর ব্যবস্থা স্থাপন করা, যেখানে এই নিশ্চয়তা দেওয়া হবে যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা সরকারি কর্মকর্তাদের দ্বারা নির্যাতন বা কোনো ধরনের অন্যায় আচরণের অভিযোগ তুললে কেউ ফের নির্যাতিত হবে না এবং অতি অবশ্যই সব অভিযোগের বিষয়ে ত্বরিত, নিরপেক্ষ ও কার্যকর তদন্ত করা হবে।

খ. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের জন্য বলপ্রয়োগ ও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার এবং যেকোনো ধরনের আটক বা বন্দী ব্যক্তির সুরক্ষাসম্পর্কিত মূলনীতিগুলোর ওপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।


বিতর্কিত আটক  ——    

২০১৮ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) প্রায় ৫ হাজার সমর্থককে আটকের তথ্যের ব্যাপারে কমিটি উদ্বেগ প্রকাশ করছে, যেখানে দুর্নীতি মামলায় বিএনপি নেতা খালেদা জিয়ার দণ্ডাদেশের পর সহানুভূতি প্রদর্শন করা অনেক সাধারণ মানুষও ছিল। একই সঙ্গে নির্বাচনের আগে-পরে বিরোধী দলের কয়েক হাজার সমর্থককে গ্রেপ্তার এবং তাদের অনেককেই এখনো আটক রাখার অভিযোগ সম্পর্কেও উদ্বেগ প্রকাশ করছে কমিটি। একই সঙ্গে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে সংযোগ রয়েছে, এমন সন্দেহে বিভিন্ন ব্যক্তির স্বাধীনতায় অযৌক্তিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ নিয়েও উদ্বিগ্ন কমিটি। (আর্টিকেল ২, ১১, ১২, ১৩ ও ১৬)

রাষ্ট্রপক্ষকে অবশ্যই রাজনৈতিক কর্মী, আন্দোলনকারী, গ্রেপ্তার ব্যক্তি, সহিংসতা রোধে গণজমায়েত থেকে আটকসহ সব আটক ব্যক্তিকে সত্যিকার অর্থেই আটককালীন সব মৌলিক নিরাপত্তা (১৯ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত) দিতে হবে এবং দ্রুততম সময়ে তাকে বিচারকের সামনে হাজির করার বিষয়টিও রাষ্ট্রপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে। ওপরে বর্ণিত প্রতিরোধমূলক কার্যকলাপের সময় আটক ব্যক্তিদের নির্যাতনের সব অভিযোগ দ্রুত ও কার্যকর তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তদন্তকারীদের সুপারিশক্রমে হয় বিচারের আওতায় আনা বা আটক ব্যক্তিদের মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে।


নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা  ——    

নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা মোকাবিলায় রাষ্ট্রপক্ষ উল্লিখিত প্রতিশ্রুতিকে স্বাগত জানাচ্ছে কমিটি। কিন্তু একই সঙ্গে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ধর্ষণের অভিযোগে করা মামলার খুবই অল্পসংখ্যকের বিচার ও সাজা হওয়া এবং একই সময়ে কর্তৃপক্ষের কাছে আসা শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের ক্রমবর্ধমান অভিযোগের বিষয়ে কমিটি উদ্বেগ প্রকাশ করছে। কমিটি আরও উদ্বিগ্ন এই তথ্য জেনে যে আইনি বাধার কারণে যৌন সহিংসতার শিকার নারীরা নিজেদের সঙ্গে হওয়া আচরণকে ধর্ষণ দাবি করতে পারছেন না। আরও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, (বাল্যবিবাহ–সংক্রান্ত) আইনে আনা সাম্প্রতিক সংযোজনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ‘বিশেষ অবস্থা’র দোহাই দেখিয়ে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের অনুমোদন দিচ্ছে, যা দেশে বিদ্যমান বাল্যবিবাহের উচ্চ হারকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। একই সঙ্গে কমিটি উদ্বিগ্ন এই কারণে যে রাষ্ট্রীয় আইন মায়ের প্রাণসংশয় ছাড়া গর্ভপাতকে অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করছে, যা নারীর শারীরিক ও মানসিক পীড়ন ও হতাশার কারণ হয়ে উঠতে পারে। (আর্টিকেল ২, ৪, ১২, ১৩, ১৪ ও ১৬)


রাষ্ট্রপক্ষের করণীয় সম্পর্কে কমিটির সুপারিশ  ——    

ক. নারী ও মেয়েশিশুদের বিরুদ্ধে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার সব ধরনের অভিযোগ, বিশেষ করে রাষ্ট্র কিংবা (জাতিসংঘ) সনদ মোতাবেক আন্তর্জাতিক পরিসরে রাষ্ট্রের দায় রয়েছে এমন অন্য কোনো সংস্থার কর্মকাণ্ড বা নিষ্ক্রিয়তার সঙ্গে জড়িত অভিযোগগুলোর পূর্ণাঙ্গ ও কার্যকর তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে, যাতে অভিযুক্ত অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনা যায় এবং দোষী সাব্যস্ত হলে তার যথাযথ শাস্তি বিধানের পাশাপাশি ভুক্তভোগী পর্যাপ্ত আর্থিক ক্ষতিপূরণসহ ন্যায়ানুগ প্রতিকার পায়।

খ. নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আইন ২০০০ (২০০৩ সালে সংশোধিত)-এ বিদ্যমান ধর্ষণের অভিযোগ দাখিল ও এ–সংক্রান্ত স্বাস্থ্য প্রতিবেদন তৈরিতে ২৪ ঘণ্টার সময়সীমা–সম্পর্কিত বিধি অপসারণ করতে হবে।

গ. ‘বিশেষ ক্ষেত্রে’ ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের আইনি নিষেধাজ্ঞা শিথিলের বিধান বাদ দেওয়া এবং ১৩ বছরের বেশি বয়সী নারীদের ক্ষেত্রে বৈবাহিক ধর্ষণ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার বিধান রহিত করা, যা দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় বর্ণিত আছে।

ঘ. ঘরোয়া সহিংসতা এবং জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সেবা নিশ্চিত করা। এর মধ্যে রয়েছে চিকিৎসা ও আইনি সহায়তা, দেশজুড়ে যেসব নিরাপদ জরুরি আবাসন ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা আছে, সেখানে এ ধরনের ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এমনকি যাঁরা দেশের নাগরিক নন, তাঁদেরও সেখানে আশ্রয় নেওয়ার অধিকার থাকতে হবে।

ঙ. গর্ভধারণ অব্যাহত রাখলে তীব্র যন্ত্রণা ও কষ্টের শিকার হতে হবে, এমন সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রগুলোতে গর্ভপাতের অনুমতিদানের জন্য আইনি ব্যতিক্রমের সুযোগ করে দিতে সংশ্লিষ্ট বিধিবিধানগুলো পর্যালোচনা করা। যেমন, ধর্ষণের কারণে বা নিকটাত্মীয়র সঙ্গে যৌন সঙ্গমের কারণে গর্ভধারণ ঘটলে বা মারাত্মক ভ্রূণবৈকল্যের ঘটনা থাকলে। এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নারীদের গর্ভপাত-পরবর্তী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট নারী বৈধ বা অবৈধ উপায়ে গর্ভপাত ঘটিয়েছেন কি না, তা এ ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় হবে না। এ ধরনের সেবা নেওয়া বা দেওয়ার কারণে সংশ্লিষ্ট রোগী বা চিকিৎসককে আইনগত শাস্তি বা অন্য কোনো ধরনের হুমকির মুখোমুখি করা যাবে না।


পাচার  ——    

যৌন ও শ্রম পাচারের বিষয়টিকে অপরাধমূলক ঘটনা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে ২০১২ সালে একটি আইনি বিধান প্রণয়ন করায় রাষ্ট্রপক্ষ প্রশংসার দাবি রাখে। তবে কমিটি এই বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগের বিষয়ে উদ্বিগ্ন যে পাচারের শিকার ব্যক্তিদের একটা বিরাট বড় অংশই পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার পথে হাঁটেন না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এটা ঘটে থাকে প্রতিশোধের ভয় ও ভয়ভীতি দেখানোর কারণে। ঘটনার শিকার অনেকেই এটা বিশ্বাস করেন না যে তাঁরা পুলিশের কাছ থেকে কার্যকর সুরক্ষা পাবেন। কমিটি আরেকটি বিষয়েও গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। সেটি হচ্ছে, ১০০টির বেশি ঘটনা পাওয়া গেছে, যেখানে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের ভেতরেই জোরপূর্বক শ্রম ও যৌন পাচারের শিকার হতে হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী, সামরিক বাহিনী এবং পুলিশের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের পাচারের সুযোগ করে দেওয়ার সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের হাইকোর্ট রোহিঙ্গাদের দায়ের করা পাচারবিরোধী মামলাগুলো গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছেন। আর কর্তৃপক্ষও এসব ঘটনার তদন্ত শুরু করতে ব্যর্থ হয়েছে (আর্টিকেল ২, ৪, ১০, ১১, ১৪ ও ১৬)।


রাষ্ট্রকে যা করতে হবে  ——    

ক. বাংলাদেশের ভেতরে রোহিঙ্গাদের যৌন ও শ্রম পাচারের বিষয়ে ওঠা অভিযোগগুলো নথিভুক্ত করতে হবে এবং যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠবে, তাঁদের তদন্ত ও বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।

খ. রোহিঙ্গাসহ পাচারের শিকার সব বিদেশি নাগরিককে সরকারি সেবার আওতায় আনতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে সহিংসতার শিকার শিশু ও নারীদের জন্য বিদ্যমান সেন্টারগুলোতে প্রবেশাধিকার ও আইনি সহায়তা প্রদান। এ ছাড়া তাঁরা যে সহিংসতার শিকার, সে বিষয়ে দেশের বিচারালয়ের সামনে অভিযোগ উত্থাপনের সুযোগদানের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।


গ. এমন বাস্তবসম্মত অবস্থা ও পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, যেখানে পাচারের শিকার ব্যক্তিরা অভিযোগ দায়ের করলে প্রতিশোধমূলক ঘটনার ভয় থেকে কার্যকর সুরক্ষা পেতে পারেন।

শরণার্থী ও নন-রিফাউলমেন্ট  ——    

বর্তমানে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে থাকা ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর বিষয়ে নন-রিফাউলমেন্ট (নির্যাতনের ঝুঁকি থাকলে স্বদেশে ফেরতের জন্য চাপ না দেওয়া) নীতির প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোয় কমিটি দেশটিকে প্রশংসা করে। বাংলাদেশ স্বীকার করেছে যে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠালে তাদের নির্যাতন ও মন্দ আচরণের শিকার হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। কমিটি একই সঙ্গে এ বিষয়ে হতাশ যে রাষ্ট্রপক্ষ কয়েকটি বিষয়ে কোনো তথ্য প্রদান করেনি। এর মধ্যে রয়েছে আইনি বিধিবিধানের মধ্যে অথবা কোন কোন দেশে তাদের ফেরত পাঠানো হয়েছে, সে বিষয়ে চাওয়া তথ্যের মধ্যে নন-রিফাউলমেন্ট নীতির প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের বিভিন্ন প্রচেষ্টা এবং নির্যাতন ও মন্দ আচরণের মুখে পড়তে পারে এমন কোনো অবস্থার মধ্যে কোনো ব্যক্তিকে ফেরত না পাঠানোর নিশ্চয়তা দেওয়ার বিষয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ (আর্টিকেল ২, ৪, ১০, ১১, ১৪ ও ১৬)।


রাষ্ট্রপক্ষকে যা যা করতে হবে  ——    

ক. বাংলাদেশের ভূখণ্ডে থাকা মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিষয়ে নন-রিফাউলমেন্ট নীতির প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো অব্যাহত রাখা;

খ. আশ্রয়প্রার্থী বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড ও নিয়মকানুনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে নিবিড় আইন প্রণয়ন করা। [নির্যাতনবিরোধী] সনদের ৩ নম্বর অনুচ্ছেদ মেনে সেই আইন করতে হবে;

গ. একটি স্বতন্ত্র প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করা, যার মাধ্যমে কেউ যদি এমন উদ্বেগ তুলে ধরে যে তাকে রাষ্ট্রপক্ষের মাধ্যমে অন্য কোনো দেশে ফেরত পাঠালে প্রকৃতপক্ষেই নির্যাতন ও মন্দ আচরণের মুখোমুখি হতে হবে, তাহলে তিনি বাংলাদেশে থেকে যাওয়ার সুযোগ নিতে পারবেন। এর ভিত্তিতে তিনি সেটা করতে পারবেন যে অন্য দেশে ফেরত পাঠালে তা হবে সনদের অধীনে বাংলাদেশের নন-রিফাউলমেন্ট নীতির বাধ্যবাধকতার লঙ্ঘন;

ঘ. নন-রিফাউলমেন্ট নীতির ওপরে রাষ্ট্রপক্ষের সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রশিক্ষণ প্রদান;

ঙ. নির্যাতন ও মন্দ আচরণের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া সবাইকে (যারা নাগরিক নয়, তাদেরও) শনাক্ত করা এবং প্রতিকার দেওয়ার বিষয়ে কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা। সবাইকে স্বাস্থ্যসেবা ও মানসিক সেবায় যথোপযুক্ত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা;

চ. শরণার্থীদের মর্যাদাসংক্রান্ত ১৯৫১ সালের সনদ ও তার ১৯৬৭ সালের প্রটোকলে যোগদানের বিষয়টি বিবেচনা করা;

ছ. নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের যেসব ক্ষেত্রে এখতিয়ার আছে, সেসব ক্ষেত্রে চলমান তদন্তে কৌঁসুলিদের সহযোগিতা করা।


প্রতিকার ও পুনর্বাসন  ——    

কমিটি খুবই উদ্বিগ্ন যে নির্যাতন ও মন্দ আচরণের শিকার ব্যক্তিদের প্রতিকার দেওয়ার বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে এবং বাস্তবে রাষ্ট্রপক্ষ খুব সামান্যই প্রতিকার দিয়েছে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে খবর এসেছে। কমিটি এ বিষয়েও উদ্বিগ্ন যে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (রোধ) আইন ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা খুব সামান্যই। এটি কোনো পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে না এবং বাস্তবে এই আইনের আওতায় কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। কারণ, আজ পর্যন্ত ওই আইনের আওতায় কোনো রায় হয়নি। প্রতিনিধি দলটি বলেছে যে ওই আইনে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণের যে পরিমাণের কথা বলা আছে, তা বৃদ্ধি করার বিষয়টি সরকার বিবেচনা করবে। কমিটি এই বিবৃতির প্রশংসা করে। তবে কমিটি এ বিষয়েও উদ্বিগ্ন যে বাংলাদেশ এখনো সনদের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুমোদন করেনি। (আর্টিকেল ১৪)।


রাষ্ট্রপক্ষকে যা যা করতে হবে  ——    

ক. নির্যাতনের শিকার সবাইকে প্রতিকার পাওয়া এবং ন্যায্য ও উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পাওয়ার বিষয়ে প্রয়োগযোগ্য অধিকার নিশ্চিত করা। এর মধ্যে থাকবে যতটা সম্ভব পুনর্বাসিত করার সব উপায় নিশ্চিত করা। এ বিষয়ে কমিটি সনদের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদ বাস্তবায়নের বিষয়ে সাধারণ মন্তব্য নম্বর ৩ (২০১২)-এর প্রতি রাষ্ট্রপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে;

খ. দেশের ভূখণ্ডে থাকা শরণার্থী বাসিন্দাসহ রাষ্ট্রপক্ষের অধীনে থাকা নির্যাতন ও মন্দ আচরণের শিকার সবাই যেন দ্রুততার সঙ্গে উপযুক্ত মানসিক সেবা ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এবং বিশেষায়িত পুনর্বাসন সেবায় প্রবেশাধিকার পায়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করা। এটিও নিশ্চিত করা যে এসব সেবায় প্রবেশাধিকার যেন নির্যাতনের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ দায়ের বা দোষী ব্যক্তিদের সাজা হওয়ার ওপর শর্তসাপেক্ষ না হয়।

গ. অপরাধের গুরুতর অবস্থার বিষয় স্বীকার করা এবং নির্যাতন ও মন্দ আচরণের শিকার ব্যক্তিদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (রোধ) আইনে সংশোধনী আনা;

ঘ. সনদের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদের বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আপত্তি তুলে নেওয়া।


আইনে শারীরিক শাস্তি  ——    

কমিটি লক্ষ করেছে যে সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা আছে, ‘কাউকে নির্যাতন অথবা নিষ্ঠুর, অমানবিক, অথবা অবমাননাকর শাস্তি বা আচরণের মুখোমুখি করা যাবে না।’ এরপরও কমিটি এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন যে দেশের বিভিন্ন আইনে বেত্রাঘাতকে শাস্তি হিসেবে ব্যবহারের, পায়ে বেড়ি পরানোর অনুমতি রয়েছে। সংবিধানের ৩৫(৬) অনুচ্ছেদে বলা আছে, নির্যাতনের বিরুদ্ধে এখানে বর্ণিত বিধিনিষেধ আইনগতভাবে প্রণীত কোনো শাস্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। (আর্টিকেল ১, ২, ৪, ১১ ও ১৬)।

সর্বস্তরের সব ধরনের দৈহিক শাস্তি নিশ্চিহ্ন করতে এবং সুস্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করতে রাষ্ট্রপক্ষকে প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ, এগুলো নির্যাতন অথবা নিষ্ঠুর, অমানবিক, অথবা অবমাননাকর শাস্তি বা আচরণের সমতুল্য, যা সনদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, রাষ্ট্রপক্ষকে ১৮৯৪ সালের কারা আইনে সংশোধনী আনতে হবে।


শিশুদের শারীরিক শাস্তি  ——    

কমিটি খেয়াল করেছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিশুদের সব ধরনের দৈহিক শাস্তি প্রদান বন্ধ করতে ২০১০ সালে বিভিন্ন নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। আর ২০১১ সালে হাইকোর্ট ঘোষণা করেছেন, বিদ্যালয়গুলোতে বেত্রাঘাত, মারধর, শিকল দিয়ে বাঁধা ও আটকে রাখাসহ সব ধরনের দৈহিক শাস্তি ‘অবৈধ ও অসাংবিধানিক’ এবং তা একধরনের মন্দ আচরণ। কমিটি এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন যে রাষ্ট্রপক্ষ সর্বস্তরে দৈহিক শাস্তিকে নিষিদ্ধ করেনি। এ ধরনের ঘটনা বৃহত্তর পরিসরে ঘটতেই আছে, যার মধ্যে বিদ্যালয়গুলোও অন্তর্ভুক্ত। (আর্টিকেল ১ ও ১৬)।


রাষ্ট্রপক্ষকে যা যা করতে হবে  ——    

ক. শিশু আইন, দণ্ডবিধি ও অন্যান্য জাতীয় আইনে অতিরিক্ত সংশোধনী আনা, যাতে সর্বস্তরে দৈহিক শাস্তি বৃহত্তরভাবে ও সুস্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করা যায়;

খ. বিদ্যালয়সহ সবখানে দৈহিক শাস্তি প্রতিরোধ করতে সব ধরনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যেসব শিক্ষক এখনো দৈহিক শাস্তি প্রয়োগ অব্যাহত রেখেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত করা ও যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া;

গ. দৈহিক শাস্তির ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করতে বিভিন্ন ধরনের জন-অবহিতকরণ কর্মসূচি পরিচালনা করা; এবং দৈহিক শাস্তির বিপরীতে শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য যেসব অহিংস পন্থা রয়েছে, সেগুলো গ্রহণের জন্য সবাইকে উদ্বুদ্ধ করা।


মৃত্যুদণ্ড  ——    

কমিটি অগণিত রায়ের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন, যেখানে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সরকারি প্রতিনিধিদলটি বর্ণনা করেছে যে তারা মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ যেসব শাস্তি দেওয়া যেতে পারে, সেদিকে ধীরে ধীরে ধাবিত হচ্ছে। অবশ্য, প্রতিনিধিদলটি উল্লেখ করেছে যে ২০১৩-২০১৭ মেয়াদে যদিও ১ হাজার ১১৯টি মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে, পরে হাইকোর্টে ‘মাত্র’ ১৩০টি ঘটনায় ওই রায় বহাল রাখা হয়েছে। আর ২৩৯টি ঘটনায় সাজা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। একই সময়ে সব মিলিয়ে ১৭টি মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর করা হয়েছে। কমিটি এসব কারণে উদ্বিগ্ন যে এ ধরনের রায় যে বিপুলসংখ্যক বন্দী পেয়ে থাকে, তাদের মধ্যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়; এ ধরনের বন্দীদের কারাগারে খুবই খারাপ অবস্থার মধ্যে রাখা হয়। এ ছাড়া কমিটির কাছে খবর রয়েছে, রাষ্ট্রপক্ষ মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যেতে পারে, এমন অপরাধের তালিকা আরও সম্প্রসারণ করতে যাচ্ছে। যেমন ২০১৮ সালের মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে বিষয়টি যুক্ত করার খবর রয়েছে (আর্টিকেল ২, ১১ ও ১৬)।

মৃত্যুদণ্ড মুলতবি রাখার জন্য একটি পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করার জন্য রাষ্ট্রপক্ষের প্রতি আহ্বান জানায়। রাষ্ট্রপক্ষকে মৃত্যুদণ্ডের সব রায়ের বিপরীতে অন্য ধরনের শাস্তি দেওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে; মৃত্যুদণ্ডের রায় পাওয়া বন্দীদের কারাগারে থাকার জায়গার অবস্থার উন্নতি করতে হবে; সন্ত্রাসবিরোধী আইন, মাদক নিয়ন্ত্রণ আইন এবং সংশ্লিষ্ট অন্য যেসব আইনে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হতে পারে, সেগুলো আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বাধ্যবাধকতার আলোকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পর্যালোচনা করতে হবে। আর মৃত্যুদণ্ড বিলোপ করার লক্ষ্যে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদের দ্বিতীয় ঐচ্ছিক প্রটোকল অনুসমর্থন করার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।


ফলোআপ প্রক্রিয়া  ——    

কমিটি হাইকোর্টের বিভিন্ন নির্দেশনা আইনশৃঙ্খলা-সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও ম্যাজিস্ট্রেটদের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার বিষয়ে কমিটির বিভিন্ন সুপারিশের ফলোআপ তথ্য ২০২০ সালের ৯ আগস্টের মধ্যে প্রদানের জন্য রাষ্ট্রপক্ষের প্রতি অনুরোধ করছে। রাষ্ট্রপক্ষকে একটি স্বাধীন কর্তৃপক্ষ ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের মাধ্যমে যেসব স্থানে নাগরিক স্বাধীনতাবঞ্চিত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, সেসব স্থানে নজরদারি করাতে হবে; বিধিবহির্ভূতভাবে আটক ব্যক্তিদের বিষয়ে অভিযোগ দেওয়ার প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করতে হবে; এবং রাষ্ট্রপক্ষের প্রাথমিক প্রতিবেদন বিবেচনায় নেওয়ার প্রেক্ষাপটে নাগরিক সমাজের বিভিন্ন সংগঠনের যেসব সদস্য কমিটিকে সহযোগিতা করেছেন, তাঁদের যেকোনো ধরনের প্রতিহিংসামূলক আচরণ ও হয়রানি থেকে সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে, যার প্রতিশ্রুতি কমিটিকে দিয়েছে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় (ধারা ২২(খ), ১৬(ঙ), ৩৫(ক) ও ৩১(ঘ) দেখুন)। এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রপক্ষকে আসন্ন রিপোর্টিং সময়কালের মধ্যেই চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণের ওপর কিছু অথবা অবশিষ্ট সব সুপারিশের বিষয়ে তাদের বাস্তবায়ন পরিকল্পনা কমিটিকে অবগত করানোর জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।


অন্যান্য বিষয়  ——    

সনদের ২১ ও ২২ নম্বর অনুচ্ছেদের আওতায় নির্ধারিত বিষয়গুলোর ঘোষণা দিতে রাষ্ট্রপক্ষকে আহ্বান জানাচ্ছে কমিটি। সনদের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদের বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের থাকা আপত্তি প্রত্যাহারের বিষয়টি বিবেচনার আহ্বান জানানো হচ্ছে।

কমিটি সনদের ঐচ্ছিক প্রটোকল অনুসমর্থন করতে এবং জাতিসংঘ মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট অন্য গুরুত্বপূর্ণ যেসব চুক্তিতে এখনো অন্তর্ভুক্ত হয়নি, সেগুলো অনুসমর্থন করতে রাষ্ট্রপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে। বিশেষ করে গুম থেকে সবাইকে সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সনদ অনুসমর্থন করতে হবে।

কমিটি এ বিষয়ে সুপারিশ করছে যে রাষ্ট্রপক্ষ বিশেষ প্রক্রিয়ার ম্যান্ডেটধারী যে নয়জন পরিদর্শনের অনুমতির জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন, তাঁদের প্রবেশাধিকারের অনুমতি দেবে। এবং বিলম্ব ছাড়াই জাতিসংঘের নির্যাতন ও অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ বা শাস্তিবিষয়ক বিশেষ দূতকে; বিচারবহির্ভূত বা বিধিবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডবিষয়ক বিশেষ দূতকে; বিধিবহির্ভূত আটকবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপকে; গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপকে; এবং মানবাধিকারের রক্ষকদের পরিস্থিতিবিষয়ক বিশেষ দূতকে আমন্ত্রণ জানাতে হবে।

রাষ্ট্রপক্ষ কমিটিকে যে প্রতিবেদন দিয়েছে, সেটি বৃহত্তরভাবে প্রচারের জন্য এবং চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণ উপস্থাপনের অনুরোধ করা হচ্ছে। উপযুক্ত বিভিন্ন ভাষায়, দাপ্তরিক বিভিন্ন ওয়েবসাইট, গণমাধ্যম ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে তা প্রকাশ করতে হবে এবং রাষ্ট্রপক্ষকে এই প্রচারমূলক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে কমিটিকে অবগত করতে হবে।


আগামী ২০২৩ সালের ৯ আগস্টের মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষকে তার পরবর্তী পর্যায়ক্রমিক প্রতিবেদন (যেটি হবে তাদের দ্বিতীয় প্রতিবেদন) জমা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। সেই লক্ষ্যে, আগামী ২০২০ সালের ৯ আগস্টের মধ্যে সেই প্রতিবেদন প্রস্তুত করার জন্য রাষ্ট্রপক্ষকে সহজতর রিপোর্টিং প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ার জন্য সম্মত হতে আহ্বান জানাচ্ছে কমিটি। সেই প্রক্রিয়ার অধীনে কমিটি রিপোর্টিংয়ের আগেই বিভিন্ন ইস্যুর একটি তালিকা রাষ্ট্রপক্ষের কাছে হস্তান্তর করবে। ইস্যুর সেই তালিকার বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের জবাবের বিষয়টি সনদের ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদের অধীনে তাদের দ্বিতীয় পর্যায়ক্রমিক প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত হবে।
  • [অনুবাদ করেছেন আবু হুরাইরাহ্‌, হারুন–অর–রশীদ, রাজিউল হাসান ও অর্ণব সান্যাল]
  • কার্টসি — প্রথম আলো/ সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৯