আহবাব চৌধুরী খোকন
সাইফুর রহমান অক্টোবর ৬, ১৯৩২ — সেপ্টেম্বর ৫, ২০০৯ |
৫ সেপ্টেম্বর বরেণ্য রাজনীতিবিদ ও অর্থনৈতিক সংস্কারক সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৯ সালের এই দিনে পবিত্র রমজান মাসে মৌলভীবাজার থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। দীর্ঘ সময়ের সফল অর্থমন্ত্রী মরহুম এম সাইফুর রহমান ছিলেন সৎ, মেধাবী ও পরিশ্রমী। প্রতিভাবান এই মানুষটির জন্ম ১৯৩২ সালের ৬ অক্টোবর মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বাহারমর্দন গ্রামে। ১৯৪৯ সালে মৌলভীবাজার সরকারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, ১৯৫১ সালে এমসি কলেজ থেকে আইএসসি ও ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে। তিনি ১৯৫৮ সালে লন্ডনের ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট থেকে কৃতিত্বের সাথে ডিগ্রি অর্জন করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ভিপি নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাভোগ করেন। তিনি ১৯৬২ সালে দেশে ফিরে এসে আত্মপ্রকাশ করেন চৌকস পেশাজীবী হিসেবে। প্রতিষ্ঠা করেন ‘রহমান, রেহমান অ্যান্ড হক’ নামে একটি নিরীক্ষা ফার্ম। এই ফার্ম আজো চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট শিক্ষার্থীদের জন্য একটি আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে সাইফুর রহমানের কৃতিত্বের স্মারক হয়ে আছে। তিনি খুব অল্প সময়ের মধ্যে অভিজ্ঞ অ্যাকাউনট্যান্ট হিসেবে তেল, গ্যাস, কেমিক্যাল, ট্রান্সপোর্ট, ইন্স্যুরেন্স, ব্যাংকিং ইত্যাদি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় পরামর্শক হিসেবে দেশে-বিদেশে প্রভূত সুনাম অর্জন করেন। ১৯৭৬ সালে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে যোগ দেন রাজনীতিতে।
তিনি ছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বিএনপির রাজনীতিকে লালন করে গেছেন। সাইফুর রহমান প্রথমে জিয়া সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা এবং ১৯৭৮ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত প্রথমে শহীদ জিয়াউর রহমান ও পরে মরহুম বিচারপতি আবদুস সাত্তার সরকারের অর্থ ও বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮২ সালে ২৪ মার্চ সামরিক শাসন জারি করে এরশাদ ক্ষমতা দখল করলে বিএনপির শীর্ষপর্যায়ের প্রায় সব নেতার সাথে তাকেও গ্রেফতার করে নির্যাতন করা হয়। তিনি নীতির প্রশ্নে আপস করেননি। বরং বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে বিএনপি পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় প্রায় পুরো ৯ বছর তিনি রাজপথে থেকে সরকারের জুলুম-নির্যাতন মোকাবেলা করেছিলেন। ১৯৯১ সালে জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়ে আবার সরকার গঠন করলে সাইফুর রহমান আবারো অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। তিনি ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত দুই দফায় ১০ বছর বেগম জিয়া সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
সাইফুর রহমান ছিলেন সাহসী, দেশপ্রেমিক ও স্পষ্টভাষী। যতটুকু মনে পড়ে, মৃত্যুর বছর চারেক আগে তার সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিল। তিনি সিলেট শাহী ঈদগাহে ঈদের নামাজ পড়ে মৌলভীবাজার যাচ্ছিলেন। তার তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব (এপিএস) কাইয়ুম চৌধুরীর সাথে তাকে মৌলভীবাজার পৌঁছে দিয়ে এসেছিলাম। তখন তার সাথে ছিলেন সিলেট ও মৌলভীবাজারের দুই জেলা প্রশাসক, দুই জেলার পুলিশ সুপার, তার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা ও সিলেট মহানগর বিএনপির সভাপতি ও বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।
অন্যান্য ঈদের দিনের মতো ওই দিন মৌলভীবাজারে তার বাগানবাড়িতে জনতার ঢল নেমেছিল। এর সপ্তাহখানেক আগে তিনি আমেরিকা সফর করে গেছেন। আমি নিউ ইয়র্ক থেকে এসেছি শুনে সিলেটি ভাষায় বললেন, ‘আমেরিকায় তো দেখলাম বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। এত ঠাণ্ডা যে, এবার গিয়ে বেশ অসুস্থ ছিলাম।’ বললাম, ‘স্যার, আমি জানি। তখন দেশে চলে এসেছিলাম। তাই আপনার সাথে দেখা হয়নি।’ দেখলাম, তিনি বেশ ক্লান্ত। বিদায় নিয়ে চলে গেলেন বাহারমর্দনের বাড়িতে। সেখানে তার পৈতৃক বাড়ি। সিলেটে এলে তিনি তার বাবার স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়িতেই রাত কাটাতেন।
জাতীয়তাবাদী রাজনীতির একজন অনুসারী হিসেবে আদর্শ এই মানুষটির সাথে নিজের অনেক স্মৃতি রয়েছে। ১৯৯১ থেকে ২০০১ মৌলভীবাজার, সিলেট ও সুনামগঞ্জে অসংখ্যবার তার সাথে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে সফরসঙ্গী হওয়ার সুযোগ হয়েছে। সিলেট জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক ও পরে জেলা বিএনপির সাংস্কৃতিক ও আপ্যায়ন সম্পাদক হিসেবে ১৯৯৩ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তার সব কর্মসূচিতে থাকার সুযোগ পেয়েছি। ১৯৯১ সালের কথা। আমি তখন ফেঞ্চুগঞ্জ থানা ছাত্রদলের সিনিয়ার যুগ্ম আহ্বায়ক। ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানাকে কেন্দ্র করে সিলেটে তখন আন্দোলন তুঙ্গে। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মরহুম আবদুুস সামাদ আজাদের নেতৃত্বে বৃহত্তর সিলেটের বিরোধীদলীয় ১৮ জন সংসদ সদস্য সারকারখানায় বিশাল প্রতিবাদ সভা করে গেছেন।
শিল্প মন্ত্রণালয় ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে দেখিয়ে ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এ ব্যাপারে একটি বিজ্ঞাপন ও বিটিভিতে প্রচারিত হয়েছে। ফেঞ্চুগঞ্জে তখন দু’টি ধারায় আন্দোলন চলছে। একটি ধারার নেতৃত্ব দিয়েছে ‘গণদাবি পরিষদ’। নেতৃত্বে ছিলেন সিলেট-৩ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য মাহমুদুস সামাদ চৌধুরী ও ডা: মিনহাজ উদ্দিন। আর অন্য ধারায় ‘সর্বদলীয় সারকারখানা রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ।’ এতে নেতৃত্ব দিয়েছেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় ছাত্রদল নেতা কাইয়ুম চৌধুরী, উপজেলা বিএনপি নেতা আনোয়ারুল করিম চৌধুরী, বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম প্রমুখ। প্রতিদিন মিছিল-মিটিং হচ্ছে। ছাত্র আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। (ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, জাসদ ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, আঞ্জুমানে তালামিজ ও জাতীয় ছাত্র ঐক্য সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয়েছিলে ওই ছাত্রঐক্য)। আমরা ঘোষণা দিয়েছিলাম ফেঞ্চুগঞ্জে নতুন সারকারখানা নির্মাণ না করে সারকারখানা বন্ধ করা যাবে না।
অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান তখন ৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের একটি প্লান্ট উদ্বোধন করতে ফেঞ্চুগঞ্জে আসবেন। আন্দোলনরত জনতার পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল- সারকারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত বাতিল করা না হলে মন্ত্রীকে ফেঞ্চুগঞ্জে নামতে দেয়া হবে না। তিনি যে দিন ফেঞ্চুগঞ্জে আসবেন, ওই দিন লাঠিমিছিল করা হবে। তিনি এ খবর পেয়ে তো খুবই ক্ষুব্ধ।
এমন উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে সিলেট থেকে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, জেলা বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতারা ফেঞ্চুগঞ্জ এলেন। উপজেলা পরিষদের হলরুমে গভীর রাত অবধি সর্বদলীয় মিটিং হলো। অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো, সাইফুর রহমানের উদ্বোধন অনুষ্ঠান হবে। লাঠিমিছিল বাতিল। তবে উপজেলা বিএনপি আহ্বায়ক ও আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং সারকারখানার সিবিএ সভাপতি নেতৃত্বে আন্দোলনরত নেতারা সাইফুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের দাবি-দাওয়া জানাবেন। অবশেষে সে দিন এদের সভা হলো এবং এম সাইফুর রহমানের নির্দেশে সে দিন শিল্প মন্ত্রণালয় সারকারখানা বন্ধের হঠকারী সিদ্ধান্ত বাতিল করেছিল। সিলেট বিভাগ প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকা কখনো ভুলে যাওয়ার নয়।
১৯৯৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সিলেটে আসার কথা। আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে তার জনসভার আয়োজন চলছে। সাইফুর রহমান এ সময় প্রধানমন্ত্রীকে নাকি বলেছিলেন, ‘যদি এই জনসভা থেকে সিলেটকে দেশের নতুন বিভাগ হিসেবে ঘোষণা না দেন, তাহলে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করব।’ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বিশাল জনসভায় সিলেটকে নতুন বিভাগ ঘোষণা দেন।
১৯৯৭ সালের কথা। আওয়ামী লীগ তখন ক্ষমতায়। আমার সুযোগ হয়েছিল তার সাথে ঢাকা থেকে সকালের ‘পারাবত’ ট্রেনে শ্রীমঙ্গল যাওয়ার। ট্রেনের একটি ডাবল কেবিনে করে আমরা ঢাকা বিমানবন্দর স্টেশন থেকে একসাথে শ্রীমঙ্গল যাচ্ছি। স্যার ট্রেনে উঠেই ঘুমিয়ে পড়লেন। আমি ও কাইয়ুম চাচা তার সামনের সিটে বসে আস্তে আস্তে গল্প করছি। ট্রেন চলতে চলতে আখাউড়া স্টেশনে এসে থামলে লোকজনের চিৎকারে মন্ত্রীর ঘুম ভেঙে গেল। জানতে চাইলেন, ট্রেন এখন কোথায় আছে। আমরা বললাম, আখাউড়া।
ঢাকা থেকে সিলেট এবং সিলেট থেকে ঢাকাগামী সব ট্রেনের স্টপেজ আখাউড়া থেকে উঠিয়ে দেয়া হলো, যা আজো বহাল আছে। এখনো দেশে গেলে ট্রেনে করে ঢাকা যাওয়ার সময় তার ওই কথা মনে পড়ে।
বেশ রেগে বললেন, এই একটি স্টপেজে প্রতিটি যাত্রীর ক্ষতি হয় এক ঘণ্টা আর লাভ হয় চোরাকারবারিদের। অথচ এখানে মাত্র অর্ধ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করতে পারলে ট্রেন সোজা সিলেট চলে যেতে পারে। ইঞ্জিন ঘোরানোর জন্য এখানে থামতে হতো না। আল্লাহ যদি কখনো আমাকে আবার সুযোগ দেন, এখানে ইঞ্জিন ঘোরানোর আর কোনো দরকার হবে না। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বিএনপি আবারো ক্ষমতায় এলে, সাইফুর রহমান অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী হন এবং আখাউড়ায় সিলেটের মানুষের সুবিধার্থে এক কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করেন।
ঢাকা থেকে সিলেট এবং সিলেট থেকে ঢাকাগামী সব ট্রেনের স্টপেজ আখাউড়া থেকে উঠিয়ে দেয়া হলো, যা আজো বহাল আছে। এখনো দেশে গেলে ট্রেনে করে ঢাকা যাওয়ার সময় তার ওই কথা মনে পড়ে।
সাইফুর রহমান মন্ত্রী থাকাকালে উন্নয়নের ব্যাপারে দেখিয়েছেন বিস্ময়কর কৃতিত্ব। মনে আছে, ১৯৯১ সালে আমরা স্যারের সাথে রাজনগরে রাগীব আলীর চা বাগানে দুপুরের লাঞ্চ করে রওনা হলাম ফতেহপুর বাজারে। ফতেহপুর সিলেট এবং মৌলভীবাজারের বর্ডার। বিশাল গাড়ির বহর নিয়ে যখন ফতেহপুর যাচ্ছিলাম, তখন ওই কাঁচা রাস্তার অবস্থা দেখে মনে হয়েছিল রাস্তা নয়, আমরা যাচ্ছি যেন হাওরের ওপর দিয়ে। অর্থমন্ত্রী স্পট পরিদর্শন করলেন, প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্টদের সাথে পরামর্শ করলেন এবং জনসভায় প্রদত্ত বক্তৃতায় জনগণের দাবির মুখে ওই রাস্তা করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। তিনি তখন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী। আওয়ামী লীগের আজিজুর রহমান মৌলভীবাজার সদরের এমপি ছিলেন।
এক বছর পর সাইফুর রহমান আবারো ফতেহপুর গেলেন ওই রাস্তা উদ্বোধন করতে। কী সুন্দর রাস্তা এক বছরে নির্মিত হয়েছে, না দেখলে বিশ্বাস করার নয়।
তিনি ছিলেন একজন দেশদরদি মানুষ। বিশেষত সিলেট বিভাগে যত অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, তার বেশির ভাগ কৃতিত্বের অধিকারী সাইফুর রহমান। তিনি তার কর্মের জন্য মানুষের অন্তরে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।
- লেখক প্রবাসী সংগঠক ও কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, সাইফুর রহমান স্মৃতি ফোরাম, নিউ ইয়র্ক।
- কার্টসি — নয়াদিগন্ত / সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১৯।
- লিঙ্ক - https://bit.ly/2lFS4Z9
No comments:
Post a Comment