Search

Wednesday, September 18, 2019

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কার্যকারিতা

এমাজউদ্দীন আহমদ
বাংলাদেশের রাজনীতি কোন পথে- এই প্রশ্ন সুধী সমাজে উঠছে। গণতন্ত্রের অবস্থাই-বা কেমন? গণতন্ত্রের ভিত্তি হচ্ছে পারস্পরিক সমঝোতা ও যোগাযোগ। রাজনৈতিক কাজকর্মের মধ্যে পারস্পরিক সহিষুষ্ণতাই সবচেয়ে মূল্যবান উপাদান। যে কোনো সভ্য দেশে এমনটিই দেখা যায়? কিন্তু আমাদের দেশে কী দেখা যাচ্ছে? এ প্রশ্নের উত্তর কী, তাও সচেতন মানুষ মাত্রেরই জানা আছে। সরকার ও বিরোধী দল উভয় পক্ষের রাজনৈতিক নেতাদের প্রধান কাজ জাতীয় সমস্যা ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এখানে বিরোধী পক্ষের রাজনীতিকদের কোনো স্পেসই দেওয়া হয় না। মুশকিলটা হলো, তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে যারা নতুন গণতান্ত্রিক সমাজে প্রবেশ করেছে, সেখানে সহিষ্ণুতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। আমরাও এর বাইরে নই। এমতাবস্থায় গণতন্ত্রের চেহারা-চিত্র কেমন হতে পারে, তাও সচেতন মানুষ মাত্রেরই জানা আছে।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিশ্চিতকরণ ক্ষেত্রে একদিকে যেমন প্রয়োজন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, অন্যদিকে তেমনি প্রয়োজন রাজনীতির কুশীলবদের গণতান্ত্রিক মন। গণতন্ত্রের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য দুটিই অপরিহার্য। সফল গণতন্ত্রে দুই-ই চলে পাশাপাশি, অনেকটা হাত ধরাধরি করে। একটি পিছিয়ে গেলে অন্যটি সহায়তা করে। হাত ধরে কাছে টানে। কোনো সমাজে গণতন্ত্রের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি এই দুটিই এবং এদের সুষম সমন্বয়। কোনো সমাজে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি হলেই যে গণতন্ত্র প্রাণবন্ত হবে, তা ঠিক নয়। বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে জাতীয় সংসদের মতো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে সংগঠিত মন্ত্রিপরিষদ। স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচিত স্থানীয় সরকারও; কিন্তু থাকলে কী হবে, এসব প্রতিষ্ঠান শুস্ক কাঠামোর মতোই। গণতান্ত্রিক প্রাণরসে এসব প্রতিষ্ঠান কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় জারিত হয়নি। যারা এসব প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর করছেন, তাদের গণতান্ত্রিক চেতনার রসে তা সিক্ত নয়। গণতান্ত্রিক মনের স্পর্শে প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাণবন্ত হয়নি।

গণতন্ত্রের উদারতায় চারদিক উজ্জ্বল হয়ে ওঠেনি। সংকীর্ণতার ঘন অন্ধকারে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দল তাই হয়ে উঠেছে দলীয়করণের মাধ্যম। জাতীয় সংসদ হয়ে উঠেছে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের শক্তিমত্তার বাহন। নির্বাচন ব্যবস্থা চালু আছে বটে; কিন্তু প্রকৃত অর্থে জনমতের যথাযথ রায়দানে এর প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি কতটা স্বচ্ছ, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। দেশে গণতন্ত্রের উপযোগী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো রচিত হয়েছে নিশ্চয়ই; কিন্তু এই কাঠামোয় প্রাণের স্পন্দন আসেনি। অন্তঃকরণের স্ম্ফুরণ ঘটেনি। অস্থিমজ্জার সতত সঞ্চালনের ফলে সৃষ্ট গতিশীলতার জন্ম হয়নি। বাংলাদেশের গণতন্ত্র তাই অনেকটা প্রাণহীন বিগ্রহের মতোই। গণতন্ত্রের আদল রয়েছে ঠিকই; কিন্তু নেই প্রাণের প্রতিষ্ঠা। নেই এর অন্তঃকরণ। তাই জনগণের কাছে নেই এর যথাযথ আবেদন। সংযম, বোঝাপড়া, আপস-মীমাংসা, আদান-প্রদান, সহিষুষ্ণতার মানদণ্ডে বাংলাদেশের গণতন্ত্র অনেকটা শুস্ক কাঠখণ্ডের মতো নিষ্প্রাণ, নিশ্চল, নিরেট। কিন্তু কেন? কথাগুলো বহুবার বলা হয়েছে, আবারও বলছি।

সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্র দু'ধারায় পরিপুষ্ট হয়েছে। সমৃদ্ধ হয়েছে মানবসভ্যতার দুটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অধ্যায়ের উন্নত অবদানে। গ্রিক সভ্যতার সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান শাসনব্যবস্থায় জনগণের সংশ্নিষ্টতা লাভ করে গণতন্ত্র হয়েছে জনগণের সরকার। প্রথমে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ, পরে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে জনগণের পরোক্ষ অংশগ্রহণের জন্যই সৃষ্টি হয়েছে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো। অন্যদিকে রোমান সভ্যতার সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান হলো জনগণের সুনির্দিষ্ট অধিকার, আইনের শাসনের মাধ্যমে অধিকার সংরক্ষণের সুব্যবস্থা, বিশেষ করে সাংবিধানিকতার ঘন আস্তরণে ঢাকা গণতান্ত্রিকতাই এই ব্যবস্থার প্রাণস্বরূপ।

এই দুইয়ের সম্মিলন যে শাসনব্যবস্থায় ঘটেছে, তাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। জনগণ অথবা জনগণের প্রতিনিধি ছাড়া অন্য কেউ শাসনব্যবস্থা পরিচালিত করলে তা হয় স্বৈরাচার। অন্যদিকে জনগণ অথবা জনগণের প্রতিনিধি কর্তৃক পরিচালিত ব্যবস্থায় যদি সাংবিধানিকতা ক্ষুণ্ণ হয়, আইনের শাসন অনুপস্থিত থাকে অথবা জনগণের অধিকার সংরক্ষিত না হয়, তা হলেও সেই ব্যবস্থা পর্যবসিত হয় নির্বাচিত স্বৈরাচারে। দুই-ই গণতন্ত্রের বিপরীত। দুই-ই গণতন্ত্রের শত্রু। দুই ব্যবস্থাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে হাজার যোজন দূরের। দুটিই জনস্বার্থবিরোধী। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পর্যালোচনা করলে অনুধাবনে কোনো অসুবিধা হয় না যে, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে দেশের শাসনব্যবস্থা কীভাবে নির্বাচিত গণতান্ত্রিকরূপে রূপান্তরিত হয়েছে শুধু ক্ষমতাসীন মহলের নীতিনির্ধারকদের গণতান্ত্রিক মনের অভাবে।

উন্নত গণতান্ত্রিক সমাজে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং গণতান্ত্রিক মনের সম্মিলন জন্ম দিয়েছে এক ধরনের সংস্কৃতির। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পরিচালনায় সেই সংস্কৃতি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি অপরিহার্য এক উপাদানে পরিণত হয়েছে। বন্যা আসুক, ঝড় উঠুক, চারদিক অন্ধকারে আচ্ছন্ন হোক, কোনো সমাজে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটলে শাসনব্যবস্থায় কোনো জটিলতার সৃষ্টি হয় না। কেননা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মৌল ভিত্তি হলো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সমস্যা সম্পর্কে শুধু রাজনীতির কুশীলবদের মধ্যে নয়, সমগ্র সমাজব্যাপী সৃষ্ট ঐকমত্যের এক সুখদ আবহাওয়া। এই আবহাওয়ায় প্রত্যেকের কাছে সুস্পষ্ট থাকে নিজ নিজ অধিকার এবং নিজ নিজ দায়িত্বের বিষয়টি। সুস্পষ্ট থাকে রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রকৃতি, এর প্রয়োগ এবং প্রয়োগকারী কর্তাদের প্রকৃতি সম্পর্কেও। কখন কোন দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকবে, কোন অবস্থায় তারা ক্ষমতা ছেড়ে দেবে, কখন নির্বাচন হবে, কীভাবে তা সম্পন্ন হবে, কারা বিরোধিতা করবে, কীভাবে বিরোধিতা করবে, বিরোধী দলের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক কী- এসব বিষয়ে সমাজব্যাপী এক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মূল কথা তা-ই। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির আর একটি উপাদান হলো সংসদীয় আচরণ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনীতি যেহেতু সংবিধানের আলোকে জনস্বার্থ সংরক্ষণ ও জনকল্যাণের লক্ষ্যে সুসংহত এক যৌথ কর্ম, তাই রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ পারস্পরিক আলাপ-আলোচনায়, আদান-প্রদানে, বক্তব্য-বিবৃতিতে, আইন পরিষদের ভেতরে এবং বাইরে কীরূপ আচরণ করবেন, তা নির্দিষ্ট হয় সংসদীয় আচরণের নিরিখে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি একদিনে গড়ে ওঠেনি। শত শত বছরের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে, অনেকটা অভিজ্ঞতার স্রোতধারায় সঞ্চিত স্বর্ণরেণুর মতো সামগ্রিক প্রজ্ঞা হিসেবে তা উঠে এসেছে মানবসভ্যতায়।

এদিক থেকেও দেখা যায়, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবস্থা অনেকটাই অনুজ্জ্বল। নির্বাচিত হলেই যে সরকার গণতান্ত্রিক হয় না, আইনের প্রাধান্য তথা জনগণের অধিকার সংরক্ষণে ব্যর্থ অথবা উদাসীন হলে, শুধু নির্বাচনের ভিত্তিতেই পীড়নমূলক ব্যবস্থা অব্যাহত রাখলে যে সরকার নির্বাচিত অগণতান্ত্রিক শাসকরূপে পরিণত হয়, তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ বাংলাদেশেই দেখা যায়। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতো সুস্থ প্রতিযোগিতা উন্নত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিচায়ক। প্রতিযোগিতার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের লক্ষ্যে দল পর্যায়েও গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটে। বিভিন্ন দল পারস্পরিক আদান-প্রদানে গণতান্ত্রিক নীতি অনুসরণ করে থাকে। জাতীয় পর্যায়ে গণতন্ত্রকে সুসংহত করার লক্ষ্যে সর্বপ্রথম দলে গণতন্ত্রের চর্চা করে থাকে। প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলেও বৈরিতার পথ পরিহার করে। বাংলাদেশে কিন্তু এই সংস্কৃতির কোনোরূপ বিকাশ ঘটেনি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইন পরিষদ বা পার্লামেন্ট হলো সব নীতিনির্ধারক এবং জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। সংসদীয় আচরণের সৌষ্ঠবে জাতীয় সংসদ কিংবা আইন পরিষদ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কোনো সময় অকথা অথবা কুকথার কেন্দ্রে তা পর্যবসিত হয় না। প্রকৃতপক্ষে আইন পরিষদই হলো জাতীয় মেধার প্রাণকেন্দ্র, জাতীয় নেতৃত্বের প্রধানতম কেন্দ্র। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে কোনো কোনো সদস্যের আলোচনার মান পর্যবেক্ষণ করলে, সদস্যদের রুচিবোধের মাত্রা অনুভব করলে যে কেউ এই মন্তব্য করবেন যে, এটি শুধু অপরিণত নয়, অপরিশীলিত। জাতীয় রাজনীতির প্রধান কেন্দ্রের চেহারা যখন এমন, তখন রাজনীতি যে উন্নত মান অর্জনে সক্ষম হবে না, তা বলাই বাহুল্য।

বাংলাদেশে আজকে রাজনীতি যে পথে চলছে এর জন্য অবশ্য তীব্র সমালোচনা যথেষ্ট নয়, সমাজবিজ্ঞানীদের সৃজনশীল বিশ্নেষণে সমাজ জীবনে ঝড় তুলতে হবে। সমগ্র সমাজকে গণতন্ত্রের ভিত্তি সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। সব সামাজিক শক্তিগুলোকে গণতন্ত্রের জন্য তৈরি করতে হবে। সামাজিক শক্তিগুলোর মধ্যে সর্বাগ্রে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ভিত্তির প্রতি বিশেষ দৃষ্টি না দিয়ে অট্টালিকার শীর্ষের দিকে তাকালে যেমন কোনো ফল লাভ হয় না, সামাজিক শক্তিগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ না ঘটিয়ে, নিম্নপর্যায়ে সংসদীয় আচরণের ব্যাপক বিস্তার সম্ভব না করে, শুধু রাজনৈতিক দল এবং দলীয় নেতা-নেত্রীর কার্যক্রম ও আচরণ বিশ্নেষণ করলে শুধু হতাশা বৃদ্ধি পাবে। কাজের কাজ কিছুই হবে না। সচেতন নাগরিকদের তা স্মরণে রাখা উচিত।

বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান রচিত হয়েছে বটে; কিন্তু রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের অনেকের মধ্যে গণতান্ত্রিক মন এখনও সৃষ্টি হয়নি। অথচ গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য এই দুটিই হলো অপরিহার্য। অগণতান্ত্রিকতার দৈত্যপুরীতে ঘুমন্ত গণতন্ত্রের ঘুম ভাঙানোর জন্য সোনা ও রূপার কাঠির মতো মহামূল্যবান রাজনৈতিক নেতৃত্বের রাজকুমার বাংলাদেশে ঘুমে অচৈতন্য গণতন্ত্রকে জাগানোর জন্য কখন এই দুটি কাঠি নিয়ে উপস্থিত হবেন? এই প্রেক্ষাপটে অরাজনৈতিক সিভিল সোসাইটির প্রধানতম দায়িত্ব হলো, শুধু প্রশ্ন উত্থাপন নয়, রাজনীতির লক্ষ্য সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করা, সামাজিক শক্তিগুলোর মধ্যে সচেতনভাবে সামাজিক স্বার্থ সম্পর্কে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা, বিশেষ করে দেশে গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান রচনার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর মধ্যে গণতান্ত্রিক মন বিনির্মাণ করা যে অপরিহার্য, তা সুস্পষ্টভাবে উচ্চারণ করা। তা হলেই এমন বিবর্ণ কিংবা এক পরীক্ষায় রাজনীতির গণ্ডি থেকে সমাজ মুক্ত হতে পারবে। গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য এর কোনো বিকল্প নেই।

  • সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী
  • কার্টসিঃ সমকাল/ সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৯ 

No comments:

Post a Comment