Search

Tuesday, February 25, 2020

দুষ্ট অর্থনীতির নষ্ট খেলোয়াড়েরা

ফারুক ওয়াসিফ
পাপিয়া আবিষ্কার কাহিনিতে একটি সংলাপ থাকা দরকার ছিল, ‘এত দিন কোথায় ছিলেন, বস?’ চলমান রাজনীতি ও অর্থনীতির মিলনে যাদের সৃষ্টি, তাদের কেউ ক্যাসিনো সম্রাট আর কেউবা হোটেল সম্রাজ্ঞী পাপিয়া। খলসময়ের খলকাহিনি খল পার্শ্বনায়ক-পার্শ্বনায়িকা। মূল নায়ক-নায়িকা হতে এঁদের আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হতো। এঁদের অভিযাত্রা রোমাঞ্চকর, শ্বাসরুদ্ধকর এবং ঝুঁকিপূর্ণ। একজন প্রতিষ্ঠিত মাফিয়ার নেতা, এমপি, শিল্পপতি, বিজনেস ম্যাগনেটে পরিণত হওয়ার শেষ ধাপটা খুব বিপজ্জনক। তার আগেই অনেকে ঝরে যায়। ক্যাসিনো সম্রাট, জি কে শামীম, খালেদ বা পাপিয়ারা শেষ ধাপে আটকে গেলেন। এই পতন মাফিয়া মহলের ভেতরে চলতে থাকা তুমুল প্রতিযোগিতার ফল। 

একেকজন মাফিয়া ‘বস’কে ফুলে ফলে ফুটিয়ে তুলতে মোটামুটি পাঁচ বছর লাগে। এই কাহিনির প্রথম অধ্যায়ের সাক্ষী জেলা শহর। সেখানকার উঠতি যুব নেতা–নেত্রীরা প্রথমে দলের ছোট নেতা হয়ে ক্ষমতার নেটওয়ার্কে জড়ান। এই পদ দখলের প্রতিযোগী অনেক। ওপরের মহলের চাহিদা মেটানোর কলাকৌশল যার হাতে বেশি, তিন তত আগুয়ান। তারপর শুরু হয় পদ ধরে রাখার যুদ্ধ, টাকা বানানোর সার্বক্ষণিক সংগ্রাম। চালিয়ে যেতে পারলে এমপি-মন্ত্রী হওয়া যায়। একবার হয়ে গেলে আর ছোঁয় কে। ব্যর্থ হলে বিদেশে পালানোর চেষ্টা হয়। জায়গা নেন ‘বেগমপাড়ায়’। একবার বিদেশে পগারপার হতে পারলে চুপচাপ সঞ্চিত সম্পদ ভোগ করা আর দেশে ফেরার সুযোগের অপেক্ষায় থাকার গুণ এদের আছে। আজকের অনেক খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠিত নেতার অতীত এমনই। এই খেলাই চলছে হরদম হরদম। 

এরা কলঙ্ক নয়, এরাই অলংকার এই রাজনৈতিক অর্থনীতির। একজন পড়ে তো আরেকজন ওঠে। জোগান চলতেই থাকে। নিচ থেকে ওপরে সম্পদ ও সুযোগ দখলের রাজনৈতিক অর্থনীতিতে এদের দরকার দুই কারণে। এঁরা কেন্দ্রে থাকা প্রতাপশালী ব্যক্তিদের নোংরা কাজগুলো করে দেন। তাঁদের অর্থ ও ক্ষমতার কারবারের যে রশি টানা আছে, এঁরা তার একেকটি গিঁট। আবার ওপর থেকে নিচের মহলে ক্ষমতা ও ইনাম বণ্টনের মাধ্যমও এরাই। 

নিয়মিত গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন যে দেশে পাকাপোক্ত সেই দেশে মাফিয়াচালিত রাজনৈতিক অর্থনীতি মূল খাত হয় না। বাংলাদেশে হয়, কারণ তেমন ‘ভালো’ গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের সুন্দর পরিবেশ এই দেশে আছে। ভঙ্গুর গণতন্ত্র ও দুর্বৃত্ত অর্থনীতি এই ধরনের ‘লিজেন্ড’ ‘গডফাদার’ ‘আম্মাজান’, ‘বড় ভাই’, ‘বস’, ‘দাবাং’ চরিত্রের উর্বর অভয়াশ্রম। বসবাসের অযোগ্য, চরম বৈষম্যপূর্ণ, নোংরা ও অপরাধে ভরা মহানগরগুলোতে এরা গড়ে তোলে শাদ্দাদের স্বর্গ, আলিশান প্রাসাদ। মজা ও মানিকে (অর্থ) একাকার করে ফেলার ওস্তাদি এখানেই জমে। 

গত এক দশকে যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক রূপান্তর বাংলাদেশে ঘটেছে, তার আলো-আঁধারিতে এদের বিচরণ। অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাতের মতে, কালোটাকার পরিমাণ জিডিপির ৪২-৮০ শতাংশের মধ্যে। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ সাড়ে ১৭ লাখ কোটি টাকা; যা তিনটি বাজেটের সমান। আর পুঞ্জীভূত কালোটাকার পরিমাণ ৩০ থেকে ৪০ লাখ কোটি টাকা; যা বর্তমানের দুটি জিডিপির সমান। আদর করে একে ইনফর্মাল ইকোনমি ডাকা হলেও আসলে তা ডাকাতির কারবার। সাম্প্রতিক বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি ও অর্থ পাচার কিংবা রানা প্লাজা ও হল–মার্ক কেলেঙ্কারিকেও এরা ছাপিয়ে যাচ্ছে। 

সমাজে অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা যত বেশি ততই এদের মওকা বাড়ে। এদের ক্যারিয়ারে টাকার খেলাকে সঙ্গ দেয় নারী, মদ আর ফুর্তি। সাধারণত এদের পারিবারিক জীবন হিন্দি সিরিয়ালের মতো কুটিল এবং যৌনজীবন হয় বিকৃত। ভোটের রাজনীতিতে সম্ভাবনা বজায় রাখতে গ্রামেও এদের খুঁটি পোঁতা থাকে। দুর্বৃত্ত নেটওয়ার্ক তথা ‘ব্যবসায়িক সম্পর্ক’ তখন তাদের জয়ী করে। এসব চালাতে হলে তাদের থাকতে হয় আইনের ঊর্ধ্বে। আইনের লোকজনের সঙ্গে খাতির ছাড়া সেটা অসম্ভব। এরা রাষ্ট্রযন্ত্র ও দলীয় যন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। রাষ্ট্রের পাশাপাশি সমাজের অপরাধীকরণের লাঠিয়াল এরা। 

এরা গতিশীল, খোলস বদলাতে ওস্তাদ। নেতা থেকে ব্যবসায়ী, মাফিয়া থেকে এমপি, ব্যবসায়ী থেকে লাভজনক সংস্থার পদাধিকারী হওয়ার দৌড়ই এদের আত্মজীবনী। বিশ্বায়নের সুবাদে বিদেশে অবধি এদের দৌরাত্ম্য, অনেক সময় সেটাই ‘সেকেন্ড অপশন’। রাজনীতি ও অর্থনীতির নিত্যনতুন সুযোগ হাসিল করায় চেইন অব কমান্ড বজায় রাখতে হয়। সেখানে গড়বড় হলেই পতন। 

এটা এমন এক সময়, যখন এক প্রজন্মেই কেউ ধনকুবের হয়ে যেতে পারে অথবা এক প্রজন্মেই বাদশাহ হয়ে যান ফকির। অনেক সময় গোনা সম্ভব হয় না বলে এরা টাকা বা স্বর্ণ ওজন দিয়ে পরিমাপ করে। অস্থিতিশীলতার ভয়ে রূপকথার গল্পের কায়দায় বালিশের মধ্যে কিংবা গর্ত খুঁড়ে টাকা রাখে। রাতারাতি এরা বিদেশে বড় শহরে বিরাট বিরাট ভবন বা প্রাসাদ কিনে ফেলে, করমুক্ত টাকা রাখার জায়গা না পেয়ে অবিশ্বাস্য মূল্যের ঘড়ি, আংটি বা গাড়ি কেনে। আখেরে সবকিছু ম্যানেজ করে ফেলার জাদু এরা জানে। এরা উদার, নরম মেরুদণ্ডের আদর্শহীন অভিযাত্রী। এরা দেখনেওয়ালা নয়, এরা করনেওয়ালা। তাই জনতা ও ক্ষমতার কাছে এরা দরকারি। টাকা বানাবার শিল্পকে এরা বসগিরির শিল্পে পরিণত করে। ফেসবুকে ভেসে বেড়ানো পাপিয়ার হাতের লাঠি সেই বসিংয়ের একটা প্রতীক। ভারতের ‘লেডি দাবাং’ পার্তিয়ালা রবির সঙ্গে তুলনা চলে তাঁর। 

বাংলাদেশের উন্নয়ন সত্যি সত্যি হচ্ছিল। একজন মানুষ এখানে পিঁপড়ার মতো ৮-১০ জনকে বহন করে যান, চাকরি বা কাজের জোগান দেন অনেকের। একজন প্রবাসী শ্রমিক, কিংবা একজন ছোট খামারি বা ব্যবসায়ী কিংবা ক্ষুদ্র শিল্পের মালিক এবং সমাজসংস্কারক ও প্রতিবাদীরা ছিলেন এই গল্পের নায়ক-নায়িকা। পরিশ্রম ও বুদ্ধি করে এক প্রজন্মে অবস্থা ফেরানোর আত্মবিশ্বাস অনেককেই উচ্চাভিলাষী করে তুলেছিল। তার সুফল দেশ পেয়েছে। তাদের হটিয়ে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে সম্রাট ও সম্রাজ্ঞী পাপিয়ারা। এরা একজনে লক্ষজনের সুযোগ ও সম্পদ আত্মসাৎ করে উন্নয়নের চাকাটাকে সত্যিই ভেঙে ফেলছে। ক্ষমতা ও বিত্ত হাতানোর এই ‘গোল্ড রাশ’ কতটা ভয়াবহ, সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান ও রাজনৈতিক চালচিত্র তা হাড়ে–মাংসে বুঝিয়ে দিচ্ছে। 

এরা বিচ্ছিন্ন কেউ নয়, এরা দুষ্ট অর্থনীতির নষ্ট নায়ক-নায়িকা। জনগণ এখানে পার্শ্বচরিত্রও নয়, ভুক্তভোগী দর্শকমাত্র। 

  • ফারুক ওয়াসিফ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
  • কার্টসি - প্রথম আলো/ ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২০ 

নয়া সম্রাট ও নয়া সম্রাজ্ঞী বা পাপিয়া-কাহিনি

সোহরাব হাসান

বাংলাদেশ হলো খবরের কারখানা। যাঁরা মনে করেন দেশে রাজনীতি নেই বলে খবরও নেই, তাঁরা ভুল করেন। প্রতিদিনই নতুন নতুন খবর পাওয়া যায়। আগের খবরটি থেকে পরের খবরটিতে আরও বেশি চমক থাকে।

গত বছর সেপ্টেম্বরে যখন ক্যাসিনো-রাজা ইসমাইল হোসেন সম্রাট ধরা পড়লেন, তখন অনেকেই অবাক হয়েছিলেন, নিষিদ্ধ ক্যাসিনোর দেশে ক্যাসিনো-সম্রাট। তিনি আবার যুবলীগের নেতাও। এরপর আরও ক্যাসিনো-মোগল ধরা পড়লেন। কিন্তু কয়েক দিন পরই আবিষ্কৃত হলো বাংলাদেশে শুধু ক্যাসিনো-সম্রাট নেই, টেন্ডার-সম্রাটও আছেন। এক জি কে শামীম সরকারের গণপূর্ত বিভাগের প্রায় অর্ধেক কাজ বাগিয়ে নিয়ে গেছেন। এ কারণে সরকারের মন্ত্রী-নেতাদের সঙ্গে তাঁর দহরম-মহরমের কথাও চাউর হয়ে যায়। পরে আরও জানা গেল, কেবল আওয়ামী লীগ সরকার নয়, বিএনপির সরকারের হোমরাচোমরাদের সঙ্গেও তাঁর দারুণ মহব্বত ছিল। সরকার বদলায়, এঁরা বদলান না। সে সময়ে শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে বাহবা নেওয়ার চেষ্টা করেছিল সরকার। বলা হয়েছিল, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগকে এবার তারা পূতপবিত্র করে ছাড়বে।

কিন্তু পাঁচ মাস না যেতেই ক্ষমতাসীনদের ডেরা থেকে আরেক সম্রাজ্ঞী আবির্ভূত হলেন। তাঁর কাহিনি অতীতের যেকোনো রোমাঞ্চকর কাহিনিকে ছাড়িয়ে যাবে। আমরা আরব্য উপন্যাসে নানা অবিশ্বাস্য কাহিনির কথা শুনেছি। সেখানে দৈত্যদানো, রাজা-রানির বিচিত্র ঘটনা দেখে যাঁরা বিস্মিত হতেন, তাঁরা বাংলাদেশের নতুন সম্রাজ্ঞী শামীমা নূর পাপিয়ার কাহিনি দেখে ভিরমি খাবেন। আরব্য উপন্যাস হাজার বছর আগের। আর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশে যে সম্রাজ্ঞীর কাহিনি বের হলো, তার কাছে আরব্য উপন্যাস কিছুই না। কেননা, আরব্য রূপকথাকে আমরা রূপকথা হিসেবেই জানি।

কিন্তু বাংলাদেশের সম্রাজ্ঞীর কাহিনি কোনো রূপকথা নয়; নিরেট বাস্তব। পত্রিকায় ও সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে তাঁর যেসব ছবি প্রকাশিত হয়েছে, তার কোনোটিতে দেখা যায় তিনি চুল উঁচু করে বেঁধে নরম সোফায় লাঠি হাতে বসে আছেন। আবার কোনো ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। 

গত শনিবার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে পাপিয়া (২৮), তাঁর স্বামী মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরী ওরফে মতি সুমন (৩৮), তাঁদের সহযোগী সাব্বির খন্দকার (২৯) ও শেখ তায়্যিবা (২২) গ্রেপ্তার হন। র‍্যাবের দাবি, তাঁরা পালিয়ে যাচ্ছিলেন।

তাহলে কি কোনো মহল তাঁকে বিদেশে পার করে দেওয়ার চেষ্টা করছিল? না হলে যে সম্রাজ্ঞী পাঁচতারা হোটেলে মাসের পর মাস থাকতেন, তাঁকে ধরতে বিমানবন্দর পর্যন্ত যেতে হলো কেন?

গ্রেপ্তারের পর পাপিয়াকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুব মহিলা লীগ। যেন এত দিন পাপিয়ার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তারা কিছুই জানত না। হঠাৎ তাদের হুঁশ ফিরে এসেছে। এ রকম ঘটনা ঘটেছে ক্যাসিনো-সম্রাট ও অন্যদের ক্ষেত্রেও। যখনই দেখা যায় ক্ষমতাসীন সংগঠনের কোনো নেতা বা সদস্যের অপকর্ম ফাঁস হয়ে গেছে, তখনই সংগঠন তাঁকে বহিষ্কার করে।

র‍্যাব-১-এর অধিনায়ক শাফিউল্লাহ বুলবুল জানিয়েছেন, পাপিয়া জাল টাকা, অবৈধভাবে টাকা পাচার, অবৈধ অস্ত্র রাখাসহ বেশ কিছু অপরাধ করেছেন। পাপিয়া পাঁচ তারকা মানের বিভিন্ন হোটেলে নারীদের দিয়ে অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতেন বলে অভিযোগ করেছে র‍্যাব। ওই সব কর্মকাণ্ডের কিছু ভিডিও পাওয়া গেছে। এত সব অপরাধের জড়িত থাকার পরও নাকি পাপিয়ার নামে কোনো মামলা হয়নি। তিনি বিমানবন্দরে ধরা না পড়লে হয়তো যুব মহিলা লীগ তাঁকে সৎ ও সাচ্চা কর্মী হিসেবে সার্টিফিকেট দিত। পত্রিকায় রিপোর্ট হলে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে হইচই করে উঠত।

এবার দেখা যাক একটি জেলা কমিটির যুবলীগ নেত্রী কী কী সম্পদের মালিক হয়েছেন। একটি পাঁচ তারকা হোটেলে বুকিং দেওয়া বিলাসবহুল প্রেসিডেনশিয়াল স্যুইট এবং ইন্দিরা রোডের ফ্ল্যাট থেকে র‍্যাব ১টি বিদেশি পিস্তল, ২টি পিস্তলের ম্যাগাজিন, ২০টি পিস্তলের গুলি, ৫ বোতল দামি বিদেশি মদ, ৫৮ লাখ ৪১ হাজার টাকা, ৫টি পাসপোর্ট, ৩টি চেকবই, কিছু বিদেশি মুদ্রা, বিভিন্ন ব্যাংকের ১০টি ভিসা ও এটিএম কার্ড উদ্ধার করে। র‍্যাব জানায়, পাপিয়া ও তাঁর স্বামীর মালিকানায় ইন্দিরা রোডে দুটি ফ্ল্যাট, নরসিংদীতে দুটি ফ্ল্যাট ও ২ কোটি টাকা দামের দুটি প্লট, তেজগাঁওয়ে এফডিসি ফটকের কাছে গাড়ির শোরুমে ১ কোটি টাকার বিনিয়োগ ও নরসিংদী জেলায় একটি প্রতিষ্ঠানে ৪০ লাখ টাকার বিনিয়োগ আছে।

অবৈধ অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, অনৈতিক কর্মকাণ্ড, জাল নোট সরবরাহ, রাজস্ব ফাঁকি, অর্থ পাচারসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। র‌্যাব বলছে, গত ১২ অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে এই দম্পতি পাঁচ তারকা হোটেলের কয়েকটি বিলাসবহুল কক্ষে অবস্থান করেন। এ জন্য তাঁরা পরিশোধ করেন ৮১ লাখ ৪২ হাজার টাকা। এই অর্থের উৎস সম্পর্কে সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি এই দম্পতি।

২০১০ সালে নরসিংদী শহর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক করা হয় পাপিয়াকে। সর্বশেষ ২০১৮ সালে তাঁকে জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক করা হয়। নরসিংদীর মেয়র কামরুজ্জামান কামরুল সমকালকে বলেন, পাপিয়াকে যুবলীগ নেত্রী বানানোর সময় স্থানীয় নেতা-কর্মীরা বিরোধিতা করেছিলেন। তবে কেন্দ্রীয় নেতারা তা আমলে নেননি। কাউন্সিল শেষে এলাকায় নয়, পাপিয়ার নাম ঘোষিত হয় ঢাকা থেকে।

শামীমা নূরকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘অপরাধ অনুযায়ী অপরাধী শাস্তি পাবে। সরকার দলের হোক কিংবা বাইরের হোক, কোনো অপরাধীকে পার পেয়ে যেতে দেয়নি। সব অপরাধীকেই বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। পাপিয়ার পরিচয় যেটাই হোক, অপরাধী হিসেবে এবং অপরাধ অনুযায়ী বিচার হবে।’ কিন্তু তিনি যে কথাটি বলেননি, তা হলো পাপিয়ারা কীভাবে তৈরি হন। কারা তৈরি করেন? তাঁদের কাছ থেকে কারা, কী সুবিধা নিয়েছেন।

আমরা ছোটবেলায় ‘লাইলি-মজনু’ ছবি দেখেছি। পরে এসেছে, ‘নয়া লাইলি নয়া মজনু’। বাংলাদেশের রাজনীতিতেও নয়া সম্রাট ও নয়া সম্রাজ্ঞীদের আবির্ভাব ঘটে চলেছে। যে রাজনীতি সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীদের তৈরি করে, সেই রাজনীতিকে শুদ্ধ করতে না পারলে এ রকম লোকদেখানো অভিযানে কোনো কাজ হবে না। একজন সম্রাট বা সম্রাজ্ঞী ধরা পড়বে। হাজারো সম্রাট ও সম্রাজ্ঞী ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে।

সহকর্মী ফারুক ওয়াসিফ কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছিলেন, ‘এত দিন কোথায় ছিলেন?’ তাঁর বক্তব্যটি আরেকটু সংশোধন করে বলতে হয়, এত দিন তাঁকে কোথায় রেখেছিলেন?

  • সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
  • কার্টসি - প্রথম আলো/ ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২০ 

Saturday, February 22, 2020

পদকের অবনমন!

সাখাওয়াত সায়ন্ত

১৯৯৫ সালে একুশে পদক প্রাপ্ত বিশিষ্টজনের সাথে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ফেব্রুয়ারি ২০, ১৯৯৬, পদক প্রধান করা হয়, 

’৫২-এর ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য একুশে পদক এবং ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, শিক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা, জনসেবা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, সঙ্গীত, খেলাধুলা, শিল্পকলা, উন্নয়নসহ ইত্যাদি বিষয়ে বিশেষ অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারও চালু করেছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম।

১৯৭৬ সালে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান চালু করেন একুশে পদক। তাঁর সময়ে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ড. মুহাম্মদ কুদরত-ই-খুদা, কবি সুফিয়া কামাল, সাহিত্যিক সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দিন, সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, কবি শামসুর রাহমান, সঙ্গীতশিল্পী আবদুল আলীম, লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, শিল্পী আলতাফ মাহমুদ, কবি আহসান হাবীব, শিল্পী আবদুল লতিফ, সাহিত্যিক আবুল হোসেন, চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর, সাহিত্যিক রাহাত খানসহ অনেককে সম্মানিত করা হয় একুশে পদক দিয়ে।

বিএনপি সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে বেগম খালেদা জিয়ার সময়ে সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ, সাংবাদিক আতাউস সামাদ, লেখক আহমেদ রফিক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ, শিল্পী মুস্তাফা জামান আব্বাসী, শিক্ষাবিদ ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীসহ আরো অনেককে এ পদকে ভূষিত করে সম্মানিত করা হয়।

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার হলো ‘স্বাধীনতা দিবস’ পুরস্কার। আজ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা এ পদক পেয়ে গর্বিত হচ্ছেন তারা কি জানেন, শহীদ  জিয়াই এ পদক চালু করে তাদের সম্মানিত করার ব্যবস্থা করেছিলেন?

১৯৭৭ সালে প্রথমবারের মতো দেয়া হয় এ পদকটি। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তার সময়েই মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ডা: মোহাম্মদ ইব্রাহীম, শিল্পী রুনা লায়লা, কবি জসীমউদ্দীন, কবি শামসুর রাহমান, রণদা প্রসাদ সাহা, সঙ্গীতজ্ঞ সমর দাস, সাহিত্যক আবুল মনসুর আহমদ, প্রফেসর কাজী মোতাহার হোসেন, শিল্পী ফিরোজা বেগম, চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান, শহীদ মুনীর চৌধুরী, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, কবি ফররুখ আহমদসহ অনেক গুণীজনকে এ পদক দিয়ে সম্মানিত করেন।

১৯৯১ সালে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সময়েও অনেক গুণীজন ও প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনতা দিবস পদক দিয়ে তাদের অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সম্মান দেয়া হয়। এদের মধ্যে রয়েছেন জহির রায়হান, আর্টিস্ট এস এম সুলতান, কবি আহসান হাবীব, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদসহ অনেকে। প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও প্রামীণ ব্যাংকসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।

পদকপ্রাপ্ত এসব ব্যক্তির নাম দেখলেই বোঝা যায় প্রকৃত গুণীজনদের সম্মানিত করার ক্ষেত্রে দলীয় পরিচয়কে কখনোই প্রাধান্য দেননি প্রেসিডেন্ট জিয়া কিংবা বেগম খালেদা জিয়া।
কিন্তু বর্তমানে কী হচ্ছে?

দু'টি ক্ষেত্রেই প্রশ্ন উঠেছে। এমন সব ব্যক্তিদের পদক/পুরস্কার দেওয়া হয়েছে যে তাদের সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, প্রথম সারির জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক পর্যন্ত চিনেন না। বিশেষ করে সাহিত্যে।

তাই স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, এই পদক/পুরস্কার দু'টি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান প্রবর্তন করেছিলেন বলেই কী তাকে এই ভাবে অবনমন করা হচ্ছে?

আওয়ামী লীগ কোন ক্ষেত্রেই দলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠতে পারে না এটা হয়তো সবারই জানা। কিন্তু তাদের দলীয় গণ্ডিতে কী যোগ্য লোকের এতোই অভাব পড়েছে যে অখ্যাত অজানা লোক যাদের কী সাহিত্য কর্ম আছে তা সাহিত্য- সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত প্রায় কেউই জানেন না?
একুশে পদক ও স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারের মতো উঁচুমানের জায়গাটাকেও এভাবে অবনমন সত্যিই মানা যায় না!

Thursday, February 20, 2020

খালেদা জিয়ার জামিন কোন পথে

সায়ন্থ সাখাওয়াৎ


এক-এগারোর বিশেষ সরকারের সময় দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের দুই প্রধান নেত্রীর নামেই মামলা হয়েছিল। জেলে যেতে হয়েছিল দুজনকেই। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নামে ৫টি ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নামে ১৫টি মামলা হয়ে ছিল তখন। সেই বিশেষ সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে যে বিশেষ নির্বাচনটি হয়েছিল তাতে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। তখন থেকেই বাড়তে থাকে খালেদা জিয়ার নামে মামলার সংখ্যা। ৫ মামলা বেড়ে হয়ে যায় ৩৬টি। আর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে থাকা ১৫টি মামলা খারিজ হয়ে যায় বা বাদী প্রত্যাহার করে নেন। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ ও সরকারের সমর্থকদের সরলীকরণ বক্তব্য, শেখ হাসিনার মামলাগুলো আদালতের মাধ্যমে আইনানুগভাবে ফয়সালা হয়েছে।

তাদের কাছে এবং দেশাবাসীর কাছে যদি আরও দুটি সরল প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়, তবে তার উত্তর কী হতে পারে? এক. এক-এগারো সরকার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যে মামলাগুলো করেছিল তার সবগুলোই মিথ্যা, অপরদিকে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে মামলা করেছিল তার সবগুলোই ঠিক ছিল? দুই. ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না এসে যদি বিএনপি আসত আর খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হতেন তাহলেও কী দুই নেত্রীর মামলার পরিণতি এখন যা হয়েছে তাই হতো? মানে প্রধানমন্ত্রী হলেও খালেদা জিয়ার এখনকার মতোই সাজা, জেল, পছন্দমতো সেন্টারে চিকিৎসা না পাওয়া- এগুলোই ঘটত? আর শেখ হাসিনার নামে থাকা সব মামলা ‘আইনানুগ ভাবেই’ খারিজ হয়ে যেত অথবা বাদীরা নিজ উদ্যোগে মামলা তুলে নিতেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তরের মধ্যেই নিহীত আছে বাংলাদেশের আদালতের প্রতি জনমানুষের আস্থার মানদন্ড। এ দেশে রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে আদালতের রায়ের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, সেটাও বেরিয়ে আসবে এই প্রশ্নের উত্তরের মাধ্যমেই। এইবার উত্তরগুলো সৎভাবে দিয়ে নিজের বিবেকের সঙ্গে মিলিয়ে নিন। তারপর বলুন, খালেদা জিয়া প্রতিহিংসার শিকার কি না? একদেশে এক আইন সবার বেলায় একভাবে প্রয়োগ হচ্ছে কি না সেটাও ভেবে দেখার বিষয়।

আওয়ামী লীগ নেতা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক দুর্নীতির দায়ে ১৩ বছরের সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার পরও জামিন পেতে পারেন, মন্ত্রী থাকতে পারেন। সাবেক মন্ত্রী ও সাবেক বিএনপি নেতা অধুনা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্য তৈরি করা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদাও সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার পর জামিন পেতে পারেন। জাতীয় পার্টির সাবেক চেয়ারম্যান প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জীবিত থাকাকালে আমৃত্যু জামিন ভোগ করে যেতে পারেন। কিন্তু খালেদা জিয়া বারবার আবেদন করেও জামিন পান না। এই যে এক আইনে বিচারের দুই ফল, সেটাই অনেকের মনে এই ধারণা দেয় যে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিন বিশেষ কারণে সুতোর টানে আটকে আছে। আর তার পেছনে আছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার পরও অনেকে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারেন। কিন্তু গুরুতর অসুস্থ হওয়ার পরও খালেদা জিয়া সে অধিকারটুকুও পান না।

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে মামলায় সাজা দেওয়া হয়েছে তার উদ্দেশ্য নিয়ে জনমনে আছে অনেক প্রশ্ন। সে মামলার বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস সেক্রেটারি সাংবাদিক মারুফ কামাল খান লিখেছেন, এই যে এত হেনস্তা যে মামলাটি নিয়ে সেই জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার কখনো কোনো ধরনের কোনো সম্পর্কই ছিল না। তিনি এই ট্রাস্টের চেয়ারম্যান, মেম্বার, ট্রাস্টি কিছুই নন।

ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিন জামানায় দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক এ মামলাটি দায়ের করে। মামলায় প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা অভিযোগের সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার কোনো রকম সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি বলে রিপোর্ট দেন। তিনি আদালতে তার সাক্ষ্যেও সে কথা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছেন। পরবর্তীকালে অধিকতর তদন্তের নামে দুদকের আরেকজন কর্মকর্তাকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেই কর্মকর্তা মামলায় বেগম খালেদা জিয়াকেও অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেন। কুয়েত থেকে পাওয়া অনুদানের অর্থে গঠিত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের প্রাথমিক মূলধন ছিল ২ কোটি ৩৩ লাখ ৩৩ হাজার ৫শ টাকা। এই টাকা থেকে বগুড়ায় এতিমখানা স্থাপনের জন্য প্রায় পৌনে তিন একরের বেশি জমি কেনার পর বাকি সমুদয় টাকা ট্রাস্টের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রাখা হয়। সরকারি ব্যাংকের তুলনায় বেসরকারি ব্যাংকে সুদের হার বেশি হওয়ায় ট্রাস্টের টাকা বেসরকারি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়। তিনটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সেই টাকা জমি কেনার পরেও সুদাসলে বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ৮৮ লাখ ২৫ হাজার টাকারও বেশি।

তারপরেও খালেদা জিয়ার সাজা হয়েছে। প্রথমে পাঁচ বছর। পরে তা বেড়ে দশ বছর হয়েছে। আগেই বলেছি, এর থেকে বড় সাজা নিয়েও অনেকের জামিন পাওয়ার নজির আছে। কিন্তু খালেদা জিয়ার বেলায় ভিন্ন ফয়সালা। কেন এমনটা হচ্ছে সে প্রশ্নই জেগেছে মানুষের মনে।

খালেদা জিয়া কে, তা নতুন করে চিনিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। প্রথমত তিনি এই দেশের একজন সিনিয়র সিটিজেন বা প্রবীণ নারী। তিনি তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। দেশের জনপ্রিয়তম শীর্ষ রাজনৈতিক নেত্রী যিনি জীবনে কোনো নির্বাচনে পরাজিত হননি। দেশের অন্যতম একটি রাজনৈতিক দল বিএনপির প্রধান। এই দেশেরই সাবেক রাষ্ট্রপতি, সাবেক সেনাপ্রধান, সেক্টর কমান্ডার ও একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী। তিনি আজ বন্দি অবস্থায় গুরুতর অসুস্থ। তারপরও তিনি কেন জামিন পান না? তিনি কি জামিন পেলে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে পারেন? তিনি এই মামলাকে প্রভাবিত করতে পারেন? খালেদা জিয়া যে তেমন ব্যক্তি নন এটা সেটাও বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে তাকে জামিন দিতে অসুবিধা কোথায়, সে প্রশ্নটি এখন দেশের প্রধান আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, খালেদা জিয়ার এই সব পরিচয়ের কোনোই মূল্য নেই আদালতের কাছে। জামিনের জন্য এর কোনো উপাদানই আমলযোগ্য নয়। কিন্তু আইন বিষয়ে দীর্ঘদিন লেখালেখি করা সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান দুদিন আগেই প্রথম আলোতে লিখেছেন, ‘বিদ্যমান আইন বলছে, নারী, বিশেষ করে তিনি যদি প্রবীণ নাগরিক হন এবং তার স্বাস্থ্য সমস্যা থাকে, তাহলে তিনি জামিন পেতে বিশেষ বিবেচনার হকদার।’ 

তাহলে কেন প্রাপ্য হক থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে এই প্রবীণ রাজনীতিবিদকে? এই দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে খালেদা জিয়ার যে সাহসী ভূমিকা রয়েছে সেটাও কয়জন নেত্রীর আছে? খালেদা জিয়ার মুক্তি মিলবে কি না আর মিললে তা কী পদ্ধতিতে ঘটবে সেটাই এখন দেশজুড়ে আলোচনার বিষয়। সরকারি দলের নেতা ও মন্ত্রীদের কথা শুনে মনে হচ্ছে, তারা চান খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তির জন্য আবেদন করুন। খালেদা জিয়ার অসুস্থতার মাত্রা ও জনআকাক্সক্ষা বিবেচনায় যদি মুক্তি দিতেই হয়, সে ক্ষেত্রেও সরকার যেন দেখাতে পারে যে তাদের অনুকম্পা নিয়ে, তাদের সঙ্গে আপোস করেই জামিন নিতে হয়েছে তাকে। অর্থাৎ খালেদা জিয়া আর আপোসহীন নন, তিনি আপোসকামী নেত্রী।

অনেকেই মনে করেন, তার জন্য কাল হয়েছে অপরাজিত জনপ্রিয় ও ‘আপোসহীন নেত্রী’ অভিধাটি। খালেদা জিয়া ‘আপোসহীন নেত্রী’ উপাধি নিয়ে থাকবেন সেটা মেনে নেওয়া অনেকের জন্য কষ্টকর হতেই পারে। তাই তারা চান, খালেদা জিয়া যেন প্যারোলে মুক্তির জন্য আবেদন করেন। যাতে তারা বলতে পারেন যে ‘আপোসহীন নেত্রী’ তো আপোস করলেন। তাই বিএনপির একটা অংশ প্যারোলে মুক্তি চাওয়ার বিরুদ্ধে। কিন্তু তাদেরও মনে রাখা দরকার, খালেদা জিয়াকে সুচিকিৎসা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখাটাও জরুরি। তাকে সাজা দিয়ে যদি আটকে রেখে, চিকিৎসার সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে, তবে যে কোনো কৌশল অবলম্বন করে সে ফাঁদ থেকে বেরিয়ে এলে তাতে আপোসহীন চরিত্র ক্ষুণ্ণ হয়ে যাবে এমনটা ভাবারও কোনো কারণ নেই। প্যারোলে মুক্তি তো এর আগেও নিয়েছেন দুই নেত্রীই। সুতরাং প্যারোল বা আদালতে আবেদনের মাধ্যমে মুক্তি নিয়ে চিকিৎসা করানো হলো সেটা বড় বিষয় নয়। বরং শঙ্কাটা অন্য জায়গায়। প্যারোলে মুক্তির আবেদনের পর এই সরকার সেটা নিয়ে আবার কোনো নাটক ফেঁদে বসবে কিনা সেটাই বা কে জানে। শেষ পর্যন্ত প্যারোলেও মুক্তি হবে নাকি খালেদা জিয়াকে জেলেই মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হবে সে প্রশ্নও অনেকের মনে আছে।        

  • লেখক- চিকিৎসক ও কলামিস্ট
  • কার্টসি - দেশ রূপান্তর/ ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২০

Wednesday, February 19, 2020

একজন খালেদা জিয়া

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও মুজতবা খন্দকার


বেগম খালেদা জিয়া 



একজীবনে একজন মানুষের যা কিছু পাওয়ার থাকে,সব তিনি পেয়েছেন। গৃহবধূ  থেকে দেশের সরকার প্রধান।  কি আর থাকে বাকি! নির্বাচন যদি একজন রাজনীতিকের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের মাপকাঠি হয়ে থাকে, তবে নি:সন্ধেহে তিনি সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা। কোনো নির্বাচনে তিনি হারেননি। জনগন তাকে সব সময় বসিয়েছে সর্বশ্রেষ্ঠ আসনে। জনগনকে কিছুমাত্র কমও দেননি তিনি। হেঁসেল থেকে রাজপথে তপ্তরোদকে উপেক্ষা করে দীর্ঘ নয়বছর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। পেয়েছেন, আপোষহীন রাজনীতিকের সুখ্যাতি। সরকার গঠন করে, নারী প্রগতির জন্য গ্রহন করেছেন এক একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। নারী শিক্ষা বাধ্যতামূলক,  বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা সবই তাড় হাত ধরে সূচিত হয়েছে,এই দেশে। রাষ্ট্রের যা কিছু ভালো,কল্যানকর সবই তার সুযোগ্য নেতৃত্বেই এসেছে।

জীবন সায়ান্বে এসে, তিনি কথিত চোরের অপবাদ নিয়ে বন্দি জীবন কাটাতে হচ্ছে তাঁকে। উপযুক্ত চিকিৎসা সেবাও দেয়া হচ্ছেনা তাকে। ধীরে ধীরে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন,অথচ আমরা সবাই কেমন নির্বিকার। তাকে জামিনে মুক্তি দেয়া হবে কি না, তা নিয়ে পুতুল খেলায় মেতে উঠেছে সরকার। যারা তার তিল পরিমান সমালোচনার যোগ্যতা রাখেনা, তারাই এখন সকাল বিকাল তাকে নিয়ে মশকরা করছে। যারা লুটপাট করে,দেশকে ফতুর করে দিয়েছে, তারাই এখন তাকে চোর বলতেও কসুর করছেনা। সবই তার ট্রাজেডি।  প্রতিহিংসারর রাজনীতি করেননি কখনো, রিকনসিলিয়েশনের কথা বলতেন, অথচ তাঁকেই চরমপ্রতিহিংসার শিকার হতে হয়েছে। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের নেতা হয়েও.  তার কারবন্দিত্বের অবসানে তার দল কাতর মিনতি ছাড়া আর কার্যত কিছুই করতে পারছেনা। মূলত: দলটির নেতৃত্বভাগের অযোগ্যতা এবং দূরদর্শীতার অভাব তার বন্ধিত্বকে প্রলম্বিত করে চলছে।

বেগম জিয়ার ওপর প্রতিশোধ নেয়া কি শেষ হবে না। সম্ভবত না। তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করাই যেন শাসকদলের ইচ্ছা। বলা হচ্ছে, তাঁকে প্যারোলে মুক্তি দেয়া হতে পারে, যদি তিনি চান। তাঁরা বলছে,প্যারোলে মুক্তি মানে খালেদা জিয়ার রাজনীতিক মৃত্যু। অথচ, তাঁরা জানেনা, খালেদা জিয়ার মৃত্যু নেই, খালেদা জিয়ার ইতিহাসে অমরত্বের আসন আগেই নিশ্চিত হয়ে গেছে। আর প্যারোল মানে যদি রাজনৈতিক মৃত্যু হয়, তবে শেখ হাসিনার সে মৃত্যু হয়েছে বহু আগে, ওয়ান ইলেভেনের সময়, যে সময় তিনি প্যারোলে মুক্তি পেয়ে বিদেশে চলে গিয়েছিলেন।

প্রত্যেক মানুষকেই একদিন মরতে হবে। কিন্তু বেগম জিয়ার মৃত্যু নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের যতসব অয়োজন দেখে দু:খের মধ্যেও কৌতুকবোধ করছি। একজন মানুষকে এত ভয়, এত পরোয়া ওদের!
ভুলে যাই আমরা, একটি প্রতিহিংসা হাজারটা প্রতিহিংসার জন্ম দেয়... এক মাঘে শীত যায়না... তাই একজন খালেদা জিয়াকে মৃত্যু নিশ্চিত করে রাজনীতির মাঠ নিষ্কন্টক করার স্বপ্ন হয়তো দিবাস্বপ্নই থেকে যাবে ওদের। খালেদা জিয়া এখন শুধু একজন মানুষের নাম নয়, অটোক্রেটিক সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নিয়োজিত সকল বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণাও বটে!

দুই

খালেদা জিয়া ১৯৭১ সালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অন্তরীণ
২০১৮ তে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে কারাবন্দী


বাঙালি কমান্ডো মেজর জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বদলি হয়ে চট্টগ্রাম আসেন, সাথে সুন্দরী স্ত্রী খালেদা খানম পুতুল ও দুই শিশু সন্তান পাঁচ বছর বয়সী তারেক রহমান (জন্ম — নভেম্বর ২০, ১৯৬৫) ও ৭ মাসের আরাফাত রহমান কোকো (জন্ম — আগস্ট ১২, ১৯৭০)। ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে মেজর জিয়াউর রহমানের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর তার আর কোয়ার্টারে ফেরা সম্ভব হয়নি, সাথের সেনানীদের নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়েছিল। অন্য বাঙালি সেনানীদের পরিবারের মতো ক্যান্টনমেন্টে রয়ে গেল মেজর জিয়ার পরিবার-পরিজনও। পাকিস্তানি সৈন্যরা চট্টগ্রাম দখল নিলে, বাঁচার তাগিদে দুই শিশুসন্তান নিয়ে প্রায় দেড় মাস চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করার পর অতর্কিতে একদিন কালো বোরকা পরে সপুত্র খালেদা খানম পুতুল মোটরলঞ্চে চট্টগ্রাম ছেড়ে মে ১৬,  ১৯৭১ নারায়ণগঞ্জ পৌঁছেন [ সূত্র — মাহফুজউল্লাহ, ‘ Begum Khaleda Zia- Her life, Her History , দি ইউনিভারসাল একাডেমি, ঢাকা ২০১৮] । সেখান থেকে বড়বোন খুরশীদ জাহান ও ভগ্নিপতি মোজাম্মেল হক একটি রেডক্রস চিহ্নিত জিপে করে তাদের ঢাকায় এনে ধানমণ্ডিতে এক বন্ধুর বাড়িতে প্রায় দুই সপ্তাহ বসবাসের ব্যবস্থা করেন। একই সময়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা, এ কে এম আহসান CSP-এর বাড়িতে অন্তরীণ ছিলেন। পরে খালেদা সপুত্র ক্ষুদ্রঋণের উদ্ভাবক কুমিল্লা একাডেমির মহাপরিচালক আখতার হামিদ খান ICS-এর যোগ্য সহকারী ম্যাগসাইসাই পুরস্কারপ্রাপ্ত গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি তাহেরুন্নেছা আবদুল্লাহর স্বামী পাকিস্তান জিওলজিক্যাল সার্ভের পরিচালক ভূতত্ত্ববিদ এম আবদুল্লাহর সিদ্ধেশ্বরীর বাড়িতে আত্মগোপনে থাকেন। তাদের অবস্থান নির্ণয়ের জন্য পাকিস্তান গোয়েন্দা বাহিনী ব্যাপক চিরুনি অনুসন্ধান চালায়। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ ও ক্যাপ্টেন আরিফ এম আবদুল্লাহর বাড়ি থেকে ১৯৭১ সালের ২ জুলাই খালেদা জিয়া ও তার শিশুসন্তানদের গ্রেফতার করে মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অন্তরীণ করে রাখে। ২১ আগস্ট মেজর জিয়া পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর মেজর জেনারেল জামসেদকে ‘বন্দী স্ত্রী খালেদা’ সাথে সম্ভ্রমের সাথে ব্যবহার করার জন্য একটি চিঠি পাঠান — 

‘Dear Gen. Jamshed, My wife Khaleda is under your custody. If you do not treat her with respect, I will kill you someday —  Zia’

জিয়ার চিঠিটা মেজর শাফায়াত জামিল বাংলাদেশে প্রবেশ করে দেওয়ানগঞ্জ থেকে পোস্ট করেছিলেন। [ সূত্র —  মেজর হাফিজউদ্দিন আহম্মেদ, বীর বিক্রম, ‘রক্তে ভেজা একাত্তর’ সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা ২০১৩।] 

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তানে সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করার পর, সপুত্র খালেদা খানম পুতুলকে অন্তরীণমুক্ত হন। 

কালের বিবর্তনে খালেদা খানম পুতুল পরিচিত হলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল—বিএনপি এর প্রধান খালেদা জিয়া রূপে এবং ১৯ মার্চ ১৯৯১ নির্বাচিত হলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। পরে খালেদা জিয়া আরো দু’বার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা সাময়িকী Forbes পরপর তিন বছর, ২০০৪ থেকে ২০০৬,  তাকে পৃথিবীর অন্যতম ‘প্রভাবশালী নারী’ চিহ্নিত করেছিলেন। ১৯৯১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সি সিনেট খালেদা জিয়াকে “Fighter for Democracy” সনদে সম্মানিত করেছিলেন।

খালেদা জিয়ার প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বকালে, বাংলাদেশের এতিমদের সহায়তার জন্য কুয়েতের আমির ১২ লাখ ৫৫ হাজার মার্কিন ডলার (৪ কোটি ৪৪ লাখ ৮১ হাজার টাকা) অনুদান পাঠান। ওই টাকা দিয়ে সেপ্টেম্বর ১৯৯৩ সালে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট স্থাপন করা হয় এবং বগুড়া ও ঢাকায় দুটো জমি কেনা হয়। দুই ট্রাস্টের কোনোটির ট্রাস্টি খালেদা জিয়া নন এবং প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কোনো লেনদেনের সাথে জড়িত ছিলেন না। ট্রাস্টের জমা ফিক্সড ডিপোজিটের টাকা বর্তমানে ৭ কোটি অতিক্রম করেছে।

৫ আগস্ট ২০০৯ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার অপব্যবহার ও অর্থ আত্মসাতের অতিযোগে দুর্নীতি দমন ৫ (২) ও পেনাল কোডের ৪০৯/১০৯ ধারায় মামলা দায়ের করে। বিশেষ জজ আদালতের বিচারক আখতারুজ্জামান খালেদা জিয়াকে ৫(২) ধারায় দোষী নির্ণীত করে ৫ বছর কারাদণ্ড ও ২ কোটি ১০ লাখ অর্থদণ্ড করে ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডস্থ পরিত্যক্ত শত একরের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠান। ২০১৯ সালে দণ্ড প্রদানকারী বিচারক আখতারুজ্জামান হাইকোর্টের বিচারপতি পদে উন্নীত হয়েছেন। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ হয়েছে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় আরো ৭ বছর কারাদণ্ডে।

উল্লেখ্য, কথিত দুর্নীতি মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে শাস্তি প্রদানের লক্ষ্যে ১৯৫৮ সালে দুর্নীতি দমন আইনে সংশোধন করে ৫(২) ধারা যুক্ত করা হয়েছিল।


উচ্চ আদালতে খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন এবং
অসম্পূর্ণ মেডিক্যাল রিপোর্ট


পরিত্যক্ত ঢাকা, কেন্দ্রীয় কারাগারের নির্জনতায় খালেদা জিয়া একাকিত্বের কারণে স্বভাবতই বিষণ্ণতা ও মানসিক অবসাদে আক্রান্ত হয়েছেন। সাথে তার পূর্বতন রোগগুলোর (১) বহুমূত্র (Diabetes), (২) উচ্চ রক্তচাপ (৩) শ্বাস-প্রশ্বাস সমস্যা (৪) রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের অবস্থার অবনতি হলে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে অক্টোবর ৬, ২০১৮ ভর্তি করা হয়। স্বতন্ত্র, নির্জন কোনায় কেবিনে।

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের নির্দেশে বিএসএমএমইউর ভিসি ডিসেম্বর ১০,  ২০১৯ একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করেন ৭ জন বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, কারাবন্দী খালেদা জিয়ার জেলে অর্জিত মানসিক অবসাদ ও বিষণ্ণতা নির্ণয় এবং চিকিৎসায় সক্ষম কোনো মানসিক রোগবিশেষজ্ঞকে বিএসএমএমইউর নির্ধারিত ৭ বিশেষজ্ঞ কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ওষুধ ছাড়া মাংসপেশি ও সন্ধির বিভিন্ন প্রকার ব্যায়াম ও ইলেকট্রিক চার্জ দিয়ে আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসা প্রদানকারী ফিজিওথেরাপিস্টকেও কমিটিতে রাখা হয়নি এবং তার পর্যবেক্ষণ মেডিক্যাল রিপোর্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

খালেদা জিয়ার মেডিক্যাল রিপোর্ট অসম্পূর্ণ। তার ‘রক্তচাপ ও কাশি সম্পৃক্ত হাঁপানি (Cough variant Asthma) পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন (Well Controlled)’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু পরিমাপ উল্লেখ করা হয়নি, বুকের এক্স-রে রিপোর্ট সংযুক্ত করা হয়নি।

তার “Recurreut Hyponatremia” কথা বলা হয়েছে অথচ দৈনন্দিন ব্লাড ইলেকট্রোলাইটস তথ্য রিপোর্টে উল্লেখ নেই। একইভাবে ডায়াবেটিসের পুরো তথ্য নেই এই নিমিত্তে HbAIC নিরূপণ করা অতীব প্রয়োজনীয়।

রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে সপ্তাহে মাত্র একবার ৭.৫ মিলিগ্রাম মেথোট্রেক্সেট (Methotrexate) তিন ট্যাবলেট সেব্য। তবে প্রয়োজনে ২.৫ মিলিগ্রাম করে সপ্তাহে বাড়ানো যায়। নখ ও চামড়ার রঙ পরিবর্তন, চোখের প্রদাহ, গলায় ব্যথা (Sore throat), যকৃতে সমস্যা যথা বমি বমি ভাব, পেটে অস্বস্তি, কালো প্রস্রাব এবং শ্বাসকষ্ট মেথোট্রেক্সটের পরিচিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। কবে ব্লাড কাউন্ট ও লিভার ফাংশন টেস্ট করা হয়েছিল এবং ফলাফল খালেদা জিয়ার মেডিক্যাল রিপোর্টে যুক্ত থাকা বাঞ্ছনীয় ছিল।

রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের সাথে যুক্ত সেকেন্ডারি সজোগ্রেন সিনড্রোমের কী কী উপসর্গ খালেদা জিয়ার চোখে, মুখে ও শরীরে পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং কী কী চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে তা খালেদা জিয়ার মেডিক্যাল রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়নি। এই রোগ নিরূপণের জন্য চক্ষুবিশেষজ্ঞ ও ডেন্টাল সার্জনের পরামর্শ নেয়া হয়েছে কি? হয়ে থাকলে তাদের অভিমত যুক্ত না করার কারণ কী?

বিশেষজ্ঞদের অভিমত হলো, মেথোট্রেক্সটে পর্যাপ্ত উন্নতি না হওয়ায় অপর একটি ইউমিউনো নিরোধক তসিলিজুমাব (Tocilijumab) ইনজেকশন নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এই ইনজেকশন নেয়ার আগে রক্তের পূর্ণ পরীক্ষা, লিভার ও কিডনির কার্যকারিতাও নির্ণয় করে নেয়া বাঞ্ছনীয়।

অসম্পূর্ণ মেডিক্যাল রিপোর্ট সম্পূর্ণ করে কারাবন্দী খালেদা জিয়াকে অবিলম্বে জামিন দেয়া হবে যৌক্তিক ও মানবিক ব্যাপার। এতে দেশের সর্বোচ্চ বিচারপতিদের ওপর জনগণের শ্রদ্ধা বাড়বে। এতদসঙ্গে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ মেডিক্যাল প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসাসেবায় অসুস্থ খালেদা জিয়ার আস্থাও কাম্য।

খালেদা জিয়াকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্ত্বনা


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদের ভাষ্যে বিএনপি নেত্রী বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কথিত ‘এতিমের টাকা চোর’।

চোর অভিযোগ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের উক্তি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য — ‘এগারো মাস মন্ত্রিত্ব করে ছিলাম। আমাকে চোর বলতে কারো বাধল না। আমি নাকি বলাকা সিনেমা হল করেছিলাম। আমাদের কিসমত যাদের জন্য রাজনীতি করি তাদের কেউ আমাদের বিশ্বাস করে না, এই তো দুনিয়া। জনাব সোহরাওয়ার্দীকে চোর বলেছে, হক সাহেবকে চোর বলেছে, নেতাজী সুভাষ বসুকে, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনকে এই বাঙালিরা চোর বলেছে, দুঃখ করার কী আছে?’

খালেদা জিয়া আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন? সুস্থ হলে অনুগ্রহ করে বইগুলো পড়বেন। 

  • কার্টসি — মুজতবা খন্দকারের ব্লগ
  • লিঙ্ক — https://bit.ly/2SXKqGD 


প্যারোলের রাজনীতি ও আইনের প্রশ্ন

কামাল আহমেদ

কান্ডারিহীন বিএনপি এবার প্যারোল রাজনীতির ফাঁদে পা দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। কেননা, প্যারোল অনুমোদন ও ব্যবস্থাপনার জন্য দেশে কোনো আইন নেই এবং তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইচ্ছাধীন ও পরিবর্তনশীল নীতিমালায় অনুশীলন করা হয়। অতএব, একজন সত্তরোর্ধ্ব ও অসুস্থ রাজনীতিকের প্যারোল নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও মন্ত্রীরাও মনের মাধুরী মিশিয়ে নানা ধরনের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। এমনকি, ১২ বছর একটানা ক্ষমতা ধরে রাখার সুবাদে অভ্যাসসূচক ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে চলেছেন। অবস্থাদৃষ্টে তাই প্রশ্ন উঠছে, আন্দোলন ও নির্বাচনের মতোই প্যারোলের রাজনীতিতেও কি বিএনপি বিভ্রান্তির কবলে পড়তে চলেছে?

প্যারোল কথাটা রাজনীতিতে নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশে অতীতে দুটো কারণে প্যারোলের কথা শোনা গেছে। একটি হচ্ছে মানবিক এবং অপরটি রাজনৈতিক। মানবিক কারণে প্যারোল বিএনপির প্রধান খালেদা জিয়া এর আগেও পেয়েছেন। ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যে বছরখানেক সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি একই ভবনে একই ধরনের কারাজীবন পার করছিলেন, সে সময়ে তাঁর মায়ের মৃত্যুতে তিনি প্যারোলে মুক্তি পেয়েছিলেন। আর, রাজনৈতিক কারণে যাঁরা প্যারোলে মুক্তি পেয়েছেন তাঁদের মধ্যে আছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অংশগ্রহণের অনুকূল পরিবেশ তৈরির শর্ত পূরণে তখনকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার এঁদের প্যারোলের ব্যবস্থা করে। রাজনীতির অন্দরমহলের খবর যাঁরা রাখেন, তাঁরা জানেন যে এসব প্যারোলের জন্য কাউকে মাঠে বক্তৃতা দিতে হয়নি এবং রাজনৈতিক চাপ অনুভব করার কারণেই তখন সরকার এগিয়ে এসে তার ব্যবস্থা করেছিল। স্বাধীনতার আগের ইতিহাসে না গেলেও পরের ইতিহাসে সুপরিচিত রাজনীতিকদের চিকিৎসার প্রয়োজনে প্যারোলের দৃষ্টান্ত আছে। যেমন, জাসদ নেতা আ স ম আবদুর রবের জার্মানিতে চিকিৎসার কথা এখানে স্মরণ করা যায়।

পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, পুত্র চিকিৎসাজনিত প্যারোল পেয়েছিলেন যত সহজে, মায়ের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় প্যারোল ততটাই কঠিন হয়ে দেখা দিয়েছে। পুত্রের প্যারোলের বিষয়ে তখন সরকার চাপ অনুভব করেছিল, আর এখন সরকার একেবারেই চাপমুক্ত। তখন প্যারোলের ফয়সালা হয়েছিল নেপথ্যে, আর এখন প্রকাশ্য দেন-দরবারেও সাড়া মেলার কোনো লক্ষণ নেই। তবে, যতটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে তাতে রাজনীতিক হিসেবে খালেদা জিয়া কারাজীবনে মৃত্যুর আশঙ্কা নিয়ে ততটা চিন্তিত নন। তবে, তাঁর দলের অন্যদের মধ্যে অস্থিরতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তাঁরা রাজনীতিতে ক্রমেই তালগোল পাকিয়ে ফেলছেন।

ক্ষমতাসীন দলের নেতারা যখন বলেন অপরাধ স্বীকার করেই প্যারোলের আবেদন করতে হবে, তখন বোঝা যায় বিষয়টি মানবিক নাকি রাজনৈতিক। প্রশ্ন হচ্ছে, প্যারোল সম্পর্কে আইনের বিধান কী? প্যারোলের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কার? সরকারের না আদালতের? বিস্ময়কর হলেও সত্য, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই, যার আলোকে প্যারোল সম্পর্কে সরকার বা বিরোধী দল বিএনপির পরস্পরবিরোধী দাবির নিষ্পত্তি হতে পারে। অবশ্য প্যারোলের সুনির্দিষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় ২০১০ সালে তৈরি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ আইন এবং ২০১৬-এর কোস্টগার্ড আইনে, যা শুধু ওই দুই বাহিনীর সদস্যদের জন্য প্রযোজ্য। প্যারোলের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন না থাকায় বিষয়টির প্রয়োগের সম্ভাব্য ব্যাখ্যা মেলে অন্য দুটো আইনে—যার একটি হচ্ছে, দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডারস অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০ এবং অন্যটি হচ্ছে দ্য প্রিজন্স অ্যাক্ট, ১৮৯৪। তবে, সরকারের যে হালনাগাদ করা প্যারোল নীতিমালার সন্ধান মেলে, সেটি জারি হয়েছিল ২০১৬ সালের ১ জুন। হালনাগাদ নীতিমালায় অতীতের যেগুলোর উল্লেখ (রেফারেন্স) পাওয়া যায় তার একটি হচ্ছে ২০১০ সালের ৩ মার্চের এবং অন্য আরেকটি ২০০৭ সালের ২২ সেপ্টেম্বরের। তবে, নীতিমালা কোন আইনের অধীনে তৈরি হয়েছে, তার কোনো উল্লেখ এতে নেই।

সরকারের সর্বসাম্প্রতিক প্যারোল নীতিতে বলা হয়েছে বন্দীদের নিকটাত্মীয়দের কেউ মারা গেলে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্যারোলে মুক্তি দেওয়া যাবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট প্যারোল মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে বিবেচিত হবেন। তবে, এই নির্দেশনায় আরও বলা আছে ‘নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুর কারণ ছাড়াও কোনো আদালতের আদেশ বা সরকারের বিশেষ সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্যারোলে মুক্তির প্রয়োজন দেখা দিলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্দীকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া যাবে।’ এতে নিরাপত্তা ও দূরত্ব বিবেচনায় এই সময় বেঁধে দেওয়ার এবং বন্দীকে সার্বক্ষণিকভাবে পুলিশ প্রহরাধীন থাকতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নীতিমালার আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এই সময়সীমা কোনো অবস্থাতেই ১২ ঘণ্টার বেশি হবে না বলার পরই তাতে লেখা হয়েছে, তবে ‘বিশেষ ক্ষেত্রে সরকার মুক্তির সময়সীমা হ্রাস/বৃদ্ধি করার ক্ষমতা সংরক্ষণ করবে।’ এই নীতিমালায় প্যারোলের মেয়াদ নির্ধারণের এখতিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হলেও বন্দীর দোষ স্বীকারের কোনো শর্ত নেই। সুতরাং মন্ত্রীদের মধ্যে যাঁরা অপরাধ স্বীকার করে প্যারোলের আবেদন করতে হবে বলে দাবি করছেন, তাঁদের বক্তব্যে যদি কেউ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হেয় করার উদ্দেশ্য খুঁজে পান, তা নাকচ করা সহজ নয়।

প্রবেশন অর্ডিন্যান্স অনুসরণ করা হলে দণ্ডিত ব্যক্তির শর্তাধীন মুক্তির আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা একমাত্র আদালতের, সরকারের নয়। এই আইনে মামলার রায় ঘোষণার সময়ে বিচারিক আদালত অথবা আপিল দায়েরের সময়ে উচ্চ আদালত দণ্ডিত ব্যক্তিকে শর্তাধীন মুক্তি দিতে পারেন। মুক্ত থাকার সময়ে তাঁকে ওই সব শর্ত পালন করতে হয় এবং সেগুলো দেখার জন্য প্রবেশন কর্মকর্তা থাকেন। একমাত্র মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত না হলে যেকোনো নারী এই আইনে শর্তাধীন মুক্তিলাভের অধিকার রাখেন। মামলার রাজনৈতিক চরিত্রের কারণে বিচারিক আদালতে তেমনটি যে সম্ভব ছিল না, তা মোটামুটি সবারই জানা। তবে, উচ্চ আদালতে আপিলের পর্যায়ে খালেদা জিয়ার সেই আবেদনের সুযোগ এখনো থাকার কথা। প্রবেশনের সিদ্ধান্তটি একান্তই বিচারকদের, সরকারের নয়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে বিএনপি বিভিন্ন সময়ে যেসব অভিযোগ করে এসেছে, বিশেষ করে খালেদার জামিনের আবেদন নাকচ হওয়ার পটভূমিতে, তাতে অবশ্য আদালতের প্রতি আস্থার প্রশ্নে তাঁদের মধ্যে সংশয় থাকা অস্বাভাবিক নয়।

তা ছাড়া, এ কথাও সত্য যে বাংলাদেশে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে আদালতে প্রবেশন আইন প্রয়োগের প্রবণতা নেই বললেই চলে। বিষয়টিতে সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি ইমান আলীর একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায় বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ও পেনাল রিফর্ম ইন্টারন্যাশনাল (পিআরআই) প্রকাশনা ‘ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ইউজ অব দ্য প্রবেশন সিস্টেম ইন বাংলাদেশ’-এ। বিচারপতি ইমান আলীর কথায় ‘সম্ভবত বিজ্ঞ বিচারকদের শাস্তি প্রদানমূলক মনোভাবের কারণে আমাদের বিচারিক আদালতে প্রবেশনের ব্যবহার অত্যন্ত বিরল এবং এই অবস্থা দেশের সর্বত্র বিরাজ করছে।’

অন্য আইন, যেটি সোয়া শ বছরের পুরোনো দ্য প্রিজন্স অ্যাক্ট, তাতে অন্তত তিনটি ধারায় সরকারকে বন্দীদের সাজা কমানো ও আগাম মুক্তির বিষয়ে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ধারণা করা অযৌক্তিক হবে না যে মন্ত্রীদের কেউ কেউ হয়তো এই আইনের আলোকে বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। ক্ষমতাটি সরকারের হাতে থাকলে এ রকম হওয়া মোটেও অস্বাভাবিক নয়। এবং তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহার করাটাও অপ্রত্যাশিত নয়। প্রিজন্স অ্যাক্টের ৫৯ ধারার ৫,৭ এবং ৯ উপধারায় বন্দীদের আচরণের ভিত্তিতে মূল্যায়ন এবং সাজা কমানো, বন্দীর মৃত্যুঝুঁকি বিবেচনায় মুক্তিদান এবং দণ্ডের সময় এবং শ্রেণি নির্ধারণের উদ্দেশ্যে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা পুরোপুরি সরকারের। এই ক্ষমতা প্রয়োগ করেই যে বিকাশের মতো দুর্ধর্ষ অপরাধীরা সাজার মেয়াদ শেষ করার আগেই সরকারের কৃপায় মুক্তি পেয়েছেন, সন্দেহ নেই।

সরকারের এখতিয়ার এবং কর্তৃত্ব বিবেচনায় প্যারোল প্রশ্নে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি ক্ষমতাসীন দল সহানুভূতিশীল হবে বিএনপির মধ্যে যাঁরা এমনটি ভাবছেন, তাঁদের ভাবনার ভিত্তি কী, তা-ও স্পষ্ট নয়। সরকারবিরোধী আন্দোলনের নামে হঠকারিতার ফাঁদে পা দিয়ে দলটির যে দুর্গতির শুরু, তা আরও প্রকট হয়েছে নির্বাচন প্রশ্নে অসংলগ্ন অস্থিরতায়। যে কারণে নির্বাচনে অংশগ্রহণ কখন অর্থপূর্ণ আর কখন নয়, সেই ভেদবোধও তাদের লোপ পাওয়ার আলামত দৃশ্যমান। নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করা যখন ক্ষমতাসীনদের জন্য জরুরি ছিল, তখন কোনো ধরনের ছাড় আদায় করতে না পারলেও উপনির্বাচন ও স্থানীয় সরকারগুলোর নির্বাচনকে বৈধতা দিতে দলটির উৎসাহে কোনো ঘাটতি নেই। এখন প্যারোলের রাজনীতিতেও দলটির ফাঁদে পড়ার আশঙ্কা ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে।

  • কামাল আহমেদ: সাংবাদিক
  • কার্টসি - প্রথম আলো/ ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২০  

প্যারোলে মুক্তি ‘দোষ স্বীকার’ ও বিদেশ যাওয়া প্রসঙ্গ

গোলাম মোর্তোজা

কিছুদিন পরপর প্রায় নিয়ম করে খালেদা জিয়ার মুক্তির প্রসঙ্গটি সামনে আসে। সেই আলোচনায় এখনকার প্রসঙ্গ ‘প্যারোল’। আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীদের মুখ থেকে ‘প্যারোল’ শব্দটি বেশি শোনা যাচ্ছে।

বিএনপির নেতা-আইনজীবীরা বলছেন ‘প্যারোলে’ মুক্তি নয়, খালেদা জিয়াকে জামিন দিতে হবে। তাদের বক্তব্য, যেহেতু খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলাগুলো রাজনৈতিক, ফলে সরকারের সদিচ্ছায় চিকিৎসাজনিত কারণে জামিন হতে পারে। জামিন পেলে তিনি উন্নততর চিকিৎসার জন্যে ইংল্যান্ডে যাবেন।

বিএনপি নেতারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পাচ্ছেন না। খালেদা জিয়ার সঙ্গে কারাগারে দেখা করছেন তার আত্মীয়-স্বজন। বিএনপি মহাসচিব খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা ও মনোভাব সম্পর্কে জানছেন, দেখা করে আসা আত্মীয়দের থেকে।

খালেদা জিয়ার মুক্তিকে কেন্দ্র করে কয়েকটি প্রসঙ্গে সামনে আসছে। আইনগতভাবে খালেদা জিয়া জামিন পেতে পারেন কিনা বা জামিন পাওয়ার সুযোগ আছে কিনা? ‘প্যারোল’র আওতায় মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা কতটা? ‘প্যারোলে’ মুক্তি পেলে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার সুযোগ আছে কিনা?

প্রথমে আসি ‘প্যারোল’ প্রসঙ্গে।

‘প্যারোল’ বিষয়ে সংসদ প্রণীত কোনো আইন নেই। প্যারোল সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিষয়। ২০১৬ সালের ১ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা নীতিমালা অনুযায়ী প্যারোলে ‘শর্তাধীনে সাময়িক সময়’র জন্যে মুক্তির সুযোগ আছে। গুরুত্বপূর্ণ ও অন্যান্য শ্রেণির হাজতি বন্দিদের কাছের কেউ মারা গেলে সাধারণত প্যারোলে মুক্তি পেয়ে থাকেন।

‘সাময়িক সময়’ ১২ ঘণ্টার বেশি হবে না, নীতিমালায় বলা হয়েছে। তবে বিশেষ বিবেচনায় সরকার সময় কমাতে বা বাড়াতে পারে। কতদিন, মাস বা বছর বাড়াতে পারে তা নির্দিষ্ট করে বলা নেই।

‘সাময়িক সময়’ কমবেশি যাই হোক পুরো সময় তাকে পুলিশি প্রহরা বা নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে। নীতিমালা অনুযায়ী, প্যারোলে মুক্ত বন্দিকে পুলিশ কারাগারের ফটক থেকে বুঝে নিবে এবং নির্দেশিত সময়সীমার মধ্যে আবার কারাগার কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করবে।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আরিফ খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “প্যারোলে মুক্ত কোনো বন্দি বর্তমান নীতিমালা অনুযায়ী চিকিৎসা বা অন্য কোনো বিবেচনায় বিদেশে যেতে পারবেন না। এছাড়া প্যারোলে মুক্তির সঙ্গে বন্দির দোষ স্বীকার করা বা না করার কোনো সম্পর্ক নেই।”

“প্যারোলে মুক্তি পাওয়া বন্দির বিদেশে যাওয়ার সুযোগ আছে”-দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন আওয়ামী লীগের সাবেক আইন বিষয়ক সম্পাদক এবং বর্তমান মৎস্য ও পশু সম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। তিনি বলেন, “বিদেশে গিয়ে সেই বন্দিকে সংশ্লিষ্ট দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসকে বিষয়টি জানাতে হবে। তিনি কোথায় থাকছেন, কোন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন সবকিছু দূতাবাসকে জানিয়ে রাখতে হবে।”

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহাসচিব আবদুল জলিল প্যারোলে মুক্তি পেয়ে চিকিৎসার জন্যে সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন।

প্যারোলে মুক্তির পর বিদেশ যাওয়ার সুযোগ নেই, আবদুল জলিলকে কীভাবে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো? তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) এম এ মতিন এ প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেননি।

২০০৮ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আট সপ্তাহের নির্বাহী আদেশে মুক্তি পেয়ে বিদেশে গিয়েছিলেন।

এবার আসি জামিন প্রসঙ্গে।

বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৪টি মামলা চলমান এবং দুটি মামলায় তিনি দণ্ড পেয়েছেন। দণ্ডপ্রাপ্ত দুটি মামলা অ্যাপিলেট ডিভিশন পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়েছে। অর্থাৎ মামলার পুরো কার্যক্রম শেষ হয়েছে। এই দুটি মামলার সম্পূর্ণ কার্যক্রম শেষ হয়ে যাওয়ায় জামিনের কোনো সুযোগ নেই। কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে শেষ হয়ে যাওয়া মামলায় আদালত জামিন দিতে পারেন না। খালেদা জিয়া জামিন পেতে পারেন চলমান মামলাগুলোতে। চলমান সবকয়টি মামলায় যদি খালেদা জিয়া জামিন পান, তবুও তার কারামুক্তির সুযোগ নেই।

‘প্যারোলে’ মুক্তির বাইরে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ আছে। সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দোষ স্বীকার করে নিয়েই ক্ষমা প্রার্থনা করতে হয়। রাষ্ট্রপতি ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন অগ্রাহ্য করতে পারেন। বিবেচনায় নিয়ে সম্পূর্ণ দণ্ড মাফ করে দিতে পারেন। দণ্ডের মেয়াদ কমিয়ে দিতে পারেন। নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে দণ্ড স্থগিত রেখে মুক্তির ব্যবস্থা করতে পারেন।

এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন খালেদা জিয়া কী চাইছেন? কয়েক মাস আগে বিএনপির সংসদ সদস্যরা কারাগারে দেখা করেছিলেন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে। বিএনপির একজন সংসদ সদস্য দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, তিনি প্যারোল বা মুক্তির প্রক্রিয়া নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। ‘কোনো লাভ নেই’-বলে খালেদা জিয়া তাকে আলোচনা করতে না করে দিয়েছিলেন।

তার মতে, তখনই খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ ছিল। তিনি উঠে দাঁড়াতে পারছিলেন না।

কয়েক দিন আগে খালেদা জিয়ার বোনসহ আত্মীয়রা দেখা করেছেন। বিএনপির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, আত্মীয়রা দেখা করে এসে বলেছেন খালেদা জিয়ার অবস্থা খারাপের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। তার দুই হাত বাঁকা হয়ে গেছে। খেতে পারছেন না। জামিন বা প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে এই প্রথম তিনি বলেছেন ‘যা ভালো মনে করো’ করতে পারো। ধারণা করছি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন বলেই হয়তো তিনি একথা বলেছেন। তবে বেগম খালেদা জিয়া কোনো অবস্থাতেই রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন না। কারণ তিনি কোনো অপরাধ করেননি।

একটি সূত্র অনুযায়ী, বিএনপি দলীয়ভাবে প্যারোলে মুক্তি চাইবে না। পরিবার সরকারের থেকে নিশ্চয়তা পেলে প্যারোলে মুক্তির প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে। তখন বিএনপি বলবে, আত্মীয়রা মানবিক কারণে প্যারোল চেয়েছে। রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।

বিএনপি নেতাদের প্রায় সবাই এখন মনে করছেন, অন্য যে কোনো কিছুর চেয়ে খালেদা জিয়ার সুস্থ থাকা বা বেঁচে থাকা জরুরি। প্যারোলে মুক্তি চাইলে বা পেলে খালেদা জিয়ার ‘আপসহীন’ ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেও তারা মনে করছেন না। সরকার এমন প্রচারণা চালালেও, বিএনপি নেতারা মনে করছেন, সরকারের কথা দেশের মানুষ বিশ্বাস করবেন না। মানবিক বিবেচনায় বেগম খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তি পেলে বিএনপির রাজনীতির জন্যে তা মঙ্গলজনক হবে। কিন্তু তাদের ভেতরে একটি সংশয় বা সন্দেহ তীব্রভাবে বিরাজ করছে, সরকারপ্রধান কী ভাবছেন তা তারা জানেন না। ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে কথা বলে মির্জা ফখরুলের সংশয় বা সন্দেহ কাটেনি। আদালত নয়, খালেদা জিয়ার মুক্তি নির্ভর করছে সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর। এবং সেই সিদ্ধান্ত মূলত সরকার প্রধানের।

  • কার্টসি - ডেইলি স্টার/ ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২০ 

খালেদা জিয়ার মুক্তি কীভাবে

মিজানুর রহমান খান

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির পথ ও পন্থা নিয়ে কথা উঠেছে রাজনীতিতে। যে অভিযোগে তাঁকে দণ্ড দেওয়া হয়েছে, তর্কের খাতিরে কেউ সেটা যথার্থ মেনে নিতে পারেন। মেনে নিয়েই প্রশ্ন তুলতে পারেন, এই ভূখণ্ডে অভিন্ন বা সমচরিত্রের অভিযোগে অন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিরা কে কোথায়? কারও জন্য আইনের দোহাই, কারও ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ নেই। যদি একজন এরশাদ ও নাজমুল হুদারও জামিন পাওয়া নিয়ে একই রকম আইনের প্রয়োগ দেখা যেত, তাহলে কথা কম উঠত। যেহেতু এক যাত্রায় ভিন্ন ফল পাওয়ার মূল কারণটা রাজনীতিতে, তাই রাজনৈতিকভাবেই এর প্রতিকার প্রতীয়মান হয়। যদি রাজনৈতিক কারণেই খালেদা জিয়া দণ্ডিত হয়ে থাকেন, তাহলে রাজনীতিই হবে তার প্রতিষেধক। এই রকম ব্যাখ্যা যদি বিশ্বাসযোগ্য হয়, তাহলে ‘শুধু আদালতই পারেন’, এই যুক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।

কাউকে মুক্তিদান প্রশ্নে আদালত অপেক্ষাকৃত কম এখতিয়ার ভোগ করেন। যে আদালত দণ্ড দিয়েছেন, তাঁর পক্ষে সেটা ওল্টানো যাবে না। আদালত কোনো রায়ই বাতিল করতে পারেন না। আদালত সব সময় স্বতঃপ্রণোদিতভাবে নিজের রায়ের ত্রুটি বদলাতে পারেন না, সুযোগ থাকে না। কিন্তু নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা প্রায় অপরিসীম। তাদের হস্তক্ষেপে মুক্তি পাওয়ার নানা নজির আছে। কিছুকাল আগে একজন দণ্ডিত ব্যক্তির রাষ্ট্রপতির ক্ষমার দরকার পড়ল না। তিনি মুক্ত মানুষ হলেন। অথচ সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের আওতায় তিনি দরখাস্ত দেননি। তিনি দণ্ডিত, তারপরও সরকার তাঁকে মুক্তি দিতে পেরেছে।

রাষ্ট্র ও সরকারের আছে অনেক ক্ষমতা। সরকার রাজনৈতিকভাবে কিছু একটা করতে চাইছে, কিন্তু আইনে মানা আছে বলে করতে পারছে না, এমন একটা অবস্থা বাংলাদেশে কমই হয়। সুতরাং নানা উপায় আছে। আইন বলছে, রাষ্ট্রপক্ষ চাইলে আদালত যেকোনো কার্যধারা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতে পারেন। এটা মামলার যেকোনো পর্যায়েই—রায়ের আগে হতে পারে, রায়ের পরেও হতে পারে। অবশ্য রায়ের আগে ও পরে সমান কথা নয়। রায়ের পরে হলে শুধু দণ্ড বিরাম বা মওকুফ করা যাবে। কিন্তু তাঁর দোষী সাব্যস্ত হওয়া মুছে ফেলা যাবে না। তিনি আইনের চোখে অপরাধী থাকবেন। ‘এতিমের তিন কোটি টাকা মেরে খাওয়া’র সুবিচার আর ‘ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে খাওয়ার’ অবিচারের মধ্যে কোনটি জনস্বার্থের বেশি বা কম ভালো, সেটা জ্বলন্ত প্রশ্ন।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলছেন, তাঁরা খালেদা জিয়ার প্যারোলের দরখাস্ত পাননি। এ কথার মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকে যে দরখাস্ত করা হলে তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে দেখা হতে পারে। আবার এটাও ধরে নেওয়ার উপায় নেই যে তাঁরা প্যারোলের দরখাস্তের অপেক্ষায় নেই এবং সেটা পাওয়ামাত্রই সেটা ছুড়ে ফেলে দেবেন। তবে অনুমান করি, সরকার চাইতে পারে যে দরখাস্ত আসুক। এতে তাদের রাজনৈতিক জিত হয়। সুতরাং বিএনপিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সরকারের সামনেও আইন নানা বিকল্প রেখেছে।

দরখাস্ত হোক জামিনের বা প্যারোলের—মোটকথা একটি জীবনকে প্রলম্বিত করার জন্য যেখানে কারামুক্তি পেতেই হবে, সেখানে কার্যপ্রণালি বড় নয়। তবে বিদ্যমান আইন বলছে, নারী, বিশেষ করে তিনি যদি প্রবীণ নাগরিক হন এবং তাঁর স্বাস্থ্য সমস্যা থাকে, তাহলে তিনি জামিন পেতে বিশেষ বিবেচনার হকদার।

কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, সরকার তাঁকে মুক্তি দিয়ে স্থিতিশীলতা ক্ষুণ্ন হওয়ার সামান্য কোনো ঝুঁকি নেবে না। তাই খালেদা জিয়াকে তারা মুক্তি দেবে না। পাল্টা প্রশ্ন হতে পারে, তাঁকে এভাবে রেখে দেওয়াটাই স্থিতিশীলতার গ্যারান্টি, কে সেটা হলফ করে বলবেন?

জীবন ও স্বাস্থ্যসুরক্ষার অধিকার মৌলিক। রাষ্ট্রের একটি অঙ্গের কাছে আমি মানবিক কারণে দরখাস্ত করতে পারি, কিন্তু একই রাষ্ট্রের আরেকটি অঙ্গের কাছে আমি মানবিক কারণে প্যারোল চাইতে দ্বিধান্বিত—বিএনপির তরফে এই দুই অবস্থা দ্বন্দ্বমূলক। বিএনপির কিছু নীতিনির্ধারক এর আগে প্যারোল চাইতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে বাধা দিয়েছেন। তাঁরা এখনো সক্রিয়। বিএনপি রাজনৈতিক আবেগকে পাথেয় ভাবছে, কিন্তু তা অকার্যকর প্রমাণিত। এই আবেগ একান্তভাবে বিএনপির গোষ্ঠীগত।

বিএনপির প্রতিনিধিদলের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যাওয়াও একদম মূল্যহীন ছিল না। একটা সংলাপ সেখানে হয়েছে, সেটা মুছে যায়নি। বিশ্বাস করার কারণ আছে যে মির্জা ফখরুলের মতো প্রবীণ নেতারা আফসোস করতে পারেন এই ভেবে যে কট্টর নেতাদের কারণে প্যারোলের সুযোগটা হাতছাড়া হলো। গত নির্বাচনের পর গণভবনে গিয়ে, শপথ নিয়ে বিএনপি যে ‘কার্যকর রাজনৈতিক বৈধতা’ সরকারকে দিল, তার বিনিময়ে বিএনপি কিছু চেয়েছে কিংবা আওয়ামী লীগ কিছু দিতে রাজি ছিল, এমন কোনো ধারণা আমরা কোথাও থেকে পাই না।

দুদকের প্রধান আইনজীবী খুরশীদ আলম খানের সঙ্গে মুঠোফোনে আলোচনায় কয়েকটি ধারণা জন্মাল। প্রথমত, এর আগে শেখ হাসিনা, তারেক রহমান, খালেদা জিয়া প্যারোল নিয়েছিলেন। কিন্তু তখন তাঁরা কেউ দণ্ডিত ছিলেন না। তাঁর প্রশ্ন, দণ্ডিত ব্যক্তিদের প্যারোল–প্রক্রিয়া কী হবে। তাঁর আরও প্রশ্ন, খালেদা জিয়া দুদকের মামলায় দণ্ডিত। দুদক আইনের মামলা সরকার নয়, তুলতে পারে দুদক। কিন্তু আইনে মামলা তুলে নেওয়ার বিষয়ে কিছু বলা নেই। সুতরাং সিআরপিসির ৪০১ ধারার আওতায় দণ্ডিতের সংশ্লিষ্ট মামলা তুলে নিতে সরকার বা দুদকেরও এখতিয়ার আছে কি না, সেটা একটা প্রশ্ন। এক-এগারোতে হওয়া মামলাগুলো প্রত্যাহারে ৪০১ ধারা প্রয়োগের চিন্তা ছিল। কিন্তু দুদক রাজি না হওয়ায় এই ধারার আওতায় প্রত্যাহার ঘটেনি। যা প্রত্যাহার হয়েছে, সেটা সিআরপিসির ৪৯৪ ধারার আওতায়। দণ্ড ঘোষণার আগের অবস্থায় মামলা প্রত্যাহারে এই বিধানের প্রয়োগ ঘটে।

ওপরের যুক্তির সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করি। ২০১৬ সালের ১ জুন প্যারোল নীতিমালা হালনাগাদ করেছে সরকার। এতে বলা আছে, প্যারোলের সিদ্ধান্ত আদালতের আদেশ ছাড়াও সরকার তার বিশেষ সিদ্ধান্তে নিতে পারবে। এটি সব শ্রেণির হাজতি ও কয়েদির জন্য প্রযোজ্য।

বাংলাদেশ সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদে সাজা মার্জনা, স্থগিত ও হ্রাস ছাড়াও রাষ্ট্রপতি (কার্যত প্রধানমন্ত্রী) কারও দণ্ড বিরাম (রেসপাইট) করতেও পারেন। রাষ্ট্রপতি যা যা পারেন, তার সব কটি বাস্তবায়নের উদাহরণ সম্ভবত তৈরি হয়নি। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি অপরাধের জন্য দণ্ডিত হইলে সরকার যে কোনো সময় বিনা শর্তে বা দণ্ডিত ব্যক্তি, যা মানিয়া লয়, সেইরূপ শর্তে যে দণ্ডে সে দণ্ডিত হইয়াছে, সেই দণ্ডের কার্যকরীকরণ স্থগিত রাখিতে বা সম্পূর্ণ দণ্ড বা দণ্ডের অংশবিশেষ মওকুফ করিতে পারিবে।’

৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার কারাবাসের দুই বছর পূর্তিতে আইন ও বিচারমন্ত্রী আনিসুল হক ও অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবুল আলম জানামতে সবচেয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির (দেখুন সমকাল প্রতিবেদন, ৮/৮/২০) বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। তাঁরা উভয়ে বলেছেন, উক্ত ৪০১(১) ধারাটি খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। খুরশীদ আলমের সঙ্গে তাই একমত নই। কারণ, দুদক আইনটি সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের অধীনে। দুদকের মামলা বা পেইন্ডিং মামলা বলে প্রাচীর তোলা যাবে না।

ধরে নিই যে বিএনপির পক্ষে ক্ষমা চাওয়া বা প্যারোলের দরখাস্ত করা কঠিন। আইনমন্ত্রী বলেছেন, ‘সাজা কমানো যেতে পারে। কিন্তু তেমন আবেদন সরকার না পেলে তা নিয়ে আলোচনার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না, সিদ্ধান্ত তো পরের বিষয়।’ আইনমন্ত্রীর এই একটি মন্তব্য ধরেই সমাধান সূত্র বের করা সম্ভব। ১২ ফেব্রুয়ারি খবর ছিল, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, মুক্তির সিদ্ধান্ত সরকারই নেবে। এখন আশার বিষয় যে ১৮ ফেব্রুয়ারিতে এসে মির্জা ফখরুল বললেন, প্যারোল বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে খালেদার পরিবার। তাঁর পরিবার কোনো ধারার উল্লেখ করে বা না করে রাষ্ট্রপতির কাছে একটি মানবিক আবেদন করতে পারে। যদিও আপিল বিভাগ দুই মাস আগেই জামিনের দরখাস্ত নামঞ্জুর করেছেন। কিন্তু প্রতীয়মান হয় যে, বিশেষ করে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগের ১২ ডিসেম্বরের পূর্ণাঙ্গ রায় আরও বড় ইতিবাচক অগ্রগতি। যদিও বিএনপি শুধু জামিন নামঞ্জুর না হওয়া নিয়ে হাপিত্যেশ করছে।

সর্বোচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণটি রাজনৈতিকভাবেও তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এটি মানবিক আবেদনে সাড়া দেওয়ার পথ সুগম করেছে। আপিল বিভাগের জামিন নামঞ্জুরের চেয়ে ঢের গুরুত্বপূর্ণ তার পর্যবেক্ষণ। আপিল বিভাগ বলেছে, ‘যদি আবেদনকারী (খালেদা জিয়া) প্রয়োজনীয় সম্মতি দেন, তাহলে মেডিকেল বোর্ড দ্রুত তাঁর অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্টের জন্য পদক্ষেপ নেবে।’ আপিল বিভাগের ১২ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ আদেশটি পড়ে প্রতীয়মান হয় যে দরকারে খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসারও একটি ভিত্তি হতে পারে রায়টি। মেডিকেল বোর্ড খালেদা জিয়ার হাইপারটেনশন ও হাঁপানি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও তাঁর রিউমিউটয়েড আর্থ্রাইটিস ‘হাইলি অ্যাকটিভ’ এবং তার অবস্থাকে ‘অ্যাট আ ক্রিপলড স্টেট’ বলে উল্লেখ করেছে। বোর্ড এরপর বলেছে, ‘অন্যান্য যোগ্যতাসম্পন্ন রিউমেটোলজিস্টদের সুপারিশ গ্রহণে তারা প্রস্তুত।’ আপিল বিভাগ এ অংশটিতে গুরুত্বারোপ করেছে। মেডিকেল বোর্ড সর্বশেষ আন্তর্জাতিক সুপারিশ অনুযায়ী, খালেদার চিকিৎসায় একটি বায়োলজিক থেরাপির প্রেসক্রিপশন দিয়েছিল। কিন্তু তাতে দরখাস্তকারীর সম্মতি মেলেনি।

কেউ বলবেন, সরকারের কিছুটা রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখছি। কারণ, কারাগারের বাইরে খালেদা জিয়া অব্যাহতভাবে হাসপাতালে থাকছেন। উপরন্তু একজন সত্তর পেরোনো নারীর স্বাস্থ্যগত অবস্থাটি যে অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্টের পর্যায়ের, সেটা আপিল বিভাগের রায়ে দৃঢ়তার সঙ্গে স্বীকৃত। সুতরাং বিএনপি ক্ষমা না চেয়ে দণ্ড কমানোর দরখাস্ত করতেই পারে। দরকার হলে তাঁর পরিবার প্যারোল বা যা সমীচীন, তেমন দরখাস্ত করতে পারে। আলোচ্য ক্ষেত্রে দণ্ড ও প্যারোল যদি রাজনীতির অপর নাম হয়, তাহলে প্যারোলই শেষ কথা নয়। তাই জিয়া পরিবার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, যদি নিরঙ্কুশভাবে তাঁর সুচিকিৎসাকেই তারা একমাত্র বিবেচ্য ভাবতে পারে। সরকারের কাছে কোনো ধরনের আবেদন ছাড়াই প্যারোল বা মুক্তি দেওয়া হলে, সেটা সরকারের জন্য পরাজয় হিসেবে দেখা হবে। বিধ্বস্ত বিএনপি তখন বলে বসবে, তারা সরকারকে নতি স্বীকারে বাধ্য করেছে।

খালেদা জিয়ার মুক্তি বিষয়ে একটি সমঝোতা হলে তা দেশের বর্তমান রাজনীতে নতুন মাত্রা দিতে পারে। তবে সবচেয়ে বড় কথা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ‘অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্ট’ তাঁর মৌলিক অধিকার। এটা রাষ্ট্রের অনুকম্পার বিষয় নয়। এটাই সেই পথ, যেখানে সরকার, আদালত ও বিএনপি—সবাই স্বস্তি পেতে পারে। জিয়া পরিবার রাষ্ট্রপতির কাছে দরখাস্ত পাঠাতে পারে। তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘দুর্নীতির দায়ে আদালতের বিচারে সাজাপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে কেবল আদালতে জামিন বা খালাস পাওয়া ছাড়া বেগম জিয়ার মুক্তির অন্য কোনো পথ নেই।’ ওপরের আলোচনা এই যুক্তিকে সমর্থন করে না।

  • মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
  • কার্টসি - প্রথম আলো/ ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২০ 

Sunday, February 16, 2020

টাকার খোঁজে দিশেহারা সরকার

ফাইজ তাইয়েব আহমেদ


অর্থনীতিবিদদের অনেকেই বলেছেন, বাংলাদেশি টাকা প্রতিবেশী দেশের মুদ্রার তুলনায় অতিমূল্যায়িত। চীন, ভারত, পাকিস্তান তাদের মুদ্রামান কমিয়েছে। এ অবস্থায় সরকার টাকার মান না কমিয়ে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রণোদনা চালিয়ে যাচ্ছে। কারণ, টাকার মান কমিয়ে দিলে আমদানি ব্যয় আরও বাড়বে। কিন্তু কথা হচ্ছে, এই নীতি কত দিন কার্যকর থাকবে। দীর্ঘ মেয়াদে এই টাকা কোথা থেকে আসবে? রপ্তানি–প্রণোদনাও তো রপ্তানি–ধস ঠেকাতে পারছে না। প্রণোদনার কারণে রেমিট্যান্স ও তথ্যপ্রযুক্তি আয় বেড়েছে, তবে বৈদেশিক মুদ্রা এই মুহূর্তে সংকটে নেই বলে নগদ প্রণোদনা খুব বেশি জরুরি নয়। টাকার মান সামান্য কিছু অবমূল্যায়ন করেও একই টার্গেট অর্জন সম্ভব।

সঞ্চয়পত্র সুদ বনাম এক অঙ্কের সুদ

ডাকঘরে আমানতের সুদের হার এক ধাক্কায় সরকার অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে। আগে যা ছিল ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। এখন তা ৬ শতাংশ। এর আগে সঞ্চয়পত্রে উৎসে কর ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করে সরকার। ব্যাংকের সুদ ৬ শতাংশ, মূল্যস্ফীতি ৬ বা ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ব্যাংকে রাখাও যা, না রাখাও তা, সঞ্চয়পত্রে সুদও তা। সরকার কেন এটা করল? অর্থনীতিবিদ রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীরের কথায়, ‘রাজস্ব কমে যাওয়ায় সরকার প্রথমে হাত দিল ব্যাংকে। ছয় মাসের মধ্যে এক বছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ঋণ করল। তারপর নতুন আইন করে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর অর্থে হাত দিল। এখন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের শেয়ার পুঁজিবাজারে দেওয়া হচ্ছে ব্যাংকের হারানো তহবিলের ঘাটতি কমাতে। অথচ ব্যাংকের টাকা যারা নিয়ে গেল, তাদের ধরছে না। এখন সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানোয় জনগণের দুর্বল অংশ যে পেনশনভোগী, তাঁদের আয়ে হাত পড়ল। তাঁদের সুদ বাবদ রাষ্ট্রের খরচ কমল। ওদিকে ইউএনওদের ৯৪ লাখ টাকার গাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’

সরকারের ঋণ বনাম ব্যক্তি খাতের ঋণ

যেখানে সরকার নিজেই অতি উচ্চ পরিমাণে ব্যাংকঋণ করছে, সেখানে বেসরকারি খাতে এবং ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়বে কীভাবে? ২০১১-১২ অর্থবছরে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ছিল জিডিপির ২২ দশমিক ৫ শতাংশ, যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এসে ২৩ দশমিক ২৬ শতাংশে স্থবির হয়েছে। সরকারের অতি উচ্চ ঋণের প্রভাবে ১১ বছরে বেসরকারি খাতে ঋণ সর্বনিম্ন ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশে এসে পৌঁছেছে।

স্বশাসিত সংস্থাগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থ রাষ্ট্রের কোষাগারে নেওয়ার বিপদ

স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ, পাবলিক নন-ফাইন্যান্সিয়াল করপোরেশনসহ স্বশাসিত সংস্থাগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থের স্থিতি ২ লাখ ১২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। বিরোধী দলের তীব্র বিরোধিতা, এমনকি ওয়াকআউটের মধ্যেই সরকার স্বশাসিত সংস্থাগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থ রাষ্ট্রের কোষাগারে নিয়ে যাওয়ার আইন পাস করেছে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে ক্রমবর্ধনশীল রাজস্বঘাটতির বিপরীতে সরকার তার অতি উচ্চ ব্যয় নির্বাহের নতুন জোগান পেলেও এর মাধ্যমে তৈরি হতে পারে বেশ কয়েকটি গুরুতর সমস্যা। উদ্বৃত্ত অর্থ যাতে একেবারেই না থাকে, সে জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো অপ্রয়োজনীয় খরচ বাড়াতে পারে, এতে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্থায়ী উৎসাহ পাবে। নিজস্ব তহবিলের স্থিতি ও তার বিপরীতে আয় না আসায় সরকারের ওপর অতি নির্ভরশীল হবে সেবা, গবেষণা ও পরিকল্পনা। প্রতিষ্ঠানগুলো নিজের সিদ্ধান্ত আর্থিক কারণে নিতে পারবে না বিধায় স্বায়ত্তশাসিত কাঠামো বলে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না বলে আশঙ্কা হয়। মারাত্মক আর্থিক বিশৃঙ্খলার সম্ভাবনায় এবং তহবিলের নিশ্চয়তা না থাকায় ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাগুলো গতি হারাতে পারে। মোটকথা, প্রতিষ্ঠানগুলোর স্পৃহা ধ্বংস হয়ে যাবে। তা–ই যদি হয়, দেশের প্রাতিষ্ঠানিক শাসনের পথে এটা একটা কালো অধ্যায় হয়েই থাকবে।

নিম্নপর্যায়ে আমানত সুরক্ষার ঝুঁকি

আমানত সুরক্ষার খসড়া আইনে বলা হচ্ছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অবসায়নে সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণ মাত্র এক লাখ টাকা। এতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে লালবাতি জ্বললে মাঝারি ও বড় আমানতকারীদের সুরক্ষাহীন হয়ে ভীত হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়। এক অঙ্কের সুদনীতির সঙ্গে এটা সরাসরি সাংঘর্ষিক মনে হচ্ছে। কেননা, ৬ শতাংশের ওপরে থাকা মূল্যস্ফীতির সমান বা তারও কম সুদের ফলে লোকে যখন ব্যাংকে টাকা রাখতেই উৎসাহ হারাচ্ছে, তখন দরকার ছিল গ্রহণযোগ্য শতাংশ হারে আমানতের বিমা নিশ্চয়তা দেওয়া। ২০০০ সালের আইনেও এক লাখ টাকার সুরক্ষা থাকলেও ২০ বছর পরে এসেও তা মূল্যস্ফীতি যোগ করে পুর্নির্ধারণ করা হয়নি—যেমনটা ভারতে করা হয়েছে অতি সম্প্রতি। নতুন আইনে টাকার অঙ্ক বদলায়নি, সংযোজন শুধু নন–ব্যাংকিং আর্থিক খাত। আমানত সুরক্ষার অঙ্ক বাড়ালে বিমা খরচ কিছুটা বাড়লেও নতুন আমানত উৎসাহ পেত। কিন্তু তা না করায় লোকে ব্যাংকে টাকা রাখা কমিয়ে দেবে। এতে ঋণপ্রবাহে দীর্ঘতর নেতিবাচক ধারা সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাবশালী, ব্যাংক মালিক, পরিচালক ও ব্যবসায়ী—এই চার পক্ষ বোঝাপড়ায় একের পর এক জালিয়াতির মুখে আর্থিক খাত যখন টালমাটাল, তখন এমন আইন বৈধ এবং অবৈধ উভয় ধরনের পাচার বাড়াতেই উৎসাহ দেবে। আশঙ্কা হয়, উদ্দেশ্যমূলক ব্যাংক লোপাট করে, আইনি কাঠামোয় দায়মুক্তি দেওয়ার ফন্দি এটা নয় তো! এর মাধ্যমে আমরা কি এই সংকেত পাচ্ছি যে, ব্যাংকগুলো আবারও লুটের কবলে পড়তে যাচ্ছে? বড় ধরনের অনাস্থা ও অবিশ্বাসের প্রেক্ষাপটে, নতুন আইনের মাধ্যমে ব্যাংকের আমানত কমে ঋণপ্রবাহে আরও বেশি নেতিবাচক ধারা সৃষ্টি করতে পারে।

ভারতের অনুকরণ!

সরকারের দ্রুত সিদ্ধান্তগুলোর প্রতিযুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে, ভারতেও অনুরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ভারত নিজেই অর্থনৈতিক মন্দায় পড়েছে। তথাপি ভারত মূল্যস্ফীতি ও অন্য বিষয়াদি আমলে নিয়ে আমানত সুরক্ষা স্থিতি এক লাখ রুপি থেকে পাঁচ লাখ করেছে। উপরন্তু, প্রতিটি অর্থনীতি নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে আলাদা। ভারতে বাংলাদেশের মতো এত বিশাল খেলাপি ঋণ এবং সরকারি ঋণের সংস্কৃতি নেই। তাই ভারতের পলিসি বাংলাদেশে নকল করা বেমানান। ভারতের সাবেক অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরম পরিষ্কার করে দুটো বিষয় উপস্থাপনা করেছেন, যার ভাবানুবাদ এমন: ‘ভারতীয় অর্থনীতির সমস্যা সাপ্লাই সাইডে নয়, বরং ডিমান্ড সাইডে। অর্থাৎ ভারতীয় নাগরিক ক্রয়ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ছে। এমতাবস্থায় ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করা দরকার, এমনকি করপোরেট করে ছাড় বা বড় ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দিলে এ সময় কাজ হবে না। বরং এই সময়ে পণ্য কীভাবে বেশি বিক্রি হবে, তার উদ্যোগ নেওয়া দরকার। নোবেল বিজয়ী অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন কৃষকের হাতে নগদ টাকা পৌঁছে দিতে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে বর্তমান বিজেপি সরকার সর্বোচ্চ পর্যায়ের ভারতীয় মেধাবীদের সমন্বয় করে অর্থনীতি পরিচালনা করছে না বলে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তে ভুল হচ্ছে।’

বাংলাদেশেও দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন কোম্পানি ও করপোরেট পণ্য বিক্রিতে ভাটা এসেছে। গত এক দশকে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি দ্রুত বাড়লেও কর্মসংস্থানে দেখা দিয়েছে নেতিবাচকতা। ২০১০ সালের পর কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৩২ শতাংশ থেকে কমে নেমেছে ১ দশমিক ৩৩ শতাংশে। কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন অর্থবছরের শুরুতে। পণ্যবাজারে বিক্রয় হ্রাস, কর্মসংস্থানে ভাটা, ব্যক্তি ও বেসরকারি বিনিয়োগে স্থবিরতা এবং কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্যহীনতায় বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এমতাবস্থায় টাকার খোঁজে দিশেহারা হয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে ভুল করার সমূহ সম্ভাবনা আছে। অর্থ ব্যবস্থাপনায় দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীদের সমন্বিত করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় হয়েছে। সম্ভাব্য অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে সৎ, সতর্ক, প্রজ্ঞাবান না হলে চোখের পলকেই বদলে যাবে দেশের অর্থনৈতিক চালচিত্র!

  • ফাইজ তাইয়েব আহমেদ: নেদারল্যান্ডসের ভোডাফোনে কর্মরত প্রকৌশলী এবং টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক।
  • কার্টসি - প্রথম আলো/ ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২০ 

বায়ু ও শব্দদূষণ - ঢাকার শ্বাসরোধ হয়ে আসছে, বাঁচান


‘যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু’—এই কথা রবীন্দ্রনাথ রূপকার্থে লিখেছিলেন, বায়ুদূষণের কথা ভেবে লেখেননি। কারণ, বায়ুদূষণ কিংবা শব্দদূষণ বলতে এখন যা বোঝায়, রবীন্দ্রনাথের কালে অন্তত এই অঞ্চলে তা ছিল না। এখন ভারী কারখানা, ইটের ভাটা, রাসায়নিক প্ল্যান্ট, হাইড্রোলিক হর্ন, মাইকের উচ্চ শব্দ, ইত্যাদির উৎপাতে কুবাতাস ও কুশব্দ এতটাই বেড়েছে যে বিশেষত ঢাকাবাসী শ্বাসরোধকর অবস্থায় পড়ে গেছে।

পরিবেশবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্রিন পিস তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে যে তথ্য দিয়েছে তা ভয়াবহ। তারা বলছে, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। বায়ুদূষণজনিত রোগে ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ৯৬ হাজার শিশুর অকালমৃত্যু হয়েছে। বছরে ৪০ লাখ মানুষ অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্টের সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে আসছে চিকিৎসা নিতে। বিশ্বের প্রধান শহরগুলোর বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এয়ার ভিজ্যুয়ালের হিসাবে, গত বুধবার ঢাকার বাতাস অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় ছিল, দূষণের দিক থেকে যা বিশ্বের প্রধান শহরগুলোর মধ্যে ষষ্ঠ।

এর পাশাপাশি আছে শব্দদূষণ। গবেষণায় দেখা গেছে, শব্দের সহনীয় মাথা ৫০ ডেসিবেল হলেও ঢাকার বেশির ভাগ এলাকায় ৯০ ডেসিবেলের বেশি মাত্রায় শব্দ হয়। কোথাও কোথাও তা ১২০ ডেসিবেলও ছাড়িয়ে যায়। ঢাকার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ এখন শব্দদূষণে আক্রান্ত। এভাবে শব্দদূষণ অব্যাহত থাকলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ঢাকা শহরের মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ কানে কম শুনবে। এদের একটি অংশ পুরোপুরি বধির হয়ে যাবে।

এ কথা ঠিক যে বায়ুদূষণ হঠাৎ করে ব্যাপক মাত্রায় কমিয়ে আনা কঠিন। কারণ, এর জন্য দূষণ ঘটানো বহু ইটের ভাটা, কারখানা, যানবাহন ইত্যাদি বন্ধ করতে হবে। গত দেড় বছরে অবৈধ ইটভাটাগুলোর ৬২ শতাংশ বন্ধ করা গেছে। কিন্তু কিছু কিছু উদ্যোগ আছে, যা দ্রুত নেওয়া যায়। শহরে যখন-তখন যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ির বিষয়টিকে পরিকল্পনার আওতায় আনা এবং দূষণ ঠেকাতে কিছু নিয়মকানুন কঠোরভাবে বাস্তবায়নের সুযোগ আছে। বিশ্বের বড় শহরগুলোতে পাকা রাস্তার বাইরের সব জায়গায় ঘাসের আচ্ছাদনের দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ঢাকার ক্ষেত্রে সে উদাহরণ অনুসরণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সড়ক বিভাজকে গাছ লাগানো হয়। কিন্তু সেই বিভাজকের মাটি ঘাস দিয়ে ঢাকা থাকে না, এর ধুলা বায়ুদূষণে ভূমিকা রাখে। গাছ লাগানোর পাশাপাশি গাছে নিয়মিত পানি দেওয়া এবং ঢাকার সব ফাঁকা জায়গা ঘাসের আচ্ছাদনে ঢেকে দেওয়ার প্রকল্প গ্রহণ করা দরকার।

অন্যদিকে শব্দদূষণ তাৎপর্যপূর্ণ মাত্রায় কমিয়ে আনার জন্য সরকারের সদিচ্ছা ও কিছু উদ্যোগ যথেষ্ট। বিশেষ করে গাড়ির হর্ন এবং মাইকের যথেচ্ছ ব্যবহার প্রশাসন চাইলেই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে। যেহেতু এর সঙ্গে অর্থনীতি বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্পর্ক নেই বললেই চলে, সেহেতু এটি করতে গেলে প্রশাসনকে বড় ধরনের কোনো চাপের মুখেও পড়তে হবে না।

মোদ্দা কথা, ঢাকা শহরকে বায়ু ও শব্দদূষণের হাত থেকে বাঁচাতে প্রথম দরকার নীতিনির্ধারকদের মানসিকতার পরিবর্তন। দূষণাসুরকে বধ করতেই হবে, এই লক্ষ্যে অটল থেকে যদি স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলেই শ্বাসরোধকর অবস্থা থেকে ঢাকা বেরিয়ে আসবে।

  • কার্টসি - প্রথম আলো/ ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২০ 

Monday, February 10, 2020

অর্থনীতি খারাপের দিকে যাচ্ছে — সালেহ উদ্দিন আহমেদ

তামান্না মোমিন খান

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সার্বিক দিক থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। সবগুলো সূচক নিম্নমূখী। শুধু রেমিট্যান্স একটু ভালো। বাকি আমদানি-রপ্তানি, রাজস্ব আয় ও ব্যাংকের অবস্থা খারাপ। তার মধ্যে মূল্যস্ফীতির একটা চাপ আছে। অর্থমন্ত্রী এটা অনুভব করেছে। তার মানে এটা একটা চ্যালেঞ্জ।

তিনি বলেন, আমার মতে এইসব নিয়ে বলার কিছু নেই।

সদিচ্ছা থাকলে সিরিয়াসলি নিলে সমস্যা উত্তরণ করা সম্ভব। শুধুমাত্র কথাবার্তা বলে বা বক্তব্য দিয়ে কোন লাভ হবে না। সমস্যা উত্তরণের জন্য শক্ত হাতে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকে এবং ব্যাংকগুলোকে ঠিকমত শৃঙ্খলা এবং তাদের যে নিয়ম-কানুন তা পরিপালনে শক্ত হতে হবে। কোনরকম ছাড় দেয়া যাবে না। যারা রপ্তানিকারক তাদের অনেক ঝামেলা আছে। ফরেন একচেঞ্জ- এখানেও ঝামেলা আছে। সেটার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।
সালেহ উদ্দিন আহমেদ

সাবেক এই গভর্নর বলেন, আমদানির ক্ষেত্রে তো এখন চায়নার বিষয়টি আছে। অর্থনীতির বহুমাত্রিক বিষয়গুলোতে নজর দিতে হবে। উনারা জানেন সমস্যাগুলো কোথায়। প্রয়োজন হলে আরও ভালোভাবে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। শুধু বললেই হবে না ভালো করছি, ভালো চলছে। অন্যায় সুবিধা, ছাড় দেয়া এগুলো সব বন্ধ করতে হবে। সদিচ্ছা থাকলে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে এখনই অ্যাকশন নিতে হবে, যেহেতু অর্থমন্ত্রী উপলব্ধি করেছেন।  

সালেহ উদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলো বহুমাত্রিক। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে আর্থিক ব্যবস্থপনা। ব্যাংকিং খাততো আছেই। ব্যাংক, বীমা, পুঁজিবাজারও বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারের রাজস্ব আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্যহীনতা, ঋণ ঘাটতি এগুলো ঠিক করতে হবে। আর্থিক ব্যবস্থপনা যদি সঠিক না হয় দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হবে এবং দেশ অর্থনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।

  • কার্টসি - মানবজমিন/ ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২০