‘কেমন আছেন?’ আর সব চিঠির মতো এই প্রশ্নটা করছি না শুরুতেই। কারণ আপনার ক্ষেত্রে এই প্রশ্নটা ভীষণ অবান্তর। ছয় মাসের মতো হয়ে গেল শেষবার আপনাকে দেখেছি সামনা সামনি, হাসপাতালের প্রিজন সেলে। কষ্টে ব্যথায় যন্ত্রণায় বারবার কুঁকড়ে যাচ্ছিলেন আপনি। খবর পাই আপনার অবস্থা প্রতিদিন আরো খারাপের দিকে যায়। আপনি খারাপ আছেন, ভীষণ খারাপ আছেন।
মনে পড়ছে প্রায় ১০ বছর আগের একটা দিনের কথা। আপনার সঙ্গে বহু বছর পর আবার আমার দেখা হয়েছিল আপনার অফিসে। কী গভীর মমতার দৃষ্টি নিয়ে সেদিন আপনি আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন! কী অসাধারণ মায়াভরা কণ্ঠে কুশল জিজ্ঞেস করেছিলেন আমার, বাবা-মার।
একজন আইনজীবী হিসেবে আমি পেশাগতভাবে ভালো করছি সেটা আপনি জানতেন উল্লেখ করে পরামর্শ দিয়েছিলেন মন দিয়ে যেন প্র্যাকটিস করে যাই। কিন্তু আমার লক্ষ্য সরে গেল আপনার অকুণ্ঠ স্নেহ, মমতা আর ভালোবাসার কারণেই।
আমার বাবা অলি আহাদ ইন্তেকাল করেন ২০১২ সালের ২০শে অক্টোবর। বাবা যেদিন চলে যান, ঠিক সেদিনই আপনি চীনে দীর্ঘ রাজনৈতিক ভ্রমণ শেষ করে মাত্রই দেশে ফিরেছেন। কোনো শারীরিক, মানসিক ক্লান্তির তোয়াক্কা না করে বিমানবন্দর থেকে আপনি সরাসরি চলে এসেছিলেন হাসপাতালে বাবাকে শেষ দেখা দেখতে। আজীবন আদর্শবাদী রাজনীতি করা একজন আপাদমস্তক রাজনীতিবিদের প্রতি আপনার গভীর শ্রদ্ধা, নিঃস্বার্থ ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ দেখেছিলাম সেদিন। যদিও এর আগে পরে বহুবারই এই শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ আমি দেখেছি। গভীর মমতায় বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন আমাকে। সেই স্পর্শ আমাকে সাহস দিয়েছিল জীবনের মুখোমুখি দাঁড়াবার। এর কিছুদিন পরই ২০১৩ সালে আমাকে না জানিয়ে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে চীন যাবার প্রতিনিধি দলে আমাকে নির্বাচিত করেছিলেন। তার কিছুদিন পরই আমাকে স্থান দিয়েছিলেন ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটিতে। নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম আমি। সব বিশাল নাম সেই কমিটিতে তখন। তার কিছুদিন পর আমাকে কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহ-সম্পাদক বানালেন আপনি। কতটা পেরেছি জানি না, আমার ওপর অর্পিত প্রতিটি দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছি সর্বান্তকরণে। বহুবার কানে এসেছে অনেকের অনেক কথাকে দু’পায়ে ঠেলে শক্তভাবে আমার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন আপনি। এত ভালোবাসা, স্নেহ আর বিশ্বাসের ঋণ কি দিয়ে চুকাবো আমি?
এমন গল্প শুধু আমার না, এমন ব্যক্তিগত গল্প আছে এই দলের অসংখ্য মানুষের- যাদের আপনি ‘কিছু না’ থেকে পরিণত করেছিলেন ‘অনেক কিছু’তে।
রুমিন ফারহানা |
যখন বেড়ে উঠছিলাম একটু একটু করে, বুঝতে শুরু করেছি সমাজ-রাজনীতি তখন থেকেই দেখেছি আপসহীন শব্দটা এই দেশে আপনার নামের একটা প্রতিশব্দে পরিণত হয়েছে। সেটার এক অসাধারণ বহিঃপ্রকাশ চাক্ষুষ করেছিলাম যেদিন সর্বশেষ আপনাকে দেখতে যাই হাসপাতালে। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ম্যাডাম অনেক সাংবাদিক তো প্যারোলের কথা জানতে চায়, কি বলবো? অসুস্থতায়, দুর্বলতায় আপনার ক্ষীণ কণ্ঠটি চকিতে কঠোর হয়ে উঠলো, জানালেন, আপনি প্যারোল চাইবেন না, কারণ আপনি জামিনের হকদার।
দেশের এক রাজনৈতিক ক্রান্তিলগ্ন, এক-এগারোর পর সেই সময়ের সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইনজীবীর সহযোগী হিসেবে কাজ করেছিলাম। সেই সময় আপনার মামলার মতো মামলায় কত মানুষের জামিন করিয়েছি আমরা। আইনের একেবারে প্রাথমিক পাঠ এর ছাত্ররা, এমনকি সাধারণ সচেতন মানুষও জানে বেশি বয়স, নারী, শারীরিক অসুস্থতা, সামাজিক অবস্থানের যেকোনো একটি গ্রাউন্ডেই একজন মানুষ জামিন পেতে পারে। আপনার ক্ষেত্রে এর সবগুলো আছে, কিন্তু জামিন পান না আপনি। একটা সরকার এই রাষ্ট্রের প্রশাসন, বিচার সবকিছু একত্র করে সর্বশক্তিতে নেমেছে আপনাকে জেলে আটকে রাখার জন্য। কারণ আপনাকে বন্দি করা গেলে বন্দি হয় গণতন্ত্র, বন্দি হয় দেশের ১৭ কোটি মানুষের মুক্তির স্বপ্ন।
এটা অনুমিতই ছিল। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়া ছাড়া একটার পর একটা মেয়াদ ক্ষমতায় থাকার পথে এই সরকারের প্রধান বাধা আপনি। সেই স্বৈরাচারী এরশাদের সময় থেকেই আপনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন এই দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রতীক আপনি। ক্ষমতাসীন দলটি এরশাদের সঙ্গে আপস করে তার ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করতে সাহায্য করেছিল, শুধু আপনার দৃঢ়তার কারণেই শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পারেনি এরশাদ। এরপর এক এগারোর সরকার আপনাকে জোর করে দেশ থেকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে আপনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, যাননি, যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকেও জুগিয়েছিল দেশে ফিরে আসার সাহস।
আপনার গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাস বলে আপনাকে ভয় পাবারই কথা যেকোনো স্বৈরশাসকের। পাচ্ছে বর্তমান স্বৈরাচারটিও।
যে অভিযোগে আপনার ওপর এই বিপর্যয় নেমে এসেছে, কি বীভৎস মিথ্যা সেটা। একটি পয়সাও এদিক-সেদিক হয়নি বরং বেড়েছে সেটা অনেক। আপনাকে নিয়ে এই ঘটনাগুলো ঘটছে এমন একটা দেশে যে দেশ এই মুহূর্তে বিশ্বের লুটপাটের স্বর্গরাজ্য। লাখ লাখ কোটি টাকা লুটপাট হয়, বিদেশে পাচার হয় প্রতিবছর। ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনের দ্বিতীয় তৃতীয় সারির নেতারাও এখন হাজার কোটি টাকার মালিক। সর্বোচ্চ পর্যায়ের অঙ্কের কথা কল্পনায় আনতেও ভয় লাগে।
আমি জানি দীর্ঘ ১১ বছর বীভৎস সব নিপীড়নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে আমাদের নেতাকর্মীরা। জানেন ম্যাডাম, এখন আমাদের মধ্যে দেখা হলে প্রাথমিক কুশলের পর অনিবার্য প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে কার বিরুদ্ধে কয়টা মামলা। অসংখ্য কর্মী মাসের পর মাস, বছরের পর বছর জেল খেটেছে, বহু কর্মীকে তুলে নিয়ে গিয়ে ক্রসফায়ারের নামে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে, অনেক কর্মী এখনো গুম হয়ে আছে। তাদের সবার কষ্ট বুকে ধারণ করেই তো আজ আপনি কারাগারে। আপনি চাইলে, একটু ইশারা করলে কি না হতে পারত? আরাম আয়েশ আর স্বাচ্ছন্দ্যের জীবনের চেয়ে ১৭ কোটি মানুষের জীবন বড় হয়ে উঠলো যে আপনার কাছে। আপনি যে বেগম খালেদা জিয়া, ইতিহাসে রাষ্ট্রনায়ক হবার জন্য যার জন্ম।
এই দেশের বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে সরাসরি কাজ করা একজন আইনজীবী, বিচারাঙ্গনের বর্তমান পরিস্থিতি এবং একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই জানি বিচার প্রক্রিয়ায় আপনার মুক্তি হয়তো সম্ভব না। বাকি থাকে নানামুখী প্রতিবাদ-আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ তৈরি করা। সংসদ, টকশো, কিংবা পত্রিকার কলাম যখন যেখানে পেরেছি আপনার ওপর বীভৎস নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছি। রাস্তায়ও আমাদের কর্মীরা নেমেছে। কিন্তু সরকারের মামলার খড়গও নেমে এসেছে সবার ওপর, আমার বিরুদ্ধেও কয়েকটি মামলা হয়েছে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে।
এটা যেমন সত্যি, পরিস্থিতি ভীষণ প্রতিকূল, তেমনি এটাও সত্যি এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আমাদের পথ বের করতে হবে। মা, পারছি কি আমরা?
এতবড় দল আপনার, কিন্তু দুই বছরের বেশি জেলে থাকার পরও সেই বিশাল দল সরকারকে বাধ্য করতে পারেনি আপনাকে মুক্তি দিতে, এটা ভেবে কি আপনার মনে কষ্ট হয় খুব? আগেই বলেছি অনেকে ‘কিছু না’ থেকে ‘অনেক কিছু’তে পরিণত হয়েছে আপনার আশীর্বাদে। আপনার এই দুর্দিনে আমাদের দায়িত্ব আমরা যথাযথভাবে পালন করতে পারিনি- এই অপরাধবোধ আমাকে তাড়া করে বেড়ায় প্রতিটা মুহূর্তে।
মা’গো, আমরা লজ্জিত, আপনার কাছে অপরাধী। আপনার যোগ্য সন্তান হতে পারিনি আমরা। কিন্তু মা দেশের মানুষ মুক্তির যে স্বপ্ন দেখে- গণতন্ত্র, সুশাসন, ন্যায়বিচার আর মানবিক মর্যাদাপূর্ণ সমাজের যে আশা আজও বুকে ধারণ করে তা আপনাকে ঘিরেই। তারা বিশ্বাস করে আপনার হাতে দেশ নিরাপদ, নিরাপদ দেশের মানুষ। আপনি বারবার মুক্ত করেছেন এদেশের মানুষকে। এবারও আপনার হাত ধরেই আসবে গণমানুষের মুক্তি। আপনি তাদের একমাত্র আস্থা আর বিশ্বাসের ঠিকানা। সাধারণ মানুষই তাদের স্বার্থেই মুক্ত করে আনবে আপনাকে। তাদের হৃদয়ের সিংহাসনে আপনি রানীর আসনে অসীন থাকবেন চিরকাল।
- কার্টসি - মানবজমিন/ ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২০
No comments:
Post a Comment