সায়ন্থ সাখাওয়াৎ
প্রচারণার উৎসব এবং বিরোধী দল ও ভোটারের উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে ঢাকায় যে ইভিএম মাধ্যমের ইলেকশনটা হয়ে গেল, তার মাধ্যমে কী পেলাম আমরা? কেমন হলো এই নির্বাচনটি? শুধু বিজয়ী বা পরাজিতদের দৃষ্টিতে নয়, ভোটারের দৃষ্টিতে কেমন ছিল সে নির্বাচন? ভোটারদের সঙ্গে কথা বলার, তাদের মনোভাব জানার সুযোগ নিশ্চয়ই কমবেশি সবারই হয়েছে। তার কিছুটা এসেছে সংবাদমাধ্যমেও।
প্রথমেই দেখে নেওয়া যাক। দেশের প্রথম সারির দৈনিক প্রথম আলোর কয়েকটি শিরোনাম ছিল গোপন বুথে ঢুকে পড়লেন আ.লীগের এজেন্ট, ‘৫ মিনিটে কার্জন হল এলাকা না ছাড়লে খবর আছে’, আ.লীগের ভোটারও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, ১৫-১৭% জনসমর্থন নিয়ে মেয়র, ‘নেই’ আর ‘নেই’-এর নির্বাচন, ইভিএমেও নিজের পছন্দে ভোট দিতে পারলেন না অনেকে, ঢাকার দুই সিটিতে নিয়ন্ত্রিত ভোটের নতুন রূপ, ‘দ্যাখেন না মিডিয়া আছে, ফিতা খোলেন’, জোর করে অন্য প্রতীকে ভোটের অভিযোগ, আঙুলের ছাপ মেলেনি সিইসির, পরিচয়পত্র দিয়ে ভোট দিলেন, বাটন চেপে ভোটটি দিলেন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটি, ভোটার না থাক ভোট তো আছে!, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএনপির এজেন্টদের পিটিয়ে বের করে দিল ছাত্রলীগ।
আরও কয়েকটি দৈনিকের শিরোনাম ছিল এই রকম ইভিএম আমাকে চিহ্নিত করতে পারেনি : জাফরুল্লাহ চৌধুরী (যুগান্তর), ভোটের মাঠে এক পক্ষ ছাড়া অন্য পক্ষকে দেখা যায়নি : ইসি মাহবুব (যুগান্তর), ইভিএমেও ভোট ‘ছিনতাই’! (বিডিনিউজ ২৪ ডটকম), ঢাকায় ভোটার খরার ভোটে নৌকার জয় (বিডিনিউজ ২৪ ডটকম), ধানের শীষে ভোট দেয়ায় ভোটারকে মারধর (মানবজমিন), উত্তরায় বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থী ও এজেন্টকে মারধর (মানবজমিন), আধঘণ্টায় একটি ভোটও পড়েনি সিইসির কেন্দ্রে (মানবজমিন), ভেতরে কৃত্রিম লাইন, ফিরে যাচ্ছেন ভোটাররা (মানবজমিন), নিরাপত্তাহীনতায় কাউন্সিলর প্রার্থীই ভোট দেননি (মানবজমিন), ভোট দিলেন ড. কামাল; লেখা উঠল আবার চেষ্টা করুন (যমুনা টিভি), ইভিএমে যত বিপত্তি (বাংলাদেশ প্রতিদিন), AL People Press EVM (Nwe Age), 3 journos beaten up (The Daily Star), Snapshots of election day: As we saw it (The Daily Star), ভোটে জনগণের অনীহা দেখে যে প্রশ্ন জেগেছে ইসি মাহবুবের মনে (দেশ রূপান্তর)।
সায়ন্থ সাখাওয়াৎ |
এই সংবাদ শিরোনামগুলো কী নির্দেশ করে? নির্বাচন কমিশন, সরকার বা আওয়ামী লীগের দাবি করা অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সাক্ষ্য দেয় এই রিপোর্টগুলো? প্রথম আলোর ‘ঢাকার দুই সিটিতে নিয়ন্ত্রিত ভোটের নতুন রূপ’ শিরোনামের রিপোর্টে লিখেছে, ১. ভোটার যন্ত্রে আঙুলের ছাপ দেওয়ার পর ব্যালট উন্মুক্ত হলো। কাপড় দিয়ে ঘেরা গোপনকক্ষে ভোট সম্পন্ন করতে গেলেন। এ সময় কোন মার্কায় ভোট দিয়েছেন, তা উঁকি দিয়ে প্রত্যক্ষ করছেন অবাঞ্ছিত ব্যক্তিরা। ২. ভোটার গোপনকক্ষে গিয়ে দেখলেন, সেখানে থাকা অবাঞ্ছিত ব্যক্তি তার ভোট দিয়ে দিচ্ছেন। ৩. ভোটার গোপনকক্ষে প্রবেশ করার পর কোন মার্কায় ভোট দিতে হবে, তা বলে দিচ্ছেন অবাঞ্ছিত ব্যক্তি। বেশির ভাগ ভোটকক্ষের দৃশ্য ছিল এমনই। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এভাবে ‘নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে’ ভোট গ্রহণ হয়েছে। ভোটকক্ষ, কেন্দ্রের ভেতরে এবং কেন্দ্রের আশপাশের এলাকায় নৌকার ব্যাজধারীদের একতরফা নিয়ন্ত্রণ ছিল। ফলে গোপন ভোট আর গোপন থাকেনি। পত্রিকাটি আরও লেখে, প্রথম আলোর ৬৬ জন সাংবাদিক ও আলোকচিত্রী দিনভর ঘুরেছেন। তারা ৪২৭টি কেন্দ্র ঘুরেছেন। এর মধ্যে সকালে ১২৫টি কেন্দ্রের কিছু কিছু কেন্দ্রে বিএনপির এজেন্ট দেখা গেছে। তবে বেলা ১টার পর তাদের আর পাওয়া যায়নি।
ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের অভিজ্ঞতাও অভিন্ন। পত্রিকাটির সাংবাদিকরা পর্যবেক্ষণ করেছেন ২০৭টি কেন্দ্র। তার মধ্যে মাত্র তিনটি কেন্দ্রের সামনে তারা দেখা পেয়েছেন বিএনপি প্রার্থীর সহায়তাকারীর। আর ধানের শীষের এজেন্ট পেয়েছেন মাত্র ২০টি কেন্দ্রে। কেন্দ্রের সামনে শুধু নৌকা সমর্থকদের জটলা, নৌকার ব্যাজ পরিহিত কর্মীদের দিয়ে কৃত্রিম লাইন বানিয়ে রাখা, ভেতরে শুধু নৌকার এজেন্ট, বুথে ঢুকে ভোটারদের সাহায্য করার নামে নৌকা ও আওয়ামী লীগ দলীয় কাউন্সিলকে ভোট দিতে বাধ্য করা বা নিজেরাই বাটন টিপে দিয়ে দেওয়াসহ সব অপকর্মের চিত্র দুটো পত্রিকার পর্যবেক্ষণেই ছিল অভিন্ন।
এত কিছু করেও এই নির্বাচনে ভোটারের আকাল ছিল লক্ষণীয়। ঢাকা দক্ষিণে আওয়ামী লীগ প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস ৪ লাখ ২৪ হাজার ৫৯৫ ভোট ও ঢাকা উত্তরে আতিকুল ইসলাম ৪ লাখ ৪৭ হাজার ২১১ ভোট পেয়ে মেয়রের চেয়ারে বসতে যাচ্ছেন। তাদের বিপরীতে দক্ষিণে বিএনপির ইশরাক হোসেন পেয়েছেন ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫১২ ভোট ও উত্তরে তাবিথ আউয়াল পেয়েছেন ২ লাখ ৬৪ হাজার ১৬১ ভোট। নির্বাচন কমিশন ঘোষিত ফলাফলে দেখা যায়, মোট ২৪ লাখ ৫৩ হাজার ভোটারের মধ্যে দক্ষিণে মাত্র ২৯ শতাংশ ও উত্তরে ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট পড়েছে। পাঁচ বছর আগে ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল ঢাকার দুই সিটি ও চট্টগ্রাম সিটিতে একদিনেই ভোট হয়েছিল। তাতে ব্যালট পেপারে গড়ে ভোট পড়েছিল ৪৩ শতাংশ। তখন ঢাকা উত্তর সিটিতে ভোটার উপস্থিতির হার ছিল ৩৭ শতাংশ; দক্ষিণ সিটিতে ৪৮ শতাংশ। আর ২০১৯ সালে ঢাকা উত্তরের মেয়র পদের উপনির্বাচনে ৩১ শতাংশ ভোট পড়ে। এসব পরিসংখ্যানই ইসি ঘোষিত। যার ওপর মানুষের আস্থা নেই মোটেই। অনেকেই মেনে করেন প্রদত্ত ভোটের হার ইসি নানা দিক বিবেচনায় নিয়ে নির্ধারণ করেন। সে সন্দেহ ঘনীভূত করেছে এবার ফল ঘোষণায় অতিরিক্ত বিলম্ব।
ইভিএমে আধা ঘণ্টায় ফল ঘোষণা করা যাবে বলে ইসি এত দিন ধরে প্রচার করলেও ঢাকা দক্ষিণের ফল ঘোষণা করতে মধ্যরাত গড়িয়ে যায়, উত্তরের ক্ষেত্রে সময় লাগে আরও বেশি। এর কোনোটিতেই কাগুজে ব্যালটের চেয়ে কম সময়ে ফল ঘোষণা করতে পারেনি ইসি। এ সময় নিয়ে প্রদত্ত ভোটের হিসাবে জালিয়াতি করেছে ইসি, এমন অভিযোগ অনেকেরই। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতা ডক্টর কামাল বলেছেন, এই নির্বাচনে মানুষের রায় ৫-৭ শতাংশ, বাকিটা জালভোট। এত জালিয়াতির পরও ঢাকার দুই অংশের মেয়র যে কথিত জনরায় নিয়ে মেয়রের চেয়ারে বসতে যাচ্ছেন, তা যথেষ্ট কি না সে প্রশ্নও উঠেছে ইতিমধ্যেই। ইসি ঘোষিত হিসেবেই আতিকুল ইসলাম মোট ভোটারের মাত্র ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ ও শেখ ফজলে নূর তাপস ১৭ দশমিক ৩০ শতাংশের সমর্থন নিয়ে মেয়রের দায়িত্ব নিচ্ছেন। অর্থাৎ এই নগরীর ৮৫ শতাংশ ভোটার ভোট দেননি তাদের।
কিন্তু প্রচারে এত উৎসব ভাব এনে, প্রতিপক্ষকে মাঠছাড়া করে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে নিজেদের পক্ষে ভোট বাড়িয়েও মাত্র ১৪ ও ১৭ শতাংশ ভোটের মালিক কেন আওয়ামী লীগ? অনেকেই বলে থাকেন আওয়ামী লীগের নিজস্ব একটা কোর ভোটার গ্রুপ আছে। তা ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। তা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সেই কোর ভোটার গেল কোথায়? তারাও কি নির্বাচনবিমুখ হয়ে পড়েছে? নাকি আওয়ামী লীগের সেই কথিত কোর ভোটারের সংখ্যাটাই ১৪-১৭ শতাংশে নেমে এসেছে? এই নির্বাচনের পর সংবাদমাধ্যমে যতটা না আলোচনা হয়েছে, আওয়ামী লীগের ভোট জালিয়াতির নানা কৌশল নির্বাচন কমিশনের দায় নিয়ে, তার চেয়ে বেশি আলোচনা দেখা গেছে মানুষ কেন ভোটবিমুখ হয়ে পড়ছে তা নিয়ে। অন্যান্য সংবাদমাধ্যমের মতো বিবিসি বাংলাও প্রকাশ করেছে তাদের অনুসন্ধানের সারমর্ম। তাদের চিহ্নিত পাঁচটি কারণ ছিল অনীহা, অনাস্থা, অনিয়মের আশঙ্কা, পরিবহন সংকট ও ছুটির ফাঁদ। বিবিসির দেওয়া পাঁচ কারণের মধ্যে প্রথম তিনটিই যে প্রধান, সে বিষয়ে বোধ করি কারও দ্বিমত নেই। এ সরকারের আমলে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, তাতে মানুষের মনে এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে, ভোট দিয়ে কোনো লাভ নেই, ফলাফল পূর্বনির্ধারিত।
সরকার যা চাইবে ইসি তাই করবে। সুতরাং ভোট দিতে কেন্দ্রে গিয়ে লাভ নেই। এর মধ্যেও যারা সরকারের ও তাদের অনুগত ইসির অন্যায়ের প্রতিবাদস্বরূপ কেন্দ্রে যেতে ইচ্ছুক, তাদের একটা অংশ শেষ পর্যন্ত বিরত থেকেছে আওয়ামী লীগের কর্মীদের দখলে থাকা কেন্দ্রে গিয়ে নিজেদের পছন্দমতো ভোট দিতে না পারার শঙ্কা থেকে। আবার কেউ তাদের হাতে হেনস্তা হওয়ার ভয়েও বিরত থেকেছেন কেন্দ্রে যাওয়া থেকে। অনেকেই মনে করেন, বিএনপি যদি ভোটকেন্দ্রে তাদের এজেন্টদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারতেন, তবে হয়তো ঘটনা অন্য রকমও হতে পারত। একতরফাভাবে বুথে ঢুকে বাটন টেপার সুযোগ পেত না আওয়ামী লীগ। সে সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে ধানের শীষের ভোটাররা দল বেঁধে যেত কেন্দ্রে। সে জোয়ার ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়ত ইসি বা সরকারের পক্ষে। কিন্তু এটা তো সবারই জানা যে, বিএনপি গত চৌদ্দ বছর ধরে নানা নির্যাতন সহ্য করে টিকে থাকার সংগ্রাম করে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ঘরছাড়া, মামলা-মোকদ্দমায় জর্জরিত নেতাকর্মীদের অনেকে ঘরে ফিরে আসার সুযোগ পেয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নতুন করে সংঘর্ষে না জড়ানোর শর্তে। তারা কোন ভরসায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে নতুন করে দ্বন্দ্বে জড়াবেন? মেয়র নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক, ক্ষমতায় সেই আওয়ামী লীগ, তাদের সেই দাপট থাকবে অপরিবর্তিত। তাদের পুলিশ-প্রশাসনের সেই পুরনো চেহারা বহাল থাকবে। এ পরিস্থিতিতে স্থানীয় কর্মীদের জন্য কেন্দ্রে এজেন্ট হয়ে টিকে থাকাটা যে কতটা কঠিন, এটা যারা বোঝেন না, তারাই বিএনপিকে গালমন্দ করে বলেন, কেন্দ্রে এজেন্ট রাখতে পারল না কেন বিএনপি। তবে সরকারের এই নিপীড়নমূলক কৌশলকে কীভাবে মোকাবিলা করবে, বিএনপি সেটা বের করাটাই হলো রাজনীতি। আওয়ামী লীগ কোনো সুবোধ পলিটিক্যাল পার্টি নয় যে, তারা রাজনৈতিক ন্যায্যতা দেখাবে আর সে সুযোগে বিএনপি সরল রাজনীতি করে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় যাবে। বিএনপিকেই ভাবতে হবে, আওয়ামী লীগের এসব কূটকৌশল ও নিপীড়ন উপেক্ষা করে দাঁড়াতে পারে, তেমন কর্মীবাহিনী কীভাবে তৈরি করবে।
- লেখক, চিকিৎসক ও কলামনিস্ট
- কার্টসি - দেশ রুপান্তর/ ফেব্রুয়ারি ৬, ২০২০
No comments:
Post a Comment