ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনের মূল্যায়ন করে বিশিষ্টজনরা বলছেন, এই নির্বাচনের চিত্র হতাশার। নির্বাচনে ভোটের যে হার তাতে মনে হচ্ছে মানুষ নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারাচ্ছে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ভয়ে লোকজন ভোট দিতে যায়নি। ভোটারদের পছন্দের প্রার্থীদের ভোট দিতে দেয়া হয়নি। টার্গেটকৃত কেন্দ্রগুলোতে সাহায্য করার নামে সরকার দলের প্রার্থীর এজেন্টরা বেশ কিছু কেন্দ্রে এ কাজগুলো করেছে। সব মিলিয়ে এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত এবং নির্ধারিত ভোট হয়েছে। নির্বাচনের আগে অনেক নেতিবাচক প্রচারণা হয়েছে। বিগত একাধিক নির্বাচনে ভোটারদের ভোট দিতে দেয়া হয়নি।
রাতে ভোট হয়েছে। এসকল কারণে অনিহার জায়গা থেকে ভোটাররা ভোট দিতে যায়নি। ভবিষ্যতে দেখা যাবে ভোটারশূণ্য যারা নির্বাচিত হচ্ছেন তাদের নৈতিকা থাকছে না। এত কম ভোট পড়া বর্তমান ইসির জন্য স্বাভাবিক হতে পারে, বাংলাদেশের ভোটারদের জন্য নয়।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক এ বিষয়ে বলেন, এত কম ভোটার অংশগ্রহণে যেটা স্পষ্ট সেটা প্রথমত, নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপরে ভোটারদের আস্থা নেই বললেই চলে। দ্বিতীয়ত, অবাধে ইচ্ছামত ভোট দিতে পারবে সেই বিশ্বাসও চলে গেছে বলে প্রতিয়মান হয়। অর্থাৎ গণতন্ত্রের প্রথম ধাপ একটি সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচন সেটাই হারিয়ে গেছে। গত ১০০ বছরে গণতন্ত্র ছাড়া চার থেকে পাঁচটি দেশে উন্নয়ন হয়েছে। আর গণতন্ত্র ছাড়া উন্নয়নের চেষ্টা করেছে এমন দেশের সংখ্যা প্রায় শতাধিক। অতএব, নির্বাচন তথা গণতন্ত্র ছাড়া আমাদের উন্নয়ন সম্ভব না। মুখে নিজেকে যত বড় উন্নয়নের রোল মডেল বলে দাবি করিনা কেনো আমার আশঙ্কা প্রকৃত অর্থে জনগণের উন্নয়ন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়লো।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ভোটার উপস্থিতি কম হওয়া এবং ইসি যে ভোটের তথ্য দিয়েছে এটা নিয়ে অনেকের মনে সন্দেহ আছে। ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার একটি বড় কারণ হচ্ছে, ইভিএমএ ভোট হয়েছে এবং ইভিএমএ অনেকগুলো দুর্বলতা আছে। ইভিএম যে ত্রুটিপূর্ণ এটা আমাদের প্রধান নির্বাচন কমিশন কয়েকদিন আগেই বলেছেন। ত্রুটি দূর করার জন্য ইসি কি করেছেন এবং কি ত্রুটি সেটা তিনি আমাদের বলেননি। ইভিএম নিয়ে মানুষের সন্দেহ আছে। আগের সিটি নির্বাচনও ছিল নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন। এর মাধ্যমে তাদের প্রতি জনগণের বিশ্বাস রাখাটা দূরুহ। মানুষ নির্বাচনের প্রতি বিমূখ হয়েছে। তাদের ধারণা আমরা যাই বা না যাই তাতে কি আসে যায়। যে নির্বাচিত হওয়ার তা হবেই। ভোট দিলাম কি না দিলাম। গেলেও যে ভোট দিতে পারবো তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ভোট কেন্দ্রে নিরাপত্তার ত্রুটি ছিল। এমনকি তাদের নিজেদের দলের লোকেরা পর্যন্ত বিমূখ ছিল। মোটা দাগে বলা যায়, সন্দেহ, আস্থাহীনতা এবং নিরাপত্তার ত্রুটি এসকল কারণে ভোটার উপস্থিতি এবং ভোট কম পড়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নির্বাচন কমিশন প্রার্থীদের সমান প্রতিযোগীতার ক্ষেত্র প্রস্তুতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। যে কারণে ভোটারগণ ভোটকেন্দ্রে আসতে উৎসাহ পায়নি। নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে আস্থার সংকট ছিল। ভোটাররা ভেবেছেন ভোট দিতে গিয়ে লাভ নেই। অথবা যারা গিয়েছেন তারা প্রতারিত হয়েছেন। অনেকে তাদের পছন্দের প্রার্থীদের ভোট দিতে পারেননি। ফলে এই নির্বাচনে যারা জয়ী হয়েছেন তারা আস্থার সঙ্গে বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন বলে আমি বিশ্বাস করি না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, এবার ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএম-এর নামে তামাশা হয়েছে। অনেকের আঙ্গুলের ছাপ মেলেনি। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জিনিসটা হচ্ছে যেখানে ভোট দিবে মানুষ সেখানে আওয়ামী লীগের লোকজন ঢুকে গেছে। বাধ্য করেছে বা প্রভাবিত করেছে ভোট দিতে। এটা সব পত্র-পত্রিকায় এসেছে। আমি বলবো গত সংসদ নির্বাচন যেটা ছিল নৈশ নির্বাচন। সেখানে যদি দশে শূন্য পেয়ে থাকে তাহলে এই নির্বাচনে ওরা দশে দুই পেয়েছে। নির্বাচনে চরম একটা আনফ্রেন্ডলি পরিস্থিতি আমরা দেখেছি। প্রথমত, এখানে মানুষের কোন আস্থা ছিলনা যে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হবে। এ জন্য বিপুল সংখ্যক ভোটার ভোট দানে বিরত ছিল। সাধারণত যে সংখ্যায় ভোটার যায় তার এক তৃতীয়াংশের মত ভোটার ভোট কেন্দ্রে গিয়েছে। তাদের মধ্যেও বহু সংখ্যক মানুষ ভোট দিতে পারেনি নিজের পছন্দ মত। অনেকের আঙ্গুলের ছাপ মেলেনি। আবার অনেককে ভোট দিতে বাধ্য করেছে। তারপরেও বিএনপি যে ভোট পেয়েছে এটা তো বিস্ময়কর বলতে হয়। বুঝাই যাচ্ছে এত কিছুর পরও যে, বিএনপি ভোট পেয়েছে যদি সুষ্ঠু এবং অবাধ নির্বাচন হতো তাহলে আওয়ামী লীগের জন্য বিপর্যয়কর ফল আসতো।
নির্বাচনের মূল উদ্দেশ্য থাকে প্রকৃত জণপ্রতিনিধি নির্বাচন করা। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমরা কোন প্রকৃত জণপ্রতিনিধি পাইনি। ইভিএম এবং নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি মানুষের অনাস্থা আরো বাড়বে। ইভিএম যে বাংলাদেশে কতটা অনির্ভরশীল হতে পারে এবং কতটা অনিয়ম করতে পারে সেটার একটা প্রমাণ আমরা দেখলাম। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে ইভিএম বলেন আর যাই বলেন এগুলোর পেছনে যে মানুষ আছে আর যে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা সেখানে যদি কোনরকম সুষ্ঠু, স্বচ্ছতা বা সততা না থাকে তাহলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মেশিন আনলেও নির্বাচন ঠিকমত করতে পারবে না।
- কার্টসি - মানবজমিন/ ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০
No comments:
Post a Comment