Search

Tuesday, April 26, 2022

শিশুদের উপর দারিদ্রতার কষাঘাত, অন্ধকার জাতির ভবিষ্যৎ

—  মুহম্মদ মাহাথির


কবি গোলাম মোস্তফার ‘কিশোর’ কবিতার ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে’ লাইনটি  বিখ্যাত হয়ে আছে, যা বোঝাচ্ছে, শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ। তাই আজকের শিশুর সঠিক ও সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার ওপর নির্ভর করছে দেশের ভবিষ্যত। দুঃখজনক হলেও সত্য দেশে বিদ্যমান দারিদ্রতার কষাঘাতে জীবনের শুরুতেই থেমে যাচ্ছে অনেক শিশুর সঠিক বিকাশ।  

শনিবার,  জানুয়ারি ২২, ২০২২,  ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘শিশুশ্রম নিরসনে ট্রেড ইউনিয়ন ও গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক এক মতবিনিময়সভায় জানানো হয় দেশে প্রায় অর্ধকোটি শিশু শ্রমিক রয়েছে। প্রতিদিনই এই সংখ্যা বেড়ে চলেছে। 

দেশের খাবারের হোটেলে, পরিবহণে, কৃষিকাজে, কলকারখানায়, হাটবাজারে, রাস্তাঘাটে অগণিত শিশুদের নানা রকম অমানবিক কাজ করতে দেখা যায়। অসংখ্য শিশু ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত। অথচ এই সময়ে তাদের থাকার কথা ছিল বিদ্যালয়ে পড়ালেখায়, পরিবারে আদর স্নেহে। 

সম্প্রতি দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত দুইটি প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে বর্তমানে শিশুদের কী করুণ অবস্থা। 

রান্নাঘরের খুঁটির সঙ্গে শিশু সিমন হোসেনের পা শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। সামনে সিমনের ভাই ইবল ও বোন আমবিয়া। বদরগঞ্জ পৌরসভার পকিহানা গ্রামের রেলবস্তির
ছবি: প্রথম আলো


এপ্রিল ২৫, ২০২২, বদরগঞ্জ, রংপুর থেকে আলতাফ হোসেনের লেখা ‘প্রতিবেশীদের বাড়িতে গিয়ে খাবার চায় শিশু দুটি, তাই শিকলে বেঁধে রাখছেন মা–বাবা’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রংপুরের বদরগঞ্জ পৌরসভার পকিহানা গ্রামের রেলবস্তির দুই শিশু সহোদর সুমন হোসেন, ১০ ও সিমন হোসেন, ৮, কে যথাক্রমে ছয়মাস ও ১৫ দিন ধরে পায়ে শিকল লাগিয়ে রেখেছে তাদের মা। 

দরিদ্র ওই পরিবারের সদস্যদের অনাহারে–অর্ধাহারে দিন কাটে। ক্ষুধার জ্বালায় সুমন ও সিমন বিভিন্ন সময়ে প্রতিবেশীদের বাড়িতে গিয়ে খাবার চায়, কখনোবা গোপনে গাছের ফল ছিঁড়ে নিয়ে আসে। এসব কারণে প্রতিবেশীদের কথা শুনতে হয় তাঁদের মা–বাবাকে। তাই এই ব্যবস্থা। 

চাল কিনবে বলে শাকের আঁটি বিক্রি করতে বের হয় পাঁচ বছরের আরিয়ান
ছবি: প্রথম আলো


বাগেরহাট থেকে সরদার ইনজামামুল হকের ‘চাল কিনবে বলে শাক বেচতে বের হয়েছে ছোট্ট আরিয়ান’ হেডলাইনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে শিশু আরিয়ানের কথা যে অনাহারের থাকা মায়ের জন্য চাল কিনবে বলে রাস্তার ধার থেকে শাক কুড়িয়ে কয়েক মাইল হেঁটে যায় বাগেরহাট শহরে। সে নিজেও ছিল ক্ষুধার্ত।  

শুধু আরিয়ান, সুমন ও সিমনই নয় দেশের প্রতিটি জনপদে অগণিত শিশুর জীবন দারিদ্রতার কঠিন আঘাতে তছনছ। খাবারের অভাবে পুষ্টিহীনভাবে বেড়ে উঠছে তারা। স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে থাকছে নিরক্ষর। ফলে তৈরি হচ্ছে এক বিশাল অদক্ষ ও অসুস্থ জনগোষ্ঠী। এদের অনেকেই সমাজে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। দক্ষতার অভাবে ভালো কোন কাজ এরা পায় না। দারিদ্রতার দুষ্টচক্রে বাধা পড়ছে এরা। 

বর্তমান অবৈধ সরকার দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিশুদের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষার কোন ব্যবস্থা করেনি। 

জনগণের ভোটে নির্বাচিত দক্ষ সরকার ও ভিশনারি নেতৃত্বই একমাত্র পারবে শিশুদের জন্য একটি সুন্দর জীবন নিশ্চিত করতে। 

টেইক ব্যাক বাংলাদেশ।

Saturday, April 23, 2022

নিরীহ সন্তান হত্যার বিচার চায় না কেন পরিবার?

তারিক চয়ন

 


ঘটনা এক

গত ২৪ মার্চ রাতে রাজধানীর শাহজাহানপুরের আমতলা মসজিদ এলাকায় দুর্বৃত্তের এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত হন মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু। ওই সময় টিপুর গাড়ির পাশেই যানজটের কারণে সড়কে আটকা পড়েছিল বদরুন্নেসা কলেজের শিক্ষার্থী সামিয়া আফরিন প্রীতি, ১৯ এবং তার বান্ধবী সুমাইয়াদের বহনকারী রিকশা। গুলি এসে লাগে রিকশায় বসে থাকা প্রীতির শরীরেও। টিপুর গাড়িচালক মনির হোসেন মুন্নাও গুলিতে আহত হন। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাদের হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক দুজনকে মৃত ঘোষণা করেন।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, মেয়েকে হারিয়ে প্রীতিদের শান্তিবাগের বাসায় শোকের মাতম চলছিল। শোকার্ত মা হোসনে আরা শুধু বলছিলেন, "বিচার চাই না। শুধু মেয়ের লাশ পৌঁছে দিলেই হবে।" আর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মর্গে প্রীতির বাবা জামাল উদ্দিন বলেছিলেন, "একজনকে মারতে গিয়ে আমার মেয়ের শরীরে গুলি লেগেছে।

সন্তানের এমন মৃত্যু কোনো বাবা-মা চান না। আমি তো মেয়ে হারিয়েছি। সম্পদ গেলে সম্পদ ফিরে পাওয়া যায়, কিন্তু কোনো প্রাণ গেলে তা আর ফিরে পাওয়া যায় না। আমি কোনো আইনগত ব্যবস্থা নিতে চাই না... মেয়ে হত্যার বিচার চাই না। মামলা চালানোর মতো অবস্থাও নেই। আমরা নিরীহ মানুষ। বিচার চাইলে আল্লাহর কাছে চাই।" এমনকি মেয়ে হত্যার শাস্তি চাইতে গিয়ে 'বিবাদে'ও জড়াতে চান না বলে জানান তিনি, "কার শাস্তি চাইব? আমি তো কাউকে চিনি না, জানি না কে আমার মেয়েকে মেরেছে। কোনো বিবাদে জড়াতে চাই না।"

ঘটনা দুই 

গত পহেলা এপ্রিল রাতে খিলগাঁও তিলপাপাড়া এলাকায় স্বামীর সাথে মোটরসাইকেলে করে বাসায় ফিরছিলেন ২০ বছর বয়সী গৃহবধূ নাসরিন খানম। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি তাদের মোটরসাইকেলটিকে ধাক্কা দিলে নাসরিন পড়ে যান এবং তার মৃত্যু হয়।

পরদিন চ্যানেল আইয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নিহত নাসরিনের পরিবারের পক্ষ থেকে জিডি করা হলেও কোন মামলা করা হয়নি। ঘটনার পর গাড়িচালক বকুল মিয়াকে আটক করা হলেও নিহতের পরিবার থেকে কোন মামলা না করায় তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে বলে জানায় খিলগাঁও থানা পুলিশ। নাসরিনের স্বামী মোঃ শামীম জানান, বিচার পাবেন না বলে তারা বিচার চান না। শামীম বলেন, "দেশের ভেতর কতো কী ঘটছে! কেউ পেরেছে? কোনকিছুই হয় নাই। আপনারা সংবাদ (প্রচার) করবেন, জনগণকে জানাবেন। পুলিশ কিছুই করবে না। দেশ দেশ নিয়েই থাকবে। এই আইন আমাদেরকে শেখাবেন না।"

ঘটনা তিন

গত ১৯ এপ্রিল সকালে কামরাঙ্গীরচরের বাসা থেকে বের হয়ে নিউমার্কেট হয়ে মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন নাহিদ হোসেন, ২০। কিন্তু, নুরজাহান মার্কেটের সামনে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও দোকান কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গুরুতর আহত হন তিনি। এরপর তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে ওইদিন রাতেই তার মৃত্যু হয়।

নিজ পরিবারকে নিয়ে কামরাঙ্গীরচরে বসবাস করতেন এলিফ্যান্ট রোডের মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের একটি কম্পিউটার সরঞ্জামের দোকানে ডেলিভারিম্যান হিসেবে কর্মরত নাহিদ।

নিহত নাহিদের রোজগার দিয়েই চলতো ছয়জনের পরিবারটি।

তার ছেলে বিবাদমান কোন পক্ষের লোক ছিলেন না জানিয়ে নাহিদের বাবা বলেন, "আমরা নিরীহ মানুষ। কারও সঙ্গে ঝামেলার মধ্যে নেই। কে মারল, কেন মারল আমার ছেলেকে। ওর তো কোনো অপরাধ নেই। কারও কাছে বিচার চাই না। বিচার চেয়ে কী হবে? কার কাছে বিচার চাইবো? মামলাও করতে চাই না। এটাই তো কপালে লেখা ছিল... শুনেছি অনেকে মিলে ওকে বেদম পিটিয়েছে। ওতো কোনো পক্ষের লোক না। নিউমার্কেটের হকারও না, কলেজের ছাত্রও না।" বিচার চাইলেও বিচার পাবেন না মন্তব্য করে ছেলেহারা শোকাহত মা নার্গিস বলেন, "আমরা বিচার চাই না। নাহিদকেতো ফেরত পাবো না। বিচার চেয়ে কী হবে? বিচার চাইলেই তো আর বিচার পাব না। আমার ঘর-সংসার কীভাবে চলবে?"

উপরের তিনটি ঘটনার দিকে নজর দিলে দেখা যাবে প্রত্যেকটি ঘটনার ক্ষেত্রেই দুটি মিল রয়েছে। প্রথমতঃ নিহত নাসরিন, প্রীতি এবং নাহিদ প্রত্যেকেই নিরীহ ছিলেন। যেসব ঘটনায় তাদের মৃত্যু হয়েছে সেসবের সাথে তাদের দূরতমও কোন সম্পর্ক ছিল না। তারা নিতান্তই ভুক্তভোগী। দ্বিতীয়তঃ নাসরিন, প্রীতি এবং নাহিদ প্রত্যেকেই নিজ নিজ পরিবারে ছিলেন আদরের সন্তান। কিন্তু নিহত প্রিয়জন নিরীহ ছিলেন জেনেও তাদের পরিবার তাদের হত্যার কোন বিচার চাইছেন না!

খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, যারা তাদের নিরীহ প্রিয়জনকে হত্যার বিচার চান না, তাদের মনে কি তবে এমন ধারণা জন্মেছে যে, বিচার চেয়ে কোন লাভ নেই? কিংবা বিচার হলেও সেটা ‘ন্যায়বিচার’ হবে না? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই এমন প্রশ্ন রাখছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান ফেসবুকে লিখেছেন, "বিচার না পাওয়ার চেয়েও বিচার না চাওয়ার সংস্কৃতি অধিক আশংকাজনক!"

প্রীতি হত্যার পর বিবিসির সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান ২৬ মার্চ লিখেছিলেন, "ঢাকার রাস্তায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে দুজন নিহত হওয়ার ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও দেশের একজন নাগরিক হিসেবে এতে খুব বেশি উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। এরকম হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর সব শহরে প্রতিদিনই হচ্ছে। কিন্তু আমি উদ্বিগ্ন অন্য একটি কারণে। হত্যাকাণ্ডের পর নিহত মেয়েটির মা বলেছেন তিনি লাশ ফেরত চান, বিচার চান না। পিতা বলেছেন আমি বিচার চাই না, কার কাছে চাইবো। বুঝতে পারছেন গত ৫০ বছরে আমরা কেমন রাষ্ট্র তৈরি করেছি! সবাইকে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা।"

আমিনুল ইসলাম নামের একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছিলেন, "একজন পিতার নিরপরাধ মেয়েকে খুন করা হয়েছে। অসহায় পিতা দুনিয়াতে বিচার না চেয়ে আখেরাতে বিচার চাচ্ছেন। এ যেনো এক নীরব প্রতিবাদ।"

বিঃদ্রঃ এই প্রতিবেদনটি যখন লেখা হচ্ছিল তখনই খবর প্রকাশিত হয় যে, নিউ মার্কেটে ব্যবসায়ী এবং ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় মুরসালিন নামে আরও একজন দোকান কর্মচারীর মৃত্যু হয়েছে।

—  মানবজমিন 

গণতন্ত্র অথবা স্বৈরতন্ত্র কোন পক্ষে জার্মানি? — মুহম্মদ মাহাথির

  — মুহম্মদ মাহাথির




বাংলাদেশে জার্মান অ্যাম্বাসেডর আখিম ট্র্যোস্টার বুধবার, এপ্রিল ২০, ২০২২, ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ-ডিক্যাব আয়োজিত ’ডিক্যাব টকে’ জানিয়েছেন যে বিএনপি তার বক্তব্যের ‘মিস কোট’ করেছে। এতে তিনি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।  

অথচ জার্মান অ্যাম্বাসেডর’র এই বক্তব্যের কোন সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। বরং বলা যায় তিনি বিএনপি নেতাদের ‘মিস কোট’ করেছেন।   

বৃহস্পতিবার, মার্চ ১৭, ২০২২, গুলশানে বিএনপি চেয়ারপার্সন’র কার্যালয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দলের তিন সদস্যের প্রতিনিধি টিমের সাথে বৈঠক করেন অ্যাম্বাসেডর আখিম ট্র্যোস্টার। 

বিএনপির নেতৃবৃন্দ জার্মান রাষ্ট্রদূতের নাম উল্লেখ করে কোন বক্তব্য দেননি। এক মাসের অধিককাল আগে জার্মান রাষ্ট্রদূতের সাথে সাক্ষাৎকার পরবর্তী বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করলেই এটা পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার কথা। এই সম্পর্কিত ভিডিয়োও ইন্টারনেটে রয়েছে।  সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরে বিএনপির নেতৃবৃন্দ পরিষ্কার বলেছেন যে বিশ্বের বিভিন্ন গণতন্ত্রে এবং মানবাধিকারে বিশ্বাসী শক্তিগুলো বাংলাদেশের গণতন্ত্রহীনতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে অবগত আছেন।  

সেই বৈঠক শেষে বিএনপির জাতীয় স্থায়ীকমিটির সদস্য ও ফরেন রিলেশনস কমিটির চেয়ারম্যান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছিলেন, তাদের আলোচনায় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আগামী নির্বাচন, মানবাধিকারসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে।

বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের বিষয়ে জার্মান রাষ্ট্রদূত কী বলেছেন, এমন প্রশ্নে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্র বিষয়ে বিশ্বব্যাপী সবাই অবগত আছেন। এখানে নতুন করে বলার কিছু নেই। এগুলো নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনাও হচ্ছে এটা তো আপনারা জানেন। এসব ব্যাপারে ওনারা কনসার্ন। বাংলাদেশের বিষয় নিয়ে বিশ্বব্যাপী যে আলোচনা হচ্ছে, ওনারা তো তার একটা অংশ। ইউরোপিয় ইউনিয়ন বলেছে, আমেরিকা বলছে, ব্রিটেন বলেছে, সবাই বলছে।

বাংলাদেশের প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সাধারণত তথ্যভিত্তিক বক্তব্য প্রদান করেন। একজন অ্যাম্বাসেডরের কাজের চৌহদ্দি সম্পর্কে তিনি ভালোভাবে অবগত। সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরে তার সেই অভিজ্ঞানও সুস্পষ্ট। এখানে তিনি জার্মান অ্যাম্বাসেডরকে মোটেও কোট করেননি। দায়িত্বশীলতার সাথে একটি সাধারণ বক্তব্য দিয়েছিলেন। 

বরং এক মাস আগের একটা বৈঠক সম্পর্কে, একটা না বলা কথাকে এখন হঠাৎ করে কেন জার্মান রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে সামনে আনা হল, তা সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে আদৌ পরিষ্কার নয়। এই ব্যাপারে জার্মান রাষ্ট্রদূতের কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়লে বিএনপির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সেটা করা যেত।  ভোটাধিকার ও মানবাধিকার ফিরিয়ে আনার কঠিন সংগ্রামে নিয়োজিত বাংলাদেশিরা জার্মান অ্যাম্বাসেডরের এমন বক্তব্যে হতাশ হয়েছেন।  

বিএনপি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল, যার প্রতিষ্ঠাতা শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম শুধু বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার ঘোষকই নন, তিনি বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁকে বলা হয় আধুনিক বাংলাদেশের আর্কিটেক্ট। বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জনগণের কল্যাণে ব্যাপক কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেছিলেন। 

এক যুগধরে বিএনপি এই দেশের হারিয়ে যাওয়া গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনার সংগ্রামে নিবেদিত,  বাংলাদেশের গণতন্ত্রহীনতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে অনবরত লড়াই করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বিএনপির হাজারো সমর্থক-নেতা-কর্মী বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। পঁয়ত্রিশ লাখ সমর্থক-নেতা-কর্মী হয়তো কারাবন্দি আছেন নতুবা আদালত প্রাঙণে নিত্য হাজির থাকছেন। জার্মান অ্যাম্বাসেডর নিশ্চয় সেই খবর রাখেন।  

বিএনপি সবসময় গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারে বিশ্বাসী দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করেছে এবং সামনের দিনেও তাই করে যাবে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা, এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধে বিশ্বের বিভিন্ন পক্ষ থেকে যে স্পষ্ট ও কার্যকর সমর্থন দেখা যাচ্ছে, বিএনপি দেশের অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর মতই সেগুলোকে স্বাগত জানায়।  

জার্মানি বিশ্বের অন্যতম গণতান্ত্রিক শক্তি। বিশ্বে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সামনের কাতারেই থাকছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় বাংলাদেশিরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করছে বাংলাদেশে লুটে নেয়া গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ফিরিয়ে আনার পক্ষে অনুপস্থিত বর্তমান ঢাকাস্থ জার্মান দূতাবাস। বাংলাদেশে অব্যাহত গুম-খুন-গ্রেপ্তার ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে নিরব তারা। বাংলাদেশে মানবাধিকার ও ভোটাধিকারের অনুপস্থিতি বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশে তারা যেনো কুণ্ঠিত! বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দল বিএনপির সাথে কথা বলতেও যেনো তারা আড়ষ্ট!

ঢাকাস্থ জার্মান দূতাবাসের প্রতি নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনার আহ্বান জানাই।  

এক। 

বিশ্বের নতুন পাঁচ 'স্বৈরতান্ত্রিক দেশের তালিকায়' বাংলাদেশ স্থান করে নিয়েছে। আর ২০১৮-এ সেই তালিকা প্রকাশ করেছে জার্মান গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'বেরটেলসম্যান স্টিফটুং। 

দুই। 

জার্মানির রাজধানী বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল৷ বাংলাদেশের ২০১৮-এর জাতীয় নির্বাচনকে এই সংগঠনটি আখ্যা দিয়েছিল ‘প্রশ্নবিদ্ধ, অভূতপূর্ব এবং অবিশ্বাস্য' হিসেবে৷ ২৯৯ আসনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনটির ৫০টি আসনের নির্বাচনি প্রক্রিয়ার ওপর এক পরিবীক্ষণের ফলাফলে ৪৭টিতেই ব্যাপক অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে সংগঠনটি৷

তিন। 

ইউরোপিয় ইউনিয়নের অন্যতম শক্তিশালী সদস্য জার্মানি অতীতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কড়া মন্তব্য করেছে৷ ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর দেশের ‘কিছু এলাকা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে' বলেও মন্তব্য করেছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন জার্মান রাষ্ট্রদূত ড. আলব্রেশট কনৎসে৷ 

চার। 

জার্মানির পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক সংসদীয় কমিটির প্রধান ড. নরবার্ট ব়্যোটগ্যান বাংলাদেশের নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির ব্যাপকতা দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন৷ তিনি বাংলাদেশ ক্রমশ একদলীয় ব্যবস্থায় পরিণত হচ্ছে বলে মন্তব্য করে এই বিষয়ে সোচ্চার হতে ইউরোপিয় সরকারগুলোর প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন৷ 

পাঁচ।

ডিসেম্বর ১০, ২০২১,  মার্কিন রাজস্ব ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় র‍্যাবসহ এর সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। 

বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করেছে এমন পরিস্থিতিতে এক লাখ বিছানা চাদর ক্রয়ের জন্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় থাকা পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদকে জার্মানি যাওয়ার ভিসা দেয় জার্মান দূতাবাস। অথচ এই ধরনের পণ্য বাংলাদেশেই তৈরি হয় এবং এখন অ্যামেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে৷ জার্মানিতেও এসব পণ্যের বড় বাজার আছে৷ সমালোচনার মুখে পড়ে এই সফর বাতিল হয়।  

সার্বিক দৃশ্যপট দেখে ওয়াকিবহাল মহলের কাছে মনে হতে পারে ঢাকাস্থ জার্মান দূতাবাসকে কোন কোন মহল বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার রক্ষায় ইউরোপিয় ইউনিয়ন ও এর অন্যতম নেতা জার্মানি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। দেশটি বাংলাদেশেও সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেব বলে প্রত্যাশা সবার।     

গণতান্ত্রিক বাংলাদেশই পারবে বিশ্বের সকল দেশের সাথে সুসম্পর্ক ও সম্মানজনক অংশীদারিত্ব রক্ষা করতে, স্বৈরতন্ত্র নয়।   

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পক্ষে অথবা গণতন্ত্রের বিপক্ষে, ইতিহাসে কোন পক্ষে থাকবে জার্মান রাষ্ট্রদূত, সেই দায়িত্ব তার নিজস্ব। 

বাংলাদেশের জনগণ ভোটাধিকার ও মানবাধিকার ফিরিয়ে পাওয়ার সংগ্রাম চালিয়ে যাবে এবং বিজয়ী হবেই। 

—  মন্তব্য লেখকের ব্যক্তিগত।