Search

Saturday, April 23, 2022

গণতন্ত্র অথবা স্বৈরতন্ত্র কোন পক্ষে জার্মানি? — মুহম্মদ মাহাথির

  — মুহম্মদ মাহাথির




বাংলাদেশে জার্মান অ্যাম্বাসেডর আখিম ট্র্যোস্টার বুধবার, এপ্রিল ২০, ২০২২, ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ-ডিক্যাব আয়োজিত ’ডিক্যাব টকে’ জানিয়েছেন যে বিএনপি তার বক্তব্যের ‘মিস কোট’ করেছে। এতে তিনি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।  

অথচ জার্মান অ্যাম্বাসেডর’র এই বক্তব্যের কোন সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। বরং বলা যায় তিনি বিএনপি নেতাদের ‘মিস কোট’ করেছেন।   

বৃহস্পতিবার, মার্চ ১৭, ২০২২, গুলশানে বিএনপি চেয়ারপার্সন’র কার্যালয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দলের তিন সদস্যের প্রতিনিধি টিমের সাথে বৈঠক করেন অ্যাম্বাসেডর আখিম ট্র্যোস্টার। 

বিএনপির নেতৃবৃন্দ জার্মান রাষ্ট্রদূতের নাম উল্লেখ করে কোন বক্তব্য দেননি। এক মাসের অধিককাল আগে জার্মান রাষ্ট্রদূতের সাথে সাক্ষাৎকার পরবর্তী বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করলেই এটা পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার কথা। এই সম্পর্কিত ভিডিয়োও ইন্টারনেটে রয়েছে।  সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরে বিএনপির নেতৃবৃন্দ পরিষ্কার বলেছেন যে বিশ্বের বিভিন্ন গণতন্ত্রে এবং মানবাধিকারে বিশ্বাসী শক্তিগুলো বাংলাদেশের গণতন্ত্রহীনতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে অবগত আছেন।  

সেই বৈঠক শেষে বিএনপির জাতীয় স্থায়ীকমিটির সদস্য ও ফরেন রিলেশনস কমিটির চেয়ারম্যান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছিলেন, তাদের আলোচনায় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আগামী নির্বাচন, মানবাধিকারসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে।

বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের বিষয়ে জার্মান রাষ্ট্রদূত কী বলেছেন, এমন প্রশ্নে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্র বিষয়ে বিশ্বব্যাপী সবাই অবগত আছেন। এখানে নতুন করে বলার কিছু নেই। এগুলো নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনাও হচ্ছে এটা তো আপনারা জানেন। এসব ব্যাপারে ওনারা কনসার্ন। বাংলাদেশের বিষয় নিয়ে বিশ্বব্যাপী যে আলোচনা হচ্ছে, ওনারা তো তার একটা অংশ। ইউরোপিয় ইউনিয়ন বলেছে, আমেরিকা বলছে, ব্রিটেন বলেছে, সবাই বলছে।

বাংলাদেশের প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সাধারণত তথ্যভিত্তিক বক্তব্য প্রদান করেন। একজন অ্যাম্বাসেডরের কাজের চৌহদ্দি সম্পর্কে তিনি ভালোভাবে অবগত। সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরে তার সেই অভিজ্ঞানও সুস্পষ্ট। এখানে তিনি জার্মান অ্যাম্বাসেডরকে মোটেও কোট করেননি। দায়িত্বশীলতার সাথে একটি সাধারণ বক্তব্য দিয়েছিলেন। 

বরং এক মাস আগের একটা বৈঠক সম্পর্কে, একটা না বলা কথাকে এখন হঠাৎ করে কেন জার্মান রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে সামনে আনা হল, তা সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে আদৌ পরিষ্কার নয়। এই ব্যাপারে জার্মান রাষ্ট্রদূতের কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়লে বিএনপির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সেটা করা যেত।  ভোটাধিকার ও মানবাধিকার ফিরিয়ে আনার কঠিন সংগ্রামে নিয়োজিত বাংলাদেশিরা জার্মান অ্যাম্বাসেডরের এমন বক্তব্যে হতাশ হয়েছেন।  

বিএনপি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল, যার প্রতিষ্ঠাতা শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম শুধু বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার ঘোষকই নন, তিনি বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁকে বলা হয় আধুনিক বাংলাদেশের আর্কিটেক্ট। বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জনগণের কল্যাণে ব্যাপক কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেছিলেন। 

এক যুগধরে বিএনপি এই দেশের হারিয়ে যাওয়া গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনার সংগ্রামে নিবেদিত,  বাংলাদেশের গণতন্ত্রহীনতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে অনবরত লড়াই করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বিএনপির হাজারো সমর্থক-নেতা-কর্মী বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। পঁয়ত্রিশ লাখ সমর্থক-নেতা-কর্মী হয়তো কারাবন্দি আছেন নতুবা আদালত প্রাঙণে নিত্য হাজির থাকছেন। জার্মান অ্যাম্বাসেডর নিশ্চয় সেই খবর রাখেন।  

বিএনপি সবসময় গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারে বিশ্বাসী দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করেছে এবং সামনের দিনেও তাই করে যাবে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা, এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধে বিশ্বের বিভিন্ন পক্ষ থেকে যে স্পষ্ট ও কার্যকর সমর্থন দেখা যাচ্ছে, বিএনপি দেশের অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর মতই সেগুলোকে স্বাগত জানায়।  

জার্মানি বিশ্বের অন্যতম গণতান্ত্রিক শক্তি। বিশ্বে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সামনের কাতারেই থাকছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় বাংলাদেশিরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করছে বাংলাদেশে লুটে নেয়া গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ফিরিয়ে আনার পক্ষে অনুপস্থিত বর্তমান ঢাকাস্থ জার্মান দূতাবাস। বাংলাদেশে অব্যাহত গুম-খুন-গ্রেপ্তার ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে নিরব তারা। বাংলাদেশে মানবাধিকার ও ভোটাধিকারের অনুপস্থিতি বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশে তারা যেনো কুণ্ঠিত! বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দল বিএনপির সাথে কথা বলতেও যেনো তারা আড়ষ্ট!

ঢাকাস্থ জার্মান দূতাবাসের প্রতি নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনার আহ্বান জানাই।  

এক। 

বিশ্বের নতুন পাঁচ 'স্বৈরতান্ত্রিক দেশের তালিকায়' বাংলাদেশ স্থান করে নিয়েছে। আর ২০১৮-এ সেই তালিকা প্রকাশ করেছে জার্মান গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'বেরটেলসম্যান স্টিফটুং। 

দুই। 

জার্মানির রাজধানী বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল৷ বাংলাদেশের ২০১৮-এর জাতীয় নির্বাচনকে এই সংগঠনটি আখ্যা দিয়েছিল ‘প্রশ্নবিদ্ধ, অভূতপূর্ব এবং অবিশ্বাস্য' হিসেবে৷ ২৯৯ আসনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনটির ৫০টি আসনের নির্বাচনি প্রক্রিয়ার ওপর এক পরিবীক্ষণের ফলাফলে ৪৭টিতেই ব্যাপক অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে সংগঠনটি৷

তিন। 

ইউরোপিয় ইউনিয়নের অন্যতম শক্তিশালী সদস্য জার্মানি অতীতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কড়া মন্তব্য করেছে৷ ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর দেশের ‘কিছু এলাকা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে' বলেও মন্তব্য করেছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন জার্মান রাষ্ট্রদূত ড. আলব্রেশট কনৎসে৷ 

চার। 

জার্মানির পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক সংসদীয় কমিটির প্রধান ড. নরবার্ট ব়্যোটগ্যান বাংলাদেশের নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির ব্যাপকতা দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন৷ তিনি বাংলাদেশ ক্রমশ একদলীয় ব্যবস্থায় পরিণত হচ্ছে বলে মন্তব্য করে এই বিষয়ে সোচ্চার হতে ইউরোপিয় সরকারগুলোর প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন৷ 

পাঁচ।

ডিসেম্বর ১০, ২০২১,  মার্কিন রাজস্ব ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় র‍্যাবসহ এর সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। 

বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করেছে এমন পরিস্থিতিতে এক লাখ বিছানা চাদর ক্রয়ের জন্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় থাকা পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদকে জার্মানি যাওয়ার ভিসা দেয় জার্মান দূতাবাস। অথচ এই ধরনের পণ্য বাংলাদেশেই তৈরি হয় এবং এখন অ্যামেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে৷ জার্মানিতেও এসব পণ্যের বড় বাজার আছে৷ সমালোচনার মুখে পড়ে এই সফর বাতিল হয়।  

সার্বিক দৃশ্যপট দেখে ওয়াকিবহাল মহলের কাছে মনে হতে পারে ঢাকাস্থ জার্মান দূতাবাসকে কোন কোন মহল বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার রক্ষায় ইউরোপিয় ইউনিয়ন ও এর অন্যতম নেতা জার্মানি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। দেশটি বাংলাদেশেও সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেব বলে প্রত্যাশা সবার।     

গণতান্ত্রিক বাংলাদেশই পারবে বিশ্বের সকল দেশের সাথে সুসম্পর্ক ও সম্মানজনক অংশীদারিত্ব রক্ষা করতে, স্বৈরতন্ত্র নয়।   

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পক্ষে অথবা গণতন্ত্রের বিপক্ষে, ইতিহাসে কোন পক্ষে থাকবে জার্মান রাষ্ট্রদূত, সেই দায়িত্ব তার নিজস্ব। 

বাংলাদেশের জনগণ ভোটাধিকার ও মানবাধিকার ফিরিয়ে পাওয়ার সংগ্রাম চালিয়ে যাবে এবং বিজয়ী হবেই। 

—  মন্তব্য লেখকের ব্যক্তিগত। 

No comments:

Post a Comment