Search

Thursday, December 28, 2023

অবৈধ আওয়ামী মন্ত্রী-এমপিরা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ

ফ্যাসিস্ট গোষ্ঠীর দুর্নীতির খন্ডচিত্র বেরিয়ে আসছে




আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ২০ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর আয় গত পাঁচ বছরে নজিরবিহীনভাবে বেড়েছে। সর্বোচ্চ আয় বেড়েছে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির– ২ হাজার ১৩১ শতাংশেরও বেশি। আর যার আয় সবচেয়ে কম বেড়েছে, তিনি হলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর, তাও ১৩২ শতাংশেরও বেশি। গত ১৫ বছরে আটজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর সম্পদও সীমাহীনভাবে বেড়েছে। এতে শীর্ষে আছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। 

প্রার্থীদের মধ্যে শতকোটি টাকার চেয়ে বেশি সম্পদের মালিক আছেন ১৮ জন। তাদের সবাই আওয়ামী লীগের কিংবা দলটির স্বতন্ত্র প্রার্থী। এদিক থেকে শীর্ষে আছেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। তাঁর সম্পদের পরিমাণ ১ হাজার ৩৪৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকার। 

ডিসেম্বর ২৬, ২০২৩ রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) আয়োজিত ‘নির্বাচনী হলফনামার তথ্যচিত্র: জনগণকে কী বার্তা দিচ্ছে?’ শিরোনামে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের দেওয়া হলফনামার তথ্য বিশ্লেষণ করে এ প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এতে দেখা যায়, গত ১৫ বছরে অনেক মন্ত্রী-এমপির সম্পদ বৃদ্ধির চিত্র রূপকথার গল্পকেও হার মানিয়েছে। 

তবে টিআইবি বলছে, হলফনামায় দেওয়া সম্পদ বিবরণী কতটা সঠিক এবং আয় ও সম্পদ বৈধ কিনা, তা যাচাই করে না নির্বাচন কমিশন, রাজস্ব বিভাগ কিংবা দুর্নীতি দমন কমিশন। আবার সম্পদের অর্জনকালীন যে মূল্য দেখানো হয়েছে, তা নিয়েও বড় রকমের প্রশ্ন রয়েছে। প্রার্থীরা তাদের অর্জিত সম্পদের কতটা দেখিয়েছেন অথবা বিদেশে সম্পদ থাকার তথ্য গোপন করেছেন কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলার সুযোগ রয়েছে।

টিআইবির প্রতিবেদনে মন্ত্রী-এমপি প্রার্থীর সম্পদের যে চিত্র  তুলে ধরা হয়েছে, তা চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। অবশ্য অনেক মন্ত্রী-এমপি-প্রার্থীর ঋণও রয়েছে। যেমন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী এসএকে একরামুজ্জামানের ৪২১ কোটি টাকার সম্পদ থাকলেও তাঁর ঋণ ও দায় রয়েছে প্রায় ২ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকার।  চারজন প্রার্থী রয়েছেন যাদের শত শত বিঘা জমি রয়েছে। অথচ বাংলাদেশের ভূমি আইন অনুযায়ী, একজন ব্যক্তির সর্বোচ্চ ৬০ বিঘা কৃষিজমি থাকার বিধান রয়েছে। 

প্রতিটি সংসদে পর্যায়ক্রমে রাজনীতিবিদের সংখ্যা কমছে। এবার প্রার্থীদের মধ্যে রাজনীতিবিদ আছেন ৩ শতাংশেরও কম। ব্যবসায়ী আছেন ৫৭ শতাংশেরও বেশি। 

সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। এ সময় টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রার্থীদের নিজের দেওয়া হলফনামায় সম্পদের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, বাস্তবে তাদের সম্পত্তির পরিমাণ আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। 

টিআইবির ট্রাস্টি মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, ‘বৈধ উপায়ে এত সম্পদ মানুষের বাড়ে কিনা, আমি জানি না। আমরা দেখছি কিছু মানুষ হাজার হাজার কোটি টাকা কামিয়ে যাচ্ছে। আর কিছু মানুষ পেট ভরে খাওয়ার জন্য প্রতিদিন যুদ্ধ করছে। আমরা একটা অসম সমাজ তৈরি করছি। আমরা দ্রুত ধনী হওয়ার প্রতিযোগিতায় চলে যাচ্ছি। এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি।’ 


গত পাঁচ বছরে আয় বৃদ্ধিতে শীর্ষে ১০ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী 

  1. বাণিজ্যমন্ত্রী — টিপু মুনশির — ২,১৩১ % 
  2. স্বাস্থ্যমন্ত্রী — ডা. জাহিদ মালেক  — ২৭৬ %
  3. বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী — নসরুল হামিদ — ২২৮ % 
  4. ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী — ডা. এনামুর রহমান — ২২৭ %
  5. শিক্ষামন্ত্রী — ডা. দীপু মনি — ২০৪ %
  6. শিল্প মন্ত্রী — নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন — ১৬৪ %
  7. প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী — মোঃ জাকির হোসেন — ১৪৯ %
  8. বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী — গোলাম দস্তগীর গাজী  — ১২২ %
  9. প্রধানমন্ত্রী — শেখ হাসিনা — ১১৯ %
  10. খাদ্য মন্ত্রী — সাধন চন্দ্র মজুমদার — ৯১ %

 


পাঁচ বছরে সম্পদ বৃদ্ধিতে শীর্ষে যারা


গত পাঁচ বছরে সবচেয়ে বেশি সম্পদ বেড়েছে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের– ১ হাজার ৬৩ শতাংশ। এরপর নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর বেড়েছে ২৮৬ শতাংশ,  স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলামের ২৪২ শতাংশ, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর ২৪২ শতাংশ, তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের ২৩৯ শতাংশ, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খানের ১৯৬ শতাংশ, দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমানের ১৯৬ শতাংশ, খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের ১৭৩ শতাংশ, প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদের ১৪০ শতাংশ এবং বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর ১৩২ শতাংশ সম্পদ বেড়েছে।





৫ বছরে যেসব এমপির আয় বেড়েছে

এ তালিকায় শীর্ষে রয়েছেন ঢাকা-২০ আসনের এমপি বেনজীর আহমদ (২২৩৮.১০%)। আজ মঙ্গলবার (২৬ ডিসেম্বর) এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য তুলে ধরেন টিআইবির সমন্বয়ক (আউট রিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন) মোহাম্মদ তাওহিদুল ইসলাম। নির্বাচন কমিশনে দেওয়া ২,০০০ এর বেশি হলফনামার তথ্য বিশ্লেষণ করে এ তথ্য তুলে ধরেছে সংস্থাটি। 

একাদশ সংসদের এমপিদের ৫ বছরে আয় বৃদ্ধির হারে শীর্ষ ১০- এ যারা:

১. ঢাকা-২০ আসনের বেনজীর আহমদ (২২৩৮.১০%)
২. কুষ্টিয়া-১ আসনের আ. ক. ম. সরওয়ার জাহান (২২০০.৫৮%)
৩. রংপুর-৪ আসনের টিপু মুনশি (২১৩১.১২%)
৪. বগুড়া-২ আসনের শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ (২০৭৪.৮৩%)
৫. নাটোর-১ আসনের মো. শহিদুল ইসলাম (বকুল) (১৯৭২.১৬%)
৬. যশোর-১ আসনের শেখ আফিল উদ্দিন (১৬০৮.৬৩%)
৭. নওগাঁ-৩ আসনের মো. ছলিম উদ্দীন তরফদার (১৪৯৪.১২%)
৮. দিনাজপুর-৪ আসনের আবুল হাসান মাহমুদ আলী (১১৮৭.৫২%)
৯. পাবনা-২ আসনের আহমেদ ফিরোজ কবির (১০৬০.৪৪%)
১০. যশোর-৩ আসনের কাজী নাবিল আহমেদ (১০৩৯.৭৮%)






১৫ বছরে সম্পদ বৃদ্ধিতে শীর্ষে যারা
গত ১৫ বছরে সবচেয়ে বেশি সম্পদ বেড়েছে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের– ৬ হাজার ৩৫০ শতাংশ। গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের বেড়েছে ২ হাজার ৮৫৮ শতাংশ, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর ২ হাজার ৭০৩ শতাংশ, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদের ২ হাজার ১৭৯ শতাংশ, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের ৯৮২ শতাংশ, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের ৭৮৩ শতাংশ,  শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদারের ৪৯৩ শতাংশ এবং ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের বেড়েছে ১২৯ শতাংশ। 


১৫ বছরে অস্থাবর সম্পদ বৃদ্ধিতে শীর্ষে যারা

  1. রাজশাহী-৪ — এনামুল হক —  ২,৪৩,৫১৩ শতাংশ
  2. নাটোর-৩  জুনায়েদ আহমেদ পলক  ১৬,৭৪২ শতাংশ   
  3. মাদারীপুর-১ — নূর আলম চৌধুরী  — ৮,৩২৪ শতাংশ 
  4. গাজীপুর-৫ — মেহের আফরোজ — ৭,৬৯২ শতাংশ
  5. নওগাঁ-১ — সাধন চন্দ্র মজুমদার — ৬,৩৫০ শতাংশ
  6. দিনাজপুর-৪ — আবুল হাসান মাহমুদ আলী — ৬,১৩৮ শতাংশ
  7. ঢাকা-২ — কামরুল ইসলাম — ৫,৩৯০ শতাংশ
  8. কুষ্টিয়া-২ — হাসানুল হক ইনু — ৪,৭২৩ শতাংশ
  9. চট্টগ্রাম-৭ — মোহাম্মদ হাছান মাহমুদ — ৪,৬৮৩ শতাংশ
  10. চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ — জিয়াউর রহমান — ৪, ৬৮২ শতাংশ




বছরে কোটি টাকা আয়ের প্রার্থী বাড়ছে
গত চারটি জাতীয় সংসদের চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বেশি আয়ের প্রার্থীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বছরে কোটি টাকা আয় করেন এ রকম প্রার্থী ২০০৮ সালে ছিল ৪৩ জন, ২০১৩ সালে ৬২ জন এবং ২০১৮ সালে ১৪৩ জন। এবার তা বেড়ে হয়েছে ১৬৪ জন। 

১৮ প্রার্থী শতকোটি টাকার মালিক
এবার ১৮ জন প্রার্থী রয়েছেন, যারা শতকোটি টাকারও বেশি সম্পদের মালিক। এর মধ্যে ১০ জনই আওয়ামী লীগের। অন্য আটজনও আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। তাদের মধ্যে শীর্ষ ১০ জন হলেন পর্যায়ক্রমে নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের আওয়ামী লীগের গোলাম দস্তগীর গাজী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনের স্বতন্ত্র একরামুজ্জামান, ঢাকা-১ আসনের আওয়ামী লীগের সালমান এফ রহমান, কুমিল্লা-৮ আসনের আওয়ামী লীগের আবু জাফর মোহাম্মদ শফি উদ্দিন, কুমিল্লা-৩ আসনের আওয়ামী লীগের ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুন, চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের  স্বতন্ত্র দিলীপ কুমার আগরওয়ালা, সিরাজগঞ্জ-৫ আসনের আওয়ামী লীগের আব্দুল মমিন মণ্ডল, নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের স্বতন্ত্র গাজী গোলাম মর্তুজা, নরসিংদী-৩ আসনের স্বতন্ত্র সিরাজুল ইসলাম মোল্লা, ঢাকা-৬ আসনে আওয়ামী লীগের মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। 

কৃষিজমির মালিকানায় শীর্ষ ১০

কিশোরগঞ্জ-৩ আসনের গোলাম কবির ভূঞার জমির পরিমাণ ৬৪৭ একর। বগুড়া-২ আসনের বিউটী বেগমের ৫৪৮ একর, ময়মনসিংহ-৪ আসনের মোহাম্মদ মোহিত উর রহমানের ১৯৫ একর, বাগেরহাট-৪ আসনের জামিল হোসাইনের ১১০ একর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের ফিরোজুর রহমানের ৮৩ একর, যশোর-১ আসনের শেখ আফিল উদ্দিনের ৬৮ একর, চট্টগ্রাম-২ আসনের হোসাইন মো. আবু তৈয়বের প্রায় ৭০ একর, ঢাকা-১৫ আসনের কামাল আহমেদ মুজদারের ৬১ একর, ভোলা-১ আসনের ছিদ্দিকুর রহমানের ৬০ একর ও সুনামগঞ্জ-২ আসনের চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদের ৫১ একর। এর মধ্যে শেষের দু’জন জাসদ থেকে এবং অন্যরা আওয়ামী লীগ বা একই দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী।



অকৃষি জমিতে শীর্ষে যারা

জামালপুর-৫ আসনের জাতীয় পার্টির প্রার্থী জাকির হোসেনের আছে ৮১৩ একর, নাটোর-৪ আসনে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির আলাউদ্দিন মৃধার ৫৮২ একর, পিরোজপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মহিউদ্দীন মহারাজের ৩৮১ একর, রাজবাড়ী-১ আসনে আওয়ামী লীগের কাজী কেরামত আলীর ১৮১ একর, সুমানগঞ্জ-২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়া সেনগুপ্তার ৯৫ একর, ঢাকা-১৮ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী খসরু চৌধুরীর ৬১ একর, ভোলা-২ আসনে জেপির মো. গজনবীর ৫৩ একর, নারায়ণণগঞ্জ-২ আসনে তৃণমূল বিএনপির আবু হানিফ হৃদয়ের ৪৩ একর, বরিশাল-১ আসনে আওয়ামী লীগের আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর ৫৮ একর, দিনাজপুর-৯ আসনের স্বতন্ত্র তরিকুল ইসলাম তারিকের সাড়ে ৩৬ একর অকৃষি জমি রয়েছে।     

দেশে বিদ্যমান ভূমি আইন অনুযায়ী, কৃষি ও অকৃষি মিলিয়ে কারও ১০০ বিঘার বেশি জমির মালিক হওয়ার  সুযোগ নেই। এর বেশি থাকলে সরকার তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। অতিরিক্ত জমি বাজেয়াপ্ত বা অধিগ্রহণ করতেও পারে সরকার। এই নিয়ম অনুযায়ী, তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সুযোগদানও অনৈতিক বলে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়। 

১০ জনের আয় বেড়েছে অবিশ্বাস্য গতিতে
গত পাঁচ বছরে ১০ জন এমপির আয় অসম্ভব গতিতে বেড়েছে। এর মধ্যে ঢাকা-২০ আসনের বেনজীর আহমদের আয় বেড়েছে ২ হাজার ২৩৮ শতাংশ, কুষ্টিয়া-১ আসনের সরওয়ার জাহানের ২ হাজার ২০০ শতাংশ, রংপুর-৪ আসনের টিপু মুনশির ২ হাজার ১৩১ শতাংশ, বগুড়া-২ আসনের শরিফুল ইসলাম জিন্নার ২ হাজার ৭৪ শতাংশ, নাটোর-১ আসনের শহিদুল ইললাম বকুলের ১ হাজার ৯৭২ শতাংশ, যশোর-১ আসনের শেখ আফিল উদ্দিনের ১ হাজার ৬০৮ শতাংশ, নওগাঁ-৩ আসনের ছলিম উদ্দীন তরফদারের ১ হাজার ৪৯৪ শতাংশ,  দিনাজপুর-৪ আসনের আবুল হাসান মাহমুদ আলীর ১ হাজার ১৮৭ শতাংশ, পাবনা-২ আসনের আহমেদ ফিরোজ কবিরের ১ হাজার ৬০ শতাংশ এবং যশোর-৩ আসনের কাজী নাবিল আহমেদের আয় ১ হাজার ৩৯ শতাংশ বেড়েছে। 

১০ জনের স্ত্রী ও পরিবারও তাক লাগিয়েছে 
চট্টগ্রাম-১৫ আসনের আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিনের স্ত্রী ও নির্ভরশীলদের আয় বেড়েছে ২ হাজার ৪০৯ শতাংশ, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির পরিবারের ২ হাজার ১৩১ শতাংশ, ফেনী-২ আসনের নিজাম উদ্দিন হাজারীর ১ হাজার ২৩০ শতাংশ, পটুয়াখালী-৪ আসনের মহিবুর রহমানের ৬৬৯ শতাংশ, ঢাকা-৩ আসনের নসরুল হামিদ বিপুর ৬২৭ শতাংশ, শরীয়তপুর-৩ আসনে নাহিম রাজ্জাকের ৫১১ শতাংশ, রাজশাহী-১ আসনের ওমর ফারুক চৌধুরীর ৪৯৯ শতাংশ, ঢাকা-২০ আসনের বেনজীর আহমদের ৩৪৪ শতাংশ, যশোর-৫ আসনের স্বপন ভট্টাচার্য্যের ২৭১ শতাংশ এবং নাটোর-১ আসনের শহিদুল ইসলাম বকুলের স্ত্রী ও নির্ভরশীলদের আয় বেড়েছে ২৩৬ শতাংশ।
 
৫ বছরে কয়েক এমপির অস্থাবর সম্পত্তি বৃদ্ধির চিত্র
রাজশাহী-৪ আসনের এনামুল হকের অস্থাবর সম্পত্তি বেড়েছে ৫ হাজার ৪৭০ শতাংশ, নোয়াখালী-৩ আসনের মামুনুর রশীদ কিরনের ৩ হাজার ৬৫ শতাংশ, নাটোর-১ আসনের শহিদুল ইসলাম বকুলের ১ হাজার ৯১৩ শতাংশ, খাগড়াছড়ির কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার ১ হাজার ৫৪ শতাংশ, পটুয়াখালী-৪ আসনের মহিববুর রহমানের ১ হাজার ২৪ শতাংশ, গাজীপুর-৫ আসনের মেহের আফরোজ চুমকির ৮২৭ শতাংশ, কুষ্টিয়া-১ আসনের আ ক ম সরওয়ার জাহানের ৫৭৪ শতাংশ,  ময়মনসিংহ-১১ আসনের কাজিম উদ্দিন আহম্মদের ৫৪৩ শতাংশ এবং যশোর-৫ আসনের স্বপন ভট্টাচার্য্যের ৪৮৬ শতাংশ। 

যেসব এমপির স্ত্রীর অস্থাবর সম্পদ ব্যাপকহারে বেড়েছে
পাঁচ বছরের ব্যবধানে রাজশাহী-৪ আসনের এনামুল হকের স্ত্রী ও তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের আয় বেড়েছে ৩৮ হাজার ৪৭৩ শতাংশ, বগুড়া-২ আসনের শরিফুল ইসলাম জিন্নার ৯ হাজার ৪৫১ শতাংশ,  সুনামগঞ্জ-৫ আসনের মহিবুর রহমান মানিকের ২ হাজার ৫৭৯ শতাংশ, পটুয়াখালী-৪ আসনের মহিববুর রহমানের ২ হাজার ৯৩ শতাংশ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনের বদরুদ্দোজা মো. ফরহাদ হোসেনের ১ হাজার ৬২৪ শতাংশ,  কুষ্টিয়া-১ আসনের আ কা ম সরওয়ার জাহানের ১ হাজার ১৬২ শতাংশ, নওগাঁ-৩ আসনের ছলিম উদ্দীন তরফদারের ১ হাজার ১৯ শতাংশ, ফেনী-২ আসনের নিজাম উদ্দিন হাজারীর ৯২০ শতাংশ, সাতক্ষীরা-১ আসনের মুস্তফা লুৎফুল্লাহর ৮৯৩ শতাংশ এবং রাজবাড়ী-১ আসনের কাজী কেরামত আলীর বেড়েছে ৮৭১ শতাংশ।
 
আয় বৃদ্ধিতে শীর্ষ ১০ এমপি 
গত ১৫ বছরে সর্বোচ্চ আয় বেড়েছে পিরোজপুর-২ আসনের এমপি আনোয়ার হোসেনের– ৭ হাজার ১১৬ শতাংশ। এ সময়ে মাদারীপুর-১ আসনের নূর-ই আলম চৌধুরীর বেড়েছে ৫ হাজার ৬৯৬ শতাংশ, মাদারীপুর-২ আসনের শাজাহান খানের ৪ হাজার ৬৯৭ শতাংশ, নোয়াখালী-১ আসনের এইচ এম ইব্রাহিমের ৪ হাজার ২৯৬ শতাংশ, শেরপুর-২ আসনের মতিয়া চৌধুরীর বেড়েছে ৪ হাজার ১৩৫ শতাংশ,  নওগাঁ-১ আসনের সাধন চন্দ্র মজুমদারের ৪ হাজার ১৩২ শতাংশ, জয়পুরহাট-২ আসনের আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের ২ হাজার ৮৯৫ শতাংশ, বাগেরহাট-১ আসনের শেখ হেলাল উদ্দীনের ২ হাজার ৭৬৭ শতাংশ,  রাজশাহী-৪ আসনের এনামুল হকের ২ হাজার ৭৫৬ শতাংশ ও গাজীপুর-২ আসনের জাহিদ আহসান রাসেলের বেড়েছে ২ হাজার ৫৪৫ শতাংশ।
 
১৫ বছরে অস্থাবর সম্পদ বৃদ্ধিতে শীর্ষে যারা
গত ১৫ বছরের ব্যবধানে অস্থাবর সম্পত্তি বৃদ্ধিতে শীর্ষে আছেন রাজশাহী-৪ আসনের এনামুল হক। তাঁর অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৫১৩ শতাংশ। এরপর পর্যায়ক্রমে মাদারীপুর-১ আসনের নূর আলম চৌধুরীর ৮ হাজার ৩২৪ শতাংশ, গাজীপুর-৫ আসনের মেহের আফরোজের ৭ হাজার ৬৯২ শতাংশ, নওগাঁ-১ আসনের সাধন চন্দ্র মজুমদারের ৬ হাজার ৩৫০ শতাংশ, দিনাজপুর-৪ আসনের আবুল হাসান মাহমুদ আলীর ৬ হাজার ১৩৮ শতাংশ, ঢাকা-২ আসনের কামরুল ইসলামের ৫ হাজার ৩৯০ শতাংশ, কুষ্টিয়া-২ আসনের হাসানুল হক ইনুর ৪ হাজার ৭২৩ শতাংশ, চট্টগ্রাম-৭ আসনের মোহাম্মদ হাছান মাহমুদের ৪ হাজার ৬৮৩ শতাংশ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের জিয়াউর রহমানের ৪ হাজার ৬৮২ শতাংশ ও ঢাকা-২০ আসনের বেনজীর আহমদের অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ৪ হাজার ১৯৭ শতাংশ।




ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে সংসদ
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১ হাজার ৮৯৬ জন প্রার্থী অংশ নিচ্ছেন। এর মধ্যে মূল পেশা বিবেচনায় ব্যবসায়ী আছেন ৫৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ। এ ছাড়া আইনজীবী আছেন ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ, কৃষিজীবী ৭ দশমিক ৮১ শতাংশ, চাকরিজীবী ৫ দশমিক ১৬ শতাংশ, শিক্ষক ৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ, রাজনীতিবিদ আছেন ২ দশমিক ৮৬ শতাংশ। অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ২ দশমিক ৭১ শতাংশ, চিকিৎসক ২ দশমিক ১৯ শতাংশ, সাংবাদিক দশমিক ৮৩ শতাংশ, গৃহস্থালি দশমিক ৬৮ শতাংশ এবং অন্যান্য ৬ দশমিক ৩০ শতাংশ। প্রার্থীদের মধ্যে নারীর অংশগ্রহণ খুবই কম– মাত্র ৫ দশমিক ১০ শতাংশ। পুরুষ ৯৪ দশমিক ৯০ শতাংশ। 

যুক্তরাজ্যে এক মন্ত্রীর ছয় কোম্পানি
‘নির্ভরযোগ্য’ তথ্যের বরাতে টিআইবি জানায়, বর্তমান মন্ত্রিসভায় এমন একজন সদস্য রয়েছেন, যাঁর যুক্তরাজ্যে ছয়টি কোম্পানি রয়েছে। এসব কোম্পানিতে তাঁর বিনিয়োগ ১৭ দশমিক ২০ কোটি পাউন্ড, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা। তবে টিআইবির হিসাবে, ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকার সম্পদ তাঁর। তিনি সেখানে প্রথম কোম্পানি স্থাপন করেন ২০১০ সালে আর পঞ্চম ও ষষ্ঠ কোম্পানি ২০২১ সালে। ওই মন্ত্রীর নাম প্রকাশ করেনি টিআইবি।



তিনি হলেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। সমকালের নিজস্ব অনুসন্ধানে সাইফুজ্জামান নিজে পরিচালক এমন আটটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানির তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া নিশ্চিত হওয়া গেছে, টিআইবির কাছে ভূমিমন্ত্রীর বিষয়েই তথ্যপ্রমাণ রয়েছে। সমকাল জানতে পেরেছে, লন্ডনে মন্ত্রী জাবেদের কোম্পানি ছয়টি না; আটটি। কোম্পানিগুলোর সম্পদমূল্য ২০ কোটি ৩১ লাখ ব্রিটিশ পাউন্ড, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ২ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। স্ত্রী রুখমিলা জামান এবং মেয়ে জেবা জামানের নামেও কোম্পানি খুলেছেন তিনি। এ ছাড়া পারিবারিক মালিকানায় থাকা ব্যবসায়িক গ্রুপ আরামিটের নামেও একটি কোম্পানি খুলেছেন।

জনগণের টাকা লুটপাট করে অর্থ পাচারের মাধ্যমে গত ১৫ বছর যাবত মাফিয়া হাসিনা সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা দেশে ও দেশের বাইরে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে।

Tuesday, December 19, 2023

আবারও আমরা একটি মুক্ত-স্বাধীন দেশে বাস করবো

দ্য ডিপ্লোম্যাটকে সাক্ষাৎকারে 
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান




আগামী ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত হয়েছে। দেশটির প্রধান বিরোধী দল- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এই নির্বাচন বর্জন করেছে। দলটির অভিযোগ, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীনে নিবার্চন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। এই নিয়ে গত এক বছর ধরে তারা দেশজুড়ে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে আসছে। বহু সভা-সমাবেশ হয়েছে এর বিরুদ্ধে। 

দ্য ডিপ্লোম্যাটের সিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য্যের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ব্যাখ্যা করেন, কেন তার দল এই নির্বাচন বর্জন করেছে। 
তিনি বলেন, আসন্ন নির্বাচনে শুধু যে রাজনৈতিক দলগুলোই অংশগ্রহণ করবে না তা নয়, ভোটাররাও এতে অংশ নিতে পারবে না। এর সবই পূর্বনির্ধারিত। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান ২০০৬-২০০৭ সালে ১৮ মাস জেলে ছিলেন। ২০০৮ সাল থেকে তিনি লন্ডনে স্বেচ্ছা নির্বাসনে আছেন। 

এই সাক্ষাৎকারে তারেক রহমান কথা বলেছেন বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল, অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচনের সম্ভাবনা এবং বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে। ডিপ্লোটম্যাটকে তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক নিয়ে ভারতের উদ্বেগ অযথাই। অতীতে ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে আওয়ামী লীগও বহুবার জোট গঠন করেছে। 

তারেক রহমানের পুরো সাক্ষাৎকারটি পাঠকদের জন্য ভাষান্তরিত করেছে বাংলা আউটলুকের অনুবাদ ডেস্ক।

প্রশ্ন : ২০২৪ সালের নির্বাচন বর্জন করার ব্যাপারে বিএনপি একেবারেই অনড় কেন? 

তারেক রহমান : বিএনপি একাই নয়, আরো ৬২টি গণতন্ত্রপন্থী রাজনৈতিক দল ৭ জানুয়ারির তথাকথিত নির্বাচন বর্জন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের জনগণের মুখের দিকে তাকিয়ে, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করতে। একটি অর্থবহ নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে। যাতে তারা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারেন। তাদের ভোট যথাযথভাবে গণনা করা হয়। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে আগের নির্বাচনগুলো হয়েছে প্রহসনমূলক। কারচুপি আর অনিয়মের কলঙ্কিত ইতিহাস হিসেবে সেগুলো চিহ্নিত। সারা দুনিয়া সেসব জানে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কোনো বিরোধী দল ছাড়াই নির্বাচন করেছিল, এবং ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৪ টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছিল বলে দাবি করেছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনে গণতন্ত্রকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তারা রাতের বেলা ব্যালট বাক্স ভর্তি করেছিল। 

২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ আরেকটা জালিয়াতির নির্বাচন আয়োজন করতে যাচ্ছে। নির্বাচনের আগেই তাদের সাথে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর আলোচনা-সাপেক্ষে ফলাফল পূর্বনির্ধারিত হয়ে গেছে। এই নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলো মূলত আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক মিত্র, তাদের ওপর জনগণের কোনো আস্থা ও বিশ্বাস নেই। এদের মধ্যে জাতীয় পার্টি একমাত্র দল, যার কিছু জনভিত্তি রয়েছে। জাতীয় পার্টির তৃণমূল নেতারা এক বৈঠকে নির্বাচন বর্জন ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বিলুপ্ত করার পক্ষে তীব্র ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন। পরে গোয়েন্দারা তাদের সাথে দেখা করেন এবং তাদের নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য করেন। 

নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা বাড়াতে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের ডামি প্রার্থী দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। ডামি প্রার্থীদের জয়-পরাজয় মূখ্য  বিষয় নয়। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি করাই এর মূল উদ্দেশ্য। রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় করে তিনি বিএনপিকে বিভক্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন। তথাকথিত কিংস পার্টি (বিরোধী দল থেকে টেনে নেওয়া লোক নিয়ে রাষ্ট্রীয় সমর্থনে গঠিত দল) গঠনে পৃষ্ঠপোষকতা জুগিয়েছেন তিনি। এর উদ্দেশ্য ছিল মিথ্যা অন্তর্ভুক্তির ধারণা তৈরি করা, যেন হাজার হাজার প্রার্থীর সাথে বিরোধী দলও এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে বলে মনে হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের আসন ভাগাভাগিতে গোলযোগ লেগে গেছে। জাকের পার্টি ২০০ টি আসন প্রত্যাহার করে নিয়েছে। অন্যান্য ছোট দলগুলোর অনেক প্রার্থীও প্রত্যাহার করতে চেয়েছিল। কিন্তু, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাদের বাধা দিয়েছে বলে জানা গেছে। 

আমরা যদি শেখ হাসিনার অধীনে উপ-নির্বাচনগুলো দেখি, যেগুলোর তেমন গুরুত্বও ছিল না, সেখানেও আওয়ামী লীগের কমীর্রা ভোটচুরির মচ্ছব বসিয়ে দিয়েছিল। রাষ্ট্রীয় সম্পদের সাহায্যে নির্বাচন কারচুপির দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য ও অভ্যাস তারা অব্যাহত রেখেছে। তাদের আয়োজিত প্রতিটি নির্বাচনেই দেখা গেছে বিরোধী প্রার্থীদের প্রতিনিধিত্বকারী এজেন্টদের ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। ভোটার তালিকায় ভোটদাতার নাম খুঁজে পাওয়া যায় না। জাল ভোট হয় ব্যাপক হারে। ব্যালট বাক্স ভরে যায় তাদের ভোটে। গত মাসেই নির্বাচনী জালিয়াতির এক সুউচ্চ শিখরে পৌঁছুতে দেখেছি আমরা,  আওয়ামী লীগের এক পোলিং এজেন্ট ৫৭ সেকেন্ডে ৪৩টি ব্যালট পেপারে সিল মেরেছে। এটা স্পষ্ট যে যতদিন শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকবেন, বাংলাদেশের প্রতিটি নির্বাচনে ততদিন অনিময়ম হবে। বহুল প্রত্যাশিত লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড ততদিন থাকবে অকল্পনীয় স্বপ্নে।

নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, বিরোধী নেতা-কমীর্দের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদী শাসন ততই জোরদার হচ্ছে। দেশব্যাপী তাদের ওপর সমানে দমন-পীড়ন চালানো হচ্ছে। উদ্দেশ্যমূলকভাবেই এমন পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে যেন কোনোভাবেই অন্তভুর্ক্তিমূলক নির্বাচন না হয়। জেলখানা উপচে পড়ছে আমাদের নেতাকমীতে, তবুও বানোয়াট মামলায় নির্বিচারে আটক চলছেই। সাথে জোরপূর্বক গুম, বিচারবহিভূর্ত হত্যা, নৃশংস নির্যাতনের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধ তো আছেই। এটা স্পষ্ট যে শুধুমাত্র একটি অ-রাজনৈতিক, নিরপেক্ষ, নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে পরিচালিত নির্বাচনের মাধ্যমেই কেবল একটি অন্তুভুর্ক্তিমূলক, বিশ্বাসযোগ্য এবং স্বচ্ছ নির্বাচন হতে পারে, যাতে বাংলাদেশের মানুষের ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার হতে পারে এবং একটি সরকার পূর্ণ জনসমর্থন পেতে পারে। 

প্রশ্ন : বিএনপির রাজপথের আন্দোলনের গতি আর কতদিন? কয়েক সপ্তাহর মধ্যেই তো নতুন সরকার আসছে।

তারেক রহমান :
২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২ হাজার ৬৮৭জন মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এই হত্যাগুলো সংঘটিত হয়েছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দ্বারাই। এর সঙ্গে জোরপূর্বক গুম করা হয়েছে ৬৭৫ জনকে। বিএনপি ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক দলের ৫০ লাখ সদস্যের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য-প্রণোদিত মামলা দেয়া হয়েছে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৫০০-এরও বেশি। ২৮ অক্টোবর আমাদের মহাসমাবেশের পর  ২২ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কারাগারে কয়েদির সংখ্যা ধারণ ক্ষমতার প্রায় আড়াই গুন বেশি। তবু গ্রেফতার চলছেই। 

ক্ষমতাসীনদের হাতে বিএনপির নেতাকমীর্রা নজিরবিহীন দমন-পীড়নের শিকার হয়েছেন। অসহ্য অত্যাচার আর অবিচার সহ্য করেছেন। দেশের গণতান্ত্রিক নীতি সমুন্নত রাখতে এটি আমাদের প্রতিশ্রুতির প্রমাণ। জনগণের যে-অধিকার অন্যায়ভাবে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে, প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আমাদের কর্তব্য তাদের অধিকার ন্যায্যভাবে আদায় করা। নির্বাচন যেমনই হোক, শেখ হাসিনা যতই ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকুন, বিএনপির প্রতি দৃঢ় জনসমর্থনের ভিত্তিতে বাংলাদেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধ থাকবে। এখন যদিও কিছু কৌশলগত সমন্বয় আসতে পারে, বড় আকারে দেখলে আমাদের আন্দোলনের গতিবেগ এখান থেকে কেবল সামনেই দিকেই যাবে, আরো ওপরের দিকেই উঠবে। 

বিএনপির সর্বশেষ সমাবেশ ও শোভাযাত্রা হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর। সে-সমাবেশে গণজোয়ারই আমাদের শক্তির প্রমাণ। রাষ্ট্রীয় সহিংসতা উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ একত্রিত হয়েছে। বিগত কয়েক বছর ধরে আমরা সারা বাংলাদেশে বিশাল বিশাল সমাবেশের আয়োজন করেছি। লক্ষ লক্ষ মানুষ আমাদের সমাবেশে যোগ দিয়েছেন। আমাদের প্রতি এই বিপুল জনসমর্থন জাতির ইতিহাসের একটি অভূতপূর্ব অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
 
প্রশ্ন : অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ওপর তীব্র চাপ রয়েছে। বিএনপির কি মনে হয় এই চাপ কাজ করবে না?

তারেক রহমান : আপনার প্রশ্নের মধ্যেই এর উত্তর রয়েছে। অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচনের জন্য একটি প্রতিকূল পরিবেশ বিরাজমান, এটা প্রমাণ করার জন্যই আমাদের আন্দোলন চলমান। এতে আমাদের নৈতিক ভিত্তি আরো শক্তিশালী হচ্ছে। কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক তার সর্বশেষ বক্তব্যে বলেছেন যে, রাতারাতি মুক্তি পাওয়ার শর্তেও বিএনপি নির্বাচনে যোগদানের প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। তিনি বস্তুত দাবি করেছেন যে একটি পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই তারা বিএনপির নেতাকর্মীদের আটক করেছেন। এতে এটাও স্পষ্ট হয় যে কীভাবে তারা নির্বাচনের ছক করেন। রাজনৈতিক গ্রেফতার এবং বিচারিক হয়রানি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী পরিকল্পনার অংশ। এতে নির্বাচন প্রক্রিয়া ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। 

শেখ হাসিনা রাষ্ট্রযন্ত্রকে রাজনীতিকরণ করেছেন। এর মধ্যে আছে বিচারবিভাগ, পুলিশ, প্রশাসন বেসামরিক এবং সামরিক আমলাতন্ত্র। ক্ষমতাসীনদের প্রতি তারা অনুগত, অবৈধ নির্দেশ মানতেও তারা পিছপা হন না। ভিন্নমত দমন করতে এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চালানোর জন্য শেখ হাসিনা এই প্রতিষ্ঠানগুলি ব্যবহার করেন। 
জন নীপিড়নের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন একেবারেই উদাসীন। নির্বাচন পর্যবেক্ষণ হিসেবে এটি ভুয়া সংস্থাগুলোর অনুমোদন দিয়েছে। এটিও প্রমাণ করে যে নির্বাচনী প্রক্রিয়া হবে আসলে আপোষে। নিবার্চন কমিশন সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচনী প্রচারণা ব্যতীত সব রাজনৈতিক অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করার জন্য, এটিও তো উদ্বেগজনক। এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন বস্তুত আনুষ্ঠানিকভাবে সমাবেশ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করেছে। এই পদক্ষেপ শুধু অনৈতিক, বেআইনি ও অসাংবিধানিকই নয়, এতে এও বোঝা যায় যে, নির্বাচন কমিশনের ওপর হাসিনার কী রকম প্রভাব রয়েছে। 

প্রশ্ন  : বিএনপির ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দিক থেকে হাসিনার সরকারকে খুব বেশি প্রভাবিত করেনি। এই অবস্থায় কীসের ভিত্তিতে হাসিনা-সরকারকে আন্তর্জাতিকভাবে দুর্বল করার জন্য বিএনপি আগামী নির্বাচন বর্জনের আশা করছে? 

তারেক রহমান : যেহেতু গণতন্ত্র ও মানবাধিকার গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যে সংযোগ-সেতু তৈরি করে, তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং বাংলাদেশের নাগরিকদের আকাঙ্ক্ষা একটি অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি সহাবস্থান তৈরি করা। বাংলাদেশের সঙ্গে যারা ব্যবসা করেন এবং বাংলাদেশের উন্নয়নের সহযোগীরা, যেমন- যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ, অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা, গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করে তাদের নৈতিক সমর্থনের জন্য আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশের জনগণ তাদের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক পদক্ষেপগুলোর প্রশংসা করেছেন। যেমন র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং ভিসা বিধিনিষেধ ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য এগুলো ছিল সাধারণ আহবান। এর সবই গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

প্রশ্ন : শেখ হাসিনা পুনরায় ক্ষমতায় এলে দলের জন্য বিএনপির কর্মপরিকল্পনা কী? নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার কারণে ভোটাররা দলের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে না?

তারেক রহমান : একেবারেই না। কারণ ভোটাররা এর মধ্যেই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে। বিএনপির রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জনগণেরই আবেগের বহিঃপ্রকাশ। এই অর্থবহ নির্বাচনের জন্য আমাদের আকাঙ্ক্ষা একইরকম। বস্তুত আমি বিশ্বাস করি, ফ্যাসিবাদের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ একেবারেই ধ্বংস গেছে। একেবারে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তার অনেক নজিরও আছে। গার্মেন্টস শ্রমিক থেকে নোবেল বিজয়ী, সাংবাদিক থেকে সুশীল সমাজ, ছাত্র থেকে পেশাজীবী- সমাজের সবাই মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা-বঞ্চিত। বিএনপির দাবির সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের আকাঙ্ক্ষা মিলে গেছে। সবাই শেখ হাসিনার পদত্যাগ চায়। আমাদের দল জনস্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে। তাই জনসমর্থনের ভিত্তিতেই আমরা রাষ্ট্রের ৩১-দফা কাঠামোগত সংস্কার এবং ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল নীতি প্রণয়ন করেছি। 

আসন্ন নির্বাচনে শুধু যে রাজনৈতিক দলগুলো অংশ নিতে পারবে না তা নয়, ভোটাররাও এতে অংশ নিতে পারবেন না। আমি বুঝতে পারি এটা কতটা বঞ্চনার। জনগণ নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না। হাসিনার অধীনে গত দুটি নির্বাচনে প্রায় ১২০ মিলিয়ন ভোটার ভোট দিতে পারেননি। যাদের মধ্যে আছেন ৩০ মিলিয়ন তরুণ ভোটার, যারা ২০০৯ সালের পর ভোটার হয়েছেন। এই অধিকার-বঞ্চিত ব্যক্তিরা ভোটের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করছেন। বিএনপির দাবিও এই একই। লিঙ্গ, ধর্ম, জাতি বা রাজনীতি নির্বিশেষে সব বাংলাদেশীর স্বাধীনতা, সমতা এবং সমৃদ্ধির ক্ষমতায়নের সর্বোচ্চ লক্ষ্যের জন্য বিএনপি ও জনগণ একে অপরের পরিপূরক।

প্রশ্ন : আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, বিএনপি নিজেদের সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণেই নির্বাচন বর্জন করছে। দলের অনেক নেতা কারাগারে বা পলাতক। এ বিষয়টি কি বিএনপির নির্বাচন থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্তে কোনো ভূমিকা রেখেছে?

তারেক রহমান : কর্মী, সমর্থক এবং অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যার দিক থেকে যদি বিবেচনা করি তাহলে বিএনপি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। সাংগঠনিক শক্তিতে আমাদের মোকাবিলা করতে না পেরে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রযন্ত্রকে লেলিয়ে দিয়েছে আমাদের পেছনে। ক্ষমতার অপব্যহার করছে। নৃশংসতা চালাচ্ছে। তৃণমূল থেকে আমাদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতাকমীর্দের ফাঁদে ফেলেছে। বিএনপির জনবান্ধব শক্তিকে এবং নিজের জনবিচ্ছিন্ন দুর্বলতাকে ভয় পেয়ে আওয়ামী লীগ এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে যেন বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে। 

বিএনপির সিনিয়র নেতারা দুই বছর ধরে রায়ের মুখোমুখি। দুই বছরের সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি নির্বাচনে অংশ নিতে পারে না, আওয়ামী লীগ এমন একটি আইনি বিধানকেও কাজে লাগিয়েছে বিএনপির নেতাদের প্রতিহত করতে। বিএনপির নেতাকর্মীরা নাশকতামূলক অগ্নিসংযোগ করেছে এমনই কাল্পনিক ঘটনার সাথে জড়িয়ে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে, পক্ষপাতদুষ্ট রায় দেওয়া হয়েছে। আটক ব্যক্তিদের ঠিকমতো চিকিৎসাও হচ্ছে না। পুলিশ-হেফাজতেই তাদের অনেকের মৃত্যু হচ্ছে। আওয়ামী লীগের গুন্ডারা এবং পুলিশ একই সাথে বিএনপির নেতাকর্মীদের বাড়িতে আক্রমণ করে। তাদের গুলি করে মারার হুমিক দেখায়, নানা উপায়ে জব্দ করে, বাড়িতে বোমা মারে। যার ফলে আমাদের লক্ষ লক্ষ কর্মী বাড়িছাড়া হয়েছে। এমন অনেক ঘটনা আছে নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে না পেয়ে তার আত্মীয়-স্বজনকে ধরে এনেছে, তাদের ওপর অত্যাচার করেছে। 

প্রশ্ন : আওয়ামী লীগ নেতারা তাদের সপক্ষে যুক্তি দেখান যে, ২০০৬-০৮ সময়কালে বিএনপিই নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অসম্মানিত করেছিল। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?

তারেক রহমান : ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের সময় নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় প্রশাসন প্রবর্তন করে বিএনপি সরকার। বাংলাদেশের সংবধিানে এটি অন্তর্ভুক্ত করে। যা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নামে পরিচিত। সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে অবাধ, সুষ্ঠু এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন পরিচালনার লক্ষ্যে জনগণের ম্যান্ডেট দ্বারা এটি সমর্থিত হয়েছিল। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগ এই বিধানটি বাতিল করে। এতে দেশের মানুষ হতবাক হয়, ক্ষুণ্ণ হয়। কোনো বৈধতা ছাড়াই ক্ষমতায় থাকার জন্য আওয়ামী লীগ এই পথ বেছে নেয়। 

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কর্তৃক নিযুক্ত “অ্যামিকাস কিউরি” তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা রাখতে ব্যাপকভাবে সমর্থন দিয়েছিলেন। রাজনৈতিক দল, অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, আইনবিদ, সুশীল সমাজের সদস্য এবং জাতীয় দৈনিক সম্পাদকদের সাথে পরামর্শ করে একটি সংসদীয় কমিটি সর্বসম্মতভাবে এই ব্যবস্থাকে সমর্থন করেছেন। সবার দাবি অগ্রাহ্য করে শেখ হাসিনা তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার জন্য সংসদীয় কমিটিকে নির্দেশ দেন। 

প্রশ্ন : বিএনপিকে নিয়ে ভারতের চিন্তার একটি দিক হলো ইসলামপন্থী দলগুলোর সাথে বিএনপির ঐক্য। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর সাথে সম্পর্ক। বিএনপি শাসনামলে বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক ভালো ছিল এবং ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগ নিয়ে বিএনপি সরকারের তেমন চিন্তা ছিল না। আপনার মন্তব্য কী?

তারেক রহমান : একটি বড় দল হিসেবে বিএনপি সবার বিশ্বাসকে মর্যাদা দেয়। বিএনপি বিশ্বাস করে ধর্ম ব্যক্তির। কিন্তু রাষ্ট্র সবার জন্য। বাংলাদেশ সব ধর্মের দেশ। যার যার ধর্মের প্রতি এখানে সবার সমান অধিকার। আমাদের দল ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চায় না। তবে বাস্তবতা হলো বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের সংবিধান ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার অধিকার দিয়েছে, তাই এই তিনটি দেশেই ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল রয়েছে।

ধরুন ভারতের চিন্তা শুধু জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে বিশেষভাবে। সেক্ষেত্রে জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সুসম্পর্কের ইতিহাস রয়েছে। ১৯৬৬ সাল থেকে ৭০ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলাম একসঙ্গেই কাজ করেছে। একযোগে পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের শাসনের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছে। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশে সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদের শাসনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য দুটি দল একযোগে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। ১৯৯৪-১৯৯৬ সালেও তারা একসাথে ছিল, এবং বিএনপির বিরুদ্ধে ছিল। বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে তারা একযোগে আন্দোলন চালিয়েছ। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ যদি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট করে তাহলে সমস্যা নেই? বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর জোট হলেই সমস্যা? 

অন্যদিকে, ভারতের উদ্বেগ যদি হয় ইসলাম নিয়ে, তাহলে উল্লেখ করতে হয় যে, একটি শরিয়াভিত্তিক ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের জন্য ইসলামী ঐক্যজোটের সাথে ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগ একটি লিখিত চুক্তি স্বাক্ষর করছিল। হাসিনাই কট্টরপন্থী ইসলামপন্থীদের আওয়ামী লীগের তাঁবুর নিচে টেনে নিয়ে এসেছেন। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা, এ. কে. এম বাহাউদ্দিন পূজা নিয়ে কটূ মন্তব্য করেন এবং কীভাবে দূর্গা পূজা করতে হবে তা হিন্দুদের শেখাতে গিয়েছিলেন। অনেক সমালোচনা সত্ত্বেও তিনি নিজের দাবি প্রত্যাহার করতে অস্বীকার করেন। তার মন্তব্যের সমালোচনা করায় তার সমর্থকরা হিন্দুদের ওপর আক্রমণ করতে যায়। হিন্দু নেতাদের সতর্কবার্তার পরেও তিনি আসন্ন ডামি নির্বাচনে আবারো মনোনয়ন পেয়েছেন। 

আমাদের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল হলো সন্ত্রাসবা
দ, বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং চরমপন্থা মোকাবেলার জন্য একটি শক্ত সমর্থ যৌথ-প্রচেষ্টার ওপর জোর দেওয়া। বাংলাদেশের ভূখণ্ড কোনো রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর নয়, এ ব্যাপারে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। 

প্রশ্ন  :  ১৫ বছর ধরে আপনি বাংলাদেশ থেকে দূরে, আপনার দল যখন ক্ষমতায় ছিল তখন বিরোধীদলীয় নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্রসহ একাধিক মামলায় দেশে জেল খেটেছেন। আপনাকে আসামী হিসেবে বিদেশী রাষ্ট্রের কাছেও প্রমাণ করার চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। আপনার বক্তৃতা এবং মন্তব্যও বাংলাদেশে প্রচার নিষিদ্ধ। এমন কি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। এর বিরুদ্ধে বিচারের ব্যবস্থাও রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি সমর্থকদের কী করে নেতৃত্ব দেবেন বলেন ভাবছেন? 

তারেক রহমান : শেখ হাসিনার সাথে আকস্মিক সম্পর্ক অবনতির পর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে জোরপূর্বক বিচার বিভাগ থেকে অপসারণ করা হয়, এতেই বাংলাদেশের বিচার বিভাগেগর স্বাধীনতা বোঝা যায়। বাইরের সিদ্ধান্ত কীভাবে আদালতের রায়কে প্রভাবিত করে তাও স্পষ্ট করে। আরেকটি ঘটনার কথা বলি, হাসিনার চাপ সত্ত্বেও বানোয়াট মামলা থেকে আমাকে বেকসুর খালাস দিয়েছিলন বিচারক মো. মোতাহার হোসেন। অবিশ্বাস্য সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু জীবন বাঁচানোর জন্য তাকে পালিয়ে বিদেশে এসে আশ্রয় নিতে হয়েছে। এতেই বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা স্পষ্ট। চাকরি বাঁচানোর জন্য বিচারকদেরও পরিকল্পিত সিদ্ধান্ত মেনে চলতে হয়। 

বিচারিক অবিচারের প্ররোচনাকারী একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি হলেন আবদুল কাহহার আকন্দ, যিনি শেখ হাসিনার নির্দেশ অনুসারে বেশ কযে়কটি সাজানো মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসাবে দাযি়ত্ব পালন করেছিলেন। আপনি যে মামলাটি হাইলাইট করেছেন তাতে তিনি আমার বিরুদ্ধে বানোয়াট দোষী সাব্যস্ত করেছেন, ঘটনার সাত বছর পরে অভিযোগপত্রে আমার নাম যুক্ত করেছেন এবং জাল প্রমাণ তৈরি করেছেন যার কোনও উপাদান নেই। অবসর গ্রহণের পর তিনি আসন্ন ডামি নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের এই সম্পৃক্ততা, পা চাটলে পুরষ্কার পাবে, ভাবলেই আমার গা জ্বলে। 

হাসিনা সরকার শুধু আমাকে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসায়নি, আমার স্ত্রীরও বিরুদ্ধেও কাল্পনিক অভিযোগ এনে মামলা সাজিয়েছে। অথচ রাজনীতির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই নেই। শেখ হাসিনা বাংলাদেশে আমাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছেন। আমার মা, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে জোরপূর্বক বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেছেন। ওই বাড়িটি ছিল তিন দশকেরও অধিক সময়ের আমাদের পারিবারিক বসতি। তার বয়স হয়েছে। স্বাস্থ্যও খারাপ। তার উন্নত চিকিৎসা দরকার। পারিবারিক সান্নিধ্য প্রয়োজন। তিনি এই সব কিছু থেকে বঞ্চিত। আমি এবং আমার পরিবার গণতন্ত্রের জন্য ত্যাগ স্বীকার করে যাচ্ছি। বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা থেকে আমরা অনুপ্রেরণা পাই। 

পরবাসে থাকলেও আমি গভীরভাবে বাংলাদেশের সত্তা ও মানুষের সঙ্গে সংযুক্ত। সারাক্ষণই আমি সারা দেশের মানুষের সঙ্গে ফোনে ও অনলাইন মিটিংয়ে থাকি। প্রতিদিনই আমি দেখি আমাদের নেতাকমীর্রা জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আরো নিভীর্ক ও দৃঢ়-সংল্পপের অধিকারী হয়ে উঠছেন। পরদিনই তারা পথসভা বা জনসভায় যোগ দিচ্ছেন। গণতান্ত্রিক আদর্শের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিতে পিছপা হন না। এই সাহস ও উদ্দীপনা দেখে আমি অনুপ্রাণিত হই। জনগণের আপসহীন অবস্থানের প্রশংসা করি। ব্যবসায়ীদের, তৃণমূলের নেতাকর্মীদের একত্রিত করতে আমার দিক থেকেও সর্বাত্মক চেষ্টা চলতে থাকে। শত দুর্ভোগ আর প্রতিকূলতার মুখেও এই বিশ্বাস থেকেই আমাদের আবেগ কাজ করে যে, আবারও আমরা একটি মুক্ত-স্বাধীন দেশে বাস করবো। 



স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য্য, 
ভারতের আলট্রা লেফট এবং হিন্দু রাইট বিষয়ক দুটি নন-ফিকশন বইয়ের লেখক। ভারতের রাজনীতি, পরিবেশ, মানবাধিকার এবং সংস্কৃতি নিয়ে লেখালেখি করেন।

মাহবুব মানিক ও বিএনপির হাজারো সাধারণ কর্মীর ত্যাগের স্মরণেঃ "সব মরণ নয় সমান"

— ড. সাইমুম পারভেজ





শেষ যখন মানিকের সাথে কথা হয়েছিলো তখন সে জেল থেকে কেবল বের হয়েছে। হঠাৎ করেই ফোন দিয়ে স্বভাবসুলভ জোরালো গলায় কিছুটা হাসি নিয়েই জেলজীবনের কথা বলছিলো। 

আমি জিজ্ঞেস করলাম, জেল এ কি খুব কষ্ট হয়েছিলো মানিক ভাই?
আমার প্রশ্নে মানিক কিছুটা থমকে গেলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, "ভাই, খুব খারাপ অবস্থায় ছিলাম। জেলে যতজন থাকার কথা তার চেয়েও অনেক মানুষ গাদাগাদি করে রাখা। ঘুমাতে তো দূরের কথা, শুতেও পারি নাই ঠিকমতো। বেশীর ভাগই আমাদের মত বিএনপির নেতা-কর্মী। চোর-ডাকাতদের সাথেই ছিলাম। এ সরকার তো আমাদের চোর-ডাকাত বানিয়ে দিলো ভাই। বিএনপি করা কি এখন অপরাধ?"

মানিকের এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আলোচনা করার আগে জেনে নেই মানিক কে। মাহবুব মানিক চল্লিশোর্ধ এক যুবক। বাংলাদেশের প্রধান বিরোধীদল বিএনপির মিডিয়া সেলের ডিজিটাল মিডিয়ার কাজগুলোর দেখভালের দায়িত্ব ছিলো মানিকের। বড় কোন রাজনৈতিক নেতা না, নিতান্তই নিরলস নিভৃতে কাজ করে যাওয়া এক কর্মী। 

গত ২৮ অক্টোবর ২০২৩ থেকে বিরোধী দল ও মতের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের পেটোয়া বাহিনী যে নিপীড়ন চালাচ্ছে তারই অংশ হিসেবে মাহবুব মানিককে গ্রেফতার করা হয় বিএনপি চেয়ারপার্সনের অফিসের সামনে থেকে। কারাবাস শেষে মানিক বের হয় ১৯ নভেম্বর। ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ সকালে মানিক মারা যায়।

সুস্থ-সবল যুবক মানিকের মৃত্যু কি স্বাভাবিক? আরো হাজারো বিরোধী মতের নেতা-কর্মীদের মত মানিক কি কারা হেফাজতে অথবা রিমান্ডে নির্যাতিত হয়েছিল? শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের চাপের কারণেই কি মানিকের মৃত্যু হলো? এসব প্রশ্নের উত্তর হয়তো একসময় জানা যাবে, বা কিছু প্রশ্ন অজানাই থেকে যাবে। 

কিন্তু যেসব প্রশ্নের উত্তর আমরা পাচ্ছি তা খুবই আশঙ্কাজনক ও হৃদয়বিদারক। গত জুলাই ২৮, ২০২৩ থেকে ডিসেম্বর ১৬, ২০২৩ পর্যন্ত মানিকের মত ২৪,৭৩৬ জন বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীকে শুধু বর্তমান সরকার বিরোধী হবার কারণে গ্রেফতার করা হয়েছে, ১০২৩টি মামলা দায়ের করা হয়েছে, ৯১,৬৩৭ জনকে এসব মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে, ৯০৫৯ জন আহত হয়েছেন, আর হত্যা করা হয়েছে কমপক্ষে ২২ জনকে।

কিন্তু এই তালিকা কেবল সংবাদপত্রে ও বিএনপির দলীয় সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আরো অসংখ্য মানুষকে গ্রেফতার, নির্যাতন, ও হয়রানি করা হয়েছে, যার সব তথ্য পাওয়া যায়নি। বিরোধী রাজনৈতিক দলের ও মতের সমর্থক ও নেতা-কর্মীদের গ্রেফতারের সংখ্যাটি এত বেশী যে তা বাংলাদেশের কারাগারের ধারণক্ষমতার অনেক বাইরে চলে গেছে। সৃষ্টি হয়েছে মানবেতর পরিস্থিতি।

আমাদের দেশের বিক্রি হয়ে যাওয়া সুশীল সমাজ, সবকিছু এড়িয়ে চলে নিজের লাইফস্টাইল ঠিক রাখতে চাওয়া মধ্যবিত্ত, আর সরকারী দলের অনুগত বুদ্ধিজীবিরা বলার চেষ্টা করেন যে গণতন্ত্র পুণরুদ্ধারের এই চলমান আন্দোলন কেবল বিএনপি বনাম আওয়ামী লীগের ক্ষমতা দখলের লড়াই। 

তারা গণতন্ত্র ও ভোটাধিকারকে ত্যাগ করে দৃশ্যমান কিন্তু সারবত্তাহীন উন্নয়নকে বেছে নেন। আওয়ামী লীগ সরকার ও এর সুবিধাভোগী কিছু মানুষ ছাড়া এই "উন্নয়ন" বাকি সবাইকে দিনের পর দিন গরীব করে তুলেছে।  সাধারণ মানুষ, যাদের দৈনন্দিন জীবনে লুটপাট ও অর্থনৈতিক সংকটের ছাপ পড়েছে, তারা এই কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের জন্য সবচেয়ে বেশী জোরালো আওয়াজ তুলেছে।

ধরা যাক শাওন আহমদের কথা। পেশায় একজন শ্রমিক শাওন সেপ্টেম্বর ২০২২ এ বিএনপির প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দেয়ার কারণে পুলিশের গুলিতে মারা যান। জুলাই ২০২২ এর হত্যা করা হয় আবদুর রহিম নামে এক কৃষককে। একই বছরের সেপ্টেম্বর এ শহিদুল আলম নামের একজন রিকশাচালক ও নভেম্বরে নয়ন মিয়া নামে একজন শ্রমিককে হত্যা করা হয়। ২৮ অক্টোবর ২০২৩ এর পর থেকে পুলিশ ও সরকারী দলের পেটোয়া বাহিনীর হাতে যারা মারা যান, যেমন শামিম মোল্লা, আব্দুর রশীদ, জাকির হোসেন, তারাও সাধারণ নেতা-কর্মী।

ফিরে যাই মৃত্যুর আগে মাহবুব মানিক আমাকে শেষ যে প্রশ্ন করেছিলো সে প্রসঙ্গে। বিরোধী দলের রাজনীতি করা কি অপরাধ? মানিক, শাওন, রহিম, শামিমের মত হাজারো নেতা-কর্মী নির্যাতিত হয়ে, প্রাণ দিয়ে, বারবার কারাগারে গিয়ে এই প্রশ্নের উত্তর নিজেরাই দিয়ে গেছেন। দিয়ে যাচ্ছেন। 

তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা আমাদের বারবার এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে যে, আমরা এমন একটি দেশ তৈরি করেছি, এমন একটি সরকারকে বৈধতা দিচ্ছি, এমন একটি নিপীড়নমূলক রাজনৈতিক দলকে শাসনক্ষমতায় অবৈধভাবে জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া থাকতে দিচ্ছি, যারা মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে, রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ডে জড়িত থাকার সার্বজনীন অধিকারকে 'ক্রিমিনালাইজড' করে ফেলেছে।

যে প্রশ্নের উত্তর এই দেশের সাধারণ জনগণ জানে, বুঝতে পারে, এবং নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য রাজপথে সংগ্রাম করে, তা কি বিক্রি হয়ে যাওয়া "শিক্ষিত শ্রেণী" বুঝে? এই প্রশ্নই এখন প্রাসঙ্গিক। 

বাংলাদেশের কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী লীগ সরকার আরেকটি প্রহসনমূলক নির্বাচনের আয়োজন করেছে ৭ জানুয়ারি ২০২৪। এই প্রহসনের নির্বাচনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকামী জনগণের আন্দোলন চলছে। নির্বাচনের আগে ও পরে এই আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি কেমন হবে তা ভবিষ্যতই ঠিক করবে। 

কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, ইতিহাসের কোন বাঁকে, কোন দেশেই ফ্যাসিস্ট সরকারকে কে সরিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সহজ হয়নি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও অনেক প্রাণ, রক্ত, আর সংগ্রামের বিনিময়ে একদিন ভোটের অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, জীবন ও জবানের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে। 

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এই শ্বাপদ-সংকুল যাত্রা যাদের প্রাণের বিনিময়ে, যাদের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পাড়ি দিবো তাদের আমরা যেন ভুলে না যাই। পুলিশের গুলিতে মারা যাবার আগে শাওন তার ফেসবুকে লিখেছিলেন, "কর্মীর চেয়ে বড় কোন পদ নাই।"

ইতিহাস সবসময় রাজা-রাজড়াদের আরো মহান করে তুলে। শাওন ও মানিকের মত হাজারো সাধারণ মানুষের জীবন হারিয়ে যায়, থাকলেও চলে যায় ইতিহাসের ফুটনোটে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এসব "সাধারণ" কে আমরা যেন অসাধারণ করে তুলতে পারি।
মাহবুব মানিক মজা করে বলতো, "বিয়ে করবো গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে, হাসিনা সরকারের পতন হলে।"

মানিকের সে স্বপ্ন পূরণ হয় নি। কিন্তু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এই আকুতি মানিক রেখে গেছে হাজারো প্রাণের মাঝে। 

মাহবুব মানিক এখন বাংলাদেশের হাজারো মায়ের "সোনা-মানিক"দের কাতারে শামিল, যাদের ত্যাগ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে অটুট রেখেছে।  

লেখক: ড. সাইমুম পারভেজ 
ব্রাসেলসভিত্তিক রাজনীতিবিজ্ঞান বিষয়ক গবেষক

Monday, December 18, 2023

কৃষিমন্ত্রীকে অভিনন্দন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

পর্যালোচনাঃ 
শহীদুল্লাহ ফরায়জী



আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বিএনপিকে ভোটে আনতে সব চেষ্টাই করেছে আওয়ামী লীগ। এমনকি একরাতে সব নেতাকে জেল থেকে মুক্তির প্রস্তাবেও বিএনপি রাজি হয়নি। বারবার নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হয়েছে, বিএনপি নির্বাচনে আসলে নির্বাচন পিছিয়ে দেয়া হবে। শুধু পিছিয়ে দেয়া নয়, বলা হয়েছে, সবাইকে জেল থেকে ছেড়ে দেয়া হবে। বিএনপির ২০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার না করলে বাংলাদেশে আজকে হরতালের দিন গাড়ি চলতো না। এছাড়া আমাদের অন্য কোনো গত্যন্তর ছিল না। বিকল্পও ছিল না। যেটা করেছি আমরা চিন্তাভাবনা করেই করেছি। তাদের জেলে না রাখলে দেশ অচল হয়ে যেতো।

মাননীয় কৃষি মন্ত্রীর কথায় যা স্পষ্ট হয়েছে তা হল, ২০ হাজার নেতাকর্মীকে কারাগারে বন্দি করে বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে সব চেষ্টা করেছে আওয়ামী লীগ। অর্থাৎ বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে কোন সংলাপ বা কোন উদ্যোগ না নিয়ে তাদের ২০ হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করেছে।

আমাদের সবার মনে থাকবার কথা, তফসিল ঘোষণার পূর্বে বিরোধী দলের সাথে সংলাপের জন্য অভ্যন্তরীণ এবং গণতান্ত্রিক বিশ্ব থেকে বারবার তাগিদ দেওয়া হলেও তা সরকারের পক্ষ থেকে  সরাসরি নাকচ করা হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে কী কারণে নেতাকর্মীদের জেলে রেখে গোপন আঁতাতের প্রয়োজন পড়লো তা মাননীয় মন্ত্রীর কথায় বোধগম্য নয়।

নাশকতা বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত ২০ হাজার নেতাকর্মীকে এক রাতে ছেড়ে দেওয়া যায়- এতে স্পষ্ট প্রমাণ হয়, ২০ হাজার নির্দোষ নেতাকর্মীকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। একমাত্র শাহজাহান ওমর ছাড়া সরকারের সাথে গোপন সমঝোতার প্রশ্নে আর কেউ রাজি না হওয়ায় কারো মুক্তি মিলেনি। মাননীয় মন্ত্রীর কথায় সরকারের সাথে সমঝোতা হলে তাদের বিরুদ্ধে আনীত সমস্ত অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে এক রাতে সবাইকে মুক্ত দেয়া সম্ভব হতো। ২০ হাজার মানুষকে নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা এবং সমঝোতার ভিত্তিতে এক রাতে মুক্তি দেয়া এটি কোন গণতান্ত্রিক দেশে, কোন আইনের শাসনের দেশে, কোন রাজতান্ত্রিক দেশে, কোন কমিউনিস্ট শাসিত দেশে, কোন একদলীয় শাসিত স্বৈরাচারী সরকারের দেশেও সম্ভব নয়। এতে এটা প্রমাণ হয় বর্তমান বাংলাদেশ সরকার উপরোক্ত দেশসমূহের সরকারের চেয়ে একেবারে ভিন্ন। এটাকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ভাষায় নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে হবে।


মাননীয় কৃষি মন্ত্রী আরো বলেছেন, বিশ হাজার কর্মীকে গ্রেপ্তার না করলে আজকে হরতালের দিনে গাড়ি চলতো না। এ ছাড়া আমাদের বিকল্প ছিল না। যেটা করেছি চিন্তা ভাবনা করেই করেছি। তাদের জেলে না রাখলে দেশে অচল হয়ে যেত।

১৯৭১ সালে তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার যদি এই সরকারের অনুরূপ বিবেচনায় রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করে পদক্ষেপ নিতো হয়ত ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর বজ্রকন্ঠের ঐতিহাসিক 
ভাষণ পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হতে পারত না, ২রা মার্চের পতাকা উত্তোলন, ৩রা মার্চের ইশতেহার পাঠ সম্ভব হতো না। এমনকি  জাতি রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের স্বপ্ন অধরাই থেকে যেত।


নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারি ইস্যুতে অতীতে আওয়ামী লীগ ১৭৩ দিন হরতাল করেছে, কিন্তু তখন তৎকালীন সরকার আওয়ামী লীগের ২০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতারের কথা বিবেচনা করেনি। অথচ বর্তমান সরকার রাজনৈতিক প্রশ্নের মীমাংসা বা নিষ্পত্তি করার ক্ষেত্রে গ্রেফতার বা বল প্রয়োগের একমাত্র পথ অনুসরণ করছে, যা দেশকে গভীর রাজনৈতিক সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।  

প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী বিভাগ নাগরিককে ইচ্ছা বা সুবিধা অনুযায়ী অভিযুক্ত করে গ্রেফতার করবে ও উদ্দেশ্য পূরণ হলে নির্বাহী বিভাগই কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে দিবে, তাহলে রাষ্ট্রীয় সকল প্রতিষ্ঠান ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে এবং আইনের শাসন তথা রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তাই শেষ হয়ে যাবে।

গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি অবজ্ঞা ও অবমাননার ফলে বাংলাদেশের জনগণ অত্যাচার ও উৎপীড়নের  বিরুদ্ধে সর্বশেষ উপায় হিসেবে ১৯৭১ সালে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। সেই দেশে আবার গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আনুগত্যকে নিশ্চিত করে না।

সত্যের দুর্ভিক্ষে মাননীয় কৃষিমন্ত্রী যে বয়ান উপস্থাপন করেছেন তার জন্য অভিনন্দন প্রাপ্য।

লেখক:
গীতিকবি ও সংবিধান বিশ্লেষক

কার্টসি - মানবজমিন/ ডিসেম্বর ১৭, ২০২৩

Sunday, December 17, 2023

মাহবুব মানিক আর নেই



ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সদস্য, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) কাউন্সিলর এবং বিএনপির মিডিয়া সেলের ডিজিটাল বিভাগের প্রধান মাহবুব মানিক ইন্তেকাল করেছেন। শুক্রবার (১৫ ডিসেম্বর ২০২৩) সকাল ১১টায় রাজধানীর বসুন্ধরার বাসায় তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। পরে এভার কেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তিনি অসংখ্য শুভাকাঙ্ক্ষী ও আত্মীয়-স্বজন রেখে গেছেন।

মরহুম মাহবুব মানিকের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দু:খ প্রকাশ করেছেন বিএনপির মিডিয়া সেলের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক ডা. মওদুদ হোসেন আলমগীর। শুক্রবার (১৫ ডিসেম্বর ২০২৩) এক শোকবার্তায় তিনি বলেন, মরহুম মাহবুব মানিক অত্যন্ত মেধাবী ও বিনয়ী সাংবাদিক ছিলেন। পেশাগত দায়িত্ব পালনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত কর্তব্যপরায়ন। বিএনপির মিডিয়া সেল কর্তৃক তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব তিনি নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে পালন করতেন।

শোকবার্তায় বলা হয়- গত ২৮ অক্টোবর তাকে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয় থেকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। পুলিশ হেফাজতে থাকাকালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। গত ২০ নভেম্বর মুক্তি পান। এর কিছুদিন পরই মানিকের মৃত্যুতে আমরা গভীর শোকাহত ও মর্মাহত। চলমান গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে তিনি ছিলেন একজন অগ্রসৈনিক। গণতন্ত্রের একজন যোদ্ধা হিসেবে তার নাম অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তার মৃত্যুতে মিডিয়া সেলের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। জাতি হারালো একজন দেশপ্রেমিক মেধাবী সাংবাদিক ও ভোটাধিকার এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের অগ্রপথিককে। 

বিএনপির মিডিয়া সেলের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক বলেন, মহান আল্লাহর দরবারে মরহুম মাহবুব মানিকের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি এবং শোকাহত পরিবার, আত্মীয়-স্বজনসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আল-আমিন যেন মরহুম মাহবুব মানিককে বেহেস্ত নসিব করেন এবং শোকাহত পরিবারকে ধৈর্য ধারণের তৌফিক দেন, এই দোয়া করি।

Friday, September 8, 2023

আপনার জনগণ আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন ——— ইসরাফিল খসরু

আমরা যারা আশির দশকের গোড়ার দিকে জন্মেছি অথবা যারা মহান মুক্তিযুদ্ধের পরে জন্মেছেন,  তাদের উভয়েই একটা ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী।  আর তা হচ্ছে ১৯৯০’র স্বৈরশাসনের পতনের মাধ্যমে ঐতিহাসিক রাজনৈতিক পালা পরিবর্তনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করা যা আমাদের মনন ও মস্তিষ্কে স্থায়ীভাবে গ্রোথিত হয়ে আছে। 

দশ বছর বয়সী এক কিশোরের চোখে আমি সেই সময়টি দেখেছিলাম, দেখেছিলাম চট্টগ্রামের রাস্তায় প্রতিবাদমুখর জনতার মিছিল, অনুভব করেছিলাম আসন্ন সামগ্রিক সম্ভাবনার সোনালি ভোর। মনে হচ্ছিল আমরা আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে একটি নতুন ভোরের সাক্ষী হতে যাচ্ছি। তখন আমি অভ্যাসগতভাবে যে কাজগুলো করতাম তার মধ্যে একটি হলো আমার বাংলা শব্দভান্ডার উন্নত করার জন্য  সংবাদপত্র  পড়া,  সেই সংবাদপত্রের পাতায়ই প্রথমবারের মতো বেগম খালেদা জিয়া সম্পর্কে আমার প্রথম জানা। সেই পত্রিকার পাতায়ই আমার চোখ নিবদ্ধ হয়েছিল সাধারণ সাদা শাড়ি পরা একজন নারীর ছবির প্রতি, যার মুখাবয়ব ছিল দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ, যিনি হ্যান্ডমাইকে উৎসুক জনতার প্রতি বক্তব্য রাখছিলেন। সেই প্রতিচ্ছবি এখনো আমার মনে খোদাই করা আছে। 

পরিবারের সিনিয়র সদস্যরা আমাকে ছবিটির ব্যক্তি সম্পর্কে জানিয়েছিলেন যে  তিনি কোন সাধারণ মহিলা নন, তিনি শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম-এর পত্নী এবং চলমান  স্বৈরাচার এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রধান নেত্রী, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির চেয়ারপার্সন । এই বিষয়ে দুটি মৌলিক তথ্য আমাকে কৌতূহলী করেছিল এবং ছোটবেলায় আমার উপর গভীর ছাপ ফেলেছিল। 

প্রথম বিষয়টি ছিল যে একজন নারী এই আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন এবং দ্বিতীয়ত, তাঁর পূর্ব কোন রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছিল না যা তাঁকে এমন একটি বিশাল আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে সহায়তা করতে পারে। পুরুষ শাসিত এমন একটি সমাজে সহস্র বাধা ডিঙ্গিয়ে যিনি এক দশক ধরে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম করেছিলেন, বাংলাদেশের ভাগ্যকে সুনিশ্চিত করেছিলেন ও ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ করেছিলেন, তিনি কোন সাধারণ নারী নন।  তিনি অবশ্যই কোন সাধারণ নারী ছিলেন না, তিনি আমাদের ত্রাণকর্তা ছিলেন। আমি সবসময় তাকে এভাবেই দেখেছি এবং এখনও সেইভাবেই জানি।

আমার উৎসুক কিশোর মন তাঁর সম্পর্কে আরো জানতে আগ্রহী হয়ে উঠে। অনুসন্ধানে আমি জেনেছিলাম কীভাবে তিনি একটি রাজনৈতিক দল যেটি ছিল একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে, তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি সেই দলটিকে এক বিপ্লবী শক্তিতে পরিণত করেছিলেন যা আশির দশকে দীর্ঘ নয় বছর রাজপথে জনপদে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম করেছিল। স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর তিনি তৃণমূল থেকে বিএনপিকে গড়ে তোলার কাজে হাত দেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তিনি জনসমর্থন তৈরি করতে এবং উপযুক্ত প্রার্থীদের খুঁজে বের করার জন্য সারা দেশে সফর করেছিলেন। তাঁর একক জনপ্রিয়তাই বিএনপিকে ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী করে এবং দলটিকে বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতিতে একটি প্রধান শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। তিনি একজন আপসহীন নেত্রী হিসাবে ক্রমাগ্রত নিজেকে নিজে অতিক্রম করেছিলেন।  শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যদি বিএনপির আদর্শিক মেরুদণ্ড হন তাহলে বেগম খালেদা জিয়াই তৈরি করে ছিলেন দলের সাংগঠনিক ভিত্তি। 

১৯৯১ সালে চট্টগ্রামে সার্কিট হাউজে দূর থেকে তাকে প্রথম দেখার স্মৃতি আমার মনে আছে। তার সেই মুখ তখনও সেই পত্রিকার পাতায় আমার দেখা সেই দৃঢ় সংকল্পকে উদ্ভাসিত করছিল যিনি সকল প্রতিকূলতাকে পরাজিত করে তার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, এই কৃতিত্ব, এই অর্জন কেউ তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবেন না। 

আমার বাবা ১৯৯১ সালে বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত হন, এরপর রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হিসেবে দীর্ঘ সময় বেগম খালেদা জিয়াকে পর্যবেক্ষণ করলেও,  আমার উপর ছোটবেলায় ব্যক্তি বেগম জিয়ার সেই প্রভাবই স্থায়ীভাবে রয়ে গেছে। বেগম খালেদা জিয়া নিজে উদাহরণ তৈরি করেছেন যে আমাদের সমাজের মহিলারা দৃঢ়সংকল্প এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে। এটি আমাকে আমাদের সমাজে মহিলাদের কাজের সম্ভাবনা ও গুরুত্ব সম্পর্কে নতুন ইতিবাচক ভাবনায় উপনিত করেছিল।

এখন তিন দশক পরে এসে আমরা ১৯৯০-এর মতো একই দুর্দশার মুখোমুখি হয়েছি। আমরা এখন এমন একটি শাসনব্যবস্থায়  রয়েছি যেখানে বিরোধীমত ও মানুষ কোনঠাসা অবস্থায় রয়েছেন, বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা অনুপস্থিত এবং ক্ষমতায় তাদের মেয়াদ দীর্ঘায়িত করার জন্য তারা বিচার বিভাগকেও নিয়ন্ত্রণ করছে। ১৯৯০ এর এর বিপরীতে, এখন অসুস্থ খালেদা জিয়া তাঁর জীবনের জন্য লড়াই করছেন যখন সরকার তাঁর সর্বোত্তম চিকিৎসায় বাধা দিয়ে চলেছে। কিন্তু এটা লক্ষ্য করা গুরুত্বপূর্ণ যে গত কয়েক বছরে তার প্রতি  ঘটা সরকারি হিংসাত্নক আচরণ ও কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও, তিনি এখনও সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে অসীম ধৈর্য এবং আপসহীনতার প্রতীক হয়ে সারা জাতিকে নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছেন । একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিকে বিগত এক দশক ধরে নিশ্চিহ্ন করার যে অপচেষ্টা চলেছে তার বিপরীতে দলটি যে টিকে আছে, তা বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব এবং ধৈর্যেরই প্রমাণ। এইভাবে, একজন অসুস্থ বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরিয়ে আনার জন আশা-আকাঙ্ক্ষার সম্মিলিত প্রতীক হয়ে আছেন এখনো।   

আমার জন্য, আমার মধ্যে থাকা কিশোরটি এখনও বিশ্বাস করে যে বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানুষের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনতে আমাদের পরিত্রাতা হিসেবে,  পথপ্রদর্শক হিসাবে আমাদের কাছে ফিরে আসবেন। তাঁর অদম্য জীবন ও পথচলা আমাদের জন্য আদর্শ  এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যও আদর্শ হয়ে থাকবে। সুস্থ হয়ে উঠুন বেগম খালেদা জিয়া, আপনার জনগণ আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন এবং লড়াই কিন্তু শেষ হয়নি।

— লেখক একজন উদ্যোক্তা।


Monday, September 4, 2023

প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বিএনপি ——— আমিরুল ইসলাম কাগজী ও ড. মোর্শেদ হাসান খান







কোথায় আজ সিরাজ শিকদার? ঘোষণা দিয়ে মানুষ হত্যা। আইন করে গণমাধ্যম বন্ধ। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রোহিত। সাংবাদিকরা বেকার। রাজনৈতিক দলের অফিসে ঝুলছে তালা। ভেড়ার পালের মতো বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গণভবনে। কারও কোনো স্বাধীনতা নেই, নেই কারও স্বতন্ত্র অবস্থা। অন্যদিকে,  দুর্ভিক্ষে ক্ষতবিক্ষত দেশ। তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ। প্রতিবাদ করার কেউ নেই। নেই স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি। একটাই দেশ,  তার একজনই নেতা। দেখা দেয় নেতৃত্বের শূন্যতা, শুরু হয় দম বন্ধ করা পরিস্থিতি। এমনই একদলীয় শাসনের বিপরীতে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ছিল সময়ের দাবি। পোড় খাওয়া ক্ষুব্ধ  রাজনীতিবিদদের মনের সেই সুপ্ত বাসনা জাগিয়ে তোলার দায়িত্বটি পালন করেছেন  জিয়াউর রহমান বীরউত্তম। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাঁর আগমন খুবই আকস্মিক কিন্তু সময়ের দাবির কাছে বাস্তবিক ও স্বাভাবিক। অনেকটা ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব ঘটে তাঁর। রাজনীতির এমন ঘনঘোর অমানিশা কাটাতে সময়ের চাহিদা এবং দেশের দাবিতে এসেছিলেন তিনি। তবে কোন চোরাগলি দিয়ে নয়, রাতের অন্ধকারে ষড়যন্ত্র করে নয় ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর   দেশপ্রেমিক সিপাহি -জনতার সম্মিলিত বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে অভিষেক ঘটে এই মহান নেতার। ১৯৭২ থেকে '৭৫ এর রাজনৈতিক ব্যর্থতার বিপরীতে সাফল্যের রূপকার হয়ে আসেন তিনি। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতির কবর রচনা করেন চিরকালের সংগ্রামী নেতা শেখ মজিবর রহমান। জিয়াউর রহমান যখন নেতৃত্বে আসেন তখন দেশে কোন রাজনীতি ছিল না। ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের রেখে যাওয়া একদলীয় বাকশাল, বাকি রাজনৈতিক দল ছিল নিষিদ্ধ। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘদিন সংগ্রাম করা সত্ত্বেও শেখ সাহেব  আবির্ভূত হলেন একদলীয় বাকশালী স্বৈরশাসন ব্যবস্থার নেতা হিসেবে। নির্বাচন ছাড়াই  জাতীয় সংসদে প্রেসিডেন্টের মেয়াদ পাঁচ বছর বাড়িয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করা হয়। ফলে রুদ্ধ হয় ক্ষমতা হস্তান্তরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সেই  সুযোগে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবের সবচেয়ে  প্রিয় সহযোদ্ধা খন্দকার মোস্তাক আহমাদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর অপেক্ষাকৃত জুনিয়র অফিসাররা রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দখল করে নেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা । একই বছর তেসরা নভেম্বর খালেদ মোশারফ এর নেতৃত্বে  পাল্টা ক্যু এর মাধ্যমে খন্দকার মোস্তাকও ক্ষমতাচ্যুত হন। গৃহবন্দি হন জেনারেল জিয়াউর রহমান। এতসব ক্যু পাল্টা ক্যু এর বিরুদ্ধে ৭ই নভেম্বর সিপাহি-জনতার ঐতিহাসিক সংহতির মধ্য দিয়ে সংগঠিত হয় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সেই পরিবর্তন ছিল স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব, বহুদলীয় গণতন্ত্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মৌলিক মানবাধিকার, সভাসমাবেশ ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে।  সেই পরিবর্তনের নেতৃত্বে ছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান ঘোষক জেনারেল  জিয়াউর রহমান। এই পরিবর্তনের জন্য তিনি রাজনীতি ফিরিয়ে আনেন, গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনেন, গঠন করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল -বিএনপি। 
এই রাজনৈতিক দল বিএনপি গঠনের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য নতুন প্রজন্মকে নিয়ে যেতে চাই ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর রমনা রেঁস্তোরায়।  সেদিন  এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট জিয়া ঘোষণা দেন নতুন এই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির। সংবাদ সম্মেলনে তিনি ঘোষণাপত্র পাঠ ছাড়াও প্রায় দুই ঘণ্টা সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। প্রতিষ্ঠাকালে দলের অন্যতম সৌন্দর্য ছিলো ডানপন্থী, বামপন্থী, মধ্যপন্থী সবার অংশগ্রহণ।
সেদিন তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন, বাস্তবিক পক্ষে জাতীয় প্রয়োজনের জন্যই নতুন দল করা হচ্ছে, এই দল জাতিকে দৃঢ় করবে এবং দেশ ও দেশের মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
প্রেসিডেন্ট জিয়া বলেন,  ১৯৭১ সালে আমরা স্বাধীনতা এনেছি। অনেকে তখন মনে করেছেন, এই স্বাধীনতার প্রয়োজন নেই। কিন্তু স্বাধীনতার মাধ্যমেই অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করা সম্ভব । বিপুল জাতীয় সম্পদ রয়েছে তার সদ্ব্যবহার করলে অল্প সময়ের মধ্যে দেশকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে। এই বিশ্বাস নিয়েই আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। আমি দেখেছি হাজার হাজার নরনারী দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছেন। তাদের ভুললে চলবে না, প্রশ্ন করতে হবে কেন তারা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। তাদের আস্থা, দেশ স্বাধীন হলে তারা শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। তাদের সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করাই নতুন দলের অঙ্গীকার।
প্রেসিডেন্ট  জিয়ার ভাষ্য অনুযায়ী জাতীয়তাবাদী দলের প্রধান লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতার অঙ্গীকার, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য এবং জনগণের মধ্যে স্বনির্ভরতার চেতনা সৃষ্টি। ১৯-দফা কর্মসূচি ছিল দলের মৌল আদর্শ। রাষ্ট্রনীতির চারটি মৌলিক আদর্শ তথা গণতন্ত্র, সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস, জাতীয়তাবাদ এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার অর্থে সমাজতন্ত্র, এই ছিল দলীয় কর্মসূচির মর্মবাণী।
বিএনপি গঠনের পর চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমানের  নেতৃত্বে  বিএনপি ১৯৭৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি  দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে  অংশ নিয়ে ২০৭ আসন পেয়ে নিরংকুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করে। আওয়ামী লীগ ৩৯ আসন পেয়ে প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসে।
প্রেসিডেন্ট জিয়ার একান্ত উদ্যোগে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা  ১৯৮১ সালের ১৭মে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এর মাত্র ১৩ দিনের মাথায় ৩০মে চট্টগ্রামে একদল বিপথগামী সৈন্যের ব্যর্থ অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট জিয়া শাহাদাৎবরণ করেন।
প্রেসিডেন্ট জিয়া যখন শাহাদাতবরণ করেন তখন বিএনপি'র জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। যার প্রমাণ মিলে তার জানাযায় উপস্থিত লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল দেখে। গোটা জাতি পালন করে ৪০ দিনের রাষ্ট্রীয়  শোক। তৎকালীন সেনাপ্রধান ধুরন্দর এরশাদ এটাকে সবচেয়ে বেশি ভয় পেয়েছিলেন। এখান থেকেই তিনি তার পরবর্তী পরিকল্পনা নির্ধারণ করে ফেলেন। প্রথমেই সেনাবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসার যারা তার চলার পথে কাঁটা হয়ে দাড়াঁতে পারে তাদের রাতারাতি কোর্ট মার্শাল করে কতক ফাঁসি, কতক বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ড দিয়ে সেনানিবাস থেকে দূরে সরিয়ে দেন। 
শহিদ জিয়ার শাহাদাৎবরণের পর ১৯৮১ সালের ১৫ নভেম্বর সকলদলের অংশগ্রহণে তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হন বিএনপি প্রার্থী  বিচারপতি আবদুস সাত্তার।  মাত্র তিন মাসের মাথায় ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদের তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করেন।
নেতাকর্মীদের ইচ্ছায় বিএনপির রাজনীতিতে ভূমিকা  রাখতে শুরু করেন শহিদ জিয়ার পত্নী বেগম খালেদা জিয়া। তিনি  যখন রাজনীতিতে আসেন সেটা অনেককে চমকে দিয়েছিল। ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল এরশাদের।
বেগম খালেদা জিয়া প্রথম জনসমক্ষে বক্তব্য রাখেন ১৯৮৩ সালের  ৭ই নভেম্বর জিয়াউর রহমানের সমাধিস্থলে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে । এরপর ১৯৮৪ সালের ১০ই মে তিনি বিএনপির চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন। বেগম খালেদা জিয়া যদি তখন বিএনপির হাল না ধরতেন তাহলে বিএনপি নিঃসন্দেহে গভীর সংকটে পতিত হতো । সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান, শামসুল হুদা চৌধুরী, মওদুদ আহমদ, ডাক্তার মতিনরা তখন বিএনপি ভেঙে নতুন নতুন দোকান খোলা শুরু করলেন যারা পরবর্তীতে এরশাদের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেই দুর্দিনে একক হাতে দলকে সামলে আন্দোলন সংগ্রাম করতে হয়েছে বেগম জিয়াকে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় তাঁকে কয়েকবার আটক করা হলেও আন্দোলন থেকে সরে যাননি বিএনপি চেয়ারপারসন। অবশ্য ততক্ষণে তিনি রাজনীতির মাঠে বেশ দক্ষ হয়ে ওঠেন। এরশাদের দমন,পীড়ন,  নির্যাতন পায়েদলে আন্দোলন সংগ্রাম এগিয়ে নিতে থাকেন তিনি। সঙ্গে ছিল তার তরুণ বাহিনী ছাত্রদল, যুবদল, শ্রমিকদল, মহিলা দল, কৃষক দল সবাই ছিল এক কাতারে বেগম খালেদা জিয়ার পিছনে একট্টা। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ১৫ দল,  সাতদল এবং জামায়াতে ইসলামী যখন যুগপথ আন্দোলন করছেন তখন একপর্যায়ে এরশাদ তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দেন। আন্দোলনকারী সকল সংগঠন এই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও আকস্মিকভাবে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা সেই নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেন। এর মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা দেশের জনগণের কাছে চিহ্নিত হলেন জাতীয় বেঈমান হিসেবে এবং নির্বাচন বর্জন করার মধ্য দিয়ে বেগম খালেদা জিয়া হলেন আপসহীন নেত্রী। শেখ হাসিনা এবং জামায়াত ইসলাম সংসদে এরশাদের দোসর হিসাবে যোগ দিলেন আর রাজপথে থাকলেন বেগম খালেদা জিয়া। ঘটনার আকস্মিকতায় এবং নির্বাচনের ঢামাঢোলে প্রথম দিকে আন্দোলনের মাঠ একটু থিতিয়ে পড়ে। কিন্তু বেগম জিয়া ঘরে উঠে যাননি, বরং পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের নিয়ে সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন। সঙ্গে পেলেন ১৫ দল থেকে চলে আসা ৫ দলীয় বাম জোট এবং আরও কিছু ছোট খাটো দলকে।
এরশাদের সঙ্গে শেখ হাসিনার মধুচন্দ্রিমা বেশিদিন স্থায়ী হলো না। আবার তাকে নামতে হলো রাজপথে। আবার শুরু হল যুগপথ আন্দোলন। দীর্ঘ ৯ বছর একটানা স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন  শেষে  ১৯৯০ এর ৬ই ডিসেম্বর চূড়ান্ত পতন ঘটলো এরশাদের। আসলো ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। পত্রপত্রিকা এবং বিভিন্ন সংস্থা জরিপ চালিয়ে বলে দিল, নির্বাচনে বিজয়ী হবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী জোট। শেখ হাসিনা এক বিদেশি পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়ে বললেন, বিএনপি পাবে মাত্র ১০ আসন। বিএনপি হবে বিরোধী দল। কিন্তু সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে  ১৪০ আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করলেন বেগম খালেদা জিয়া। ক্ষমতার পাদপিঠে আবারো বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। বেগম খালেদা জিয়ার হাত ধরেই বাংলাদেশের মাটিতে সূচিত হয় ওয়েস্টমিনস্টার  স্টাইলে ধ্রুপদী গণতন্ত্র সংসদীয় ব্যবস্থা।  বেগম খালেদা জিয়া হলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। এরশাদের ফেলে যাওয়া ভঙ্গুর অর্থনীতি, দুর্নীতিবাজ প্রশাসন, অনিয়ম ও ব্যবস্থাপনার বিপরীতে বেগম খালেদা জিয়া যখন শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কাজে ব্যস্ত তখন শুরু হয় আবার ষড়যন্ত্র। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি এবং গোলাম আযমের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী হরতাল অবরোধ অগ্নিসংযোগ করে গোটা দেশ অচল করে ফেলে। দাবি একটাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিতে হবে। বেগম জিয়া নিয়ম রক্ষার জন্য ১৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালে নির্বাচন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্বলিত ত্রয়োদশ সংশোধনী সংসদে পাস করলেন। ২০০১ সালে আবারও সেই নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ৪ দলীয় জোট ভূমিধস বিজয় অর্জন করে সরকার গঠন করেন। ধারণা করা হয়েছিল এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাংলাদেশের নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনায় স্থায়ীরূপ লাভ করতে পারে। কারণ এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যতগুলো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সবগুলো নির্বাচন দেশে এবং বিদেশে প্রচুর প্রশংসা কুড়িয়েছে। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধান থেকে বিলুপ্ত করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হলো। অর্থাৎ শেখ হাসিনা সারা জীবন নির্বাচিত হবেন ক্ষমতায় থাকবেন এবং বিরোধীদল বিএনপি এর উপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালাবেন। এটাকে একধরনের সামন্ততান্ত্রিক মনোভাব বলা চলে।
কিন্তু দিন যে বদলে গেছে, মানুষের মনে আওয়ামী লীগের দুঃশাসন, দুর্নীতি, লুটপাট এমন ভাবে ঘৃণা ছড়িয়ে দিয়েছে যে তারা আজ ফুসে উঠেছে দেশনায়ক তারেক রহমানের বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতৃত্বে।  জবর দখল করে ক্ষমতায় জেঁকে বসা হাসিনার সরকারকে তারা এখন হটাতে চায়। ভোটের অধিকার ফিরে পেতে চায়,  গণতন্ত্র ফিরে পেতে চায়,  মত প্রকাশের স্বাধীনতা ফিরে পেতে চায়,  সর্বোপরি মানবাধিকার বাস্তবায়ন চায়। এবারও জনগণের সেই আন্দোলনের পুরোভাগে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশনায়ক তারেক রহমান।
১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর রমনার রেস্তোরাঁয় জিয়াউর রহমান যে জাতীয়তাবাদী দলের গোড়াপত্তন করেছিলেন হাঁটি হাঁটি পা পা করে আজ ৪৫ বছরে একটি পরিপূর্ণ রাজনৈতিক দলের রূপ নিয়েছে। এই দলটিকে ভাঙার জন্য, বিরোধ সৃষ্টির জন্য শেখ হাসিনার সরকার এমন কোন কাজ করেন নাই যা ইতিহাসে বিরল। কখনো তৃণমূল বিএনপি কখনো বা বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট মুভমেন্ট।  কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করতে পারে নাই, বিএনপি থেকে একটি কর্মীও ভাগায়ে নিতে পারে নাই, এখানেই শেখ হাসিনার চরম ব্যর্থতা। শেখ হাসিনার পেটোয়া বাহিনী যত নির্যাতন করে যত খুন করে গুম করে মামলা দেয় ততই নেতাকর্মী ঘুরে দাঁড়ায়। শেখ হাসিনা ধ্বংস করতে চায় বিএনপিকে কিন্তু বারবার সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে বিএনপি বেরিয়ে আসে ফিনিক্স পাখির মত। তারেক রহমানের পরিকল্পনায় বিএনপির নেতৃত্বে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন আজ সারা বিশ্বের কাছে মডেল। একটি ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে,  একটি দলবাজ পুলিশ প্রশানের বিরুদ্ধে, একটি অনুগত আদালতের বিরুদ্ধে,  এমন পরিকল্পিত সংগ্রাম প্রসংশা কুড়িয়েছে সর্বমহলে। আন্দোলনের এই শান্তিপূর্ণ কৌশলের কাছে ধরাশায়ী আওয়ামী লীগ নানা ফন্দিফিকির করে এর ওপর সন্ত্রাসের তকমা লাগাতে মরিয়া। কিন্তু দেশের জনগণের কাছে আজ দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে বিএনপি নয় আওয়ামী লীগই সন্ত্রাসী দল। বিগত ২০১৩, ১৪ ও ১৫ সালে আওয়ামী লীগ নিজেরা বাসে আগুন দিয়ে,মানুষ পুড়িয়ে দোষ চাপিয়ে বিএনপিকে কোনঠাসা করেছিলো কিন্তু এবার সেটা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ সে সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তেমন শক্তিশালী ছিলো না, ছিলো আওয়ামী লীগের কিছু দালাল মিডিয়া। তারা এসব পরিকল্পিত হামলার শিকার মানুষকে নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বার্ন ইউনিটে স্যুটিংস্পট বানিয়ে ফেলেছিলো। সেখান থেকে তারা প্রতিনিয়ত বিভৎস প্রতিবেদন বানিয়ে সকল দায়-দায়িত্ব বিএনপির ওপর চাপিয়ে প্রচার করতো। এর মধ্য দিয়ে বিএনপির ওপর জনগণের ঘৃণা সৃষ্টির অপচেষ্টা করে। কিন্তু সচেতন দেশবাসী তা জানে। 
এখন আন্দোলন হচ্ছে, পুলিশ আগের মতই বুকে গুলি করছে, উল্টো গায়েবি মামলা দিচ্ছে। বিএনপি নেতাকর্মীরা জীবন দিচ্ছে কিন্তু পাল্টা কোনো অ্যাকশনে যাচ্ছে না। যে কারণে বিএনপির মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে এবং বাড়ছে সমাবেশের আয়তন। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, নির্যাতন নিপীড়ন, জেল-জুলুম, হুলিয়া মাথায় নিয়ে শহিদ জিয়ার হাতে গড়া বিএনপি নেতাকর্মীরা আজ দলকে এগিয়ে নিচ্ছে। এখন  আন্দোলন,সংগ্রাম,রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু বিএনপি। শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পতাকা তিন তিনবারের জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার হাত ধরে এখন তারুণ্যের প্রতীক দেশনায়ক তারেক রহমানের মুষ্টিবদ্ধ হাতে যৌবনপ্রাপ্ত।
কবি হেলাল হাফিজের কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই, ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’

ইতিহাস প্রমাণ করে বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্রমনা ——— ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান


ইতিহাস প্রমাণ করে বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্রমনা। কারণ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপট তৈরি করার ক্ষেত্রে স্বাধীনতাত্তোরকালের রাজনৈতিক গতিধারা যেমন — ছয় দফা, আগরতলার ষড়যন্ত্র মামলা, গোলটেবিল বৈঠক, ১৯৬৯ সালে প্রস্তাবিত সংবিধান সংশোধনী বিল ইত্যাদির ভূমিকা ছিল পরোক্ষ। মূলত, এ দেশের স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের রায় পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী না মানার কারণে। স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের পর বাংলাদেশের জনগণ প্রত্যাশিত গণতন্ত্রের পথে প্রথম যাত্রা করে।

কিন্তু ১৯৭৫ সালের ৪ জানুয়ারি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বাকশাল তৈরি করেছিলেন। বাংলাদেশের মানুষ তা মেনে নেয়নি। সৈনিক-জনতার নজিরবিহীন সমর্থনে শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম-এর হাত ধরে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথচলা শুরু হয়। কিন্তু আশির দশকে দেশ আবার স্বৈরশাসকের কবলে নিপতিত হয়। আবারো বাংলাদেশিরা এরশাদের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। রাজনৈতিক দল, ছাত্র-শিক্ষক-জনতাসহ দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশকে স্বৈরাচার মুক্ত করার ক্ষেত্রে আপসহীন নেতৃত্বের মুখ্য দায়িত্ব পালন করেন বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা শহিদ জিয়ার সুযোগ্য সহধর্মিণী বেগম খালেদা জিয়া। এরপর থেকে সাংবিধানিক নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন-চর্চার শুভসূচনা হয়। অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে পঞ্চম জাতীয় সংসদে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠিত হয়।

আপনারা সবাই অবগত আছেন,  মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনের নেতৃত্বাধীন ১/১১-এর সরকার ১৯৯৬ সালে প্রণীত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সব ধারা ভূলুণ্ঠিত করে দুই বছর ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখে। পরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে আওয়ামী লীগ ১/১১-এর সরকারকে তাদের আন্দোলনের ফসল হিসেবে দায় মুক্তি দিয়েছিল। ওই সময় বিদেশিদের দৌড়ঝাঁপ ছিল চোখে পড়ার মতো। আওয়ামী লীগ সেটি নিয়ে নাখোশ ছিল না। কিন্তু এখন গণতন্ত্রের পক্ষে বিদেশিদের ইতিবাচক কোনো ভূমিকাকে তারা সহ্য করতে পারছে না। গত ২৩ আগস্ট ২০২৩-এ জোহানেসবার্গে ব্রিকস সম্মেলন চলাকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেছেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।

চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি অনুযায়ী, বৈঠকে চীনা প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ‘চীন বাংলাদেশের... বহিরাগত হস্তক্ষেপের বিরোধিতাকে সমর্থন করে; যাতে দেশটি অভ্যন্তরীণ ঐক্য ও স্থিতিশীলতা বজায় রেখে উন্নয়ন ও প্রাণসঞ্চার করতে পারে।’ এই বক্তব্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে চীনের একধরনের হস্তক্ষেপ কিনা সে বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারপ্রধানের কোনো মন্তব্য জানা যায়নি। আওয়ামী লীগের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীরা প্রতিনিয়ত অভিযোগ করে যাচ্ছে, বিএনপি বিদেশিদের কাছে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার জন্য ধরনা দিচ্ছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল সম্প্রতি ভারতের নয়াদিল্লি সফরে গেছেন। ফিরে এসে শনিবার (১৮ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ-ভারত সম্প্রীতি পরিষদের বিশেষ সাধারণ সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, ‘বাংলাদেশ- ভারতের সম্পর্কের ভিত্তি রক্তের। তাই দুটি দেশের সম্প্রীতি রক্ষা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং সবাইকে এ ব্যাপারে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।’ তার এই বক্তব্যই প্রমাণ করে বর্তমান সরকার দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বহিঃশক্তির অন্তর্ভুক্তি চায় না বলে যে দাবি করে, তা সঠিক নয় । বরং অনেকই মনে করেন, তারা দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে, বিশেষ করে নির্বাচনের প্রাক্কালে বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপ আমন্ত্রণ করে এসেছেন তাদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য।

এবার অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। স্বাধীনতার পর মোট ১১ বার জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায়, ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ থেকে শুরু করে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ছয়টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতিসংক্রান্ত নির্বাচন কমিশনের হিসাব নিয়ে তীব্র মতভিন্নতা নেই। প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ভোট পড়েছে ২৬.৫ শতাংশ, দ্বিতীয়টিতে পড়েছে ৫১.৩ শতাংশ, তৃতীয়টিতে পড়েছে ৬১.৩ শতাংশ, চতুর্থটিতে পড়েছে ৫২.৫ শতাংশ, পঞ্চমটিতে পড়েছে ৫৫.৪ শতাংশ, সপ্তমটিতে পড়েছে ৭৫.৪৯ শতাংশ। তাই দেখা যায়, ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে কমিশন প্রদত্ত হিসাব নিয়ে সন্দেহ শুরু হয়।

কিন্তু ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ভোটারবিহীন ও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন জনগণ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়। নির্বাচন কমিশন ২০১৪-তে ভোটার উপস্থিতি নথিভুক্ত করেছেন ৪০ শতাংশ । প্রকৃতপক্ষে কোনো কোনো স্থানে যা ছিল ১০ শতাংশেরও কম। দেশবাসী জানেন, ২০১৪ সালে নির্বাচনে ১৫৩ জন প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিল যা ছিল বিশ্ব রেকর্ড। একাদশ সংসদ নির্বাচনের কত শতাংশ ভোট পড়েছে তা আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা হয়নি। তবে, পরে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে বলে দাবি করা হয়েছে (গোলাম সামদানী, ‘কেমন ছিল দেশের ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন’, সারাবাংলা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৮)। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত চারটি নির্বাচন হয়েছে। উল্লিখিত পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতিবারই ভোটাররা ক্ষমতাসীনদের হটিয়ে বিরোধীদলকে ক্ষমতায় বসিয়েছেন। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়ায় ভোটাররা তাদের মতামত ব্যক্ত করতে পেরেছেন। কিন্তু ২০০৮ সালে পর এই শক্তি কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকার জুন ৩০, ২০১১ সালে ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে সংযোজিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। দেশ কার্যত একদলীয় ব্যবস্থায় আবারও ফিরে যায়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত স্থানীয় কিংবা জাতীয় কোনো নির্বাচনই বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না। বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বচ্ছতা, অংশগ্রহণমূলক এবং প্রতিযোগিতার মানদণ্ডে এসব নির্বাচন কোনো পর্যায়েই পড়ে না। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কতটা নিকৃষ্ট হতে পারে ২০১৪-এর ভোটারবিহীন জাতীয় সংসদ নির্বাচন এক্ষেত্রে একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। জাতির জন্য আরেকটি কলঙ্ক তিলক হয়ে থাকবে ২০১৮-এর নির্বাচন। ভোটের আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভরে রাখা এবং প্রশাসনের সর্বস্তরের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে ভোটারবিহীন একটি নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার অভিযোগে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছিল (১৫ জানুয়ারি ২০১৯, প্রথম আলো )।

সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজনসহ নানা সংস্থার কর্মরত বুদ্ধিজীবী ও গবেষকরাও প্রায় অভিন্ন অভিযোগ করেছিল। অভিযোগের দীর্ঘতালিকা এখনো বিভিন্ন গণমাধ্যম সংরক্ষিত আছে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেক বিদেশি বিশেষজ্ঞ ও পর্যবেক্ষক ওই নির্বাচনকে বিশ্বে ‘সবচেয়ে ব্যর্থ’ নির্বাচন বলে অভিহিত করেছেন (M. Solimullah Khan, Bangladesh : Who Vote? How do they Vote? , Dhaka, AHDPH, 2018)। নৈর্বাচনিক অবস্থার এরূপ বেহাল প্রেক্ষাপটে বিশেষজ্ঞরা একে ‘Illiberal democracy’, ‘Imperiled democracy’ ইত্যাদি নামে অভিহিত করেছেন ।

বাংলাদেশের গত এক যুগের বেশি সময় ধরে যে তথাকথিত ‘নির্বাচন’ ও ‘গণতন্ত্রের’ চর্চা হচ্ছে তা ব্যাখ্যা করার জন্য এই পরিভাষাগুলো যথার্থ বলে প্রতীয়মান হয়। এ সরকারের আমলে দেশে নির্বাচন ব্যবস্থা কেবল ধ্বংসই হয়নি এ ব্যবস্থাকে নিয়ে করা হচ্ছে রঙ্গ-তামাশা। সাধারণ ভোটারদের মনে তাই নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে একটা আশঙ্কা কাজ করছে। নির্বাচন কমিশনও পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে গেছে। এর মধ্যে অন্যতম কারণগুলোর একটি হলো দলীয় সরকারে অধীনে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা। এ বিষয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী একসময় বলেছিলেন ‘রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকলে নির্বাচন কমিশন যত শক্তিশালী হোক না কেন তাতে নির্বাচন নিরপেক্ষ হতে পারে না’ (দৈনিক ইত্তেফাক ১৬ জুন ১৯৯৪)। অথচ তার বর্তমান অবস্থান কী, তা কারও অজানা নয়।

এ প্রসঙ্গে যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট-ইআইইউ’র এবং সুইডেনের গোথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যারাইটিজ অব ডেমোক্রেসির-ভি-ডেম ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা যায়। ইআইইউর মাপকাঠিতে বাংলাদেশ একটি ‘হাইব্রিড’ শাসনব্যবস্থার দেশ। ‘হাইব্রিড’ শাসনব্যবস্থার দেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়, দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার লাভ করে ও আইনের শাসন দুর্বল হয়। ভি-ডেম ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতীয়মান হয় বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিকাশে উদার ধারার ব্যাপক অবনতি হয়েছে।

১৭৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৭ (স্কোর .১১) (দেখুন, Democracy Report 2023 : Defiance in the Face of Autocratization)। এর অর্থ হলো এ দেশে গণতন্ত্র অপস্রিয়মাণ। এ প্রসঙ্গে আরও বিভিন্ন নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করা যায়। জার্মান প্রতিষ্ঠান ‘বেরটেলসম্যান স্টিফটুং’ বিশ্বের ১২৯টি দেশের ওপর সমীক্ষা চালায়। ২০১৮ সালের ২৩ মার্চ প্রকাশিত রিপোর্টে প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশকে একনায়কতান্ত্রিক দেশ বলে তুলে ধরে। নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ—এইচআরডব্লিউ অনেক আগেই বিবৃতি দিয়ে বলেছে, বাংলাদেশ সরকার আরও কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠছে। বিশেষ করে ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশ অধিকতর স্বৈরশাসনের পথে এগোচ্ছে। গত বছর ৩০-৩১ জুলাই জেনেভায় জাতিসংঘের ‘নির্যাতনবিরোধী কমিটি’ [Committee Against Torture (CAT)-র] ৬৭তম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বলা হয়েছিল, গুম, রিমান্ড, বিচারহীনতা, ধর্ষণ, ভোটারদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা, নির্বাচনী সহিংসতা, তথ্যপ্রযুক্তি আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো আরও অনেক বিষয়ে তীব্র প্রশ্নবাণের মুখে পড়তে হয়েছিল বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের সদস্যদের। এমন জবাবদিহির মুখে উত্তর দিতে গিয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের সদস্যরা রীতিমতো খেই হারিয়ে ফেলেছিলেন।

কর্তৃত্ববাদে ব্যক্তি হয়ে ওঠে রাষ্ট্রের সমার্থক। প্রসঙ্গত বলা যায়, ফরাসি সম্রাট চতুর্দশ লুই ( ১৬৪৩-১৭১৫) সদম্ভে ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমিই রাষ্ট্র। গণতন্ত্রের নামে এখন বাংলাদেশের যা চলছে তা চতুর্দশ লুই-এর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। হার্বার্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্টিফেন ওয়াল্টের ব্যাখ্যা অনুযায়ী কর্তৃত্ববাদী শাসনের দশটি লক্ষণ রয়েছে। লক্ষণগুলো হচ্ছে —   ভীতি অথবা উৎকোচের মাধ্যমে তথ্য ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ; তাঁবেদার তথ্যব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা; প্রশাসন ও নিরাপত্তাব্যবস্থার দলীয়করণ; নিজ স্বার্থে নির্বাচনী ব্যবস্থায় জালিয়াতি; বিরোধী রাজনীতিকদের ওপর নজরদারির জন্য গোয়েন্দা সংস্থার ব্যবহার; অনুগত ব্যবসায়ীদের পুরস্কার, আবাধ্য ব্যবসায়ীদের শাস্তি; বিচারব্যবস্থা হাতের মুঠোয় নিয়ে আসা; শুধু একপক্ষের ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ; ভীতি ও আতঙ্ক ছড়ানো; বিরোধী রাজনীতিকদের সম্পর্কে মিথ্যা প্রচার। স্টেফান ওয়াল্ট কর্তৃত্ববাদী শাসনের যে রূপরেখা তুলে ধরেছেন, তার সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান শাসন মিলে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ‘আগে উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র’ এমন একটি প্রচারণা সামনে নিয়ে আসা হয়েছে । রাজনৈতিক স্বার্থে গণতন্ত্রকে উন্নয়নের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খান ‘মৌলিক গণতন্ত্রের কথা বলেছিলেন। আর বর্তমান সরকার বলছে ‘উন্নয়নের গণতন্ত্র’। এভাবে গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা হারিয়ে যায়। বাংলাদেশে তাই হয়েছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান কিংবা আন্তর্জাতিক মিডিয়ার পর্যবেক্ষণ-মতামতের পাশাপাশি দেশের মানুষের অভিজ্ঞতাটা কম কষ্টকর নয়। রাষ্ট্রায়ত্ত ২৬টি পাটকল বন্ধের নির্মম সিদ্ধান্ত কেবল ২৫ হাজার শ্রমিকের জন্যই নয়, পাটশিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে যুক্ত লাখ লাখ মানুষের জন্য চরম হুমকিস্বরূপ। করোনা-মহামারিতে একের পর এক স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির কাহিনি উঠে আসছে। করোনার মধ্যে গার্মেন্টস-এ শ্রমিক ছাঁটাই অব্যাহত ছিল। কর্তৃত্ববাদী শাসনের অন্যতম আর একটি অনুষঙ্গ হলো লুটপাট। বাংলাদেশ যেন লুটেরাদের স্বর্গরাজ্য। প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি—জিএফআই-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে গড়ে পাচার হয়ে যাচ্ছে প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা।

খেলাফি ঋণ ইত্যাদিও এ ক্ষেত্রে অতি প্রাসঙ্গিক। ক্যাসিনা সম্রাট থেকে পাপিয়া, ট্রাংক আর সিন্ধুকে থরে থরে সাজানো টাকা, এসব বিষয় মানুষ ভোলেনি, ভুলার নয়। সরকারের সমালোচনা করায়, করোনা-মহামারির সময় থেকে শুরু করে অদ্যাবধি বেশ কয়েকজন শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, অ্যাকটিভিস্টকে বাড়ি থেকে তুলে এনে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা ঠুকে দেওয়া হয়েছে। তাদের জামিন দেওয়া হচ্ছে না। সাংবাদিক, লেখকরা ‘সেল্ফ-সেন্সরশিপে’ বাধ্য হচ্ছেন। আইনজ্ঞদের মতে, এই আইনের প্রায় সব ধারা ও উপধারা নাগরিকের মতপ্রকাশের সুরক্ষা ও স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার ও অন্যান্য নাগরিক অধিকারকে সীমিত ও ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষুণ্ণ এবং নাগরিকের জনবান্ধব কর্মকাণ্ডকে অপরাধীকরণ করেছে। আইন প্রণয়নের সময় নাগরিক সমাজের যথাযথ অংশগ্রহণ এবং মতামত প্রদানের পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকার কারণে আইনটি সুরক্ষা প্রদানের পরিবর্তে কেবল নিয়ন্ত্রণমুখী নিপীড়নমূলক চেহারা ধারণ করেছে এবং এই আইনের মাধ্যমে মামলা করার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে যেমন দমন করা হচ্ছে তেমনি যে কোনো প্রকারের বিরুদ্ধ মতকে দমন করতে ভূমিকা পালন করছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরার জামিন না হওয়া এবং ৩৬৫ দিন অতিবাহিত হওয়াই এর প্রমাণ।

তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান ‘রিউমার স্ক্যানার’ তাদের ফেসবুক পেজে লিখেছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ৫০ লাখ টাকা চিকিৎসা সহায়তা নিয়ে মির্জা ফখরুলের বিদেশ ভ্রমণ দাবিতে ভাইরাল চেকটি ভুয়া।’ অথচ ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের চরিত্র হননকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করলেও ‘সরকারের সমালোচনাকারীদের খুঁজে বের করে কারাগারে আবদ্ধ রেখে জুলুম নির্যাতন করা হচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নাম বদলে সাইবার সিকিউরিটি আইন করতে যাচ্ছে সরকার। কারাভোগ-এর পাশাপাশি অর্থদণ্ড যুক্ত হওয়া ছাড়া সাইবার সিকিউরিটি আইনের সঙ্গে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের মধ্যে কার্যত মৌলিক তেমন কোনো পার্থক্য নেই। মোটকথা কর্তৃত্ববাদী সরকারের ইচ্ছামাফিক চলছে সবকিছু। শৃঙ্খলা রক্ষার নামে পুলিশি নির্যাতন ও বিচারের নামে ফরমায়েসি রায়ের শিকার শিক্ষার্থী খাদিজা থেকে শুরু করে বিএনপির মহাসচিব, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, ও চেয়ারপারসন পর্যন্ত সবাই। এই সরকার টিকে থাকলে ক্রমেই তা আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। এমন দিন আসবে যে নিজ দলের সাধারণ কর্মী সমর্থকরাও জুলুম নির্যাতন থেকে রেহাই পাবেন না।

বাংলাদেশে দলীয় সরকারের নির্বাচন এখন শুধু প্রহসনই নয়, এক আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। এই আতঙ্ক এখন সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচনও আতঙ্কমুক্ত নয়। সর্বশেষ সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির ভোট গ্রহণ বন্ধ এবং বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের বের করে দিয়ে পুলিশ সাংবাদিকদের মারধর করা দেশে আতঙ্কজনক পরিস্থিতি তৈরি করছে। সরকারের সমর্থন ছাড়া কেউ একটি সংগঠনের কোনো পদে জয়ী হবেন, এমনটি ভাবতে পারবেন না। এটা স্পষ্ট হয়েছে, কর্তৃত্ববাদের নিপীড়নে গণতন্ত্র বিপন্ন হয়; এর ফলে দুর্যোগ নেমে আসে অর্থনীতি, রাজনীতি থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বস্তরে।

পৃথিবীতে এমন একটি দেশ দেখানো যাবে না, যেখানে গণতন্ত্র আছে, অথচ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নেই। অথচ বর্তমান ক্ষমতাসীনরা ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ বাংলাদেশে সেই নির্বাচনকেই নির্বাসনে পাঠানোর সমস্ত আয়োজন করেছেন। বর্তমান সরকারের ‘আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র’ একটি ভ্রান্তনীতি। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান সরকার উন্নয়নের নামে বাণিজ্যিক শর্তে স্বল্পমেয়াদে গৃহীত ঋণের অর্থ যে মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করছে, তাতে করে শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান এর অনুরূপ বাংলাদেশও ঋণ ফাঁদে জড়িয়ে গেছে এবং বাংলাদেশের জনতা বছরের পর বছর এই ঋণ পরিশোধ করতে বাধ্য হবে। অদূর ভবিষ্যতে পাহাড়সম এই ঋণ পরিশোধের ভয়াবহ চাপ দেশকে চরম আর্থিক দুরবস্থা ও দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দেবে। ‘আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র’ বিষয়ে বর্তমান সরকার যে বক্তব্য দিচ্ছে তা নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের বক্তব্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অমর্ত্য সেন মনে করেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পেছনে উন্মুক্ত বাজার ব্যবস্থা ভূমিকা রাখছে। তিনি বলেন, যে দেশে গণতন্ত্র নেই সেটাতে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা বেড়ে যায়। তার ওই বক্তব্যের প্রমাণ পাওয়া যায় নিম্নবর্ণিত উদাহরণগুলো থেকে যেমন —  চীনে ১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ সালে সবচেয়ে বড় দুর্ভিক্ষ ঘটে; ইউক্রেনে ১৯৩০ সালে, কম্বোডিয়ায় ১৯৭০ সালে এবং বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে। তিনি বলেন, উন্নয়ন আসে গণতন্ত্রায়নের মাধ্যমে। আফ্রিকার বাতসোয়ানা রাষ্ট্রের উদাহরণ এ ক্ষেত্রে উপস্থাপন করা যায়। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল এ রাষ্ট্রটি গণতন্ত্রের মাধ্যমে উন্নতি লাভ করেছে।

সার্বিকভাবে বলা যায়, জনগণের জানমালের নিরাপত্তাহীনতা, নিপীড়ন, নির্যাতন ও সর্বস্তরে ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থতার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে, দেশ বর্তমানে এক অগণতান্ত্রিক সরকারের কাছে জিম্মি। দলনিরপেক্ষ অস্থায়ী সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনগণের সরকার ব্যবস্থা কায়েম করা এখন গণদাবি। সংবিধানের দোহাই দিয়ে সরকার এই দাবি মানছে না, যা অযৌক্তিক এবং ‘আইনের’ প্রকৃত (নৈতিক) চেতনা পরিপন্থি। কারণ জনগণের প্রয়োজনে ১৭ বার সংবিধান সংশোধিত হতে পারলে গণতন্ত্র ও স্বচ্ছ নির্বাচনের স্বার্থে আরেকবার সংবিধান সংশোধন করতে অসুবিধা কোথায়? ১৯৯৬ সালের জানুয়ারি মাসে তৎকালীন বিএনপি সরকার যখন সাধারণ নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, বিরোধীদল আওয়ামী লীগ (জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টিকে সঙ্গে নিয়ে) তখন রাস্তায় তুমুল আন্দোলন চালিয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করেছে লাগাতার হরতাল, অবরোধ, হামলা এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দেশ বিপর্যস্ত করার মাধ্যমে। তাহলে বিএনপি ও এর জোট সঙ্গীদের অহিংস আন্দোলনের এই দাবি কেন মানছে না তারা।

আওয়ামী লীগের স্ববিরোধী আচরণ আজ জনগণের নিকট পরিষ্কার হয়ে গেছে। জনগণের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বর্তমানে সরকার। ২০১১ সালে মে মাসে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করে বলেছিল, পরবর্তী দুটি জাতীয় নির্বাচন ওই ব্যবস্থার অধীনে হতে পারে। যেহেতু দলীয় (আওয়ামী লীগ) সরকারের অধীনে গত দুই নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসে নিকৃষ্টতম হিসেবে বিশ্বব্যাপী ধিক্কৃত হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের সেই পরামর্শ অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারে অধীনে আরও দুটি নির্বাচন আয়োজনে বিষয়ে বর্তমান সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করাতে পারে। সরকার পরিবর্তনের দুটো পথ খোলা রয়েছে — একটি হচ্ছে নির্বাচনের মাধ্যমে, আরেকটা হচ্ছে রাজপথে। এ ব্যাপারে প্রথম বিকল্পের বিষয়ে একটি মতানৈক্যে পৌঁছানো না গেলে ফয়সালাটি হবে রাজপথে, যা সব পক্ষের জন্যই ক্ষতিকর। তাই সরকারের উচিত সংকট সমাধানের জন্য রাজপথের বিপরীতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ বেছে নেওয়া। যদি রাজপথ বেছে নেওয়া হয় তাহলে জনগণের জানমালের ক্ষতির দায়ভার সরকারকেই বহন করতে হবে। এতে শুধু সরকার ক্ষমতাচ্যুত হবে তা নয়, বরং দল হিসেবেও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

যদি সরকার শান্তির পথ পরিহার করে তাহলে জনসম্পৃক্ত দল হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। অবাধ ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনের দাবির জন্য যে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে তা অব্যাহত রাখা। ’৬৯-এ আসাদ প্রাণ দিয়েছিলেন, সেই প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি।

’৯০-এ ড. মিলন, জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দিপালী সাহা ও জেহাদ প্রাণ দিয়েছেন। আমরা স্বৈরাচারমুক্ত হয়েছি। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ঘোষিত গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে ইতোমধ্যেই আলিম, জিকু, নূরে আলম, মকবুল, শাজাহান, আরেফিন ও নয়ন মিয়াসহ ২০টি তরুণ দেশপ্রেমিক শহিদ হয়েছেন। নিশ্চয়ই এই শহিদের রক্তও বৃথা যাবে না। তাই বর্তমান কর্তৃত্ববাদী সরকারকে দ্রুত বিদায় করার লক্ষ্যে সর্বস্তরের জনগণকে সম্পৃক্ত করে আপসহীন গণতন্ত্র ও জনমুক্তির একদফার এই সংগ্রাম অব্যাহত রাখাই হোক বিএনপির ৪৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অঙ্গীকার।

লেখক অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। সাধারণ সম্পাদক, জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।