Search

Tuesday, December 19, 2023

মাহবুব মানিক ও বিএনপির হাজারো সাধারণ কর্মীর ত্যাগের স্মরণেঃ "সব মরণ নয় সমান"

— ড. সাইমুম পারভেজ





শেষ যখন মানিকের সাথে কথা হয়েছিলো তখন সে জেল থেকে কেবল বের হয়েছে। হঠাৎ করেই ফোন দিয়ে স্বভাবসুলভ জোরালো গলায় কিছুটা হাসি নিয়েই জেলজীবনের কথা বলছিলো। 

আমি জিজ্ঞেস করলাম, জেল এ কি খুব কষ্ট হয়েছিলো মানিক ভাই?
আমার প্রশ্নে মানিক কিছুটা থমকে গেলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, "ভাই, খুব খারাপ অবস্থায় ছিলাম। জেলে যতজন থাকার কথা তার চেয়েও অনেক মানুষ গাদাগাদি করে রাখা। ঘুমাতে তো দূরের কথা, শুতেও পারি নাই ঠিকমতো। বেশীর ভাগই আমাদের মত বিএনপির নেতা-কর্মী। চোর-ডাকাতদের সাথেই ছিলাম। এ সরকার তো আমাদের চোর-ডাকাত বানিয়ে দিলো ভাই। বিএনপি করা কি এখন অপরাধ?"

মানিকের এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আলোচনা করার আগে জেনে নেই মানিক কে। মাহবুব মানিক চল্লিশোর্ধ এক যুবক। বাংলাদেশের প্রধান বিরোধীদল বিএনপির মিডিয়া সেলের ডিজিটাল মিডিয়ার কাজগুলোর দেখভালের দায়িত্ব ছিলো মানিকের। বড় কোন রাজনৈতিক নেতা না, নিতান্তই নিরলস নিভৃতে কাজ করে যাওয়া এক কর্মী। 

গত ২৮ অক্টোবর ২০২৩ থেকে বিরোধী দল ও মতের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের পেটোয়া বাহিনী যে নিপীড়ন চালাচ্ছে তারই অংশ হিসেবে মাহবুব মানিককে গ্রেফতার করা হয় বিএনপি চেয়ারপার্সনের অফিসের সামনে থেকে। কারাবাস শেষে মানিক বের হয় ১৯ নভেম্বর। ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ সকালে মানিক মারা যায়।

সুস্থ-সবল যুবক মানিকের মৃত্যু কি স্বাভাবিক? আরো হাজারো বিরোধী মতের নেতা-কর্মীদের মত মানিক কি কারা হেফাজতে অথবা রিমান্ডে নির্যাতিত হয়েছিল? শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের চাপের কারণেই কি মানিকের মৃত্যু হলো? এসব প্রশ্নের উত্তর হয়তো একসময় জানা যাবে, বা কিছু প্রশ্ন অজানাই থেকে যাবে। 

কিন্তু যেসব প্রশ্নের উত্তর আমরা পাচ্ছি তা খুবই আশঙ্কাজনক ও হৃদয়বিদারক। গত জুলাই ২৮, ২০২৩ থেকে ডিসেম্বর ১৬, ২০২৩ পর্যন্ত মানিকের মত ২৪,৭৩৬ জন বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীকে শুধু বর্তমান সরকার বিরোধী হবার কারণে গ্রেফতার করা হয়েছে, ১০২৩টি মামলা দায়ের করা হয়েছে, ৯১,৬৩৭ জনকে এসব মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে, ৯০৫৯ জন আহত হয়েছেন, আর হত্যা করা হয়েছে কমপক্ষে ২২ জনকে।

কিন্তু এই তালিকা কেবল সংবাদপত্রে ও বিএনপির দলীয় সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আরো অসংখ্য মানুষকে গ্রেফতার, নির্যাতন, ও হয়রানি করা হয়েছে, যার সব তথ্য পাওয়া যায়নি। বিরোধী রাজনৈতিক দলের ও মতের সমর্থক ও নেতা-কর্মীদের গ্রেফতারের সংখ্যাটি এত বেশী যে তা বাংলাদেশের কারাগারের ধারণক্ষমতার অনেক বাইরে চলে গেছে। সৃষ্টি হয়েছে মানবেতর পরিস্থিতি।

আমাদের দেশের বিক্রি হয়ে যাওয়া সুশীল সমাজ, সবকিছু এড়িয়ে চলে নিজের লাইফস্টাইল ঠিক রাখতে চাওয়া মধ্যবিত্ত, আর সরকারী দলের অনুগত বুদ্ধিজীবিরা বলার চেষ্টা করেন যে গণতন্ত্র পুণরুদ্ধারের এই চলমান আন্দোলন কেবল বিএনপি বনাম আওয়ামী লীগের ক্ষমতা দখলের লড়াই। 

তারা গণতন্ত্র ও ভোটাধিকারকে ত্যাগ করে দৃশ্যমান কিন্তু সারবত্তাহীন উন্নয়নকে বেছে নেন। আওয়ামী লীগ সরকার ও এর সুবিধাভোগী কিছু মানুষ ছাড়া এই "উন্নয়ন" বাকি সবাইকে দিনের পর দিন গরীব করে তুলেছে।  সাধারণ মানুষ, যাদের দৈনন্দিন জীবনে লুটপাট ও অর্থনৈতিক সংকটের ছাপ পড়েছে, তারা এই কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের জন্য সবচেয়ে বেশী জোরালো আওয়াজ তুলেছে।

ধরা যাক শাওন আহমদের কথা। পেশায় একজন শ্রমিক শাওন সেপ্টেম্বর ২০২২ এ বিএনপির প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দেয়ার কারণে পুলিশের গুলিতে মারা যান। জুলাই ২০২২ এর হত্যা করা হয় আবদুর রহিম নামে এক কৃষককে। একই বছরের সেপ্টেম্বর এ শহিদুল আলম নামের একজন রিকশাচালক ও নভেম্বরে নয়ন মিয়া নামে একজন শ্রমিককে হত্যা করা হয়। ২৮ অক্টোবর ২০২৩ এর পর থেকে পুলিশ ও সরকারী দলের পেটোয়া বাহিনীর হাতে যারা মারা যান, যেমন শামিম মোল্লা, আব্দুর রশীদ, জাকির হোসেন, তারাও সাধারণ নেতা-কর্মী।

ফিরে যাই মৃত্যুর আগে মাহবুব মানিক আমাকে শেষ যে প্রশ্ন করেছিলো সে প্রসঙ্গে। বিরোধী দলের রাজনীতি করা কি অপরাধ? মানিক, শাওন, রহিম, শামিমের মত হাজারো নেতা-কর্মী নির্যাতিত হয়ে, প্রাণ দিয়ে, বারবার কারাগারে গিয়ে এই প্রশ্নের উত্তর নিজেরাই দিয়ে গেছেন। দিয়ে যাচ্ছেন। 

তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা আমাদের বারবার এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে যে, আমরা এমন একটি দেশ তৈরি করেছি, এমন একটি সরকারকে বৈধতা দিচ্ছি, এমন একটি নিপীড়নমূলক রাজনৈতিক দলকে শাসনক্ষমতায় অবৈধভাবে জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া থাকতে দিচ্ছি, যারা মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে, রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ডে জড়িত থাকার সার্বজনীন অধিকারকে 'ক্রিমিনালাইজড' করে ফেলেছে।

যে প্রশ্নের উত্তর এই দেশের সাধারণ জনগণ জানে, বুঝতে পারে, এবং নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য রাজপথে সংগ্রাম করে, তা কি বিক্রি হয়ে যাওয়া "শিক্ষিত শ্রেণী" বুঝে? এই প্রশ্নই এখন প্রাসঙ্গিক। 

বাংলাদেশের কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী লীগ সরকার আরেকটি প্রহসনমূলক নির্বাচনের আয়োজন করেছে ৭ জানুয়ারি ২০২৪। এই প্রহসনের নির্বাচনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকামী জনগণের আন্দোলন চলছে। নির্বাচনের আগে ও পরে এই আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি কেমন হবে তা ভবিষ্যতই ঠিক করবে। 

কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, ইতিহাসের কোন বাঁকে, কোন দেশেই ফ্যাসিস্ট সরকারকে কে সরিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সহজ হয়নি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও অনেক প্রাণ, রক্ত, আর সংগ্রামের বিনিময়ে একদিন ভোটের অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, জীবন ও জবানের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে। 

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এই শ্বাপদ-সংকুল যাত্রা যাদের প্রাণের বিনিময়ে, যাদের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পাড়ি দিবো তাদের আমরা যেন ভুলে না যাই। পুলিশের গুলিতে মারা যাবার আগে শাওন তার ফেসবুকে লিখেছিলেন, "কর্মীর চেয়ে বড় কোন পদ নাই।"

ইতিহাস সবসময় রাজা-রাজড়াদের আরো মহান করে তুলে। শাওন ও মানিকের মত হাজারো সাধারণ মানুষের জীবন হারিয়ে যায়, থাকলেও চলে যায় ইতিহাসের ফুটনোটে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এসব "সাধারণ" কে আমরা যেন অসাধারণ করে তুলতে পারি।
মাহবুব মানিক মজা করে বলতো, "বিয়ে করবো গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে, হাসিনা সরকারের পতন হলে।"

মানিকের সে স্বপ্ন পূরণ হয় নি। কিন্তু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এই আকুতি মানিক রেখে গেছে হাজারো প্রাণের মাঝে। 

মাহবুব মানিক এখন বাংলাদেশের হাজারো মায়ের "সোনা-মানিক"দের কাতারে শামিল, যাদের ত্যাগ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে অটুট রেখেছে।  

লেখক: ড. সাইমুম পারভেজ 
ব্রাসেলসভিত্তিক রাজনীতিবিজ্ঞান বিষয়ক গবেষক

No comments:

Post a Comment