Search

Thursday, December 31, 2020

জানুয়ারি ৫, ও ডিসেম্বর ৩০ — বাকশাল দিবসের মতো আরো দুইটি কলঙ্কিত দিবস

—  ড. জাহিদ দেওয়ান শামীম 

বাংলাদেশের ইতিহাসে জানুয়ারি ৫, ও ডিসেম্বর ৩০, বাকশাল দিবসের মতো আরো দুইটি কলঙ্কিত দিবস, শুধু  পিতা থেকে কন্যা। 

বাংলাদেশের ডিসেম্বর ৩০, ২০১৮, নির্বাচন হল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গার পর পৃথিবীর গণতান্ত্রিক ইতিহাসের নিকৃষ্টতম নির্বাচন।  বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন ও এর ফলাফল নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বিশ্লেষণ ও মতামতধর্মী নিবন্ধে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে বিপুল ব্যবধানে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন শাসকদল জয়লাভ করেছে। বিজয়ী ও বিজিত দলের মধ্যে পার্থক্যসূচক এমন চিত্র উত্তর কোরিয়ার মতো দেশে আশা করা যায়, বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক দেশে নয়। এই নির্বাচনের পর বাংলাদেশে শেখ হাসিনার ক্ষমতা দিন দিন আরও শক্তিশালী হয়ে দেশটির শাসনব্যবস্থা একদলীয় শাসনে পরিণত হতে চলেছে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এখন অস্পষ্ট। দেশটির তরুণ ও যুবসমাজ গণতন্ত্রের ওপর বিশ্বাস হারাতে বসেছে। জানুয়ারি ২৫ —  বাকশাল দিবসের মতই জানুয়ারি ৫ এবং ডিসেম্বর ৩০ আরো দুইটি কালো দিবস যোগ হয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাসে। মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে দেশের মানুষের সাথে চরম পরিহাস করা হয়েছে।  

ডিসেম্বর ৩০, ২০১৮, ঢাকা-৪ আসনের বিএনপি মনোনীত ধানের শীষের
প্রার্থী সালাহউদ্দিন আহমেদ আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলায় রক্তাক্ত হন।  

২০১৪ সালের একতরফা একদলীয় নির্বাচনের পর থেকে কয়েক বছর যাবৎ যে ভোটডাকাতির নির্বাচনী সংস্কৃতি চলছে তার কারণে মানুষের ভোট প্রদানের উৎসাহ কমে গেছে। ডিসেম্বর ৩০, ২০১৮, মিডনাইট ভোটডাকাতির জাতীয় নির্বাচনের পর ভোট কেন্দ্রে না যাওয়ার প্রবণতা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত স্থানীয় নির্বাচনেও এই চিত্র পাল্টায়নি। বিগত জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনগুলোর ধারাবাহিক দৃশ্যপট বজায় ছিল এইসব নির্বাচনেও। এবারের নির্বাচনে ভোটার নেই ও ভোট প্রদানের আগ্রহ নেই, কারচুপি ও অনিয়মের শেষ নেই, কারো কারো ক্ষেত্রে নিজের ভোট নিজে দেওয়ার উপায় নেই, প্রধান বিরোধী দলের প্রার্থীদের এজেন্ট নেই। দিনভর ছিল সহিংসতা। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, জোরপূর্বক নৌকা প্রতীকে ভোট, কেন্দ্র দখলসহ নানা অনিয়মের মাধ্যমে শেষ হয়েছে প্রথম ধাপের ২৪টি পৌরসভার নির্বাচন। এ ঘটনায় বিভিন্ন জায়গায় ভোট বর্জন করেছেন বিএনপি প্রার্থীরা। ভোট গ্রহণের আগেই আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয় অনেক পৌর এলাকায়। হুমকি-ধমকি ও আতঙ্কে ভোট দিতে যাননি অনেকে। এমনকি মেয়র প্রার্থীও আতঙ্কে মাঠ ছেড়েছেন। 

অনেক স্থানে ইভিএম মেশিন বিকল, আঙ্গুলের ছাপ না মেলার কারণে বিড়ম্বনার শিকার হন ভোটাররা। 

এদেশের মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো সুশাসন, সমঅধিকার ও শোষণ-বঞ্চনামুক্ত একটি গণতান্ত্রিক দেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। সাংবিধানিক ভাবে বহুদলীয় গণতন্ত্র স্বীকৃত একটি দেশ বাংলাদেশ। সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্র হবে একটি গণতন্ত্র। যেখানে মানুষের মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হবে এবং প্রশাসনের সবপর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। কিন্তু নির্বাচনে ভোটডাকাতি ও কারচুপি করতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তা সংবিধান লঙ্ঘন। তাছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনাসহ সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতিগ্রস্ত করা হয়েছে। গণমুখী অনুচ্ছেদগুলো শুধু সংবিধানেই লিপিবদ্ধ রয়েছে কিন্তু বাস্তবে এসবের প্রয়োগ নাই বললেই চলে। তাই গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পারদ দিন দিন নিম্নগামী। শাসকদলের ক্ষমতালিপ্সার কারনে দেশের আজ এই বেহাল অবস্থান এবং বহুমুখী ষড়যন্ত্রে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন। 

দেশের মালিক জনগণের পবিত্র ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার করতে জনগণকেই আবারো ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা নিয়ে আন্দোলন সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হবে। ফ্যাসিস্টদের পতন অনিবার্য। মজলুমের বিজয় সুনিশ্চিত। 

—  লেখক সিনিয়র সায়েন্টিস্ট, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, ইউএসএ। 

Wednesday, December 30, 2020

২০১৮ সালের ‘নির্বাচন’

— আলী রিয়াজ 


ডিসেম্বর ৩০, ২০১৮ এ অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রচারণার সময়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা বিএনপি'র প্রার্থী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনকে গুলি করে।  

একাদশ জাতীয় সংসদের ‘নির্বাচনের’ দ্বিতীয় বার্ষিকী উপলক্ষে ৩০ ডিসেম্বর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ পালন করবে এবং বিএনপি এই দিনটিকে বলছে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’। বাংলাদেশের গণতন্ত্র রক্ষা এবং হত্যা দিবস পালনের এই ঘটনা নতুন নয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত এক-দলীয় নির্বাচনের বার্ষিকীকেও এইভাবেই এই দুই দল চিহ্নিত করেছিলো। সম্ভবত ২০১৭ সালের পরে আর এইভাবে কোনও পক্ষই আর এই দিন নিয়ে উৎসাহ দেখায়নি। এর আগে ১৯৯১ সাল থেকে কয়েক বছর ৬ ডিসেম্বরকে ‘গণতন্ত্র দিবস’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছিলো – ১৯৯০ সালে গনআন্দোলনের মুখে জেনারেল এরশাদের সরকারের পতনের দিনটি এক সময় ঘটা করে পালিত হতো, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পরে মন্ত্রিসভা গঠন এবং ১৯৯৯ সালে বিরোধী জোট গঠনের পরে এই দিন পালনে উৎসাহেরই কেবল অবসান হয়েছে তা নয়, দিনটি রাজনীতিবিদদের জন্যে এক ধরণের অস্বস্তির দিন বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। ২০২০ সালে এসে এই দিন যে কোনও রকম ভাবেই পালিত হয়নি সেই বিষয় ডেইলী স্টার সম্পাদক মাহফুজ  আনাম স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন (মাহফুজ আনাম, “নীরবেই চলে গেল ‘গণতন্ত্র দিবস’”, ডেইলি স্টার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২০)।

এটি যতই বেদনাদায়ক বলে মনে হোক না কেন, একে এখন আর বিস্ময়কর মনে হয়না। কেননা বাংলাদেশে গণতন্ত্রের যে আকাঙ্ক্ষা ১৯৯০ সালে তৈরি হয়েছিলো গত তিন দশকে সেই আশাবাদ আকাঙ্ক্ষা এখন আর উপস্থিত নেই। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে সংবিধানের বদল ঘটেছে, নির্বাচন হয়েছে – কিন্ত গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলো গড়ে ওঠার প্রশ্ন পরে, যে অধিকারগুলো ছিলো সেগুলো টিকে থাকার সম্ভাবনারও অবসান হয়েছে। ১৯৯০-এর দশকে যা ছিলো প্রত্যাশা, তা ক্রমেই দূরে সরে গেছে। ১৯৯০-এর দশকে, বিশেষ করে ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার সূচনার পরে ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি শান্তিপূর্ণ পথ প্রতিষ্ঠার কারণে আশা ছিলো গণতন্ত্রের অন্যান্য উপাদান এবং প্রতিষ্ঠানের দিকে সম্ভবত মনোযোগ দেয়ার সুযোগ তৈরি হবে। মতপ্রকাশের অধিকারের আরও সম্প্রসারন ঘটবে, বিচার বিভাগ স্বাধীন হবে, জবাবদিহির কাঠামোগুলো গড়ে উঠবে। নির্বাচন জবাবদিহির একটি কাঠামো, একে বলা হয় উল্লম্ব কাঠামো। এর বাইরে আছে আনুভুমিক কাঠামো – এগুলো হচ্ছে সাংবিধানিকভাবে তৈরি কিন্ত স্বাধীন প্রতিষ্ঠান যারা ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহি করবে। সামাজিক জবাবদিহির ব্যবস্থা হচ্ছে সেই সব প্রতিষ্ঠান যেগুলো হচ্ছে সমাজের অন্যান্য অংশের প্রতিনিধিত্ব করে যারা রাজনৈতিক দল এবং রাষ্ট্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে উভয় পক্ষের জবাবদিহি দাবি করতে পারেন। কিন্ত জবাবদিহির এই ধরণের কাঠামোগুলো গড়ে ওঠেনি, সেগুলো গড়ে ওঠার আশাও ক্রমান্বয়ে তিরোহিত হয়েছে।

২০১৪ সালের এক-দলীয় নির্বাচনের পরে নাগরিকের অন্যান্য অধিকারের প্রশ্নকে পিছে ফেলে ভোটের অধিকারের মতো মৌলিক প্রশ্ন, যা গণতন্ত্রের একেবার অত্যাবশ্যকীয় বিষয়, সেই বিষয়েই নজর দিতে হচ্ছে। গণতন্ত্র এখন হয়ে উঠেছে ভোট দিতে পারা না পারার প্রশ্ন। একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, নির্বাচনই গণতন্ত্র নয়, কিন্ত সকলের অংশগ্রহণমূলক অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ছাড়া পৃথিবীর কোনও দেশে কখনোই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এই ধরণের পশ্চাৎযাত্রা শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচনকেই অকার্যকর এক আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত করেছে। অনেকের মনে থাকবে যে, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলেছিল যে সাংবিধানিক ধারবাহিকতা রক্ষার জন্যে এই নির্বাচন। কিন্ত তাতে করে সংবিধানের মর্মবস্তের সঙ্গেই এই নির্বাচন অসামঞ্জস্য পূর্ন হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, যেহেতু আর কোনও ধরণের জবাবদিহির কাঠামো বাস্তবে ছিলোনা সেহেতু ক্ষমতাসীনরা সব ধরণের জবাবদিহির কাঠামোর বাইরে চলে গেলেন। ফলে ইলেকটোরাল ডেমোক্রেসি বা নির্বাচনী গণতন্ত্রও থাকলো না।

ফলে ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিরোধী দল অংশগ্রহণ করা স্বত্বেও এটি আর ‘নির্বাচন’ হয়ে ওঠেনি। কিন্ত তার পরেও ২০১৮ সালের নির্বাচন ২০১৪ সালের নির্বাচন থেকে ভিন্ন। কেননা ২০১৮ সালের নির্বাচনের  মধ্যে যে কেবল নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়া হয়েছে তাই নয়, রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের বিভিন্ন অংশ (যেমন প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী), ক্ষমতাসীন দল, নির্বাচন কমিশন একাকার হয়ে গেছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আগের রাতে ভোট দেয়ার ব্যাপার কেবল ভোট জালিয়াতি বলে বিবেচনা করাই যথেষ্ট নয়। এটি হচ্ছে নতুন এক ধরণের রাষ্ট্রের ইঙ্গিত। এটি যদিও একটি রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় এনেছে এবং একটি কার্যত এক-দলীয় সংসদ তৈরি করেছে কিন্ত তার চেয়েও বড় হচ্ছে ২৯ ডিসেম্বর রাতে এমন এক ধরণের জোটের অভিষেক হয়েছে যা আগে কখনোই ছিলোনা। এই অভিষেক হঠাৎ করে হয়নি, ২০১৪ সালের পর থেকে তা ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে, এক ধরণের সমঝোতা বা বন্দোবস্ত তৈরি হয়েছে যা কোনও ধরণের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। এই বন্দোবস্ত টিকিয়ে রাখার স্বার্থ কেবল রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নয়, যারা এই বন্দোবস্তের অংশীদার তাঁদেরও। ২০১৮ সালের পরের এবং আগের বাংলাদেশের রাজনীতি ও শাসন ব্যবস্থার পার্থক্যটা সেখানেই। এই পার্থক্যের একটা বড় দিক হচ্ছে রাজনীতির অবসান, পুরো ব্যবস্থায় উপস্থিত একাদিক্রমে বল প্রয়োগের বৈধতা এবং আমলাতান্ত্রিকতা।          



— লেখক যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর। 

Friday, December 25, 2020

নির্বাচন কমিশন ‘মারাত্মক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ’ যা বিশ্বে বিরল

— শহীদুল্লাহ ফরায়জী

গাজীপুর সিটি নির্বাচনের কিছু কেন্দ্রে জাল ভোট দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে৷ শফিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাওয়া যায় সিল মারা এসব ব্যালট৷ 


কেএম নূরুল হুদার নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই বিভিন্নভাবে গুরুতর অসদাচরণে লিপ্ত হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে দেশের ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি দিয়েছেন। দেশে দলীয় অনুগত বুদ্ধিজীবীদের ‘বিস্ময়কর নীরবতা’ এবং ‘অবিশ্বাস্য তোষামোদ’-এর প্রতিযোগিতার মাঝেও নির্বাচন কমিশনের নৈতিক অধপতনের বিরুদ্ধে ৪২ জন নাগরিকের ‘রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার হুমকির ওপর সত্য উচ্চারণ’- দেশবাসীকে শুধু সাহসীই করবে না, তাদের এ অনন্য ভূমিকা দেশবাসীকে ভবিষ্যতের উজ্জ্বল সময়ের স্বপ্ন দেখতে শক্তি যোগান দেবে এবং জনগণের সংগ্রামী প্রতিভাকে উন্মোচিত ও শাণিত করবে।

রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদনে দুই ধরনের নয়টি অভিযোগ করা হয়েছে। একটি হচ্ছে আর্থিক অনিয়ম ও দ্বিতীয়টি হচ্ছে নির্বাচনী অনিয়ম। দুর্নীতি ও অর্থসংক্রান্ত তিনটি অভিযোগ হচ্ছে ১. বিশেষ বক্তা হিসেবে বক্তৃতা দেয়ার নামে দুই কোটি টাকা নেয়ার মতো আর্থিক অসদাচরণ ও অনিয়ম ২. নির্বাচন কমিশনের কর্মচারী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ৪ কোটি ৮ লাখ টাকার অসদাচরণ ও অনিয়ম ৩. নিয়ম বহির্ভূতভাবে তিনজন কমিশনারের তিনটি গাড়ি ব্যবহারজনিত আর্থিক অসদাচরণ ও অনিয়ম।

নির্বাচন সংক্রান্ত ৬ অভিযোগ - ১. ইভিএম কেনা ও ব্যবহারে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম ২. একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম ৩. ঢাকা (উত্তর ও দক্ষিণ) সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম ৪. খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম ৫. গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম এবং ৬. সিলেট বরিশাল রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনের গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম।

নির্বাচন কমিশনের ভূলুণ্ঠিত নৈতিকতা আর ভয়াবহ কদর্য অবস্থা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত রাষ্ট্রের জন্য লজ্জাজনক।

ভোটাধিকার প্রশ্নে নির্বাচন কমিশনের দায় ও দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি বিস্তৃত ও সুস্পষ্ট। নির্বাচন কমিশনের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের কাজ হচ্ছে - প্রজাতন্ত্রের জনগণের ভোটাধিকার রক্ষা করা ও ভোটাধিকারের সাংবিধানিক ক্ষমতার নিশ্চয়তা প্রদান করা। জনগণের ভোটাধিকার যখন বিপদগ্রস্ত হয়, ভোটাধিকার প্রশ্নে যখন অরাজকতা সৃষ্টি হয় তখন হস্তক্ষেপ করে ভোটাধিকারের সাংবিধানিক ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করে দেওয়াই নির্বাচন কমিশনের কর্তব্য।

সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য হচ্ছে - প্রজাতন্ত্রের সাংবিধানিক নির্দেশনাকে সুরক্ষা দেয়া, সরকারের আইন বহির্ভূত দুর্বিনীত ক্ষমতা প্রয়োগের প্রবণতা থেকে বিরত রাখা, সর্বোপরি জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করা।

সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের অবৈধ ক্ষমতা প্রয়োগের সহযোগী নয় বরং সাংবিধানিক কর্তৃত্ব প্রয়োগের উৎস। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সরকারের প্রতিবিম্ব নয় বরং রাষ্ট্রের প্রতিবিম্ব। গণমুখী ও গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের প্রয়োজনে সংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রের অতি প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ।

সরকারি দলকে আইন বহির্ভূতভাবে বৈধতা দেয়া বা সুবিধা বণ্টন করে দেয়া বা সমঝোতা বা মধ্যস্থতা করে দেয়ার কাজ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নয়।

রাতের আঁধারে নির্বাচন সম্পন্ন হলে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে পড়ে এবং  জনগণের কাছে রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে, যা রাষ্ট্রকে অকার্যকর করার পথে ধাবিত করে।

গণতন্ত্র হলো - বহুমুখী প্রক্রিয়া যা মানুষের চিন্তা ও কর্মের সমগ্র দিককে স্পর্শ করে, মনোজগতের মূল্যবোধকে প্রভাবিত করে। গণতন্ত্রের প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে মানুষ ক্রমাগত ব্যক্তিস্বার্থের বদলে সর্বজনীন মূল্যবোধের পানে এগিয়ে যায় এবং যোগ্যতা দিয়ে অর্জন করার প্রতিযোগিতায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। জনগণ ক্রমাগত নাগরিক কর্তব্য পালনে সচেষ্ট হয়। গণতন্ত্রবিহীন রাষ্ট্র সমাজের জন্য অভিশাপস্বরূপ। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সচল থাকলে সমাজে দুর্নীতি, শোষণ ও অসাম্যের মূল উৎস উচ্ছেদের সংগ্রামকে বেগবান করা যায়। গণতন্ত্রের মাধ্যমেই মানুষের আকাঙ্ক্ষাসমূহ সার্থক বিকাশ ও চরিতার্থতা লাভ করে।

আমাদের নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সংবিধানের ১১৮(৪) বলা হয়েছে “নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন কেবল এই সংবিধান ও আইনের অধীন হইবেন”।

কিন্তু আমাদের নির্বাচন কমিশন সংবিধান ও আইনের অধীন না থেকে সরকারের ইচ্ছার অধীন হয়েছেন। জনগণকে ভোট প্রদান থেকে বিরত থাকতে উৎসাহী ভূমিকা রেখেছেন।

নির্বাচন কমিশনের সৌজন্যে ভোট এখন আর জনগণের অধিকার নয়। নির্বাচন কমিশন ভোটারবিহীন নির্বাচনে যে নৈতিক সমর্থন যোগায় তাতে মনে হয় নির্বাচন কমিশন সরকারের রাজনৈতিক শাখার  ভূমিকায় অবতীর্ণ। নির্বাচন কমিশন ভোটাধিকার প্রশ্নে অভিভাবকত্বের ভূমিকা গ্রহণ করার কথা কিন্তু কার্যত সরকারের ক্ষমতা সংহত করার দায়-দায়িত্ব পালন করছে, যা রাষ্ট্রের জন্য ভয়ঙ্কর খারাপ ফলাফল বয়ে আনবে।

গত কয়েক বছরে নির্বাচন কমিশন সরকারি দলের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে দেয়ার ন্যক্কারজনক ভূমিকা পালন করে তার সাংবিধানিক কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। এখন সমাজে নির্বাচন কমিশনের উপযোগিতা একেবারে  ভোঁতা হয়ে গেছে। অন্যান্য দেশের নির্বাচন কমিশন জনগণের  ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য যখন অধিকতর ক্ষমতা সচেষ্ট তখন আমাদের নির্বাচন কমিশন সরকারের কাছে সাংবিধানিক ক্ষমতা হ্রাস করার প্রস্তাব পেশ করে।

আমাদের নির্বাচন কমিশন সংবিধান লঙ্ঘন, আর্থিক অনিয়ম ও অজ্ঞতায় ‘মারাত্মক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ’ যা বিশ্বে বিরল। কিছুদিন পূর্বে বাংলা ভাষা থেকে বিদেশি শব্দ বিদায় করার জন্য ভাষাবিজ্ঞানীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নাম ও পদ-পদবি পরিবর্তনের অনধিকার প্রস্তাব উত্থাপন করেছিল। যে নির্বাচন কমিশন তার  সাংবিধানিক এখতিয়ার সম্পর্কে অবগত নয়, সে প্রতিষ্ঠান অসদাচরণে অভিযুক্ত হবে না - তা কি করে আশা করা যায়!

একসময়ে ভোট মানে ছিল জনগণের উৎসব। ভোটে প্রতিফলিত হতো সমগ্র সমাজের প্রতিচ্ছবি। সেই বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন যখন বলেন - কে ভোট দিতে এলো কিংবা এলো না সেটা আমাদের দায়িত্ব নয়, তখন মনে হয় নির্বাচন কমিশন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের কোনো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নয়, মনে হয় দেশ বিরোধী কোনো অপশক্তির প্রতিষ্ঠান।

জাতীয় সংসদ থেকে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত যে কোনো নির্বাচনে জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের ন্যূনতম যে ব্যবস্থা পূর্বে ছিল তা বর্তমান কমিশন ধ্বংস করে কার্যত ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিয়েছে। এরপরও নির্বাচন কমিশন গর্ববোধ করে।

স্বৈরশাসক আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্র সম্পর্কে বলেছিলেন ‘এটি একটি সহজবোধ্য সাদামাটা ব্যবস্থা, যা নিয়ে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করা যায় সহজে তা বাস্তবায়ন যোগ্য’। আইয়ুব খানের যোগ্য উত্তরসূরি বর্তমান নির্বাচন কমিশনের কাছেও রাতের আঁধারে বা স্বল্প উপস্থিতিতে বা এক পক্ষের উপস্থিতিতে ভোটগ্রহণ ও গণনা করাও সহজবোধ্য সাদামাটা হয়, এ রকম তামাশাপূর্ণ কাজ করতেই নির্বাচন কমিশন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন এবং সহজে তা বাস্তবায়নযোগ্য করে তুলছেন।

আইয়ুব খান আরও বলেছিলেন মৌলিক গণতন্ত্রের মাধ্যমে সুদক্ষ ও কার্যকরভাবে নাগরিকদের অংশগ্রহণ পরিপূর্ণ ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব কিন্তু গণতন্ত্রের প্রশ্নে সর্বোপরি সর্বজনীন ভোটাধিকারের প্রশ্ন আমরা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই মীমাংসা করে ফেলেছি। সত্তরের নির্বাচনে জনগণের ভোটের অধিকারকে অমর্যাদা করার প্রতিবাদে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল এদেশের জনগণ, অগণিত আত্মদানের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রকে রাষ্ট্রপরিচালনার মূল ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

আমরা যদি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করতে না পারি তাহলে অতি দ্রুত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বপ্ন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। জনগণের অধিকারের স্বীকৃতি ছাড়া স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়বে। আমরা আইয়ুব খানের পুরনো রাজনৈতিক মডেল বুকের রক্ত দিয়ে ছুড়ে ফেলেছি ভোটারবিহীন নির্বাচন প্রতিষ্ঠা করার জন্য নয়।

সুতরাং ভোটারবিহীন রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে আমাদের অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন আমাদের জন্য জরুরি। এ পরিবর্তনের লক্ষ্য হবে বৃহত্তর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহণের পরিধি বৃদ্ধি করা। রাষ্ট্র পরিচালনায়  জনগণের অগ্রাধিকারই চূড়ান্ত।

জনগণের সম্মতিবিহীন রাজনৈতিক ব্যবস্থা জনগণকে ক্ষমতাহীন করে দেয়, রাষ্ট্রের ‘লক্ষ্য’ ও ‘উদ্দেশ্য’ থেকে জনগণকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

‘চুরি হয়ে যাওয়া’ নির্বাচনী ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার না হলে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নভিত্তিক বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা সম্ভব হবে না। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির অভাবে অধিকতর চরমপন্থার উদ্ভব ঘটবে, রাষ্ট্র এবং সমাজ অনৈতিক ও অমানবিকতা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হয়ে উঠবে এবং সহিংসতায় বিশ্বাসীদের উসকে দেবে। জনগণকে নির্দয় হতে বাধ্য করবে। সর্বক্ষেত্র হতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নির্বাসনে পাঠাবে।

সুতরাং গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে অভিযুক্ত নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ মোতাবেক সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে তাদের অপসারণ করা জরুরি।  নির্বাচন কমিশন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের পূর্বরাতে এবং ভোটের দিন সংঘটিত গুরুতর অনিয়ম ও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। এমনকি ২৩১ টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট প্রদানের মতো অলৌকিক ঘটনায়ও নির্বাচন কমিশন একটি তদন্তের প্রয়োজন বোধ করেনি। যে নির্বাচন কমিশন বিশ্বাস করে ভোটার তালিকায় নাম লিপিবদ্ধ হওয়ার পর ভোটারের আর মৃত্যু হতে পারে না। সেজন্য শতভাগ ভোট পড়ার পরেও তারা অবাক হননি বা কোনো অনিয়মের আভাষ পাননি। এই নির্বাচন কমিশন দিয়ে ভিনগ্রহের নির্বাচন সম্পন্ন হলেও হতে পারে কিন্তু বাংলাদেশের নয়। এটা তাঁরা দক্ষতার সঙ্গে প্রমাণ করতে পেরেছেন।

জনগণ এবং রাষ্ট্রের মাঝে কারও হস্তক্ষেপ অনভিপ্রেত। জনগণকে ক্ষমতার কাঁটাস্বরূপ মনে করা কোনো বিবেচনায়ই গ্রহণযোগ্য নয়। দেশটা স্বাধীন হয়েছে জনগণের রক্তে, কারো সাথে কোনো দেনদরবারে নয়।

নির্বাচন কমিশনের অপসারণ প্রক্রিয়া নিয়ে সংবিধানের ১১৮(৫) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক যেরূপ পদ্ধতি ও কারণে শত অপসারিত হতে পারেন, সেইরূপ পদ্ধতি ও কারণ ব্যতীত কোনো নির্বাচন কমিশনার অপসারিত হইবেন না। এজন্য সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ মোতাবেক সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে তাদের অপসারণ করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ও নৈতিক কর্তব্য।

বর্তমান নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘনসহ আর্থিক অনিয়ম এবং গুরুতর অসদাচরণের যে অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছে তা দ্রুত নিরসন হতে পারে যদি কমিশন সংবিধানের ১১৮(৬) মোতাবেক রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ করিয়া স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে পদত্যাগ করেন, যা হবে সবচেয়ে উত্তম বিকল্প।

কান্টের নীতি দর্শনের বলা হয়েছে মানুষের প্রকৃতি সুমহান; কেননা নৈতিকতা নামক মর্যাদার বস্তুকে নীতিরূপে গ্রহণ করতে মানুষের প্রকৃতি প্রস্তুত; অথচ কার্যক্ষেত্রে সেই নীতিবোধ অনুসরণ করতে সে দুর্বলতার পরিচয় দেয়, যে যুক্তিবৃত্তির কাজ হলো নৈতিক আইন দান করা, সেই যুক্তিকেই স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করা হয়।

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার দার্শনিক ভিত্তিকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা সম্ভব নয়।





— লেখক গীতিকার। তাঁর ইমেইল একাউন্ট faraizees@gmail.com। লেখাটি প্রথমে দৈনিক মানবজমিনে প্রকাশিত হয়েছে, https://bit.ly/2WPm7Nj । 

 


Thursday, December 24, 2020

মানব অধিকার কোথায়

— সায়ন্থ সাখাওয়াৎ 




আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের দ্বারপ্রান্তে। নিশ্চয়ই অনেক অর্জনের কথা শুনব, উৎসব করব। অর্জন যে নেই এমনও নয়। এই পঞ্চাশ বছরে আমাদের গর্ব করার মতো অনেক অর্জন আছে। পাশাপাশি আছে অনেক বঞ্চনাও। আবার অর্জনের বিনিময়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিসর্জনের উদাহরণও আছে।

এই বিজয়ের মাসেই ১০ ডিসেম্বর পালিত হলো বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। আমরা সরকারের পক্ষ থেকে অধিকার সুরক্ষার ফিরিস্তি শুনলাম। অন্যদিকে সরকারবিরোধী পক্ষ, মানবাধিকার সংস্থা ও কর্মী এবং মানবাধিকার হরণের শিকার ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের কাছে শুনলাম অধিকার হরণের লোমহর্ষক ও নির্মম কাহিনী। যে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের অধিকারের সুরক্ষা দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ, সে রাষ্ট্রই কীভাবে অধিকার হরণ করে সে কথাই উঠে এলো ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের কণ্ঠে। আসলে রাষ্ট্র তো নিজে কিছু করতে পারে না। রাষ্ট্র পরিচালকরা রাষ্ট্রের পক্ষে তার দায়িত্ব পালনের অঙ্গীকার করেন। কিন্তু বাংলাদেশে রাষ্ট্র পরিচালকরা করছেন সে অঙ্গীকারের উল্টোটা। তারা নাগরিকদের অধিকার রক্ষা করছেন না বা পারছেন না তো বটেই, উপরন্তু নিজেরাই অধিকার হরণে প্রবৃত্ত হচ্ছেন অহরহ। এ কথাই উঠে এসেছে বাংলাদেশ বিষয়ে দেশি-বিদেশি মানবাধিকার রিপোর্টগুলোতে।

সে বিষয়ে যাওয়ার আগে জেনে নেওয়া যাক, একটি সভ্য রাষ্ট্রে মোটাদাগে মানুষের অধিকারগুলো কী। সংবিধান, মানবাধিকার সনদসহ বহু কিতাবে অনেক ধরনের অধিকারের কথা বলা আছে। সে জটিল হিসাবের খাতা না খুলেও সহজ ভাষায় যেটুকু বলা যায় তা হলো, একজন নাগরিকের জান-মাল-সম্ভ্রমের নিরাপত্তা দেবে রাষ্ট্র। স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি দেবে। তার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। রাষ্ট্রীয় আইন মেনে সভা-সমাবেশ-সংগঠন করার অধিকার থাকবে। ভোট প্রয়োগের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচনের অধিকারও থাকবে। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার পাবে। এবার যদি আমরা একটু মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করি যে, এই অধিকারগুলো আমরা পাচ্ছি কি না এবং রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা আমাদের এই অধিকার হরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত কি না, তাহলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে সরকার ঠিক পথে আছে কি না। মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের এক ভার্চুয়াল সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনকে অত্যন্ত ঘৃণ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে সরকার। মানবাধিকারের প্রতি সরকারের প্রতিশ্রুতি সব সময় পালনের চেষ্টা করে সরকার এবং চলমান করোনা পরিস্থিতিতেও এ বিষয়ে কোনো আপস হবে না। করোনা পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বে অনেকগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। এসব অপরাধের জবাবদিহি করতে হবে, যাতে সেগুলোর পুনরাবৃত্তি না ঘটে।

আইনমন্ত্রীর এবারের এ কথার মতোই রিপোর্ট বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সময় জমা দিয়েছে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায়। সেখানেও বরাবরই সরকার দাবি করেছে, বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে বাংলাদেশ মানবাধিকারের ক্ষেত্রে চমৎকার অগ্রগতি লাভ করেছে। কিন্তু দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, বিরোধীদলীয় সদস্যদের গ্রেপ্তার, মতপ্রকাশের অধিকার সংকোচন, ৫৭ ধারা ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, নারী ও শিশুর নিরাপত্তাহীনতা এবং বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যের যেসব পরিসংখ্যান ও তথ্য তুলে ধরা হয়েছে, তা সরকারের দাবিকে অসংগতিপূর্ণ প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট।

চলতি বছরের শেষের দিকে বাংলাদেশের র‌্যাব কর্মকর্তাদের আমেরিকায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রেও বেশ কয়েকজন সিনেটর যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে চিঠি দিয়েছেন। সিনেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির সদস্য ডেমোক্র্যাট দলের বব মেনেনদেজ ও রিপাবলিকান সিনেটর টড ইয়াংয়ের সঙ্গে সিনেটর বেন কারডিন, কোরি গার্ডনার, জিন শেহিন, মার্কো রুবিও, ক্রিস মারফি, ক্রিস কুনস, জেফ মার্কলে ও কোরি বুকার ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এবং অর্থমন্ত্রী স্টিভেন মনুশেনকে লেখা মার্কিন সিনেটরদের ওই চিঠিতে বলা হয়, ২০১৫ সালের পর থেকে চারশোর বেশি ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’র অভিযোগ রয়েছে বাংলাদেশের এই বাহিনীর বিরুদ্ধে।

ওই অভিযোগে শীর্ষস্থানীয় র‌্যাব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গ্লোবাল ম্যাগনিৎস্কি হিউম্যান রাইটস অ্যাকাউন্টিবিলিটি অ্যাক্ট এবং ফারদার কনসোলিডেটেড অ্যাপ্রোপ্রিয়েশনস অ্যাক্ট-২০২০-এর ৭০৩১(সি) ধারায় নিষেধাজ্ঞা আরোপের অনুরোধ জানানো হয়েছে সিনেটরদের চিঠিতে। যুক্তরাষ্ট্রের আইনের ওই দুটি ধারায় সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা এবং যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সুযোগ রয়েছে।

চিঠিতে তারা লিখেছেন, ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ছাড়াও র‌্যাবের হাতে গুম এবং ব্যাপক মাত্রায় নির্যাতনের ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করেছে জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক ও মানবাধিকার গ্রুপগুলো।

এর আগে চলতি বছরের ৩০ আগস্ট গুমের শিকার ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক দিবসকে সামনে রেখে ১২টি মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশের গুম বিষয়ে এক যৌথ বিবৃতি দিয়েছিল। তাতে বাংলাদেশের দুটি সংগঠন ‘অধিকার’ ও ‘মায়ের ডাক’ ছাড়াও অ্যাডভোকেট ফর হিউম্যান রাইটস, অ্যান্টি-ডেথ পেনাল্টি এশিয়া নেটওয়ার্ক, এশিয়ান ফেডারেশন অ্যাগেইনস্ট ইনভলান্টারি ডিসএপেয়ারেন্সেস (এএফএডি), এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন (এএইচআরসি), এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশন (এনফ্রেল), এশিয়ান ফোরাম ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআর ডব্লিউ), রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটস, ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন অ্যাগেইনস্ট টর্চারের মতো সংগঠনও। যৌথ বিবৃতিতে তারা বলেছে, বর্তমান সরকারের ১ জানুয়ারি ২০০৯ থেকে ৩১ জুলাই ২০২০ পর্যন্ত বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো অন্তত ৫৭২ জন মানুষকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে গুম করেছে। এর মধ্যে কিছুসংখ্যককে ছেড়ে দিয়েছে বা গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, কিছু মানুষকে তথাকথিত ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়েছে। আর বড় একটা অংশ এখনো নিখোঁজ! যদিও বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেওয়া তথ্য মতে এ সময় গুমের শিকার মানুষের সংখ্যা ৬০৩ জন।

যৌথ বিবৃতিতে গুরুতর যে তথ্যটি উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো, গুমের বেশির ভাগ ঘটনা ঘটেছে ২০১৪ এবং ২০১৮-এর নির্বাচন ঘিরে। সবচেয়ে বেশি গুম করা হয়েছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে। আর ২০২৮ সালের নির্বাচনের সময় গুম করা হয়েছে অন্তত ৯৮ জনকে। আরেকটি বিষয়ও লক্ষণীয়। তা হলো, দেশের যেসব এলাকায় সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরালো ছিল, সেখানে গুমের সংখ্যাও বেশি। এ পর্যবেক্ষণ থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশে গুমের ঘটনাগুলো রাজনৈতিক। (দৈনিক দেশ রূপান্তর, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২০)

এই রিপোর্টগুলোর সঙ্গে মিলে যায় বাংলাদেশের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের রিপোর্ট, মানবাধিকার কর্মীদের বক্তব্য ও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য। গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, হামলা, মামলা, হয়রানি, মতপ্রকাশে বাধা, রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে বাধা, নারী ও শিশু নির্যাতন, ভোটের অধিকার হরণ কী করা হয়নি বাংলাদেশে? শুধু করা হচ্ছে, তা-ই নয়। দিনে দিনে বাড়ছে উদ্বেগজনকভাবে। একদিকে সরকার তা প্রতিরোধের চেষ্টা তো করছেই না, অন্যদিকে ক্ষেত্রবিশেষে এসব মানবাধিকার হরণের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে সরকার ও তাদের ছত্রছায়ায় থাকা ব্যক্তিরা।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে আমরা যদি সরকারের একটি কার্যকর উদ্যোগ দেখতে পেতাম যে তারা আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো জঘন্য কাজে প্রবৃত্ত হবে না এবং মানুষের অধিকার রক্ষায় যথাযথ ভূমিকা রাখবে সেটাই হতো বড় প্রাপ্তি। একটি দেশে যদি ন্যূনতম মানবাধিকার না থাকে, সে রাষ্ট্র কোনোভাবেই একটি সভ্য রাষ্ট্র বলে দাবি করতে পারে না। সরকার যত উন্নয়নের দাবিই করুক না কেন, মানবাধিকার রক্ষিত না হলে কোনো উন্নয়নই কাজে আসবে না। যে মানুষের জন্য উন্নয়ন, আগে সেই মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা দিতে হবে। মানুষের জন্যই রাষ্ট্র। মানুষের জন্যই রাষ্ট্রের পরিচালক। তাই আগে রাষ্ট্রকে সেই মানুষের জন্য উপযোগী একটি মানবিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে। মানুষের অধিকার তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে। রাষ্ট্রটিকে শুধু ক্ষমতাবানদের নয়, সবার করে তুলতে হবে। তবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পরিচালকরা কখনোই তার নাগরিকের পূর্ণ অধিকার দেয়নি। তাই প্রয়োজনে রাষ্ট্রের নাগরিকদের অধিকার আদায় করে নিতে হবে তাদেরই।


— লেখক চিকিৎসক ও কলামিস্ট। লেখকের ইমেইল একাউন্ট sayantha15@gmail.com । লেখাটি প্রথম দৈনিক দেশরূপান্তরে প্রকাশিত হয়েছে, লিঙ্ক — https://bit.ly/34Gaugg 

Sunday, December 13, 2020

রোহিঙ্গাদের কি রেখেই দেবে বাংলাদেশ

—  সায়ন্থ সাখাওয়াৎ 

জাহাজে করে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হয়।

তিন বছরের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও বাংলাদেশ একজন রোহিঙ্গাকেও তাদের দেশ মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে পারেনি। কিন্তু বারো লাখের বেশি রোহিঙ্গার চাপে পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন কক্সবাজার থেকে গত সপ্তাহে হাজার দেড়েক রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশেরই আরেক অঞ্চলের দ্বীপ ভাসানচরে স্থানান্তর করেছে। সেখানে এই রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপত্তা, আবাসন, চিকিৎসা, তাদের শিশুদের জন্য শিক্ষাসহ উন্মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করেছে। সেখানে ইতিমধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে ১ হাজার ৪৪০টি ছাউনি নিয়ে ১২০টি গুচ্ছগ্রাম। প্রতিটি ছাউনিতে ১৬টি রুম। রান্নার জন্য ৮ পরিবারের জন্য এক জায়গায় ৮টি চুলা। সেখানে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের জন্য সরকার তো রেশন দিচ্ছেই। আরও আছে ২২টি এনজিওর সাহায্য।

 

আপাতত সেখানে লক্ষাধিক রোহিঙ্গার বসবাসের জায়গা তৈরি করা হয়েছে। তবে ভাসানচরে যে পরিমাণ জায়গা আছে তাতে পর্যায়ক্রমে প্রায় সব রোহিঙ্গাকে সেখানে হস্তান্তর করা সম্ভব বলে অনেকেই মত দিয়েছেন। কেউ কেউ এমনও বলছেন যে প্রথম পর্যায়ে স্থানান্তরিত রোহিঙ্গারা ভাসানচরে থাকার অভিজ্ঞতা নিয়ে যখন কক্সবাজারে থেকে যাওয়া তাদের স্বজনদের জানাবেন যে নতুন জায়গায় তারা অনেক ভালো আছেন, তখন সব রোহিঙ্গাই ভাসানচরে স্বেচ্ছায় যেতে চাইবেন।

প্রথম দফায় স্বেচ্ছায় স্থানান্তরিত রোহিঙ্গারা ভাসানচরে গিয়ে খুশি বলেই সংবাদমাধ্যমে জানা যাচ্ছে। কক্সবাজারের পাহাড়ি এলাকায় যে পরিবেশে রোহিঙ্গাদের রাখা হয়েছে, তার চেয়ে অনেক সুন্দর খোলামেলা পরিবেশ পেয়ে তাদের খুশি হওয়ারই কথা। সেখানে অনেকটা মুক্ত পরিবেশ পেয়েছেন তারা। তাদের শিশু সন্তানরা খেলাধুলা করতে পারছে, যা কক্সবাজারে পারেনি। ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য নির্মিত লাল রঙের দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা দেখে হয়তো অনেক বাংলাদেশিও আফসোস করেছেন যে এমন জায়গা পেলে তারাও সেখানে বসবাস করতে চলে যাবেন।

কিন্তু এই চমৎকার জায়গাটিতে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর করার মধ্য দিয়ে আমরা বিশ^বাসীকে কী বার্তা দিলাম? বাংলাদেশ কি তবে ধরেই নিয়েছে রোহিঙ্গাদের আর মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে না? তাই তাদের জন্য স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থার দিকে যাচ্ছে কি সরকার? এই পদক্ষেপের ফলে সরকারের যথাযথ প্রচেষ্টা থাকলে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর যে ন্যূনতম সম্ভাবনাটুকু ছিল তাও কি শেষ হয়ে যাবে না?

এই স্থানান্তর নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের আপত্তি আছে। আপত্তি আছে জাতিসংঘেরও। ইতিমধ্যে জাতিসংঘ বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে যে, তারা রোহিঙ্গাদের এই স্থানান্তর প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত নয়। মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোও এই স্থানান্তরের সমালোচনা করেছে। যদিও জাতিসংঘ বা এসব সংস্থা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে এখনো কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখেনি। আর তাদের আপত্তির উদ্দেশ্যও ভিন্ন। ফলে তাদের আপত্তি কানে তোলা নিষ্প্রয়োজন বলে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের যুক্ত থাকা উচিত বলেও বক্তব্য দিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। কিন্তু আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘উচিত’ আর জাতিসংঘের ‘উচিত’ যে সমান্তরাল হবে এমন তো কোনো কথা নেই। তাই জাতিসংঘ অনড় থেকেছে তার অবস্থানে। আর বাংলাদেশও অটল থেকেছে তার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে। কিন্তু এতে বাংলাদেশের লাভ হলো নাকি ক্ষতির মুখে পড়ল সেটা সময় বলবে।

বাংলাদেশের বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যমে রোহিঙ্গাদের এ স্থানান্তরের বিষয়ে সরকারের প্রশংসা করার প্রতিযোগিতা ছিল লক্ষণীয়। বিশেষ করে টিভি টক-শোতে সরকারপন্থি আলোচকরা এ স্থানান্তরের পক্ষে ব্যাপক ওকালতিতে নেমে পড়েন। একজন সম্পাদক ও একজন সাবেক কূটনীতিক একটি অনুষ্ঠানে বলছিলেন রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে বিশ-ত্রিশ বছর লেগে যেতে পারে। মুখে বিশ-ত্রিশ বছর বললেও তাদের চোখেমুখে ছিল অবিশ^াসের হাসি। অর্থাৎ তারা ধরেই নিয়েছেন যে এই রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে গ্রহণ করে নেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ বাংলাদেশের সামনে নেই। তারা এটাও মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, বাংলাদেশে আটকেপড়া পাকিস্তানিদের আমরা নাগরিকত্ব দিয়েছি। তারা এখন বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দা ও ভোটার। সেই উদারতা আমরা দেখিয়েছি। সুতরাং রোহিঙ্গাদের ব্যাপারেও বাংলাদেশের উদারতা দেখানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন তারা। কিন্তু তারা কেউ এ প্রশ্নটি করেননি যে তিন বছরে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে সরকার কী প্রচেষ্টা চালিয়েছে? কেন সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলো রোহিঙ্গাদের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থন বাংলাদেশের পক্ষে আনতে? আর এত তাড়াতাড়ি রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিরাপদ নিবাস গড়ে দিয়ে তাদের রেখে দেওয়ার মেসেজটি দেওয়া কতটা সংগত হয়েছে সে প্রশ্নটিও করেননি তারা।

গত বছর ৩১ আগস্ট দেশ রূপান্তরেই লিখেছিলাম সরকারের অনেকগুলো ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে জাতিকে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের প্রথম ভুল, এ বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি না করা। এর আগে ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান এবং ২০০৩ ও ২০০৫ সালে বেগম খালেদা জিয়ার সরকার সফল হয়েছিল রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে। তার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের পরামর্শও নিতে পারত সরকার। তাও নেয়নি। দ্বিতীয় ভুল মিয়ানমারের ফাঁদে পড়া। অনেকেরই হয়তো মনে আছে, যখন বানের জলের মতো বাংলাদেশে ঢুকছিল রোহিঙ্গারা, যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের ওপর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দিচ্ছিল, তখন চাল আমদানির কথা বলে মিয়ানমার গিয়েছিলেন সরকারের তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রী। তখনই গুঞ্জন উঠেছিল যে সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পাশ কাটিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় যাচ্ছে কারও বুদ্ধিতে। যারা সরকারকে ওই পথে পরিচালিত করেছে তারা কোনোভাবেই বাংলাদেশের বন্ধু না। খাদ্যমন্ত্রীর ওই সফর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তখন যে মেসেজ দিয়েছিল তা বাংলাদেশকে তাদের সহানুভূতির তালিকা থেকে বের করে আনার জন্য ছিল যথেষ্ট।

আজও এ সরকারের জন্য সে একই কথাই প্রযোজ্য। তারা সব সময়ই একলা চলার নীতি অবলম্বন করেছে। বিএনপিসহ ডান, বাম, মধ্য কোনো দলকেই ডাকেনি এ বিষয়ে সমাধানের পরামর্শ নিতে। রোহিঙ্গা ইস্যুটি রাজনৈতিক। আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির অংশ রোহিঙ্গা ইস্যুটি। তাই এটিকে সমাধানের পথও হতে হবে রাজনৈতিকই। কিন্তু বাংলাদেশে সহাবস্থানের রাজনীতি নির্বাসনে রেখে দেশ পরিচালনার মতো জাতীয় ইস্যুতেও রাজনৈতিক ঐক্য নিয়ে মোটেই ভাবেনি সরকার।

বাংলাদেশ সরকারের অকৃত্রিম বন্ধু বলে কথিত ভারত রোহিঙ্গা ইস্যুতে কেন বাংলাদেশের পক্ষে নেই, তারা কেন জাতিসংঘে এ ইস্যুতে ভোট দেওয়া থেকে বিরত রইল, সে প্রশ্নের উত্তর নেই। বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকান্ডে সবচেয়ে বড় অংশীদার চীনও এ ইস্যুতে কেন মিয়ানমারের পক্ষে ভোট দেয়, সে প্রশ্নেরও উত্তর মেলে না।

জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোর আপত্তির উদ্দেশ্য যাই হোক, তাদের আপত্তির মুখে বাংলাদেশ যদি রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর স্থগিত রেখে বলত যে তবে তোমরা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে আমাদের সহযোগিতা করো, সেটাই হতো যুক্তিসংগত। এতে ওই সব সংস্থা একটা চাপের মধ্যে থাকত। কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়ে এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থা ও প্রভাবশালী দেশগুলোকে পক্ষে আনার চেষ্টা চালাতে পারত। কিন্তু বাংলাদেশের ভূমিকা দেখে মনে হতে পারে যে, সরকার রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে গ্রহণ করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।

সরকারের পক্ষে যে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব নয় সেটা হয়তো তারা ভালো করেই জানে। জানে বলেই তাদের এখন ভাসানচর প্রকল্প ছাড়া আর কোনো পথ নেই। এ সরকারটি গত একযুগ ধরে যে পদ্ধতিতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আঁকড়ে রেখেছে তাতে তাদের পক্ষে আন্তর্জাতিক ফোরামে জোর গলায় কথা বলা মুশকিল। ভোটবিহীন নির্বাচনে যারা ক্ষমতায় আসে তারা একদিকে যেমন থাকে জনবিচ্ছিন্ন, অন্যদিকে সারাক্ষণ থাকে ক্ষমতা হারানোর ভয়ে আতঙ্কিত। যাদের ক্ষমতায় থাকার জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছে সমর্থন ভিক্ষা করতে হয়, তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অন্য কোনো বিষয়ে দরকষাকষি করা। সেটা যত ন্যায্যই হোক না কেন। সে কারণেই হয়তো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এবং বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম দেশগুলো পেয়ে বসেছে বর্তমান সরকারকে। তারা জানে জনবিচ্ছিন্ন একটি সরকারকে খুব বেশি পাত্তা দেওয়ার দরকার নেই। বরং তারা মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে তাদের ব্যবসায়িক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করে চলছে, সেখানে বাংলাদেশের কোনো স্থান নেই।

 






লেখক —  চিকিৎসক ও কলামিস্ট।ইমেইল —  sayantha15@gmail. লেখাটি প্রথম দৈনিক দেশরূপান্তর এ প্রকাশিত হয়েছে। 

 লিঙ্ক —   https://bit.ly/34oN0w7


Saturday, December 12, 2020

Intolerance and a repressive legal regime: A twin threat to freedom of expression

 — Sultan Mohammed Zakaria
 




On October 6, Robiul Islam Khandokar, 35, a district correspondent of the national daily Sangbad in Rajbari, wrote a Facebook status appealing to the prime minister: "Honourable Prime Minister[,] an utterly deranged person is trying to cause unrest in the peaceful Rajbari." (My translation) 
 
Robiul was apparently trying to alert the prime minister to the unlawful activities of someone in the district. He, however, forgot to place a comma after the title of the country's leader. Little did he know that this oversight would be construed as an attack on the prime minister herself. As soon as he was alerted to the typographical error, Robiul corrected his Facebook post. But it was too late. On October 9, a member of the student wing of the ruling Awami League filed a defamation case against Rabiul under the draconian Digital Security Act (DSA), accusing him of "defaming the prime minister". He was arrested the next day. This Kafkaesque sequence of events has become depressingly familiar in Bangladesh where even the perception of a slight is enough to invite official retribution.
 
Like Robiul, hundreds of people—journalists, academics, activists—have been charged and detained under the Digital Security Act simply for exercising their right to freedom of expression online. Many of these cases have been filed by members of the ruling party, or people acting on their behalf. According to the government's own Cyber Crime Tribunal data, more than 800 cases were filed under the DSA between January and October in 2020. Nearly 1,000 people were charged. More than 350 people were detained.
 
The DSA is not the only tool used to silence critical voices. It is often accompanied by others in an arsenal of repression that includes threats, harassment, intimidation, physical attacks and even enforced disappearances. According to Ain o Salish Kendra, a local human rights group, at least 219 journalists have been targeted this year by state agencies or individuals acting on behalf of the government.
 
On March 10, the editor of the daily Pokkhokal, Shafiqul Islam Kajol, was forcibly disappeared from the capital Dhaka, a day after a ruling party lawmaker filed a case against him under the DSA for his Facebook post. Kajol was later "found" by police under mysterious circumstances along the Bangladesh-India border—53 days after he was last seen in Dhaka—only to face an unlawful detention since then. In April, the acting editor of jagonews24.com, Mohiuddin Sarker, and editor-in-chief of bdnews24.com, Toufique Imrose Khalidi, were charged under the DSA for publishing reports on alleged embezzlement of relief materials meant for poor people affected by the Covid-19 lockdown. In May, a news editor of daily Grameen Darpan, Ramzan Ali Pramanik, staff reporter Shanta Banik, and publisher and editor of the online news portal Narsingdi Pratidin, Khandaker Shahin, were arrested for reporting on a custodial death at the Ghorashal police station. In June, the editor of the Bangla national newspaper Inqilab, AMM Bahauddin, was charged for publishing a story about an advisor to the prime minister.
 
Even children have not been spared. On June 19, a 14-year-old boy from Mymensingh district, who is in his ninth grade at school, criticised the government's decision of increasing Value Added Tax on mobile phone calls alleging that the extra revenue earned would fill the prime minister's coffers. The next day, he was detained under a DSA charge by police for "defaming the prime minister" in his Facebook post.
 
Bangladesh's academy was once regarded as a relatively safe space for airing of critical views. But this year, several academics have also been targeted and prosecuted for exercising their right to freedom of expression. In June, two professors at Rajshahi University and Begum Rokeya University were sacked for their Facebook posts about a deceased ruling party MP. In September, the Dhaka University authorities terminated BNP-linked professor Hasan Morshed Khan for publishing an opinion piece in a national newspaper allegedly distorting history. In the same month, the National University authorities suspended AKM Wahiduzzaman, an assistant professor, for posting on Facebook "offensive" and "indecent" remarks about the prime minister.
 
The DSA is a successor to the Information and Communication Technology (ICT) Act, widely criticised by human rights groups for its draconian Section 57, which was abused to file more than 1,271 charges between 2013 and 2018. But instead of remedying the repressive elements of the ICT Act, the DSA is arguably more abusive in character. The law was passed in 2018 in the face of strong opposition from journalists, civil society organisations, and human rights defenders. At the time, there were serious warnings of how an already restricted space for dissent online could be further squeezed to the point of near-suffocation. These warnings seem prescient now.
 
Some sections of the law that raised serious concerns were too vague and too broad to be able to define a crime, and also provided for disproportionately harsh punishments. For instance, Section 17 of the DSA can punish anyone for 10 years' imprisonment for "making any kind of propaganda or campaign against liberation war, spirit of liberation war, father of the nation, national anthem or national flag." The actions that would specifically constitute a violation under this provision were not at all defined. Besides, the terms are dangerously vague and overly broad, and the suggested punishments are not only disproportionate, but they also punish acts that shouldn't be considered a crime in the first place.
 
Provisions such as this create a situation where any political position deemed to be contrary to the regime narrative could land an individual in prison for 10 years. Similarly, Sections 25(b) (publications "damaging the image or reputation of the country"), 28 (publications "hurting religious values and sentiments"), 29 ("publications of defamatory information"), 31 ("publications deteriorating law and order"), and 32 ("breaching the secrecy of the government")—all criminalise legitimate forms of expression and suffer from the same vague and broad definitional issues, giving law enforcement authorities too much leverage to determine what act(s) would constitute a crime.
 
What the country has now is a legal regime under which the government's intolerance for criticism means that anyone even publishing the faintest whispers of dissent can be severely punished. Instead of a system where people can express themselves to promote the accountability of those in power, the reverse applies. A climate of fear now pervades society, with people filled with a sense of foreboding for what may happen if they dare to speak out, or even forget to place a comma correctly.
 
The right to freedom of expression is essential to all societies, and crucial to advance human rights. It is how people can claim their other human rights, speaking up for their rights and that of others—whether that's education, food, or healthcare. It is also the right on the basis of which societies thrive, testing old ideas and generating new ones. Without the right to freedom of expression, which is protected in Bangladesh's constitution and in its international commitments under the International Covenant on Civil and Political Rights, Bangladesh stands to lose in a global knowledge-based economy.
 
We must remember that when people fear to express themselves freely, when journalists are afraid to write or report on what they see, without fear of reprisals, it only corrodes and undermines the accountability and transparency pillars of the state. Such an outcome may prove ultimately self-defeating for any government that wants to serve the public good. Only an open, deliberative, and discursive political culture resting on the respect of the right to freedom of expression can arrest such a drift. As the noted American Justice Louis Brandeis once said, "Sunshine is the best disinfectant."
 
 
 
Sultan Mohammed Zakaria


  • The writer is South Asia Researcher for Amnesty International. His Twitter handle is: @smzakaria
The write up was first published in the Daily Star. 
Link — https://bit.ly/3qZgSc2
 

Monday, December 7, 2020

তত্ত্বাবধায়ক সরকারই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারে

 — কামরুল হাসান দর্পণ






এক। 

যে আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে নির্বাচিত সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু, কারচুপিবিহীন ও প্রশ্নহীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করা হয়েছিল, সে লক্ষ্য যে আজও পূরণ হয়নি, তা বিগত দশ বছরে সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে স্থানীয় সব ধরনের নির্বাচনের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ভোট কেন্দ্র দখল, কারচুপি, জালভোট এমনকি ভোটের আগের রাতে ভোট হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। দেশের যে কোনো নির্বাচন এলেই সাধারণ মানুষ ধরে নেয়, ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত। ক্ষমতাসীন দলের নমিনেশন পাওয়া মানে সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে সিটি মেয়র, পৌর মেয়র, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ার গ্যারান্টি। ফলে ক্ষমতাসীন দলের নমিনেশন পাওয়ার জন্য প্রার্থীদের যে ভিড় লক্ষ্য করা যায়, ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের তার ছিঁটেফোটাও দেখা যায় না। বৃহত্তম বিরোধী দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও ভোটের দিন তাদের কোনো পাত্তা থাকে না। অনেক সময় দিনে দুপুরেই বর্জন করে চলে আসে। দলটির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ ক্ষমতাসীন দলের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না বলে ঘোষণা দেন। দেখা যায়, এ ঘোষণায় তারা অটল থাকতে পারেন না। আবারও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের যুক্তি হচ্ছে, আমরা দেখাতে চাই ক্ষমতাসীন দলের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না। অন্যদিকে, ক্ষমতাসীন দলের নেতৃবৃন্দের বক্তব্য, নির্বাচনকে বিতর্কিত করার জন্য বৃহত্তম বিরোধী দলটি অংশগ্রহণ করে মাঝপথে সরে যায়। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষমতাসীন দল ও বৃহত্তম বিরোধী দলটির মধ্যে একধরনের বাগযুদ্ধ চলছে। এই বাকবিতন্ডা হলেও তা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখছে না। ফলে সাধারণ মানুষ ও ভোটাররাও নির্বাচনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। তারা ভোট দিতে যায় না। এমনকি ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে সমর্থকরাও অনেক সময় ভোট দেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না। তারা বিলক্ষণ জানেন, আমাদের প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত এবং তা নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশন রয়েছে। কাজেই কষ্ট করে ভোট দিতে যাওয়ার দরকার কি!

















দুই। 

দেশের সচেতন মহল থেকে শুরু করে নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা যে ক্ষমতাসীন দলের অধীনে অনুষ্ঠিত সব ধরনের নির্বাচনে অসন্তুষ্ট তা তারা বিভিন্ন সময়ে সভা-সেমিনারে বক্তব্য দিয়ে এবং পত্র-পত্রিকায় কলাম লিখে পরামর্শ দিয়েছেন। এতে ক্ষমতাসীন দলের যে কিছু যায় আসে না, তা নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার কোনো উদ্যোগ না নেয়া থেকেই বোঝা যায়। নির্বাচনে কিছু ভোটার এনে নামকাওয়াস্তে লোক দেখানো ভোটের দৃশ্য দেখানোর মধ্যেই সে সন্তুষ্ট। কে কি বলল, তার আমলে নিচ্ছে না। তার মধ্যে এ প্রবণতা বিদ্যমান, ভোট তো হচ্ছে, মানুষ ভোট দিতে না এলে তার কি করার আছে? সরকারের সাথে তাল মিলিয়ে নির্বাচন কমিশনও একই বক্তব্য দেয়। তার কথা, ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের আনার দায়িত্ব তার নয়। তবে সে এটা ভুলে থাকতে চায়, অতীতে দেশের ভোটের চিত্র কেমন ছিল। সেসব ভোটের কোথাও কোথাও অনিয়ম হলেও সেগুলোতে যে বিপুল ভোটারের উপস্থিতি ছিল, তা মনে করতে চায় না। মনে করতে গেলে তার ব্যর্থতা দৃশ্যমান হয়ে উঠবে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, আমাদের দেশে ভোট কারচুপি, ব্যালট বাক্স ছিনতাই ইত্যাদি স্বাধীনতার পর থেকেই হয়ে আসছে। এর বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর জোরালো আন্দোলন মূলত গড়ে উঠে আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে। একদিকে স্বৈরাচারকে ক্ষমতা থেকে হটানো, অন্যদিকে ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার আন্দোলন চলতে থাকে। বৃহৎ বিরোধী দলসহ অন্যান্য বিরোধী দলের সাথে সমবিভ্যহারে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলও এসব আন্দোলনে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে। মানুষের ‘ভোট ও ভাতের অধিকার’ নিশ্চিত করার স্লােগান নিয়ে ব্যাপক আন্দোলন করে। আন্দোলনে বহু রক্ত ক্ষয়ের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারের পতনের পর বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয়, কার অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে? যেহেতু সব বিরোধী দলের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কারণে স্বৈরাচারের পতন ঘটে, তাই তাদের মতাদর্শগত ভিন্নতা থাকলেও একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্টজনদের নিয়ে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে একমত পোষণ করে। এই সরকারের প্রধান হবেন প্রধান বিচারপতি এবং তিনি বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্টজনদের নিয়ে একটি উপদেষ্টা কমিটি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করবেন। এই সরকার ক্ষমতা গ্রহণের তিন মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন করবেন। সবাই এই সরকার গঠনের বিষয়ে একমত হয়। এতে সংবিধানে সংশোধনীও আনতে হয়। পরবর্তীতে এটা একটা অটো সিস্টেম হয়ে দাঁড়ায়। যে দল ক্ষমতাসীন তাকে কর্মরত প্রধান বিচারপতির হাতে ক্ষমতা দিয়ে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হতো। যদিও যে সরকার ক্ষমতায় থাকে সে নানা ছলচাতুরির মাধ্যমে তার অনুগত লোকজন যাতে তত্ত¡াবধায়ক সরকারে আসে এমন কূটকৌশল অবলম্বন করত। যাই হোক, স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিল, তার অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছিল বৃহত্তম বিরোধী দল বিএনপি, যা তখন কেউ যেমন কল্পনা করতে পারেনি, তেমনি বিএনপি এবং তার সমর্থকদেরও ভাবনায় ছিল না। দলটি অনেকটা বিরোধী দলে বসার প্রস্তুতি নিয়েই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ এতটাই নিশ্চিত ছিল যে, সে ক্ষমতায় যাচ্ছে। সে সময় শুনেছি, দলটির অনেক বড় বড় নেতা মন্ত্রী হওয়ার জন্য আগেভাগেই স্যূট-কোট বানাতে দিয়ে দিয়েছিল। নির্বাচনের পর দেখা গেল, আওয়ামী লীগ নয়, জয়ী হয়েছে বিএনপি। এটা আওয়ামী লীগের মাথায় বাজ পড়ার মতোই ছিল। দলটির নেতারা দাবী করে বসেন, নির্বাচনে সূ² কারচুপি হয়েছে। যদিও শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের সুষ্ঠুতার কাছে তাদের এ দাবী ধোপে টিকেনি এবং এক পর্যায়ে তারা নির্বাচনটি মেনে নেন। এভাবে ’৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। একইভাবে ২০০১ সালে আসে বিএনপি। গোল বাঁধে ২০০৭ সালে যখন বিএনপি তার দলীয় অনুগত লোকজন নিয়ে তত্ত¡াবধায়ক সরকার গঠন করে। এ ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করবে না বলে আওয়ামী লীগ ও তার জোট বেঁকে বসে এবং আন্দোলন-সংগ্রাম করে। কোনো ফয়সালা না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ওয়ান-ইলেভেন নামক এক ভিন্ন ধরনের সরকার গঠিত হয়। নামে তত্তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলেও নেপথ্যে তার নিয়ন্ত্রণ থাকে সামরিক বাহিনীর হাতে। এ সময় দুই নেত্রীকে গ্রেফতার করা হয়। মূল দল থেকে বের হয়ে দুই দলে সংস্কারপন্থী নামক একদল লোকজনের উদ্ভব ঘটে। তাদের মাধ্যমে দুই নেত্রীকে মাইনাস করার ফর্মূলাও দেয়া হয়। তবে দুই দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা-কর্মীর কাছে তারা ‘কুসংস্কারপন্থী’ হিসেবে আখ্যায়িত হন। তারা দুই নেত্রীকে বাদ দেয়ার যে মিশন নিয়ে নেমেছিলেন, তাতে সফল হতে পারেননি। এ নিয়ে রাজনীতিতে নানা নাটকীয় ঘটনা শুরু হয় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার তিন মাস থাকার কথা থাকলেও তা দুই বছর পর্যন্ত প্রলম্বিত হয়। বহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর চাপে শেষ পর্যন্ত ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে আর্মি ব্যাকড তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও তার জোট নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে।





















তিন। 

আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয় দলটিকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। দলটির মনে হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আর নির্বাচন করার প্রয়োজন নেই। পরবর্তী নির্বাচন হবে নির্বাচিত তথা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন মহাজোটের অধীনে। যুক্তি হিসেবে দাঁড় করানো হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি অনির্বিচিত সরকার এবং তা অগণতান্ত্রিক। সারাবিশ্বে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ক্ষমতাসীন দলের অধীনেই নির্বাচন হয়। পার্শ্ববর্তী ভারত, যক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচন হয় এবং বিরোধী দলগুলো তাতে অংশগ্রহণ করে। এতে গণতন্ত্র বিকশিত ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে এবং মানুষও গণতন্ত্র মনস্ক হয়ে উঠে। সরকার এবং বিরোধী দলগুলোর মধ্যে একে অপরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস সৃষ্টি হয়। সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংবিধান থেকে তুলে দেবে। এর বিরোধিতা করে তখন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তার জোটসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল চরম বিরোধিতা ও আন্দোলন শুরু করে। বিষয়টি উচ্চ আদালতে যায় এবং সরকারও এর পক্ষে-বিপক্ষে মতামতের জন্য একটি কমিটি গঠন করে। বিরোধী দলসহ দেশের বিশিষ্টজনদের কমিটির কাছে মতামত ব্যক্ত করার আমন্ত্রণ জানানো হয়। দেখা গেছে, সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করে। এর মধ্যে আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবৈধ বলে রায় দেয় এবং পরবর্তী একটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে বলে মত দেন। সরকারও তা কালবিলম্ব না করে তা লুফে নেয়। আদালতের রায় মানতে হবে এ যুক্তিতে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দেয়। যদিও আদালতের পরবর্তী নির্বাচনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার আদালতের মত আমলে নেয়া হয়নি। প্রধান বিরোধী দল ও তার জোট অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম করেও সরকারকে টলাতে পারেনি। সরকার অনড় অবস্থানে থেকে বিরোধী দলের আন্দোলন এবং ব্যাপক সহিংসতার মাধ্যেই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন করে ফেলে। নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিশ দলীয় জোটসহ অন্যান্য দল অংশগ্রহণ করেনি। ক্ষমতাসীন দল তার মহাজোট নিয়েই নির্বাচন করে। ফলে নির্বাচনের আগেই ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ক্ষমতাসীন দলের ১৫২ জন এমপি বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হয়ে যান। অন্যদিকে নির্বাচনের দিন ব্যাপক সহিংসতার কারণে অধিকাংশ ভোট কেন্দ্র ভোটার শূন্য হয়ে পড়ে। এ নির্বাচনকে তখন বিশ্লেষকরা দেশের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন এবং ভোটারশূন্য নির্বাচন হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বিরোধী দলগুলোর দাবী ছিল এ নির্বাচনে শতকরা ৫ ভাগ ভোটার ভোট দিয়েছেন। আর নির্বাচন কমিশনের দাবী শতকরা ৪০ ভাগ ভোটার ভোট দিয়েছেন। তবে যে কজনই ভোট দিয়ে থাকুক না কেন, ক্ষমতাসীন দল তাতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে। দলটির বড় যুক্তি ছিল, সংবিধান অনুযায়ী তারা নির্বাচন করেছে এবং এর ব্যতিক্রম হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। তাতে সাংবিধানিক সংকট দেখা দিতে পারে। দেশে-বিদেশে নির্বাচনটি তুমুল বিতর্কিত হলেও ক্ষমতাসীন দল প্রতিবেশী একটি দেশের সহায়তায় বিদেশীদের বোঝাতে সক্ষম হয়, সংবিধান অনুযায়ী এ নির্বাচন করা ছাড়া তার আর কোনো বিকল্প ছিল না। তার এ যুক্তি বিদেশীরা মেনে নেয়। বিতর্কিত এ নির্বাচনের পর সরকারের রোষানলে পড়ে আন্দোলনরত বৃহৎ বিরোধী দল ও তার জোটের নেতা-কর্মীরা লাখ লাখ মামলায় জড়িয়ে একেবারে নাস্তানাবুদ হয়ে যায়। ক্ষমতাসীন দল রাজনীতির মাঠে তার প্রতিপক্ষকে কোনঠাসা করে নিস্ক্রিয় করে দিতে সক্ষম হয়। সভা-সমাবেশ করতে দেয়া দূরে থাক সাধারণ মানববন্ধন করতেও দেয়া হয়নি। এক পর্যায়ে বিএনপি নেত্রীকেও দুদকের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে জেলে যেতে হয় এবং সরকারের বদান্যতায় জেল থেকে মুক্ত হলেও তিনি এখন ঘরবন্দী হয়ে রয়েছেন। ২০০৯ সালের পর থেকে এবং ২০১৮ সালের একাদশ নির্বাচনসহ এ পর্যন্ত যেসব নির্বাচন হয়েছে দেখা গেছে, সব নির্বাচনেই ক্ষমতাসীন দলের জয়জয়কার। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনটিতো ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের চেয়েও কৌশলগত দিক থেকে অভাবনীয় ছিল। নির্বাচনের আগের দিন রাতেই প্রশাসনের সহায়তায় ব্যালট বক্স ভর্তি করে নির্বাচন করা হয় বলে বিরোধী দল থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করেন। এ নির্বাচনকে অভিহিত করা হয়, ‘রাতের ভোট’ হিসেবে। গত এক দশক ধরে বিরোধী দল বিভিন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও উল্লেখ করার মতো তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। নির্বাচনগুলো ক্ষমতাসীন দলের মধ্যকার প্রতিদ্ব›দ্বীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। দল থেকে নমিনেশন পাওয়া এবং না পাওয়া বা বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে নির্বাচন হচ্ছে। এতে কখনো নমিনেশন পাওয়া প্রার্থী বিজয়ী হয়, কখনো বিদ্রোহী প্রার্থী বিজয়ী হয়। গত এক দশক ধরে এ ধরনের নির্বাচনের ফলে সাধারণ মানুষ ও ভোটাররা নির্বাচনবিমুখ হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে এখন এ ধারণা, ভোট দিয়ে লাভ নেই। কারণ, তাতে তাদের ভোটের কোনো মূল্য থাকে না। বিশিষ্টজনরা গণতন্ত্রের জন্য এ পরিস্থিতিকে ভীতিকর ও বিরাজনীতিকরণ হিসেবে অভিহিত করছেন। অন্যদিকে, এ ধরনের নির্বাচন করে ক্ষমতাসীন দল সন্তুষ্টি প্রকাশ করছে এবং বিরোধীদল জনবিচ্ছিন্ন, জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে বলে যুক্তি দিচ্ছে।
















চার। 

দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা যে ভেঙ্গে পড়েছে, তাতে একজন সাধারণ মানুষও বোঝে। যেভাবে নির্বাচন হয়, তাকে তারা মানতে না পারলেও তাদের কিছু করার নেই। কারণ, তাদের ভোট দেয়ার যেমন সুযোগ নেই, তেমনি সরকার ও নির্বাচন কমিশন সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেনি। ফলে সাধারণ মানুষ নির্বাচনবিমুখ এবং আগ্রহহীন হয়ে পড়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে দেশে গণতন্ত্র ও রাজনীতি বলে কিছু থাকবে না। তারা তাকিদ বোধ করছেন, ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি এবং গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য তারা পুরনো ফর্মূলা ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’কেই উপযুক্ত মনে করছেন। এ পদ্ধতি ফিরিয়ে আনার পরামর্শও দিচ্ছেন। গত রোববার সুসাশনের জন্য নাগরিক (সুজন) আয়োজিত এক ভার্চুয়াল গোলটেবিল বৈঠকে দেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, মানুষ ভোটকেন্দ্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় দেশের গণতন্ত্র ক্ষতি হচ্ছে। গণতন্ত্র ‘কাল্পনিক’ রূপ লাভ করায় উগ্রবাদীদের উত্থান ঘটতে পারে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে এনে নাগরিকদের ভোটকেন্দ্রমুখী করতে হবে। একইসঙ্গে তারা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে ‘বিরাজনীতিকরণ কমিশন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তারা বলেছেন, আগে দেখতাম সামরিক শাসকরা ক্ষমতা দখল করে বিরাজনীতিকরণ করেন, এখন বেসামরিক সরকারও ইসির সহায়তায় রাষ্ট্রকে বিরাজনীতিকরণ করেছে। অন্যদিকে বাম গণতান্ত্রিক জোটও নতুন করে নির্দলীয় তাদারকি তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলেছে। তাদের এসব বক্তব্য থেকে এটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, দেশের সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং অবাধ ও নিরপেক্ষ ভোট অনুষ্ঠানের জন্য দলীয় সরকার উপযুক্ত নয়। এর জন্য প্রয়োজন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এ ধরনের সরকারের মাধ্যমে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব এবং মানুষ উৎসবমুখর হয়ে ভোট দিতে যায়, তা একাধিকবার প্রমানিত হয়েছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের অধীনে যে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হয় না, তাও প্রমানিত। এতে যেমন ভোটাররা ভোটাধিকার হারিয়েছে, তেমনি গণতন্ত্রও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি। এই পর্যবেক্ষণ থেকে বোঝা যায়, অন্তত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং উৎসবমুখর পরিবেশে মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অনির্বাচিত হলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারই সবচেয়ে বেশি কার্যকর।

লেখক সাংবাদিক। 

  • কার্টসি — ইনকিলাব/ডিসেম্বর ৬, ২০২০ 

Sunday, December 6, 2020

ডুবছে ৩৬ সরকারি প্রতিষ্ঠান

— আশরাফুল হক ও মামুন আব্দুল্লাহ



দেশের সবগুলো বেসরকারি টেলিযোগাযোগ কোম্পানি যখন চুটিয়ে ব্যবসা করছে, তখন উল্টোপথে হাঁটছে সরকারি মালিকানাধীন টেলিটক। গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংকের মতো প্রতিষ্ঠান বছরে হাজার কোটি টাকা মুনাফা করলেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির লোকসান ২৬৯ কোটি টাকা। যদিও এই লোকসানের পেছনে যৌক্তিক কারণ আছে বলে সাফাই গেয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী। অন্যদিকে সরকারি মালিকানাধীন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশন গত অর্থবছরে লোকসান গুনেছে ২৬৩ কোটি টাকা। এভাবে একই অর্থবছরে সরকারের ৩৬টি প্রতিষ্ঠানের মোট লোকসানের পরিমাণ ৪ হাজার কোটি টাকা।


অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাষ্টায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসানে থাকার বড় কারণ অনিয়ম, অদক্ষতা ও দুর্নীতি। এ ছাড়া চরম অব্যবস্থাপনা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর করে তুলেছে। এ ক্ষেত্রে সময় বেঁধে দিয়ে মুনাফায় ফিরতে না পারলে এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার চিন্তা করা উচিত বলে পরামর্শ দিয়েছেন তারা।


টেলিটকের লোকসানের কারণ জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘টেলিটকের লোকসানের যৌক্তিক কারণ রয়েছে। সরকারি এই অপারেটরের নেটওয়ার্ক নেই। গ্রামে-গঞ্জে সব মানুষ টেলিটক ব্যবহার করতে চায়, কিন্তু নেটওয়ার্ক পায় না।’


তিনি আরও বলেন, ‘২০১৮ সালে গ্রামীণফোনের বিনিয়োগ যেখানে ছিল ৪০ হাজার কোটি টাকা, সেখানে টেলিটকের ছিল ৩ হাজার কোটি টাকা। এই বিনিয়োগ দিয়ে কম্পিটিশন করা অসম্ভব। তবে আশার কথা হলো টেলিটকের বিনিয়োগ বাড়ছে। ২ হাজার ২০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাবও পাঠানো হয়েছে। আশা করি এটি পাস হলে টেলিটকের উন্নয়ন হবে। একই সঙ্গে শিগগিরই মুনাফাও করতে পারবে।’


গত ২ নভেম্বর মন্ত্রিসভা বৈঠকে সব সরকারি কোম্পানি ও সংস্থার লাভ-লোকসান অনুমোদন করা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, সর্বোচ্চ লোকসানে থাকা সরকারের ১০ সংস্থার মধ্যে লুটপাটের শিকার হওয়া বেসিক ব্যাংক রয়েছে। ব্যাংকটি লোকসান দিয়েছে ৩১৯ কোটি টাকা। তবে লোকসানে বেসিক ব্যাংককে ছাড়িয়ে গিয়ে শীর্ষ স্থান দখল করেছে কৃষি ব্যাংক। এই ব্যাংকের লোকসান ১ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা। তাদের পাশাপাশি কৃষি উন্নয়নে নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকা রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকও লোকসান দিয়েছে প্রায় ৩৭ কোটি টাকা।


প্রাকৃতিক গ্যাসকেন্দ্রিক ব্যবসা করে সব প্রতিষ্ঠানের প্রসার ঘটলেও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম এলপি গ্যাস লিমিটেড। গত বছর প্রতিষ্ঠানটি লোকসান দিয়েছে সাড়ে তিন কোটি টাকা। পাটকল করপোরেশন লোকসান দিয়েছে প্রায় সাত কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশনের লোকসান দাঁড়িয়েছে ২৬৩ কোটি টাকায়।


এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. মীর্জ্জা এবি আজিজুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি প্রতিষ্ঠানে লোকসানের বড় কারণ অদক্ষতা ও কিছুটা দুর্নীতি। এখানে জনবল রিক্রুট থেকে শুরু করে পরবর্তী কার্যসম্পাদনে সমস্যা থাকে। এসব সংস্থায় শ্রমিকদের একটি বেপরোয়াভাব থাকে। কারণ জবাবদিহির ঘাটতি রয়েছে।’


তিনি আরও বলেন, ‘লোকসানি প্রতিষ্ঠানকে একটি টাইমলাইন বেঁধে দেওয়া উচিত। নির্দিষ্ট সময়ে তারা ঘুরে দাঁড়াতে না পারলে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। কারণ বছরের পর বছর সরকার লোকসান টানতে পারে না।’


একই ধরনের মত দিয়েছেন বিশ^ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একই ধরনের বেসরকারি কোম্পানি যে খাতে অতি মুনাফা করছে, সেখানে সরকারি প্রতিষ্ঠান মোটা অঙ্কের লোকসান দিচ্ছে। এর পেছনে অন্যতম কারণ আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি। তবে এর চেয়ে বড় কারণ জবাবদিহি না থাকা। আর যতটুকু আছে তা শুধু কাগজে-কলমে।’


এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ‘এভাবে চলতে পারে না। আদমজী পাটকল বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। এখন সেটা প্রমাণিত। সম্প্রতি পাটকল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখানে লোকসানি অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়েও পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে তাদের সময় বেঁধে দিয়ে দেখা যেতে পারে।’


তথ্য অনুসারে, লোকসানের তালিকায় থাকা অন্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই রয়েছে। এর মধ্যে সারকারখানাগুলো লোকসানের শীর্ষে। শাহজালাল ফার্টিলাইজার লোকসান দিয়েছে ২৬৪ কোটি টাকা। চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজারের লোকসানের পরিমাণ ১৪৬ কোটি টাকা। এ ছাড়া যমুনা ফার্টিলাইজারের লোকসান ৬২ কোটি, আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানির ৭২ কোটি, পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরির ৬ কোটি ও ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি ১৭৪ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে।


দেশ রূপান্তরের হাতে আসা তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারি সিমেন্ট কোম্পানিগুলো চুটিয়ে ব্যবসা করলেও মার খাচ্ছে সরকারি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি। ছাতক সিমেন্ট কোম্পানি গত অর্থবছরে ৪০ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। একই পথে হাঁটছে আরও বেশ কিছু সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে বাংলাদেশ ইন্সুলেটর অ্যান্ড স্যানিটারিওয়্যার ফ্যাক্টরি ১৯ কোটি, উসমানিয়া গ্লাস সিট ফ্যাক্টরি ১১ কোটি, এটলাস বাংলাদেশ  ৩ কোটি, ইস্টার্ন কেবলস ১৩ কোটি, ইস্টার্ন টিউবস ৪ কোটি, কর্ণফুলী পেপার মিলস ২০ কোটি, বাংলাদেশ ব্লেড ফ্যাক্টরি ৪ কোটি এবং ঢাকা স্টিল ওয়ার্কস ২৩ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে।


শিল্প মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকা ১৪টি সুগার মিলের সব কটি লোকসান দিচ্ছে বছরের পর বছর। এর মধ্যে গত বছর সবচেয়ে বেশি লোকসান দিয়েছে নর্থ-বেঙ্গল সুগার মিলস। যার পরিমাণ প্রায় ৯৫ কোটি টাকা। মোবারকগঞ্জ সুগার মিলস ৯৩ কোটি টাকা এবং ৮৪ কোটি টাকা করে লোকসান দিয়েছে রাজশাহী ও নাটোর সুগার মিলস। এ ছাড়া জয়পুরহাট সুগার মিলস ৭৭ কোটি, পঞ্চগড় সুগার মিলস ৬২ কোটি, রংপুর সুগার মিলস ৬১ কোটি, শ্যামপুর সুগার মিলস ৬৩ কোটি, সেতাবগঞ্জ সুগার মিলস ৬৩ কোটি, ঠাকুরগাঁও সুগার মিলস ৮০ কোটি, পাবনা সুগার মিলস ৬১ কোটি, কুষ্টিয়া সুগার মিলস ৬২ কোটি, ফরিদপুর সুগার মিলস ৭০ কোটি ও ঝিলবাংলা সুগার মিলস ৬২ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে।


৬৫ প্রতিষ্ঠানের ১৫ হাজার কোটি টাকা লাভ : অনেকগুলো সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর লোকসান গুনলেও সরকারি মালিকানাধীন ৬৫টি কোম্পানি গত অর্থবছরে ১৫ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। যদিও স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিচালনা করা হলে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে আরও বেশি লাভ আসার কথা বলে মনে করেন অনেকেই। গত অর্থবছরে চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক মুনাফা করেছে ৪ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংক একাই করেছে ২ হাজার ২০৬ কোটি টাকা। অগ্রণী ব্যাংকের মুনাফা ১ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা। সবচেয়ে কম মুনাফা করেছে রূপালী ব্যাংক ২৪৮ কোটি টাকা।


সরকারি মালিকানাধীন পেট্রোলিয়াম ও বিদ্যুৎ খাতের কোম্পানিগুলো বরাবরের মতো মুনাফা করেছে। এর মধ্যে ৪ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন। এ ছাড়া কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড ৪৮৬ কোটি, ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড ৪৬৪ কোটি, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) ৩৮৩ কোটি, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি (এসিসিএল) ৩৪৫ কোটি এবং সিলেট গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড ৩০৯ কোটি টাকা মুনাফা করেছে।


বরাবরের মতো চট্টগ্রাম বন্দরও মুনাফা করেছে। যার পরিমাণ ১ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। এ ছাড়া বেসামরিক বিমান চলাচল কর্র্তৃপক্ষ ৩১০ কোটি টাকা মুনাফা করেছে।


  • কার্টসি — দেশরূপান্তর / ডিসেম্বর ৬, ২০২০