Search

Sunday, September 30, 2018

তথ্যঅধিকার আইনের সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সাংঘর্ষিক যে কারণে

গোলাম মোর্তোজা

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের শুরু থেকেই সাংবাদিক-সম্পাদকদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

তবে তথ্য কমিশন, কোনো কোনো সাংবাদিক এবং সাংবাদিকতার শিক্ষক বলছেন, নতুন এই আইনটি তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়।

১. তথ্য অধিকার আইনের প্রথম অধ্যায়ের ৩ (খ): তথ্য প্রদানে বাধা সংক্রান্ত বিধানাবলী এই আইনের বিধানাবলীর সহিত সাংঘর্ষিক হইলে, এই আইনের বিধানাবালী প্রাধান্য পাইবে।

তথ্য কমিশনের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে বলা হয়েছে, ‘সম্প্রতি পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। তথ্য অধিকার আইনে অবাধ তথ্য পাওয়ার অধিকার আছে। অন্য কোনো আইনের মাধ্যমে এই আইনের বিধান ক্ষুণ্ণ হবে না।’ (প্রথম আলো, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮)
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনের কোনো বিধানের সহিত যদি অন্য কোনো আইনের কোনো বিধান অসমঞ্জস্ হয়, তাহা হইলে অন্য কোনো আইনের বিধানের সহিত এই আইনের বিধান যতখানি অসমঞ্জস্ হয় ততখানির ক্ষেত্রে 

এই আইনের বিধান কার্যকর থাকিবে:
তবে শর্ত থাকে যে, তথ্য অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ের ক্ষেত্রে তথ্য অধিকার আইনের বিধানাবলী কার্যকর থাকিবে।


ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও তথ্য অধিকার আইনের এই দুটি ধারা উল্লেখ করে বলা হচ্ছে, আইন দুটি পরস্পর সাংঘর্ষিক নয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন গণমাধ্যম বা সংবাদকর্মীদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করবে না। কারণ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যেখানে অধিকার ক্ষুণ্ণ করবে, সেখানে তথ্য অধিকার আইন সুরক্ষা দিবে। কারণ দুই আইনেই তথ্য অধিকার আইনের প্রাধান্য স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে।

২. এখন দেখা যাক- তথ্য অধিকার আইন গণমাধ্যম বা সংবাদকর্মীদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন থেকে কীভাবে এবং কতটা সুরক্ষা দিবে?

ক. একজন সংবাদকর্মী তথ্য অধিকার আইনের সুযোগ নিয়ে প্রক্রিয়া অনুসরণ করে যে তথ্য সংগ্রহ করবেন, সেই তথ্যের ভিত্তিতে সংবাদ প্রকাশিত হলে তিনি সুরক্ষা পাবেন। এক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ করে সংবাদকর্মী বা গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না।

খ. অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্যে যেসব তথ্য প্রয়োজন হয়, তা কি তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী পাওয়া সম্ভব? দুর্নীতি, জালিয়াতির তথ্য কি তথ্য অধিকার আইনের মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব?

একটি উদাহরণের ভিত্তিতে আলোচনা করলে বুঝতে সুবিধা হবে।
ধরুন, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির কথা। ঋণের নামে জালিয়াতি করে ব্যাংক থেকে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়ে গেল। এমন গুঞ্জন শোনা গেল, কিন্তু কোনো প্রমাণের নথি পাওয়া গেল না। গুঞ্জনের বিষয়টি সত্যি হলেও, তার ওপর ভিত্তি করে সংবাদ প্রকাশ করা যাবে? যাবে না। তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী, প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তথ্য-নথি-প্রমাণ চাওয়া যেতে পারে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কি তাদের জালিয়াতির সব তথ্য-প্রমাণ সংবাদকর্মীকে সরবরাহ করবেন? তাদের সরবরাহ করা নথি-প্রমাণ এনে সংবাদকর্মী 

অনুসন্ধানী রিপোর্ট করবেন?

ব্যাংক কর্তৃপক্ষ যে নিজেদের জালিয়াতি প্রমাণ হয় এমন তথ্য-প্রমাণের কাগজপত্র সংবাদকর্মীকে দিবেন না, তা নিয়ে বোধ করি বিতর্কের অবকাশ নেই।

সংবাদকর্মীকে তার নিজস্ব সোর্সের মাধ্যমে গোপনে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করতে হবে। বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির সংবাদ প্রকাশের আগে নিজস্ব একাধিক সোর্সের মাধ্যমে সংবাদ তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করতে হয়েছিল। সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি, স্বর্ণের মেডেলে ভেজালসহ আলোচিত সব অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের তথ্য-প্রমাণ গোপনেই সংগ্রহ করা হয়েছিল।

এই প্রক্রিয়ায় তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে সংবাদ প্রকাশ করলে, তথ্য অধিকার আইন গণমাধ্যম বা সংবাদকর্মীকে সুরক্ষা দিবে না। কারণ এই তথ্য-প্রমাণ তথ্য অধিকার আইন অনুসরণ করে সংগ্রহ করা হয়নি। বলে রাখা দরকার, বর্তমানে সংগৃহীত সব রকমের তথ্য এবং প্রকাশের সঙ্গে কোনো না কোনো প্রক্রিয়ায় ডিজিটাল ডিভাইসের সম্পৃক্ততা থাকে।

গ. তথ্য অধিকার আইনের কারণে ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ অকার্যকর হয়ে গিয়েছিল। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তা আবার কার্যকর করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারা অনুযায়ী ‘সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অপরাধে’- অভিযুক্ত করা যাবে গণমাধ্যম বা সংবাদকর্মীকে।

অনুসন্ধানী সংবাদকর্মীর সংগৃহীত সত্য-সঠিক তথ্য-প্রমাণও, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করার সুযোগ থাকবে। এতে একজন সংবাদকর্মীর ১৪ বছরের জেল ও ২৫ লাখ টাকা জরিমানা হতে পারে।

৩. তথ্য কমিশনের বক্তব্য বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘আইন দুটি সাংঘর্ষিক কিনা তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে যেসব উদাহারণ দেয়া হচ্ছে তা অত্যন্ত নিম্নমানের। এই তুলনা নাগরিকের অধিকারের বিষয় মাথায় রেখে করতে হবে। তথ্য কমিশনার এই পার্থক্য করতে ব্যর্থ হয়েছেন। প্রায় পাঁচ হাজার লিখিত আইনের প্রায় সবই নিয়ন্ত্রণমূলক। একমাত্র ২০০৯ সালের তথ্য অধিকার আইন-ই, কিছুটা হলেও জনমানুষকে অধিকার দিয়েছে। কিছুটা হলেও সরকারের স্বচ্ছতার পথ তৈরি হয়েছে। তথ্য অধিকার আইনের প্রাধান্যের কথাটা কৌশল হিসেবে রাখা হয়েছে। অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ফিরিয়ে আনাসহ আরও নানাবিধ আইনি ব্যাখ্যায়, তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দৃশ্যমানভাবে সাংঘর্ষিক।’

তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী তথ্য পাওয়ার পরিসর অত্যন্ত সীমিত।

বড় বড় অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী পাওয়া যায় না, যাবে না। ফলে তথ্য অধিকার আইনের প্রাধান্য স্বীকার করে নেওয়া হলেও, দুর্নীতি-জালিয়াতি-অনিয়মের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করলে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তা অপরাধ হিসেবে বিবেচনার সুযোগ থাকবে কিনা?

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ূম বলেন, ‘অবশ্যই সংবাদকর্মী বা গণমাধ্যমকে অভিযুক্ত করা যাবে। কারণ দুর্নীতি-জালিয়াতির তথ্য কোনো অবস্থাতেই তথ্য অধিকার আইন অনুসরণ করে পাওয়া যাবে না। সংবাদকর্মী তার নিজস্ব পদ্ধতিতে এসব ক্ষেত্রে যে তথ্য সংগ্রহ করবেন, তাকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত করার সুযোগ থাকবে। প্রয়োগের বিষয়টি নিয়ে হয়ত আলোচনা করা যাবে, প্রয়োগ হবে না তা তো বলা যাবে না। ৫৭ ধারার উদাহরণ তো আমাদের সামনে আছে।’

বিষয়টি খুব পরিষ্কারভাবেই অনুধাবন করা যায় যে, তথ্য অধিকার আইন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পরস্পর সাংঘর্ষিক নয়, তা বলা যায় না।

তরুণ সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সহজ ভাষায় বাংলাদেশের সংবিধান সম্পাদনাকারী অ্যাডভোকেট আরিফ খান এ বিষয়ে বলেন, ‘তথ্য  অধিকার আইনের প্রাধান্যের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যৌক্তিকতা প্রমাণের কৌশল হিসেবে, গণমাধ্যম বা সংবাদকর্মীদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্যে নয়। তথ্য অধিকার আইন দিয়ে যে অধিকার দেওয়া হয়েছিল, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দিয়ে তার অনেক কিছুই হরণ করা হবে।’

‘জেল দিয়ে মনোবল ভাঙা যাবে না’



জেল দিয়ে সাংবাদিক শহিদুল আলমের মনোবল ভেঙে দেয়া যাবে না। তার সঙ্গে শুক্রবার সাক্ষাৎ শেষে এ কথা বলেছেন তার স্ত্রী রেহনুমা আহমেদ। বাংলাদেশি এই প্রখ্যাত ফটোসাংবাদিক ও অধিকারকর্মী শহিদুল আলমের জেল নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশ ও এর  বাইরে ক্রমেই ক্ষোভ বাড়ছে। অনলাইন আল জাজিরার খবরে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, রেহনুমা আহমেদ বলেছেন, শহিদুল আলমের সাহস, উদ্যম অটুট রয়েছে। তিনি নিয়মিত জগিং করছেন এবং শরীরচর্চা করছেন। তার ভাষায়, তাকে আমি যত তাড়াতাড়ি বই সরবরাহ দিই তার চেয়ে আগেই সে তা পড়ে শেষ করে ফেলছে জেলের ভেতরে। 

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে (আইসিটি) ৫০ দিনেরও বেশি সময় ঢাকার জেলখানায় বন্দি শহিদুল আলম।তার বিরুদ্ধে সরকারের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা ও মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। তিনি ঢাকায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনের ইস্যুতে আল জাজিরা ও ফেসবুক লাইভে বক্তব্য দেয়ার পর পরই গত ৫ই আগস্ট তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। 

শুক্রবার তার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে রেহনুমা আহমেদ আল জাজিরাকে বলেন, তার চোয়ালে ও দাঁতে ব্যথা আছেই। কিছু খাওয়া তার জন্য কঠিন। তুলে নেয়ার আগে তার এমন কোনো সমস্যা কখনোই ছিল না। 

১১ই সেপ্টেম্বর তার জামিন আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন আদালত।
তার আইনজীবী সারা হোসেনের মতে, আদালত বলেছেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে কোনো সাধারণ নাগরিক ফেসবুকে কোনো মন্তব্য বা পোস্ট আপলোড দিতে পারেন না। শুধু একজন রাজনীতিক তা পারেন। আল জাজিরাকে সারা হোসেন বলেছেন, কেন একজন নাগরিককে এভাবে খেয়ালখুশিমতো তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে? এক্ষেত্রে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা হচ্ছে। সারা হোসেন ১লা অক্টোবর উচ্চতর আদালতে শহিদুল আলমের মুক্তির জন্য জামিন আবেদন করতে পারেন। ওদিকে, জেলের ভেতর উন্নত সুবিধা দেয়ার যে আদেশ এর আগে আদালত দিয়েছিলেন সেই নির্দেশকে সরকার চ্যালেঞ্জ করেছে ৫ই সেপ্টেম্বর। এখনো সরকারের ওই আবেদনের বিষয়ে কোনো রুল জারি করেনি আদালত। 

এরই মধ্যে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের বাইরে শহিদুল আলমের মুক্তি দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন তার পরিবারের সদস্যরা, বন্ধুবান্ধব ও বিভিন্ন অধিকার গ্রুপ। বৃহস্পতিবারের এ বিক্ষোভে ছিল বিভিন্ন অধিকার বিষয়ক গ্রুপ, সাংবাদিকদের সংগঠন। বিক্ষোভে অংশ নেন অধিকারকর্মী কেরি কেনেডি, অভিনেত্রী ও অধিকারকর্মী শ্যারন স্টোন, শিক্ষাবিদ ও নারীবাদী গায়ত্রী চক্রবর্তী, স্পিভাক ও শহিদুল আলমের ভাতিজি সোফিয়া করিম। সেখানে সোফিয়া করিম বলেন, ক্রমাগত একনায়কতন্ত্রের দিকে দেশ এগিয়ে যাওয়া গভীর বেদনার। দেশে একটি আতঙ্ক ও নিষ্পেষণের অবস্থা বিরাজ করছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।  

আল জাজিরার খবরে বলা হয়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিরোধীদলীয় ও সরকার বিরোধী অনেক অধিকারকর্মীকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, জোরপূর্বক গুম ও গোপনে বন্দি রাখার ব্যাপক অভিযোগ আছে। এখানে শহিদুল আলম যদি তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগে অভিযুক্ত হন তাহলে তাকে ১৪ বছরের জেল দেয়া হতে পারে। যে আইনে এই শাস্তি দেয়া হবে তাকে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কুখ্যাত বলে আখ্যায়িত করেছে। মঙ্গলবার হিউম্যান রাইটস ওয়াচ একে মুক্ত মত প্রকাশের ওপর আঘাত বলে আখ্যায়িত করেছে। সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস, কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস সহ কয়েক ডজন নাগরিক অধিকার বিষয়ক গ্রুপ এ ইস্যুতে বিবৃতি দিয়েছে। তাতে শহিদুল আলমের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে ভয়াবহভাবে লঙ্ঘন করা হচ্ছে বলে নিন্দা জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে অবিলম্বে ও নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করা হয়েছে তার। 

Abject negligence of doctors and staff

Editorial

Make examples of them


In a recent case of negligence by hospital staff, as reported in this daily last Saturday, a baby's body got severed from its head as nurses and cleaning staff of an upazila health complex were trying to deliver the baby without the presence of a doctor. We are horrified to learn about the incident. And we are rather perplexed at the revelation by the hospital authorities later that the baby had actually died in its mother's womb before the hospital staff attempted the normal delivery. If that was the case, why didn't the doctor, who attended to the patient and performed the ultrasound, reveal it to the patient's family members before the delivery? And even if a normal delivery had to be performed to deliver the baby who was dead, shouldn't it have been done in the presence of a specialised doctor, which is the standard practice?

Words are not enough to describe our frustration over the current state of our healthcare services as we regularly come across news of doctors' negligence, wrong treatment, wrong diagnosis and various types of medical malpractices rampant all across the country. In this particular case, it should be investigated whether the baby was dead before the delivery or if it died due to the medical staff's negligence during the delivery. In addition, the attending doctor should be held responsible for not disclosing the truth to the patient's family in the first place, and also for not being present during the delivery. If we cannot make examples of these doctors and medical staff, such incidents will be repeated, unfortunately.

  • Courtesy: The Daily Star / Sep 30, 2018

সংখ্যালঘুদের জন্য চাই নিরাপদ পরিবেশ

সম্পাদকীয়

নির্বাচন ও মনোনয়ন


গত শুক্রবার বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সমাবেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে যেসব দাবিদাওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেসবের সঙ্গে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই। যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোত্রনির্বিশেষে সব নাগরিক সমান সুযোগ ভোগ করবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ইতিহাস নানা কুটিল ও জটিল পথে পরিচালিত হওয়ায় এই উপমহাদেশে অনেক অস্বাভাবিক ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটেছে, বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়।

উপমহাদেশের প্রতিটি দেশেই ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুরা কমবেশি বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার। এটি সংখ্যালঘুদের জন্য নয়, বরং সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের জন্যই লজ্জার। অন্য কোনো দেশে সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যের প্রতিবাদ তখনই ন্যায্যতা পাবে, যখন আমরা আমাদের সংখ্যালঘুদের প্রতি সুবিচার করতে পারব।

তিনটি সম্প্রদায়ের নামে গড়ে ওঠা ঐক্য পরিষদের সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ভূমিকা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করেন। তাঁদের জানার জন্য বলা প্রয়োজন যে একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে এই সংগঠনটি  গঠিত হয়েছিল। এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৮ সালে যখন রাষ্ট্রধর্ম বিল পাস করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা হয়, তখন সংখ্যালঘুরা ঐক্য পরিষদকে প্রতিবাদ ও আন্দোলনের হাতিয়ার করেন। গত ৩০ বছরে বেশ কয়েকবার সংবিধান পরিবর্তন করা হলেও স্বৈরাচারী শাসকের মস্তিষ্কজাত এই কালো আইনটি এখনো বহাল রয়েছে। পরবর্তী কোনো সরকারই আইনটি বাতিল করতে সাহস পায়নি, যদিও আইন পাসের সময় সব দলের নেতারা এর প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।

শুক্রবারের সমাবেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও নাগরিক সমাজের নেতারা নির্বাচন সামনে রেখে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, এ দেশে নির্বাচন অনেকের কাছে উৎসব হলেও সংখ্যালঘুদের জন্য আতঙ্কের বিষয়। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। তখন ক্ষমতায় ছিল বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট। বর্তমান সরকার সেই ঘটনা তদন্তে একটি বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের মাধ্যমে অপরাধীদের শনাক্ত করলেও কারও বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও রামু, নাসিরনগর, গোবিন্দগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-নির্যাতন হলেও অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতিই সংখ্যালঘুদের গভীর অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। সরকার রামু ও নাসিরনগরে আক্রান্ত মানুষের বাড়িঘর পুনর্নির্মাণ করে দিয়েছে। এটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু অপরাধীরা শাস্তি না পেলে সংখ্যালঘুরা নিজেদের নিরাপদ ভাববে কী করে?

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে উত্থাপিত পাঁচ দফা প্রস্তাবে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা করেছেন কিংবা তাদের জমিজমা দখল করে নিয়েছেন, এ রকম কোনো ব্যক্তিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন না দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। শুধু সংখ্যালঘুদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষার জন্যই নয়, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে হলেও এ ধরনের লোকদের মনোনয়ন দেওয়া যাবে না।

সমাবেশে সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন, আনুপাতিক হারে সংসদে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন ও অর্পিত সম্পত্তি আইনের বাস্তবায়ন, সমতলের আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশন গঠন, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে রূপরেখা প্রণয়নের যে দাবি জানানো হয়েছে, তাকে আমরা ন্যায্য বলে মনে করি।

সংবিধানে ধর্ম-বর্ণ-জাতিনির্বিশেষে সবার সমানাধিকারের যে অঙ্গীকার রয়েছে, তা থেকে রাষ্ট্র সরে যেতে পারে না। সংবিধানে বর্ণিত মানবিক মর্যাদাশীল ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যের অবসান ঘটাতেই হবে।

  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ সেপ্টেম্বর ৩০,২০১৮ 

শুধুই মামলা–জরিমানা, শৃঙ্খলা ফেরেনি সড়কে

রাজধানীর সড়ক নিরাপত্তা

সামছুর রহমান


এত আলোচনার মধ্যেও সড়কে মৃত্যুর মিছিল থেমে নেই। গতকালও বাসের ধাক্কায় মারা গেছেন একজন। রাজধানীর সড়কে চলা দীর্ঘদিনের অনিয়ম তাড়ানোর ঘোষণা দিয়ে মাঠে নেমেছে পুলিশ। গত দুই মাসে ট্রাফিক আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশ আড়াই লাখের বেশি মামলা দিয়েছে । জরিমানা আদায় করেছে প্রায় ১৭ কোটি টাকা। মামলা ও জরিমানা দেদার হলেও সড়কে নৈরাজ্য বন্ধে পুলিশ যেসব উদ্যোগের কথা বলেছিল, সেগুলোর পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে ও নৈরাজ্য বন্ধে পুলিশের পাশাপাশি সরকারের অন্যান্য সংস্থাও নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এসব প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হচ্ছে খুবই কম। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে দেওয়া নির্দেশনাগুলোও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হচ্ছে না। ফলে রাজধানীর সড়কে শৃঙ্খলাও ফেরেনি।

গতকাল শনিবার মহাখালীর জাহাঙ্গীর গেটের কাছে বেপরোয়া বাসের চাপায় মারা গেছেন বেসরকারি ৭১ টেলিভিশনের কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন। এ নিয়ে গত দুই মাসেই রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১৫ জন। তাঁদের প্রায় সবাই মারা গেছেন বাস বা ট্রাকের চাপায়। নিহত ব্যক্তিদের ৭ জন ছিলেন পথচারী এবং ৬ জন মোটরসাইকেল আরোহী।

৪ সেপ্টেম্বর ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া সংবাদ সম্মেলন করে সড়কের অনিয়ম তাড়াতে নানা পরিকল্পনার কথা জানান। তিনি ট্রাফিক আইন প্রয়োগ ও সচেতনতা বাড়াতে সেপ্টেম্বর মাসজুড়ে ট্রাফিক সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন।

ট্রাফিকব্যবস্থার উন্নয়ন এবং নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে গত আগস্ট মাসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি কমিটি করা হয়। কমিটি নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে ৩০টি বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছে। পুলিশ কমিশনারের ঘোষিত উদ্যোগ আর এই কমিটির স্বল্পমেয়াদি নির্দেশনাগুলো একই রকম।

গত চার দিন রাজধানীর আটটি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এসব নির্দেশনার অন্যতম বাস থেকে যত্রতত্র যাত্রী ওঠা-নামা বন্ধ হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে চলন্ত অবস্থায় বাস থেকে যাত্রীদের নামতে বাধ্য করছেন। বাসের পাদানিতে যাত্রীদের ঝুলতে দেখা যায়। চলাচলের সময় অধিকাংশ বাসের দরজা বন্ধ রাখা হচ্ছে না।

বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ‘বাস স্টপেজ শুরু’ এবং ‘বাস স্টপেজ শেষ’ লেখা ছোট বোর্ড লাগিয়েছে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ। গতকাল দুপুরে অগ্রদূত পরিবহনের একটি বাসে টেকনিক্যাল থেকে মহাখালী পর্যন্ত যান এই প্রতিবেদক। পুরো পথে একবারের জন্যও বাসের দরজা বন্ধ করেননি চালকের সহকারী। নির্ধারিত স্টপেজ ছাড়াও অন্তত সাত জায়গা থেকে যাত্রী তোলা হয়। পুলিশের নির্ধারিত কোনো স্টপেজেই দাঁড়াননি চালক।

পদচারী–সেতুর উভয় পাশে ১০০ মিটারের মধ্যে সড়ক পারাপার বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। শ্যামলী এলাকায় দেখা যায়, পদচারী–সেতুর নিচে সড়ক বিভাজকে কোনো প্রতিবন্ধকতা বসানো হয়নি। পথচারীরা যানবাহনের সামনে দিয়ে ঝুঁকি নিয়েই সড়ক পার হচ্ছেন। শিক্ষার্থী, বয়স্ক ব্যক্তি, নারী, শিশু কেউই পদচারী–সেতুর দিকে তাকাচ্ছেও না।

সেখানে কথা হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরাফাত রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘রাস্তা পার হতে বারবার ওপর-নিচ কেন করতে হবে? দিনে ১০ বার রাস্তা পার হতে হলে ১০ বার ওভারব্রিজে ওঠা সম্ভব? নিচ দিয়েই জেব্রা ক্রসিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।’

গণপরিবহনে দৃশ্যমান দুটি জায়গায় চালক ও চালকের সহকারীর ছবিসহ নাম, চালকের লাইসেন্স নম্বর এবং মোবাইল ফোন নম্বর প্রদর্শন নিশ্চিত করতে বলা হয়েছিল। অন্তত ২০টি বাসে ওঠে দেখা যায়, সেগুলোর কোনোটিই মানা হচ্ছে না।

রাজধানীর ফুটপাতগুলো হকারদের দখলে থাকায় পথচারীরা অনেকটা বাধ্য হয়েই মূল সড়কে হাঁটতে বাধ্য হন। ঘোষণা দিলেও ফুটপাতগুলো দখলমুক্ত করতে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বরে পদচারী–সেতুটির চার দিকে সিঁড়ি আছে। কিন্তু প্রতিটি সিঁড়িতে ওঠার মুখের আশপাশে বসেছে জামাকাপড়, জুতা, চশমা, খাবারের দোকান। সিঁড়ির নিচ দিয়ে হাঁটার পথেও বসেছে দোকানপাট।

পুলিশ কমিশনার ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেপ্টেম্বর মাসে গুলিস্তানের জিরো পয়েন্ট থেকে ক্যান্টনমেন্টের জাহাঙ্গীর গেট পর্যন্ত ‘মডেল করিডর’ চালু করা হবে। এ পথে স্বয়ংক্রিয় সংকেতের মাধ্যমে যানবাহন চলাচল করবে এবং সব ধরনের শৃঙ্খলা ও নিয়ম নিশ্চিত করা হবে।

গতকাল দেখা যায়, এই পথে স্বয়ংক্রিয় সংকেতব্যবস্থা চালুই হয়নি। জাহাঙ্গীর গেট, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বিজয় সরণি, ফার্মগেট এলাকার কোনো সংকেত বাতিই জ্বলছে না। দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা হাতের ইশারাতেই যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছেন।

রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোতে লেগুনা বা হিউম্যান হলার চলাচল করতে পারবে না বলে ডিএমপি কমিশনার ঘোষণা দেন। এরপর বেশ কিছু পথে লেগুনা চলাচল বন্ধ রয়েছে। আবার মিরপুরের ৬০ ফুট সড়ক থেকে ফার্মগেট, কামরাঙ্গীরচর থেকে গুলিস্তান, শ্যামলী থেকে ঢাকা উদ্যান পর্যন্ত লেগুনা চলছে। অবশ্য কোনো বিকল্প পরিবহনের ব্যবস্থা না করেই রাজধানীতে লেগুনা বন্ধের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করছেন যাত্রীরা।

তবে মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহীর হেলমেট ব্যবহারের নির্দেশনা অনেকটাই বাস্তবায়িত হয়েছে। এ বিষয়ে পুলিশ যথেষ্ট তৎপর। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে পুলিশের পাশাপাশি গার্ল গাইডস এবং স্কাউট সদস্যরাও পথচারীদের সচেতন করতে কাজ করছেন। এসব মোড়ে পথচারীদের যত্রতত্র সড়ক পারাপার হতে দেওয়া হচ্ছে না। তবে যেখানে স্কাউট সদস্যরা নেই, সেখানে পথচারীরা ঝুঁকি নিয়েই পার হচ্ছেন।

গত ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হন। সেদিন থেকে নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যেই পুলিশের ট্রাফিক সপ্তাহ শুরু হয়। পরে তিন দিন বাড়িয়ে ট্রাফিক সপ্তাহ শেষ হয় ১৪ আগস্ট। এরপর ঈদুল আজহার জন্য অভিযানে বিরতি দেয় পুলিশ। ঈদের পর ২৫ আগস্ট থেকে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ।

গত ১ আগস্ট থেকে গত শুক্রবার (২৮ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত ট্রাফিক আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ট্রাফিক বিভাগ মোট মামলা দিয়েছে ২ লাখ ৫২ হাজার ৯৭৮টি। জরিমানা আদায় করা হয়েছে ১৬ কোটি ৫৭ লাখ ৬২ হাজার ৪৫৯ টাকা।

সবচেয়ে বেশি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে মোটরসাইকেলের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, এই বছরের আগস্ট পর্যন্ত ঢাকায় নিবন্ধিত মোটরসাইকেল আছে ৫ লাখ ২ হাজার ৬৫৮টি। গত দুই মাসে আইন অমান্য করায় ১ লাখ ৩ হাজার ৩৭৪টি মোটরসাইকেলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, গড়ে নিবন্ধিত পাঁচটি মোটরসাইকেলের মধ্যে একটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ। এরপরও মোটরসাইকেলচালকদের শৃঙ্খলায় আনা যাচ্ছে না।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মীর রেজাউল আলম প্রথম আলোকে বলেন, এই নির্দেশনাগুলোর বাস্তবায়ন চলমান প্রক্রিয়া। একেকটি নির্দেশনার সঙ্গে একাধিক সংস্থা জড়িত। নির্দেশনা বাস্তবায়নে সমন্বিতভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। রাতারাতি সব পরিবর্তন সম্ভব নয়। তবে রাজধানীর সড়কে শৃঙ্খলা ফিরছে।

বেপরোয়া গাড়ি চালানো বন্ধ করতে ৯ আগস্ট থেকে চালকদের সঙ্গে চুক্তিতে গাড়ি না চালানোর ঘোষণা দেয় মালিক সমিতি। ফিটনেসবিহীন গাড়িও না চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় তারা।

রাজধানীর বিভিন্ন পথের ১৫টি বাসের চালক ও সহকারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁদের কারও বেতন নির্ধারিত নয়। যত ট্রিপ তত টাকা—এই চুক্তিতে তাঁরা বাস চালাচ্ছেন। এ বিষয়ে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে চলা এই ব্যবস্থা সাত দিনে হয়তো বন্ধ হবে না, কয়েক মাস সময় লাগবে।’

অবশ্য সড়কের নৈরাজ্য বন্ধে সরকারের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে বলে মনে করেন নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সড়কের বিশৃঙ্খলা গুরুতর পর্যায়ে চলে গেছে। এই খাতে প্রচণ্ড রকম দুর্নীতি। তিনি মনে করেন, সড়কে শৃঙ্খলা আনতে হলে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকতে হবে। মালিক, চালক, পথচারী এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আইন মানার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।

  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ সেপ্টেম্বর ৩০,২০১৮ 

মানব অঙ্গের আন্তর্জাতিক বাজারে পাচার হচ্ছে বাংলাদেশী শিশু

তাসনিম মহসিন 

মানব অঙ্গের জন্য প্রথমে ইউক্রেনে পাচার। ওইসব মানব অঙ্গ সেখান থেকে যাচ্ছে ইসরায়েলে। ইউক্রেন থেকে সরবরাহ করা এসব মানব অঙ্গ ইসরায়েল হয়ে চলে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে। মানব অঙ্গ কেনা-বেচার এ আন্তর্জাতিক বাজারে পাচার হচ্ছে বাংলাদেশী শিশুরাও।

বাংলাদেশ থেকে ইউক্রেনে পাচার হওয়া তিন শিশুর বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে এমন ধারণা করছে পোল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাস। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও বলছেন, ইউক্রেনে ওই তিন শিশুকে পাচার করা হয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রির উদ্দেশ্যেই।

জানা গেছে, নওগাঁর একডালা ইউনিয়নের ওই তিন শিশুকে দত্তক নিয়েছিলেন ইউক্রেনের নাগরিক ওস্টাপেনকো ওলেকসি। গত বছরের মাঝামাঝি তাদের নিয়ে যাওয়া হয় ইউক্রেনে। এরপর থেকেই খোঁজ নেই ২০০৬ সালে জন্ম নেয়া এ তিন শিশুর। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, ওলেকসির মাধ্যমে ওই তিন শিশুকে ইউক্রেনে পাচার করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করা হয়েছে ইসরায়েলের বাজারে।

ঘটনার শুরু ২০১৭ সালের আগস্টে, যখন পোল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে তিন শিশুর বিষয়ে প্রথম ঢাকায় তথ্য দেয়া হয়। তিনজনের জন্ম নিবন্ধন সনদ যাচাই করে বেশকিছু অসঙ্গতি খুঁজে পায় দূতাবাস। আর এ জন্ম নিবন্ধন সত্যায়িত করে দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

দূতাবাসের দেয়া তথ্যের বিষয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, অবাক করা বিষয় হলো, প্রতিটি শিশুর বাবার নাম উল্লেখ করা হয়েছে ইউক্রেনের নাগরিক ওস্টাপেনকো ওলেকসির। তিন শিশুর মা-ই মৃত। তাদের সবার বাড়িই নওগাঁ জেলার একডালা ইউনিয়নে। প্রত্যেকের জন্ম ২০০৬ সালের জুন মাসে। সবার জন্মসনদও ইস্যু করা হয়েছে একই সময়ে। জন্মসনদগুলো নোটারি করেছেন একই আইনজীবী। এগুলো একই দিনে প্রথমে আইন মন্ত্রণালয়, পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সত্যায়িত করে দিয়েছে।

তিনজনের মাকেই মৃত দেখানো হয়েছে কেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অপ্রাপ্তবয়স্ক কাউকে বাবার সঙ্গে ইমিগ্রেশন পার হতে মায়ের অনুমতি প্রয়োজন হয়। আবার মায়ের সঙ্গে ইমিগ্রেশন পার হতে প্রয়োজন হয় বাবার অনুমতির। এ কারণেই তিনজনের মাকেই মৃত দেখানো হয়েছে। এতে অনুমতির আর কোনো প্রয়োজন পড়েনি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ তিন শিশু পাচারের সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ইউক্রেনের নাগরিক মো. ফয়জুল খক। ইউক্রেনের পাসপোর্টধারী (এফবি ৬৯০৯৭০) মো. ফয়জুল খকের জন্ম সিলেটে বলে বাংলাদেশ দূতাবাসকে জানিয়েছে ইউক্রেনের পুলিশ।

পাসপোর্টে উল্লেখিত তথ্য অনুযায়ী, তার জন্ম ১৯৭৫ সালের ২ এপ্রিল। ইউক্রেনের পাসপোর্ট পেতে তিন শিশুর জন্ম নিবন্ধন সনদ দেশটির সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ে জমা দেয় ফয়জুল খকই। যাচাইয়ের জন্য বাংলাদেশ দূতাবাসে জন্মসনদগুলো পাঠালে তখনই এ শিশুদের পাচারের বিষয়টি সামনে আসে।

ইউক্রেনের আইন অনুযায়ী, দেশটিতে পাসপোর্ট তৈরি করতে সশরীরে উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। তবে অপ্রাপ্তবয়স্ক হলে তার আইনানুগ অভিভাবক সেটি তৈরি করতে পারেন। এক্ষেত্রে অপ্রাপ্তবয়স্কের উপস্থিতির প্রয়োজন পড়ে না।

কূটনৈতিক কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্বব্যাপী মানব অঙ্গের কেনা-বেচার অবৈধ বাজার হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ইউক্রেন। এসব মানব অঙ্গের সবচেয়ে বড় ক্রেতা ইসরায়েল। ইউক্রেন থেকে সরবরাহ করা মানব অঙ্গ ইসরায়েল থেকে পরবর্তী সময়ে ইউরোপের বাজারে যায়। বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়া ১২ বছর বয়সী ওই শিশুদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেয়া সম্ভব নয়। গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জন্যই তাদের পাচার করা হয়েছে।

গত বছরের মার্চে প্রকাশিত গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির ‘ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম অ্যান্ড দ্য ডেভেলপিং ওয়ার্ল্ড’ শীর্ষক প্রতিবেদনেও ইসরায়েলকে মানব অঙ্গ কেনা-বেচার বড় বাজার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, অবৈধ কিডনির সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী ও গ্রহণকারী ইসরায়েল। অবৈধ কিডনির সবচেয়ে বেশি মূল্যও পাওয়া যায় দেশটিতে। ইসরায়েলে প্রতিটি কিডনির খুচরা মূল্য হয়ে থাকে ১ লাখ থেকে ১ লাখ ৭৫ হাজার ডলার পর্যন্ত।

ইউক্রেনে মানব অঙ্গের জন্য বাংলাদেশ থেকে মানব পাচারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কনসুলার ও ওয়েলফেয়ার উইংয়ের মহাপরিচালক নাহিদা রহমান সুমনা। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, এটি একটি ভয়াবহ অপরাধ। যারা এর সঙ্গে জড়িত, তারা সবাই অপরাধী। যে জন্মসনদগুলো তৈরি করা হয়েছে, তার তদন্ত হওয়া জরুরি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নওগাঁ জেলার একডালা ইউনিয়নে মো. নয়ন আলী, মো. রায়হান আলী এবং মো. লিখন আলীর নামে জন্ম নিবন্ধন সনদে নোটারি এবং সত্যায়িত করেছে আইন ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে মো. নয়ন আলীর (জন্মসনদ নং: ২০০৬৬৪১৮৫২১০২৩৫২১, রেজিস্ট্রেশন নং: ০১) নিবন্ধনের তারিখ ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর, মো. রায়হান আলীর (জন্মসনদ নং: ২০০৬৬৪১৮৫২১০২২৫০২, রেজিস্ট্রেশন নং: ০৫) নিবন্ধনের তারিখ একই বছরের ২৩ ডিসেম্বর এবং মো. লিখন আলীর (জন্মসনদ নং: ২০০৬৬৪১৮৫২১০০৫৫১৫, রেজিস্ট্রেশন নং: ০২) নিবন্ধনের তারিখ ওই বছরের ২৫ ডিসেম্বর।

জন্মসনদে মো. নয়ন আলীর মায়ের নাম উল্লেখ করা হয়েছে মৃত খাতুন বিবি, মো. রায়হান আলীর মৃত মনোয়ারা বেগম ও মো. লিখন আলীর মৃত কদুজান বিবি। জন্মসনদে একডালা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. রেজাউল ইসলাম ও সচিব মো. আবদুল হাকিমের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। ২০১৩ সালে মো. আবদুল হাকিম ইউনিয়ন পরিষদের সচিব থাকলেও মো. রেজাউল ইসলাম চেয়ারম্যান ছিলেন না। ২০১৩ সালে একডালার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন মো. মোসারব হোসেন প্রামাণিক। জন্ম নিবন্ধন সনদে সচিব মো. আবদুল হাকিমের যে স্বাক্ষর ব্যবহার করা হয়েছে, তাও জাল। পাচারের জন্য যেসব জন্মসনদ ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলোর নিবন্ধন নম্বর যাচাই করে দেখা গেছে, কোনো কোনোটির ক্ষেত্রে প্রকৃত ব্যক্তির নাম ব্যবহার করা হলেও অন্য সব তথ্য পরিবর্তন করা হয়েছে। আবার কোনোটির ক্ষেত্রে নামসহ সব তথ্যই পরিবর্তন করা হয়েছে।

বাংলাদেশ পুলিশের ইমিগ্রেশন শাখার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, মো. ফয়জুল খক ইউক্রেনের পাসপোর্ট ব্যবহার করে কখনো বাংলাদেশে প্রবেশ করেননি। এমনকি বাইরেও যাননি। তার ইউক্রেনের পাসপোর্ট বাংলাদেশের কোনো ইমিগ্রেশনে ব্যবহার হয়নি। কারণ ইউক্রেনের পাসপোর্ট ব্যবহার করে বাংলাদেশে প্রবেশ করলে অন-অ্যারাইভাল ভিসায় ৫১ ডলারের ফি প্রদান করতে হয়। এক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশী পাসপোর্ট ব্যবহার করেছেন।

জাল জন্মসনদ তৈরি ও তা সত্যায়িত করার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্টরা সবাই একে অন্যের ওপর দায় চাপান। জন্মসনদ তিনটি সত্যায়িত করতে কে এসেছিল, জানতে চাইলে পররাষ্ট্র বা আইন মন্ত্রণালয়ের কেউ তা বলতে পারেননি।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শুধু আইন মন্ত্রণালয়ের যাচাই ও সই সত্যায়িত করে। মন্ত্রণালয়ে আসা কোনো ধরনের সার্টিফিকেটের কনটেন্ট সত্যায়িত করে না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সত্যায়িতর জন্য যে সিলটি ব্যবহার করে, সেখানে বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, পাসপোর্টের ক্ষেত্রে আমরা যাচাইয়ের জন্য যেভাবে সিস্টেমে প্রবেশ করতে পারি, অন্য সেবাগুলো দেয়ার ক্ষেত্রে সে সুযোগ নেই। ফলে আমাদের অন্য নথিগুলো আসল কিনা, তা যাচাইয়ের সুযোগ নেই। ফলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সত্যায়িতর ওপরই নির্ভর করতে হয় আমাদের।

যিনি নোটারি করেন মূলত তাকে যাচাইয়ের কাজটি আইন মন্ত্রণালয় করে থাকে বলে জানান মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের এক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, যেসব আইনজীবী নোটারি করেন, তাদের নিবন্ধন নিতে হয় আইন মন্ত্রণালয় থেকে। ফলে তারা যখন সত্যায়িত করেন, তখন তাদের সত্যায়িত অনুলিপির ওপর ভিত্তি করেই মন্ত্রণালয় এগুলোকে সত্যায়িত করে। আইন মন্ত্রণালয়ের সিলেও যিনি নোটারি করেছেন, তাকেই সত্যায়িত করার বিষয়টি উল্লেখ থাকে।

তিনটি জন্মসনদের সত্যতা যাচাই করেছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ আজিমুল হক চৌধুরী। ঢাকার কোর্ট হাউজ স্ট্রিটে তার চেম্বারে গিয়ে জানা গেছে, নোটারি করতে আসা কোনো গ্রাহকেরই কোনো রেজিস্টার রাখা হয় না। নোটারি করতে শুধু মূল কাগজ নিয়ে আসতে হয়। সে নথির সত্যতা যাচাইয়ের কোনো ব্যবস্থা তাদের নেই।

নোটারির রেজিস্টার নিয়ে প্রশ্ন করলে অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ আজিমুল হক চৌধুরী বলেন, নোটারি কে করিয়ে গেছে, সে তথ্য সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই আমাদের। তবে নোটারি করতে আমরা শুধু মূল নথিটি নিয়ে আসতে বলি। আর নোটারির সময় সে নথির সত্যতা যাচাইয়ের কোনো সুযোগ আমাদের নেই। কারণ শুধু জন্মসনদ নিয়েই যদি বলি, এখনো সব জন্মসনদ সরকারি ডাটাবেজে সংরক্ষিত নেই।

প্রতিবেদক বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে বিভিন্ন নোটারি পাবলিক অফিসের দপ্তরে নোটারি করার জন্য প্রয়োজনীয় নথি সম্পর্কে খোঁজ নিতে যান। বেশির ভাগ নোটারি পাবলিক অফিসের দপ্তর থেকে প্রথমে বিভিন্ন কাগজ নিয়ে আসার কথা জানানো হয়। পরক্ষণেই কাগজ না থাকলেও কিছু টাকা বেশি খরচ করে নোটারি করার প্রস্তাব এসেছে। এ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী বলেন, নিয়ম হচ্ছে সব কাগজ যাচাই করে দেখা। একই সঙ্গে রেজিস্টার রাখা। এসব নিয়ম কিছু আইনজীবী পরিপালন করলেও বেশির ভাগ আইনজীবীই এ ধরনের ঝামেলায় যান না। ফলে হরহামেশাই ভুয়া নথিতে নোটারির সিল পড়ে।

  • ** প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন নওগাঁ প্রতিনিধি এবাদুল হক।
  • কার্টসিঃ বনিক বার্তা / সেপ্টেম্বর ৩০,২০১৮ 

Finalising design of new oil refinery in slow lane

M Azizur Rahman

The government's plan to build a new crude oil refinery is facing a setback as its design could not be finalised over the past three years. The project has remained in the slow lane owing to inadequate funding, bureaucratic bottlenecks and less priority, a senior official of the Ministry of Power, Energy and Mineral Resources told the FE.

French firm Technip had signed a memorandum of understanding (MOU) with state-run Bangladesh Petroleum Corporation (BPC) on November 11, 2015 to build the refinery aiming to treble the country's crude oil refining capacity to 4.5 million tonnes per year from existing 1.5 million tonnes per year, he said.

Technip subsequently sent technical and financial offers to the BPC on December 20, 2015 to implement the project.

Technip initially had offered to arrange US$ 600 million French credit for the project and pledged to help collect the remaining amount to implement the project from other commercial sources, a senior BPC official said.

The estimated project cost of the refinery is Tk 89.49 billion (US$1.15 billion).

The project faced an initial setback in March 2016 when Technip backed out of its initial plan to fund the project.

The French company then intended to get the job as an engineering, procurement and construction (EPC) contractor through a negotiation with the government bypassing the tender process, he added.

It was only the lack of funding, which delayed installation of a new refinery in over a decade, said the official.

To expedite the project work, the BPC on April 19, 2016 assigned Indian consulting firm Engineers India Limited (EIL) as the project management consultant (PMC) to implement the project.

The BPC would have to pay around Tk 1.61 billion to the EIL against the PMC fees, which include US$ 16.54 million plus Tk 82.28 million inclusive of local taxes, within three years.

The corporation on January 18, 2017 assigned Technip to carry out the front end engineering and design (FEED) for the proposed refinery at a cost worth Tk 2.57 billion (US$ 32.10 million), the BPC official said.

But the state-run national oil corporation had not arranged any financier yet to implement the project, he lamented.

As per the contract, Technip submitted a draft of the final FEED over the refinery project in March, 2018.

The BPC along with Indian EIL, has been reviewing the FEED before its finalisation, said the BPC official.

Once implemented, the new refinery could help the country save $220 million every year, BPC officials said.

Currently, Bangladesh imports around 7.50 million tonnes of crude and refined petroleum products combined every year to meet the local demand.

BPC arranged land for the refinery through purchasing from the Ministry of Industries for Taka 2.30 billion.

Officials said the refinery could enable the country to process any kind of crude oil and it might put Bangladesh on the path to becoming a refined petroleum products-exporting country.

Nepal has already shown interest to import refined petroleum products from Bangladesh and agreed to ink an MoU in this regard, he said. The surplus finished petroleum products can be exported to Sri Lanka, Bhutan, Myanmar and the north eastern parts of India as well, the officials said.

A consortium of three French companies led by Technip had installed the first unit of the ERL, which is also the country's sole refinery, having the crude oil refinery capacity of 1.5 million tonnes per year in the port city of Chittagong.

The first unit started commercial operations in 1968 with 30 years of economic life.

The first unit is still in operation having a de-rated capacity of around 1.4 million tonnes a year.

  • Courtesy: The Financial Express /Sep 30, 2018

সম্পাদক পরিষদের ব্যাখ্যা — কেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরোধিতা করছি

জাতীয় সংসদে সদ্য পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে নিচের মৌলিক ত্রুটিগুলো রয়েছে 


১. ডিজিটাল যন্ত্রের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটন প্রতিহত করা এবং ডিজিটাল অঙ্গনে নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়নের চেষ্টা করতে গিয়ে এমন একটি আইন করা হয়েছে, যা সংবাদমাধ্যমের কাজের ওপর নজরদারি, বিষয়বস্তুর ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং আমাদের সংবিধানপ্রদত্ত সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং নাগরিকদের বাক্‌ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণের সুযোগ সৃষ্টি করবে।

২. এই আইন পুলিশকে বাসাবাড়িতে প্রবেশ, অফিসে তল্লাশি, লোকজনের দেহ তল্লাশি এবং কম্পিউটার, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, সার্ভার ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম-সংক্রান্ত সবকিছু জব্দ করার ক্ষেত্রে সীমাহীন ক্ষমতা দিয়েছে। পুলিশ এ আইনে দেওয়া ক্ষমতাবলে পরোয়ানা ছাড়াই সন্দেহবশত যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে পুলিশের কোনো কর্তৃপক্ষের কোনো ধরনের অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন নেই।

৩. এই আইনে অস্পষ্টতা আছে এবং এতে এমন অনেক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যার ভুল ব্যাখ্যা হতে পারে এবং সহজেই সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যেতে পারে।

৪. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এমন এক আতঙ্ক ও ভীতির পরিবেশ তৈরি করবে, যেখানে সাংবাদিকতা, বিশেষত অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়বে।

৫. এই আইন সংবাদমাধ্যমের কর্মী ছাড়াও কম্পিউটার ও কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ইত্যাদি ব্যবহারকারী সব ব্যক্তির মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করবে।

২০০৬ সালে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন (আইসিটি অ্যাক্ট) প্রণীত হওয়ার সময় সরকার বলেছিল, সাংবাদিকদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই; কারণ, আইনটি করা হয়েছে সাইবার অপরাধ ঠেকানো ও সাইবার অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার লক্ষ্যে। বাস্তবতা হলো, সাংবাদিকসহ অন্য যাঁরা স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার চর্চা করতে গেছেন, তাঁরা তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় কারাভোগ করেছেন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। এখনো একইভাবে বলা হচ্ছে যে সাংবাদিকদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ ঘটেনি, কিন্তু আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে যে এই আইনেও সাংবাদিকেরা আবার একই ধরনের হয়রানির মুখোমুখি হবেন। আইনটির প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, এ আইনের উদ্দেশ্য ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ শনাক্তকরণ, প্রতিরোধ, দমন, বিচার’ করা। তাই এ আইন নিয়ে আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু সমস্যা হলো, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তার সংজ্ঞায়িত পরিধি অনেক দূর ছাড়িয়ে গিয়ে সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকতার পরিধির মধ্যে ঢুকে পড়েছে। এই আইন স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রকৃতির পরিপন্থী এবং তা অনুশীলনের প্রতিকূল, যে সাংবাদিকতা জনগণের জানার অধিকার সুরক্ষা করে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতি জনসমক্ষে উন্মোচন করে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কাজ ডিজিটাল প্রযুক্তির জগৎ নিয়ে, যে জগৎ অবিরাম বিকশিত হয়ে চলেছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি জীবনের সর্বস্তরে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা থেকে খাদ্য উৎপাদন, স্বাস্থ্যসেবা, আর্থিক লেনদেন পর্যন্ত সর্বত্রই ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রবেশ ঘটেছে। সংবাদমাধ্যমও এর বাইরে নেই।

অন্য ক্ষেত্রগুলোতে প্রয়োজন ‘নিয়ন্ত্রণ’, কিন্তু সংবাদমাধ্যমের প্রয়োজন ‘স্বাধীনতা’। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কেন্দ্রীয় বিষয় কেবলই ‘নিয়ন্ত্রণ’, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা এতে পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে। এটা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অন্যতম মৌলিক ত্রুটি, এর ফলে এ আইন সংবাদমাধ্যমের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একটা ভীতিকর দিক হলো, এতে পুলিশকে এমন অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যার বলে একজন সাংবাদিক ভবিষ্যতে তথাকথিত কোনো অপরাধ করতে পারেন কেবল এই সন্দেহে পুলিশ তাঁকে প্রেপ্তার করতে পারবে। পুলিশকে পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলো জামিন অযোগ্য। এর ফলে সাংবাদিকতা বাস্তবত পুলিশের নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়বে।

উদ্বেগের আরও একটি বিষয় হলো, এ আইনের অপরাধ ও শাস্তি–সংক্রান্ত প্রায় ২০টি ধারার মধ্যে ১৪টি জামিন অযোগ্য, ৫টি জামিনযোগ্য এবং একটি সমঝোতাসাপেক্ষ। ন্যূনতম শাস্তির মেয়াদ করা হয়েছে ১ বছর কারাদণ্ড, সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শাস্তির মেয়াদ ৪ থেকে ৭ বছর কারাদণ্ড। এর ফলে অনিবার্যভাবে একটা ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি হবে, যেখানে সাংবাদিকতার স্বাভাবিক অনুশীলন অসম্ভব না হলেও হয়ে উঠবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

আইনটি তার উদ্দেশ্যের সীমানা অনেক দূর পর্যন্ত কেবল লঙ্ঘনই করেনি, এটি অস্পষ্টতায়ও পরিপূর্ণ। অস্পষ্টতার কারণে এ আইন অপব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। দেশ–বিদেশের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, যেসব আইনের শব্দচয়ন সুস্পষ্ট, যেখানে অপরাধগুলো সুনির্দিষ্ট এবং অপরাধের সঙ্গে শাস্তির মাত্রা সামঞ্জস্যপূর্ণ, সেসবের মাধ্যমে ‘আইনের শাসন’ ভালোভাবে অর্জিত হয়। আইনের ভাষাগত অস্পষ্টতা থেকে অপরাধ সম্পর্কে ভুল ব্যাখ্যা এবং আইনের অপব্যবহারের সুযোগ ঘটে থাকে। যখন আইনের অপব্যবহার ঘটে, তখন স্বাধীনতা খর্বিত হয়।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আরেক ত্রুটি হলো ‘অপরাধীদের’ শাস্তির মাত্রা নির্ধারণের বিষয়টি। এ প্রসঙ্গে একই সময়ে পাস করা সড়ক নিরাপত্তা আইনের কথা বলা যায়। এ আইনে দুর্ঘটনায় মানুষ মেরে ফেলার সর্বোচ্চ শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ বছরের কারাদণ্ড। আর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিধান করা হয়েছে, ঔপনিবেশিক আমলের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট (১৯২৩) লঙ্ঘনের জন্য সাংবাদিকদের যাবজ্জীবন পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। কোনো সাংবাদিক তাঁর মোবাইল ফোনে অপ্রকাশিত কোনো সরকারি নথির ছবি তুললে অপরাধী বলে গণ্য হবেন, অথচ এটি আজকাল খুবই সাধারণ একটি চর্চা।


বিশদ ব্যাখ্যা

সম্পাদক পরিষদ মনে করে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মুক্ত সংবাদমাধ্যমের পরিপন্থী, বাক্স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরোধী এবং গণতন্ত্রের সঙ্গে বিরোধাত্মক। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যেসব ধারাকে আমরা সবচেয়ে বিপজ্জনক বলে মনে করছি, নিচে তা হুবহু তুলে ধরলাম। একই সঙ্গে সেসব নিয়ে আমাদের অবস্থানের বিশদ বিশ্লেষণ তুলে ধরলাম।

ধারা ৮

৮। কতিপয় তথ্য-উপাত্ত অপসারণ বা ব্লক করিবার ক্ষমতা।—
(১) মহাপরিচালকের নিজ অধিক্ষেত্রভুক্ত কোনো বিষয়ে ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত ডিজিটাল নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি সৃষ্টি করিলে তিনি উক্ত তথ্য-উপাত্ত অপসারণ বা ক্ষেত্রমত, ব্লক করিবার জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে, অতঃপর বিটিআরসি বলিয়া উল্লিখিত, অনুরোধ করিতে পারিবেন।

(২) যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিকট প্রতীয়মান হয় যে, ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত দেশের বা উহার কোনো অংশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুণ্ন করে, বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণার সঞ্চার করে, তাহা হইলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উক্ত তথ্য-উপাত্ত অপসারণ বা ব্লক করিবার জন্য মহাপরিচালকের মাধ্যমে, বিটিআরসিকে অনুরোধ করিতে পারিবেন।

(৩) উপ-ধারা (১) ও (২)–এর অধীন কোনো অনুরোধ প্রাপ্ত হইলে বিটিআরসি, উক্ত বিষয়াদি সরকারকে অবহিতক্রমে, তাৎক্ষণিকভাবে উক্ত তথ্য-উপাত্ত অপসারণ বা ক্ষেত্রমতো, ব্লক করিবে।

সম্পাদক পরিষদের মন্তব্য

এখানে দুটি উদ্বেগের বিষয় রয়েছে। একটি মহাপরিচালকের (ডিজি) ক্ষমতা, অন্যটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর ক্ষমতা। প্রকাশের বিষয়বস্তু ব্লক করার ক্ষমতা মুদ্রিত বা অনলাইন যেকোনো প্রকাশনার অন্তরাত্মাকে আঘাত করবে। কোনো সংবাদমাধ্যমের যেকোনো প্রতিবেদন ব্লক করা যাবে, যেকোনো আলোকচিত্র জব্দ করা যাবে—এভাবে সংবাদমাধ্যমটির স্বাভাবিক কাজ বিঘ্নিত হবে।

প্রকাশিত বিষয়বস্তু অপসারণ বা ব্লক করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় যৌক্তিক্তা  আইনটিতে এত অস্পষ্ট যে তা নানা ব্যক্তি নানাভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন। এতে আইনটির অপব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, কোনো প্রকল্পে দুর্নীতির খবর প্রকাশ করার ফলে যদি সেটার অর্থায়নকারী বা কোনো বিনিয়োগকারী অর্থায়ন বন্ধ করে দেন, তাহলে এ আইনের অধীনে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক ‘অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিঘ্ন সৃষ্টি করা’র দায়ে অভিযুক্ত হতে পারেন এবং তা ওই খবর ব্লক বা অপসারণ পর্যন্ত গড়াতে পারে।


ধারা ২১

২১। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণার দণ্ড।—
(১) যদি কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণা চালান বা উহাতে মদদ প্রদান করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।


সম্পাদক পরিষদের মন্তব্য

আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মর্যাদা ও সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণের প্রতি পরিপূর্ণভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ এবং অতীতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা উপলব্ধি করি যে এ বিষয়ে কিছু করা প্রয়োজন। তবে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ খুবই অস্পষ্ট একটি শব্দবন্ধ। কী কী করলে তা এই ধারার অধীনে ‘অপরাধ’ বলে গণ্য হবে, তা সুস্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট না করায় এবং ‘অপরাধগুলো’কে আরও সংজ্ঞায়িত না করায় এই আইনের গুরুতর অপব্যবহার ও সাংবাদিকদের হয়রানির ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, এর শাস্তি হিসেবে রাখা হয়েছে যাবজ্জীবন পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং/অথবা ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডের বিধান।

আমরা আবারও বলতে চাই, আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মহান উত্তরাধিকার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংক্ষরণ করতে চাই। তবে আইন প্রণয়নের সময় আমাদের তা খুব স্বচ্ছ ও সুনির্দিষ্ট করতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এখন যে অবস্থায় আছে, তা শুধু সাংবাদিকদের জন্যই ভোগান্তিমূলক হবে না, ইতিহাসবিদ, গবেষক, এমনকি কথাসাহিত্যিকদের মতো সৃজনশীল লেখকদেরও দুর্ভোগের কারণ হতে পারে। এমনকি ভুল ব্যাখ্যা এবং সম্ভাব্য শাস্তির ভয়ে অনেকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বেশি লেখালেখিও করতে চাইবেন না।

ধারা ২৫

২৫। আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শক, তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ ইত্যাদি।—(১) যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে।—

(ক) ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে, এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ করেন, যাহা আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শক অথবা মিথ্যা বলিয়া জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয় প্রতিপন্ন করিবার অভিযোগে কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা প্রচার করেন, বা

(খ) রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ন করিবার, বা বিভ্রান্তি ছড়াইবার, বা তদুদ্দেশ্যে অপপ্রচার বা মিথ্যা বলিয়া জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও, কোনো তথ্য সম্পূর্ণ বা আংশিক বিকৃত আকারে প্রকাশ, বা প্রচার করেন বা করিতে সহায়তা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।


সম্পাদক পরিষদের মন্তব্য

এই ধারা সংবাদমাধ্যমে সব ধরনের অনুসন্ধানী রিপোর্টিংকে সরাসরি বিরূপভাবে প্রভাবিত করবে। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম–সংক্রান্ত ঘটনা নিয়েই এ ধরনের প্রতিবেদন করা হয়ে থাকে। দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা সাংবাদিক ও সংবাদপ্রতিষ্ঠানকে ভয় দেখাতে এই আইন ব্যবহার করতে পারেন। তাঁরা এই অজুহাত দেখিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন যে ওই প্রতিবেদনে তাঁদের আক্রমণ করা বা হুমকি দেওয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের সব প্রতিবেদনই উল্লিখিত এক বা একাধিক বিধানের আওতায় পড়ে বলে মন্তব্য করা হতে পারে এবং সংবাদমাধ্যমকে হয়রানির কাজে ব্যবহার করা হতে পারে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি উন্মোচন করে, এমন যেকোনো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জন্য ‘বিরক্তিকর’, ‘বিব্রতকর’ বা ‘অপমানজনক’ হতে পারে। এই বিধান কোনো দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি সম্পর্কে নেতিবাচক প্রতিবেদন প্রকাশ অসম্ভব করে তুলবে।

এটি সংবাদপত্রকে জনসংযোগ প্রতিষ্ঠানে পর্যবসিত করবে। এমনকি সাংবাদিকতার সাধারণ অনুসন্ধানও অসম্ভব হয়ে পড়বে।

দ্বিতীয় ধারায় ‘বিভ্রান্তি ছড়ানো’র কথা বলা হয়েছে। বিভ্রান্তি ছড়ানো বলতে কী বোঝানো হয়েছে, তা সুনির্দিষ্ট করা না হলে এই ধারা সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের হয়রানি করার হাতিয়ারে পরিণত হবে। একজনের কাছে যা বিভ্রান্তিমূলক, আরেকজনের কাছে তা না–ও হতে পারে। সংবাদমাধ্যমকে ভয় দেখানোর জন্য এটি নিশ্চিতভাবেই নতুন একটি পথ তৈরি করবে।

রাষ্ট্রের ‘ভাবমূর্তি ও সুনাম’ ক্ষুণ্ন করা বলতে কী বোঝায়? সম্প্রতি আমরা ব্যাংক খাতে বিভিন্ন বিবেকহীন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর দুর্নীতির খবর পরিবেশন করেছি। সেসব প্রতিবেদনের মাধ্যমে আমরা জনগণকে জানিয়েছি যে ব্যাংক খাত গুরুতর সংকটে পড়েছে। এতে কি ‘ভাবমূর্তি’ ক্ষুণ্ন হয়েছে? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে দুর্নীতি নিয়ে আমরা সংবাদ পরিবেশন করেছি। আমরা ‘হেফাজতে মৃত্যু’, ‘গুম’ ও ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’ নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করেছি। কেউ যদি ব্যাখ্যা করেন যে এসব প্রতিবেদন রাষ্ট্রের ‘ভাবমূর্তি’ ক্ষুণ্ন করেছে, তাহলে এই আইন এ ধরনের সংবাদ পরিবেশন করায় সাংবাদিক ও সংবাদপত্রগুলোকে শাস্তি দেওয়ার বৈধতা দেয়। কারণ, প্রায় সব সংবাদপত্রেরই নিজস্ব ওয়েবসাইট ও অনলাইন পোর্টাল রয়েছে।

ধারা ২৮

২৮। ওয়েবসাইট বা কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কোনো তথ্য প্রকাশ, সম্প্রচার, ইত্যাদি।—
(১) যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করিবার বা উসকানি প্রদানের অভিপ্রায়ে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা প্রচার করেন বা করান, যাহা ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর আঘাত করে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।


সম্পাদক পরিষদের মন্তব্য

‘ধর্মীয় মূল্যবোধ’ একটি অস্পষ্ট পরিভাষা। একজন সাংবাদিক কীভাবে জানবেন কখন ও কীভাবে ধর্মীয় মূল্যবোধ আহত হয়েছে? এই পরিভাষা বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যায় এবং কোনো সাংবাদিকই এ ধরনের বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে স্বস্তিবোধ করবেন না। এটি সমাজের বড় একটি অংশে সাংবাদিকতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নিরীক্ষণ বাধাগ্রস্ত করবে। বহির্বিশ্বে ক্যাথলিক ধর্মযাজকদের যৌন হয়রানির অভিযোগ নিয়ে সাম্প্রতিক প্রতিবেদনগুলো প্রকাশ করা সম্ভব হতো না, যদি ওই সব দেশে ধর্মীয় অনুভূতিতে ‘আঘাত’ করে, এমন সংবাদ প্রকাশ রুখতে আইন থাকত। বেআইনি ফতোয়া ও সম্পত্তিতে নারীর অধিকার নিয়ে আলোচনা করাও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি আঘাত হিসেবে ব্যাখ্যা করা হতে পারে। এই ধারা সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের হয়রানি করতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে পারে।

ধারা ২৯

২৯। মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, প্রচার, ইত্যাদি।—
(১) যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে Penal Code (Act XLV of 1860)-এর section 499-এ বর্ণিত মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করেন, তজ্জন্য তিনি অনধিক ৩ (তিন) বৎসর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

সম্পাদক পরিষদের মন্তব্য

মানহানির অভিযোগ বিচার করার জন্য ইতিমধ্যেই একটি আইন থাকায় ডিজিটাল মাধ্যমে মানহানি নিয়ে আলাদা কোনো আইন নিষ্প্রয়োজন। উপরন্তু একই অপরাধে পত্রিকার চেয়ে ডিজিটাল সংবাদমাধ্যমে অতিরিক্ত শাস্তির যুক্তি থাকতে পারে না।

ধারা ৩১

৩১। আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো, ইত্যাদির অপরাধ ও দণ্ড।—
(১) যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যাহা সংশ্লিষ্ট শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা ঘটিবার উপক্রম হয়, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।

সম্পাদক পরিষদের মন্তব্য

দলিত বা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য এবং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর ওপর কোনো শোষণ সম্পর্কে পরিবেশিত একটি সংবাদ–প্রতিবেদনের এমন ব্যাখ্যা দেওয়া হতে পারে যে সেটি বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের দুঃখকষ্ট তুলে ধরে লেখা প্রতিবেদন এভাবে ব্যাখ্যা করা হতে পারে যে তাতে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করবে। একইভাবে সম্ভাব্য শ্রমিক অসন্তোষ, আসন্ন হরতাল বা বিক্ষোভ সমাবেশ নিয়ে পরিবেশিত সংবাদ ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিকারী’ প্রতিবেদন হিসেবে গণ্য হতে পারে এবং এই আইনের আওতায় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে। এমন খবর পরিবেশিত হতে পারে যে কোনো বিক্ষোভের সময় এক ব্যক্তি মারা গেছেন, পরে জানা যেতে পারে যে খবরটি সত্য নয়। তাহলে কি সংবাদমাধ্যম ‘গুজব ছড়ানো’র অপরাধ করবে? সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে এ রকম ভুল হয়, কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে ভুলের সংশোধনীও প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, এমনকি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির সংখ্যায় হেরফের হয়। সরকারি পরিসংখ্যানের সঙ্গে সব সময়ই বেসরকারিভাবে সংগৃহীত তথ্যের অমিল থাকে। এ ধরনের ঘটনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী ‘গুজব ছড়ানোর’ অভিযোগে সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে। কখনো কখনো আমরা কিছু পূর্বাভাসমূলক খবরও পরিবেশন করতে পারি, যা পরে ঠিক সেভাবেই না–ও ঘটতে পারে। এ ধরনের প্রতিবেদনও ‘গুজব ছড়ানো’ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এভাবে দেখতে পাচ্ছি, এই ধারা স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য গুরুতর ঝুঁকির সৃষ্টি করবে।

ধারা ৩২

৩২। সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অপরাধ ও দণ্ড।—
(১) যদি কোনো ব্যক্তি Official Secrets Act, 1923 (Act No. XIX of 1923)-এর আওতাভুক্ত কোনো অপরাধ কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটন করেন বা করিতে সহায়তা করেন, তাহা হইলে তিনি অনধিক ১৪ (চৌদ্দ) বৎসর কারাদণ্ড, বা অনধিক ২৫ (পঁচিশ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

(২) যদি কোনো ব্যক্তি উপধারা (১)–এ উল্লেখিত অপরাধ দ্বিতীয়বার বা পুনঃ পুনঃ সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বা অনধিক ১ (এক) কোটি টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

সম্পাদক পরিষদের মন্তব্য

অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ঔপনিবেশিক আমলের ব্যাপক নিয়ন্ত্রণমূলক আইন, যা ব্রিটিশ প্রশাসনকে সব ধরনের জবাবদিহি থেকে রক্ষা করার জন্য প্রণয়ন করা হয়েছিল। আমরা মর্মাহত হয়ে সেটিকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে টেনে আনতে দেখলাম। সরকার যা প্রকাশ করে না, তা-ই ‘সরকারি গোপন তথ্য’ বলে বিবেচিত হতে পারে। একটি উদাহরণ দিই। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আমরা ব্যাংক খাতের অনিয়ম সম্পর্কে কয়েক ডজন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছি। বলা হতে পারে, এ ধরনের সব প্রতিবেদনই অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট লঙ্ঘন করেছে। প্রকাশ করা হয়নি, এমন সব সরকারি প্রতিবেদনই অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের আওতায় পড়ে, এমনকি পরিবেশদূষণ বা শিশুপুষ্টি নিয়ে সরকারি প্রতিবেদন ইত্যাদিও। এ ধরনের কোনো তথ্য ছাড়া কি অর্থপূর্ণ সাংবাদিকতা সম্ভব? আর যেখানে তথ্য অধিকার আইনের বলে জনগণের ‘জানার অধিকার’ রয়েছে—বিশেষত যখন এ ধরনের সব প্রতিবেদন তৈরি করা হয় জনগণের অর্থ ব্যয় করে—সেখানে এসব প্রতিবেদন সাংবাদিকতার কাজে ব্যবহার করা কেন ‘অপরাধ’ বলে গণ্য হবে?

বাংলাদেশ ব্যাংক বা সরকারি দপ্তরের অপ্রকাশিত প্রতিবেদন ছাড়া ফারমার্স বা বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বা ব্যাপক অনিয়ম নিয়ে কি আমরা কোনো প্রতিবেদন তৈরি করতে পারতাম? আমাদের প্রতিবেদকের হরহামেশাই মোবাইল ফোনে এ ধরনের দলিলের ছবি তুলতে হয়। কাজেই তাদের সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া যেতে পারে, তাই তো?

এ আইনের প্রবক্তাদের কাছে আমাদের উদাহরণগুলো ‘হাস্যকর’ ঠেকতে পারে। কিন্তু তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা প্রয়োগের বাস্তব নজির সাংবাদিকদের কোনো স্বস্তির কারণ জোগায়নি।

ধারা ৪৩

৪৩। পরোয়ানা ব্যতিরেকে তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তার।—
(১) যদি কোনো পুলিশ অফিসারের এইরূপ বিশ্বাস করিবার কারণ থাকে যে কোনো স্থানে এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটিত হইয়াছে বা হইতেছে বা হইবার সম্ভাবনা রহিয়াছে বা সাক্ষ্য প্রমাণাদি হারানো, নষ্ট হওয়া, মুছিয়া ফেলা, পরিবর্তন বা অন্য কোনো উপায়ে দুষ্প্রাপ্য হইবার বা করিবার সম্ভাবনা রহিয়াছে, তাহা হইলে তিনি অনুরূপ বিশ্বাসের কারণ লিপিবদ্ধ করিয়া মহাপরিচালকের অনুমোদনক্রমে নিম্নবর্ণিত কার্য সম্পাদন করিতে পারিবেন,—

(ক) উক্ত স্থানে প্রবেশ করিয়া তল্লাশি এবং প্রবেশ বাধাপ্রাপ্ত হইলে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ;
(খ) উক্ত স্থানে তল্লাশিকালে প্রাপ্ত অপরাধ সংঘটনে ব্যবহার্য কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, তথ্য-উপাত্ত বা অন্যান্য সরঞ্জামাদি এবং অপরাধ প্রমাণে সহায়ক কোনো দলিল জব্দকরণ;
(গ) উক্ত স্থানে উপস্থাপিত যে কোনো ব্যক্তির দেহ তল্লাশি;
(ঘ) উক্ত স্থানে উপস্থিত কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ করিয়াছেন বা করিতেছেন বলিয়া সন্দেহ হইলে উক্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার।

সম্পাদক পরিষদের মন্তব্য

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সবচেয়ে বিপজ্জনক বিধান এটি।
এতে পুলিশকে যেকোনো জায়গায় প্রবেশ, যেকোনো কম্পিউটার ব্যবস্থায় তল্লাশি চালানো, যেকোনো কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ও সার্ভার জব্দ করা, যেকোনো ব্যক্তির দেহ তল্লাশি এবং শুধু সন্দেহবশত যে কাউকে গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
প্রথমত, পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তারের হুমকি স্বাভাবিকভাবেই সাংবাদিকদের দায়িত্ব পালনে বাধার সৃষ্টি করবে। পুলিশ যখন স্রেফ সন্দেহবশত ও পরোয়ানা ছাড়াই সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা পাবে, তখন এই আইনের ছায়াতলে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার কবর রচিত হবে। আইনটির ২০টি শাস্তির বিধানের মধ্যে যখন ১৪টিই জামিন অযোগ্য, তখন গ্রেপ্তারের ঝুঁকি প্রত্যেক সাংবাদিকের মাথার ওপর ডেমোক্লেসের খড়্গের মতো সব সময় ঝুলতে থাকবে, মানসিক চাপ সৃষ্টি করে রাখবে। এতে প্রকৃত সাংবাদিকতার সব পন্থা বাধাগ্রস্ত হবে। আমাদের সংবাদমাধ্যম নিছকই জনসংযোগ কর্মকাণ্ড ও প্রচারণা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।
এমনকি সাংবাদিকদের ওপর এ আইনের প্রয়োগ না হলেও (আইন থাকলে প্রয়োগ হবেই না বা কেন?) ভীতির পরিবেশে তাঁরা পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা অনুভব করবেন। গ্রেপ্তার–আতঙ্ক তাঁদের ‘মানসিক পরিবেশের’ এক প্রাত্যহিক অংশ হয়ে উঠবে। প্রতিবেদন তৈরির কাজে তাঁরা নিয়মিত যেসব সংগত ঝুঁকি নিয়ে থাকেন, এই ভীতির কারণে সেসব ঝুঁকি নিতে তাঁরা আর সাহস পাবেন না। এই বিধানের ফলে সাংবাদিকদের মধ্যে যে মানসিক চাপ সৃষ্টি হবে, তা খাটো করে দেখা ঠিক নয়। খুব সহজেই ধরে নেওয়া যায় যে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা এ আইনের অপব্যবহার করবেন। ধনী ও ক্ষমতাসীনেরা গোপন রাখতে চান, এমন বিষয়ে যেকোনো সংবাদ প্রতিবেদনের জন্য সংশ্লিষ্ট সাংবাদিককে হুমকি দিতে, এমনকি গ্রেপ্তার করতে তাঁরা আইন প্রয়োগকারীদের প্ররোচিত বা ‘হাত করতে’ পারেন।

এ আইনের আরও বিপজ্জনক দিক হলো, সব সংবাদপত্র ও টেলিভিশন স্টেশনই এখন ডিজিটাল ব্যবস্থায় কাজ করে বলে কম্পিউটার, সার্ভারসহ কম্পিউটার নেটওয়ার্ক জব্দ করার ক্ষমতা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে দেওয়ার মাধ্যমে কার্যত তাদের যেকোনো সংবাদপত্র, টিভি স্টেশন বা অনলাইন নিউজ পোর্টালের কাজ বন্ধ দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কোনো সংবাদপ্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি জব্দ করলে তার কার্যক্রম থেমে যেতে পারে। এভাবে কোনো সংবাদপ্রতিষ্ঠান আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ না করেই আইনের এই ধারায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর হাতে সংবাদপত্রের প্রকাশনা বা কোনো টিভি স্টেশনের কার্যক্রম রুদ্ধ করে দেওয়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।

ধারা ৫৩

৫৩। অপরাধের আমলযোগ্যতা ও জামিনযোগ্যতা।—এই আইনের—
(ক) ধারা ১৭, ১৯, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৭, ২৮, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩ ও ৩৪-এ উল্লেখিত অপরাধসমূহ আমলযোগ্য ও অ-জামিনযোগ্য হইবে; এবং
(খ) ধারা-১৮-এর উপধারা (১) এর দফা (খ) ২০, ২৫, ২৯ ও ৪৮-এর উপধারা (৩) এ উল্লিখিত অপরাধসমূহ অ-আমলযোগ্য ও জামিনযোগ্য হইবে;

সম্পাদক পরিষদের মন্তব্য

এই আইনের প্রায় ২০টি ধারার ১৪টির ক্ষেত্রেই অপরাধ আমলযোগ্য ও জামিন–অযোগ্য। পুলিশকে নিছক সন্দেহের কারণে এবং পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা দেওয়ায় এবং এতগুলো অপরাধের অভিযোগকে আমলযোগ্য ও জামিন অযোগ্য করায় আইনটি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি এক বাস্তব হুমকি।

উপসংহার

১. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নাগরিকদের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, যা যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে আমাদের সংবিধানে নিশ্চিত করা হয়েছে, তা সুস্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করে;
২. এ আইন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং যেসব মহান আদর্শ ও মুক্তির জন্য আমাদের শহীদেরা জীবন উৎসর্গ করেছেন, সেসব লঙ্ঘন করে;
৩. গণতন্ত্রের মূলনীতি, গণতান্ত্রিক শাসন এবং পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও ১৯৭১ সালের পরবর্তী সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে যেসব গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য আমাদের জনগণ বারবার লড়াই করেছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সেসবের পরিপন্থী;
৪. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নৈতিক ও স্বাধীন সাংবাদিকতার সব মূল্যবোধের পরিপন্থী।
৫. এ আইন তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কেন আমাদের সংবিধান, মৌলিক অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক নীতির পরিপন্থী, তা আমরা ওপরে বিভিন্ন ধারা উল্লেখ করে বিশদভাবে বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করেছি।
এসব কারণে সম্পাদক পরিষদ এই আইন প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হয়েছে।
এই আইন আমাদের সংবিধানের ৩৯(১) অনুচ্ছেদে প্রদত্ত চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং ৩৯(২) অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ‘যুক্তিসংগত বাধানিষেধ–সাপেক্ষে’ (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্‌ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার, এবং (খ) সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা খর্ব করে।

পরিশেষে আমরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কিছু কথা উদ্ধৃত করতে চাই। ১৯৫৬ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদে সংবিধান প্রণয়ন–সম্পর্কিত এক বিতর্কে তিনি স্পিকারের উদ্দেশে বলেছিলেন:

‘আপনারা বলে থাকেন যে বাক্‌স্বাধীনতা মানেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা।
‘আপনি কি জানেন যে পূর্ববঙ্গে সম্পাদকদের ডেকে বলা হয়, আপনারা এটা ছাপাতে পারবেন না, আপনারা ওটা ছাপাতে পারবেন না। স্যার, তাঁরা সত্য কথা পর্যন্ত লিখে ছাপাতে পারেন না এবং আমি সেটা প্রমাণ করে দিতে পারি।...নির্দেশটা যায় সচিবালয় থেকে...। সরকারের তরফ থেকে একজন ইন্সপেক্টর গিয়ে নির্দেশনা দেন যে, আপনি একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে লিখতে পারবেন না।...

‘এটা পরিষ্কারভাবে লিপিবদ্ধ থাকতে হবে যে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকবে, তাঁরা তাঁদের ইচ্ছামতো বক্তব্য লিপিবদ্ধ করতে পারবেন এবং জনমত গড়ে তুলতে পারবেন।’

প্রাপক মার্শা বার্নিকাটের মাধ্যমে ডোনাল্ড ট্রাম্প

— শফিক রেহমান

বুধবার ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮-তে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গিয়েছিলেন জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন বা জেনারেল এসেম্বলিতে। প্রেসিডেন্ট হবার পর এই নিয়ে তিনি দ্বিতীয়বার গেলেন বিশ্বায়ন বা গ্লোবালাইজেশনের সর্বোচ্চ স্থানে। কিন্তু সেখানে নির্ধারিত সময়ের আধা ঘণ্টা পরে উপস্থিত হয়ে ট্রাম্প তার ভাষণে বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করেন এবং বিশ্বায়নের বদলে স্বদেশকে অগ্রাধিকার দেয়ার পক্ষে বলেন। তিনি জানান, “বিশ্বকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য দেয় আমেরিকা কিন্তু খুব কম দেশই আমেরিকাকে প্রতিদান দেয়। আমরা ভবিষ্যতে শুধু সেই সব দেশকেই সাহায্য দেব যারা আমাদের শ্রদ্ধা করে এবং যারা আমাদের বন্ধু।”

এরপর ট্রাম্প আমেরিকার বন্ধু ও শত্রু দেশের একটি লিস্ট দেন। বন্ধু রূপে সবচেয়ে প্রথমে তিনি উত্তর কোরিয়ার সর্বময় স্বৈরাচারী নেতা কিম জং উন-এর নাম করেন। অথচ বর্তমান বিশ্বে কিম জং উন-ই সবচেয়ে বড় স্বৈরাচারী রূপে পরিচিত।

ট্রাম্প বলেন, সৌদি আরব ও ইউনাইটেড আরব এমিরেটস (ইউএই বা সংযুক্ত আরব আমিরাত) দুটি বন্ধু দেশ। উল্লেখ্য, এই দুটি দেশই ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হবার আগে তার সাথে হৃদ্যতার সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। এই দুটি দেশ যে এখন ইয়েমেনে নির্বিচারে বোমা ফেলছে সে বিষয়ে ট্রাম্প কিছু বলেননি।

ইউরোপের মাত্র একটি দেশকে তিনি বন্ধু রূপে চিহ্নিত করেন এবং সেটি হচ্ছে পোল্যান্ড। এর একটি প্রধান কারণ হতে পারে এই মাসে পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আন্দ্রে দুদা আমেরিকায় এসে হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে দেখা করেন। তখন তিনি ট্রাম্পকে ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, পোল্যান্ডে যে আমেরিকার সামরিক ঘাঁটি আছে, সেটার নাম “ট্রাম্প ফোর্ট” (ট্রাম্প দুর্গ) তিনি করতে চান।

সবচেয়ে বড় শত্রু দেশ রূপে ট্রাম্প ইরানকে চিহ্নিত করেন। তবে সেই সাথে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানিকে “একজন ভালো ও চমৎকার মানুষ” বলেন।

খুব সম্ভবত জাতিসংঘে উপস্থিত হয়ে ট্রাম্পের মিত্র ও শত্রুদের এই নামকরণ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের নাম উচ্চারিত হয়নি। হয়তো ট্রাম্প জানেনও না যে আগস্ট ২০০৫-এ আমেরিকার দক্ষিণ উপকূলে যে বিধ্বংসী হারিকেন ক্যাটারিনা ঝড় বয়ে যায় তখন বাংলাদেশও এগিয়ে গিয়েছিল সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। হারিকেন ক্যাটারিনার ঝড়ো হাওয়ার বেগ ছিল ঘণ্টা প্রতি ৭৪ মাইল (১১৯ কিলোমিটার ঘণ্টা প্রতি) এবং এর ফলে ১২৫ বিলিয়ন ডলার পরিমাণের সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষের নিরাপদ আশ্রয়, পানি, খাবার ও চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য আমেরিকা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

সাহায্য করেছিল বিশ্বের বহুদেশ যাদের অন্যতম ছিল বাংলাদেশ।

শুধু তাই নয় সবচেয়ে বেশি সাহায্যকারী দেশগুলোর মধ্যে ষষ্ঠ স্থানে ছিল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের এই অবস্থান ছিল জাপানের সরকারি অনুদানের সমান। অবশ্য জাপানের বহু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিগতভাবে অনেকে আরো দান করেছিল।

বাংলাদেশ কেন এবং কিভাবে বিশ্বের ১৯৩টি দেশের মধ্যে ষষ্ঠ হয়েছিল এবং ইনডিয়া, পাকিস্তান ও শ্রীলংকার ওপরে স্থান করেছিল?

সেই প্রশ্নের উত্তরটি জানা থাকলে আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জাতিসংঘে তার ভাষণে বাংলাদেশের নামটিও উল্লেখ করতেন। হারিকেন ক্যাটরিনা বয়ে গিয়েছিল তের বছর আগে। তখন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাবলিউ বুশ ক্ষমতায় ছিলেন।

দুই মেয়াদে জর্জ বুশ ছিলেন প্রেসিডেন্ট এবং তার আমলে ইরাক যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল আমেরিকা। সেই যুদ্ধে আমেরিকা চেয়েছিল বাংলাদেশ থেকে কিছু সৈন্য। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে সেখানে পাঠাতে রাজি হননি বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। কেন তিনি রাজি হননি? সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ এবং পরে সেটা বলা যাবে। কিন্তু তার সেই সিদ্ধান্তের ফলে আমেরিকার সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্কে একটা গভীর ফাটল ধরেছিল।

ক্যাটরিনার প্রলয়ংকরী ঝড়ের বিবরণ পড়ে এবং বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে তার সচিত্র রিপোর্ট দেখে আমি বুঝতে পারি সেই ফাটল মেরামত করতে এবং আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক আবার ভালো করার একটা অপ্রত্যাশিত সুযোগ বাংলাদেশের এসেছে।

আমি প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে (প্রাইম মিনিস্টার্স অফিস, সংক্ষেপে চগঙ বা পিএমও নামে পরিচিত) ফোন করে খালেদা জিয়ার সঙ্গে বিনা বিলম্বে দেখা করতে চাইলাম। তখন সকাল সাড়ে দশটা।

এগারোটার দিকে পিএমও থেকে ফোন এল এবং আমাকে যতো শিগগির সম্ভব সেখানে যেতে বলা হলো। আমি দ্রুত রেডি হয়ে পিএমওতে পৌঁছে গেলাম। সিকিউরিটি গেট পেরিয়ে প্রধানমন্ত্রীর রুমে যখন ঢুকলাম তখন বেলা প্রায় বারোটা। দেখলাম হালকা বাদামি রংয়ের শিফনের শাড়ি পরা প্রধানমন্ত্রী। সেদিন আমিই ছিলাম তার রুমে প্রথম দর্শনার্থী। তার চোখে মুখে একটু জিজ্ঞাসু চিহ্ন। কোনো প্রশ্ন তিনি করলেন না। বসতে বললেন।



‘একটা ইমারজেন্সি বিষয়ে কথা বলার জন্য আমি এসেছি।’ বললাম।

‘কি হয়েছে?’ তিনি জানতে চাইলেন।

‘আপনি নিশ্চয়ই আমেরিকায় হারিকেন ক্যাটরিনার সংবাদ পড়েছেন এবং টিভিতে ধ্বংসলীলা দেখেছেন, দুর্গতদের করুণ অবস্থা দেখেছেন।’

‘হ্যা। দেখেছি। খুবই খারাপ অবস্থা।’

‘ম্যাডাম, এই সময়ে আমেরিকাকে সাহায্য করা উচিত। বাংলাদেশ ছোট দেশ। গরিব দেশ। কিন্তু বিপদের সময়ে আমাদের সাহায্য করা উচিত বিপদগ্রস্ত অন্য দেশকে।’

‘নিশ্চয়ই। ঠিকই বলেছেন। এখনি কিছু করা উচিত।’ প্রধানমন্ত্রীর চোখে মুখে উদ্বেগ দেখলাম।

‘ধন্যবাদ আপনাকে। আমার প্রয়াত পিতা প্রায়ই কামিনী রায়ের একটি কবিতার শেষ চারটি লাইন বলতেন। তিনি বলতেন, ‘আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে, আসে নাই কেহ অবণী পরে, সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।’ তবে এর পরেই তিনি বিদ্রুপ করে বলতেন, বাংলাদেশের মানুষের চিন্তাধারা অন্যরকম, তারা ভাবে, ‘আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসিয়াছি আমি অবণী পরে, প্রত্যেকে আমরা নিজের তরে।’ আপনি যে সেই সাধারণ পথে না গিয়ে আজ একটি অসাধারণ সিদ্ধান্ত নিলেন, এটা বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যতে অনেক সুফল বয়ে আনবে। কারণ, বাংলাদেশ একটি ঘূর্ণিঝড় প্রবণ দেশ এবং ভবিষ্যতে এপৃল ১৯৯১-এর মতো বাংলাদেশে আরো ঘূর্ণিঝড় হবে। তখন আমেরিকা আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিল। চট্টগ্রাম পোর্ট এরিয়াতে তারা বহু কাজ করে চট্টগ্রাম পোর্টকে আবার সচল করতে পেরেছিল। আর হ্যা, আরেকটা স্থায়ী অবদান আমেরিকা রেখে যায়। তখন আমেরিকান সৈন্যরা মিনারেল ওয়াটার খেত। সেই থেকে গোটা বাংলাদেশে মিনারেল ওয়াটার, যেটা আসলে আমাদের দেশে সিদ্ধ পানি, সেটা খাবার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।’

‘এখন বলুন বাংলাদেশের কি করা উচিত।’ প্রধানমন্ত্রী দ্রুত আসল পদক্ষেপ কি হবে সেটা জানতে চাইলেন।

‘বাংলাদেশ দুটি কাজ করতে পারে। প্রথমত, যেহেতু আমাদের সেনাবাহিনী ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বা দুর্ঘটনায় কাজ করতে অভ্যস্ত সেহেতু এবার আপনি আমাদের সেনাবাহিনীর একটি অংশকে আমেরিকায় পাঠানোর প্রস্তাব দিতে পারেন। ফলে ইরাক যুদ্ধে অসহযোগিতার ফলে আমেরিকার বিরূপ প্রক্রিয়ার কাউন্টার ও পজিটিভ একশনের প্রস্তাব দেয়ার সুযোগটা নিতে পারেন। এতে বাংলাদেশের খুব খরচ হবে না। বাংলাদেশ বিমানে আপনি সেনাবাহিনীকে নিউ ইয়র্ক পাঠিয়ে দিতে পারেন। সেখান থেকে আমেরিকানরা প্রয়োজন মোতাবেক দক্ষিণ উপকূলে তাদের নিয়ে যাবে আমেরিকান প্লেনে।’

‘আমেরিকা রাজি হবে? তাদের সেনাবাহিনীর পাশাপাশি আমাদের সেনাবাহিনীকে রিলিফ কাজ করতে দিবে?’ প্রধানমন্ত্রী মত চাইলেন।
‘খুব সম্ভবত রাজি হবে না। তারা মনে করতে পারে এর ফলে আমেরিকান সেনাবাহিনীর মান একটু ক্ষুণ্ণ হতে পারে। কিন্তু তাতে কি? আমেরিকানরা রাজি হলে তো ভালোই। আর রাজি না হলেও ভালো। ইরাকে সেনা পাঠাননি কারণ সেখানে মানুষের দুর্দশা বাড়তো। কিন্তু এবার আমেরিকা সরকার বুঝবে, মানুষের দুর্দশা কমাতে আপনার সরকার সদা প্রস্তুত।’

‘আপনার যুক্তি সঠিক। বেশ। সেই প্রস্তাব আমরা দেব। আর দ্বিতীয় কোনভাবে আমরা সাহায্য করতে পারি?’ খালেদা জানতে চাইলেন।
‘আমরা তাদের ক্যাশ ডলার দিতে পারি।’

‘হ্যা। সেটা সম্ভব। কিন্তু কতো? আমি সাইফুর রহমান সাহেবকে ফোন করছি।’ তিনি তার ইন্টারকমে নির্দেশ দিলেন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানকে কানেক্ট করতে।

কিছুক্ষণ পরেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর টেলিফোন যোগাযোগ স্থাপিত হলো। ওদিক থেকে অর্থমন্ত্রী জানালেন বাংলাদেশের ডলার তহবিলের অবস্থা।

‘অর্থমন্ত্রী দশ হাজার ডলার দিতে পারবেন।’ খালেদা ফোন রেখে দিয়ে বললেন।

আমি হেসে ফেললাম। বললাম, ‘দেখুন, যায়যায়দিন একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা মাত্র। তবু, ইনডিয়াতে ভূপাল দুর্ঘটনার সময়ে, জাপানে কোবে ভূমিকম্পের সময়ে, এমন বিভিন্ন সময়ে অন্ততপক্ষে দুশ ডলার সাহায্য আমরা পাঠিয়েছি পত্রিকার পাঠকদের পক্ষ থেকে। সেই তুলনায় বাংলাদেশ সরকারের কি উচিত নয় এই সময়ে যতোটা সম্ভব বেশি দান করা?’

‘নিশ্চয়ই। তাহলে আমরা কতো ডলার সাহায্য দেয়ার প্রস্তাব করবো?’

‘সেটা আপনার সিদ্ধান্ত এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে ডলার তহবিলের ওপর নির্ভরশীল। আপনিই বলুন।’

‘তাহলে এক মিলিয়ন ডলার?’ প্রধানমন্ত্রী উৎসুকভাবে বললেন।
‘চমৎকার। আমাদের দেশের সীমিত সামর্থ্যে এক মিলিয়ন ডলার যে অনেক সেটা সবাই বুঝবে।’ আমি খুব খুশি হয়ে সায় দিলাম।

‘তাই হবে। আমি সাইফুর রহমান সাহেবকে এখনি বলে দিচ্ছি।’ এবার খালেদার মুখে গভীর তৃপ্তি দেখা গেল।
‘থ্যাংক ইউ ম্যাডাম।’

আমেরিকার বিপদে বাংলাদেশের এক মিলিয়ন ডলার দানের বিষয়টি আমেরিকার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হয়েছিল। তারা অবাক হয়েছিল গরিব বাংলাদেশের এই বদান্যতায়।
কিন্তু বাংলাদেশে এ বিষয়টি তেমন প্রচার পায়নি। যেমন প্রচার পায়নি সেই সময়ে বিএনপি সরকারের অনেকগুলো ভালো কাজের কথা।

বাংলাদেশে বসে আমার জানার উপায় ছিল না অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থানটি কি। কয়েক মাস পরে ক্যাটরিনা ঝড়ে বিভিন্ন দেশের সাহায্য প্রসঙ্গে মাসিক রিডার্স ডাইজেস্ট পড়ে আমি জেনেছিলাম বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। রিডার্স ডাইজেস্টের চার্টে আনন্দিত হয়েছিলাম দেখে যে প্রতিবেশী দেশগুলোর চাইতে বাংলাদেশের অবস্থান ওপরে। হ্যা, বাংলাদেশ পারে যদি নেতৃত্ব সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়। গুগলে সার্চ দিলে বাংলাদেশের এই অতি অসাধারণ কৃতিত্ব বিষয়ে অনেক কিছু পাঠকরা জেনে নিতে পারেন।

কিন্তু এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আমেরিকানরা কি জানে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর চরম অমানবিক দুর্দশার কথা? কেউ কি এই বিষয়টি আমেরিকার রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটকে এবং তার মাধ্যমে তার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জানিয়ে দেবেন?

লন্ডন
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮