Search

Wednesday, September 26, 2018

পরিবেশ ইস্যুতে বিতর্কিত হয়ে পড়ছে অর্থনৈতিক অঞ্চল

বদরুল আলম ও নিহাল হাসনাইন

বিনিয়োগ বাড়াতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠছে অর্থনৈতিক অঞ্চল। এসব অঞ্চল গড়ে তুলতে গিয়ে বিরোধ দেখা দিচ্ছে জমি নিয়ে। বিতর্কিত হয়ে পড়ছে পরিবেশ ইস্যুতে। কোনো কোনো অর্থনৈতিক অঞ্চলের বিরুদ্ধে কৃষিজমি দখলের অভিযোগ উঠছে। নদী ও বনের জমি দখলের অভিযোগও রয়েছে কোনো কোনো অর্থনৈতিক অঞ্চলের বিরুদ্ধে।

প্রাক-যোগ্যতা সনদ পাওয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর একটি সোনারগাঁ ইকোনমিক জোন। কৃষিজমিকে অর্থনৈতিক অঞ্চলটির আওতায় নিয়ে আসার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। অর্থনৈতিক অঞ্চলটি যে ভূমি উন্নয়ন করছে, সেখানে নদীর জমিও থাকছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ জেলা কার্যালয় সরেজমিন পরিদর্শনে সোনারগাঁ অর্থনৈতিক অঞ্চলের বিরুদ্ধে সংলগ্ন কৃষিজমি, জলাভূমি ও নিচু জমিতে বালি ভরাটের প্রমাণও পেয়েছে। এসব এলাকা বালি ভরাটে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালতও।

সোনারগাঁ অর্থনৈতিক অঞ্চলটির অবস্থান নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়নে। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ইউনিয়নটির পূর্ব পাশে বিস্তৃত মেঘনা নদী, দক্ষিণে মারিখালী ও উত্তরে মেনিখালী খাল। মাঝে ভবনাথপুর, কান্দারগাঁও ও বীরেশ্বরগাঁও নামের তিনটি গ্রাম। এ তিন গ্রামের মধ্যে ৫৫ দশমিক ৭৮ একর জমি নিয়ে গড়ে উঠছে অর্থনৈতিক অঞ্চলটি। অর্থনৈতিক অঞ্চলটির জন্য নদীর ভেতরও সীমানা তৈরি করা হয়েছে। ঝাওচড় ঘাট থেকে শুরু করে নদীর পাড় ঘেঁষে ১২ বিঘা নদীর ফোরশোর ভূমিতে বালি ফেলে ভরাট করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এজন্য ওই জমিতে ১০টিরও বেশি ড্রেজার পাইপ স্থাপন করা হয়েছে। মেঘনা নদীর ফোরশোর ভূমিতে বালি ভরাট করায় মেনিখালী ও মারিখালী খালের পানি আর মেঘনা নদীতে যেতে পারছে না।

নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে সোনারগাঁ ইকোনমিক জোনের বালি ভরাট কার্যক্রমকে অবৈধ উল্লেখ করে একটি নোটিস জারি করা হয়। তাতে পিরোজপুর ইউনিয়নের জৈনপুর, চরভবনাথপুর, ভাটিবন্দর, রতনপুর মৌজায় বিস্তীর্ণ কৃষিজমি, জলাভূমি ও নিচু জমিতে মাটি ভরাট কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। সেসঙ্গে সোনারগাঁ উপজেলার চরভবনাথপুর, ভাটিবন্দর মৌজায় কৃষিজমি, জলাভূমি এবং মেঘনা নদীর কিছু অংশে ভরাট করা মাটি ও বালি অপসারণের নির্দেশ দেয় জেলা প্রশাসন।

নারায়াণগঞ্জের জেলা প্রশাসক রাব্বি মিয়া এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী সোনারগাঁ ইকোনমিক জোনের বালি ভরাট কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ভরাট করা বালি ও মাটি অপসারণের জন্যও প্রতিষ্ঠানটিকে নোটিস করা হয়েছে।

সোনারগাঁ ইকোনমিক জোনের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তরেরও। অবস্থানগত ছাড়পত্র গ্রহণ ব্যতিরেকে বালি ভরাটের কারণ দর্শানোর জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে কয়েক দফা নোটিস করেছে তারা।

জানতে চাইলে সোনারগাঁ অর্থনৈতিক অঞ্চলের মূল প্রতিষ্ঠান ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নূর আলী বণিক বার্তাকে বলেন, পরিবেশের বিষয়টি নিয়ে মামলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে পরিবেশের কোনো বিষয় এখানে নেই। কারণ এমনিতেই ওটাকে অকৃষি অঞ্চল ঘোষণা করা হয়েছে। পাশে আছে মেঘনা ও আমান ইকোনমিক জোন। ডিসি ও আদালতকেও বলে এসেছি বিষয়টি ব্যক্তিগতভাবে নেয়া হচ্ছে। ওখানে পরিবেশের কোনো বিষয় নেই। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকেও আমাদের জানানো হয়েছে, এখানে তাদের কোনো অসুবিধা নেই। কিছু কারণে বিষয়টি ব্যক্তিগতভাবে নেয়া হয়েছে, যাতে করে অর্থনৈতিক অঞ্চলে বাধা দেয়া যায়।

এদিকে সোনারগাঁ অর্থনৈতিক অঞ্চলের বিরুদ্ধে দায়ের করা রিট পিটিশনটি নিষ্পত্তি না হওয়ায় প্রাক-যোগ্যতাপত্রের মেয়াদ বাড়ায়নি অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। গত ১৯ আগস্ট এক চিঠির মাধ্যমে অর্থনৈতিক অঞ্চলটিকে তা জানিয়েও দেয়া হয়েছে।

বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, সোনারগাঁ ইকোনমিক জোনের ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, তা হলো আমরা যখন প্রাক-যোগ্যতা লাইসেন্স দিই, তখন এক বছর সময় দেয়া হয়। ৫৫ একরের জন্য দুই বছর সময় দেয়া হয়েছে তাদের। এ সময়ের মধ্যে যদি কাজ শেষ না হয়, তাহলে বুঝে নিতে হবে কাজটি আর তারা করছে না। যেগুলো অসমাপ্ত কাজ, সেগুলো আমরা সমাপ্ত করতে বলেছি। তখন আবার লাইসেন্সের আবেদন করলে বিবেচনা করা হবে। যে মামলা আছে তাতে বাদীপক্ষ বলেছে, অর্থনৈতিক অঞ্চলের জমি দেখিয়ে পার্শ্ববর্তী জমি নেয়া হচ্ছে

বর্তমানে সবচেয়ে দ্রুত এগিয়ে চলেছে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ। ২০১৪ সালে অঞ্চলটির জমি নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। বনের জমি দখলের অভিযোগও ওঠে অর্থনৈতিক অঞ্চলটির বিরুদ্ধে। এছাড়া সম্প্রতি নদীর জমি দখল ও নতুন জেগে ওঠা চরে বালি ফেলে স্থাপনা নির্মাণের অভিযোগ ওঠে বেসরকারি উদ্যোগের আমান অর্থনৈতিক অঞ্চলের বিরুদ্ধে। বিষয়টি নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিস থেকে নোটিসও দেয়া হয়। পরবর্তীতে রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত দখল বন্ধের নির্দেশ দেন।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পবন চৌধুরী বলেন, পৃথিবীর যে দেশই উন্নত হয়েছে, তারা বিনিয়োগকে ১ নম্বর অগ্রাধিকারে রেখেছে, বাংলাদেশও সে ধারাতেই আছে। প্রধানমন্ত্রী বলছেন উন্নত সমৃদ্ধ দেশ। যেকোনো সরকারের এজেন্ডায় উন্নয়ন থাকে। এজন্য বিনিয়োগ প্রয়োজন। কিন্তু বিনিয়োগ তো হাওয়ার উপরে হবে না। এর জন্য জমি লাগবে। আবার শুধু জমি হলে হবে না, পণ্য পরিবহনে সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা লাগবে। শিল্প যখন করবেন, তখন শিল্পের জন্য জমিও দিতে হবে। এখন শিল্পের জন্য খালি জমি কোথাও বসে নেই, প্রভাবশালীরা সবসময়ই জমি নিয়ে গেছে দরিদ্রদের নামে। নিঝুম দ্বীপে শিল্প করতে চাইলে তা বাস্তবসম্মত নয়, তবে মিরসরাইতে সম্ভব। কারণ বন্দর থেকে কাছে, সমুদ্রে সহজে প্রবেশের সুযোগ আছে। এজন্যই আমরা ওই স্থানটি বেছে নিয়েছি। স্বাভাবিকভাবেই এগুলোয় বিরোধ কিছু আসবেই। মিরসরাইয়ে এ ধরনের খুবই নগণ্য একটি সমস্যা দেখা দিয়েছিল।

আমানের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে আদালতের যে আদেশ সেটি মানতেই হবে। সবাইকে মানতে হবে। আমরা কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নই।

২০১০ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল আইন প্রণয়নের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা পায় বেজা। ২০১১ সালের নভেম্বরে কাজ শুরু করে এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে সংস্থাটি।

সরকারি মালিকানাধীন অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর বেশির ভাগই গড়ে উঠছে মৌলভীবাজার, সিরাজগঞ্জ, মোংলা এবং চট্টগ্রামের মিরসরাই ও আনোয়ারায়। এছাড়া সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য চিহ্নিত গন্তব্যগুলোর মধ্যে আছে সোনারগাঁ, শেরপুর, রাজশাহী, পঞ্চগড়, নীলফামারী, নেত্রকোনা, নাটোর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া, জামালপুর, গোপালগঞ্জ, গাজীপুর, ফেনী, ঢাকা, বরিশাল, বাগেরহাট ও বগুড়া। বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর মধ্যে আছে নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর, সিরাজগঞ্জ ও ঢাকা। এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর বেশির ভাগেরই কেন্দ্রীভবন ঢাকা ও চট্টগ্রামে।

অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো পরিবেশ ঠিক রেখে গড়ে উঠছে কিনা জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. সুলতান আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা বিভিন্ন ধরনের শর্ত দিচ্ছি, শিল্পোদ্যোক্তারাও আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করছেন। শিল্পের জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চলে তৈরি জায়গা পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে শিল্পের ধরন অনুযায়ী পৃথক সাব জোনে শিল্প স্থাপন হবে। এখন পর্যন্ত যতগুলো অনুমোদন দেয়া হয়েছে, সেগুলো আমরা দেখেই দিয়েছি। আমাদের কাছে আসছে পর্যায়ক্রমে। আমরা যেগুলোর ছাড়পত্র দিচ্ছি, দেখে-শুনে নিশ্চিত হয়েই দিচ্ছি। যেগুলো নিয়ে বিরোধ দেখা দিয়েছে বা দিচ্ছে, সেগুলো প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে অনুমোদন দেয়া হয়নি।

  • Courtesy: Banikbarta/ Sep 26, 2018

No comments:

Post a Comment