Search

Tuesday, September 18, 2018

রাঘববোয়াল পুঁজি লুটেরাদের কথা

মইনুল ইসলাম

১২ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘বিশ্বে অতি ধনীর উত্থানে শীর্ষে বাংলাদেশ’ শিরোনামের প্রতিবেদনটি একটি বড় দুঃসংবাদ। মার্কিন গবেষণা সংস্থা ‘ওয়েলথ এক্স’-এর ২০১৮ সালের ওয়ার্ল্ড আলট্রা ওয়েলথ রিপোর্টের গবেষণা মোতাবেক ২০১২ সাল থেকে ২০১৭—এই পাঁচ বছরে অতি ধনী লোকের সংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের সব ধনী দেশকে পেছনে ফেলে শীর্ষ স্থান অধিকার করেছে। ওই সময় বাংলাদেশে ধনকুবেরের সংখ্যা বেড়েছে ১৭.৩ শতাংশ হারে। ওই প্রতিবেদনে ৩ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি নিট সম্পদের অধিকারী ব্যক্তিদের অতি ধনী ‘আলট্রা-হাই নেট-ওয়ার্থ ইন্ডিভিজ্যুয়াল’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।

বলা হয়েছে, বিশ্বে অতি ধনী ব্যক্তির সংখ্যা মোট ২ লাখ ৫৫ হাজার ৮৫৫ জন। তাঁদের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক আছেন যুক্তরাষ্ট্রে—৭৯ হাজার ৫৯৫ জন। দ্বিতীয় স্থানে জাপান, সে দেশে আছেন ১৭ হাজার ৯১৫ জন। তৃতীয় থেকে দশম স্থানে আছে গণচীন (১৬ হাজার ৮৭৫ জন), জার্মানি (১৫ হাজার ৮০ জন), কানাডা (১০ হাজার ৮৪০ জন), ফ্রান্স (১০ হাজার ১২০ জন), হংকং (১০ হাজার ১০ জন), যুক্তরাজ্য (৯ হাজার ৩৭০ জন), সুইজারল্যান্ড (৬ হাজার ৪০০ জন) ও ইতালি (৫ হাজার ৯৬০ জন)। অন্য দেশগুলোর ধনকুবেরের সংখ্যা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি। এই ২ লাখ ৫৫ হাজার ৮৫৫ জন ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১২.৯ শতাংশ, কিন্তু তাঁদের সম্পদ বৃদ্ধির হার ছিল ১৬.৩ শতাংশ। তাঁদের মোট সম্পদের পরিমাণ বেড়ে ২০১৭ সালে দাঁড়িয়েছে ৩১.৫ ট্রিলিয়ন (মানে সাড়ে ৩১ লাখ কোটি) ডলারে। গত পাঁচ বছরে ধনকুবেরের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে গণচীন ও হংকংয়ে, কিন্তু ধনকুবেরের সংখ্যার প্রবৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি ১৭.৩ শতাংশ, বাংলাদেশে। গণচীনে ধনকুবেরের প্রবৃদ্ধির হার ১৩.৪ শতাংশ।

অতি ধনীর এই দ্রুততম প্রবৃদ্ধির হার বাংলাদেশের জন্য মহা বিপৎসংকেত হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। কারণ, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের জিডিপি এবং জিএনআই প্রবৃদ্ধির হার যেভাবে বেড়ে চলেছে, সে প্রবৃদ্ধি এই ধনকুবেরদের দেশে-বিদেশের সম্পদের প্রবল স্ফীতি ঘটানোর অর্থই হলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফলের সিংহভাগ দেশের ধনাঢ্য গোষ্ঠীগুলোর কাছে জমা হচ্ছে। সোজা কথায়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ন্যায্য হিস্যা থেকে দেশের শ্রমজীবী জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে ক্ষমতাসীন মহলের মারাত্মক ভ্রান্ত নীতির কারণে। দেশের আয় ও সম্পদের এহেন মারাত্মক পুঞ্জীভবন বর্তমান সরকারের ‘জনগণের সরকার’ দাবিকে মুখ ভ্যাঙচাচ্ছে এবং বঙ্গবন্ধুকন্যার রাজনীতিকে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’-এর খারাপ নজির হিসেবে সারা বিশ্বের কাছে উপহাসের পাত্রে পরিণত করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক-বাহক বলে দাবিদার দল আওয়ামী লীগের জন্য এই শিরোপা অত্যন্ত লজ্জাজনক। 

বাংলাদেশের চারটি মূলনীতির মধ্যে ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র আবার পুনঃস্থাপিত হয়েছে। ২০১১ সালে সংসদে পাস হওয়া সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার সে রায়কে সংবিধানে ফিরিয়ে এনেছে। কিন্তু আমি বারবার জানিয়ে যাচ্ছি যে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা সত্ত্বেও সরকার এখনো ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’র অহিফেনের মৌতাতে মেতে রয়েছে। ‘স্বজনতোষী পুঁজিবাদ’ (ক্রোনি ক্যাপিটালিজম) আজও নীতিপ্রণেতাদের ধ্যানজ্ঞান হিসেবে ‘হলি রিটের’ মর্যাদায় বহাল রয়ে গেছে। এসব পণ্ডিতম্মন্য ব্যক্তি সারা বিশ্বে আয় ও সম্পদ বণ্টনের ক্রমবর্ধমান বৈষম্যকে চোখে দেখতে পাচ্ছেন না। বাংলাদেশেও এই ক্রমবর্ধমান বৈষম্য যে মহাসংকটে পরিণত হয়ে যাচ্ছে, তার আলামত বারবার পেয়েও তাঁরা নির্বিকার! 

গত বছরের ১৭ অক্টোবর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) তাদের পরিচালিত হাউসহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে ২০১৬-এর তথ্য-উপাত্তগুলো একটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জাতির সামনে উপস্থাপন করেছিল, যেগুলো ১৮ অক্টোবর ২০১৭ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় পরিচালিত এবারের জরিপে ৪৬ হাজার হাউসহোল্ড বা খানা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। জরিপের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো নিম্নরূপ:

১. বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যার অনুপাত ২০১৬ সালে ২৪.৩ শতাংশ ছিল, যে হার ২০১০ সালে ছিল ৩১.৫ শতাংশ। অতএব, ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ সাল-এই ছয় বছরে দারিদ্র্য কমেছে ৭.২ শতাংশ। মানে, ওই ছয় বছরে প্রতিবছর গড়ে ১.২ শতাংশ হারে দারিদ্র্য কমেছে। এর আগের পাঁচ বছর মানে ২০০৫-১০ মেয়াদে দারিদ্র্য হ্রাসের হার ছিল প্রতিবছর ১.৭ শতাংশ। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে দারিদ্র্য হ্রাসের হার ক্রমেই শ্লথ হয়ে যাচ্ছে। এর প্রধান কারণটাও জরিপের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্যে ধরা পড়েছে, সেটা হলো বাংলাদেশে আয়ের বৈষম্য বেড়ে মারাত্মক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে।

২. অর্থনীতিশাস্ত্রে আয়ের বৈষম্য পরিমাপের বহুল ব্যবহৃত পরিমাপক হলো জিনি (বা গিনি) সহগ, যেটার মান এবারের জরিপে ২০১০ সালের ০.৪৬৫-এর চেয়ে বেড়ে ২০১৬ সালে ০.৪৮৩-এ গিয়ে দাঁড়িয়েছে। জিনি সহগের মান বাড়লে বোঝা যায় যে দেশে আয়ের বৈষম্য বেড়েই যাচ্ছে। যেসব দেশের জিনি সহগ ০.৫ পেরিয়ে যায়, সেসব দেশকে উন্নয়ন তত্ত্বে উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ হিসেবে অভিহিত করা হয়, বাংলাদেশ এর কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। মহাজোট সরকার নিজেদের দরিদ্রবান্ধব সরকার হিসেবে প্রোপাগান্ডা চালাতে সিদ্ধহস্ত। তাদের আমলে আয়বৈষম্য বেড়ে গেছে, এটা তাদের এহেন মিথ্যাচারের প্রতি চরম চপেটাঘাত বৈকি!

৩. আরও একটা উপাত্ত একই সাক্ষ্য বহন করছে: ছয় বছর আগে দেশের ১০ শতাংশ উচ্চবিত্ত ধনাঢ্য ব্যক্তির দখলে দেশের মোট জিডিপির ৩৫.৮৪ শতাংশ ছিল, ২০১৬ সালে ওই ১০ শতাংশ মানুষের হাতে দেশের ৩৮.১৬ শতাংশ আয় জমা হয়ে যাচ্ছে। এর বিপরীতে ১০ শতাংশ দরিদ্রতম মানুষ ২০১৬ সালে মোট আয়ের মাত্র ১.১ শতাংশের মালিক হতে পেরেছে, যেখানে ২০১০ সালে তারা মোট আয়ের ২ শতাংশের মালিক ছিল। একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর হাতে যে জিডিপি পুঞ্জীভূত হয়ে যাচ্ছে, এটা তার অকাট্য প্রমাণ। মুক্তবাজার অর্থনীতিকে আঁকড়ে ধরলে এটাই তো হবে, নয় কি?

৪. দেশের দরিদ্রতম ৫ শতাংশ মানুষের কাছে ২০১০ সালে ছিল ০.৭৮ শতাংশ আয়, কিন্তু ২০১৬ সালে তাদের কাছে মাত্র ০.২৩ শতাংশ আয় গিয়ে পৌঁছাতে পেরেছে। তার মানে, দেশের হতদরিদ্র ব্যক্তিরা ওই ছয় বছরে আরও দরিদ্র হয়ে গেছে।

১৯৭৫ সাল থেকে এ দেশের সরকারগুলো ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’র ডামাডোলে শরিক হয়ে ব্যক্তি খাত ও বাজারীকরণকে আঁকড়ে ধরার ফলে এ দেশে আয় ও সম্পদ বণ্টনের বৈষম্য বেড়ে বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে গেছে। ১৯৭২ সালে বিআইডিএসের গবেষণায় নির্ণীত হয়েছিল যে বাংলাদেশের আয়বৈষম্য পরিমাপক জিনি সহগ ০.৩২। ২০১৬ সালে এসে জিনি সহগ ০.৪৮৩-এ পৌঁছে গেছে। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে ২২টি কোটিপতি পরিবারের কথা বলা হতো, যারা রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় পাকিস্তানের শিল্প-বাণিজ্যে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। ওই ২২ পরিবারের মধ্যে দুটো পরিবার ছিল পূর্ব পাকিস্তানের, তা-ও একটি ছিল অবাঙালি। ওই বাংলাদেশেই ২০১২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মোতাবেক ২৩ হাজার ২১২ জন কোটিপতি ছিলেন। 

২০১৪ সালে তাঁদের ওই সংখ্যা ৫০ হাজার অতিক্রম করেছে বলে দাবি করা হচ্ছে। ২০১৭ সালে ১ কোটি টাকার বেশি অর্থ অ্যাকাউন্টে থাকা ব্যাংকের আমানতকারীদের সংখ্যা ১ লাখ ১৪ হাজার অতিক্রম করেছে বলে খোদ অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন। 

এসব তথ্যের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল যে একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে গিয়ে পুঞ্জীভূত হয়ে যাওয়ার কিংবা তাদের মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার বিপৎসংকেত পাওয়া যাচ্ছে, সে ব্যাপারে ক্ষমতাসীন সরকারের কি কোনো করণীয় নেই? সাধারণ জনগণের কাছে বোধগম্য যেসব বিষয় এই বিপদটার জানান দিচ্ছে সেগুলো হলো: 

১. দেশে প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে ১১ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যেখানে মা-বাবার বিত্তের নিক্তিতে সন্তানের স্কুলের এবং শিক্ষার মানে বৈষম্য সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে; ২. দেশে চার ধরনের মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে; ৩. ব্যাংকের ঋণ সমাজের একটা ক্ষুদ্র অংশের কাছে কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে এবং ঋণখেলাপি বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে; ৪. দেশের জায়গাজমি, অ্যাপার্টমেন্ট, প্লট, ফ্ল্যাট, মানে রিয়েল এস্টেটের দাম প্রচণ্ডভাবে বেড়েছে; ৫. বিদেশে পুঁজি পাচার মারাত্মকভাবে বাড়ছে; ৬. ঢাকা নগরীতে জনসংখ্যা ১ কোটি ৭৫ লাখে পৌঁছে গেছে, যেখানে আবার ৪০ শতাংশ বা ৭০ লাখ মানুষ বস্তিবাসী; ৭. দেশে গাড়ি, বিশেষত বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে; ৯. বিদেশে বাড়িঘর, ব্যবসাপাতি কেনার হিড়িক পড়েছে; ১০. ধনাঢ্য পরিবারগুলোর বিদেশ ভ্রমণ বাড়ছে; ১১. উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের বিদেশে পড়তে যাওয়ার খায়েশ বাড়ছে; ১২. উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার জন্য ঘন ঘন বিদেশে যাওয়ার খাসলত বাড়ছে; ১৩. প্রাইভেট হাসপাতাল ও বিলাসবহুল ক্লিনিক দ্রুত বাড়ছে; ১৪. প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার হিড়িক পড়েছে; ১৫. দেশে ইংলিশ মিডিয়াম কিন্ডারগার্টেন, ক্যাডেট স্কুল, পাবলিক স্কুল এবং ও লেভেল/এ লেভেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার মচ্ছব চলছে এবং ১৬. প্রধানত প্রাইভেট কারের কারণে সৃষ্ট ঢাকা ও চট্টগ্রামের ট্রাফিক জ্যাম নাগরিক জীবনকে বিপর্যস্ত করছে।

ইন্টারনেটে উইকিপিডিয়ায় খোঁজ নিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়—১৮৭০ থেকে ১৯১৪ সালের পুঁজিবাদী বিকাশে ‘রবার ব্যারন’দের ভূমিকার বর্ণনা পাওয়া যাবে, যার সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর ৪৭ বছরের রাঘববোয়াল পুঁজি লুটেরাদের অবিশ্বাস্য ধনসম্পদ আহরণের পদ্ধতির আশ্চর্যজনক মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। এসব রবার ব্যারন সৃষ্টির জন্য কি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলাম আমরা?

  • মইনুল ইসলাম: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ সেপ্টেম্বর ১৮,২০১৮ 

No comments:

Post a Comment