- সরকারের ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের অন্যতম মেট্রোরেল
- প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা
- এখন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ১০৫ কোটি টাকা
- আগস্ট পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক বাস্তব অগ্রগতি সাড়ে ১৬ শতাংশ
মেট্রোরেল প্রকল্পের মূল কাজ শুরুর পর সড়কের প্রস্থ কমে গেছে। যানজট এখন মিরপুর, আগারগাঁওবাসীর নিত্যসঙ্গী। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হলে এই ভোগান্তি আরও দীর্ঘ হবে বলে আশঙ্কা। গতকাল দুপুরে মিরপুর ১১ নম্বর এলাকায়। ছবি: তানভীর আহাম্মেদ
মেট্রোরেলের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ, দুই বছরে সিকি ভাগ কাজও হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হলে প্রকল্প ব্যয় বাড়বে। তবে প্রকল্প–সংশ্লিষ্টদের দাবি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ হবে।
প্রকল্প–সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত নির্মাণাধীন মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজের সার্বিক বাস্তব অগ্রগতি সাড়ে ১৬ শতাংশ। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের উড়ালপথ এবং স্টেশন নির্মাণের কাজ শেষ করার কথা ২০১৯ সালের ৩০ জুনে। আর আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হওয়ার কথা ওই বছরের ডিসেম্বরে। আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশ ২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা। এখন পর্যন্ত মেট্রোরেল প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ১০৫ কোটি টাকা।
এদিকে মেট্রোরেল প্রকল্পের মূল কাজ শুরুর পর থেকে প্রকল্প এলাকায় সড়কের প্রস্থ কমে গেছে। সড়কে পাশাপাশি দুটি গাড়ি, বাস চলতে পারছে না। যানজট এখন মিরপুর, আগারগাঁওবাসীর নিত্যসঙ্গী। প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ না হলে নিত্যদিনের এই ভোগান্তি আরও দীর্ঘ হবে বলে এলাকাবাসীর আশঙ্কা।
মিরপুরের বাসিন্দা আরিফুর রহমান বলেন, রাস্তার বড় অংশ আটকে মেট্রোরেলের কাজ চলায় প্রতিদিন যানজটে পড়তে হয়। মেট্রোরেলের কাজ শেষ হলে যানজটের দুর্ভোগ কমবে—এই আশায় সবাই হাসিমুখে বর্তমান ভোগান্তি মেনে নিচ্ছে। কিন্তু আগেও দেখা গেছে, একটি প্রকল্প শুরু হলে শেষ হতে চায় না। এটার ক্ষেত্রেও যেন এমন না হয়।
বর্তমান সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যেসব বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায়, সেগুলোকে ‘ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের অন্যতম মেট্রোরেল। এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা।
ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের পরিচালনা পরিষদের ১১ তম সভায় ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের (এমআরটি-৬) বাস্তবায়ন অগ্রগতি তুলে ধরা হয়। প্রকল্পটি ‘মেট্রোরেল প্রকল্প’ নামেই বেশি পরিচিত।
অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়, এ বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত এই প্রকল্পের সার্বিক বাস্তব অগ্রগতি সাড়ে ১৬ শতাংশ। আর প্রকল্পের সার্বিক আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ২৩ দশমিক ২২ শতাংশ। ১২০ মিটার উড়ালপথ (ভায়াডাক্ট) দৃশ্যমান হয়েছে। সংশোধিত পরিকল্পনা অনুযায়ী মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
২০১২ সালে এমআরটি-৬ বা মেট্রোরেল প্রকল্প নেওয়া হয়। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় বিশেষ উদ্যোগে সংশোধিত পরিকল্পনা নেওয়া হয়।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, মেয়র হানিফ উড়ালসড়ক ও মৌচাকে উড়ালসড়ক নির্মাণ করতে গিয়ে সবচেয়ে সমস্যা হয়েছিল সেবা সংস্থার লাইন সরাতে। কিন্তু মেট্রোরেল প্রকল্পে সেই সমস্যা নেই। সেবা সংস্থার লাইন আগেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কাজ দ্রুত শেষ করার সব আয়োজন আছে। সরকার ও ঠিকাদার চাইলে কাজ দ্রুত করা সম্ভব।
উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত উড়ালপথ ও স্টেশন নির্মাণের কাজ শেষ করার কথা ২০১৯ সালের জুনে। চালু হওয়ার কথা ওই বছরের ডিসেম্বরে।
মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ আটটি প্যাকেজে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম প্যাকেজের আওতায় ডিপো এলাকার ভূমি উন্নয়নের কাজ সবার আগে শুরু হয়। এই প্যাকেজের কাজ গত ৩১ জানুয়ারি শতভাগ শেষ হয়েছে। আর বিরতিতে ট্রেন রাখার স্থান, ট্রেন মেরামত ও মালামালের গুদাম, প্রধান ওয়ার্কশপসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণকাজের বাস্তব অগ্রগতি ১৭ শতাংশ।
উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার উড়ালপথ ও ৯টি স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে প্যাকেজ ৩ ও ৪-এর আওতায়। পরে এই উড়ালপথের ওপরই ট্রেনের জন্য লাইন বসানো হবে। এই প্যাকেজের কাজ আগামী বছরের জুনের মধ্যে শেষ করতে হবে। এ বছরের আগস্ট পর্যন্ত এই প্যাকেজের অগ্রগতি ১৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ।
মিরপুর ১০ থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায়, দুই পাশে কংক্রিটের বেড়া দিয়ে মেট্রোরেল এলাকা ঘেরাও দেওয়া। ভেতরে বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে। কয়েকটা জায়গায় পাইলিংয়ের কাজ চলছে। কোথাও পাইলিং শেষে ক্যাপ বসানো হচ্ছে।
এ বিষয়ে কথা বলতে ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন সিদ্দিকের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি ধরেননি। পরিচয় জানিয়ে বক্তব্য জানতে চেয়ে খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি জবাব দেননি। প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী (পূর্ত) আবদুল বাকি মিয়া বলেন, ‘কাজের অগ্রগতি ভালো। দিন-রাত কাজ চলছে। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করার বিষয়ে আমরা আশাবাদী।’
মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রকল্প চালু হলে প্রতি ৪ মিনিট পরপর ১ হাজার ৮০০ যাত্রী নিয়ে চলবে মেট্রোরেল। ঘণ্টায় চলাচল করবে প্রায় ৬০ হাজার যাত্রী। প্রায় ২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে সময় লাগবে ৪০ মিনিটের কম। মেট্রোরেল প্রকল্পে বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা বসানোর কাজে বাস্তব অগ্রগতি ১ শতাংশ। ইতিমধ্যে প্রথম মেট্রোট্রেনের সামনের ও পেছনের নকশা এবং বাইরের রং চূড়ান্ত করা হয়েছে। এতে লাল-সবুজের প্রাধান্য রয়েছে।
বুয়েটের অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, মেট্রোরেলের মতো প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি দেখতে সময় লাগে। শেষের দিকে কাজের গতি অনেক বেড়ে যায়। তবে মেট্রোরেলের কাজ শেষ করার জন্য যে সময় নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটি খুবই আঁটসাঁট। মেট্রোরেলের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ হওয়া নিয়ে তিনি আশাবাদী হতে পারছেন না বলে জানান।
স্টেশনগুলো কেমন হবে
মেট্রোরেল স্টেশন থেকে নামার পর যাত্রীদের গন্তব্যে যাওয়ার ক্ষেত্রে সড়কপথ ব্যবহার করতে হবে। একসঙ্গে বহু যাত্রী এক স্টেশনে নামার পর সড়কপথে যাতায়াতের মাধ্যম কী হবে, তা নির্দিষ্ট করা নেই মেট্রোরেল প্রকল্পে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্পের ব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) খান মো. মিজানুল ইসলাম বলেন, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা কমিটি করা হয়েছে। কমিটি পুলিশ, দুই সিটি করপোরেশন, বিআরটিসি, বাস মালিক সমিতির সঙ্গে আলোচনা করছে। মেট্রোর যাত্রীদের সড়কপথে গন্তব্যে আসা-যাওয়ার বিষয়টি কোনো সমস্যা হবে না।
অনেকের ধারণা, মেট্রোস্টেশনগুলোর কারণে ফুটপাত দিয়ে পথচারীদের হাঁটতে সমস্যা হবে। পথচারীদের চলাচলে সমস্যা হবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে মিজানুল ইসলাম বলেন, শুনতে মনে হচ্ছে স্টেশন ফুটপাতে হবে। আসলে স্টেশনগুলো খুব টেকনিক্যালি তৈরি করা হচ্ছে। যাত্রীদের ওঠা-নামার সময় জায়গাগুলো অনেকটা প্রশস্ত হবে। স্টেশনের ভেতর দিয়ে রাস্তা পারাপারের ব্যবস্থাও থাকবে। তিনি আরও বলেন, কয়েকটি জরিপ চালিয়ে মেট্রোরেল স্টেশন নির্মাণের জায়গা চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রতিটি তিনতলা স্টেশনের দৈর্ঘ্য হবে ১৮০ মিটার। একেকটি স্টেশনে যাত্রী ধারণক্ষমতা হাজারের কাছাকাছি।
- কার্টসিঃ প্রথম আলো/ সেপ্টেম্বর ২৬,২০১৮
No comments:
Post a Comment