রাজধানীর সড়ক নিরাপত্তা
সামছুর রহমান
এত আলোচনার মধ্যেও সড়কে মৃত্যুর মিছিল থেমে নেই। গতকালও বাসের ধাক্কায় মারা গেছেন একজন। রাজধানীর সড়কে চলা দীর্ঘদিনের অনিয়ম তাড়ানোর ঘোষণা দিয়ে মাঠে নেমেছে পুলিশ। গত দুই মাসে ট্রাফিক আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশ আড়াই লাখের বেশি মামলা দিয়েছে । জরিমানা আদায় করেছে প্রায় ১৭ কোটি টাকা। মামলা ও জরিমানা দেদার হলেও সড়কে নৈরাজ্য বন্ধে পুলিশ যেসব উদ্যোগের কথা বলেছিল, সেগুলোর পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে ও নৈরাজ্য বন্ধে পুলিশের পাশাপাশি সরকারের অন্যান্য সংস্থাও নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এসব প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হচ্ছে খুবই কম। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে দেওয়া নির্দেশনাগুলোও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হচ্ছে না। ফলে রাজধানীর সড়কে শৃঙ্খলাও ফেরেনি।
গতকাল শনিবার মহাখালীর জাহাঙ্গীর গেটের কাছে বেপরোয়া বাসের চাপায় মারা গেছেন বেসরকারি ৭১ টেলিভিশনের কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন। এ নিয়ে গত দুই মাসেই রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১৫ জন। তাঁদের প্রায় সবাই মারা গেছেন বাস বা ট্রাকের চাপায়। নিহত ব্যক্তিদের ৭ জন ছিলেন পথচারী এবং ৬ জন মোটরসাইকেল আরোহী।
৪ সেপ্টেম্বর ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া সংবাদ সম্মেলন করে সড়কের অনিয়ম তাড়াতে নানা পরিকল্পনার কথা জানান। তিনি ট্রাফিক আইন প্রয়োগ ও সচেতনতা বাড়াতে সেপ্টেম্বর মাসজুড়ে ট্রাফিক সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন।
ট্রাফিকব্যবস্থার উন্নয়ন এবং নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে গত আগস্ট মাসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি কমিটি করা হয়। কমিটি নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে ৩০টি বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছে। পুলিশ কমিশনারের ঘোষিত উদ্যোগ আর এই কমিটির স্বল্পমেয়াদি নির্দেশনাগুলো একই রকম।
গত চার দিন রাজধানীর আটটি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এসব নির্দেশনার অন্যতম বাস থেকে যত্রতত্র যাত্রী ওঠা-নামা বন্ধ হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে চলন্ত অবস্থায় বাস থেকে যাত্রীদের নামতে বাধ্য করছেন। বাসের পাদানিতে যাত্রীদের ঝুলতে দেখা যায়। চলাচলের সময় অধিকাংশ বাসের দরজা বন্ধ রাখা হচ্ছে না।
বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ‘বাস স্টপেজ শুরু’ এবং ‘বাস স্টপেজ শেষ’ লেখা ছোট বোর্ড লাগিয়েছে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ। গতকাল দুপুরে অগ্রদূত পরিবহনের একটি বাসে টেকনিক্যাল থেকে মহাখালী পর্যন্ত যান এই প্রতিবেদক। পুরো পথে একবারের জন্যও বাসের দরজা বন্ধ করেননি চালকের সহকারী। নির্ধারিত স্টপেজ ছাড়াও অন্তত সাত জায়গা থেকে যাত্রী তোলা হয়। পুলিশের নির্ধারিত কোনো স্টপেজেই দাঁড়াননি চালক।
পদচারী–সেতুর উভয় পাশে ১০০ মিটারের মধ্যে সড়ক পারাপার বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। শ্যামলী এলাকায় দেখা যায়, পদচারী–সেতুর নিচে সড়ক বিভাজকে কোনো প্রতিবন্ধকতা বসানো হয়নি। পথচারীরা যানবাহনের সামনে দিয়ে ঝুঁকি নিয়েই সড়ক পার হচ্ছেন। শিক্ষার্থী, বয়স্ক ব্যক্তি, নারী, শিশু কেউই পদচারী–সেতুর দিকে তাকাচ্ছেও না।
সেখানে কথা হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরাফাত রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘রাস্তা পার হতে বারবার ওপর-নিচ কেন করতে হবে? দিনে ১০ বার রাস্তা পার হতে হলে ১০ বার ওভারব্রিজে ওঠা সম্ভব? নিচ দিয়েই জেব্রা ক্রসিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।’
গণপরিবহনে দৃশ্যমান দুটি জায়গায় চালক ও চালকের সহকারীর ছবিসহ নাম, চালকের লাইসেন্স নম্বর এবং মোবাইল ফোন নম্বর প্রদর্শন নিশ্চিত করতে বলা হয়েছিল। অন্তত ২০টি বাসে ওঠে দেখা যায়, সেগুলোর কোনোটিই মানা হচ্ছে না।
রাজধানীর ফুটপাতগুলো হকারদের দখলে থাকায় পথচারীরা অনেকটা বাধ্য হয়েই মূল সড়কে হাঁটতে বাধ্য হন। ঘোষণা দিলেও ফুটপাতগুলো দখলমুক্ত করতে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বরে পদচারী–সেতুটির চার দিকে সিঁড়ি আছে। কিন্তু প্রতিটি সিঁড়িতে ওঠার মুখের আশপাশে বসেছে জামাকাপড়, জুতা, চশমা, খাবারের দোকান। সিঁড়ির নিচ দিয়ে হাঁটার পথেও বসেছে দোকানপাট।
পুলিশ কমিশনার ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেপ্টেম্বর মাসে গুলিস্তানের জিরো পয়েন্ট থেকে ক্যান্টনমেন্টের জাহাঙ্গীর গেট পর্যন্ত ‘মডেল করিডর’ চালু করা হবে। এ পথে স্বয়ংক্রিয় সংকেতের মাধ্যমে যানবাহন চলাচল করবে এবং সব ধরনের শৃঙ্খলা ও নিয়ম নিশ্চিত করা হবে।
গতকাল দেখা যায়, এই পথে স্বয়ংক্রিয় সংকেতব্যবস্থা চালুই হয়নি। জাহাঙ্গীর গেট, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বিজয় সরণি, ফার্মগেট এলাকার কোনো সংকেত বাতিই জ্বলছে না। দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা হাতের ইশারাতেই যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছেন।
রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোতে লেগুনা বা হিউম্যান হলার চলাচল করতে পারবে না বলে ডিএমপি কমিশনার ঘোষণা দেন। এরপর বেশ কিছু পথে লেগুনা চলাচল বন্ধ রয়েছে। আবার মিরপুরের ৬০ ফুট সড়ক থেকে ফার্মগেট, কামরাঙ্গীরচর থেকে গুলিস্তান, শ্যামলী থেকে ঢাকা উদ্যান পর্যন্ত লেগুনা চলছে। অবশ্য কোনো বিকল্প পরিবহনের ব্যবস্থা না করেই রাজধানীতে লেগুনা বন্ধের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করছেন যাত্রীরা।
তবে মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহীর হেলমেট ব্যবহারের নির্দেশনা অনেকটাই বাস্তবায়িত হয়েছে। এ বিষয়ে পুলিশ যথেষ্ট তৎপর। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে পুলিশের পাশাপাশি গার্ল গাইডস এবং স্কাউট সদস্যরাও পথচারীদের সচেতন করতে কাজ করছেন। এসব মোড়ে পথচারীদের যত্রতত্র সড়ক পারাপার হতে দেওয়া হচ্ছে না। তবে যেখানে স্কাউট সদস্যরা নেই, সেখানে পথচারীরা ঝুঁকি নিয়েই পার হচ্ছেন।
গত ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হন। সেদিন থেকে নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যেই পুলিশের ট্রাফিক সপ্তাহ শুরু হয়। পরে তিন দিন বাড়িয়ে ট্রাফিক সপ্তাহ শেষ হয় ১৪ আগস্ট। এরপর ঈদুল আজহার জন্য অভিযানে বিরতি দেয় পুলিশ। ঈদের পর ২৫ আগস্ট থেকে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ।
গত ১ আগস্ট থেকে গত শুক্রবার (২৮ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত ট্রাফিক আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ট্রাফিক বিভাগ মোট মামলা দিয়েছে ২ লাখ ৫২ হাজার ৯৭৮টি। জরিমানা আদায় করা হয়েছে ১৬ কোটি ৫৭ লাখ ৬২ হাজার ৪৫৯ টাকা।
সবচেয়ে বেশি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে মোটরসাইকেলের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, এই বছরের আগস্ট পর্যন্ত ঢাকায় নিবন্ধিত মোটরসাইকেল আছে ৫ লাখ ২ হাজার ৬৫৮টি। গত দুই মাসে আইন অমান্য করায় ১ লাখ ৩ হাজার ৩৭৪টি মোটরসাইকেলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, গড়ে নিবন্ধিত পাঁচটি মোটরসাইকেলের মধ্যে একটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ। এরপরও মোটরসাইকেলচালকদের শৃঙ্খলায় আনা যাচ্ছে না।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মীর রেজাউল আলম প্রথম আলোকে বলেন, এই নির্দেশনাগুলোর বাস্তবায়ন চলমান প্রক্রিয়া। একেকটি নির্দেশনার সঙ্গে একাধিক সংস্থা জড়িত। নির্দেশনা বাস্তবায়নে সমন্বিতভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। রাতারাতি সব পরিবর্তন সম্ভব নয়। তবে রাজধানীর সড়কে শৃঙ্খলা ফিরছে।
বেপরোয়া গাড়ি চালানো বন্ধ করতে ৯ আগস্ট থেকে চালকদের সঙ্গে চুক্তিতে গাড়ি না চালানোর ঘোষণা দেয় মালিক সমিতি। ফিটনেসবিহীন গাড়িও না চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় তারা।
রাজধানীর বিভিন্ন পথের ১৫টি বাসের চালক ও সহকারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁদের কারও বেতন নির্ধারিত নয়। যত ট্রিপ তত টাকা—এই চুক্তিতে তাঁরা বাস চালাচ্ছেন। এ বিষয়ে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে চলা এই ব্যবস্থা সাত দিনে হয়তো বন্ধ হবে না, কয়েক মাস সময় লাগবে।’
অবশ্য সড়কের নৈরাজ্য বন্ধে সরকারের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে বলে মনে করেন নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সড়কের বিশৃঙ্খলা গুরুতর পর্যায়ে চলে গেছে। এই খাতে প্রচণ্ড রকম দুর্নীতি। তিনি মনে করেন, সড়কে শৃঙ্খলা আনতে হলে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকতে হবে। মালিক, চালক, পথচারী এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আইন মানার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।
- কার্টসিঃ প্রথম আলো/ সেপ্টেম্বর ৩০,২০১৮
No comments:
Post a Comment