সম্পাদকীয়
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন
১৯ সেপ্টেম্বর দেশের মানুষের বাক্স্বাধীনতা হরণের জন্য একটি কালো দিন হিসেবে ইতিহাসে ঠাঁই করে নেবে। কারণ, এই দিনটিতে সচেতন অংশীজন বিশেষ করে গণমাধ্যমকর্মীদের বিস্ময়ে স্তব্ধ করে দিয়ে বিতর্কিত ডিজিটাল আইন পাস হয়েছে। দলমত-নির্বিশেষে সচেতন মহল তাই একবাক্যে এই বিষয়ে তাদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় গভীর হতাশা ব্যক্ত করেছে। তাদের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় একটি বিষয় স্পষ্ট যে, মানুষকে ভয়ভীতি দেখাতে এই আইনের ব্যাপকভিত্তিক অপপ্রয়োগ ঘটতে পারে। দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর একশ্রেণির সদস্য এখন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারেন।
অবশ্য তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী আশ্বস্ত করেছেন যে, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এই আইন ব্যবহার করা হবে না। বরং উল্টো তিনি সংসদে একটি অভিনব দাবি করেছেন যে, এই আইন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার পথ খুলে দেবে। অপ্রিয় সত্য হলো, তাঁর এই দাবি সঠিক বলে গণ্য করার কোনো কারণ নেই। মন্ত্রীর এই দৃষ্টিভঙ্গি একটি প্রহসন। তবে কয়েক বছর ধরে কলঙ্কিত কালাকানুন হিসেবে চিহ্নিত ৫৭ ধারাকে যে ‘ছড়িয়ে ছিটিয়ে’ নতুন আইনে অবিকল ধারণ করার মতো নজির তৈরি হতে পারে, তা আমাদের কল্পনায় ছিল না। শেষ পর্যন্ত তা–ই ঘটেছে।
২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকার তাদের ক্ষমতা প্রলম্বিত করার দুরভিসন্ধি থেকে সুকৌশলে একটা রাজনৈতিক ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ৫৭ ধারা যুক্ত করেছিল। ঠিক এ রকমেরই একটি বিধান ভারত তার আইনে যুক্ত করলে তার বৈধতা সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করা হয়। এবং সুপ্রিম কোর্ট তা অসাংবিধানিক হিসেবে বাতিল করলে ক্ষমতাসীন দল তা বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নেয়। সব থেকে বেদনাদায়ক হলো, একাধিক সেমিনারে আইনমন্ত্রী নিজেও ৫৭ ধারা বাতিল বা সংশোধনে নির্দিষ্ট আশ্বাস দিয়েছিলেন।
আমরা এটাও বিবেচনায় নেব যে, দেশের প্রচলিত আইনে বহুকাল ধরে বিরাজমান থাকা কিছু কালাকানুনের প্রয়োগ সরকার করেনি। ঔপনিবেশিক আমলের ১৯২৩ সালের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের সাম্প্রতিক ব্যবহার আমরা দেখি না। কিন্তু প্রয়োগ করি না, করব না—এ ধরনের যুক্তি দিয়ে প্রায় শতাব্দী কাল পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটির নীতিনির্ধারকেরা ১৯২৩ সালের আইনের ‘গুপ্তচরবৃত্তির’ ধারণাকে বরণ করবেন, তা কোনো স্বাভাবিক চিন্তাপ্রসূত বিষয় হতে পারে না। ওই আইনে ‘গুপ্তচরবৃত্তি’ যুক্ত করার লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র ও স্বাধীনতাকামীদের দমন করা।
সব থেকে দুর্ভাগ্যজনক যে, নয় মাসের একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাক্স্বাধীনতা এবং সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করেছিলেন। এর লক্ষ্য ছিল, এই রাষ্ট্র গঠনে সাংবাদিকদের লেখনীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা এবং অনাগত দিনের শাসকদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে, তারা শাসনের স্বার্থে কখনোই যা খুশি উপায়ে ‘সংবাদক্ষেত্রের’ স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। নতুন আইনটি এর আগে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগেরই প্রণীত তথ্য অধিকার আইন এবং বিশেষ করে বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ, যাতে শুধুমাত্র ‘যুক্তিসংগত বাধানিষেধ’ বজায় রাখার শর্তে সংসদকে আইন পাস করার শর্ত দিয়েছে, সেই শর্ত লঙ্ঘন করেছে।
এই আইন সর্বতোভাবে ১৯৭২ সালের সংবিধান এবং এরপরে সুপ্রিম কোর্টের একাধিক রায় এবং আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা সমর্থিত মৌলিক মানবাধিকারের সঙ্গে গুরুতর সংঘাত তৈরি করেছে। আমরা ডিজিটাল নিরাপত্তা, দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা ও গঠনমূলক সমালোচনার নীতিতে বিশ্বাসী। কিন্তু নতুন আইন অপব্যবহারের ভয়ংকর ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। এটা তাই চলতে পারে না।
আগামী সাধারণ নির্বাচন, যা অবাধ ও সুষ্ঠু হবে কি না, সেই বিষয়ে সন্দেহ সংশয় যখন যথেষ্ট জোরালো, তখন নির্বাচনকে টার্গেট করেই তড়িঘড়ি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করা হলো কি না, সেই প্রশ্ন নাকচ করা যাবে না। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে এই কালো আইন সংশোধনের কোনো বিকল্প নেই।
- কার্টসিঃ প্রথম আলো/ সেপ্টেম্বর ২৩,২০১৮
No comments:
Post a Comment