Search

Sunday, September 30, 2018

সংখ্যালঘুদের জন্য চাই নিরাপদ পরিবেশ

সম্পাদকীয়

নির্বাচন ও মনোনয়ন


গত শুক্রবার বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সমাবেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে যেসব দাবিদাওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেসবের সঙ্গে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই। যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোত্রনির্বিশেষে সব নাগরিক সমান সুযোগ ভোগ করবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ইতিহাস নানা কুটিল ও জটিল পথে পরিচালিত হওয়ায় এই উপমহাদেশে অনেক অস্বাভাবিক ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটেছে, বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়।

উপমহাদেশের প্রতিটি দেশেই ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুরা কমবেশি বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার। এটি সংখ্যালঘুদের জন্য নয়, বরং সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের জন্যই লজ্জার। অন্য কোনো দেশে সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যের প্রতিবাদ তখনই ন্যায্যতা পাবে, যখন আমরা আমাদের সংখ্যালঘুদের প্রতি সুবিচার করতে পারব।

তিনটি সম্প্রদায়ের নামে গড়ে ওঠা ঐক্য পরিষদের সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ভূমিকা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করেন। তাঁদের জানার জন্য বলা প্রয়োজন যে একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে এই সংগঠনটি  গঠিত হয়েছিল। এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৮ সালে যখন রাষ্ট্রধর্ম বিল পাস করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা হয়, তখন সংখ্যালঘুরা ঐক্য পরিষদকে প্রতিবাদ ও আন্দোলনের হাতিয়ার করেন। গত ৩০ বছরে বেশ কয়েকবার সংবিধান পরিবর্তন করা হলেও স্বৈরাচারী শাসকের মস্তিষ্কজাত এই কালো আইনটি এখনো বহাল রয়েছে। পরবর্তী কোনো সরকারই আইনটি বাতিল করতে সাহস পায়নি, যদিও আইন পাসের সময় সব দলের নেতারা এর প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।

শুক্রবারের সমাবেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও নাগরিক সমাজের নেতারা নির্বাচন সামনে রেখে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, এ দেশে নির্বাচন অনেকের কাছে উৎসব হলেও সংখ্যালঘুদের জন্য আতঙ্কের বিষয়। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। তখন ক্ষমতায় ছিল বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট। বর্তমান সরকার সেই ঘটনা তদন্তে একটি বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের মাধ্যমে অপরাধীদের শনাক্ত করলেও কারও বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও রামু, নাসিরনগর, গোবিন্দগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-নির্যাতন হলেও অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতিই সংখ্যালঘুদের গভীর অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। সরকার রামু ও নাসিরনগরে আক্রান্ত মানুষের বাড়িঘর পুনর্নির্মাণ করে দিয়েছে। এটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু অপরাধীরা শাস্তি না পেলে সংখ্যালঘুরা নিজেদের নিরাপদ ভাববে কী করে?

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে উত্থাপিত পাঁচ দফা প্রস্তাবে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা করেছেন কিংবা তাদের জমিজমা দখল করে নিয়েছেন, এ রকম কোনো ব্যক্তিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন না দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। শুধু সংখ্যালঘুদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষার জন্যই নয়, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে হলেও এ ধরনের লোকদের মনোনয়ন দেওয়া যাবে না।

সমাবেশে সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন, আনুপাতিক হারে সংসদে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন ও অর্পিত সম্পত্তি আইনের বাস্তবায়ন, সমতলের আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশন গঠন, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে রূপরেখা প্রণয়নের যে দাবি জানানো হয়েছে, তাকে আমরা ন্যায্য বলে মনে করি।

সংবিধানে ধর্ম-বর্ণ-জাতিনির্বিশেষে সবার সমানাধিকারের যে অঙ্গীকার রয়েছে, তা থেকে রাষ্ট্র সরে যেতে পারে না। সংবিধানে বর্ণিত মানবিক মর্যাদাশীল ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যের অবসান ঘটাতেই হবে।

  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ সেপ্টেম্বর ৩০,২০১৮ 

No comments:

Post a Comment