মাসুদ মজুমদার
নির্বাচন কমিশন সমালোচনার ঊর্ধ্বে উঠতে পারছে না। যেখানে অবিতর্কিত নির্বাচন কমিশন বা ইসি এবং সিইসি প্রয়োজন, সেখানে বিতর্ক বাড়ছে। যার ফলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা সিইসি কিংবা নির্বাচন কমিশন এখনো জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারছে না। সরকারের মুখপাত্ররা সিইসি ও নির্বাচন কমিশনকে অবিতর্কিত থাকতে দিতে চান না বলেই মনে হয়। কারণ, সিইসি যা বলেন তা ‘সংশোধন’ করে দিতে চেষ্টা করেন বর্তমান সরকারের মুখপাত্ররা।
ইভিএম নিয়ে অতি উৎসাহ এবং সেনা মোতায়েন নিয়ে সিইসি যা বলেন; সরকার যেন তার সে বক্তব্যকে সমর্থন করা দায়িত্ব বলে মনে করে। নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ প্রশ্নেও ইসি কতটা দৃঢ়, তা স্পষ্ট হতে পারেনি। কারণ, সরকারি লোকদের চিন্তা-ভাবনা ইসিকে বিশেষ বিবেচনায় নিতে হচ্ছে বলেই জনসাধারণের ধারণা। জনপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ তথা আরপিও খসড়ার পর্যালোচনা নিয়েও সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে; ঘোষিত রোডম্যাপও অনুসরণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন করার ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণায় এক ধরনের জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। সে ক্ষেত্রে ইসি এখনো স্পষ্ট করে কিছু বলেনি। তাই ধারণা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, ইসি সম্ভবত নিষ্ঠা নিয়েও মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারছে না; যেমনটি পারা উচিত ছিল। নির্বাচন কমিশন স্থানীয় প্রশাসনের ওপর কতটা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে, সে ব্যাপারেও জনমনে সংশয় রয়েছে। তার বাইরে পুলিশ প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণে রেখে ইসির কাজ করার সক্ষমতা নিয়ে আজো জনমনে আস্থা সৃষ্টি হয়নি।
বর্তমান সরকার সারা দেশে বিরাট একটি সুবিধাভোগী শ্রেণী সৃষ্টি করেছে। এটা অস্বীকার করা যাবে, কিন্তু বাস্তবতা এড়ানো যাবে না। এদের দৌরাত্ম্য নির্বাচনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এ ক্ষেত্রে ইসির ভূমিকা এখনো কতটা দৃঢ়, সেটা বোঝা কঠিন। ক্ষমতাসীনেরা নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে দিয়েছেন; অথচ বিরোধী দল ন্যূনতম গণতন্ত্রচর্চার সুযোগও পাচ্ছে না। এ ব্যাপারে ইসির ভূমিকা এখনো অনেকটা দায়হীন।
আইন নির্বাচন কমিশনকে প্রচুর ক্ষমতা দিয়েছে। কিন্তু সেই ক্ষমতা প্রয়োগের সাহস ও সক্ষমতা দেখাতে প্রশাসন, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা প্রয়োজন। অতীতেও আমরা লক্ষ করেছি, ইসি নিজের ক্ষমতাটুকু স্বাধীনভাবে প্রয়োগ করতে সক্ষম হয় না; বরং প্রশাসনের কাছে জিম্মি হয়ে ইসি প্রচুর অনিয়মকে প্রশ্রয় দিয়েছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের কথা বাদ দিলেও নির্বাচন কেন্দ্রগুলোর নিরাপত্তা বিধান এবং ভোটারদের নির্বিঘ্নে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেয়া সম্ভব হয় না।
ক্ষমতাহীন সেনা মোতায়েন কার্যত কোনো কাজ দেয় না। তাই সেনা মোতায়েন করতে হবে তাদের পর্যাপ্ত ক্ষমতাসহ। নয়তো জাতিকে যেখানে এনে বর্তমান ক্ষমতাসীনেরা দাঁড় করিয়েছেন, সেখানে একটি গ্রহণযোগ্য ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করা কঠিন।
জাতীয় সংসদের নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, রাজনৈতিক মেরুকরণ ততটা চাঙা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত রাজধানীর নাট্যমঞ্চের ঐক্যপ্রক্রিয়া নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এই মেরুকরণের ধরন-ধারণের ওপরই জাতীয় নির্বাচন নির্ভর করবে। মিডিয়ায় খবর এসেছে, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কেউ দুর্ভাবনায় রয়েছেন; কেউ আছেন খোশ মেজাজে। বাস্তবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি এবং ভোটারদের মনের ওপর নির্বাচন নির্ভর করবে। তবে নির্বাচন কমিশন যতটা সাফল্য ও যোগ্যতার সাথে আম্পায়ারিং করবে- গ্রহণযোগ্য ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হবে কি না সেটাই ফলাফল মিলিয়ে দেবে। এটা ঠিক, ভোটারেরা পরিবর্তনের প্রত্যাশায় প্রহর গুনছে। জাতীয় নেতাদের মনের অবস্থাও তাই। শেষ পর্যন্ত পরিবেশ পরিস্থিতি এবং ইসির ভূমিকাই মুখ্য হয়ে যাবে।
যেকোনো মানুষের সাথে দেখাসাক্ষাতে সবার প্রশ্ন একটাই- কী হবে? কী হতে যাচ্ছে? নির্বাচন হবে তো? সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে কি না, আবার ৫ জানুয়ারি ধরনের কোনো কিছুর আয়োজন চলছে না তো? এর বাইরেও অনেক প্রশ্ন করা হয়, যা উল্লেখ করা যায় না কিংবা উল্লেখ করলে নানা ধরনের প্রশ্ন উঠবে। আর জবাবই বা কী দেয়া সম্ভব? দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি ভালো নেই। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি সব ক্ষেত্রে এক ধরনের নৈরাজ্য চলছে। নীতি-নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন না তোলাই ভালো। আইনশৃঙ্খলা নিয়ে কম কথাই সবার জন্য নিরাপদ। দেশে যখন এমন একটি গুমোট ও অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই কোনো বিষয়ে মন্তব্য করা যায় না। তা ছাড়া, পুরো দেশটি এক ধরনের ভীতি ও শঙ্কার রাজ্যে পরিণত হয়েছে। কেউ নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একবাক্যে মন্তব্য করতে পারছেন না। রাজনীতিবিদেরা রাজনীতি সম্পর্কে মন্তব্য করতে নারাজ। অর্থনীতিবিদেরা শুধু বলেন, সামগ্রিক পরিস্থিতি হতাশাজনক।
গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার, পররাষ্ট্রনীতি, দেশের উন্নয়ন, ব্যাংকপাড়ার অবস্থা- কোথাও কেউ সুখবর দিতে পারছেন না। সরকারপ্রধান ও ক্ষমতাসীন দলের লোকদের রাজনীতি আছে, তারা যা খুশি বলতে পারেন, মন্তব্য করতে পারেন, প্রতিপক্ষকে শাসাতে পারেন। ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদ শোনাতে পারেন। কিন্তু পুরো জাতিকে হতাশায় ঘিরে ধরেছে। এ দিকে, নির্বাচনের রোডম্যাপ শেষ পর্যন্ত ঠিক থাকবে কি না, বলা কঠিন।
জাতীয় রাজনীতিতে নানামুখী সঙ্কট রয়েছে। অসংখ্য ইস্যু রয়েছে। আস্থা-অনাস্থার সঙ্কটও কম নেই। তাই সরকার সঙ্কট ঘনীভূত করার ক্ষেত্রে এখনো কোনো ছাড় দেয়নি। আবার বিরোধী দলও একটা সীমা পর্যন্ত ছাড় দেবে, তার বাইরে নির্বাচনকে এড়িয়ে যেতেও পারে। তবে দেশী-বিদেশী প্রভাবক শ্রেণী এবার আমাদের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বেশ উৎসাহী। এই উৎসাহে যাতে ভাটা না পড়ে সে ব্যাপারে সরকার ও বিরোধী জোট সমানভাবে সতর্ক থাকার চেষ্টা করার কথা।
এবার বিচারবহির্ভূত হত্যা, খুন, গুম, জেল-জুলুম বেশি মাত্রায় সামনে এসে যাবে। দলবাজির বিষয়টি জনগণ আমলে নেবে। সবচেয়ে বড় কথা, জনগণ বিগত দিনের দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারির সাক্ষী হয়ে আছে। জনগণ প্রত্যক্ষ দেখা এ বিষয়গুলোর সাক্ষ্য দেয়ার জন্য কোর্টে যাবে না। প্রতিবাদ করার সুযোগ পায়নি বলে সাক্ষ্য দিতে যাবে না। তবে ব্যালট হাতে পেলে সেটি বাক্সে ফেলার সুযোগ পেলেই হবে।
খালেদা জিয়ার বিষয়টি জনগণের মনে এত বেশি দাগ কেটেছে যে, সেটাই সরকারকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জে ফেলতে পারে। বিচার-আচার নিয়ে জনগণ উচ্চবাচ্য করেনি। করতেও যাবে না। কিন্তু যে প্রতিক্রিয়া দেখাবে, সেটা ভাবনারও অতীত। তা শাসকেরা এখনো ভাবতে পারছেন না। এখনো শাসকেরা যেদিকে তাকাচ্ছেন, সেদিকেই ‘নিজের লোক’ দেখতে পাচ্ছেন। সবাই কর্তার ইচ্ছায় কীর্তন গাইতে চেষ্টা করছে। এটাই যেকোনো স্বৈরশাসক ও একনায়কের দৃষ্টিভ্রম। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে অতীত যতটা স্মৃতিতে আছে, ততটায় মনে হয়- সব একনায়ক একই ধরনের আচরণ করে থাকেন। একই ধরনের ভাবেন। একই ধরনে সব মানুষকে নিজের লোক ভাবতে চেষ্টা করেন। যতক্ষণ না তখত উল্টে যায়, ততক্ষণ তারা শুধু দুর্বিনীত থাকেন না, এতটা বেপরোয়া থাকেন যে, মনে হয় তারা ছাড়া আর কেউ ক্ষমতার যোগ্য নন। প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। যারা আছে তারা তো দুর্বল। ফুৎকারে উড়ে যাবে।
যদিও আমরা কোনো শাসকের ভাগ্য গুনে বলে দিতে পারি না, কার কী পরিণতি হবে বা কখন হবে। এটা বিধাতা নিজের হাতে রেখে দিয়েছেন। তবে জানিয়ে দিয়েছেন- দুর্বিনীত এবং দুঃশাসক, যারা জনগণের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ জুলুম করে, তাদের পরিণতি কোনো দিন ভালো হয় না।
এবার বিশ্বপরিস্থিতি ও জাতীয় প্রেক্ষাপট একসাথে পাল্টে গেছে। আঞ্চলিক রাজনীতিতে বোঝাপড়ার ধরনও পাল্টে যেতে শুরু করেছে। এখন আঞ্চলিক রাজনীতিতে আমরা একক খেলোয়াড় নই। খেলোয়াড়ের সংখ্যা শুধু বাড়েনি, আরো বাড়তি কিছু করার চেষ্টা করে যাবে।
আঞ্চলিক রাজনীতির সাথে বিশ্বরাজনীতির পারঙ্গম অনেক খেলোয়াড় রয়েছেন, যারা তাদের স্থানীয় এজেন্টদের সময়মতো কাজে লাগাবেন এবং ঘুড়ির রশির মতো টানবেন। তাই আগামী জাতীয় নির্বাচন শুধু বাংলাদেশের মাঠের একটা খেলা নয়। এখানে বহু উৎসাহী দর্শক থাকবেন, আম্পায়ার থাকবেন অনেকেই। তা ছাড়া, দেশীয় রাজনীতির অভিজ্ঞ খেলোয়াড়রা বসে থাকবেন না। তারা নতুন করে অঙ্ক কষবেন। তাই জাতীয় নির্বাচন হবে জাতীয় প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের জন্য। এ সত্যটি কেউ মস্তিষ্ক থেকে বাদ দিলে ভুল করবেন।
- কার্টসিঃ নয়াদিগন্ত/ সেপ্টেম্বর ২৭,২০১৮
No comments:
Post a Comment