Search

Monday, September 24, 2018

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনিয়ম বন্ধে ব্যর্থ শিক্ষা মন্ত্রণালয়

সাইফ সুজন
দফায় দফায় সময় নিয়েও স্থায়ী ক্যাম্পাসে যায়নি দুই ডজনের বেশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ দেয়া হচ্ছে বেআইনিভাবে। অর্থব্যয়ের হিসাব দেয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তারও তোয়াক্কা করছে না বেসরকারি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়। আইনের ব্যত্যয় ঘটছে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে। একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এসব অনিয়ম নিয়মিত ঘটলেও তা বন্ধে ব্যর্থ হচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এসব অনিয়ম বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) সময় সময় সুপারিশ করলেও তা আমলে নিচ্ছে না মন্ত্রণালয়।



বর্তমানে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ১০৩টি। এর মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে ৯১টিতে। ১১টি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পেলেও শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেনি। আর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।



খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছর শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পূর্ণাঙ্গভাবে স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তরের জন্য ৩৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে সময় বেঁধে দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিভিন্ন ধাপে বেঁধে দেয়া এ সময়সীমা শেষ হয়েছে গত ৩১ ডিসেম্বর। সরকারের বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসে পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি দুই ডজনের বেশি বিশ্ববিদ্যালয়। স্থায়ী ক্যাম্পাসে না গেলে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধের হুঁশিয়ারি দেয়া হয় ওই সময়। তারও আট মাস পেরিয়ে গেছে। যদিও এখন পর্যন্ত নির্দেশ অমান্যকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি মন্ত্রণালয়।



বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তর প্রক্রিয়ার অগ্রগতি নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদনও পাঠিয়েছে ইউজিসি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৭টি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তরের চিঠি দেয়া হয়। নির্দিষ্ট কিছু প্রোগ্রাম স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তরের জন্য বলা হয় ১৭টি বিশ্ববিদ্যালয়কে। এছাড়া দুটি বিশ্ববিদ্যালয়কে আউটার ক্যাম্পাস বন্ধ করতে ও একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য জমি কেনার নির্দেশ দেয়া হয়। এর মধ্যে সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তর হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো— ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, পুন্ড্র ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামী, ইস্ট ডেল্টা, অতীশ দীপঙ্কর ও প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয়।



সরকারের বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে ১২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের অগ্রগতি খুঁজে পায়নি ইউজিসি। এগুলো হলো— ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ, স্টামফোর্ড, সাউথ ইস্ট, প্রাইমেশিয়া, বাংলাদেশ, আশা, রয়েল, ভিক্টোরিয়া, সাউথ এশিয়া, ইবাইস, স্টেট ও চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়। এদিকে স্থায়ী ক্যাম্পাস থাকা সত্ত্বেও স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় আগ্রহ নেই এ ধরনের পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এগুলো হলো— ড্যাফোডিল, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল, এশিয়ান, লিডিং ও মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। এছাড়া চট্টগ্রামের ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ও ঢাকার সিটি ইউনিভার্সিটিকে আউটার ক্যাম্পাস বন্ধের নির্দেশনা দেয়া হলেও তারা তা মানছে না।



ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান এ প্রসঙ্গে বলেন, স্থানান্তর প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করে সার্বিক পরিস্থিতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে। আমরা আমাদের কাজ করেছি। এখন আইন না মানা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেয়া হবে— সেটি দেখার দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের।



এদিকে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের আইন অমান্যের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে। আইন অনুযায়ী, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য সার্বক্ষণিক উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ থাকা বাধ্যতামূলক। যদিও ইউজিসির ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, দেশে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনাকারী ৯১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২১টিতেই উপাচার্য নেই। কোষাধ্যক্ষ নেই ৪৯টিতে। আর উপ-উপাচার্য ছাড়াই চলছে ৭০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।



এছাড়া যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা ছাড়াই উপাচার্য নিয়োগের অভিযোগ রয়েছে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে। গত বছরের নভেম্বরে বোর্ড অব ট্রাস্টিজ থেকে পাঠানো প্রস্তাবের ভিত্তিতে রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকার উপাচার্য পদে ড. মো. আজিজুর রহমানকে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। নিয়োগের নয় মাস পার হলেও এখনো দায়িত্ব বুঝে পাননি তিনি। উল্টো ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য দিয়েই শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম চালাচ্ছে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়টির পক্ষ থেকে নতুন প্যানেল প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে মন্ত্রণালয়ে। নতুন প্যানেল বিষয়ে ইউজিসির মতামতও চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যদিও রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে নিয়োগ না দেয়া বিষয়ে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়।



গত বছরের ৯ আগস্ট বরিশালের ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজের উপাচার্য প্যানেল বিষয়ে মতামত জানাতে ইউজিসিকে চিঠি দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্যানেলভুক্ত তিনজনের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে প্রতিবেদন দেয় ইউজিসি। প্রতিবেদনে বলা হয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী উপাচার্য পদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কমপক্ষ ১০ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতাসহ গবেষণা ও প্রশাসনিক কাজে মোট ২০ বছরের অভিজ্ঞতা প্যানেলভুক্ত অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলমের নেই। অধ্যাপক ড. মো. সবদের আলীর যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা রয়েছে। তবে বিদেশী ডিগ্রির সমতা সনদ নেই। অধ্যাপক ড. সুশান্ত কুমার ভট্টাচার্য্যের ১০ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতাসহ গবেষণা ও প্রশাসনিক কাজে মোট ২০ বছরের অভিজ্ঞতা নেই। তাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এর ধারা ৩১ (৩) অনুযায়ী যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে পূর্ণাঙ্গ প্যানেলের প্রস্তাব করে ইউজিসি।



যদিও পরবর্তী সময়ে পুনরায় প্যানেল প্রস্তাব না নিয়ে অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলমকে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য পদে নিয়োগ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।



বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি শিক্ষাবর্ষের আয়-ব্যয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশনা রয়েছে সরকারের। প্রতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে কোনো নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের (সিএ ফার্ম) মাধ্যমে নিরীক্ষা করে প্রতিবেদন ইউজিসিতে জমা দেয়ার কথা।

যদিও ইউজিসি সূত্রে জানা যায়, এখন পর্যন্ত ২০১৭ সালের নিরীক্ষিত অডিট রিপোর্ট জমা দিয়েছে ২৭টি বিশ্ববিদ্যালয়। অর্থাৎ অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ই সরকারের এ নির্দেশনা মানছে না।



বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০-এর ৩৫(৩) ধারা অনুযায়ী, কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগ বা প্রোগ্রামে খণ্ডকালীন শিক্ষক সংখ্যা পূর্ণকালীন শিক্ষক সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের বেশি হওয়ার সুযোগ নেই। যদিও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (আইইউবি), সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি, স্টেট, প্রিমিয়ার, ইবাইস ও ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিসহ বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক সংখ্যা আইনে নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি।



এসব অনিয়ম ঘটলেও তা বন্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যে ব্যর্থ তেমনটি মনে করেন না শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই স্থায়ী ক্যাম্পাসে চলে গেছে। আবার কিছু বিশ্ববিদ্যালয় সময় চেয়েছে। ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আইন পরিপালনে উৎসাহিত করার চেষ্টা চলছে। স্থায়ী ক্যাম্পাস, উপাচার্য নিয়োগ ও আয়-ব্যয়ের হিসাবসহ সব বিষয়ে আইন অনুসরণ করার কথা বলা হচ্ছে। হুট করে ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ কিংবা কঠোর কোনো পদক্ষেপ নিলে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এসব বিষয় মাথায় রেখেই সিদ্ধান্ত নিতে হয় আমাদের। সব মিলিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ব্যর্থ সেটি বলা যাবে না।

  • কার্টসিঃ বনিক বার্তা/ সেপ্টেম্বর ২৪,২০১৮ 

No comments:

Post a Comment