- ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন
- বিতর্কিত ৫৭ ধারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা হলো
- ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ যুক্ত করে পরিধি আরও বড় করা হলো
- পরোয়ানা ছাড়া তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা
- সাংবাদিকদের উদ্বেগ ও প্রস্তাব উপেক্ষিতই থেকেছে
- আইনটি পাস হলে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা হুমকিতে পড়বে
- সম্পাদক পরিষদ ইতিমধ্যে আইনটি প্রত্যাখ্যান করেছে
সরকারের বিভিন্ন পর্যায় ও সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হলেও প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বড় কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। যে ধারাগুলো নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের আপত্তি ছিল, তার কয়েকটিতে কিছু জায়গায় ব্যাখ্যা স্পষ্ট করা, সাজার মেয়াদ কমানো এবং শব্দ ও ভাষাগত কিছু সংশোধন এনেছে সংসদীয় কমিটি। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারার বিষয়গুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে চারটি ধারায় ভাগ করে এই আইনে রাখা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই আইনের ব্যাপারে সাংবাদিকদের উদ্বেগ ও প্রস্তাব উপেক্ষিতই থেকেছে। আইনটি পাস হলে সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকতার স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়বে। সম্পাদক পরিষদ ইতিমধ্যে আইনটি প্রত্যাখ্যান করেছে।
গতকাল সোমবার জাতীয় সংসদে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ইমরান আহমদ ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল-২০১৮-এর প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। নিয়ম অনুযায়ী, এখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বিলটি পাসের জন্য সংসদে তুলবেন।
সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রস্তাবিত আইনের বহুল আলোচিত ‘ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তি’ শব্দটি বাদ দেওয়া হলেও সেখানে কার্যকর কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। বরং এই ধারাটিতে ঔপনিবেশিক আমলের ‘অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ অন্তর্ভুক্ত করে এর পরিধি আরও বড় করা হয়েছে। অর্থাৎ ডিজিটাল মাধ্যমে কেউ অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ভঙ্গ করলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তার সাজা হবে। এর সর্বোচ্চ সাজা ১৪ বছর কারাদণ্ড।
আইনে পরোয়ানা ছাড়া তল্লাশি ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা বহাল আছে। এ ক্ষেত্রে শুধু ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির মহাপরিচালকের অনুমতি নেওয়ার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শক তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ; মানহানিকর তথ্য প্রকাশ; ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত; আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো-সংক্রান্ত ধারায় আমূল কোনো পরিবর্তন আসেনি। তবে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত-সংক্রান্ত অপরাধের সাজা কমানো হয়েছে। মানহানিকর তথ্য প্রকাশ-সংক্রান্ত ধারায় সম্পাদক পরিষদের উদ্বেগকে আমলে নেওয়া হয়নি। এই ধারায় সংশোধনী এনে মানহানিকর তথ্য প্রকাশ শব্দের সঙ্গে প্রচার শব্দটি যুক্ত করা হয়েছে।
আর ইতিবাচক পরিবর্তন বলতে মূলত এই আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে ‘তথ্য অধিকার-সংক্রান্ত বিষয়ের ক্ষেত্রে তথ্য অধিকার আইনের বিধানাবলি কার্যকর থাকবে’ এই একটি উপধারা যুক্ত করা হয়েছে।
সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, প্রস্তাবিত এই আইনটিতে স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থী যেসব বিষয় ছিল, সেগুলো রয়ে গেছে। কোনো পরিবর্তন আসেনি। স্বাধীন সাংবাদিকতার সুযোগ আর রইল না। নব্বইয়ের প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে দেশের সংবাদপত্র এবং সংবাদমাধ্যমের যে প্রসার ঘটেছে, এই আইনে সেই অর্জন গুরুতরভাবে ব্যাহত হবে। গণতন্ত্রের বিকাশও বাধাগ্রস্ত হবে।
অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টকে অন্তর্ভুক্ত করার সমালোচনা করে ডেইলি স্টার সম্পাদক বলেন, ঔপনিবেশিক এই আইন এখন আর ব্যবহৃত হয় না। আস্তাকুঁড় থেকে এই আইনটিকে আবার সামনে আনা হলো। তিনি বলেন, সংবাদপত্র, টেলিভিশনসহ সব ধরনের সংবাদমাধ্যমকে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করতেই হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগগতভাবে সব ধরনের গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণে আনার ক্ষমতা রাখে।
গত ২৯ জানুয়ারি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া অনুমোদন করেছিল মন্ত্রিসভা। তখন থেকে এই আইনের বেশ কয়েকটি ধারা নিয়ে সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পক্ষ আপত্তি জানিয়ে আসছে। সম্পাদক পরিষদ এই আইনের ৮টি (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২ ও ৪৩ ) ধারা নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আপত্তি জানিয়েছিল। সম্পাদক পরিষদ মনে করে, এসব ধারা বাক্স্বাধীনতা ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে বাধা হতে পারে। এ ছাড়া ১০টি পশ্চিমা দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকেরা এই আইনের ৪টি (২১, ২৮, ৩২ ও ২৫) ধারা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ৯টি ধারা (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৮) পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছিল।
আপত্তির মুখে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে। এই প্রেক্ষাপটে গত ৯ এপ্রিল বিলটি সংসদে তোলা হয়। পরে বিলটি পরীক্ষার জন্য সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়। সাংবাদিকদের তিনটি সংগঠন সম্পাদক পরিষদ, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) এবং অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনার্সের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বিলটি নিয়ে দুই দফা বৈঠক করে সংসদীয় কমিটি। প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার আশ্বাসও দেওয়া হয়েছিল।
সংসদীয় কমিটি প্রতিবেদন দিতে তৃতীয় দফায় ১১ সেপ্টেম্বর এক মাসের সময় নিয়েছিল। কিন্তু এর পরদিনই তারা প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে এবং গতকাল তা সংসদে পেশ করে।
বিএফইউজের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল প্রথম আলোকে বলেন, সংসদীয় কমিটির সঙ্গে তাঁদের তৃতীয় বৈঠকটি না হওয়ায় প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে ফারাক রয়েছে। সাংবাদিকদের সঙ্গে তৃতীয় বৈঠকের মাধ্যমে আইনের সংশোধনী চূড়ান্ত করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি, এটা হতাশার বিষয়। দুঃখজনক হলো, অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। সাংবাদিকদের জন্য এই আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাঁরা একটি সুরক্ষা চেয়েছিলেন। আইনমন্ত্রী নিজেও এ বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন। তাঁরা চেয়েছিলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে তা প্রথমে প্রেস কাউন্সিলে যাবে। এটি না হওয়াটাও হতাশার। আরেকটি হতাশা ও উদ্বেগের জায়গা হলো, ৫৭ ধারার মতো এই আইনের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে আতঙ্ক ছড়ানোর জায়গাটা থাকল।
‘গুপ্তচরবৃত্তি’র জায়গায় সিক্রেটস অ্যাক্ট
মন্ত্রিসভায় আইনের খসড়া অনুমোদনের পর থেকে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হয়েছে ৩২ নম্বর ধারা (কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ) নিয়ে। সংসদীয় কমিটি এ ধারায় পরিবর্তন এনেছে। ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তি শব্দটি বাদ দিয়ে এই ধারায় ঊপনিবেশিক আমলে ১৯২৩ সালে করা আইন অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এই আইনটি যুক্ত করার বিষয়ে সম্পাদক পরিষদ ও সাংবাদিক নেতারা সংসদীয় কমিটির বৈঠকেই আপত্তি জানিয়েছিলনে। কারণ, আইনটি তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
এখন ৩২ নম্বর ধারায় ‘ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তি’ শব্দ বাদ দিয়ে সংসদীয় কমিটি বলেছে, ‘সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অপরাধ ও দণ্ড’। তাতে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট-এর আওতাভুক্ত কোনো অপরাধ কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটন করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হবে।
পরোয়ানা ছাড়া তল্লাশি, গ্রেপ্তার
প্রস্তাবিত আইনের ৪৩ ধারায় পুলিশকে পরোয়ানা ছাড়া তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ ধারায় সামান্য পরিবর্তন এনেছে সংসদীয় কমিটি। তারা পুলিশ তল্লাশির জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির মহাপরিচালকের অনুমোদন নেওয়ার বিধান যুক্ত করেছে। এখন এই ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুলিশ কর্মকর্তার বিশ্বাস করার কারণ থাকে যে কোনো স্থানে এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বা হচ্ছে বা হওয়ার সম্ভাবনা আছে বা সাক্ষ্যপ্রমাণ হারানো, নষ্ট হওয়া, মুছে ফেলা, পরিবর্তন বা অন্য কোনো উপায়ে দুষ্প্রাপ্য হওয়ার বা করার সম্ভাবনা আছে তাহলে তিনি এরূপ বিশ্বাসের কারণ লিখে মহাপরিচালকের অনুমোদনক্রমে ওই জায়গায় তল্লাশি চালাতে পারবেন। ঢুকতে বাধা পেলে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবেন। তল্লাশির সময় অপরাধ সংঘটনে ব্যবহার্য কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, তথ্য-উপাত্ত এবং অপরাধ প্রমাণে সহায়ক কোনো দলিল জব্দ করতে পারবেন। ওই স্থানে উপস্থিত যেকোনো ব্যক্তির দেহ তল্লাশি করতে পারবেন এবং ওই জায়গায় কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ করেছেন বা করছেন বলে সন্দেহ হলে ওই ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারবে।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, এজেন্সির মহাপরিচালক হবেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। তাঁর অনুমতি নেওয়ার বিষয়টি হবে একেবারে দাপ্তরিক প্রক্রিয়া। সব মিলে ভয়াবহ একটি কালো আইন হতে যাচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। নানা আশ্বাস আর আলোচনার নামে সরকার ধোঁকাবাজি করেছে। আরেকটি বিতর্কিত নির্বাচন করার জন্য সরকার তাড়াহুড়া করে এই আইন করতে যাচ্ছে।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত-সংক্রান্ত ২৮ নম্বর ধারায় অপরাধের সাজা কমানো হয়েছে। তবে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের সঙ্গে উসকানি দেওয়াকেও অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই ধারায় বলা হয়েছে, ধর্মীয় অনুভূতি বা মূল্যবোধের ওপর আঘাত করে এমন কিছু কেউ প্রকাশ বা প্রচার করলে তা অপরাধ হবে। সাজা হবে সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। আগে সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ডের প্রস্তাব ছিল।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
এই ধারায় মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতার বিরুদ্ধে অপপ্রচারের (প্রোপাগান্ডা) সঙ্গে জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে অপপ্রচারকে অপরাধ হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে। ডিজিটাল মাধ্যমে কেউ এসব বিষয়ে অপপ্রচার চালালে ১০ বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এই অপরাধে আগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ৩ কোটি টাকা অর্থদণ্ডের বিধান প্রস্তাব করা হয়েছিল।
- কার্টসিঃ প্রথম আলো/ সেপ্টেম্বর ১৮,২০১৮
No comments:
Post a Comment