প্রতিবন্ধক ফ্লাইওভার
শামীম রাহমান
পরিকল্পনা ছিল, গাজীপুর থেকে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত যাত্রীদের দেড় ঘণ্টায় পৌঁছে দেয়ার। এ লক্ষ্যে গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত বিশেষায়িত বাস লেনের (বাস র্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি) একাংশের কাজও শুরু হয়েছে। কিন্তু বিপত্তি বেধেছে বিমানবন্দর-কেরানীগঞ্জ অংশটি বাস্তবায়নে। মগবাজার-মৌচাক ও প্রস্তাবিত শান্তিনগর-ঝিলমিল ফ্লাইওভারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় অংশটি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে সরকার।
সরকারের কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (এসটিপি) গাজীপুর থেকে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত বিআরটি নির্মাণের সুপারিশ ছিল। এটিকে চিহ্নিত করা হয়েছিল বিআরটি-৩ নামে। প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান না হওয়ায় ২০১২ সালে প্রকল্পটির একাংশ (গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত) অনুমোদন দেয় সরকার, যার কাজ চলছে। বিআরটির অন্য অংশটি হলো বিমানবন্দর-কেরানীগঞ্জ, তবে এটি আর বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) কর্মকর্তারা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
গাজীপুর-কেরানীগঞ্জ বদলে এখন বিআরটি লাইনটি বিমানবন্দর থেকে মহাখালী পর্যন্ত সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেখান থেকে ফিডার সার্ভিসের মাধ্যমে ফার্মগেট ও গুলিস্তানে বিআরটির যাত্রীদের পৌঁছে দেয়া হবে বলে জানান ডিটিসিএর কর্মকর্তারা। এটিকে চিহ্নিত করা হচ্ছে পার্ট অব দ্য বিআরটি নামে।
বিআরটি বাস্তবায়ন-সম্পর্কিত বিশেষজ্ঞ দলের অন্যতম সদস্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল হক। বিমানবন্দর-কেরানীগঞ্জ অংশে বিআরটি নির্মাণে সমস্যার বিষয়ে তিনি বলেন, বিমানবন্দর থেকে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত বিআরটি লাইনটি যাওয়ার কথা ছিল মহাখালী-তেজগাঁও-মগবাজার-বিজয়নগর-শান্তিনগর হয়ে। এ পথে লাইনটি এগিয়ে নিতে প্রথম বাধার মুখে পড়বে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারে। ফ্লাইওভারের নিচে বড় বড় খুঁটির কারণে বিআরটির জন্য লেন বের করা যাবে না। আবার উপরেও মাত্র দুটি লেন। যদি ফ্লাইওভারটি ছয় লেন থাকত, তাহলে দুপাশে একটি করে লেন বিআরটির জন্য রাখা যেত।
শুধু তাই নয়, প্রস্তাবিত শান্তিনগর-ঝিলমিল ফ্লাইওভারের অ্যালাইনমেন্ট আর বিআরটি-৩-এর অ্যালাইনমেন্ট একই। এ ফ্লাইওভারও থাকবে রাস্তার মাঝখানে। এসব কারণে বিমানবন্দর-কেরানীগঞ্জ বিআরটির পরিকল্পনাই আর বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না।
বিকল্প পরিকল্পনার বিষয়ে অধ্যাপক শামছুল হক বলেন, গাজীপুর-বিমানবন্দর বিআরটি হচ্ছে। চিন্তার বিষয় হচ্ছে, এটি ব্যবহার করে যেসব যাত্রী বিমানবন্দরে এসে নামবে, তাদের কীভাবে শহরের ভেতরে আনা হবে। এ কারণে বিআরটি-৩-এর মূল নকশা বাস্তবায়ন না করে গাজীপুর-বিমানবন্দর অংশটি সম্প্রসারণ করে মহাখালী পর্যন্ত এগিয়ে নেয়া হবে। মহাখালী থেকে চালু করা হবে ফিডার সার্ভিস। একটি ফিডার সার্ভিস যাত্রীদের নিয়ে যাবে ফার্মগেটে। আরেকটি ফিডার সার্ভিস দিয়ে গুলিস্তান পর্যন্ত যাত্রীদের পৌঁছে দেয়ার চিন্তাভাবনা চলছে।
বর্তমান বিআরটি-৩-এর গাজীপুর-বিমানবন্দর অংশের কাজ চলছে। গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের আওতায় সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর, বাংলাদেশ সেতু বিভাগ (বিবিএ) ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) লাইনটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে। নির্মাণ করা হচ্ছে ২০ দশমিক ৫ কিলোমিটার বিআরটি লেন। এর মধ্যে পড়েছে টঙ্গী সেতু। এটি বিআরটি প্রকল্পের আওতায় ১০ লেনে উন্নীত করা হচ্ছে। পাশাপাশি নির্মাণ করা হচ্ছে ছয়টি ফ্লাইওভার, একটি বাস ডিপো, ১১৩টি সংযোগ সড়ক ও ২৪ কিলোমিটার উচ্চক্ষমতার ড্রেন। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে অংশটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ২ হাজার ৩৯ কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিমানবন্দর-কেরানীগঞ্জ বিআরটি বাস্তবায়ন না হলে ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন গাজীপুর-বিমানবন্দর অংশটি তেমন কাজে আসবে না।
পরিবহন ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মিজানুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ঢাকার যানজট নিরসনের সবচেয়ে কার্যকরী মাধ্যম হতে পারে মেট্রোরেল ও বিআরটি। সরকারের কৌশলগত পরিকল্পনাতেও গাজীপুর-কেরানীগঞ্জ বাস ট্রানজিটের সুপারিশ ছিল। এ পরিকল্পনার কথা না ভেবে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার বানানো হয়েছে। শান্তিনগর-ঝিলমিলে ফ্লাইওভার বানানোরও উদ্যোগ নিয়েছে। এসব ভুল পরিকল্পনার কারণে যদি বিআরটি লাইনটি অর্ধেক বাস্তবায়ন করেই থেমে যেতে হয়, তাহলে যেটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে তার সুফলও মিলবে না।
তিনি আরো বলেন, উদ্দেশ্য ছিল বিআরটি দিয়ে কেরানীগঞ্জ থেকে গাজীপুরে নির্বিঘ্নে যাত্রীদের পৌঁছে দেয়া। অর্ধেক বিআরটি দিয়ে সেটি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বিআরটি লাইনটি ঢাকা-ময়মসসিংহ সড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করার কথা ছিল। কেরানীগঞ্জ-বিমানবন্দর বিআরটি না হলে সে লক্ষ্যও পূরণ হবে না।
বিআরটির পরিকল্পনা, সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও বিস্তারিত নকশা প্রণয়নের কাজ হয়েছে ডিটিসিএর তত্ত্বাবধানে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এ কাজগুলো করা হয়েছে। তবে বিআরটির এ অংশটির সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও নকশা প্রণয়ন করলেও অর্থায়নে রাজি হয়নি বিশ্বব্যাংক। কারণ হিসেবে তারা শান্তিনগর-ঝিলমিল ফ্লাইওভারের অনুমোদনকে দায়ী করেছে।
বিআরটি প্রকল্পে সৃষ্ট এসব জটিলতার বিষয়ে জানতে চাইলে ডিটিসিএর ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ার আনিসুর রহমান বলেন, গাজীপুর-বিমানবন্দর অংশের কাজ চলছে। আর বিমানবন্দর-কেরানীগঞ্জ অংশের বদলে বিমানবন্দর থেকে মহাখালী পর্যন্ত বিআরটি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করা হয়েছে। আমরা শুধু পরিকল্পনা করে দিই, বাস্তবায়ন করি না। এ অংশটি সওজ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন ও এলজিইডি বাস্তবায়ন করবে।
- কার্টসিঃ মানবজমিন/ সেপ্টেম্বর ১৮,২০১৮
No comments:
Post a Comment