Search

Thursday, September 27, 2018

টাকা ছাড়া নড়েন না আওয়ামী লীগ নেতা

  • ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু বরগুনা-১ আসনে চারবারের সাংসদ
  • ২৫ বছর ধরে জেলা আ.লীগের সভাপতি সাবেক এই উপমন্ত্রী
  • শম্ভুর বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির নানা অভিযোগ
  • অভিযোগকারীরা সবাই শম্ভুর দলীয় সহকর্মী

নিয়োগ, মনোনয়ন, নির্বাচন, উন্নয়ন, নলকূপ বরাদ্দ, টিআর, কাবিখা—হেন কোনো খাত নেই, যেখান থেকে টাকা খান না তিনি। বেশি টাকা পেলে কম টাকার প্রার্থীকে ভুলে যান অনায়াসে। আছে দখল, মারধর, পারিবারিকীকরণের অভিযোগও।

যাঁর বিরুদ্ধে এত অভিযোগ, তিনি সাংসদ ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু। তিনি বরগুনা-১ আসনে চারবারের সাংসদ, ২৫ বছর ধরে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সাবেক উপমন্ত্রী। অভিযোগকারীরা সবাই তাঁর দলীয় সহকর্মী। শম্ভু এসব অভিযোগের ব্যাপারে একেবারেই কুম্ভকর্ণ।

গত এপ্রিলে দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে সাংসদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির ২৪টি লিখিত অভিযোগ করেন বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। এর আগে জানুয়ারিতে বরিশাল বিভাগের দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের কাছে অভিযোগ জানানো হয়। কেন্দ্র থেকে প্রতিকার না পেয়ে ৩ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে একই অভিযোগ তুলে ধরা হয় গণমাধ্যমের কাছে। ওই সংবাদ সম্মেলন থেকে সাংসদ শম্ভুকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয় তাঁর তিন দশকের সহযোগী জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবিরের নেতৃত্বে।

এই সংবাদ সম্মেলনের পর বদলে গেছে সাংসদের নির্বাচনী এলাকার দৃশ্যপট। রাস্তার মোড়ে, চায়ের দোকানে এখন স্থানীয় প্রভাবশালী এই সাংসদকে নিয়ে আলোচনা। সাধারণ মানুষ থেকে দলীয় নেতা-কর্মী—সবার মুখে একই অভিযোগ, ‘টাকা ছাড়া নড়েন না শম্ভু বাবু’!

জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির প্রথম আলোর কাছে অভিযোগ করেন, ‘কালেকশন মাস্টার’ দিয়ে রাজনীতি চালান সাংসদ। টাকা ছাড়া কোনো কাজ করেন না তিনি।

জেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক মাওলানা আলতাফ হোসেন ও সাংগঠনিক সম্পাদক মনিরুজ্জামান ওরফে নশা সাংসদের ‘কালেকশন মাস্টার’ বা ঘুষ আদায়কারী বলে জানিয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আরিফুর রহমান (মারুফ)। এই দুজন নলকূপ বরাদ্দে ঘুষ আদায় থেকে শুরু করে মাদ্রাসায় চাকরি, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মনোনয়ন-বাণিজ্যের টাকা আদায় করেন।

তবে আলতাফ হোসেন ও মনিরুজ্জামান দুজনই অভিযোগ অস্বীকার করেন। সাংসদের আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে তাঁরা কিছু জানেন না বলে জানান।

আরিফুর রহমান গত ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে হেরেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দলের মনোনয়নের বিনিময়ে তাঁর কাছে টাকা চেয়েছিলেন সাংসদের ‘কালেকশন মাস্টার’ আলতাফ হোসেন। টাকা না দেওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করেন এবং জাতীয় পার্টির প্রার্থীর পক্ষ নেন সাংসদ। এভাবে প্রশাসনকে ব্যবহার করে চারটি ইউনিয়নে দল মনোনীত প্রার্থীকে হারানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন সাংসদ শম্ভু।

বরগুনা জেলা কৃষক লীগের সভাপতি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মো. আজিজুল হক অভিযোগ তুলে বলেন, ‘ঢলুয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন পেতে সাংসদকে টাকা দিয়েছি। ভোটের আগের দিন আবার টাকা চাইলেন তিনি। নির্বাচনের দিন দেখা গেল, প্রশাসনকে ব্যবহার করে আমার এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে। বেশি টাকার বিনিময়ে বিএনপির প্রার্থীকে জিতিয়ে দিয়েছেন।’

ওই ইউনিয়নে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন বিএনপির আবু হেনা মোস্তফা কামাল। অভিযোগের বিষয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পারিবারিক সম্পর্কের সূত্রে নির্বাচনের আগে সাংসদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। সে হিসেবে তিনি নির্বাচনে প্রশাসনিক সহযোগিতা করেছেন। অন্যান্য ইউনিয়নে আর্থিক লেনদেন হতে পারে। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে হয়নি।’

সদর উপজেলার গৌরীচন্না ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী মনিরুল ইসলাম দাবি করেন, সব ইউনিয়নেই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে ও নির্বাচনে জয়ী হতে সাংসদকে টাকা দিতে হয়েছে। তবে তিনি নিজে কোনো টাকা দেননি।

দলীয় সূত্র ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিরা জানান, সাংসদের বড় দুই অর্থায়নকারী বরগুনা ও আমতলীর দুই মেয়র। দুজনেই এখানকার প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদার। বরগুনার মেয়র শাহাদাত হোসেন ‘শাহাদাত কন্ট্রাক্টর’ নামে পরিচিত। ২০১৫ সালের পৌর নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী জেলা যুবলীগের সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামরুল আহসানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে মেয়র নির্বাচিত হন তিনি। কামরুল আহসানের অভিযোগ, ‘দলীয় প্রার্থী হওয়ার পরও সাংসদ সরাসরি আমার বিরুদ্ধে প্রশাসনকে ব্যবহার করে কারচুপির মাধ্যমে বিদ্রোহী প্রার্থীকে জিতিয়ে দেন।’

২০১১ সালে আমতলী পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের সমর্থিত প্রার্থী ছিলেন গাজী শামসুল হক। তাঁকে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন সাংসদের ঘনিষ্ঠ মতিয়ার রহমান ওরফে মতি কন্ট্রাক্টর। টাকার বিনিময়ে নির্বাচনে সাংসদের কাছ থেকে সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে মেয়র শাহাদাত হোসেনকে প্রশ্ন করলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার টাকা কে না খায়? দলের অর্ধেক খরচ এখনো আমি চালাই।’

নিয়োগ-বাণিজ্য

সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগের মধ্যে অন্যতম ছিল নিয়োগ–বাণিজ্য। এতে বলা হয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নৈশপ্রহরী কাম দপ্তরি নিয়োগে প্রতিজনের কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা করে নিয়েছেন সাংসদ। পুলিশ কনস্টেবল পদে নিয়োগের সুপারিশে নিয়েছেন ১০ লাখ টাকা। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে ৭ থেকে ৮ লাখ। আবার নারী কোটার শূন্য পদে পুরুষ নিয়োগ দিয়ে ১৪ লাখ টাকা নিয়েছেন সাংসদ। জেলা হাসপাতালের কর্মচারী নিয়োগে নিয়েছেন ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা করে। কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) আর টেস্ট রিলিফসহ (টিআর) ৪০ দিনের কর্মসূচি বাস্তবায়নে বাধ্যতামূলকভাবে মোট বরাদ্দের এক-তৃতীয়াংশ ঘুষ দিতে হয় সাংসদকে।

উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আরিফুর রহমান অভিযোগ করেন, ‘আমি নিজে সাংসদকে দুই লাখ টাকা দিয়েছিলাম আলিয়া মাদ্রাসায় আমার স্ত্রীর চাকরির জন্য। কিন্তু তিনি আরও বেশি টাকা নিয়ে অন্য একজনকে চাকরি দেন। তবে পরে আমার টাকা ফেরত দেন।’

আনোয়ার হোসেন নামের একজন অভিযোগ করেন, ‘গর্জনগুনিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে চাকরির জন্য স্কুল কমিটির সভাপতি হুমায়ূন কবির আমার কাছ থেকে সাংসদকে দেওয়ার কথা বলে ১৩ লাখ টাকা নিয়েছেন। পরে আরেকজনের কাছ থেকে বেশি টাকা নিয়ে তাঁকে চাকরি দিয়ে দেন। আমার টাকাও ফেরত দেননি।’

বরগুনা জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন, আমতলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান জি এম দেলোয়ার বলেন, নিয়োগ ও মনোনয়ন-বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সাংসদ। টাকা ছাড়া তাঁর কাছে কোনো কথা নেই।

সরকারি কর্মকর্তাকে মারধর

সরকারি কর্মকর্তারাও হয়রানির শিকার হন সাংসদের কাছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, সাংসদ নিজে ফোন করে বিভিন্ন বিষয়ে তদবির করেন, চাপ প্রয়োগ করেন। তাঁর কথা না শুনলে ওই কর্মকর্তাকে বদলি করতে ঊর্ধ্বতনদের কাছে অভিযোগ করেন।

২০১৪ সালে বরগুনায় বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে বিশ্বব্যাংকের নেওয়া ৩০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প ঘিরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল মালেককে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে কিল-ঘুষি মারেন সাংসদ। ওই দিনই বরগুনা ছেড়ে যান ওই নির্বাহী প্রকৌশলী। তিনি বর্তমানে অবসরে আছেন। প্রকৌশলী আবদুল মালেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাংসদের মনে হয়েছে আমি প্রকল্প থেকে কমিশন নিয়েছি, কিন্তু সাংসদ কিছু পাননি। তাই তিনি ওই ঘটনা ঘটান।’ 

জমি দখল

বরগুনা সদর রাস্তাটি মূলত পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ। এর পূর্ব ও পশ্চিম পাশের জমি পাউবোর। সেখানে দীর্ঘদিন ধরে একটি কার্যালয় চালাচ্ছেন সাংসদ। দ্বিগুণ দাম পরিশোধ করে এ জমি এখন সরকারের কাছ থেকে কিনে নিতে চাচ্ছেন তিনি।

সদর উপজেলা পরিষদের সামনে একটি জলাশয় ভরাট করে নতুন ভবন বানিয়েছেন সাংসদ। এলাকায় এটি সাংসদের রংমহল হিসেবে পরিচিত। বরগুনায় এলে এখানেই থাকেন তিনি। অভিযোগ আছে, জলাশয় ভরাট, রাস্তা নির্মাণ, ড্রেনেজ নির্মাণ ও ল্যাম্পপোস্ট স্থাপন করার পাশাপাশি এ বাড়ির নিয়মিত পরিচর্যা করে পৌরসভা।

এ বিষয়ে সাংসদের ঘনিষ্ঠ বরগুনা পৌরসভার মেয়র শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘শম্ভু বাবুর মায়ের জায়গা সরকার অধিগ্রহণ করেছিল। তিনি সরকারের কাছে আবেদন করে ফেরত নিয়েছেন। পৌরসভা থেকে শুধু বাসার সামনের ড্রেনেজ ও ল্যাম্পপোস্ট করে দেওয়া হয়েছে। বাড়ির ভেতরের সব কাজ সাংসদ নিজের টাকায় করেছেন।’

বিভিন্ন পদে স্বজনেরা 

সাংসদের স্ত্রী মাধবী দেবনাথ জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। একমাত্র ছেলে জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক। ছেলের শ্বশুর অমল তালুকদার জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ। ছেলের চাচাশ্বশুর সুবল তালুকদারকে বানিয়েছেন প্রচার সম্পাদক। আর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাংসদের ভায়রা সিদ্দিকুর রহমান। দলের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখতেই পরিবারের সদস্যদের দলীয় পদে এনেছেন বলে অভিযোগ করেন নেতা-কর্মীরা।

এসব অভিযোগ নিয়ে কথা বলার জন্য ১১ সেপ্টেম্বর যোগাযোগ করা হয় সাংসদ ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর সঙ্গে। ১৪ সেপ্টেম্বর দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে বৈঠক ছিল তাঁর। তার আগে কথা বলতে রাজি হননি তিনি। বৈঠকটি পিছিয়ে যাওয়ায় ১৫ সেপ্টেম্বর আবারও তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, দলের সাধারণ সম্পাদক তাঁকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন। তাই তিনি এসব বিষয়ে এখন গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলবেন না।
  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ সেপ্টেম্বর ২৭,২০১৮ 

No comments:

Post a Comment