Search

Wednesday, September 26, 2018

হাসপাতালের বেডে থেকেও ভাঙচুর মামলার আসামি

কাফি কামাল

মামলা, গ্রেপ্তার আর হয়রানিতে বিপর্যস্ত গাজীপুর জেলা বিএনপি। চলতি মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে কয়েক ডজন গায়েবি মামলা হয়েছে এ জেলায়। বিএনপি চেয়ারপারসন কারাবন্দি খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসার দাবিতে দলটির মানববন্ধনকে কেন্দ্র করে সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দেয় পুলিশ। তবে কোনো ধরনের ঘটনা-দুর্ঘটনা ছাড়াই দায়ের করা হয়েছে বেশিরভাগ মামলা। এসব মামলায় আসামির তালিকায় নাম রয়েছে এমন অনেকের, যারা সে সময় গাজীপুরেই ছিলেন না। 

সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বেডে চিকিৎসাধীন, ভারতের কলকাতা ও ভেলোরের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, ছেলের চিকিৎসার্থে সিঙ্গাপুরে ও পবিত্র হজপালনে সৌদি আরবে অবস্থানকারী অনেকের নামই রয়েছে আসামির তালিকায়। মামলার অভিযোগ অনুযায়ী তাদের যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে যানবাহন ভাঙচুর ও জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে দেখেছে পুলিশ। আসামির তালিকায় উল্লিখিতদের নাম দেখে অবাক এলাকাবাসী।

গাজীপুর জেলা ও মহানগর বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। 

জেলা বিএনপি নেতারা জানান, খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসার দাবিতে কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে মানববন্ধনের আয়োজন করে গাজীপুর বিএনপি। কর্মসূচি শুরুর কিছুক্ষণ পর লাঠিপেটা করে মানববন্ধন পণ্ড করে দেয় পুলিশ। এক পর্যায়ে নেতাকর্মীদের লক্ষ্য করে পুলিশ গুলি ছোড়ে। এতে ছাত্রদল নেতা আবির হোসেন গুলিবিদ্ধ ও অন্তত ২২ জন আহত হয়। পুলিশ ৯ জনকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু যানবাহন ভাঙচুরের অভিযোগে ১১ই সেপ্টেম্বর জেলা বিএনপি সভাপতি ফজলুল হক মিলন, সাধারণ সম্পাদক কাজী সাইয়েদুল আলম বাবুল, কেন্দ্রীয় নেতা ডা. মাজহারুল আলম, ডা. রফিকুল ইসলাম বাচ্চু, মজিবুর রহমানসহ ১৪০ জনের নাম উল্লেখ করে ৪৪০ জনের বিরুদ্ধে জয়দেবপুর থানায় একটি মামলা দেয় পুলিশ। মামলা নং-৭০ (৯) ১৮। একই ঘটনায় ৬৩ জনের নাম উল্লেখ ও ৩০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে একটি মামলা হয় কালিয়াকৈর থানায়। একইভাবে শ্রীপুর থানায় দায়েরকৃত মামলায় ৪৮ জনের নাম উল্লেখ ও ৭০ জনকে অজ্ঞাত আসামি দেখানো হয়। কালীগঞ্জ থানায় দায়েরকৃত মামলায় নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতনামা মিলিয়ে আসামির সংখ্যা শতাধিক।

জেলা বিএনপি নেতারা জানান, গাজীপুর সদর থানায় দায়েরকৃত মামলায় আসামির তালিকায় রয়েছে গাজীপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী সাইয়েদুল আলম বাবুলের নাম। অথচ ওইদিন সকাল আটটায় তিনি সিঙ্গাপুর গিয়েছেন বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে। মামলায় কাজী সাইয়েদুল ৩৪ নম্বর আসামি। কিন্তু ছেলের চিকিৎসার জন্য আগে থেকেই সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছিলেন তিনি। একই দিন গাজীপুরের শ্রীপুরে দায়েরকৃত বিস্ফোরক দ্রব্য ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলায় উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি সিরাজ কাইয়াসহ ৪৮ জনকে আসামি করা হয়। মামলার ১৭ নম্বর আসামি হলেন- উপজেলা বিএনপি’র সাবেক সভাপতি সিরাজ কাইয়া। কিন্তু ঘটনার একসপ্তাহ আগে থেকেই চিকিৎসার জন্য কলকাতায় অবস্থান করছিলেন তিনি। এ মামলায় আরেক আসামি হলেন কেন্দ্রীয় বিএনপির স্বাস্থ্যবিষয়ক সহ-সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বাচ্চু। অথচ তিনি উপস্থিত ছিলেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে কেন্দ্রীয় মানববন্ধনে। আসামির তালিকায় রয়েছে অ্যাডভোকেট শহীদুজ্জামানের নাম। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ঘটনার সময় তিনি সংকটাপন্ন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

দলের আরেক নেতা অ্যাডভোকেট মনির ঘটনার দুই সপ্তাহ আগে থেকেই চিকিৎসার জন্য অবস্থান করছিলেন ভারতের ভেলোরে। কালিয়াকৈরে দায়েরকৃত মামলায় আসামির তালিকায় রয়েছে থানা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক খলিলুর রহমান ইবরাহিম ও যুবদল মৌচাক শাখার সভাপতি রিয়াজ মেম্বারের নাম। ঘটনার সময় হজ পালনে সৌদি আরবে অবস্থান করছিলেন খলিলুর রহমান। আর বিগত ৬ মাস ধরে কারাগারে আটক রয়েছেন রিয়াজ মেম্বার। কালিগঞ্জ থানায় দায়েরকৃত মামলায় থানা যুবদল নেতা শাহীন ও পৌর ছাত্রদলের সভাপতি বিপ্লবকে আসামি করা হয়। অথচ যে ঘটনার অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয় তার তিনদিন আগেই ওই দুইজনকে আটক করে পুলিশ। ঘটনার সময় তারা পুলিশ হেফাজতেই ছিলেন। এ ছাড়া কালীগঞ্জ থানায় অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক, ওপেন হার্ট সার্জারির রোগীসহ বেশ কয়েকজন বৃদ্ধকে আসামি করা হয়েছে। নেতারা জানান, কর্মসূচিতে উপস্থিত না থাকলেও পুলিশ তালিকা ধরে মামলা করায় অনেক নেতার নাম উঠেছে আসামির তালিকায়। সিঙ্গাপুরে থাকা কাজী সাইয়েদুল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, আমার ছেলে দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। সে জন্য সোমবার সকাল আটটায় বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে আমি সিঙ্গাপুরে আসি। কিন্তু পরে জানতে পেরেছি জয়দেবপুর থানায় দায়ের মামলায় আমাকেও আসামি করা হয়েছে। 

বিএনপি’র কেন্দ্রীয় দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, চলতি সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম তিন সপ্তাহেই ৪৮টি মামলা হয়েছে এ জেলায়। যেসব মামলায় আসামি করা হয়েছে বিএনপি ও অঙ্গ দলের নেতাকর্মীসহ অন্তত ১১ হাজার ৫৬৮ জন। এর মধ্যে গাজীপুর মহানগরের ১৪ মামলায় ৮ হাজার ২২৯ জন ও গাজীপুর জেলার ৩৪ মামলায় আসামির সংখ্যা ৩ হাজার ৩৩৯ জন। তবে এ সময় গাজীপুর মহানগরের আলোচিত এক মামলায় জেলা ও মহানগর বিএনপির বেশিরভাগ সিনিয়র ও সক্রিয় নেতাকে আসামি করেছে পুলিশ। তবে মামলা, গ্রেপ্তার ও হয়রানির বিষয়টি গাজীপুর বিএনপি নেতাকর্মীদের কাছে নতুন কিছু নয়। কয়েক বছর ধরে গাজীপুর জেলা বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে মামলার বন্যা। বর্তমান সরকারের আমলে শিল্পনগরী খ্যাত গাজীপুর পরিণত হয়েছে মামলাপ্রবণ জেলায়। বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরের মামলা ও গ্রেপ্তার সেলের প্রধান কর্মকর্তা পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত ওসি সালাউদ্দিন জানান, ২০০৭ সাল থেকে ২০১৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত গাজীপুর জেলা ও মহানগর মিলিয়ে ৬৯০টি মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। এসব মামলায় আসামির তালিকায় রয়েছে বিএনপি ও অঙ্গ দলের নেতাকর্মীসহ ৪২ হাজার ৪৮১ জনের নাম। যাদের বেশিরভাগই বিএনপি ও অঙ্গ দলের নেতাকর্মী। 

গাজীপুর জেলা বিএনপি নেতারা জানান, গাজীপুরে বিএনপির কর্মিসভায় লাঠিপেটার পর বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নাল আবেদিন ফারুক ও গাজীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি ফজলুল হক মিলনসহ ১৪৭ জনের নামোল্লেখ করে ৩৪৭ নেতাকর্মীকে আসামি করে চলতি বছরের ২৮শে জানুয়ারি একটি মামলা দায়ের করে পুলিশ। জয়দেবপুর থানায় দায়েরকৃত মামলাটিতে অভিযোগ আনা হয় গোলযোগ ও সংঘর্ষের। রাজধানী ঢাকার প্রতিবেশী ও দেশের সবচেয়ে বড় সিটি করপোরেশন এখন গাজীপুর। বর্তমান সরকারের আমলে এই সিটির দুইটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু মামলা ও গ্রেপ্তারের শিকার হন বিএনপি ও অঙ্গ দলের শত শত নেতাকর্মী। গাজীপুর সিটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আদালতের নির্দেশে কিছুদিনের জন্য সে নির্বাচন স্থগিত হয়েছিল। ৭ই মে গাজীপুর সিটি নির্বাচন স্থগিতের পর সন্ধ্যায় বিএনপিদলীয় মেয়রপ্রার্থী হাসানউদ্দিন সরকারের বাড়ির সামনে থেকে বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমানসহ ১২ জনকে আটক করে পুলিশ। 

পরে নোমানকে ছেড়ে দেয়া হলেও অন্যদের বিরুদ্ধে টঙ্গীতে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা, গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, নাশকতা ও জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির অভিযোগে বিশেষ ক্ষমতা আইনে ২৫০ জনকে আসামি করে মামলা করেছে পুলিশ। মামলায় জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইয়্যেদুল আলম বাবুল, সিনিয়র সহ-সভাপতি সালাহউদ্দিন সরকার, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ডা. মাজহারুল আলম, সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ইজাদুর রহমান, ভাওয়াল মির্জাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল হক মুসল্লি ও হেফাজতে ইসলামের নেতা মুফতি নাসির উদ্দিনসহ ১০৩ জনের নামোল্লেখ এবং অন্যদের অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়। নামোল্লেখকৃত আসামিদের মধ্যে বিএনপিদলীয় মেয়রপ্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যই ছিলেন ৪৮ জন। হাসানউদ্দিন সরকারের চার চাচাতো ভাই সালাহউদ্দিন সরকার, পাপ্পু সরকার, নকিবউদ্দিন সরকার ও অপু সরকারসহ তার আত্মীয় ছিলেন অন্তত ২০ জন। এ ছাড়া যে গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মামলাটি করেছিল পুলিশ পরদিন দেখা যায় পুলিশের জব্দ করা লেগুনাটি অক্ষত পড়ে আছে টঙ্গী থানায়। সে গাড়িতে ভাঙচুর বা অগ্নিসংযোগের কোনো আলামত ছিল না। পরদিন গাড়ির মালিক ও চালক গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, তাদের গাড়ি ভাঙচুর বা অগ্নিসংযোগের শিকার হয়নি। বিএনপি নেতারা জানান, ২০১৮ সালে গাজীপুর সিটি নির্বাচনের আগে সেখানে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার অভিযান চালায় পুলিশ। ২১শে জুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার গাজীপুরে প্রার্থীদের সঙ্গে সমন্বয় সভা করার পর থেকে সিটির বিভিন্ন ওয়ার্ডে বিএনপির নির্বাচন সংশ্লিষ্ট নেতাদের বিরুদ্ধে ধরপাকড় শুরু করে পুলিশ। ২৪শে জুন এক রাতেই ধানের শীষ প্রতীকের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির ১৮ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। নির্বাচনের আগের দিন ও নির্বাচনের দিন কেন্দ্রে সমন্বয়কের দায়িত্বপ্রাপ্তদের তুলে নিয়ে টাঙ্গাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নরসিংদীতে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেয়া হয় নির্বাচনের দিন বিকালে। 

গাজীপুর জেলা বিএনপি সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন বলেন, কোথাও কোনো ঘটনা-দুর্ঘটনা নেই কিন্তু গায়েবি মামলা দায়ের করছে পুলিশ। বিএনপির মানববন্ধনের মতো নিরীহ কর্মসূচিতে হামলা চালিয়ে পুলিশ নেতাকর্মীদের লাঠিপেটা করেছে, গুলিবর্ষণ করেছে। আবার পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে মামলাও করেছে। তার মানে ঘটনা যা, তার সবই করছে পুলিশ। গাজীপুর জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক ও জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ডা. মাজহারুল আলম বলেন, ১লা সেপ্টেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর পর থেকে গাজীপুরে জেলা ও মহানগর বিএনপিসহ অঙ্গ দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যতগুলো মামলা হয়েছে তার সবগুলো হাওয়াই মামলা। কোনো ধরনের ঘটনা ছাড়াই এসব মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। তিনি বলেন, সরকারি এজেন্সির মাধ্যমে জেলা, থানাসহ প্রতিটি ইউনিট বিএনপি এবং অঙ্গ দলের কমিটির তালিকা সংগ্রহ করেছে পুলিশ। বায়বীয় মামলাগুলোতে আসামি করা হচ্ছে সে তালিকা ধরে। এতে প্রতীয়মান হচ্ছে, উপরের ইশারায় বিএনপি নেতাদের নামে মামলা দেয়াটাই এখন যেন জরুরি, ঘটনার সত্য-মিথ্যা এখানে কোনো বিষয় নয়। 

  • কার্টসিঃ মানবজমিন/ ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮

No comments:

Post a Comment