Search

Thursday, September 27, 2018

পরিবহনব্যবস্থা সমস্যাটি আইনের নয়, শাসনের

এ কে এম জাকারিয়া

নিরাপদ সড়ক নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিণতি শেষ পর্যন্ত যা–ই হোক, অন্তত একটি নতুন আইন পাওয়া গেছে। সংসদে সড়ক পরিবহন আইন বিল, ২০১৮ পাস হয়েছে ১৯ সেপ্টেম্বর। তবে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী অবশ্য একে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফল হিসেবে মানতে রাজি হননি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, যুগোপযোগী করার জন্য যে আইন বছরের পর বছর ধরে ঝুলে ছিল, তা পাস হয়েছে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মাসখানেকের মাথায়। নতুন ও সংশোধিত এই আইন পরিবহন খাতের বিশেষজ্ঞদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি, তবে একে সামান্য হলেও অগ্রগতি হিসেবেই মানছেন তাঁরা।

সড়কমন্ত্রী স্বীকার করুন বা না করুন, এর কৃতিত্ব ছোট বাচ্চাদের আন্দোলনকেই দিতে হবে। কতটা বিশৃঙ্খলা আর অব্যবস্থাপনা ও নৈরাজ্যের মধ্য দিয়ে চলছে আমাদের পুরো পরিবহনব্যবস্থা, শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন তা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। আমরা এভাবেই চলছিলাম, আর উন্নয়ন-উন্নয়ন জপ শুনছিলাম। এই যে এত উন্নয়ন, এর ফলাফলটা আসলে কী? একটি উদাহরণ দিই, ১০ বছর আগে ঢাকায় যানবাহনের গড় গতি ছিল ২১ কিলোমিটার। এখন তা ৭ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। মানুষের স্বাভাবিক হাঁটার গতি হচ্ছে ঘণ্টায় ৬ কিলোমিটার।

এখন সরকার বা এর নীতিনির্ধারকদের যদি বলা হয়, ঢাকায় আপনাদের ১০ বছরের উন্নয়নের ফল হচ্ছে যানবাহনের গতি ২১ কিলোমিটার থেকে ৭ কিলোমিটারে নামিয়ে আনা; তাঁরা কী জবাব দেবেন? আসলে তাঁরা কখনো জবাব দেন না। জবাব দেওয়ার কোনো দরকারও মনে করেন না। এই যে বছরের পর বছর ধরে ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে বসবাসের অনুপযোগী শহরের পরিচিতি পেয়ে আসছে, তা নিয়ে সরকারকে কখনো বিচলিত বা এ কারণে তৎপর মনে হয়েছে?

আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার স্বপ্নের মধ্যে রয়েছি। ঘণ্টায় ৭ কিলোমিটার গতিতে যানবাহন চালিয়ে বা বিশ্বের সবচেয়ে বসবাসের অনুপযোগী রাজধানী শহর নিয়ে কি তা সম্ভব? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) কয়েক বছরের পুরোনো এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী শুধু সড়ক দুর্ঘটনার কারণে বছরে ক্ষতি হচ্ছে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ দশমিক ৬ শতাংশ। আর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণা বলছে, যানজটের কারণে প্রতিবছর ক্ষতি হচ্ছে দেশের মোট জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ। দেশের পরিবহনব্যবস্থা, নগর ব্যবস্থাপনা—এসব নিয়ে অসংখ্য গবেষণা হয়েছে, সুপারিশেরও অভাব নেই। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ বা ঢাকার পরিবহনব্যবস্থা এবং এর ব্যবস্থাপনা নিয়ে যে সমস্যা-সংকট রয়েছে, তার সমাধান নেই এমন নয়। বিশ্বের অনেক দেশ এসব সমস্যার সমাধান করেছে। এর নানা মডেল আছে। আমাদের দেশের বিশেষজ্ঞরাও সমস্যার সমাধানের নানা পথ বাতলেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার কি সেসব বিবেচনায় নিয়েছে? কোনো সামগ্রিক পরিকল্পনার অধীনে কি এসব সমস্যা মোকাবিলার পথ ধরা হচ্ছে?

ঢাকা শহর পরিচালনা, এর ব্যবস্থাপনা ও ভবিষ্যৎ সামনে রেখে পরিকল্পনা তৈরির কাজে যে সবচেয়ে বড় সমস্যা সমন্বয়হীনতা, এটা বলতে বলতে আমাদের বিশেষজ্ঞ ও নগর–পরিকল্পনাবিদেরা মুখে ফেনা তুলে ফেলেছেন। কোনো কাজের কাজ কি হয়েছে? কমবেশি ৫০টি সংস্থা ঢাকার সেবা দেওয়ার কাজ করে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রেষারেষি আছে। কেউ কারও কথা শুনতে চায় না। যে যার মতো পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়নে নেমে পড়ে। এসব সমস্যা দূর করতে একটি একক কর্তৃপক্ষের কথা বহুদিন ধরে বলা হচ্ছে। তা সম্ভব না হলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে একটি বিশেষ সেল করে একজন শক্তিশালী মন্ত্রীকে এর দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাবও বিভিন্ন নগর–পরিকল্পনাবিদের মুখ থেকে আমরা শুনেছি। সরকার কোনো কিছুতেই গা করেনি। উন্নয়নের জন্য নাকি ধারাবাহিকতা লাগে। এই সরকার তো প্রায় ১০ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে, পরিস্থিতি তো দিনে দিনে খারাপই হয়েছে!

ঢাকা শহরের পরিবহন সমস্যা দূর করতে বিশেষজ্ঞরা গণপরিবহনের দিকে জোর দেওয়ার কথা বলে আসছেন। এটাই পরীক্ষিত পথ। কিন্তু সরকার হাঁটছে পুরো উল্টো পথে। ফ্লাইওভার কিংবা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এসব তৈরি নিয়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার যত আগ্রহ দেখা যায়, গণপরিবহনব্যবস্থা নিয়ে তার ছিটেফোঁটাও নেই। বাস র‍্যাপিড ট্রানজিটের (বিআরটি) কথা ঢাকার কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (এসটিপি) রয়েছে। কোথায় সেই বিআরটি? গণপরিবহন বা সাধারণ মানুষ কীভাবে যাতায়াত করবে, তা সরকারের কাছে প্রাধান্য পাওয়া বিষয়গুলোর মধ্যে নেই। এসটিপিতে গাজীপুর থেকে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত বিআরটি তৈরির সুপারিশ ছিল। এখন এই পরিকল্পনার পুরো বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না মগবাজার–মৌচাক ফ্লাইওভারের কারণে। এই ফ্লাইওভার তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় বিআরটির কথা বিবেচনাতেই নেওয়া হয়নি। এই সমন্বয়হীনতার দায় কার? কে জবাবদিহি করবে? এসব বিষয় সুশাসন ও রাষ্ট্র পরিচালনার দক্ষতার ওপর নির্ভর করে।

সরকার এখন সড়ক পরিবহন আইন পাস করছে। এই আইন আসলে কতটুকু ভূমিকা রাখবে দুর্ঘটনা কমাতে বা ট্রাফিক ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনতে? উল্টো পথে চলা কি ট্রাফিক আইনে বৈধ? অথবা লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানোর বিষয়টি? পুলিশের গাড়ি যে চালায়, তার লাইসেন্স নেই। লাইসেন্স ছাড়াই পুলিশ মোটরসাইকেল চালায়। মন্ত্রী, এমপি থেকে শুরু করে সরকারি কর্মকর্তা—তাঁদের গাড়িচালকদের বৈধ লাইসেন্স নেই। গণমাধ্যমের গাড়ির চালকদেরও নেই। আমরা বিস্ময় নিয়ে দেখলাম, এসব প্রভাবশালীর অনেকের মধ্যে এমন ধারণা গেঁথে গেছে যে তাঁদের গাড়ির চালকদের কোনো লাইসেন্স লাগে না। তাঁরা আইনের ঊর্ধ্বে। নতুন আইন দিয়ে কী হবে, যদি কেউ আইন না মানে বা কাউকে আইন না মানতে বাধ্য করা যায়! সমস্যাটি আসলে আইনের নয়, আইনের শাসনের। আইনের শাসন দেশে কার্যকর থাকলে পরিস্থিতি এমন হতো না।

দেশের পরিবহন সমস্যা, ট্রাফিক অব্যবস্থা, সড়ক-মহাসড়ক ব্যবস্থাপনা, সামগ্রিক পরিবহন পরিকল্পনা—এসব বিষয় বুঝতে নিয়মিত যাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখি, আলাপ-আলোচনা করি, পরামর্শ নিই, তিনি সামছুল হক। 

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, পরিবহন বিষয়ে রয়েছে তাঁর বিশেষজ্ঞ জ্ঞান। তিনি বলেন, সব সমস্যারই সমাধান আছে। সমস্যা সমাধানের জন্য আপনাকে দূরদৃষ্টি এবং ভবিষ্যৎ বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে, যার ভিত্তি হতে হবে বিজ্ঞান। সড়ক ব্যবস্থাপনা ও পরিবহন আইন নিয়েও কথা হয়েছে তাঁর সঙ্গে। এখানেও তিনি বিজ্ঞানের প্রসঙ্গ টেনেছেন। বললেন, আইন ও নিয়মনীতিও হতে হবে বিজ্ঞান মেনে। বিজ্ঞান বলে, মানুষের মধ্যে আইন না মানার প্রবণতা আছে, ফলে পরিকল্পনাটাই এমনভাবে করতে হবে যাতে মানুষ আইন মানতে বাধ্য হয়।

আসলে ব্যবস্থাটাই এমনভাবে পরিকল্পনা করতে হবে, যা হবে স্বনিয়ন্ত্রিত। আইন ভেঙে যাতে কারও কিছু করার না থাকে বা আইন ভেঙে কোনো বাড়তি সুবিধা না পায়। পরিবহনব্যবস্থা সাজানোর ক্ষেত্রে শুরুতেই এটা মাথায় রাখতে হবে যে মানুষের যাতে আইন ভাঙার দরকার না পড়ে। এবং পরিকল্পনাটি করতে হবে এর ওপর ভিত্তি করে। আবার সবকিছু পরিকল্পিত ও ঠিকঠাক থাকার পরও কিছু মানুষ আইন ভাঙতে চাইবে। সেখানে দরকার আইনের যথাযথ প্রয়োগ। উন্নত বিশ্বে ট্রাফিক বা পরিবহনব্যবস্থা খুবই পরিকল্পিত, কিন্তু এরপরও আইন লাগে এবং তার যথাযথ প্রয়োগ লাগে। আইন মেনে চলা হচ্ছে কি না, তার নিয়মিত ও নিরবচ্ছিন্ন তদারকি লাগে। আমাদের সমস্যা এই সব কটি ক্ষেত্রেই।

আমাদের পরিবহনব্যবস্থা এখন যেভাবে চলছে, তাতে কি এটা মনে হবে যে এর পেছনে বিজ্ঞানভিত্তিক যথাযথ কোনো পরিকল্পনা আছে! এই যে মেট্রোরেল হচ্ছে, দেরি হলেও একসময় তা শেষ হবে। উত্তরা থেকে মতিঝিল এই রেলরুটের নকশা স্টপেজগুলোসহ আমরা পত্রপত্রিকায় ছাপা হতে দেখছি। কিন্তু এই রুটে বাধাহীন পথ অতিক্রম করে যাঁরা স্টপেজগুলোতে নামবেন, তাঁরা সেখান থেকে তাঁদের গন্তব্যে কীভাবে বা কোন ধরনের বাহনে করে যাবেন? বাসে, ট্যাক্সিক্যাবে, সিএনজিচালিত অটোরিকশায়, নাকি হেঁটে? এসব বিবেচনায় নিয়ে কোনো পরিকল্পনা কি নীতিনির্ধারকদের আছে? চরম বিশৃঙ্খলা ও পরিকল্পনাহীনতার মধ্যে চলছে আমাদের পরিবহনব্যবস্থা। এর সঙ্গে আছে আইনের যথাযথ প্রয়োগ না করার গুরুতর সমস্যা। নিরবচ্ছিন্নভাবে আইনের প্রয়োগ ছাড়া মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে যে জনগণকে আইন মানতে বাধ্য করা যায় না, এটা আমাদের নীতিনির্ধারকদের কে বোঝাবে!

নতুন নতুন আইন প্রণয়ন কোনো কাজে দেবে না, যদি না তার প্রয়োগ হয়। আর একটি কার্যকর ও পরিকল্পিত ব্যবস্থা নিশ্চিত না করে জনগণকে আইন মানতে বাধ্য করা কার্যত অসম্ভব। এই দুটি সমস্যা দূর করার জন্য যা দরকার, তা হচ্ছে জবাবদিহি ও আইনের শাসন।
  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ সেপ্টেম্বর ২৭,২০১৮ 

No comments:

Post a Comment