Search

Thursday, September 27, 2018

যুবলীগ নেতার চাঁদা দাবি, আঞ্জুমানের ভবন নির্মাণ বন্ধ

আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম। সবার কাছে পরিচিত বেওয়ারিশ লাশ দাফনের প্রতিষ্ঠান হিসেবে। এ কাজ ছাড়াও এতিম শিশুদের লালন-পালনসহ নানা দাতব্য কাজ করে আসছে সেবামূলক এ সংস্থাটি। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দান আর অনুদানে চলে এর কার্যক্রম। অথচ মানুষের দানের সেই অর্থ থেকেই চাঁদা দাবি করেছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগ সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ও তার লোকজন। শুধু তাই নয়, চাঁদা না পাওয়ায় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে আঞ্জুমানের নির্মাণাধীন নিজস্ব ভবনের নির্মাণকাজ। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাও।

ঘটনার অভিযোগ পৌঁছেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত। এতে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে অভিযুক্তদের বিষয়ে তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

দলীয় সূত্র জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা ব্যক্তিগতভাবে আঞ্জুমানে নিয়মিত দান করে থাকেন। ওই প্রতিষ্ঠানে নিজ দলের সহযোগী সংগঠনের নেতাদের চাঁদা দাবির অভিযোগ পাওয়ায় তিনি চরম ক্ষুব্ধ হয়ে যুবলীগ নেতাদের ডেকে পাঠান। নির্দেশ দেন তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার। আঞ্জুমান সূত্র জানায়, কাকরাইলে অবস্থিত আঞ্জুমানের যে অস্থায়ী কার্যালয় ছিল ওই জায়গাটি জামিলুর রহমান নামের একজন প্রতিষ্ঠানটিকে দান করেছিলেন। প্রায় ৩০ কাঠা পরিমাণ ওই জমিতে ১৮ তলা নিজম্ব ভবন নির্মাণের প্রকল্প নেয় আঞ্জুমান। জমিদাতার নামে ভবনটির নামকরণ করা হয় জেআর টাওয়ার। ২০১৪ সালে এ ভবনের কাজ শুরু হয়। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দান ও অনুদানে ভবনের নির্মাণকাজ চলছিল। এর মধ্যেই আঞ্জুমানের কাছে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগ সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের পক্ষে তার লোকজন মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করেন। চাঁদা না দিলে নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দেন তারা। দফায় দফায় হুমকি আসায় গত এপ্রিলের শেষদিকে নির্মাণকাজ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় আঞ্জুমান কর্তৃপক্ষ। এরপর থেকে ওই ভবনের নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে। পরে বাধ্য হয়ে সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অভিযোগ দেন। 

জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে অংশ নিতে নিউ ইয়র্কে যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ আসলে তিনি যুবলীগ নেতাদের গণভবনে ডেকে ঘটনার বিষয়ে জানতে চান। তিনি নির্দেশ দেন ঘটনা তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে। চাঁদা দাবির অভিযোগের বিষয়টি স্বীকার করে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক হারুন-অর-রশীদ মানবজমিনকে বলেন, বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের কাছে সম্রাটের চাঁদা দাবির বিষয়ে নেত্রীর (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) কাছে অভিযোগ এসেছে। 

জাতিসংঘ অধিবেশনে যাওয়ার আগে নেত্রী যুবলীগের চেয়ারম্যানকে ডেকে নেন। তিনি চেয়ারম্যানকে অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। পাশাপাশি নেত্রীর নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও বিষয়টি দেখছে বলে জানান তিনি। হারুন-অর-রশীদ বলেন, আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম আর্ত মানবতার সেবায় নিয়োজিত একটি সংস্থা। এই সংস্থার কাছে যেই চাঁদা দাবি করুক, সন্ত্রাস করুক সে রেহাই পাবে না। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত কঠোর বলে জানান তিনি। ঘটনার বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি বিশেষ সংস্থার পক্ষ থেকে তদন্ত করা হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা জানান, বিষয়টি খতিয়ে দেখতে আমাদের বলা হয়েছে। খুব গুরুত্ব নিয়ে বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। 

বুধবার দুপুরে কাকরাইলে নির্মাণাধীন ওই ভবনে গিয়ে দেখা গেছে, ১৫তলাবিশিষ্ট ওই ভবনের নির্মাণকাজ বন্ধ। গেইটে দাঁড়িয়ে আছেন নিরাপত্তাকর্মী। ভেতরে নিচ তলার একটি কক্ষে অফিসের কাজ চলছে। গেইট দিয়ে ঢুকতেই নিরাপত্তাকর্মী পথ আগলে দাঁড়ান। তার চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ। একই অবস্থা অফিস কক্ষে দায়িত্ব পালনকারীদের মধ্যেও। তবে এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি তারা। ফকিরাপুলের হাজী সাবেদ আলী লেনে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের কেন্দ্রীয় অফিসে গেলে কথা হয় এই সংস্থার সহকারী পরিচালক তানিম হোসেনের সঙ্গে। চাঁদা দাবির ঘটনার সত্যতা জানালেও এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি তিনি। একইভাবে অজানা আতঙ্কে কথা বলতে চাননি সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ইলিয়াস আহমেদ। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা জানান, সম্রাটের লোকজন হুমকি দিয়েছে টাকা দিতে হবে নতুবা জান দিতে হবে। চাঁদা ছাড়া এখানে ভবন নির্মাণ হবে না। চাঁদা দাবি করা হয়েছে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে। বাধ্য হয়ে বিষয়টি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে অবগত করা হয়েছে। 

সূত্রমতে, গত ২১শে সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিতে রাষ্ট্রীয় সফরে যাওয়ার প্রাক্কালে এ বিষয়ে কঠোর নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় গণভবনে যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ তাকে বিদায় জানাতে যান। তাৎক্ষণিকভাবে সম্রাটের চাঁদা দাবির বিষয়টি আলোচনায় উঠে। এসময় চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। তখন সম্রাটের পক্ষ নিয়ে আওয়ামী লীগের এক নেতা কথা বললে তাকে থামিয়ে দেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান। এখানে বেওয়ারিশ লাশ দাফন হয়। এখানে আমি ও শেখ রেহানাও সাহায্য করি। এ প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা দাবি করা ও চাঁদা না দেয়ায় ভবন নির্মাণের কাজ বন্ধ করে দেয়া- এটা আমি সহ্য করবো না।’ 

আঞ্জুমান কর্তৃপক্ষ জানায়, বহুতল জে আর টাওয়ারে থাকবে আঞ্জুমানের অফিস, টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট, ডিউটি অফিসারের রুম। এ ছাড়াও বিভিন্ন ফ্লোর ভাড়া দেয়া হবে। ভবনে থাকবে চারটি লিফট, দুটি সিঁড়ি, অত্যাধুনিক গ্লাস সজ্জিত কক্ষ। ২ লাখ বর্গফুটের এই ভবনে নির্মাণ ব্যয় হবে প্রায় ৮০ কোটি টাকা। ইতিমধ্যে ২৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. আবুল বাশার খান। বিভিন্ন ব্যক্তিদের অনুদানে দ্রুতগতিতেই চলছিলো এই টাওয়ারের নির্মাণকাজ। ১৫ তলার ছাদ ঢালাই দেয়া হয়েছে গত ১৬ই জানুয়ারি। নির্মাণকাজ হয়েছে মার্চ মাস পর্যন্ত। এপ্রিলে হঠাৎ করেই কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়। কেন কাজ বন্ধ করা হলো তা জানেন এই সেবামূলক সংস্থার প্রায় সবাই। কিন্তু অজানা আতঙ্কে তারা মুখ খুলতে চান না। কাজ কেন বন্ধ করা হলো- জানতে চাইলে প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন সবাই জানে, আপনি জানেন না? 

এক পর্যায়ে চাঁদা দাবির ঘটনা স্বীকার করে বলেন, কার নাম বলবো, আমাদের জীবনের নিরাপত্তা দেবে কে? তবে তিনি জানান, চাঁদা দাবি করা হয়েছে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে। বিষয়টি তারাই দেখছেন। এ বিষয়ে যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের বক্তব্য জানতে বারবার তার ফোনে কল দেয়া হলেও তিনি তা ধরেননি। মানবজমিনের পক্ষ থেকে বক্তব্য নেয়ার জন্য মোবাইলফোনে ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়ে একদিন অপেক্ষা করলেও তিনি সাড়া দেননি। 
  • কার্টসিঃ মানবজমিন/ সেপ্টেম্বর ২৭,২০১৮ 

No comments:

Post a Comment