Search

Tuesday, January 17, 2017

আদালতের রায়ের আগেই বেগম জিয়াকে প্রকাশ্যে ‘জেলে যাওয়ার’ হুমকি দেয়া কি আইন পরিপন্থি নয়?

মোহাম্মদ আলী বোখারী, টরন্টো থেকে


সকলেই জানেন, ২০০৭ সালে ১/১১-র ‘ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিন’ সরকার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ উভয়ের প্রায় সমান সংখ্যক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও নানাবিধ মামলা দেয়। সংখ্যায় তা আট সহস্রাধিক ছিল। তবে ২০০৯ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর দল ক্ষমতাসীন হলে তাদের সবগুলো মামলাই প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। অথচ খালেদা জিয়া ও তাঁর দলের মামলাগুলো সচল থাকে; এমনকি গত আট বছরে আরও মামলায় তাঁদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলা হয়। এখন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে পরিচালিত প্রধান মামলাগুলো শেষ পরিণতির দিকে ধাবিত এবং নতুন কিছু মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানি পিছিয়ে গেছে।

আপাতদৃষ্টিতে সেই শেষ পরিণতির মামলাগুলো যেন ঘটনাক্রমে চূড়ান্ত: ‘লাগসই ও কাকতালীয়’। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয়টি হচ্ছে -  গত ৮ জানুয়ারি রাডার কেনায় দুর্নীতির অভিযোগে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে করা মামলায় হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করে দেয় সুপ্রিমকোর্ট। পাশাপাশি ৩১ মার্চের মধ্যে এরশাদের রাডার মামলা নিষ্পত্তির নির্দেশও দেয়। পরদিন ৯ জানুয়ারি দুপুরে এরশাদ রংপুর নগরীর পল্লী নিবাস বাসভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে বলেন, ‘শুনতে পাচ্ছি খালেদা জিয়াও জেলে যাচ্ছেন, আমি এখন সেই দিনের অপেক্ষায় আছি’। একই সঙ্গে তিনি ইসি গঠন প্রসঙ্গে বলেন, ‘বিএনপির মানা না মানা নিয়ে কিছুই যায় আসে না। সরকার যে সিদ্ধান্ত দেবে আর তাতে যদি আমরা সমর্থন দিই সেটাই চূড়ান্ত হবে। কারণ, বিএনপির অবস্থা খুবই করুণ। তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই এখন কঠিন হয়ে গেছে।’ এরপর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের জনসভায় খালেদা জিয়ার মামলায় হাজিরা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘তিনি এতিমের টাকা চুরি করেন, একবার হাজিরা দেন তো পরে আদালতে হাজিরা না দিয়ে পালিয়ে বেড়ান। তাঁর কাছ থেকে রাজনীতি শিখতে হবে না। গণতন্ত্র শিখতে হবে না।’ অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী মামলার রায় ছাড়াই জানেন, ‘খালেদা জিয়া এতিমের টাকা চুরি করেছেন’। একই ভাবে এরশাদও নিশ্চিত ‘খালেদা জিয়া জেলে যাচ্ছেন’। এতে উভয়ের ভাষ্যে যেন আইনের সর্বজনীন বিধান ‘প্রিসাম্পশন অব ইনোসেন্স’ বা ‘নির্দোষের অনুমিতি’টি লাপাত্তা!

কিন্তু ‘প্রিসাম্পশন অব ইনোসেন্স’ বা ‘নির্দোষের অনুমিতি’টি হচ্ছে বিশ্বজনীন মানবাধিকার, যা জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদের ১১ অনুচ্ছেদে এবং একই ভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মৌলিক অধিকারের ৪৮ অনুচ্ছেদে বিবৃত। এই ‘নির্দোষের অনুমিতি’র মুখ্য বক্তব্যটি হচ্ছে, ‘দোষী প্রমাণিত ব্যতীত সকলেই নির্দোষ’। এ জন্য ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্তের উপর দায় চাপানো বা ‘বার্ডেন অব প্রুফ’ তাদের উপর প্রযোজ্য, যাঁরা তা ঘোষণা দেন। সেক্ষেত্রে দোষ প্রমাণে যথেষ্ট পরিমাণে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণাদি সংগ্রহ ও উপস্থাপনের দায়িত্বটিও তাঁদের উপর বর্তায়। পাশাপাশি আইনের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য প্রকৃত সাক্ষ্য ও সন্দেহাতীতভাবে দোষ প্রমাণ অপরিহার্য। আর যদি সেখানে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ থাকে তবে বেকসুর খালাস দিতে হয়। একমাত্র দেওয়ানী মামলা ছাড়া রোমান, কমন ল’ ও ইসলামিক আইনে সেটাই বিধান। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৪(২) অনুচ্ছেদেও ‘দোষী প্রমাণিত ব্যতীত সকলেই নির্দোষ’ কথাটি বর্ণিত। পাশাপাশি মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে ওই সংবিধানের ৩৫(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অপরাধকালীন সুনির্দিষ্ট অপরাধটিই বিবেচ্য, অন্য অপরাধ আরোপ আইন পরিপন্থি। এছাড়া ‘ইন্টারন্যাশনাল কভনেন্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস’-এ বাংলাদেশ ২০০০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর থেকে একটি স্বাক্ষরদাতা দেশ। ফলে সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদটি সমতা, নিরপেক্ষ আদালতে স্বচ্ছ বিচার, দোষ প্রমাণ ব্যতীত নির্দোষ, অপরাধ জানা, দ্রুত বিচার, আইনগত পরামর্শ, সাক্ষীর শুনানি, দোষ স্বীকার, আপিল ও দোটানা থেকে মুক্তির অধিকারগুলো অভিযুক্তের ক্ষেত্রে নিশ্চিত করা হয়েছে।

তাতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে পরিচালিত মামলায় তিনি কি ‘নির্দোষের অনুমিতি’র পরিপ্রেক্ষিতে জনসমক্ষে কোনো প্রকার অপবাদ, ভর্ৎসনা কিংবা ‘জেলে যাওয়া’ জাতীয় হুমকির সম্মুখীন হতে পারেন? উত্তরটি সহজেই বোধগম্য ও অনুমেয়। তথাপি এ ক্ষেত্রে একটি রাষ্ট্রের সরকার প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী কিংবা তার বিশেষ দূতের আইন পরিপন্থি কথাবার্তাগুলো কী পর্যায়ে বিবেচ্য, সেটি একটি যথার্থ প্রশ্নই বটে! যদি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের শপথনামার দিকে নজর দেওয়া যায়, তবে ওই দায়িত্বের ‘প্রাইমা ফেসি অব ডিউটি’ অর্থাৎ বাধ্যবাধকতামূলক দায়িত্বটি হচ্ছে, তিনি কারো প্রতি কোনো প্রকার রাগ-অনুরাগ-বিরাগ ও অনুকম্পা ব্যতীত নিজ মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, গোয়েন্দা তৎপরতা, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, মন্ত্রণালয়সমূহের সার্বিক সমন্বয় সাধন ও আনুষ্ঠানিকতাতেই সীমাবদ্ধ থাকবেন। একই ভাবে তার বিশেষ দূতের পরিসীমাটিও সুনির্দিষ্ট পরিসরেই সীমাবদ্ধ। তাই অগ্রবর্তী যাত্রায় জাতি নিশ্চয়ই কারো ক্ষেত্রে সেই ব্যত্যয়টি প্রত্যাশা করে না।

-         লেখক রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

No comments:

Post a Comment