Search

Sunday, September 30, 2018

তথ্যঅধিকার আইনের সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সাংঘর্ষিক যে কারণে

গোলাম মোর্তোজা

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের শুরু থেকেই সাংবাদিক-সম্পাদকদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

তবে তথ্য কমিশন, কোনো কোনো সাংবাদিক এবং সাংবাদিকতার শিক্ষক বলছেন, নতুন এই আইনটি তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়।

১. তথ্য অধিকার আইনের প্রথম অধ্যায়ের ৩ (খ): তথ্য প্রদানে বাধা সংক্রান্ত বিধানাবলী এই আইনের বিধানাবলীর সহিত সাংঘর্ষিক হইলে, এই আইনের বিধানাবালী প্রাধান্য পাইবে।

তথ্য কমিশনের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে বলা হয়েছে, ‘সম্প্রতি পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। তথ্য অধিকার আইনে অবাধ তথ্য পাওয়ার অধিকার আছে। অন্য কোনো আইনের মাধ্যমে এই আইনের বিধান ক্ষুণ্ণ হবে না।’ (প্রথম আলো, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮)
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনের কোনো বিধানের সহিত যদি অন্য কোনো আইনের কোনো বিধান অসমঞ্জস্ হয়, তাহা হইলে অন্য কোনো আইনের বিধানের সহিত এই আইনের বিধান যতখানি অসমঞ্জস্ হয় ততখানির ক্ষেত্রে 

এই আইনের বিধান কার্যকর থাকিবে:
তবে শর্ত থাকে যে, তথ্য অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ের ক্ষেত্রে তথ্য অধিকার আইনের বিধানাবলী কার্যকর থাকিবে।


ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও তথ্য অধিকার আইনের এই দুটি ধারা উল্লেখ করে বলা হচ্ছে, আইন দুটি পরস্পর সাংঘর্ষিক নয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন গণমাধ্যম বা সংবাদকর্মীদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করবে না। কারণ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যেখানে অধিকার ক্ষুণ্ণ করবে, সেখানে তথ্য অধিকার আইন সুরক্ষা দিবে। কারণ দুই আইনেই তথ্য অধিকার আইনের প্রাধান্য স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে।

২. এখন দেখা যাক- তথ্য অধিকার আইন গণমাধ্যম বা সংবাদকর্মীদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন থেকে কীভাবে এবং কতটা সুরক্ষা দিবে?

ক. একজন সংবাদকর্মী তথ্য অধিকার আইনের সুযোগ নিয়ে প্রক্রিয়া অনুসরণ করে যে তথ্য সংগ্রহ করবেন, সেই তথ্যের ভিত্তিতে সংবাদ প্রকাশিত হলে তিনি সুরক্ষা পাবেন। এক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ করে সংবাদকর্মী বা গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না।

খ. অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্যে যেসব তথ্য প্রয়োজন হয়, তা কি তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী পাওয়া সম্ভব? দুর্নীতি, জালিয়াতির তথ্য কি তথ্য অধিকার আইনের মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব?

একটি উদাহরণের ভিত্তিতে আলোচনা করলে বুঝতে সুবিধা হবে।
ধরুন, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির কথা। ঋণের নামে জালিয়াতি করে ব্যাংক থেকে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়ে গেল। এমন গুঞ্জন শোনা গেল, কিন্তু কোনো প্রমাণের নথি পাওয়া গেল না। গুঞ্জনের বিষয়টি সত্যি হলেও, তার ওপর ভিত্তি করে সংবাদ প্রকাশ করা যাবে? যাবে না। তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী, প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তথ্য-নথি-প্রমাণ চাওয়া যেতে পারে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কি তাদের জালিয়াতির সব তথ্য-প্রমাণ সংবাদকর্মীকে সরবরাহ করবেন? তাদের সরবরাহ করা নথি-প্রমাণ এনে সংবাদকর্মী 

অনুসন্ধানী রিপোর্ট করবেন?

ব্যাংক কর্তৃপক্ষ যে নিজেদের জালিয়াতি প্রমাণ হয় এমন তথ্য-প্রমাণের কাগজপত্র সংবাদকর্মীকে দিবেন না, তা নিয়ে বোধ করি বিতর্কের অবকাশ নেই।

সংবাদকর্মীকে তার নিজস্ব সোর্সের মাধ্যমে গোপনে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করতে হবে। বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির সংবাদ প্রকাশের আগে নিজস্ব একাধিক সোর্সের মাধ্যমে সংবাদ তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করতে হয়েছিল। সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি, স্বর্ণের মেডেলে ভেজালসহ আলোচিত সব অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের তথ্য-প্রমাণ গোপনেই সংগ্রহ করা হয়েছিল।

এই প্রক্রিয়ায় তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে সংবাদ প্রকাশ করলে, তথ্য অধিকার আইন গণমাধ্যম বা সংবাদকর্মীকে সুরক্ষা দিবে না। কারণ এই তথ্য-প্রমাণ তথ্য অধিকার আইন অনুসরণ করে সংগ্রহ করা হয়নি। বলে রাখা দরকার, বর্তমানে সংগৃহীত সব রকমের তথ্য এবং প্রকাশের সঙ্গে কোনো না কোনো প্রক্রিয়ায় ডিজিটাল ডিভাইসের সম্পৃক্ততা থাকে।

গ. তথ্য অধিকার আইনের কারণে ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ অকার্যকর হয়ে গিয়েছিল। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তা আবার কার্যকর করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারা অনুযায়ী ‘সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অপরাধে’- অভিযুক্ত করা যাবে গণমাধ্যম বা সংবাদকর্মীকে।

অনুসন্ধানী সংবাদকর্মীর সংগৃহীত সত্য-সঠিক তথ্য-প্রমাণও, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করার সুযোগ থাকবে। এতে একজন সংবাদকর্মীর ১৪ বছরের জেল ও ২৫ লাখ টাকা জরিমানা হতে পারে।

৩. তথ্য কমিশনের বক্তব্য বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘আইন দুটি সাংঘর্ষিক কিনা তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে যেসব উদাহারণ দেয়া হচ্ছে তা অত্যন্ত নিম্নমানের। এই তুলনা নাগরিকের অধিকারের বিষয় মাথায় রেখে করতে হবে। তথ্য কমিশনার এই পার্থক্য করতে ব্যর্থ হয়েছেন। প্রায় পাঁচ হাজার লিখিত আইনের প্রায় সবই নিয়ন্ত্রণমূলক। একমাত্র ২০০৯ সালের তথ্য অধিকার আইন-ই, কিছুটা হলেও জনমানুষকে অধিকার দিয়েছে। কিছুটা হলেও সরকারের স্বচ্ছতার পথ তৈরি হয়েছে। তথ্য অধিকার আইনের প্রাধান্যের কথাটা কৌশল হিসেবে রাখা হয়েছে। অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ফিরিয়ে আনাসহ আরও নানাবিধ আইনি ব্যাখ্যায়, তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দৃশ্যমানভাবে সাংঘর্ষিক।’

তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী তথ্য পাওয়ার পরিসর অত্যন্ত সীমিত।

বড় বড় অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী পাওয়া যায় না, যাবে না। ফলে তথ্য অধিকার আইনের প্রাধান্য স্বীকার করে নেওয়া হলেও, দুর্নীতি-জালিয়াতি-অনিয়মের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করলে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তা অপরাধ হিসেবে বিবেচনার সুযোগ থাকবে কিনা?

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ূম বলেন, ‘অবশ্যই সংবাদকর্মী বা গণমাধ্যমকে অভিযুক্ত করা যাবে। কারণ দুর্নীতি-জালিয়াতির তথ্য কোনো অবস্থাতেই তথ্য অধিকার আইন অনুসরণ করে পাওয়া যাবে না। সংবাদকর্মী তার নিজস্ব পদ্ধতিতে এসব ক্ষেত্রে যে তথ্য সংগ্রহ করবেন, তাকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত করার সুযোগ থাকবে। প্রয়োগের বিষয়টি নিয়ে হয়ত আলোচনা করা যাবে, প্রয়োগ হবে না তা তো বলা যাবে না। ৫৭ ধারার উদাহরণ তো আমাদের সামনে আছে।’

বিষয়টি খুব পরিষ্কারভাবেই অনুধাবন করা যায় যে, তথ্য অধিকার আইন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পরস্পর সাংঘর্ষিক নয়, তা বলা যায় না।

তরুণ সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সহজ ভাষায় বাংলাদেশের সংবিধান সম্পাদনাকারী অ্যাডভোকেট আরিফ খান এ বিষয়ে বলেন, ‘তথ্য  অধিকার আইনের প্রাধান্যের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যৌক্তিকতা প্রমাণের কৌশল হিসেবে, গণমাধ্যম বা সংবাদকর্মীদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্যে নয়। তথ্য অধিকার আইন দিয়ে যে অধিকার দেওয়া হয়েছিল, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দিয়ে তার অনেক কিছুই হরণ করা হবে।’

No comments:

Post a Comment