Search

Sunday, September 16, 2018

ফের বড় অঙ্কের ঋণ পাচ্ছেন খেলাপিরা

দেলোয়ার হুসেন


বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) রিপোর্ট জালিয়াতি করে খেলাপিরা নতুন করে বড় অঙ্কের ঋণ পেয়ে যাচ্ছেন। এভাবে তুলে নিচ্ছেন একাধিক ঋণ। একই সঙ্গে খেলাপি ঋণের তথ্য আড়াল করে ঋণ নবায়নও করে নিচ্ছেন। আগের ঋণ পনর্গঠন বা ঋণসীমা বাড়ানোর ক্ষেত্রেও হালনাগাদ সিআইবি প্রতিবেদন জমা না দিয়েই বেআইনিভাবে এসব সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে প্রভাবশালী চক্রটি।

কতিপয় অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তাদের সহায়তায় ঋণখেলাপিরা প্রকৃত সিআইবি প্রতিবেদন গোপন করে এসব জালিয়াতি করছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের চারটি ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ, বৈদেশিক মুদ্রা পরিদর্শন বিভাগ ও ভিজিলেন্স বিভাগ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে তদন্ত করে সিআইবি প্রতিবেদন জালিয়াতির বিভিন্ন ধরনের তথ্য পেয়েছে।

এসব তথ্যের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থিতি ধরে মার্চ থেকে এ তদন্ত শুরু করেছে। আগামী নভেম্বরের মধ্যে এ কাজ শেষ হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন তদন্তে ঋণখেলাপিদের সিআইবি রিপোর্ট জালিয়াতির ঘটনা উঠে আসার পরিপ্রেক্ষিতে নড়েচড়ে বসেছেন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এসব জালিয়াতি বন্ধ করতে ব্যাংকগুলোর প্রতি কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এখন থেকে কোনোক্রমেই হালনাগাদ সিআইবি রিপোর্ট ছাড়া গ্রাহককে নতুন ঋণ দেয়া যাবে না। একই সঙ্গে আগের ঋণ নবায়ন, পুনর্গঠনের ক্ষেত্রেও হালনাগাদ সিআইবি প্রতিবেদন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

যেসব ব্যাংক কর্মকর্তা হালনাগাদ সিআইবি প্রতিবেদন ছাড়া নতুন ঋণ মঞ্জুর, আগের ঋণ নবায়ন বা পুনর্গঠন করতে প্রস্তাব করবেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর মহাব্যবস্থাপক মনছুরা খাতুন যুগান্তরকে বলেন, নতুন ঋণ মঞ্জুর, খেলাপি ঋণ নবায়ন বা ঋণসীমা বাড়ানোর ক্ষেত্রে হালনাগাদ সিআইবি প্রতিবেদন সংগ্রহ করা বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক।

যেসব ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান হালনাগাদ সিআইবি প্রতিবেদন ছাড়া এসব কাজ করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে জরিমানা আরোপের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোও অভিযুক্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় বিভাগীয় ও আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, সিআইবি এখন সব সময়ই হালনাগাদ থাকে। অনলাইনে প্রতিবেদন সংগ্রহ করা সম্ভব বলে ব্যাংকগুলো নিজেরাই সহজেই এটি করতে পারে। কোনো খেলাপিই যাতে নতুন ঋণ সুবিধা পেতে না পারে সেজন্য এসব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, কোনো ঋণখেলাপি নতুন কোনো ঋণ পেতে পারেন না। একইভাবে ঋণখেলাপিদের ঋণ নবায়ন, ঋণসীমা বাড়ানো বা এলসি খোলা, ব্যাংক গ্যারান্টি দেয়ার ক্ষেত্রে সিআইবি প্রতিবেদন পর্যালোচনা করা হয়। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৬০ দিনের সিআইবি রিপোর্ট আমলে নেয়া হয়। এর বেশিদিনের রিপোর্ট আমলে নেয়া যাবে না। কোনো ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত কাজ সম্পন্ন করতে বেশি সময় লাগলে প্রয়োজন হলে দ্বিতীয় দফায় সিআইবি প্রতিবেদন নিতে হবে। ঋণ মঞ্জুরের তারিখের দিন থেকে ৬০ দিনের বেশ আগের সিআইবি প্রতিবেদন গ্রহণযোগ্য হবে না।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, হালনাগাদ সিআইবি প্রতিবেদন নিলে গ্রাহকের ঋণের সার্বিক চিত্র ফুটে উঠবে। ফলে ব্যাংক গ্রাহকের ঋণ পরিশোধের সংস্কৃতি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাবে। এটি বাস্তবায়ন করা হলে ঋণখেলাপিরা ঋণ সংক্রান্ত কোনো বাড়তি সুবিধা পাবে না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকের শাখাগুলোতে বড় অঙ্কের ঋণের নথিপত্র পর্যালোচনাকালে দেখা যায়, বড় অঙ্কের ঋণের সিআইবি প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে তারা শুধু কোড নম্বর উল্লেখ করে। কোনো তারিখ উল্লেখ করে না। এর ফলে ঋণ মঞ্জুর, নবায়ন বা পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে সিআইবি রিপোর্ট ৬০ বেশি পুরনো কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায় না। এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে কিছু গ্রাহকের ক্ষেত্রে এসব নির্দেশনা মেনে চলতে দেখা যায় না। এতে করে নতুন ঋণ মঞ্জুর, খেলাপি ঋণ নবায়ন বা ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে খেলাপিরাও নতুন ঋণ পেয়ে যাচ্ছে বা ঝুঁকি বিবেচনা না করেই খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হচ্ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রাহক সম্পর্কে হালনাগাদ সিআইবি রিপোর্ট না থাকার কারণে ঋণখেলাপিদের অনুকূলে ঋণ প্রদানের সুযোগ থাকে। এতে ব্যাংকের ঝুঁকির মাত্রা বেড়ে যায়। কেননা খেলাপিরা নতুন ঋণ পেলে ব্যাংকিং খাতে ঋণ শৃঙ্খলা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

সূত্র জানায়, জনতা ব্যাংকে ক্রিসেন্ট গ্রুপের রফতানি বিল বকেয়া থাকায় ফোর্সলোন সৃষ্টি করে দেনা শোধ করা হয়েছে। হলনাগাদ সিআইবি প্রতিবেদন ছাড়া গ্রাহককে নতুন ঋণ দেয়া হয়েছে। একই ঘটনা ঘটেছে জারা নিটিং টেক্সের ক্ষেত্রে। সিআইবি রিপোর্ট জালিয়াতি করে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের পরিচালক হয়েছেন কামরুন নাহার। তিনি একটি সরকারি ব্যাংকে ঋণখেলাপি ছিলেন। কিন্তু তাকে ঋণ ব্যাংক খেলাপি না দেখিয়ে নিয়মিত দেখিয়েছে। পরবর্তীকালে বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে ধরা পড়ে। আরও একটি সরকারি ব্যাংকে সিআইবি রিপোর্ট গোপন করে এলটেক্স, থার্মেক্স গ্রুপকে ঋণ দেয়া হয়। জনতা ব্যাংক ও একটি বেসরকারি ব্যাংক একই প্রক্রিয়ায় সোহেল গ্রুপকে ঋণ সুবিধা দিয়েছে।

  • কার্টসিঃ যুগান্তর/ সেপ্টেম্বর ১৫,২০১৮ 

No comments:

Post a Comment