Search

Sunday, September 16, 2018

এবার ইইউর জিএসপি সুবিধা নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে

বদরুল আলম

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী পণ্যের অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা (জিএসপি) স্থগিত হয়েছে ২০১৩ সালে। এবার শঙ্কা বাড়ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারে জিএসপি সুবিধা নিয়েও। ইইউতে জিএসপি সুবিধা থাকবে কি থাকবে না সেই পর্যালোচনা শুরু করেছে ইউরোপীয় কমিশন (ইসি)। তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে ইইউ। তবে শ্রমসংক্রান্ত বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশের যে অগ্রগতি তাতে ইইউতে জিএসপি সুবিধা বহাল থাকা নিয়ে সংশয়মুক্ত হতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা।

ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশের জিএসপি বহাল থাকার বিষয়টি নির্ভর করছে শ্রম অধিকার, কর্মপরিবেশ, দায়িত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক আচরণ ও শ্রমিকের নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নের ওপর। গত বছর বাংলাদেশ সরকারকে পাঠানো একাধিক চিঠিতে শ্রমসংক্রান্ত বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ইইউ। চিঠিতে শ্রম অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়ে বাংলাদেশের অগ্রগতি না থাকলে জিএসপি বাতিলের হুমকি দেয়া হয়। তবে বাতিলের আগে তদন্ত হবে বলেও উল্লেখ করে তারা। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সফর করছে ইইউ প্রতিনিধি দল।

সূত্র জানিয়েছে, ইইউর প্রতিনিধি দলে রয়েছেন বাণিজ্য ও শ্রমবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা। তারা শ্রম খাতসংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি দপ্তর ও সংস্থার সঙ্গে পৃথক সভা করেছেন। সভাগুলোয় প্রতিনিধি দল তাদের উদ্বেগের বিষয়গুলো তুলে ধরে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে।

এ সফরের আগেও বাংলাদেশকে একাধিক চিঠি দিয়ে তাদের উদ্বেগের বিষয়গুলো সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে ইইউ। ২০১৭ সালের ১৬ মার্চ, ৩১ মে ও ৫ জুলাই পাঠানো চিঠিতে মানবাধিকার এবং শ্রমমান-সংক্রান্ত ইবিএর (এভরিথিং বাট আর্মস) শর্তগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।

বাণিজ্য ও শ্রম মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ইইউর প্রত্যাশা ছিল বাংলাদেশ যেন শ্রম অধিকার ইস্যুগুলো সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়। এ বার্তা পুনরায় উল্লেখ করা হয় গত জুলাইয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের উপস্থিতিতে সাসটেইনেবিলিটি কম্প্যাক্টের সভায়ও। এ আলোচনার ধারাবাহিকতায় ১১ থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের টেকনিক্যাল টিম বাংলাদেশ সফর করছে।

সরকারি ও বেসরকারি সূত্রমতে, ইইউর পর্যালোচনায় থাকা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোর মধ্যে আছে শ্রম সংঘ করার স্বাধীনতা ও সামষ্টিক দরকষাকষি। এ-সংক্রান্ত সব বাধা দূর করার পক্ষে ইইউ। ইইউর আরেকটি উদ্বেগ শিশুশ্রমের বয়সসীমা নির্ধারণ নিয়ে। শিশু পাচারও ইইউর উদ্বেগের আরেকটি কারণ।

সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে ইইউর সভায় উপস্থিত একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, জিএসপি বিষয়ে ইইউর বক্তব্য হলো, মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হলে বাংলাদেশের সুবিধা থাকবে না। তখন জিএসপি প্লাস আসবে। বর্তমানে শ্রমসংক্রান্ত বিষয়ে যে ধরনের শর্ত আছে, জিএসপি প্লাসের ক্ষেত্রে তা আরো কঠোর হবে। এ শর্তগুলো যদি অনুসরণ ও প্রতিপালন করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে জিএসপি প্লাসের জন্য আবেদন করা সম্ভব হবে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে জিএসপি প্লাসের জন্য বাংলাদেশ যে অনুপযুক্ত, সেটি নিশ্চিত করেছেন ইইউ প্রতিনিধিরা।

ইইউ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেয়া আরেকটি সূত্রমতে, প্রতিনিধি দলের প্রতিবেদনের ওপরই নির্ভর করছে বিদ্যমান জিএসপি সুবিধা থাকা না-থাকা বিষয়টি। ২০১৭ সালের শেষ দিক থেকেই তারা বলছে, শ্রমসংক্রান্ত ইস্যুগুলো কমপ্লাই না করলে জিএসপি থাকবে না। জিএসপি স্কিমের আওতায় সবচেয়ে বেশি সুবিধা বাংলাদেশ নিচ্ছে। এ সুবিধার ফল সমাজের সবাই সমানভাবে পাচ্ছে কিনা, এটা পর্যবেক্ষণেই তারা এসেছে।

খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এটাই জিএসপি নিয়ে তদন্তের প্রাথমিক দল। এ দলের সদস্যরা সন্তুষ্ট না হলে চূড়ান্ত তদন্ত শুরু হবে। তারা যদি দেখে, শ্রম আইনে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে, তাহলে তারা কখনই চাইবে না জিএসপি বাতিল হোক। তবে তদন্তে যাওয়ার আগে ইইউ আগামী নভেম্বরে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) পরিচালনা পর্ষদের সভার জন্য অপেক্ষা করবে। ওই সভায় শ্রমসংক্রান্ত ইস্যুতে বাংলাদেশের অগ্রগতি পর্যালোচনার ওপর নির্ভর করবে জিএসপির চূড়ান্ত তদন্ত। তবে নিশ্চিতভাবেই জিএসপি অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে বাংলাদেশের সংশয় এখনই কাটছে না।

ইসি বাংলাদেশ সূত্রমতে, ২০২৪ সালে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হলে বাংলাদেশের জন্য ইবিএ সুবিধা থাকবে না। তখন বাংলাদেশকে জিএসপি প্লাসের মাধ্যমে বাণিজ্য সুবিধা আদায় করতে হবে। বর্তমানে জিএসপি প্লাসের শর্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ ওই সুবিধার জন্য এখনো উপযুক্ত নয়। বাংলাদেশকে অনুরোধ করতে হবে। একই সঙ্গে ইইউকেও বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধার আওতায় রাখতে শর্তে পরিবর্তন আনতে হবে।

জিএসপির আওতায় ইবিএর সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী দেশ বাংলাদেশ। এ সুবিধা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে সরাসরি অবদান রাখছে। ২০১৬ সালে ইবিএ সুবিধার আওতায় ইইউতে বাংলাদেশের রফতানির পরিমাণ ছিল ১৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ইউরো।

কর্মপরিবেশ ও শ্রম অধিকার নিশ্চিতের লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম চালু রেখেছে বাংলাদেশ। এসব কার্যক্রমের মধ্যে পোশাক খাতের কারখানাগুলোর মূল্যায়নে আন্তর্জাতিক জোটের কর্মসূচি প্রায় শেষ পর্যায়ে। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপীয় ক্রেতা জোটের তথ্য অনুযায়ী, কারখানার সংস্কার কার্যক্রমের অগ্রগতি ৮৫ শতাংশের বেশি। স্থানীয় উদ্যোগের মূল্যায়ন কার্যক্রম চলবে ২০২১ সাল পর্যন্ত। এভাবে পর্যায়ক্রমে কর্মপরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত হচ্ছে।

শ্রম অধিকার-বিষয়ক আইনি প্রক্রিয়াগুলোয়ও পরিবর্তন এসেছে। সম্প্রতি মন্ত্রিসভার চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে শ্রম আইনের সংশোধনী। সেখানে ট্রেড ইউনিয়ন করার সদস্যসীমা কমিয়ে আনা হয়েছে। পরিবর্তন আনা হয়েছে শিশুশ্রমের বয়সসীমায়। বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলগুলোয় (ইপিজেড) সরকারি সংস্থার মাধ্যমে পরিদর্শন কার্যক্রমও শুরু হতে যাচ্ছে। এছাড়া ইপিজেডের অভ্যন্তরে বিনিয়োগকারীদের প্রয়োজন অনুযায়ী শ্রম সংঘের বিধান নিয়ে কাজ করেছে সরকার। কর্মপরিবেশ ও শ্রম অধিকার-সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে এভাবে পর্যায়ক্রমিক কার্যক্রম ও অগ্রগতি চলমান রয়েছে।

উল্লেখ্য, কর্মপরিবেশের উন্নতি ও শ্রম অধিকার সুরক্ষায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি না হওয়ায় ২০১৩ সালের ২৭ জুন তত্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এক আদেশে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করেন। এ সুবিধা পুনর্বহালে বাংলাদেশের জন্য ১৬টি শর্তও দেয়া হয়। বাংলাদেশ সরকার শর্তগুলো পূরণ করেছে বলে দাবি করলেও জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল করেনি যুক্তরাষ্ট্র।
  • কার্টসিঃ বনিক বার্তা / সেপ্টেম্বর ১৬,২০১৮ 

No comments:

Post a Comment