Search

Monday, October 1, 2018

যেখানে প্রধান বিচারপতি বিচার পায় না সেখানে খালেদা জিয়া বা অন্যরা কিভাবে ন্যায়বিচার পাবেন?

বই প্রকাশনা উৎসবে এস কে সিনহা


বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রের তিন নম্বর ব্যক্তি। সেই প্রধান বিচারপতি যেখানে ন্যায়বিচার পান না সেখানে খালেদা জিয়া বা অন্যরা ন্যায়বিচার কিভাবে পাবেন? আর এই মুহূর্তে আমি দেশে গেলে আমাকে হত্যা করা হবে। আমার জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই, যেহেতু দেশে কোনো আইন নেই।

গত ২৯ সেপ্টেম্বর দুপুরে (নিউ ইয়র্ক সময়) ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল প্রেস ক্লাবে সাবেক প্রধান বিচারপতির আলোচিত বই ‘এ ব্রোকেন ড্রিম’ বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।

মোহাম্মদ দীপুর সঞ্চালনায় প্রকাশনা উৎসবে সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ছাড়াও আমেরিকার সাবেক রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম বক্তব্য রাখেন।

বিচারপতি এস কে সিনহা বলেন, বাংলাদেশের বিচার বিভাগ স্বাধীন নয়। বিচার বিভাগের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এই বিষয়গুলো আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুব এ আলমকে জানিয়েছিলাম কিন্তু কাজ হয়নি। ষোড়শ সংশোধনীতে বিচারপতিদের ইম্পিচ করা নিয়ে প্রধান বিচারপতি হিসেবে আমি ছয়জন বিচারপতিকে নিয়ে একটি বেঞ্চ করেছিলাম। আমরা এই সংশোধনী বাতিলের জন্য একমতও হয়েছিলাম কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা তা করতে পারিনি। উল্টো আমাকে দেশ থেকে বের করে দেয়া হলো। আমাকে নিয়ে অনেক নাটক করা হলো।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমি বলেছিলাম, বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে। কিন্তু তিনি তা করেননি। উল্টো আমাকে অনুরোধ করেছিলেন তার সরকারের পক্ষে রায় দিতে। আমি সেই সময় তাকে বলেছিলাম- এটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ আমি একটি বেঞ্চ করেছি তারা যে সিদ্ধান্ত দেবে আমি সেই সিদ্ধান্তই মেনে নেবো। আমরা আরো চেয়েছিলাম যে- পুলিশ যাকে রিমান্ডে নেবে তাকে যেন জীবত বা সুস্থ অবস্থায় কোর্টে আনা হয়-এ বিষয়ে লিখিত দিতে। আমাকে নিয়ে নাটক করা শুরু হলো। একটি এজেন্সিকে দিয়ে আমাকে হুমকি দেয়া হলো- আমি যেন এসব থেকে বিরত থাকি।

আমি প্রধানমন্ত্রীকে জানালাম ওই এজেন্সির বিষয়টি। আমি তাকে বললাম ওই এজেন্সি যেন কোর্টে না আসে, বা কোন বিচারকের বাড়িতে না যায়। এরই মধ্যে ভারতের রাষ্ট্রপতি এলেন। হোটেলে নৈশভোজে আমি গেলাম। যেখানে প্রধানমন্ত্রী আবারো সরকারের পক্ষে রায় দেয়ার জন্য বললেন। আমি প্রায় ছয় মাস অপেক্ষা করলাম। একদিন ওই এজেন্সি আমাকে সরাসরি ফোন করল। বললেন, আমরা মিটিং ফিক্সড করছি, আশা করি আপনি আসবেন।

বিকেলে আমি ওই এজেন্সি থেকে ফ্যাক্স পাই। আমাকে জানানো হলো রাষ্ট্রপতির সাথে বৈঠক। আমি গিয়ে বিস্মিত। আমাকে মিলিটারি সেক্রেটারির রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ পায়চারী করছেন। ৪৫ মিনিট পরে আমাকে ডাকা হলো। দেখলাম প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, অ্যাটর্নি জেনারেল বসে আছেন। আমি বুঝতে পারলাম কেন আমাকে দাওয়াত দেয়া হলো। প্রধানমন্ত্রী আবারো বললেন, তাদের ফেভারে রায় দেয়ার জন্য। আরো বললেন, আমি আপনার সাপোর্ট চাই।

আমি হাসলাম এবং বেঞ্চের কথা তাকে জানালাম। তিনি রেগে বললেন, সার্ট আপ অ্যান্ড গো। আমি বললাম আমি যাবো না, রাষ্ট্রপতি বললে যাবো। কারণ তিনিই আমাকে নিয়োগ দিয়েছেন। সেই দিনের মিটিংটি সন্ধ্যা ৭ থেকে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত চলে। আমি কিভাবে সেখান থেকে এলাম আপনাদের বলতে পারব না।

বাসায় এসে আমি ঘুমাতে পারিনি। রাত ৪টায় ওঠে গেলাম। ১ ঘণ্টা হাঁটাহাঁটি করি। কী করব চিন্তা করছি। সকাল ৮টায় আমি কোর্টে চলে গেলাম। ছয়জন বিচারপতির সাথে আমি বসি। বঙ্গভবনের বিষয়টি আমি তাদের জানাইনি। তিনজন আমার পক্ষে ছিলেন, দু’জন সরকারের পক্ষে, একজন কোনো পক্ষে মত দেননি।

আমি বিদেশে গেলাম। তারা সরকারকে বিষয়টি জানিয়ে দেয়। সাবেক বিচারপতি খায়রুল হক আমার বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করে। আমাকে পাকিস্তানের এজেন্ট বানানো হলো, জড়ানো হলো ড. কামাল হোসেনকে। পূজার ছুটিতে রাষ্ট্রপতির সাথে আমার দেখা হয়।

৩০ সেপ্টেম্বর আবারো বঙ্গভবনে ডাকা হলো। আমি গেলাম। আরো পাঁচজন বিচারপতিকে আমন্ত্রণ জানানো হলো। সেখানে আইনমন্ত্রী এবং অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন। ওই পাঁচজন বিচারপতি তখনো আসেননি। আমি কল করলাম, তারা বললেন, ৪৫ মিনিট পরে আসবেন। বুঝলাম কেন দেরিতে আসবেন। রাষ্ট্রপতি আমাকে বললেন, আপনার বিরুদ্ধে অন্যান্য বিচারকদের অভিযোগ আছে। তারা আপনার সাথে কোর্টে বসবেন না।

আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। তারা বিচারপতি ওয়াহাব মিয়ার সাথে বৈঠক করছে। আমি ষড়যন্ত্র টের পাচ্ছিলাম এবং বাসায় চলে এলাম। একদিন ওই এজেন্সির চিফ আমার কোর্টে আসে। এসে বলে আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। সুতরাং আপনাকে তিন মাসের জন্য ছুটিতে যেতে হবে। আমি হতভম্ব।

আমার সেক্রেটারি আমাকে কানে কানে বললেন, স্যার পুরো কোর্ট সিভিল পোশাকে ডিজিএফআই দখল করে আছে। আমি আমার সেক্রেটারিকে বললাম এক মাসের ছুটির আবেদন করতে। ছুটি শেষে বাসায় আসার পর আমি দেখি আমার পুরো বাসা মিলিটারি ঘিরে রেখেছে। অর্থাৎ আমি গৃহবন্দী।

ওই এজেন্সির প্রধান এসে বললেন, আপনি অসুস্থ, আপনি হাসপাতালে চলে যান। আমি বললাম আমি তো সুস্থ। আর আমি আপনার কথা শুনব কেন? তখন আমাকে হুমকি দেয়া শুরু করল। আমাকে পরীক্ষা করাতে ডাক্তার নিয়ে আসে। এক সময় আমার আত্মীয়স্বজনকে হয়রানি শুরু করে। আমাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়।

আমি প্রথমে অস্ট্রেলিয়া, তারপর কানাডায় এবং পরে আমেরিকায় আসি। তিনি আরো বলেন, আমার এ বইতে সব কিছু আসেনি। দ্বিতীয় খণ্ডে আসবে। সেটি তাড়াতাড়িই প্রকাশ করা হবে।

তিনি আরো বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চতুর্থ সংশাধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশে বাকশাল কায়েম করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেননি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সেই বাকশাল কায়েম করেছেন। ১৫৪ জন এমপি মনোনয়ন দিয়েই এমপি হয়েছেন। বাকিরা ২% থেকে ৫% ভোটে এমপি হয়েছেন। ভারত তাদের পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এস কে সিনহা বলেন, ভারত সমর্থন দেয়ার কারণ হলো বাংলাদেশে জঙ্গি আছে, সন্ত্রাস আছে। আওয়ামী লীগ বলেছিল জঙ্গিবাদ এবং সন্ত্রাস বন্ধ করবে। অন্য দিকে করিডোরসহ ভারত তাদের সুবিধা পাবে। ইতোমধ্যেই ভারত শ্রীলঙ্কা এবং নেপালকে হারিয়েছে। এই অবস্থায় এগোতে থাকলে ভারতকে দুটো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আই হেইট পলিটিক্স। আমি চাই না রাজনীতিবিদরা আমার সামনে আসুক। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মামলা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে এস কে সিনহা বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রের তিন নম্বর ব্যক্তি। সেই প্রধান বিচারপতি যেখানে ন্যায়বিচার পান না সেখানে খালেদা জিয়া বা অন্যরা ন্যায়বিচার কিভাবে পাবেন? আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছি, এখানো কোনো কিছু পাইনি। যে কারণে অনেক দেশে নিমন্ত্রণ থাকা সত্ত্বেও আমি যেতে পারছি না।

প্রধানমন্ত্রী গত ২৮ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন অন্যের অর্থে আপনি বই বের করেছেন- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বই বের করার জন্য কী আমাজন আমার কাছ থেকে অর্থ নিয়েছে? এগুলো বানোয়াট। আমার বইকে প্রধানমন্ত্রী ভয় পাচ্ছেন কেন?

আপনি কি আবার দেশে ফিরে যাবেন- এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমি দেশ ত্যাগের সময় বলেছিলাম- আমি আবারো ফিরে আসবো। এখন গেলে আমাকে হত্যা করবে, আমার জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই। তা ছাড়া দেশে আইনও নেই। এখানেও আমি নিউজার্সির যে বাড়িতে থাকি, তারপাশে আরেকটি বাড়ি ওই এজেন্সি ভাড়া করেছে। দুটো ক্যামেরা দিয়ে ২৪ ঘণ্টা ভিডিও করছে।

  • - Noyadigonto/ Oct 1,2018 

No comments:

Post a Comment