বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণের নামে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন এসএ গ্রুপের কর্ণধার মো. শাহাবুদ্দিন আলম। জালিয়াতির মাধ্যমে গড়ে তোলা বিপুল সম্পদ কৌশলে ছেলে-মেয়ে ও আত্মীয়-স্বজনের নামে হস্তান্তর করে আবেদন করেছেন কোম্পানি বিলুপ্তির। সবশেষে চেষ্টায় ছিলেন বিদেশে পালানোর। তবে সে চেষ্টায় সফল হননি চট্টগ্রামের এ ঋণখেলাপি ব্যবসায়ী। রাজধানীর গুলশান এলাকা থেকে গতকাল তাকে গ্রেফতার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। পরে আদালতের মাধ্যমে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) ইপিজেড থানায় ব্যাংক এশিয়ার দায়ের করা অর্থ কেলেঙ্কারির মামলায় শাহাবুদ্দিন আলমকে গ্রেফতার করেছে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিট। তারা বলছে, আলোচিত এ ব্যবসায়ী বিভিন্ন সময় ভুয়া কাগজ সৃষ্টি করে বিভিন্ন ব্যাংকে এলসি খুলেছেন। কিন্তু এলসির বিপরীতে যেসব কাঁচামাল আমদানির কথা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা আসেনি। যেসব এলসির বিপরীতে বন্ড সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি করেছেন, সেগুলোও নিয়ম ভেঙে খোলাবাজারে বিক্রি করেছেন। কিন্তু এলসির বিপরীতে নেয়া ঋণ আর ব্যাংককে পরিশোধ করেননি।
শাহাবুদ্দিন আলমের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা সূত্রে জানা যায়, এ ব্যবসায়ীর প্রতিষ্ঠান এসএ অয়েল রিফাইনারি লিমিটেডের সঙ্গে ব্যাংক এশিয়ার চট্টগ্রামের সিডিএ এভিনিউ শাখার একটি চুক্তি হয়। চুক্তিপত্র অনুযায়ী ক্রুড অয়েল আমদানির জন্য ২০১৪ সালের ১৯ জুন তিনি ব্যাংক এশিয়ায় একটি এলসি খোলেন। সেই এলসির বিপরীতে ওই বছরের ২৪ জুলাই তিনি ৮৪ লাখ ডলার মূল্যের পাম অয়েল আমদানির জন্য চুক্তি করেন।
চুক্তিপত্র অনুযায়ী এলসির বিপরীতে প্রথম চালানে ওই বছরের ২৯ জুলাই ৫৭ লাখ ১১ হাজার ৯১০ মার্কিন ডলার মূল্যের প্রায় ৬৮ লাখ টন রিফাইনড ব্লিচড ডিওডোরাইজড পাম অয়েল আমদানি করেন। ব্যাংকের দেনা পরিশোধে আমদানি কাঁচামাল খালাসও করেন। ওই এলসির বিপরীতে দ্বিতীয় চালানে ২০১৪ সালের ৭ জুলাই ৩৫ লাখ ২৭ হাজার ডলার মূল্যের প্রায় ৪২ টন পাম অয়েল খোলাবাজারে বিক্রি করে ২৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন।
সিআইডির তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাম অয়েল আমদানির বিপরীতে খোলা দুটি এলসির মধ্যে ইনভয়েস, ব্যাংকের এনডোর্স করা মূল দলিলাদি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আদালতের নির্দেশনার পর পুনরায় মূল কাগজপত্র খোঁজাখুঁজি চলছে।
ব্যাংক এশিয়ার সিডিএ এভিনিউ শাখা থেকে এর আগেও শাহাবুদ্দিন আলম ৭০৯ কোটি ২৭ লাখ টাকা একই কায়দায় এলসি খুলে আত্মসাৎ করেছেন। এ ঘটনায় আলোচিত এ ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ব্যাংকের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়। এছাড়া ইসলামী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা থেকে ঋণের নামে ৯৪০ কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন এ ব্যবসায়ী। এ নিয়ে চট্টগ্রাম আদালতে মামলা চলছে।
ব্যাংক এশিয়া ও ইসলামী ব্যাংকের মতো ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের আগ্রাবাদ শাখা থেকেও ঋণের নামে ৭০১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন এসএ গ্রুপের চেয়ারম্যান শাহাবুদ্দিন আলম। এ ঘটনা নিয়েও চট্টগ্রাম আদালতে মামলা চলছে। পূবালী ব্যাংকের আগ্রাবাদ করপোরেট শাখা থেকে ঋণের নামে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন শাহাবুদ্দিন আলম। একই প্রক্রিয়ায় প্রায় ১৮০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন কৃষি ব্যাংকের ষোলশহর শাখা থেকে।
এর বাইরে এসএ গ্রুপের কর্ণধার অগ্রণী ব্যাংকের চট্টগ্রাম করপোরেট শাখা থেকে ঋণের নামে আত্মসাৎ করেছেন ৫৪৮ কোটি টাকা। এছাড়া জনতা ব্যাংকের চট্টগ্রাম শেখ মুজিব রোডের করপোরেট শাখা থেকে ১১৮ কোটি, প্রাইম ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা থেকে ৫৫ কোটি ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা থেকে ৩৬ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন শাহাবুদ্দিন আলম।
এসএ গ্রুপের কাছে পাওনাদার একাধিক ব্যাংকের এমডি বলেন, শাহাবুদ্দিন আলম দেশের ব্যাংকিং খাতে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের একজন। তার গ্রেফতার অন্যদের জন্য যেন নিদর্শন হয়। তবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এ তত্পরতা যেন থেমে না যায়। ইচ্ছাকৃত অন্য খেলাপিদেরও আইনের আওতায় আনা হলে খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি কিছুটা হলেও বন্ধ হবে।
অর্থ আত্মসাতের এসব ঘটনায় এসএ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহাবুদ্দিন আলমের বিরুদ্ধে দুই ডজনের বেশি ব্যাংক ১১১টি মামলা করেছে। এসব মামলা বিচারাধীন থাকা অবস্থাতেই তিনি কোম্পানি বিলুপ্তির আবেদন করেন। পাশাপাশি ঋণের নামে আত্মসাৎ করা অর্থ ছেলে-মেয়ে ও আত্মীয়-স্বজনের নামে হস্তান্তর করে নিজের বাড়ি ও গাড়ি বিক্রি করে দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছিলেন বলে তথ্য রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে।
সিআইডির সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তা জানান, ঋণের নামে আত্মসাৎ করা অর্থের বড় অংশই বিদেশে পাচার করেছেন শাহাবুদ্দিন আলম। পাচার করা এসব অর্থ দিয়ে তিনি বিদেশে অবৈধ সম্পদও গড়েছেন। দ্রুততম সময়ের মধ্যেই তার বিরুদ্ধে মুদ্রা পাচার আইনে মামলা করা হবে। পাশাপাশি অন্যান্য ব্যাংকের মামলাগুলো এলে সেগুলোতেও তাকে গ্রেফতার দেখানো হতে পারে।
শাহাবুদ্দিন আলমের গ্রেফতারের বিষয়ে সিআইডির মুখপাত্র ও অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএস) মোল্যা নজরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, চট্টগ্রামে ব্যাংক এশিয়া থেকে ঋণের নামে অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাটি তদন্ত করতে গিয়ে অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। এর ভিত্তিতে এসএ গ্রুপের কর্ণধারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলাটি যেহেতু চট্টগ্রামের আদালতের, তাই তাকে ঢাকার আদালতে সমর্পণ করা হয়েছে। পরে চট্টগ্রাম আদালতে রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে আত্মসাত্কৃত অর্থ পাচারের উৎস খুঁজে দেখা হবে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী শাহাবুদ্দিন আলম ভাগ্যগুণে দেশের দুই ডজনের বেশি ব্যাংক থেকে ঋণ পেয়েছেন। ব্যাংকগুলোও বাছবিচার ছাড়াই প্রায় জামানতবিহীন ঋণ দিয়েছে এ ব্যবসায়ীকে। ঋণের অর্থে তিনি গড়ে তুলেছেন দেড় ডজন কোম্পানি। প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণের ভারে নিমজ্জিত এসএ গ্রুপের এ কর্ণধার এখন চূড়ান্ত উদ্যোগ নিয়েছেন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডোবানোর। যদিও তিনি নিজেই একটি বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালক।
এসব নিয়ে গত ১৯ জুলাই ‘শাহাবুদ্দিন আলম: ব্যাংক লুটের কারিগর’ শিরোনামে বণিক বার্তায় একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ হয়।
- কার্টসিঃ বনিক বার্তা /১৮ অক্টোবর ২০১৮
No comments:
Post a Comment