তৌফিক আলী
গাজীপুরে চলছে র্যাপিড বাস ট্রান্সপোর্ট (বিআরটি)-এর নির্মাণ কাজ। ছবি: এসকে এনামুল হক
কাজে মন্থরগতির আরেকটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ তৈরি করলো বিমানবন্দর-গাজীপুর র্যাপিড বাস ট্রান্সপোর্ট বা বিআরটি লাইন প্রকল্প। শুধু তাই নয়, প্রকল্প খরচ বৃদ্ধিরও এক নমুনা সৃষ্টি করেছে এটি।
গণপরিবহনকে গতিশীল করতে গাজীপুর ও হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মধ্যে ২০.৫ কিলোমিটার বিআরটি লাইন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিলো ২০১২ সালে। এরপর, একে একে ছয়টি বছর কেটেছে কিন্তু, কাজ হয়েছে মাত্র ২০ শতাংশ। অথচ প্রকল্প শেষ হওয়ার তারিখ দেওয়া হয়েছে চলতি বছরের ডিসেম্বরে।
প্রকল্পের কর্তাব্যক্তিদের মতে, সেই পথে আধুনিক ও দ্রুত বাস পরিষেবা পেতে যাত্রীদের অপেক্ষা করতে হবে আরও ছয় বছর। এর জন্যে খরচ করতে হবে আরও অনেক টাকা। প্রথমে এই প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছিলো ২ হাজার ৪০ কোটি টাকা। ইতোমধ্যে, সেই খরচ দ্বিগুণের বেশি বাড়িয়ে ৪ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত বিআরটি ব্যবস্থার একজন সাবেক কারিগরি বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, “এর ফলে বিআরটি লাইনের কিলোমিটার প্রতি গড় খরচ পড়ছে ২৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় ২১৮ কোটি টাকা। এটি একেবারেই অবাস্তব একটি প্রকল্পের রূপ নিয়েছে। কেননা, সারাবিশ্বে সেই খরচ সর্বোচ্চ ছয় মিলিয়ন ডলার।”
নিউইয়র্ক-ভিত্তিক ইনন্সিটিউট ফর ট্রান্সপোর্টেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পলিসির ম্যানুয়ালের বরাত দিয়ে তিনি আরও বলেন, বিআরটি সেবার লক্ষ্যই হলো তা সর্বনিম্ন খরচে তৈরি করা হবে। এবং দুই বছরের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হবে। কেননা, এটি তৈরি করা হয় বিদ্যমান সড়কের ওপর।
“অথচ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে এটি তৈরি করতে এক যুগের বেশি সময় লেগে যাচ্ছে,” যোগ করেন অধ্যাপক শামসুল হক। তার মতে, এ ধরনের উচ্চ ব্যয় ও ধীর অগ্রগতি সম্পন্ন প্রকল্প একটি অবাস্তব পরিস্থিতির দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে।
প্রকল্পের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, দুর্বল পরিকল্পনা এবং বিআরটি ব্যবস্থার নির্মাণকাজে অনভিজ্ঞতার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে এমন মন্থরগতি দেখা যাচ্ছে।
অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, যাহোক, প্রকল্পটি যখন শেষ হবে তখন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং পরিবহণ চাহিদা উভয়ই বদলে যাবে। ফলে যে উদ্দেশ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে তা সফল নাও হতে পারে।
তিনি জানান, স্ট্রাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্লানের সুপারিশক্রমে গাজীপুর ও হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মধ্যে বিআরটি স্কিমটি সরকার হাতে নেয় ২০১২ সালে। জাতীয় মহাসড়কের দুটি প্রধান লেনের ওপর নির্মিতব্য সেই প্রকল্পের সাফল্য দেখে তা বিমানবন্দর থেকে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত বর্ধিত করার চিন্তাভাবনাও রয়েছে।
কিন্তু, প্রকল্পের আংশিক বাস্তবায়নের বর্তমান অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে তা বর্ধিত করার ভাবনাটি অপ্রাসঙ্গিক, মন্তব্য শামসুল হকের।
এদিকে, প্রকল্প পরিচালক সানাউল হকের মতে, দরপত্র, জরিপ ও নকশা চূড়ান্ত করতে দেরি হওয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হচ্ছে।
তিনি জানান, বিআরটি ব্যবস্থা দেশে এই প্রথম বাস্তবায়িত হচ্ছে। পরামর্শক নিয়োগ ও নকশা চূড়ান্ত করতেই চার বছর সময় লেগে গেছে। তিনি বলেন, “আমরা এই প্রকল্পটি বাস্তাবায়ন করছি মহাসড়ক ও আশপাশের সড়কগুলোতে যানবাহন চলাচলে কোনো বিঘ্ন না ঘটিয়েই। এছাড়াও, মহাসড়কটি বছরে ছয়মাস বর্ষার পানিতে ডুবে থাকে। শুধু তাই নয় যথাযথ পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় রাস্তার পাশের কারখানাগুলোর ময়লা রাস্তায় ফেলা হচ্ছে।”
প্রকল্পের খরচ বৃদ্ধির বিষয়টি ব্যাখ্যা করে সানাউল হক বলেন, প্রাথমিক নকশায় যা ছিলো পরে চূড়ান্ত নকশায় তা বাড়ানো হয়। যেমন, প্রাথমিক নকশায় ৫০টি আর্টিকুলেটেড বাস চলাচলের ব্যবস্থা থাকলেও চূড়ান্ত নকশায় তা বাড়িয়ে ১২০টি বাস করা হয়।
কর্মকর্তারা এখন প্রকল্পটি নতুনভাবে সাজিয়ে তা পরিকল্পনা কমিশনে জমা দেওয়ার চিন্তা করছেন। এতে প্রকল্পের বাড়তি খরচের অনুমোদন চাওয়া হচ্ছে। এছাড়াও, প্রকল্প কাজ শেষ করতে ২০২০ সালের জুন মাস ধরা হয়েছে।
কিন্তু, প্রকল্পটির সঙ্গে নিযুক্ত ব্যক্তিরা জানিয়েছেন বিআরটি লাইন-৩ এর কাজ শেষ করতে আরও অনেক বেশি সময় লাগবে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ফরাসি উন্নয়ন সংস্থা এবং গ্লোবাল এনভারনমেন্ট ফ্যাসিলিটির ঋণে চারটি প্যাকেজে বিআরটি লাইন-৩ এর কাজ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে এক হাজার ৬৫১ কোটি টাকা নেওয়া হবে এবং ৩৮৯ কোটি টাকা নেওয়া হবে জনগণের করের টাকা থেকে।
‘গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট’- এই শিরোনামে প্যাকেজগুলো যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর।
প্যাকেজগুলোর মধ্যে রয়েছে ২৫টি বিআরটি স্টেশন, গাজীপুরে ডিপো, গাজীপুর এবং বিমানবন্দরে দুটি টার্মিনাল, ছয়টি উড়াল সেতু, ৫৬ কিলোমিটার সংযোগ সড়কের উন্নয়ন, ২০.৫ কিলোমিটার ফুটপাতের উন্নয়ন, ২৪ কিলোমিটার পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং ১০টি কাঁচাবাজার নির্মাণ।
সেতু কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে রয়েছে উত্তরা থেকে চেরাগ আলী বাজার পর্যন্ত ৪.৫ কিলোমিটার উড়াল সড়ক এবং ১২ লেনের টঙ্গী সেতু নির্মাণ। এই প্যাকেজের প্রকল্প পরিচালক লিয়াকত আলী জানান, তারা এখন টেস্ট পাইলিং, জরিপ, সয়েল টেস্ট এবং যন্ত্রপাতি আনা-নেওয়ার কাজ করছেন।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের দায়িত্বে রয়েছে ১৬ কিলোমিটার বিআরটি লেন তৈরি এবং ছয়টি উড়াল সেতু নির্মাণের কাজ এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের দায়িত্বে রয়েছে ডিপো, কাঁচা বাজার এবং সংযোগ সড়কের উন্নয়নের কাজ।
এসব নির্মাণের লক্ষ্য হচ্ছে গাজীপুর, টঙ্গী এবং উত্তরার অধিবাসীরা যেন আধুনিক আর্টিকুলেটেড বাসে চড়ে দ্রুত ঢাকায় আসতে পারেন। প্রকল্প অনুযায়ী প্রতি স্টেশনে তিন থেকে পাঁচ মিনিট পরপর বাস এসে থামবে।
প্রকল্প পরিচালক সানাউল হক বলেন, জয়দেবপুর চৌরাস্তায় ইন্টারচেঞ্জ এবং ভোগরা, আব্দুল্লাহপুর ও বিমানবন্দর মোড়ে উড়ালসেতু যানবাহন চলাচলে গতি আনবে।
যাহোক, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম ধাপে বলা হয়েছিল বিমানবন্দর থেকে কেরানীগঞ্জের মধ্যে দ্রুত বাস পরিষেবা শুরু হবে ২০১৩ সালের মধ্যে এবং গাজীপুর ও বিমানবন্দরের মধ্যে সেই পরিষেবা পাওয়া যাবে এর পরের বছর।
- কার্টসিঃ দ্যা ডেইলি স্টার / আগস্ট ২৯, ২০১৮
- সূত্রঃ https://bit.ly/2NYS9zT
No comments:
Post a Comment