সম্পাদকীয়
দ্রুত রহস্য উদ্ঘাটন করতে হবে
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের পূর্বাচল এলাকায় তিন ব্যক্তির গুলিবিদ্ধ লাশ যেখানে মিলেছিল, এবং যার হত্যারহস্য আজও অনুদ্ঘাটিত, সেই এলাকার কাছেই ছয় সপ্তাহের কম সময়ের ব্যবধানে আরও চারজনের গুলিবিদ্ধ লাশ মিলেছে। উভয় ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা এজাহারের বিবরণে একধরনের গোঁজামিল ও পক্ষপাত লক্ষ করা যায়। কোনো ধরনের প্রাথমিক তদন্ত ছাড়াই নিহত ব্যক্তিদের কোনো না কোনোভাবে অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকার বিষয়ে তারা ইঙ্গিত করেছে। গত সেপ্টেম্বরে ‘ডিবি’ পরিচয়ে নৈশকোচ থামিয়ে যে কায়দায় তিনজনকে নামিয়ে নেওয়ার পর হত্যা করা হয়েছে, তাতে সমাজে তাঁদের ‘কেউকেটা’ হিসেবে একটা পরিচিতি বা তেমন পূর্ব বৃত্তান্ত থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু খোঁজখবর নিয়ে যেটুকু জানা গেছে, তাতে তঁারা খুবই সাধারণ মানুষ এবং এভাবে তাঁদের খুন করার কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না।
গত রোববারের ঘটনায় যে চারজনের গুলিবিদ্ধ লাশ মিলেছে,পুলিশের স্বীকৃতমতে তাঁদেরও অপরাধবিষয়ক কোনো নির্দিষ্ট পূর্ব বৃত্তান্ত নেই। কিন্তু এজাহারের বিবরণে পুলিশ যা লিখেছে, তা গভীর পরিতাপ ও পরিহাসের বিষয়। যেমন তারা বলেছে,‘লোকমুখে জানতে পারি যে, পাচরুবিতে দুই দল অস্ত্রদা(ধা)রীরা সন্ত্রাসীরা গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই।’ এরপর ‘প্রাথমিক ধারণা’ হিসেবে দাবি করা হয়েছে যে,‘অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসী বা ডাকাতরা নিজেদের মধ্যে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়া নিজের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে অজ্ঞাতনামাদের দ্বারা নিহত হইতে পারে।’ অশুদ্ধ বাক্য ও বানানে এতটা গুরুতর ত্রুটিপূর্ণ এবং দৃশ্যত আইনগত এখতিয়ারবিহীন এজাহার লেখা নির্দেশ করে যে পুলিশ অপরাধের ভয়াবহতা এবং সামাজিক উদ্বেগের প্রতি যেন অভ্যাসগতভাবে উদাসীন হয়ে পড়েছে। প্রাথমিক ধারণার ভিত্তি ন্যূনতম তথ্যভিত্তিক হতে হবে। এটা নিতান্ত কল্পনাপ্রসূত বলে প্রতীয়মান হওয়া যুক্তিসংগত নয়। পুলিশের উল্লিখিত ‘প্রাথমিক ধারণা’ সত্য হতে পারে না, এমনও নয়। বরং আমরা সে ক্ষেত্রে শঙ্কিত হতে পারি যে, এ ধরনের ত্রুটিপূর্ণ এজাহার সন্ত্রাসীদের জন্য ফয়দার সুযোগ তৈরি করে দিতে পারে।
আমাদের বক্তব্য হলো, এজাহারও একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এটা প্রণয়নে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা প্রত্যাশিত। সাধারণভাবে এটা প্রতিষ্ঠিত যে প্রাথমিক বিবরণ অন্তত স্বব্যাখ্যাত হতে হবে। কথিত ‘দুই দল সন্ত্রাসীর গোলাগুলির’ ফল এ পর্যন্ত আমরা যা প্রত্যক্ষ করেছি, তা বরাবর রহস্যময়ই থেকে গেছে। এজাহারে বলা হয়েছে, চারজনেরই পেছন থেকে মাথায় গুলি, তিনজনের মাথার ভেতর শটগানের গুলি এবং মাথা ছাড়া তাঁদের কারও শরীরের অন্যত্র ক্ষতের চিহ্ন নেই। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন মাইক্রোবাসের চালক, একজন বাসচালক এবং অপর দুজন বেকারিশ্রমিক। কিন্তু তঁাদের কোনো অপরাধের পূর্ব রেকর্ড থাকার তথ্য পুলিশ দাবি করেনি। দেখা যাচ্ছে, ঘটনাস্থল থেকে দুটি দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র ‘উদ্ধার’–এর সূত্রেই পুলিশ এজাহারে দুই দল সন্ত্রাসীর ‘স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়’ নিয়ে ‘গোলাগুলির ঘটনা’ ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করেছে।
গত সেপ্টেম্বরে তিন ব্যক্তির লাশ উদ্ধারের পর দেখা গিয়েছিল, পুলিশ সামান্য ইয়াবা পেয়েছিল। কিন্তু ওই তিন খুনের তদন্তে কোনো অগ্রগতি ঘটেনি। এ ধরনের রহস্যময় ও ঘন ঘন হত্যাকাণ্ড এবং তার কোনো নির্দিষ্ট কারণ জনগণকে অবহিত করতে না পারা সাধারণভাবে সমাজে আতঙ্ক ছড়ায়। এ ধরনের ঘটনা বন্ধ, ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর রহস্যভেদ ও খুনি চক্রকে বিচারের মুখোমুখি করা না গেলে এই আতঙ্ক দিনে দিনে বাড়তেই থাকবে। রাজধানীর তুরাগ থানার দিয়াবাড়ি এলাকায় গত শনিবার অজ্ঞাতপরিচয় আরও দুই যুবকের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধারের ঘটনারও পুলিশ কোনো কিনারা করতে পারেনি।
আমরা আশা করব,আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো উল্লিখিত তিনটি ঘটনায় তিন লাশ, চার লাশ ও দুই লাশের কিনারা করতে সক্ষম হবে।
- কার্টসি — প্রথম আলো/২৩ অক্টোবর ২০১৮
No comments:
Post a Comment