সম্পাদকীয়
পণ্য জাহাজীকরণ ও অর্থপ্রাপ্তির মধ্যে সামঞ্জস্য থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ দুইয়ের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে গরমিল চলতে থাকলে তা প্রশ্ন তৈরি করে বৈকি। বণিক বার্তায় গতকাল প্রকাশিত এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনের হিসাব অনুযায়ী, গত অর্থবছরই পণ্য জাহাজীকরণ ও অর্থপ্রাপ্তিতে গরমিল হয়েছে ৪ বিলিয়ন ডলারের। আর গত ছয় বছরে গরমিলের এ পরিমাণ ২০ বিলিয়ন বা ২ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। গরমিলের এ ধারা চলতে থাকা উদ্বেগজনক।
পণ্য জাহাজীকরণ ও অর্থপ্রাপ্তির মধ্যে ধারাবাহিক গরমিল বিভিন্ন প্রশ্ন উসকে দেয়। অনেকে এ গরমিলকে অনেক বেশি ও অবাস্তব বলে মনে করছেন। যে সংস্থাগুলো এ তথ্য সংগ্রহ করে, তারা কি হিসাবে ভুল করছে? এনবিআর তার অধীন সংস্থার মাধ্যমে রফতানি পণ্য জাহাজীকরণের তথ্য সংগ্রহ করে, যেটি পরিসংখ্যান আকারে প্রকাশ করে ইপিবি। অন্যদিকে জাহাজীকরণকৃত এসব পণ্য বাবদ দেশে অর্থ আসে ব্যাংকিং চ্যানেলে। সে তথ্য সংগ্রহ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাদের হিসাব আমলে নিয়েই এ পার্থক্য দেখা গেছে। এ সংস্থাগুলোর নিজেদের তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া নিয়ে পর্যালোচনা করা উচিত।
কোথাও কোনো সমস্যা কিংবা হালনাগাদের প্রয়োজন হলে দ্রুত সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। যতটা সম্ভব, এমন তথ্য সঠিক করার ওপর জোর দিতে হবে। এখন আমরা যদি ধরে নিই, এসব সংস্থার তথ্য সঠিক, তবে যে গরমিলের চিত্র সামনে থাকছে, তা নিয়ে অবশ্যই উদ্বিগ্ন হতে হয়। এ গরমিলের সঙ্গে বাইরে অর্থ পাচারের বিষয়টি অবধারিতভাবে চলে আসছে।
আমরা অবগত রয়েছি, দেশ থেকে প্রচুর অর্থ পাচার হয়, যা খোদ সরকারও স্বীকার করেছে। নির্বাচনী বছর হওয়ায় এ নিয়ে দুশ্চিন্তা আরো বেড়েছে। কারণ দেখা গেছে, বিগত নির্বাচনী বছরগুলোয় তুলনামূলক বেশি অর্থ পাচার হয়েছে। রফতানি ও আমদানিকারকদের বিষয়ে আরো তথ্য সংগ্রহের ওপর জোর দিতে হবে। কে কী পণ্য রফতানি-আমদানি করছে, তার ওপর কড়া নজরদারি চালাতে হবে। কোনো ধরনের অসামঞ্জস্য দেখা দিলে রফতানি-আমদানিকারকের জবাবদিহি দাবি করা উচিত।
পণ্য জাহাজীকরণ হওয়ার পর অর্থ না আসার ঘটনাগুলোর ওপর সবচেয়ে বেশি নজর দেয়া দরকার। কারণ এভাবে অর্থ পাচার হচ্ছে। দেশের একটি বড় প্রতিষ্ঠান এভাবে অর্থ পাচার করেছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চট্টগ্রাম বন্দরে চীনা প্রতিষ্ঠানের কাগজের বদলে কয়েক বস্তা বালি-মাটি পাঠানোর ঘটনা স্মরণে থাকার কথা। এর আগেও বিভিন্ন সময় যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির জন্য এলসি খোলা হলেও তা আসেনি।
এগুলোর বদলে এসেছে মাটি, বালি, পাথর ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, এভাবে অর্থ পাচার করা হয়। এমন ঘটনার রাশ টেনে ধরতে হবে। সদা সতর্ক থাকতে হবে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে। যারা অথবা যেসব প্রতিষ্ঠান এমন হীন কাজে জড়িত, তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে।
অর্থ পাচার একটি দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির পথে অন্যতম বড় বাধা। আবার বিভিন্ন কারণে পণ্য জাহাজীকরণ ও অর্থপ্রাপ্তির মধ্যে ব্যবধান তৈরি হতে পারে। এর মধ্যে ডিসকাউন্ট অন্যতম বড় কারণ। এসব বিষয়কেও নজরে রাখতে হবে। তবে এর মধ্যেও কিন্তু রয়েছে। ক্রেতা ও রফতানিকারক নিজেদের মধ্যে সমঝোতার যোগসাজশ করেন কিনা, তাও খতিয়ে দেয়া উচিত। যেসব প্রতিষ্ঠানের রফতানির সমপরিমাণ অর্থ আসেনি, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কঠোর হতে হবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অর্থ আনার বিষয়ে। আমদানি-রফতানির ওপর নজর রাখতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
গত ছয় বছরের মোট পার্থক্যের যে তথ্য রয়েছে, তা কোনোভাবেই ছোট সংখ্যা নয়। এনবিআর, রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরো, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে বিষয়টি তদন্তে তত্পর হওয়া উচিত।
- কার্টসিঃ বনিক বার্তা/ ২২ অক্টোবর ২০১৮
No comments:
Post a Comment