Search

Tuesday, October 23, 2018

নৈরাজ্যের সড়কে শৃঙ্খলা ফেরেনি

  • নিরাপদ সড়ক দিবস আজ
  • জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ১১ জনের প্রাণহানি
  • মামলা-জরিমানাতেই আটকে আছে শৃঙ্খলার উদ্যোগ


নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশজুড়ে ছাত্র আন্দোলনের পরও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরেনি। সড়কে চলাচল সংকেত ঠিক নেই। ফিটনেসবিহীন যানবাহনও চলছে। চালকের বেপরোয়া মনোভাব বন্ধ হয়নি। এর সঙ্গে দাবি আদায়ে বহাল আছে মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর কথায় কথায় মানুষকে জিম্মি করার পুরোনো কৌশল।

গত ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে দুই কলেজশিক্ষার্থী বাসচাপায় নিহত হওয়ার পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নামে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। সরকারি সংস্থাগুলো বলেছিল, শিশুদের এই আন্দোলন তাদের চোখ খুলে দিয়েছে। সড়কে চলমান বিশৃঙ্খলা আর অনিয়ম বন্ধে নেওয়া হয় নানা উদ্যোগ, ছিল নানা প্রতিশ্রুতিও। তবে চোখ খুলে দেওয়ার পরও সড়কে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর মিছিল থামেনি।

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলনের হিসাবে, গত জুলাই মাসে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে ২১৩ টি। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় ২৭৭ জন। আগস্ট মাসে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৬১, দুর্ঘটনা ছিল ৩০০ টি। আর সেপ্টেম্বর মাসে ২৮৬টি দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৩০৯ জন। প্রথম আলোর হিসাবে গত রোববারও ছয় জেলায় সাতজন মারা গেছে।

এই পরিস্থিতিতে আজ ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস পালিত হচ্ছে। দিবসটি উপলক্ষে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় শোভাযাত্রা ও সেমিনারের আয়োজন করেছে। সড়ক দুর্ঘটনায় নিসচার চেয়ারম্যান ও চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের স্ত্রীর মৃত্যুর তারিখটিকে সরকার ২০১৭ সালে নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে।

ইলিয়াস কাঞ্চন প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় চালক, পথচারী, মালিক ও প্রভাবশালী সবাই আইন মেনেছে। কারণ তারা তখন বিপদে ছিল। এখন বিপদে নেই। এ জন্য কেউ আইন মানছে না, কাজও করছে না। মালিক-শ্রমিকদের বেপরোয়া মনোভাবের বিষয়ে তিনি বলেন, মালিক-শ্রমিকেরা জানে তাদের যানবাহন ও চালকেরা ঠিক নেই। তারা আইন ভাঙবেই, মানুষ মারবেই। এ জন্য তারা আইনের বিরোধিতা করে। নিরাপদ সড়কের বিষয়ে সোচ্চার হলে তারা মাঠে নেমে যায়। এভাবে বিপদে পড়ে আইন মানার প্রবণতা থাকলে সড়ক নিরাপদ হবে না।

এরই মধ্যে মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো নিরাপদ সড়ক দিবসের অনুষ্ঠান বর্জন করার ঘোষণা দিয়েছে। প্রকাশ্যে তারা বলছে, তারিখটি তাদের পছন্দ নয়। কিন্তু মূল কারণ হলো, সম্প্রতি পাস হওয়া সড়ক পরিবহন। এই আইনটি তাদের মনঃপূত হয়নি। এ বিষয়ে শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা নিরাপদ সড়ক দিবসের কর্মসূচি বর্জন করেছেন। সড়ক আইনের শাস্তির কয়েকটি ধারা বাতিলের দাবিতে ২৭ অক্টোবর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ করবেন। সারা দেশে ২৮ ও ২৯ অক্টোবর শ্রমিকেরা কর্মবিরতি পালন করবেন।

আগস্টে এক সপ্তাহের মতো আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা সড়কে নেমে নিজেরাই চালকের লাইসেন্সসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যাচাই করে। এর সঙ্গে ছিল সড়কে শৃঙ্খলার জন্য নানা পদক্ষেপ। দেশে এই আন্দোলন জনপ্রিয়তা পায়। সড়ক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে ৩০ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়। এর আগে জুন মাসে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে দূরপাল্লার পথে বিকল্প চালক রাখা, মহাসড়কের পাশে চালকদের জন্য বিশ্রামাগার নির্মাণ, পথচারীদের জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার নিশ্চিত করাসহ পাঁচ দফা নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে সময়-সময় বৈঠক করে বাস্তবায়ন অগ্রগতি দেখার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু এই বিষয়ে আর কোনো বৈঠক হয়নি বলে জানা গেছে।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়নই বড় ঘটনা। এর বাইরে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও ঢাকা মহানগর পুলিশ বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এর বেশির ভাগই মামলা-জরিমানা, কিছু চালককে স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ প্রদান, প্রচারপত্র বিতরণে সীমাবদ্ধ। যেগুলোকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টোটকা, অস্থায়ী উদ্যোগ।

হইচই হলে তৎপর হয় সড়ক মন্ত্রণালয় 

সড়ক মন্ত্রণালয় ও বিআরটিএ সূত্র বলছে, সড়কে শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অন্তত ২০টি সরকারি প্রতিষ্ঠান আছে। সবারই বড় প্রকল্পের দিকে ঝোঁক বেশি। সড়ক নিরাপত্তা বা শৃঙ্খলার বিষয়টি আলাদাভাবে বিবেচনা করা হয় না। কোনো বড় দুর্ঘটনার পর হইচই হলে তড়িঘড়ি কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়।

গত ২৫ আগস্ট নাটোরে বাসের সঙ্গে লেগুনার মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৫ জন প্রাণ হারায়। এই ঘটনা তদন্তে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শফিকুল ইসলামকে প্রধান করে ১০ সদস্যের কমিটি করা হয়। এই কমিটির প্রতিবেদন বলছে, দুর্ঘটনাস্থলে মহাসড়কে কোনো সাইন-সংকেত ব্যবস্থা ছিল না। দুর্ঘটনাকবলিত লেগুনার চালকের লাইসেন্স ছিল না। আর লেগুনাটি তৈরি করা হয়েছে নিম্নমানের সরঞ্জাম দিয়ে। মহাসড়কে এটি চলাচলই নিষিদ্ধ।

বেহাল মহাসড়কের বিষয়টি পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের বক্তব্যেও উঠে এসেছে। গত ২৩ সেপ্টেম্বর শেরেবাংলা নগরের পরিকল্পনা কমিশনে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের এক সেমিনারে তিনি বলেছিলেন, ‘ঢাকা থেকে বের হলে আপনি বুঝবেন না, আপনি চট্টগ্রাম যাচ্ছেন, নাকি সিলেট যাচ্ছেন, নাকি আবার ঢাকা ফিরে আসছেন। সড়কে এ-সংক্রান্ত কোনো সিগন্যাল বা নির্দেশক নেই।’ ওই সেমিনারে সারা দেশের বেহাল সড়ক ও সড়ক নির্মাণে গলদের কথা উঠে আসে।

সওজের গত মে মাসের হিসাব অনুযায়ী, সারা দেশের বেহাল সড়ক ৪ হাজার ৭৩১ কিলোমিটার, যা মোট সড়ক ও মহাসড়কের ৪ ভাগের ১ ভাগের বেশি। অথচ সওজের সড়কগুলোর মেরামত রক্ষণাবেক্ষণসহ বিভিন্ন খাতে গত ৯ বছরে (২০০৯ সালের জুন থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত) ১১ হাজার ৯৪ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে নতুন সড়ক ও মহাসড়ক নির্মাণ ও উন্নয়নে খরচ হয়েছে আরও ৪৬ হাজার ৪৩২ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে খরচ ৫৭ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা।

বিআরটিএর তথ্য অনুসারে, বর্তমানে সারা দেশে যানবাহন আছে ৩৫ লাখ ৪২ হাজার। মোটরযান আইন অনুযায়ী চাকা, ইঞ্জিনক্ষমতা ও ধরন বিবেচনায় নিয়ে ৪০ ধরনের যানের নিবন্ধন দেয় বিআরটিএ। এর মধ্যে মোটরসাইকেলের ফিটনেস সনদ দরকার হয় না। কারসহ অবাণিজ্যিক যানবাহনের ক্ষেত্রে তৈরির সাল থেকে পরবর্তী পাঁচ বছরের ফিটনেস সনদ একসঙ্গেই দেওয়া হয়। বাস, ট্রাকসহ যানবাহনের ফিটনেস সনদ নিতে হয় প্রতিবছর। 

সারা দেশে মোটরসাইকেল আছে ২২ লাখ ৪০ হাজার। বিআরটিএর কর্মকর্তারা বলছেন, ১০ শতাংশ গাড়ি নতুন। ফলে কমবেশি পৌনে ১২ লাখ যানবাহনের প্রতিবছরই ফিটনেস সনদের প্রয়োজন হয়। গত ১ আগস্ট পর্যন্ত ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৯৯ হাজার। নিরাপদ সড়কের আন্দোলন শুরু হলে কিছুদিন ফিটনেস সনদ নেওয়ার হিড়িক পড়ে। এখন আর সেই অবস্থা নেই বলে বিআরটিএর কয়েকজন জানিয়েছেন।

বিআরটিএর হিসাবে, বর্তমানে দেশে যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ৩৫ লাখ। আর লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা প্রায় ১৯ লাখ। অর্থাৎ প্রায় ১৬ লাখ যানবাহন চলছে ভুয়া চালক দিয়ে। অবশ্য কিছু কিছু চালকের একাধিক শ্রেণির লাইসেন্স রয়েছে। এটা হিসাবে ধরলে লাইসেন্স আছে ২৬ লাখের কিছু বেশি।

মালিক-শ্রমিকেরাই মূল নিয়ন্ত্রক

পরিবহন খাতের শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণকারী সমিতি হচ্ছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। এই সংগঠনের কার্যকরী সভাপতি নৌমন্ত্রী শাজাহান খান। তাঁর পরিবারের বাসের ব্যবসা রয়েছে। আর মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান। সমিতির মহাসচিব ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোন্দকার এনায়েত উল্লাহ।

মালিক-শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় এই দুই সংগঠনের ঐক্য পরিষদ রয়েছে। যার নেতৃত্বেও শাজাহান খান, মসিউর রহমান ও খোন্দকার এনায়েত উল্লাহ। পরিবহন খাতের কোনো সিদ্ধান্ত মালিক-শ্রমিকদের বিরুদ্ধে গেলেই তাঁরা ধর্মঘট ডাকেন, যাত্রীদের জিম্মি করেন।

গত ১৫ সেপ্টেম্বর রাজশাহীর কাশিয়াডাঙ্গা এলাকায় একটি ট্রাক দোকানের ভেতর চলে গেলে অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্র নিহত হয়। এই ঘটনায় করা মামলায় ট্রাকচালক, চালকের সহকারী ও ট্রাকের মালিককে কারাগারে পাঠান আদালত। এর প্রতিবাদে ১ অক্টোবর রাজশাহী নগরের সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করে ৩ ঘণ্টা অচল করে দেন পরিবহনের শ্রমিকেরা। এক সপ্তাহ না যেতেই আবারও মাঠে নামে মালিক-শ্রমিকেরা। সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের দাবিতে তারা কর্মবিরতি যান। দুই দিন পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর কর্মসূচি স্থগিত করা হয়।

সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষক কাজী সাইফুন নেওয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্র আন্দোলনের পর সড়ক পরিবহন আইনটি হওয়া একটা অর্জন। কিন্তু গণপরিবহনের মালিকানা, চলাচলের ব্যবস্থায় গলদ আছে। পথচারীরাও সচেতন নন। সব মিলিয়ে একটা বিশৃঙ্খল অবস্থা। এটা এক সপ্তাহ বা এক মাসের পরিকল্পনা-কর্মসূচি দিয়ে ঠিক হবে না। লাগাতার চেষ্টা ও উদ্যোগ জরুরি।

  • কার্টসি —  প্রথম আলো/২৩ অক্টোবর ২০১৮

No comments:

Post a Comment