Search

Sunday, October 28, 2018

ঢাকা ফোরামের গোলটেবিল বৈঠক

‘সংসদ রেখে নির্বাচন স্বেচ্ছাচারের বহিঃপ্রকাশ’

স্টাফ রিপোর্টার


সংসদ ভেঙে দিয়ে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে আলোচনা ও সমঝোতার ভিত্তিতে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়েছে নাগরিক সংগঠন দি ঢাকা ফোরাম। গতকাল রাজধানীতে এক গোলটেবিল বৈঠকে ফোরামের নেতৃবৃন্দ বলেন, গণতান্ত্রিক বিশ্বে বিশেষত পশ্চিমা দেশসমূহে পূর্বতন সংসদ বজায় রেখে ওই সব সংসদ সদস্য দিয়েই নির্বাচন করার কোনো নজির নেই। এটি একধরনের স্বেচ্ছাচারের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। গোলটেবিল বৈঠকে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে সংবিধান কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতার ব্যবহার করতে দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। তাই সকলের প্রত্যাশা প্রধান রাজনৈতিক দলের উচিত আলোচনা ও সমঝোতার ভিত্তিতে এগিয়ে যাওয়া। তা না হলে জাতি গভীর অন্ধকারে নিপতিত হতে পারে। যা মুক্তিযুদ্ধের মহান শহীদদের রক্তের প্রতি অবমাননা করা হবে। ‘আসন্ন জাতীয় নির্বাচন শীর্ষক’ ওই গোলটেবিল বৈঠকে সাবেক আমলা, কূটনীতিক, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।




বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও ঢাকা ফোরামের চেয়ারম্যান ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সঞ্চালনায় গোলটেবিল  বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত এম সিরাজুল ইসলাম। মূল প্রবন্ধে বলা হয়, একাদশ  জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ বর্তমানে একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে।


সমগ্র জাতি ২০১৪ সালের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তির আশঙ্কায় উৎকণ্ঠিত। গণমানুষের এ আশঙ্কা বাস্তবে রূপ নিলে তা হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি। প্রবন্ধে আরো বলা হয়, বর্তমান সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বহাল রেখেই নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার বিষয়ে অনড়। অর্থাৎ দলীয় নেত্রীকে নির্বাচনকালীন সরকার প্রধান হিসেবে বহাল রাখতে তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সরকারি দল ইতিমধ্যে এই লক্ষ্যে পুলিশ ও জনপ্রশাসন বিভাগের রাজনীতিকরণ সম্পন্ন করেছে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার্থে। যদি এটি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে এমন আশঙ্কা অমূলক নয় যে গায়েবি, মিথ্যা মামলা, গুম আর অপহরণের মতো বিষয়গুলো আরো প্রকটতর হবে। দুটি বিষয় ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে বাংলাদেশের জনগণকে আশান্বিত করেছে বলে প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে প্রথমটি হলো- অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কিছু পরিবর্তন। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ভারতসহ অন্যান্য দেশ ও সংস্থাসমূহের দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন। দেশজ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে অনুসৃত বিরোধী বৃত্তের বাইরে তৃতীয় একটি শক্তির উত্থান হয়েছে।
এই শক্তিটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার জন্য কাজ করেছে। এই মোর্চাটি আওয়ামী লীগের ২০০৯ ও ২০১৪ নির্বাচনে প্রত্যক্ষ করেছে কীভাবে সরকারি প্রশাসনকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করেছে যা মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি। বাংলাদেশ ইস্যুতে বহির্বিশ্বের অবস্থান বদলেছে দাবি করে প্রবন্ধে বলা হয়, অতীতে আওয়ামী লীগের দেয়া যুক্তি বিএনপি-জামায়াতকে ভোট দেয়া মানে ‘তথাকথিত’ ইসলামী সন্ত্রাসকে উস্কে দেয়া যা আন্তর্জাতিক বিশ্ব অনেকটা মেনে নিয়েছিল। কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি আজ নেই। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাম্প্রতিক সফরে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চান। বাংলাদেশে প্রাক্তন ভারতীয় হাইকমিশনার ও অন্যান্য কিছু সাংবাদিক ও কূটনীতিক একই মত ব্যক্ত করে গেছেন। বর্তমান হাইকমিশনারও একাধিকবার একই মনোভাব ব্যক্ত করেছেন।
বৈঠকে নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ নেই উল্লেখ করে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, তফসিলের পর ৪৫ দিনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড অসম্ভব। একটি রাজনৈতিক দল দুই বছর থেকে ভোট চেয়ে জনসভা করে বেড়াচ্ছে। আরেকটি দলকে জনসভার অনুমতিই দেয়া হচ্ছে না। ইসি’র উচিত ছিল ভোটের অন্তত ৯০ দিন আগে তফসিল ঘোষণা করা। সিইসি’র দেয়া প্রতিশ্রুতির উল্লেখ করে আলী ইমাম মজুমদার বলেন, সিইসি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ৫ই জানুয়ারির মতো আর কোনো নির্বাচন হবে না। ১৯৯৬ সালে সিইসি’র দলীয় ও নির্দলীয় দুই রকম সরকারের অধীনে নির্বাচন করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য ইসিকে তাই প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, সুশীল সমাজের কাজ হচ্ছে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা। সেই সুশীল সমাজও বিভক্ত হয়ে গেছে। মামলা, মোকদ্দমা, গুম, খুনের কারণে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে দেশে।


এই পরিবেশ অব্যাহত থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। পাশাপাশি নির্বাচন উপলক্ষে সরকার যেভাবে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করছে তাও অনৈতিক। এসব প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা আদৌ আছে কিনা তা যাচাই করা দরকার। বর্তমান ইসি সন্দেহজনক কার্যকলাপ করছে অভিযোগ করে সাবেক এই মহা হিসাবনিরীক্ষক বলেন, ইভিএম প্রকল্প পাসের আগে ইসি তা কেনার জন্য এলসি খুলেছে। ইসির তো আরো গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল। সেসব বাদ দিয়ে তারা ইভিএমের পেছনে লেগে আছে। মুখে বক্তৃতা দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। সংসদ ভেঙে নির্বাচন সংবিধানেই আছে উল্লেখ করে এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, সংসদ ভেঙে নির্বাচন দিলে বেআইনি কিছু হবে না। এমপিরা অলিখিতভাবে অনেক প্রভাবশালী। সংসদ রেখে নির্বাচন করলে নানা সমস্যা দেখা দেবে।


বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ সমাপনী বক্তব্যে বলেন, একাত্তর সালের মতো বাংলাদেশ একটি মৌলিক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। গতানুগতিক নির্বাচন করে কেউ যদি তিন চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেয় সমস্যার সূত্রপাত হবে সেই সময় থেকে। আমরা স্বল্প সময়ে কিছু করতে পারবো না। তিনি বলেন, এবার সমস্যাকে কার্পেটের নিচে ঠেলে দেয়া যাবে না। যারা ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র তারা জানে এটা বিস্ফোরণ করে। তাই যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা পালন করা দরকার। গতানুগতিক একটা নির্বাচন হলেই হবে না- সেই উদ্বেগ আমরা প্রকাশ করছি। এখানে কিছু করার থাকলে করতে হবে, না হলে দেশের সর্বনাশ হয়ে যাবে।


রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী বলেন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও সুষ্ঠু নির্বাচনের শর্ত। কিন্তু সেই সংবাদপত্রকে ভয়ভীতি দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হচ্ছে। দেশের বিচার বিভাগের কী অবস্থা তা সাবেক প্রধান বিচারপতির বক্তব্যে বোঝা যায়। এই পরিবেশে কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না বলে মন্তব্য করেন তিনি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষক আরো বলেন, দেশে সাংঘাতিক সংকটময় পরিবেশ বিরাজ করছে। এখানে সুশীল সমাজও আপস করে চলছে। সরকার যেভাবে দমন নীতি গ্রহণ করেছে তাতে করে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নেই। এ জন্য সংসদ ভেঙে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানান তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, সত্যিকার ভোটে নির্বাচিত সরকারের কর্মকাণ্ড ভালো হয়। ভুয়া ভোটে নির্বাচিত সরকারের কাজ ভালো হয় না। যে সরকার প্রশাসন, পুলিশের মাধ্যমে ভোটে জিতে তারা জনগণকে খুশি করার বদলে পুলিশ ও প্রশাসনকেই খুশি করে। আর জনসমর্থন না থাকায় তারা জনগণের প্রতি প্রতিশোধ নিতে চায়।


ড. আসিফ নজরুল আরো বলেন, সরকারের ক্ষমতা হারানোর ভীতি থাকলে দুঃশাসন কম হয়। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিল বলে ভালোভাবে শাসন করেছে। কিন্তু ২০১৪ সালের পরবর্তী পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। এই আমলে জনগণকে প্রতিবাদ পর্যন্ত করতে দেয়া হয়নি। বিরোধী দলকে সরকার নানাভাবে দমন করছে উল্লেখ করে আসিফ নজরুল বলেন, গায়েবি মামলা ও গ্রেপ্তার আতঙ্কের কারণে বিরোধী নেতাকর্মীরা মাঠে নামতে পারছে না। তাদের জনসভা করতে দেয়া হচ্ছে না। সাধারণ মানুষকে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। নির্বাচন যতই সামনে আসে সরকার ততই দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। জামিনযোগ্য অপরাধে মামলার পরও ব্যারিস্টার মইনুলকে জামিন দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেন তিনি। গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়ে ইউএসএইড বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও সুশাসন বিষয়ক ডেপুটি অফিস ডিরেক্টর স্লেভিকা রডোসেভিক বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সুশীল সমাজ একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাদের এই আলোচনা ও সংলাপ অব্যাহত থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।


বৈঠকে সাবেক রাষ্ট্রদূত এফ এ শামীম আহমেদ, মাহমুদুর রেজা চৌধুরী, ইফতেখারুল করিম, মাসুদ আজিজ, শাহেদ আখতার, পানি বিশেষজ্ঞ ম. ইনামুল হক, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুজাহেরুল হক, জাতীয় পার্টির এমপি ফখরুল ইমাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
Courtesy: Manabziban Oct 28, 2018
 

No comments:

Post a Comment