সম্পাদকীয়
ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ ও সুশাসন নিশ্চিত হোক
যে দেশের অর্থনীতি যত উন্নত হয়, সে দেশে নগদ লেনদেনের পরিমাণ তত কমে বলে গবেষকরা দাবি করেন। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিষয়টি ব্যতিক্রম বলা চলে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংকের তালিকায় নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ। জাতিসংঘের উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধিও ঈর্ষণীয় পর্যায়ে রয়েছে। দেশজ উৎপাদন, মাথাপিছু আয়— সব অর্থনৈতিক সূচকে ইতিবাচক অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে নগদ অর্থনীতির আকার। বৈশ্বিক প্রবণতা অনুযায়ী বাংলাদেশের জিডিপির বিপরীতে নগদ অর্থনীতির আকার ছোট হয়ে আসার কথা। ব্যাংকিং ও প্রযুক্তির সম্প্রসারণে বাংলাদেশের মানুষের আর্থিক লেনদেন আরো কাঠামোবদ্ধ হওয়া উচিত। কিন্তু তা হয়নি। অর্থনীতির আকারের সমান্তরালে আর্থিক অবকাঠামোয় উন্নতি না হওয়াকে এজন্য দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হতে পারে ছায়া অর্থনীতি। রাজস্ব ফাঁকি দেয়া বা অবৈধ উপার্জন লুকানোর জন্য আনুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে লেনদেনকে পাশ কাটিয়ে নগদ লেনদেন করেন অনেকে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতির বিস্তার ও সুশাসনের অভাব দেখা দিলে ছায়া অর্থনীতির আকারও বড় হয়।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তেমনটিই ঘটেছে বলে মনে করছেন অনেকে। দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশ এখনো নিচের সারিতে। এখানে ব্যবসা করতে গেলে বড় অংকের ঘুষ দিতে হয়। ঘুষ-দুর্নীতির ব্যাপকতা দেশে নগদ অর্থের চাহিদা বাড়াচ্ছে। এক দশক আগেও দেশের নগদ অর্থনীতির আকার ছিল জিডিপির ৮ শতাংশের মতো। এখন তা পৌঁছেছে ১২ শতাংশের কাছাকাছি। এক্ষেত্রে নগদ অর্থনীতির অধিক বিস্তার পরিলক্ষিত হলে অন্যান্য সূচকের সঙ্গে এর সম্পর্ক অনুসন্ধান জরুরি। সমসাময়িক বিভিন্ন আর্থিক অপরাধের প্রবণতার সঙ্গেও বিষয়টিকে মিলিয়ে দেখতে হবে। আমরা চাইব সরকার বিষয়টি বিশ্লেষণের জন্য বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেবে এবং নগদ বা ছায়া অর্থনীতির রাশ টেনে ধরতে দুর্নীতি কমিয়ে সুশাসন নিশ্চিত করবে। নগদ অর্থনীতির একটি বড় অংশ বাইরে পাচার হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। এর সত্যতা মেলে অর্থ পাচারের তথ্যে। দেশে নগদ অর্থনীতির আকার যত বড় হয়েছে, অর্থ পাচার ততই বেড়েছে। ২০০৬ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত ছায়া অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বিবেচনায় বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও পাকিস্তানের উপরে। তথ্যপ্রযুক্তি ও আর্থিক কাঠামো শক্তিশালী হওয়ায় বিশ্বব্যাপী নগদ লেনদেনের প্রবণতা কমেছে। বাংলাদেশে এর বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে। দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের টাকাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে নগদ লেনদেন হয়। কর ফাঁকি দিতে ধনীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে না গিয়ে অনানুষ্ঠানিক লেনদেন করেন বেশি।
দুর্নীতিমুক্ত ও টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে নগদ লেনদেনের চেয়ে আনুষ্ঠানিক লেনদেননির্ভর হওয়ার বিকল্প নেই। যখন কোনো অর্থনীতি নগদ মুদ্রার ওপর নির্ভরশীল হয়, তখন তার অভিশাপও অর্থনীতিকে ভোগায়। রাজস্ব আহরণ ও অর্থ পাচার বন্ধে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বৈষম্য বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণও নগদ লেনদেন। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে লেনদেন হলে সরকার সহজেই রাজস্ব আহরণ করতে পারত। নগদ অর্থনীতির পরিমাণ কমিয়ে আনতে ভারত সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যাংকিং খাতে লেনদেন বাড়াতে বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে। দুর্নীতি ও কালো টাকা ঠেকাতে বাতিল করা হয়েছে ৫০০ ও ১ হাজার রুপির নোট। উদ্দেশ্য ছিল নগদবিহীন সমাজে পরিবর্তন করা। বাংলাদেশের ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়লেও মানুষের দোরগোড়ায় এ সেবা নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। নানা ফি ও চার্জের কারণে সাধারণ মানুষ বিমুখ এ খাত ব্যবহারে। ব্যাংক থেকে অর্থ লুটপাট, খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধিসহ কয়েকটি ব্যাংক মূলধন সংকটে পড়ায় মানুষের মধ্যে শঙ্কা বেড়েছে আনুষ্ঠানিক খাত সম্পর্কে। এসব কারণে মানুষের মধ্যে নগদ লেনদেনে উৎসাহ বেশি। এক্ষেত্রে দুর্নীতি কমিয়ে আনতে হলে নগদবিহীন সমাজের পথে যেতে হবে সরকারকে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া এটি যে সম্ভব নয়, তা এরই মধ্যে প্রমাণিত। সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে বটে, তবে তার ফল আশানুরূপ নয়। নগদবিহীন লেনদেন বাড়াতে হলে এ ব্যাপারে উৎসাহ সৃষ্টি করতে হবে। তবে মূল প্রশ্নটি হচ্ছে সুশাসন নিশ্চিত করা। এটি হলে দুর্নীতি কমবে। আর দুর্নীতি কমলে নগদমুক্ত অর্থনীতিতে রূপান্তরের প্রক্রিয়া আরো সহজ হবে।
- Courtesy: Banikbarta /Oct 30, 2018
No comments:
Post a Comment