সম্পাদকীয়
আমাদের সরকারগুলো ৪৭ বছর ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির কাজ শেষ করতে পারছে না। একটা করে সরকার আসে আর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা পরিবর্তন করা হয়; সংযোজন-বিয়োজন শেষে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়ে গেছে। এভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা পরিবর্তন করা হয়েছে ছয়বার। মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা, স্বীকৃত বয়স ও মানদণ্ড পরিবর্তন করা হয়েছে ১১ বার। যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জনকারী জাতির জন্য এটা দুর্ভাগ্যজনক।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অতীতে দুই মেয়াদে ৯ বছর এবং বর্তমানে টানা প্রায় ১০ বছর ধরে সরকার পরিচালনা করছে, কিন্তু তারাও মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে যে ন্যক্কারজনক ঘটনাটি ঘটেছে, তা হলো পাঁচজন সচিব ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থার প্রধান প্রকৌশলীসহ প্রশাসনের কতিপয় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মুক্তিযোদ্ধা সাজার উদ্দেশ্যে ভুয়া সনদ নিয়েছেন এবং সনদগুলো ভুয়া প্রমাণিত হওয়ার পরও সরকার তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত পদক্ষেপ নেয়নি। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী শহীদদের জন্য চরম অবমাননাকর এই অনৈতিক কাজের প্রতি সরকারের নির্বিকার উদাসীনতা এককথায় মর্মান্তিক।
শনিবার প্রথম আলোর প্রথম পাতায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর বরাত দিয়ে লেখা হয়েছে, বিগত বিএনপি সরকারের আমলে প্রায় ২২ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা গেজেটভুক্ত হয়েছেন। মন্ত্রী বলেছেন, তাঁর আমলে আট হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার গেজেট বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু প্রথম আলোর প্রতিবেদক দুই সপ্তাহ ধরে অনুসন্ধান চালিয়েও আট হাজার মুক্তিযোদ্ধার গেজেট বাতিল করার কোনো প্রমাণ উদ্ধার করতে পারেননি। এখানে কিছু আইনি জটিলতা আছে, অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা গেজেট বাতিল হওয়ার পর আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন, ফলে বিষয়টি অনিষ্পন্ন রয়ে গেছে।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও সাড়ে ১১ হাজার মুক্তিযোদ্ধা গেজেটভুক্ত হয়েছেন। প্রশ্ন হলো, মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার এত বছর পর যাঁরা মুক্তিযোদ্ধার সনদ পেলেন, তাঁরা কি প্রকৃতই মুক্তিযোদ্ধা? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় সরকারের মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়াটির হাঁড়ির খবর নিলে। বর্তমান সরকার যাচাই-বাছাই করে পাঁচ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। গত বছর জানুয়ারি মাসে এই উদ্যোগ শুরু হয়: দেড় লাখ লোক মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য আবেদন করেন। কিন্তু যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন থেকে শুরু করে পুরো প্রক্রিয়ায় ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠলে সরকার নতুন তালিকা তৈরির সিদ্ধান্তটি স্থগিত করে দেয়। এ থেকে বলা যায়, এই সরকারের আমলেই যে সাড়ে ১১ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে গেজেটভুক্ত করা হয়েছে, তাঁদের অধিকাংশই ভুয়া।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, বর্তমানে মোট ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা প্রায় ৩৩ হাজার। কিন্তু তাঁদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি বলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন। তিনি এ কথাও বলেছেন যে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন জেলা কমিটি থেকে পাঠানো মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় ভুয়াদের উপস্থিতি বেশি। এটা থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায়, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির প্রক্রিয়াটিতে গুরুতর গলদ রয়েছে। দলীয় কমিটিগুলোকে এর সঙ্গে যুক্ত করা উচিত নয়। আরও উচিত নয় এই প্রক্রিয়ায় চলমান দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতিসহ সব ধরনের অনৈতিক চর্চাকে প্রশ্রয় দেওয়া। মুক্তিযোদ্ধা নন, কিন্তু ভুয়া সনদ ও সুবিধাদি নিয়েছেন, এমন ব্যক্তিদের শনাক্ত করে আইনানুগ শাস্তি দিতে হবে।
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি নিয়ে এই লজ্জাজনক অব্যবস্থাপনার অবসান ঘটাতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রতি আন্তরিক দায়বদ্ধতা থেকে পরিপূর্ণ সততার সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাছাই সম্পন্ন করে একটা সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি ও প্রকাশ করার উদ্যোগ নেওয়া হোক, যা হবে চূড়ান্ত, যাতে আর কোনো সংযোজন-বিয়োজনের প্রয়োজন থাকবে না।
- কার্টসিঃ প্রথম আলো/ ২ অক্টোবর ২০১৮
- লিঙ্ক — https://goo.gl/kFmhMD
No comments:
Post a Comment