সাইফ সুজন
দেশে প্রথম সারির কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো এখনো ভালোভাবে গড়ে ওঠেনি। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো অবকাঠামো থাকলেও শিক্ষার্থীর তুলনায় পর্যাপ্ত নয়। এর মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে চলেছে টিউশন ফি। এতেই ফুলেফেঁপে উঠছে তাদের আয়।
দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়-ব্যয়, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রতি বছর প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। সর্বশেষ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে গত সপ্তাহে।
তাতে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে শিক্ষা কার্যক্রমে থাকা ৯০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মিলিত আয় ছিল ৩ হাজার ২০১ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে শিক্ষা কার্যক্রমে ৮৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মিলিত আয় ছিল যেখানে ২ হাজার ৯৩০ কোটি ৬২ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। এ হিসাবে এক বছরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় বেড়েছে প্রায় ২৭১ কোটি টাকা।
ইউজিসি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আয়ের এ তথ্য দিয়েছে কমিশনে পাঠানো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হিসাবের ভিত্তিতে। যদিও প্রকৃত আয় গোপন করার অভিযোগ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে। তাই প্রকৃত আয় হিসাবে নিলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আয় আরো বাড়বে বলে মনে করছেন ইউজিসির কর্মকর্তারা।
সর্বোচ্চ আয়কারী বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবার উপরে আছে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টি ২২৯ কোটি টাকার মতো আয় করলেও ২০১৭ সালে তা বেড়ে হয়েছে ২৬৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরেই বিশ্ববিদ্যালয়টির আয় বেড়েছে ৩৩ কোটি টাকা। বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়ের সর্বোচ্চ বৃদ্ধিও এটাই।
১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ২০১৭ সালে শিক্ষার্থী ছিল ২০ হাজার ২৫ জন। এর মধ্যে স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ১৭ হাজার ৫১৭ ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ২ হাজার ৫০৮ জন। এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা, দরিদ্র ও মেধাবী কোটায় পড়ালেখা করছে ১ হাজার ১৬৮ জন। বাকি ১৮ হাজার ৮৫৭ জন শিক্ষার্থীকে অর্থ দিয়ে পড়তে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, স্নাতক কোর্স সম্পন্নে কম টিউশন ফি যে বিভাগগুলোয়, তার একটি ইংরেজি। বিভাগটিতে স্নাতক কোর্স সম্পন্নে একজন শিক্ষার্থীকে টিউশন ফি বাবদ খরচ করতে হয় ৮ লাখ ২৯ হাজার টাকা। এ হিসাবে ইংরেজি বিভাগের একজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে টিউশন ফি বাবদ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বছরে পায় ২ লাখ টাকার বেশি। এটি হিসাবে নিলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টির আয় হওয়ার কথা বছরে ৩৮০ কোটি টাকার মতো।
আয়ের প্রকৃত তথ্যই তারা ইউজিসিকে দেন বলে দাবি করেন বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক আতিকুল ইসলাম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধির কারণেই আমাদের আয় বাড়ছে। আয়ের পাশাপাশি আমাদের ব্যয়ের পরিমাণও কম নয়। শিক্ষকদের আকর্ষণীয় বেতন-ভাতা, গবেষণা বৃত্তি প্রদান, শিক্ষার্থীদের মেধা বৃত্তিসহ বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। পর্যাপ্ত অবকাঠামো গড়ে তোলার পেছনেও আয়ের বড় একটি অংশ ব্যয় হয়। সব মিলিয়ে উচ্চশিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিতে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা রয়েছে।
গত বছর আয়ে বড় ধরনের উল্লম্ফন হয়েছে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউবিটি)। ২০১৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টির আয় ছিল মোট ৬৮ কোটি ১৮ লাখ টাকা। ২০১৭ সালে এসে আয়ের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০১ কোটি টাকায়। এ হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে বিইউবিটির আয় বেড়েছে ৩২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ৮ হাজার ৫৪৩ জন শিক্ষার্থী। আর শিক্ষা কার্যক্রমে আছে ২০০৩ সাল থেকে।
২০১৬ সালের তুলনায় গত বছর ২৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা বেশি আয় করেছে বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (আইইউবি)। ২০১৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টি আয় করেছে মোট ১৩৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। ২০১৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টির আয় ছিল যেখানে ১১৩ কোটি ৪২ লাখ টাকা।
উচ্চ আয় করেছে বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ও। ইউজিসির হিসাবমতে, গত বছর বিশ্ববিদ্যালয়টির আয় হয়েছে সব মিলিয়ে প্রায় ১৬৫ কোটি টাকা। যদিও ২০১৬ সালে ১৪৬ কোটি ৬২ লাখ টাকা আয় করেছিল ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির আয় বেড়েছে ১৮ কোটি ১৯ লাখ টাকা।
দেশের বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ২০১৭ সালে শিক্ষার্থী ছিল ৮ হাজার ৩০৩ জন। যদিও এর আগের বছর ৭ হাজার ৪০৩ জন শিক্ষার্থী ছিল বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী বেড়েছে ৯০০ জন।
শিক্ষার্থী ও আয় বাড়লেও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে উচ্চশিক্ষার মৌলিক খাতগুলোতে ব্যয়ের পরিমাণ কমেছে। ২০১৬ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা খাতে ৪৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকা ব্যয় করলেও ২০১৭ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৩৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকায়।
ব্র্যাকের পর আয় বৃদ্ধিতে এগিয়ে আছে বেসরকারি ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৪৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা আয় করলেও ২০১৭ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১৫৭ কোটি ২২ লাখ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ইস্ট ওয়েস্টের আয় বেড়েছে ১৩ কোটি ৯৭ লাখ টাকা।
শীর্ষ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশও (এআইইউবি) গত বছর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আয় করেছে। ইউজিসিতে পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টির আয়ের পরিমাণ ২১৮ কোটি টাকা। প্রথম সারির অন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ইউআইইউ) ১০৫ কোটি, আহছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ৯৫ কোটি ও ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস (ইউল্যাব) ৭৪ কোটি টাকা আয় করেছে।
যদিও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রকৃত আয় এর চেয়ে বেশি বলে জানান ইউজিসির কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করে ইউজিসির এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থী সংখ্যা ও আয়ের যে বিবরণী ইউজিসিতে পাঠায়, তার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অসাধুতা রয়েছে। আসনের অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তির অভিযোগ রয়েছে শীর্ষস্থানীয় অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে। এছাড়া টিউশন ফির বাইরে নামে-বেনামে বিভিন্ন ফি আদায় করে তারা। ইউজিসিতে যে হিসাব পাঠানো হয়, তাও প্রশ্নবিদ্ধ। নিরীক্ষিত প্রতিবেদন পাঠানোর কথা থাকলেও অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ই তা মানছে না।
এদিকে আয় বাড়লেও দেশের অধিকাংশ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই গবেষণা, গ্রন্থাগার ও ল্যাবরেটরির মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোয় ব্যয়ের পরিমাণ কমছে। যদিও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে গবেষণা, গ্রন্থাগার ও ল্যাবরেটরির মতো উচ্চশিক্ষার মৌলিক খাতগুলোতে বার্ষিক বাজেটের একটি নির্দিষ্ট অংশ ব্যয় করতে বলা হয়েছে। ইউজিসির সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গবেষণা, গ্রন্থাগার ও ল্যাবরেটরি খাতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যয়ের পরিমাণ কমে যাচ্ছে।
ইউজিসির সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সালে গবেষণা খাতে অর্থ ব্যয় করেছে দেশের ৭৩টি বিশ্ববিদ্যালয়। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট গবেষণা ব্যয়ের পরিমাণ ৭৮ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। সে হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়প্রতি গড়ে ব্যয়ের পরিমাণ ১ কোটি ৮ লাখ টাকা। যদিও ২০১৬ সালে ৬৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাতে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৯৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানপ্রতি গড় ব্যয় ছিল ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। সে হিসাবে বছরপ্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়লেও গবেষণা খাতে ব্যয়ের পরিমাণ কমছে। একইভাবে ব্যয় কমেছে গ্রন্থাগার ও ল্যাবরেটরি খাতে। ২০১৭ সালে ৭৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি খাতে মোট ব্যয় হয় ৪৫ কোটি ৬ লাখ টাকা। যদিও ২০১৬ সালে এ ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৫৭ কোটি ২৮ লাখ টাকা।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বণিক বার্তাকে বলেন, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি কাজ। এগুলো হলো গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞান সৃষ্টি, জ্ঞান ধারণ ও জ্ঞান বিতরণ। এ তিনটি কাজ যে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেই, পাবলিক কিংবা প্রাইভেট হোক, তাকে বিশ্ববিদ্যালয় বলা যাবে না। যদিও দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশের অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই গবেষণার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষকদের যন্ত্রের মতো ব্যবহার করে। এমন বিশ্ববিদ্যালয়ও আছে, যেখানে একজন লেকচারারকে দিয়ে ছয়টি ক্লাস নেয়া হয়। তাহলে শিক্ষকরা গবেষণার সুযোগ পাবেন কীভাবে?
- Courtesy: Banikbarta /Oct 30, 2018
No comments:
Post a Comment