Search

Wednesday, December 30, 2020

২০১৮ সালের ‘নির্বাচন’

— আলী রিয়াজ 


ডিসেম্বর ৩০, ২০১৮ এ অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রচারণার সময়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা বিএনপি'র প্রার্থী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনকে গুলি করে।  

একাদশ জাতীয় সংসদের ‘নির্বাচনের’ দ্বিতীয় বার্ষিকী উপলক্ষে ৩০ ডিসেম্বর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ পালন করবে এবং বিএনপি এই দিনটিকে বলছে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’। বাংলাদেশের গণতন্ত্র রক্ষা এবং হত্যা দিবস পালনের এই ঘটনা নতুন নয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত এক-দলীয় নির্বাচনের বার্ষিকীকেও এইভাবেই এই দুই দল চিহ্নিত করেছিলো। সম্ভবত ২০১৭ সালের পরে আর এইভাবে কোনও পক্ষই আর এই দিন নিয়ে উৎসাহ দেখায়নি। এর আগে ১৯৯১ সাল থেকে কয়েক বছর ৬ ডিসেম্বরকে ‘গণতন্ত্র দিবস’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছিলো – ১৯৯০ সালে গনআন্দোলনের মুখে জেনারেল এরশাদের সরকারের পতনের দিনটি এক সময় ঘটা করে পালিত হতো, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পরে মন্ত্রিসভা গঠন এবং ১৯৯৯ সালে বিরোধী জোট গঠনের পরে এই দিন পালনে উৎসাহেরই কেবল অবসান হয়েছে তা নয়, দিনটি রাজনীতিবিদদের জন্যে এক ধরণের অস্বস্তির দিন বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। ২০২০ সালে এসে এই দিন যে কোনও রকম ভাবেই পালিত হয়নি সেই বিষয় ডেইলী স্টার সম্পাদক মাহফুজ  আনাম স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন (মাহফুজ আনাম, “নীরবেই চলে গেল ‘গণতন্ত্র দিবস’”, ডেইলি স্টার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২০)।

এটি যতই বেদনাদায়ক বলে মনে হোক না কেন, একে এখন আর বিস্ময়কর মনে হয়না। কেননা বাংলাদেশে গণতন্ত্রের যে আকাঙ্ক্ষা ১৯৯০ সালে তৈরি হয়েছিলো গত তিন দশকে সেই আশাবাদ আকাঙ্ক্ষা এখন আর উপস্থিত নেই। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে সংবিধানের বদল ঘটেছে, নির্বাচন হয়েছে – কিন্ত গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলো গড়ে ওঠার প্রশ্ন পরে, যে অধিকারগুলো ছিলো সেগুলো টিকে থাকার সম্ভাবনারও অবসান হয়েছে। ১৯৯০-এর দশকে যা ছিলো প্রত্যাশা, তা ক্রমেই দূরে সরে গেছে। ১৯৯০-এর দশকে, বিশেষ করে ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার সূচনার পরে ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি শান্তিপূর্ণ পথ প্রতিষ্ঠার কারণে আশা ছিলো গণতন্ত্রের অন্যান্য উপাদান এবং প্রতিষ্ঠানের দিকে সম্ভবত মনোযোগ দেয়ার সুযোগ তৈরি হবে। মতপ্রকাশের অধিকারের আরও সম্প্রসারন ঘটবে, বিচার বিভাগ স্বাধীন হবে, জবাবদিহির কাঠামোগুলো গড়ে উঠবে। নির্বাচন জবাবদিহির একটি কাঠামো, একে বলা হয় উল্লম্ব কাঠামো। এর বাইরে আছে আনুভুমিক কাঠামো – এগুলো হচ্ছে সাংবিধানিকভাবে তৈরি কিন্ত স্বাধীন প্রতিষ্ঠান যারা ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহি করবে। সামাজিক জবাবদিহির ব্যবস্থা হচ্ছে সেই সব প্রতিষ্ঠান যেগুলো হচ্ছে সমাজের অন্যান্য অংশের প্রতিনিধিত্ব করে যারা রাজনৈতিক দল এবং রাষ্ট্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে উভয় পক্ষের জবাবদিহি দাবি করতে পারেন। কিন্ত জবাবদিহির এই ধরণের কাঠামোগুলো গড়ে ওঠেনি, সেগুলো গড়ে ওঠার আশাও ক্রমান্বয়ে তিরোহিত হয়েছে।

২০১৪ সালের এক-দলীয় নির্বাচনের পরে নাগরিকের অন্যান্য অধিকারের প্রশ্নকে পিছে ফেলে ভোটের অধিকারের মতো মৌলিক প্রশ্ন, যা গণতন্ত্রের একেবার অত্যাবশ্যকীয় বিষয়, সেই বিষয়েই নজর দিতে হচ্ছে। গণতন্ত্র এখন হয়ে উঠেছে ভোট দিতে পারা না পারার প্রশ্ন। একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, নির্বাচনই গণতন্ত্র নয়, কিন্ত সকলের অংশগ্রহণমূলক অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ছাড়া পৃথিবীর কোনও দেশে কখনোই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এই ধরণের পশ্চাৎযাত্রা শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচনকেই অকার্যকর এক আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত করেছে। অনেকের মনে থাকবে যে, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলেছিল যে সাংবিধানিক ধারবাহিকতা রক্ষার জন্যে এই নির্বাচন। কিন্ত তাতে করে সংবিধানের মর্মবস্তের সঙ্গেই এই নির্বাচন অসামঞ্জস্য পূর্ন হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, যেহেতু আর কোনও ধরণের জবাবদিহির কাঠামো বাস্তবে ছিলোনা সেহেতু ক্ষমতাসীনরা সব ধরণের জবাবদিহির কাঠামোর বাইরে চলে গেলেন। ফলে ইলেকটোরাল ডেমোক্রেসি বা নির্বাচনী গণতন্ত্রও থাকলো না।

ফলে ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিরোধী দল অংশগ্রহণ করা স্বত্বেও এটি আর ‘নির্বাচন’ হয়ে ওঠেনি। কিন্ত তার পরেও ২০১৮ সালের নির্বাচন ২০১৪ সালের নির্বাচন থেকে ভিন্ন। কেননা ২০১৮ সালের নির্বাচনের  মধ্যে যে কেবল নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়া হয়েছে তাই নয়, রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের বিভিন্ন অংশ (যেমন প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী), ক্ষমতাসীন দল, নির্বাচন কমিশন একাকার হয়ে গেছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আগের রাতে ভোট দেয়ার ব্যাপার কেবল ভোট জালিয়াতি বলে বিবেচনা করাই যথেষ্ট নয়। এটি হচ্ছে নতুন এক ধরণের রাষ্ট্রের ইঙ্গিত। এটি যদিও একটি রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় এনেছে এবং একটি কার্যত এক-দলীয় সংসদ তৈরি করেছে কিন্ত তার চেয়েও বড় হচ্ছে ২৯ ডিসেম্বর রাতে এমন এক ধরণের জোটের অভিষেক হয়েছে যা আগে কখনোই ছিলোনা। এই অভিষেক হঠাৎ করে হয়নি, ২০১৪ সালের পর থেকে তা ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে, এক ধরণের সমঝোতা বা বন্দোবস্ত তৈরি হয়েছে যা কোনও ধরণের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। এই বন্দোবস্ত টিকিয়ে রাখার স্বার্থ কেবল রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নয়, যারা এই বন্দোবস্তের অংশীদার তাঁদেরও। ২০১৮ সালের পরের এবং আগের বাংলাদেশের রাজনীতি ও শাসন ব্যবস্থার পার্থক্যটা সেখানেই। এই পার্থক্যের একটা বড় দিক হচ্ছে রাজনীতির অবসান, পুরো ব্যবস্থায় উপস্থিত একাদিক্রমে বল প্রয়োগের বৈধতা এবং আমলাতান্ত্রিকতা।          



— লেখক যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর। 

No comments:

Post a Comment