Search

Thursday, December 24, 2020

মানব অধিকার কোথায়

— সায়ন্থ সাখাওয়াৎ 




আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের দ্বারপ্রান্তে। নিশ্চয়ই অনেক অর্জনের কথা শুনব, উৎসব করব। অর্জন যে নেই এমনও নয়। এই পঞ্চাশ বছরে আমাদের গর্ব করার মতো অনেক অর্জন আছে। পাশাপাশি আছে অনেক বঞ্চনাও। আবার অর্জনের বিনিময়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিসর্জনের উদাহরণও আছে।

এই বিজয়ের মাসেই ১০ ডিসেম্বর পালিত হলো বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। আমরা সরকারের পক্ষ থেকে অধিকার সুরক্ষার ফিরিস্তি শুনলাম। অন্যদিকে সরকারবিরোধী পক্ষ, মানবাধিকার সংস্থা ও কর্মী এবং মানবাধিকার হরণের শিকার ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের কাছে শুনলাম অধিকার হরণের লোমহর্ষক ও নির্মম কাহিনী। যে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের অধিকারের সুরক্ষা দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ, সে রাষ্ট্রই কীভাবে অধিকার হরণ করে সে কথাই উঠে এলো ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের কণ্ঠে। আসলে রাষ্ট্র তো নিজে কিছু করতে পারে না। রাষ্ট্র পরিচালকরা রাষ্ট্রের পক্ষে তার দায়িত্ব পালনের অঙ্গীকার করেন। কিন্তু বাংলাদেশে রাষ্ট্র পরিচালকরা করছেন সে অঙ্গীকারের উল্টোটা। তারা নাগরিকদের অধিকার রক্ষা করছেন না বা পারছেন না তো বটেই, উপরন্তু নিজেরাই অধিকার হরণে প্রবৃত্ত হচ্ছেন অহরহ। এ কথাই উঠে এসেছে বাংলাদেশ বিষয়ে দেশি-বিদেশি মানবাধিকার রিপোর্টগুলোতে।

সে বিষয়ে যাওয়ার আগে জেনে নেওয়া যাক, একটি সভ্য রাষ্ট্রে মোটাদাগে মানুষের অধিকারগুলো কী। সংবিধান, মানবাধিকার সনদসহ বহু কিতাবে অনেক ধরনের অধিকারের কথা বলা আছে। সে জটিল হিসাবের খাতা না খুলেও সহজ ভাষায় যেটুকু বলা যায় তা হলো, একজন নাগরিকের জান-মাল-সম্ভ্রমের নিরাপত্তা দেবে রাষ্ট্র। স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি দেবে। তার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। রাষ্ট্রীয় আইন মেনে সভা-সমাবেশ-সংগঠন করার অধিকার থাকবে। ভোট প্রয়োগের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচনের অধিকারও থাকবে। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার পাবে। এবার যদি আমরা একটু মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করি যে, এই অধিকারগুলো আমরা পাচ্ছি কি না এবং রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা আমাদের এই অধিকার হরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত কি না, তাহলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে সরকার ঠিক পথে আছে কি না। মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের এক ভার্চুয়াল সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনকে অত্যন্ত ঘৃণ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে সরকার। মানবাধিকারের প্রতি সরকারের প্রতিশ্রুতি সব সময় পালনের চেষ্টা করে সরকার এবং চলমান করোনা পরিস্থিতিতেও এ বিষয়ে কোনো আপস হবে না। করোনা পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বে অনেকগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। এসব অপরাধের জবাবদিহি করতে হবে, যাতে সেগুলোর পুনরাবৃত্তি না ঘটে।

আইনমন্ত্রীর এবারের এ কথার মতোই রিপোর্ট বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সময় জমা দিয়েছে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায়। সেখানেও বরাবরই সরকার দাবি করেছে, বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে বাংলাদেশ মানবাধিকারের ক্ষেত্রে চমৎকার অগ্রগতি লাভ করেছে। কিন্তু দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, বিরোধীদলীয় সদস্যদের গ্রেপ্তার, মতপ্রকাশের অধিকার সংকোচন, ৫৭ ধারা ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, নারী ও শিশুর নিরাপত্তাহীনতা এবং বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যের যেসব পরিসংখ্যান ও তথ্য তুলে ধরা হয়েছে, তা সরকারের দাবিকে অসংগতিপূর্ণ প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট।

চলতি বছরের শেষের দিকে বাংলাদেশের র‌্যাব কর্মকর্তাদের আমেরিকায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রেও বেশ কয়েকজন সিনেটর যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে চিঠি দিয়েছেন। সিনেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির সদস্য ডেমোক্র্যাট দলের বব মেনেনদেজ ও রিপাবলিকান সিনেটর টড ইয়াংয়ের সঙ্গে সিনেটর বেন কারডিন, কোরি গার্ডনার, জিন শেহিন, মার্কো রুবিও, ক্রিস মারফি, ক্রিস কুনস, জেফ মার্কলে ও কোরি বুকার ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এবং অর্থমন্ত্রী স্টিভেন মনুশেনকে লেখা মার্কিন সিনেটরদের ওই চিঠিতে বলা হয়, ২০১৫ সালের পর থেকে চারশোর বেশি ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’র অভিযোগ রয়েছে বাংলাদেশের এই বাহিনীর বিরুদ্ধে।

ওই অভিযোগে শীর্ষস্থানীয় র‌্যাব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গ্লোবাল ম্যাগনিৎস্কি হিউম্যান রাইটস অ্যাকাউন্টিবিলিটি অ্যাক্ট এবং ফারদার কনসোলিডেটেড অ্যাপ্রোপ্রিয়েশনস অ্যাক্ট-২০২০-এর ৭০৩১(সি) ধারায় নিষেধাজ্ঞা আরোপের অনুরোধ জানানো হয়েছে সিনেটরদের চিঠিতে। যুক্তরাষ্ট্রের আইনের ওই দুটি ধারায় সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা এবং যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সুযোগ রয়েছে।

চিঠিতে তারা লিখেছেন, ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ছাড়াও র‌্যাবের হাতে গুম এবং ব্যাপক মাত্রায় নির্যাতনের ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করেছে জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক ও মানবাধিকার গ্রুপগুলো।

এর আগে চলতি বছরের ৩০ আগস্ট গুমের শিকার ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক দিবসকে সামনে রেখে ১২টি মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশের গুম বিষয়ে এক যৌথ বিবৃতি দিয়েছিল। তাতে বাংলাদেশের দুটি সংগঠন ‘অধিকার’ ও ‘মায়ের ডাক’ ছাড়াও অ্যাডভোকেট ফর হিউম্যান রাইটস, অ্যান্টি-ডেথ পেনাল্টি এশিয়া নেটওয়ার্ক, এশিয়ান ফেডারেশন অ্যাগেইনস্ট ইনভলান্টারি ডিসএপেয়ারেন্সেস (এএফএডি), এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন (এএইচআরসি), এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশন (এনফ্রেল), এশিয়ান ফোরাম ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআর ডব্লিউ), রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটস, ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন অ্যাগেইনস্ট টর্চারের মতো সংগঠনও। যৌথ বিবৃতিতে তারা বলেছে, বর্তমান সরকারের ১ জানুয়ারি ২০০৯ থেকে ৩১ জুলাই ২০২০ পর্যন্ত বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো অন্তত ৫৭২ জন মানুষকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে গুম করেছে। এর মধ্যে কিছুসংখ্যককে ছেড়ে দিয়েছে বা গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, কিছু মানুষকে তথাকথিত ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়েছে। আর বড় একটা অংশ এখনো নিখোঁজ! যদিও বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেওয়া তথ্য মতে এ সময় গুমের শিকার মানুষের সংখ্যা ৬০৩ জন।

যৌথ বিবৃতিতে গুরুতর যে তথ্যটি উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো, গুমের বেশির ভাগ ঘটনা ঘটেছে ২০১৪ এবং ২০১৮-এর নির্বাচন ঘিরে। সবচেয়ে বেশি গুম করা হয়েছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে। আর ২০২৮ সালের নির্বাচনের সময় গুম করা হয়েছে অন্তত ৯৮ জনকে। আরেকটি বিষয়ও লক্ষণীয়। তা হলো, দেশের যেসব এলাকায় সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরালো ছিল, সেখানে গুমের সংখ্যাও বেশি। এ পর্যবেক্ষণ থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশে গুমের ঘটনাগুলো রাজনৈতিক। (দৈনিক দেশ রূপান্তর, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২০)

এই রিপোর্টগুলোর সঙ্গে মিলে যায় বাংলাদেশের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের রিপোর্ট, মানবাধিকার কর্মীদের বক্তব্য ও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য। গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, হামলা, মামলা, হয়রানি, মতপ্রকাশে বাধা, রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে বাধা, নারী ও শিশু নির্যাতন, ভোটের অধিকার হরণ কী করা হয়নি বাংলাদেশে? শুধু করা হচ্ছে, তা-ই নয়। দিনে দিনে বাড়ছে উদ্বেগজনকভাবে। একদিকে সরকার তা প্রতিরোধের চেষ্টা তো করছেই না, অন্যদিকে ক্ষেত্রবিশেষে এসব মানবাধিকার হরণের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে সরকার ও তাদের ছত্রছায়ায় থাকা ব্যক্তিরা।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে আমরা যদি সরকারের একটি কার্যকর উদ্যোগ দেখতে পেতাম যে তারা আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো জঘন্য কাজে প্রবৃত্ত হবে না এবং মানুষের অধিকার রক্ষায় যথাযথ ভূমিকা রাখবে সেটাই হতো বড় প্রাপ্তি। একটি দেশে যদি ন্যূনতম মানবাধিকার না থাকে, সে রাষ্ট্র কোনোভাবেই একটি সভ্য রাষ্ট্র বলে দাবি করতে পারে না। সরকার যত উন্নয়নের দাবিই করুক না কেন, মানবাধিকার রক্ষিত না হলে কোনো উন্নয়নই কাজে আসবে না। যে মানুষের জন্য উন্নয়ন, আগে সেই মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা দিতে হবে। মানুষের জন্যই রাষ্ট্র। মানুষের জন্যই রাষ্ট্রের পরিচালক। তাই আগে রাষ্ট্রকে সেই মানুষের জন্য উপযোগী একটি মানবিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে। মানুষের অধিকার তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে। রাষ্ট্রটিকে শুধু ক্ষমতাবানদের নয়, সবার করে তুলতে হবে। তবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পরিচালকরা কখনোই তার নাগরিকের পূর্ণ অধিকার দেয়নি। তাই প্রয়োজনে রাষ্ট্রের নাগরিকদের অধিকার আদায় করে নিতে হবে তাদেরই।


— লেখক চিকিৎসক ও কলামিস্ট। লেখকের ইমেইল একাউন্ট sayantha15@gmail.com । লেখাটি প্রথম দৈনিক দেশরূপান্তরে প্রকাশিত হয়েছে, লিঙ্ক — https://bit.ly/34Gaugg 

No comments:

Post a Comment